সেলুন কারে বাতি জ্বলে উঠেছে। এক সঙ্গে সবাই হৈ হৈ করে উঠল। যমুনা হাত তালি দিচ্ছে। যমুনার দেখাদেখি অন্যরাও হাত তালি দিচ্ছে। ব্যান্ডের একজন অতি দ্রুত ড্রামে কয়েকটা বাড়ি দিল। বিপুল হাত তালির ভেতর বদরুল ঢুকল। সেলুন কারে হঠাৎ যেন বজ্রপাত হল।

.

আশহাব মা’র পাশে বসে আছে। সাজেদা শান্ত। দেখে বুঝার উপায় নেই যে কিছুক্ষণ আগেও কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। তিনি হট পট খুলে খাবার বের করেছেন। পেপার প্লেট, নেপকিন বের হয়েছে। আচারের কৌটা, কাঁচামরিচ। আয়োজনে কোনো খুঁত নেই। একটা কাসুন্দির শিশিও দেখা যাচ্ছে।

সাজেদা বললেন, বৌমা আবার কোথায় গেল। ঘরের বউ হুট হাট করে বেড়াতে বের হওয়া আমার পছন্দ নয়। বৌমাকে ডেকে আন।

আশহাব বলল, মা তুমি বৌমা পেলে কোথায়? চিত্রা এই ট্রেনের একজন যাত্রী। কিছুক্ষণ আগে তার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে।

আমার সঙ্গে ফাজলামী করবি না। তোকে যা বলেছি কর। বৌমাকে ডেকে নিয়ে আয়।

মা তুমি কি সত্যি ভাবছ সে তোমার বৌমা? না-কি ইচ্ছা করে একটা নাটক করছ?

সাজেদা বললেন, তোর এতবড় সাহস? তুই এইভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছিস? আমি আমার বৌমাকে চিনব না।

মা তোমাকে দু’টা ট্যাবলেট দিচ্ছি। ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়। তোমার ঘুম দরকার।

আমার সঙ্গে ডাক্তারী ফলাচ্ছিস? ফেল করা ডাক্তার।

ফেল করা ডাক্তার মানে?

নকল করে ধরা পড়লি মনে নাই। প্রিন্সিপ্যাল তোকে বের করে দিল।

মা তুমি এসব কি বলছ?

তুই আমাকে দিয়ে প্রিন্সিপ্যালের পায়ে ধরালি। একজন মানুষের সামনে কতটা নিচু তুই আমাকে করলি। বদমাশ ছেলে।

মা তোমার অবস্থাতো খুবই কাহিল। কি গল্প ফাঁদছ। এরকম গল্প তোমার মাথায় আসছে কেন? আমি দু’টা সাবজেক্টে হাইয়েস্ট পাওয়া। গোল্ড মেডেল তোমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলাম। মনে নাই?

মনে আছে।

তাহলে এইসব কি বলছ?

আর বলব না।

মাথা কি ঠিক হয়েছে?

হুঁ। হা কর মুখে ভাত দিয়ে দেই।

আশহাব হা করল। সাজেদা ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন, আজ তুই আমার হাতে খাবি। তোর হাত নোংরা করার দরকার নেই।

আশহাব কিছু বলল না। সাজেদা বললেন, তুই মাঝে মাঝে এমন গাধার মতো কাজ করিস।

গাধার মতো কাজ কি করলাম?

বৌমাকে নিয়ে প্রথম যাচ্ছিস–তোরা দু’জন যাবি এক কামরায় আমি যাব আলাদা। তা-না তিনজন এক সঙ্গে যাচ্ছি। বেচারী মনটাতো এই জন্যেই খারাপ করেছে। একটু পর পর তোর খুঁজে যাচ্ছে। ওর মনের ভাব আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি।

বুঝতে পারলে তো ভালো। মা আমাকে আর খাইয়ে দিতে হবে না। যথেষ্ট হয়েছে। এখন তুমি খাও।

তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। বৌমাকে রেখে আমি খেয়ে ফেললে সে কি মনে করবে। বাপ নেই, মা নেই একটা মেয়ে। স্নেহের কাঙ্গাল।

আশহাব বিড় বিড় করে বলল, মহা বিপদ।

সাজেদা বললেন, খাওয়া শেষ করে তুই বৌমাকে খুঁজে আনবি। আমি কামরা ছেড়ে দেব তোরা দুই জন এখানে ঘুমাবি। আদর ভালবাসা করতে চাইলে করবি। হুট করে আমি তোদের কামরায় ঢুকব এরকম ভুলেও মনে করবি না। এই বুদ্ধি আমার আছে।

অবশ্যই সেই বুদ্ধি তোমার আছে। ভাত চাবাচ্ছিস না কেন? মুখে দিচ্ছি আর কোৎ করে গিলে ফেলছিস। ভাল করে চাবাতে হবে না। আচার খাবি? একটু আচার দেই?

আশহাব বিড় বিড় করে বলল, Oh God, oh God.

.

