চিত্রা বসে আছে সাজেদার সামনে। চিত্রার মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলা কিছুটা শান্ত হয়েছেন। তবে এখন তিনি ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। কথারও আগা মাথা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে না। অর্থহীন কথা শুনতে চিত্রার আপত্তি নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিলির অর্থহীন কথা শুনে সে অভ্যস্ত। সমস্যা হল ভদ্রমহিলা তাকে বৌমা বলে সম্বোধন করছেন। চিত্রার উচিত তাকে মনে করিয়ে দেয়া যে তিনি ভুল করছেন। চিত্রার সঙ্গে এই প্রথম তার দেখা হয়েছে, এবং চিত্রা তাঁর বৌমা না। বৌমা হবার কোনো বাসনাও তার নেই।

বৌমা শোন, আমার ছেলে ইচ্ছা করে আমাকে অপমান করার জন্যে মদ গিলছে। সে কি করবে তোমাকে বলি। গলা পর্যন্ত মদ গিলবে তারপর টলতে টলতে কামরায় ঢুকবে। তোমার সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করবে। তখনতো আমি তাকে ছাড়ব না। মায়ের সামনে যে তার স্ত্রীকে অপমান করে তার মতো কুলাঙ্গার এই দুনিয়ায় জন্মায় নি। আমি সেই কুলাঙ্গারকে সহ্য করব না। আমি খাঁ বাড়ির মেয়ে। আমার দাদা আশরাফ আলীর নাম নিশ্চয় শুনেছ? আমি আশরাফ আলী খাঁ সাহেবের নাতনী। আশরাফ আলী খাঁ সাহেব প্রকাশ্য বাজারে থানার ডিউটি অফিসারকে কি করেছিলেন তা এখনো ইতিহাস। পুলিশের এস পি খবর পেয়ে জেলা হেড কোয়ার্টার থেকে দাঙ্গা পুলিশ নিয়ে এলেন। আমার দাদাজানের লোকজনও লাঠি-বৈঠা নিয়ে তৈরি হল। দাদাজান তার দুনলা বন্দুক বের করলেন। থমথমে অবস্থা। দাঙ্গা বেঁধে যায় এমন অবস্থা। শেষ পর্যন্ত এস পি সাহেবের বুদ্ধিতে সমস্যার সমাধান হল। এস পি সাহেব শাদা পোষাকে এসে দাদাজানের বাড়িতে ঢুকে বললেন, স্যার, আমার চাচা আপনার ছাত্র ছিলেন। দাদাজান সঙ্গে সঙ্গে এস পি সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বাবা কেমন আছ? এস পি সাহেব বললেন, ভালো থাকব কি ভাবে? শুনেছি আমার এক অফিসার আপনার সঙ্গে বেয়াদবী করেছে। আমি এস পি। আমার অফিসারের বেয়াদবী আমি সহ্য করব না।

দাদাজানের রাগ সঙ্গে সঙ্গে পানি। তিনি বললেন, এটা কেমন কথা। অল্প বয়সের উত্তেজনায় একটা বেয়াদবী করেছে এটা কোনো ব্যাপার না। তুমি তাকে খবর দিয়ে আন হাত মিলাই।

এখন বুঝেছ আমি কোন বংশের?

চিত্রা বলল, জি বুঝেছি।

সাজেদা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি যাও আমার ছেলেকে ডেকে আন। আমি তাকে ক্ষমা করেছি। আমি যেমন রাগতে পারি ক্ষমাও করতে পারি। রাত দশটা বাজে। তার নিশ্চয়ই ক্ষিধে লেগেছে। নটা বাজতেই সে খেয়ে নেয়। ছোট বেলার অভ্যাস।

চিত্রা উঠে দাঁড়াল। মহিলার সঙ্গে কামরা শেয়ার করার ব্যাপারটা তার এখন আর ভাল লাগছে না। তারচে অনেক ভালবুডোর অংকের গল্প শুনে রাত কাটানো।

আশহাব কামরা থেকে বের হয়েছে তবে ঠিক মতো পা ফেলতে পারছে। তাকে এগুতে হচ্ছে দেয়াল ধরে। চিত্রার সামনে সে খানিকটা ব্ৰিতও বোধ করছে। চিত্রা বলল, আপনাদের মাতা-পুত্রের সমস্যায় হঠাৎ জড়িয়ে পড়েছি। ভাল লাগছে না।

আশহাব বলল, ভাল লাগার কথা না। সমস্যায় আপনি ইচ্ছে করে জড়িয়েছেন। মার সঙ্গে রুম শেয়ার করতে চেয়েছেন। মা কি তার দাদাজানের গল্প শুরু করেছেন?

হ্যাঁ করেছেন। উনার দাদাজানের গল্প সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে উনি মাঝে মাঝেই আমাকে বৌমা ডাকছেন। আপনি নিশ্চয়ই বিয়ে করেছিলেন। আপনার মায়ের একজন আদরের বৌমা ছিল। ছিল না?

জি না।

চিত্রা বলল, আগে বৌমা ডাকার অভ্যাস না থাকলে হঠাৎ করে কারো মুখ দিয়ে বৌমা বের হবে না।

আশহাব বলল, মার মুখ দিয়ে যে কোনো কিছু বের হবে। আমার মাকে আপনি চেনেন না। আমি চিনি। তিনি মানসিক ভাবে সামান্য অসুস্থ। মার হয়ে আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।

আশহাব হাত জোড় করল।

চিত্রা বলল, ক্ষমা চাইতে হবে না।

আশহাব বলল, মায়ের অসুখটা প্যারানয়ার অন্য এক ফরম। প্যারানয়ারের রোগী মনে করে সবাই ষড়যন্ত্র করছে তাকে মেরে ফেলার জন্যে। আর মা মনে করেন অপরিচিত যেই তার সঙ্গে কথা বলছে সেই তার পরম আত্মীয়। আপনি এখন মার কাছে আমার চেয়ে একশ গুন বেশি প্রিয়।

চিকিৎসা করাচ্ছেন না?

করাচ্ছি।

আপনি যদি কিছু মনে না করেন—আমি রাতে আপনার মার সঙ্গে থাকব না।

আশহাব বলল, মার সমস্যা একটাই—কথা বলা। এ ছাড়া তার আর কোনো সমস্যা নেই।

বুঝতে পারছি, আমার ভাল লাগছে না। আপনি আপনার মার কাছে যান। তিনি অপেক্ষা করছেন। আপনারা মাতা-পুত্র খাওয়া দাওয়া করুন। এর মধ্যে আমাকে ডাকবেন না প্লিজ। আমি বুফে কারে খাব। অর্ডার দিয়ে রেখেছি। আপনারা মাতা-পুত্রের মিলন দৃশ্য দেখার আগ্রহ যেমন আমার নেই, বিচ্ছেদ দেখার আগ্রহও আমার নেই।

মা আপনাকে ছাড়া খাবে না।

ব্যবস্থা করুন যেন খায়। প্লিজ।

আশহাবকে করিডোরে দাঁড় করিয়ে চিত্রা এগিয়ে গেল। তার সত্যিই অসহ্য লাগছে। মোবাইল টেলিফোনে পিং পিং শব্দ হচ্ছে। নিশ্চয়ই লিলি।

এই চিত্রা! Hello!

Hello!

ফান হচ্ছে?

খুব ফান হচ্ছে। ফানে ড়ুবে আছি। নাক পর্যন্ত ফান।

বাবারে একটু ধৈর্য্য ধর। ময়মনসিংহ জংশনে গাড়ি থামবে তুই চলে যাবি স্যালুনে। রাণীর মত থাকবি।

একবারতো বলেছিস। বার বার একই কথা শুনতে ভাল লাগে না।

এতো রেগে আছিস কি জন্যে?