চিত্রা রশীদ সাহেবের পাশে বসে আছে। তার চোখ উজ্জ্বল। সে আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছে। বিজ্ঞানের অতি জটিল সব বিষয় এই মানুষ এত সহজে কিভাবে বলছে সে বুঝতে পারছে না। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীতে জটিল বলে কিছু নেই।

রশীদ সাহেব বললেন, মা আমাকে তুমি বল একটা আপেল থ্রি ডাইমেনশনাল বডি না? এর দৈর্ঘ্য প্রস্থ এবং উচ্চতা আছে না?

চিত্রা বলল, জি। অবশ্যই।

রশীদ সাহেব বললেন, আপেলের খোসাটা কিন্তু টু ডাইমেনশনাল। আপেলের খোসার আছে শুধু দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ।

চিত্রা বলল, জি চাচা।

রশীদ সাহেব বললেন, তুমি কি এখন বুঝতে পারছ একটি থ্রি ডাইমেনশনাল বস্তুকে একটি টু ডাইমেনশনাল বস্তু ঘিরে রেখেছে।

জি।

এটা যে সম্ভব তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।

পারছি।

রশীদ সাহেব সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, একই লজিকে আমি যদি বলি থ্রিডাইমেনশনাল কোনো বস্তু দিয়ে ফোর ডাইমেনশনাল জগৎ আটকে রাখা

সম্ভব তাহলে কি বিশ্বাস করবে?

চিত্রা চিন্তিত গলায় বলল, বিশ্বাস করাইতো উচিত।

রশীদ সাহেব বললেন, তোমার কাছে কোনো কিছু যদি অস্পষ্ট মনে হয় আমাকে বলবে। বিজ্ঞান অস্পষ্টতা পছন্দ করে না যদিও হায়ার সায়েন্স পুরোটাই অস্পষ্ট।

কেন?

হায়ার সায়েন্স Big Bang আগে কি হচ্ছে বলতে পারছে না। সময় কি সুষ্ঠু ভাবে বলতে পারছে না, অতীত এবং ভবিষ্যত কি বলতে পারছে না। হায়ার সায়েন্স হঠাৎ বলছে হলগ্রাফিক ইউনিভার্সের কথা। হলোগ্রাফিক ইউনিভার্সের কথা শুনেছ?

না।

বলব?

অবশ্যই বলবেন।

মূল ডিসকাশান থেকে আমি কিন্তু সরে যাব।

মূল ডিসকাশনে পরে যাবেন–হলোগ্রাফিক ইউনিভার্সটা কি আগে বলুন।

রশীদ সাহেব বললেন, এই হাইপোথিসিসে বিশ্ব ভ্ৰহ্মাণ্ড একটা হলোগ্রাম ছাড়া আর কিছুই না…

খোলা দরজায় বসির মাথা বের করে বলল, বিরাট এক সমস্যা হয়েছে। আপা আপনি কি ডাক্তার?

চিত্রা বলল, না তো। আশহাব সাহেব ডাক্তার।

বসির বলল, একজন মহিলা ডাক্তার দরকার। পাঁচ নম্বর কেবিনে এক মহিলার ডেলিভারী পেইন শুরু হয়েছে। উনার হাসবেন্ড মাওলানা। উনি লেডি ডাক্তার ছাড়া তাঁর স্ত্রীকে দেখাবেন না। আমি পুরো ট্রেইন খুঁজে এসেছি। কোনো লেডি ডাক্তার নেই।

রশীদ সাহেব বললেন, ডাক্তারের আবার পুরুষ মহিলা কি? ডাক্তার হল ডাক্তার। আমি মাওলানার সঙ্গে কথা বলি। উনাকে বুঝিয়ে বলি।

বসির বলল, উনি বুঝ মানার লোক না স্যার। কঠিন মাওলানা।

রশীদ সাহেব বললেন, নিশ্চয়ই কেউ তাকে ঠিকমতো লজিক দিতে পারে নি। মানুষ এমন ভাবে তৈরি যে তাকে লজিকের কাছে সারেন্ডার করতেই হয়। উনি যেমন কঠিন মাওলানা, আমিও কঠিন তার্কিক।

বসির বলল, আপনার কথা উনাকে বলে দেখি উনি কথা শুনতে রাজি হন কি-না।

রশীদ সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ইন্টারমিডিয়েট কারোর প্রয়োজন দেখছি না। আমি সরাসরি কথা বলব। তুমি আমাকে নিয়ে চল।

চিত্রা বলল, চাচা আমিও আসি। আমি আপনার লজিক শুনব।

রশীদ সাহেব বললেন, এসো।

.

মাওলানা কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কপালে ঘাম তবে চোখ মুখ কঠিন। তার একটা হাত পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকানো। মনে হচ্ছে ওই হাতে তসবি। কেবিনের দরজা বন্ধ। নারী কণ্ঠের চাপা কাতরানি শোনা যাচ্ছে।

রশীদ উদ্দিন এগিয়ে গেলেন। চিত্রা গেল তার পিছু পিছু। মাওলানা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। রশীদ সাহেব বললেন, আসোলামু আলায়কুম।

মাওলানা শীতল গলায় বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম।

রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার স্ত্রীর লেবার পেইন শুরু হয়েছে বলে শুনেছি। এইটাই কি আপনাদের প্রথম সন্তান?