এক মহিলা আমাকে বৌমা ডাকছেন।

সে কি! কেন? তোর চেহারা কি মহিলার অতি আদরের বৌমার মতো যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। বাংলা সিনেমা?

চুপ কর তো। উনি মেন্টাল পেশেন্ট!

ওহ মাই গড।

রাতে ঐ মহিলার রুম আমার শেয়ার করার কথা।

ভুলেও ঐ কর্ম করবি না। শত হস্ত দূরেত থাকিথং। অর্থাৎ শত হস্ত দূরে থাকবি। নয়ত দেখা যাবে রাতে সে তোকে গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে।

উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ।

ম্যাথমেটিশিয়ানের সঙ্গে কথা হয়েছে? এখনো না।

বুড়োরা তরুণী মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে খুব পছন্দ করে। মজার মজার গল্প বলে এরা তরুণীদের ভুলাতে চায়। তুই এককাজ কর। বুড়োর সঙ্গে গল্প করতে করতে চলে যা। তোর জায়গায় আমি থাকলে বুড়োর সঙ্গে এমনই গল্প জমাতাম যে বুড়ো ভাবতো—কিয়া মজা। খাব ব্যাঙ ভাজা। মেয়ে তো আমার প্রেমে ড়ুব সাঁতার দিচ্ছে।

লিলি আমার ধারণা তুই ভাবছিস যে খুব মজার কথা বলছিস। তোর কথাবার্তায় হিউমার ঝড়ে পড়ছে। ব্যাপারটা সে রকম না। তুই একই ভঙ্গিতে সবার সঙ্গে কথা বলিস। তোর কথাবার্তায় সামান্যতম ভেরিয়েসন নেই।

তোর কথায় ভয়ংকর দুঃখ পেলাম। দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছা করছে। এই দেখ মরে যাচ্ছি ওয়ান টু থ্রী। বলেই লিলি মোবাইল অফ করল। চিত্রা বলল, থ্যাংক গড।

 

মন্ত্রী সাহেবের সেলুন কারে আরো একজন বলল, থ্যাংক গড়। সেই একজন মন্ত্রী সাহেবের আদরের শ্যালিকা যমুনা। তার থ্যাংক গড বলার কারণ গান বাজনা শুরু হতে যাচ্ছে। ব্যান্ডের লম্বা চুলের ছেলে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে তৈরি করছে। সে অস্বাভাবিক চিকন গলায় বলল, শুরু করব Fusion Tagore দিয়ে।

ব্যান্ডের সুরে রবীন্দ্র সংগীত নামে নতুন এক জিনিস শুরু হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ইংরেজি এবং হিন্দি কথাবার্তাও আছে। মহা Fusion যাকে বলে। অল্প সময়ে তরুণ তরুণীদের হৃদয় এই সঙ্গীত হরণ করে নিয়েছে।

ব্যান্ডের পরিচালক যমুনার দিকে তাকিয়ে বলল, আপা এই গানটায় সবাইকে অংশ নিতে হবে।

যমুনা বলল, কি ভাবে অংশ নিব? আমি তো গান জানি না।

গান জানতে হবে না গানের মাঝখানে যতবার আমি হাততালি দেব ততবার আপনারা সবাই বলবেন—ঠেকাই মাথা। হাতের ইশারা না করা। পর্যন্ত ঠেকাই মাথা বলতেই থাকবেন। সুর নিয়ে চিন্তা করবেন না। যে ভাবে বলতে চান——বলবেন।

যমুনা আনন্দিত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, কি মজা। এই মজা না?

যমুনার স্বামী বলল, মজা বলেইতো মনে হচ্ছে।

যমুনা তার বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, দুলাভাই জয়েন করবে না?

সুরমা বললেন, ওর শরীরটা খারাপ। ঐ যে এসিডিটি প্রবলেম।

যমুনা বলল, কয়েকবার ঠেকাই মাথা করলে এসিডিটি ঠিক হয়ে যেত।

সুরমা বললেন, তোরা শুরু কর আমি ওকে নিয়ে আসব।

সংগীত শুরু হয়েছে—

ও আমার দেশের মাটি
তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা
ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা।
My head down on your feet
Mother, mother, mother, mother.
ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা।

 

সংগীত জমে গেছে। ঠেকাই মাথা সুপার হিট হয়েছে। যমুনা আনন্দে স্বামীর গায়ে বার বার গড়িয়ে পড়ছে। আনন্দের তুঙ্গ মুহূর্তে সেলুন কারের বাতি নিভে গেল। বগী ড়ুবে গেল অন্ধকারে। সুরমা পা টিপে টিপে স্বামীর কাছে গিয়ে বললো, এই বাতি নিভে গেছে তো।

খায়ের সাহেব বললেন, দেখতে পাচ্ছি। আমি অন্ধ না।

সুরমা বললেন, ট্রেনের লোকজন কেউ তো আসছে না। মোমবাতি, চার্জার কিছু দেবে না?

না দিলে আমি কি করব? আমার হাতে কি ক্ষমতা আছে?

সুরমা বললেন, এরা কি জেনে গেছে?

জানতেও পারে।

সুরমা বললেন, আমি কিন্তু যমুনাকে কিছু বলি নি। ওদের ট্রিপটা নষ্ট করে লাভ কি?

এক সময় যেহেতু জানবে এখনি বলে দাও।

যমুনা এগিয়ে আসছে। তার হাতে মোবাইল। সে মোবাইল অন করে তার আলোয় সাবধানে এগুচ্ছে।

দুলাভাই?

বল শুনছি।

ট্রেনের প্রতিটি কামরায় লাইট আছে। শুধু আমাদেরটায় নেই। আমরা অন্ধকারে বসে আছি।

তাই না-কি?

হ্যাঁ। আপনি খোঁজ নিয়ে আসুন।

খোঁজ নিতে হবে না। তুমি বলছ এই যথেষ্ট। মনে হয় ইলেকট্রিকেল কানেকশনে কোনো ঝামেলা হয়েছে।

কানেকশনে ঝামেলা হলে রেলের লোকজন ছোটাছুটি করবে না? এরা এসে সমস্যা কি জানাবে না? দুলাভাই আপনি এক্ষুনি রেল মন্ত্রীকে টেলিফোন করুন। এদের সবাই যেন সাসপেন্ড হয়। মন্ত্রীর সেলুন কার যাচ্ছে। সেখানে ইলেকট্রিসিটি নেই। ওদের কোনো গরজও নেই। এরা ভেবেছে কি?

খায়ের সাহেব বললেন, ব্যবস্থা হবে। তোমরা গান বাজনা করতে থাক।

যমুনা বলল, অন্ধকারে কি গান বাজনা?

খায়ের সাহেব বললেন, অন্ধকারের গানে অন্য মজা আছে। তোমরা শুরু কর আমি দেখছি কি করা যায়।

গান আবার শুরু হয়েছে। খায়ের সাহেব সিগারেট ধরিয়েছেন। সুরমা আছেন স্বামীর পাশে। অন্য দিন সিগারেট ধরানো নিয়ে নানান কথাবার্তা বলতেন। আজ চুপচাপ। খায়ের সাহেব বললেন, কিছু বলবে?

সুরমা বললেন, আমার মন কু ডাক ডাকছে।

খায়ের সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, যা হবার তা তো হয়ে গেছে। আর কি কু ডাক?