জি।

ছেলে না মেয়ে?

কি করে বলব। সন্তানতো এখনো হয় নাই।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে আগে ভাগে জানার ব্যবস্থা আছে।

মাওলানা বললেন, আল্লাহপাক যদি চাইতেন আমরা আগে ভাগে জানি তাহলে মেয়েদের পেটের চামড়া পাতলা কাঁচের মতো বানাতেন আমরা পেটের ভেতরের সন্তান দেখতে পেতাম।

রশীদ উদ্দিন বললেন, আল্লাহ পাক মানুষকে ক্ষমতা দিয়েছেন যেন সে অজানাকে জানতে পারে। সূরা আল ইমরানে আছে…

মাওলানা বললেন, জনাব আমি আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না। আমি বুঝতে পারছি আপনি তর্কে আমাকে পরাস্ত করার আনন্দ পেতে চান। আনন্দ আপনাকে দিলাম—আগেই পরাজয় মানলাম।

রশীদ উদ্দিন বললেন, একজন পুরুষ ডাক্তার আমাদের সঙ্গে আছেন।

আমি আমার স্ত্রীর পর্দা নষ্ট করব না। কোনো পুরুষ ডাক্তার তাকে দেখাব না।

আপনার সিদ্ধান্তের কারণে আপনার স্ত্রী বা সন্তানের সমূহ ক্ষতি কিন্তু হতে পারে। দুর্ঘটনা ঘটে তারাতো মারাও যেতে পারে।

যদি মারা যায় তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহপাক তাদের আয়ু দেন নাই। জনাব আপনার সঙ্গে আর বাক্যালাপ করব না। গোস্তাকি নিবেন না। আমার মন অস্থির। তর্ক করার মতো অবস্থায় আমি নাই।

মাওলানা কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

চিত্রা বলল, চাচাজি উনি কোনো লজিকই শুনবেন না।

রশীদ উদ্দিন বললেন, এ রকম হয়। এই মাওলানা নিশ্চয়ই লজিকের কারণে অনেক বার আহত হয়েছেন যে কারণে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। বড় বড় বিজ্ঞানীদের মধ্যেও এই জিনিস দেখা যায়। অন্য বিজ্ঞানীদের লজিক যাতে শুনতে না হয় তার জন্যে নিজে লজিক থেকে সরে যান।

চিত্রা বলল, আমরা কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব?

রশীদ উদ্দিন বললেন, আমি দাঁড়িয়ে থাকব। মাওলানা আবার যখন বের হবেন তাকে আবার ধরব। ভাল কথা তোমার কাছে কি কোনো কয়েন আছে।

কেন বলুন তো!

তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাব।

এখন দেখাবেন। এইখানে?

Why not.

চিত্রা হ্যান্ডব্যাগ খুঁজে কোনো কয়েন পেল না। রশীদ উদ্দিন বললেন, কারো কাছ থেকে খুঁজে একটা কয়েন নিয়ে এসো তো।

বিস্মিত চিত্রা কয়েনের খোঁজে বের হল। মানুষটা কি পাগল? এই অবস্থায় কেউ ম্যাজিক দেখানোর কয়েন খোঁজে? বেশির ভাগ বিখ্যাত মানুষ একসেনট্রিক। এই একসিনট্রিসিটির কতটা সত্যি আর কতটা ভান? আমি আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো না। আমি আলাদা আমি অন্য রকম’ এই ধারণা বিখ্যাত মানুষরাই দিতে চেষ্টা করেন। সাধারণ মানুষদের এই সব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। আমি যা আমি তাই। Take me or leave me.

চিত্রা!

চিত্রা থমকে দাঁড়াল। ডাক্তার আশহাব। তাঁর মুখ চিন্তিত। চিত্রা বিস্মিত। এই ভদ্রলোক এত সহজে তাকে চিত্রা ডাকছে যেন সে তার ঘরের কেউ।

আশহাব বলল, আমার মায়ের মাথা পুরোপুরি গেছে। ব্রেইনের নিউরেনোল কানেকশনের চল্লিশ পার্সেন্ট মনে হয় অফ হয়ে গেছে। পরিচিত জগত সম্পর্কে যেখানে information থাকে সেখানে মনে হয় একটা havoc হয়ে গেছে।

আপনাকে চিনতে পারছেন না?

আমাকে এখনো চিনতে পারছেন তবে কিছুক্ষণ পরে মনে হয় চিনতে পারবেন না।

চিত্রা বলল, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে কিন্তু খুশি খুশি লাগছে।

আশহাব বলল, ঠিক ধরেছেন বিচিত্র কারণে আমি ফান পাচ্ছি। কেন পাচ্ছি নিজেও জানি না।।

চিত্রা বলল, আমি জানি।

আশহাব বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি কিভাবে জানবেন?

চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আপনার মা আমাকে বৌমা বৌমা ডাকছেন এই বিষয়টাতে আপনি ফান পাচ্ছেন। যে কোনো মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করতে ছেলেরা ভালোবাসে এবং ফান পায়।

আশহাব বলল, আর মেয়েরা কিসে Fun পায়?

মেয়েরা বিয়ের আগে কোনো পুরুষকেই স্বামী ভেবে fun পায় না। তার প্রেমিককেও সে বিয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামী ভাবে না। আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি আপনি যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করছেন। আপনার সঙ্গে কথা কাটাকাটি খেলার শখ এই মুহূর্তে হচ্ছে না। আপনার কাছে যদি কয়েন থাকে আমাকে একটা কয়েন দিন।

কয়েন দিয়ে কি করবেন?

ম্যাজিক দেখব। রশীদ সাহেব ম্যাজিক দেখাবেন।

আশহাব কয়েন বের করতে করতে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার মা আপনাকে ছাড়া ডিনার করবেন না।

চিত্রা বলল, না করলে নাই।

একজন অসুস্থ মানুষ। তার দিকটা দেখবেন না?

আমিও অসুস্থ।

.

রশীদ সাহেব কয়েন হাতে নিতে নিতে বললেন, চিত্রা মন দিয়ে দেখ কি করছি কয়েনটা কোন হাতে?

ডান হাতে।

এখন কোন হাতে নিয়েছি?

বাম হাতে। রশীদ সাহেব বাম হাত খুলে দেখালেন যে বাম হাত শূন্য। চিত্রা বলল, কয়েনটা ডান হাতেই আছে। আপনি ভঙ্গি করছেন কয়েনটা বাম হাতে নিয়েছেন আসলে নেন নি।

তোমার ধারণা কয়েনটা ডান হাতে?

জি।

রশীদ সাহেব ডান হাত খুলে দেখালেন। সেখানে কয়েন নেই। দুই হাতের কোথাও নেই। দু’টা হাতই খালি। চিত্রা বলল, কয়েন গেল কোথায়?

রশীদ সাহেব বললেন, আমারোতো একই প্রশ্ন। কয়েন গেল কোথায়। এ রকম জলজ্যান্ত একটা বস্তুতো উধাও হয়ে যেতে পারে না তাই না?

চিত্রা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। কয়েন অদৃশ্য করার খেলা সে আগে অনেকবার দেখেছে এ রকম কখনো দেখে নি।

রশীদ সাহেব বললেন, কয়েন ভ্যানিশের ম্যাজিকটা শেখায় আমার একটা বড় লাভ হয়েছে। পদার্থবিদ বন্ধুদের খেলাটা দেখাতে পারব। তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে মজা পাবে। ভিন্ন কারণটা শুনবে?

শুনব।

আগ্রহ নিয়ে শুনবে না-কি শুনতে হয় বলে শুনবে?

আগ্রহ নিয়ে শুনব। চাচা আমি নিজেও Physics-এর ছাত্রী।

রশীদ সাহেব বললেন, পদার্থবিদরা জগত সম্পর্কে হাইপোথিসিস, জগতের নিয়ম সম্পর্কে হাইপোথিসিস দাঁড়া করান। বিপুল উৎসাহে তারা অগ্রসর হন। ম্যাথমেটিকেল মডেল তৈরি হয়। তখন আমাদেরও ডাক পড়ে। কারণ বেশির ভাগ পদার্থবিদ অংকে দুর্বল। তোমাদের আইনস্টাইনের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। যাই হোক মূল কথায় ফিরে যাই। মনে করো পদার্থবিদ একটি সূত্র দাঁড় করালেন–

Y = BC + M + N^2

Y হল B, C, M এবং N–এর ফাংশান।

সব ঠিক মত চলছে হঠাৎ এক সময় নজরে আসবে M অদৃশ্য। শুরুতে M ছাড়া সূত্র কাজ করছে না, মাঝখানে M থাকলে সূত্র কাজ করছে না।

বুঝতে পারছ কি বলছি?

বুঝতে পারছি।

রশীদ সাহেব বললেন, তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে না God পদার্থবিদদের সামান্য ম্যাজিক দেখালেন? হঠাৎ M অদৃশ্য করে দিলেন?

মনে হচ্ছে।

আরেকটা জিনিস কি মনে হচ্ছে–God M-কে অদৃশ্য করে দেন নি লুকিয়ে রেখেছেন। এমন এক সাধারণ জায়গায় লুকিয়েছেন যে আমাদের চোখে পড়ছে না।

চিত্রা বলল, আপনি শিক্ষক হিসেবে নিশ্চয়ই খুব ভাল।

রশীদ সাহেব বললেন, খুব ভাল না। মোটামুটি ভাল। তুমি কি মাওলানা সাহেবের স্ত্রীর কাত্রানী শুনতে পাচ্ছ।

পাচ্ছি।

খুব খারাপ লাগছে না? লাগছে।

অংক হচ্ছে যুক্তি। আমি অংকের Giant. সেই আমি যদি মাওলানা সাহেবকে যুক্তিতে পরাস্ত করতে না পারি তাহলে শিক্ষক হিসেবে আমি দুর্বল শিক্ষক।

চিত্রা বলল, উনাকে তো যুক্তি শুনতে হবে। যুক্তি না শুনলে আপনি তাঁকে পরাস্ত করবেন কিভাবে?