সুরমা বললেন, সেলুন কারে বাতি নিভিয়ে দেয়াটা ইচ্ছাকৃত নয় তো? সব কামরায় বাতি জ্বলছে— সেলুন কারে বাতি নেই। এতক্ষণ হয়ে গেল একজন কেউ খোঁজ নিতে আসছে না।

খায়ের সাহেব কিছু বললেন না। সুরমা বললেন, কান ধরে উঠবোস করিয়েছি—এটার জন্যে কিছু না তো? সবাই মিলে ঠিক করেছে আমাদের শিক্ষা দেবে।

হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষা দিতে পছন্দ করে।

আমার ভয় লাগছে।

ভয় লাগাই স্বাভাবিক। এই দেশের অনেক মন্ত্রী, মন্ত্রিত্ব চলে যাবার পর পাবলিকের হাতে মার খেয়েছে।

মন্ত্রীত্ব যাবার পরে না, পার্টি ক্ষমতা থেকে যাবার পর কেউ কেউ হয়তোবা ইনসালটেড হয়েছে। তোমার পার্টিতো এখনো ক্ষমতায় আছে।

ক্ষমতায় থাকলেও আমি পার্টির গুড বুকে নেই। সবাই জানবে আমাকে লাথি দিলে এখন পার্টি কিছু বলবে না। বরং খুশি হবে। আমি লাথি খাচ্ছি এই দৃশ্য দেখলে অনেক নেতা-কর্মীরাই এখন খুশি হবে।

একজনকে কি পাঠাব রেলের যে কাউকে ডেকে নিয়ে আসবে। তুমি কথা বলবে। কথা বলে ঠিক করবে। কথা বলে মানুষকে ভুলাতে তো তুমি ওস্তাদ।

কাকে পাঠাবে?

বদরুলটা কে?

ঐ যে ভিডিও করে ছেলেটা।

পাঠাও। তবে আমার ধারণা ওকে মেরে তক্তা বানাবে।

সুরমা ভীত গলায় বললেন, ওকে মেরে তক্তা বানাবে কেন?

নানান কায়দায় কানে ধরে উঠবোসের ভিডিও করেছে ওকে ছাড়বে কেন? আমি হলেও তো মারতাম।

মারতে?

অবশ্যই।

তুমি আর কি করতে?

চেষ্টা করতাম এই অপমান যে মহিলা আমাকে করেছেন সবার সামনে তার গালে একটা থাপ্পড় বসাতে।

তাহলে কি বদরুলকে পাঠাব না?

পাঠাও-টেস্ট কেস হিসাবে পাঠাও। মার খেয়ে ফেরে কি-না দেখি।

সুরমা ভীত গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে রিভলবার আছে না?

আছে। গুলি মাত্র ছয়টা। সিন্ধুতে বিন্দু।

তুমিতো আর গুলি করতে যাচ্ছনা। অস্ত্র হাতে থাকাটাই ভরসা।

খায়ের সাহেব বললেন, মাঝে মাঝে অস্ত্র থাকলে সমস্যা। নিজের অস্ত্রে নিজে বধ। টান দিয়ে রিভলবার নিয়ে সেই রিভলবারে গুলি।

সুরমা বললেন, আজে বাজে কথা বলছ কেন?

ভাল ভাল কথা মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।

 

খায়ের সাহেব মোবাইল টেলিফোন বের করে বোতাম টিপতে শুরু করলেন। সুরমা বললেন, কাকে টেলিফোন কর?

খায়ের সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, কাকে তোমাকে বলতে হবে কেন? কাকে টেলিফোন করছি জানার তোমার প্রয়োজনটা কি?

জানলে অসুবিধা কি?

অসুবিধা আছে। সব ইনফরমেশন সবার জন্যে না।

আমি তোমার স্ত্রী।

খায়ের সাহেব বললেন, তুমি আমার সামনে থেকে যাও। তুমি ক্রমাগত আমাকে বিরক্ত করে যাচ্ছ। আমার চল্লিশ গজের ভিতর যেন তোমাকে না দেখি।

সুরমা হতভম্ব গলায় বললেন, যদি না যাই তাহলে কি করবে? মারবে?

খায়ের সাহেব বললেন, হ্যাঁ মারব। তোমার বোন আর বোনের স্বামী ঐ বান্দরটার সামনে কষে চড় মারব। অন্ধকার হলেও ওরা দেখতে পাবে।

সুরমা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বান্দর বলছ কাকে?

খায়ের সাহেব বিকট শব্দে ধমক দিলেন, Get lost you pig.

গান থেমে গেল। সবাই সুরমার দিকে তাকিয়ে আছে। যমুনা ভীত গলায় বলল, আপা কি হয়েছে?

সুরমা স্বাভাবিক গলায় বললেন, তোর দুলাভাই টেলিফোনে কাকে যেন ধমকাচ্ছে। ভিডিওর বদরুল কোথায়? আমার কাছে আসতে বল তো। সুরমা এগিয়ে গেলেন গানের দলের কাছে। তিনি এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছেন। নিজেকে দ্রুত সামলাতে চেষ্টা করছেন। এখনো সামলাতে পারেন নি। তবে পারবেন।

আবুল খায়ের খান টেলিফোন করেছেন পূর্ত মন্ত্রীকে। রিং হচ্ছে। কেউ টেলিফোন ধরছে না। রিং হতে হতে টেলিফোন থেমে গেল। একটা সময় ছিল দ্বিতীয় রিং শেষ হবার আগেই পূর্তমন্ত্রী বলতেন, গ্রেট খায়ের ভাই! কি ব্যাপার! বান্দা হাজির।

এখন সময় ভিন্ন। খায়ের ভাইয়ের গ্রেটনেস বলে কিছু নেই। তার টেলিফোন ধরতে হবে না। আবুল খায়ের আবার টেলিফোন করলেন। তার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। তিনি ঠিক করেছেন টেলিফোন করেই যাবেন। ব্যাটা যতক্ষণ না ধরবে ততক্ষণই টেলিফোন বাজতে থাকবে। শালার বাচ্চা শালা!

 

ভিডিও ম্যান বদরুল ফুরফুরে মেজাজে এগুচ্ছে। তার হাতে ভিডিও ক্যামেরা না থাকায় হাত খালি খালি লাগছে। শরীর ভার শূন্য। মনে হচ্ছে অফিস শেষ হয়েছে এখন তার ছুটি। ভিডিও ক্যামেরা হাতে থাকা মানেই অফিস। একেকজনের অফিস একেক রকম। কবির অফিস তার কাঁধের ঝোলায়। ভিডিওম্যানের অফিস ভিডিও ক্যামেরায়। লেখকের অফিস তাঁর মাথায়।

সেলুন কার পার হয়েই সে ঢুকল ডায়নামো কারে। বিকট সব যন্ত্রপাতি। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ইলেকট্রিসিটি, বিভিন্ন কামরায় চলে যাচ্ছে। শুধু তাদের কামরাতেই আলো নেই। কিছুদূর এগুতেই রেলের কিছু লোকজন দেখা গেল। গোল হয়ে বসে চা খাচ্ছে। ক্রিমিনালটাকে দেখা যাচ্ছে না। সবাই অপরিচিত। বদরুল বলল, হ্যালো আপনারা রেলের লোক?

সবাই এক সঙ্গে তাকালো। কেউ জবাব দিল না।

বদরুল কঠিন গলায় বলল, মন্ত্রী মহোদয় আমাকে পাঠিয়েছেন। উনি জানতে চেয়েছেন সেলুন কার অন্ধকার কেন? অলরেডি রেলের বড় বড় অফিসারের কাছে টেলিফোন চলে গেছে।

দলের একজন (গোল মুখ, গোফ আছে। বডি বিল্ডারের মতো চেহারা) চায়ের কাপে শব্দ করে চুমুক দিয়ে বলল, আপনে কে?