রশীদ সাহেব বললেন, ছাত্র আমার কথাই শুনতে চাচ্ছে না এটাও কি শিক্ষক হিসেবে আমার ব্যর্থতা না?

চিত্রা বলল, উনি তো আপনার ছাত্র না।

রশীদ সাহেব বললেন, একজন শিক্ষকের কাছে সবাই ছাত্র।

.

মাওলানা সাহেবের স্ত্রী আফিয়ার ৩৫ সপ্তাহ মাত্র চলছে। শিশু চল্লিশ সপ্তাহ মায়ের পেটে থেকে বড় হবে। এই চল্লিশ সপ্তাহ সে তার জগতে নিজের মত বড় হবে। সব শেষে তৈরী হবে তার ফুসফুস। ফুসফুস তৈরী হয়ে যাবার পর শিশু সিগন্যাল পাঠাবে মায়ের শরীরে–আমি এখন তৈরি। পৃথিবী দেখব। আমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দাও। মায়ের শরীর ব্যবস্থা নেবেন।

এখানে কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। সময়ের আগেই শিশু বন্দিদশা থেকে মুক্তি চাচ্ছে। আফিয়া বলল, পানি ভাঙছে। পানি।

মাওলানা বললেন, আল্লাহর নাম নাও।

আফিয়া বলল, ডাক্তার লাগবে ডাক্তার।

মাওলানা বললেন, আমি খোঁজ নিয়েছি ট্রেনে লেডি ডাক্তার নেই।

আমি মরে যাব না-কি?

আহারে চিৎকার করছ কেন। মেয়েদের গলার স্বর বাইরের পুরুষের শোনা ঠিক না। পর্দার বরখেলাফ হয়।

আফিয়া গোংগাতে গোংগাতে বলল, মরে গেলাম। আমি মরে গেলাম। মাগো আমি মরে গেলাম।

মাওলানা বিরক্ত গলায় বললেন, আল্লাহর নাম নাও, মা মা করছ কেন? এখানে যা করার আল্লাহপাক করবেন। তোমার মা কি করবেন?

আপনি সামনে থেকে যান। কোনো একজন মহিলাকে ডাকেন। যে কোনো মহিলা। আমার সন্তান বের হয়ে আসতেছে। আমি বুঝতেছি। মাগো তুমি কোথায় মা।

মাওলানা দরজা খুলে বের হয়েই দেখলেন দরজার বাইরে চিত্রা এবং রশীদ সাহেব। মাওলানা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিত্রাকে বললেন, আপনি কি একটু ভেতরে যাবেন?

চিত্রা বলল, আমি ভেতরে গিয়ে কি করব? উনার দরকার একজন ডাক্তার। আমাদের সঙ্গে ডাক্তার আছে। উনাকে ডেকে নিয়ে আসি?

মাওলানা বললেন, পুরুষ ডাক্তার আমি দেখাব না। অসম্ভব। কোনদিনও না।

চিত্রা বলল, আমি ভেতরে যাচ্ছি। বোকার মতো বসে থাকা ছাড়া আমি কিছু করতে পারব না।

চিত্রা ঢুকে গেল। রশীদ উদ্দিন সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললেন, সিগারেট খাবেন। এতে টেনশান কিছু কমবে। নিকোটিনের নার্ভ সুদিং ক্ষমতা আছে।

আমি ধুমপান করি না।

গুড। ভেরি গুড। আমি আপনার দুই মিনিট সময় নিতে পারি? দুই মিনিটে আমি আপনাকে একটা গল্প বলব। গল্প শেষ করে আমি চলে যাব। আপনাকে আর বিরক্ত করব না। আমার হাত থেকে বাঁচার জন্যে আপনি আমাকে দুই মিনিট সময় দিন।

মাওলানা কঠিন গলায় বললেন, আপনাকে দুই মিনিট সময় দিলাম।

রশীদ সাহেব গল্প শুরু করলেন, দেশে একবার বন্যা শুরু হয়েছে। ঘরবাড়ি সব ডুবে যাচ্ছে। উদ্ধারকারী লোকজন নৌকা নিয়ে এসেছে। সবাই নৌকায় উঠে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেলেন। এক মাওলানা শুধু গেলেন না। উনি আল্লাহ ভক্ত মানুষ। উনি বললেন আল্লাহর উপর আমার ভরসা। আল্লাহপাক ব্যবস্থা করবেন।

বন্যার পানি ঘরের চাল পর্যন্ত উঠল। মাওলানা চালে উঠে বসলেন। তখন উদ্ধারকারী লঞ্চ এল। মাওলানা লঞ্চে উঠলেন না। উনার এক কথা, ‘আল্লাহপাক ব্যবস্থা করবেন’। বন্যার পানি আরো বাড়ল। মাওলানার বুক পর্যন্ত উঠল। এল উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার। মাওলানা তাতেও উঠলেন না। হেলিকপ্টার ফিরে গেল।

পানিতে ডুবে মাওলানা মারা গেলেন। মৃত্যুর পর আল্লাহকে গভীর আফসোসের সঙ্গে বললেন, আমি সারাজীবন একনিষ্ঠভাবে আপনাকে ডেকেছি আপনার উপর ভরসা করেছি আর আজ আমাকে কিনা ডুবে মরতে হল। কোনো সাহায্য আপনার কাছ থেকে এল না।

আল্লাহ বললেন, তোমাকে সাহায্য করার জন্যে আমি তিনবার ব্যবস্থা নিয়েছি। একবার নৌকা পাঠানো হয়েছে। তারপর গেল লঞ্চ। সর্বশেষে হেলিকপ্টারও পাঠালাম। বল আর কি করতে পারতাম?

আমার গল্প শেষ। আমি এখন বিদায় নেব।

মাওলানা বললেন, আপনার গল্পটা সুন্দর। গল্প কিন্তু গল্পই। আল্লাহপাক ইচ্ছা করলেই বন্যার পানি নামিয়ে দিতে পারতেন।

রশীদ উদ্দিন বললেন, তা অবশ্যই পারতেন। তিনি আপনার সন্তানের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারেন কিন্তু মাওলানা সাহেব আপনি কি একটা হাদিস জানেন? এই হাদিস অনুযায়ী আল্লাহপাক বলেছেন, তুমি যখন রোগগ্রস্ত হবে তখন একজন ভাল চিকিৎসকের কাছে যাবে সেই সঙ্গে রোগমুক্তির প্রার্থনা করবে।

মাওলানা বললেন, আমি এই হাদিসের কথা জানি না।

রশীদ উদ্দিন বললেন, আমি জানি। আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন। আমার প্রাথমিক পড়াশোনা মাদ্রাসায়। আপনি আমার কথা শুনুন, আমি ডাক্তার ছেলেটিকে ডাকি। সে আপনার স্ত্রীকে ‘মা’ সম্বোধন করে কামরায় ঢুকুক।

মা ডাকলেই মা হয় না।

রশীদ উদ্দিন বললেন, তাও ঠিক। কোরান শরীফেই আছে পালক পুত্র পুত্র নয়। তারপরেও এই ডাক্তারের কল্যাণে হয়ত আপনার সন্তান। তার মাকে মা ডাকবে। জগতের মধুরতম শব্দ আপনার স্ত্রী শুনবে।

মাওলানা বললেন, ঐ ডাক্তার ছেলে গলাপর্যন্ত মদ খেয়েছে। তার মুখ দিয়ে ভক ভক করে মদের গন্ধ, আসছে। ঐ গন্ধ আমি চিনি। কিছু মনে করবেন না জনাব আপনিও মদ খেয়েছেন।

রশীদ উদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, কথা সত্য। মদ খাওয়ায় ডাক্তারের শরীর এবং মন হয়ত অশুচি হয়েছে। তার বিদ্যা কিন্তু হয় নি।

রশীদ উদ্দিনের কথা শেষ হবার আগেই চিত্রা কামরা থেকে বের হল। উত্তেজিত গলায় বলল, ডাক্তার কোথায়? বাচ্চা বের হচ্ছে। মাথা বের হচ্ছে।

চিত্রা ছুটে চলে গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হতভম্ব মাওলানার সামনেই ডাক্তারের হাত ধরে টানতে টানতে কেবিনে ঢুকে গেল।

মাওলানা বললেন, কাজটা কি ঠিক হয়েছে?

রশীদ সাহেব বললেন, যদি আমার মতামত জানতে চান তাহলে বলব কাজ উত্তম হয়েছে। এখন আপনি নিশ্চিন্ত মনে আল্লাহপাককে ডাকতে পারেন।

.

চিত্রা ভয়ে কাঁদছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। আশহাব বলল, আপনি ঘাবড়াবেন না। মহিলার হাত ধরুন। ডেলিভারি নরম্যাল হবে। আমার ফুটন্ত পানি দরকার। ব্লেড দরকার, সূতা দরকার।

ব্লেড দিয়ে কি করবেন?

বাচ্চার নাড়ি কাটতে হবে না।

আফিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আপনি কি ডাক্তার?

আশহাব বলল, আমি ডাক্তার, এবং খুব ভাল ডাক্তার। গাইনি আমার বিষয় না, তারপরেও কোনো সমস্যা নেই। আপনাকে যা করতে বলব করবেন আমাকে সাহায্য করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় চাপ আসবে তার জন্যে প্রস্তুত হোন। যখন নিঃশ্বাস চেপে রাখতে বলব তখন নিঃশ্বাস চাপবেন।

আফিয়া গোংগাতে গোংগাতে বলল, আমি পারব না। আমি পারব না।

.