বদরুল বলল, আমি কে তা দিয়ে আপনার প্রয়োজন কি? ধরে নিন আমি মন্ত্রী মহোদয়ের পি এস।

আপনার নাম বলেন।

আপনাকে নাম বলতে যাব কেন?

বদরুলের কথা শুনে সেই লোক চায়ের কাপ মেঝেতে রেখে শান্ত ভঙ্গিতে উঠে এল। বদরুল কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রচণ্ড শব্দে চড় বসালো। বদরুল ছিটকে পেছনের বেঞ্চে পড়ে গেল। বসে থাকা সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। বডি বিল্ডার টাইপ লোকটা বলল, এখন প্রশ্ন করলে জবাব দিবে। তেড়িবেড়ি করবে না।

তোর নাম কি?

বদরুলের কপাল ফেটে গেছে। টপটপ করে রক্ত পড়ছে। সে কপালের রক্ত মুছে হতভম্ব গলায় বলল, এইসব কি? আপনারা সবাই আন্ডার এ্যারেস্ট। এক্ষুনি রেল পুলিশ আসবে। সবাইকে ডিটেনশনে যেতে হবে।

এই হারামীর পুত যা জিজ্ঞেস করব জবাব দিবি তোর নাম কি?

বদরুল।

তুই করস কি?

আমি ভিডিওম্যান। ভিডিও করি।

সবুরের ভিডিও তুই করেছিস? এইবার তোর ভিডিও করা হবে। এই তোমরা হারামীর বাচ্চাটার জামা কাপড় খুলে ফেলে একে নেংটা করে ফেল। নেংটা ভিডিও হবে।

বদরুল চেঁচিয়ে বলল, কি বলেন।

এরে পুরো নেংটা করে ফিরত পাঠাও। তারা বুঝুক ঘটনা কি।

বদরুল বলল, আমি মন্ত্রী মহোদয়ের লোক।

রাখ ব্যাটা মন্ত্রী মহোদয়। তোর মন্ত্রীর পাছায় এখন বাঁশ। সে আর মন্ত্রী নাই। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। তোকে নেংটা অবস্থায় ছাড়বো। তুই তোর মন্ত্রীকে বলবি সবুরকে যে কানে ধরে উঠবোস করিয়েছে তাকেও কানে ধরে উঠবোস করতে হবে। তোকে নেংটো অবস্থায় দেখলে তারা বুঝবে খবর ভালো না। আমরা মানুষ খারাপ।

বদরুল বুঝতেই পারেনি যে তাকে সত্যি সত্যি নগ্ন করে ফেলা হবে। সে হা হয়ে গেল।

দাঁড়িয়ে থাকবি না যা। মন্ত্রী মহোদয় তোকে যেন ঠিকমতো দেখতে পায় সে জন্যে কিছুক্ষণের জন্যে সেলুন কারে কারেন্ট দেয়া হবে। এই তুই রওনা হ। নেংটো, হাত দিয়ে ঢাকাঢাকি করার চেষ্টা করবি না। চেষ্টা করলে হাত কেটে ফেলে দিব।

বদরুল কাতর গলায় বলল, আমি এইভাবে যেতে পারব না। ভাই আমি আপনাদের পায়ে ধরি।

পায়ে ধরে লাভ নেই। তুই এখন রওনা দে। এখন রওনা না দিলে তোকে কি করা হবে সেটা তোর কানে কানে বলব, তুই সঙ্গে সঙ্গে রওনা হবি। দৌড়ায়া যাবি। হা হা হা।

সবাই হাসছে। বদরুল আতংকে জমে গেল। ব্যাপারটা সত্যি ঘটেছে নাকি এটা কোনো ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তা সে বুঝতে পারছে না। বডি বিল্ডার উঁচু গলায় বলল, সেলুন কারে কারেন্ট দাও।

একজন কি একটা হাতলে চাপ দিল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