রশীদ সাহেব মাওলানাকে বললেন, আপনি কি একটা ম্যাজিক দেখবেন?

হতভম্ব মাওলানা বললেন, ম্যাজিক?

পয়সা অদৃশ্য করার খেলা দেখাব। মজা পাবেন।

আপনার কি মাথা টাথা খারাপ এখন ম্যাজিক দেখাবেন?

মূল ম্যাজিক আল্লাহপাক কিছুক্ষণের মধ্যে দেখাবেন এখন আমারটা দেখুন। আমার ডান হাতে কি? পাঁচ টাকার একটা কয়েন না। কয়েনটা এখন নিলাম বাম হাতে। এখন দেখুন বাম হাত শূন্য। ডান হাতও শূন্য। বলুন কয়েনটা কোথায়?

জাহান্নামে।

খারাপ বলেন নি। From here to eternity.

চিত্রা দরজা খুলে বলল, ফুটন্ত পানি লাগবে, ব্লেড লাগবে, সূতা লাগবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেলিভারি হবে।

মাওলানা তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে চিত্রার কথা বুঝতে পারছে না। চিত্রা তাঁকে কঠিন ধমক দিল, হাদার মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ব্যবস্থা করুন।

.

সেলুন কারে বাতি জ্বলা নেভার খেলা চলছে। এই বাতি জ্বলছে এই নেই। সেলুন কারের যাত্রীরা আতংকে অস্থির। সবচেয়ে ভয় পেয়েছে যমুনা এবং তার স্বামী। যতবার বাতি নিভছে ততবার সে আতংকে অস্থির হয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরছে। ভয় সংক্রামক। যমুনার আতংক ছড়িয়ে পড়েছে সবার মধ্যে। বদরুলের কর্মকাণ্ডও সবাইকে ঘাবড়ে দিচ্ছে। তার মেন্টাল ব্রেক ডাউনের মত হয়েছে। সে যেসব কথাবার্তা বলছে তার কোনো অর্থই বুঝা যাচ্ছে না তবে মাঝে মাঝে যখন বলছে– “মেরে ফেলবে। সবাইকে মেরে ফেলবে” তখন সবাই আঁৎকে উঠছে। মেরে ফেলবে বাক্যের অর্থ না বুঝার কিছু না। খায়ের সাহেবের মন্ত্রীত্ব নেই এই খবর এখন সবাই জানে। মূল আতংক এখানেই।

খায়ের সাহেব পূর্ত প্রতিমন্ত্রী হেলাল উদ্দিনকে টেলিফোন করছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হেলাল টেলিফোন ধরেছেন এবং ধরেই বলেছেন, আপনার ব্যাপারটা শুনেছি। ভেরি স্যাড। দলের মধ্যে কান ভাঙানির লোক হয়েছে বেশি এরাই কাজটা করেছে। আপনি একজন সিনসিয়ার ওয়ার্কার। দলের জন্যে আপনার সেক্রিফাইস আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সবাই একদিন ভুল বুঝতে পারবে।

আবুল খায়ের সাহেব বললেন, আমি এখন এক বিপদে আছি। তুমি কাউকে বলে কিছু করতে পারবে?

হেলাল উদ্দিন বললেন, কি বিপদ?

আবুল খায়ের বিপদটা মোটামুটি গুছিয়েই বললেন। বাতি জ্বালানো নিভানো অংশও বাদ দিলেন না।

হেলাল উদ্দিন বললেন, কি সর্বনাশ। এদের এটিচুডতে মোটেই ভাল মনে হচ্ছে না।

আবুল খায়ের বললেন, আমারো ভাল মনে হচ্ছে না।

হেলাল উদ্দিন বললেন, আপনাদেরটা কি সব শেষের কামরা?

হ্যাঁ।

বলেন কি। আরো বিপদ।

আরো বিপদ কেন?

হেলাল উদ্দিন বললেন, বদগুলা বগিটা খুলে দিতে পারে। মূল ট্রেন থেকে আলাদা করে দিতে পারে। পরে যখন ইনভেসটিগেসন হবে তখন বলবে একসিডেন্ট। আপনা আপনি খুলে গেছে।

তুমি তো আরো ভয় ধরিয়ে দিলে।

খায়ের ভাই এটাই বাস্তবতা।

এখন করব কি বল।

ঐ পার্টির কাউকে টাকা পয়সা দিয়ে হাত করতে হবে। বিপদ থেকে উদ্ধারের একটাই পথ।

তুমি রেলের কাউকে কিছু বলতে পার না?

আচ্ছা দেখি। কি করতে পারি আপনাকে জানাব।

দশ মিনিট পর আমি টেলিফোন করি?

হেলাল উদ্দিন বললেন, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি জানাব।

আবুল খায়ের সাহেব চাপা নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি নিশ্চিত হেলাল উদ্দিন আর টেলিফোন করবে না। নিজের মোবাইলও অফ করে রেখে দেবে। হেলালকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তিনি নিজে অসংখ্যবার এই কাজ করেছেন। অন্যদের করতে দোষ কি? মহা বিপদে পড়ে কতবার লোকজন তাকে টেলিফোন করেছে তিনি বলেছেন, দেখি কি করা যায়। কিছু করতে পারলে জানাব আমাকে টেলিফোন করার দরকার নেই। বলেই লাইন কেটে দিয়েছেন।

ব্যান্ডদলের পরিচালকের নাম কাউসার। সে নিজের নাম লেখে ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে–Cowসার। নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে বলে গরুর সার অর্থাৎ গোবর। Cowসার ডাকতে যদি সমস্যা হয় আমাকে গোবর ডাকতে পারেন, গোবর ভাইয়া ডাকতে পারেন কোনো অসুবিধা নেই।

কাউসারের রসবোধে তার ব্যান্ডের লোক যেমন মোহিত, বাইরের লোকজনও মোহিত। এই মুহূর্তে তার মধ্যে রসবোধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সে ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছে। টেনশানে তার পেট নেমে গেছে। কাউসার আবুল খায়েরের দিকে এগিয়ে এল। খায়ের সাহেব বললেন, কিছু বলবে?

কাউসার বলল, বিনাকারণে আমরা ক্যাচালের মধ্যে পড়েছি। আমরা ঠিক করেছি সামনের স্টেশনে নেমে যাব। সঙ্গে অনেক টাকার ইনস্ট্রমেন্ট। নষ্ট হলে পথে বসব।

খায়ের সাহেব বললেন, সামনের ষ্টেশনে নামবে কি ভাবে? ট্রেন তো আর কোথাও থামবে না। ময়মনসিংহ থামবে।

তাহলে স্যার আমরা চেইন টেনে ট্রেন থামায়ে নেমে পড়ব।

জঙ্গলের মধ্যে কোথায় নামবে? ভাওয়ালের জঙ্গল।

কাউসার বলল, ভাওয়ালের জঙ্গলেই নামব। আপনি তো এখন কোনো প্রটেকশান দিতে পারবেন না। কোন ভরসায় থাকব?

যমুনার স্বামী ফয়সল বলল, আমি কাউসার সাহেবের সঙ্গে একমত। আমার মতে আমাদের সবারই নেমে যাওয়া উচিত।

খায়ের সাহেব বললেন, জঙ্গলে নেমে যে আরো বড় বিপদে পড়বে না কে বলল?

সুরমা রাগী গলায় বললেন, বোকার মতো কথা বলবে না। জঙ্গলে কিসের বিপদ? জঙ্গলে কি সিংহ আছে যে আমাদের খেয়ে ফেলবে?

কাউসার বলল, তাহলে ডিসিসান কি হল? আমরা চেইন টেনে ট্রেন থামাব?

খায়ের সাহেব কিছু বলার আগেই ফয়সল বলল, অবশ্যই। এখন দেখা যাবে চেইন টেনেও ট্রেন থামানো যাবে না। টানতে টানতে চেইন ছিঁড়ে ফেললাম ট্রেইন থামল না।

ফয়সলের কথা শেষ হবার আগেই বাতি আবার নিভে গেল। কাউসার চেইন ধরে ঝুলে পড়ল।

ঝাঁকুনি খেতে খেতে ট্রেন থেমে গেল। অস্বাভাবিক দক্ষতায় কাউসার দলবল নিয়ে নেমে পড়ল। ফয়সল নামল যমুনাকে নিয়ে। সুরমা স্বামীর হাত ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি করে নিজেও ঝাঁপ দিয়ে পড়ে পা মচকে ফেললেন।

ট্রেনের ভিতর ছোটাছুটি ব্যস্ততা। অনেকেই চিৎকার করছে ডাকাত ডাকাত। রেল পুলিশ ঘন ঘন হুইসেল দিচ্ছে। ট্রেনের কয়েকটা কামরা থেকে টর্চের আলো দু’পাশের জঙ্গলে ফেলা হচ্ছে। একদল যাত্রী চেঁচাচ্ছে ঐ যে জঙ্গলে ঢুকে। জঙ্গলে ঢুকে। মেয়েছেলে নিয়ে পালায়ে যাচ্ছে। রেল পুলিশ দু’বার রাইফেলে ফাঁকা আওয়াজ করল।

.

রেল পুলিশের রাইফেলের গুলির আওয়াজের সঙ্গে নবজাত শিশুর কান্না মিশল। আশহাব বাচ্চাটাকে পা ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে। বাচ্চা একেকবার ফুসফুস ভর্তি করে বাতাস নিচ্ছে এবং চিৎকার করে কাঁদছে। অসময়ে চলে এলেও এই শিশু প্রাণশক্তিতে ভরপুর। সে তার উপস্থিতি সবাইকে জানান দেবেই। চিত্রা বলল, ছেলে না মেয়ে?

আশহাব বলল, ছেলেই হোক মেয়েই হোক একটি ‘শয়তানই’ যথেষ্ট।

আহা বলুন না। ছেলে না মেয়ে?

আশহাব বলল, মেয়ে হয়েছে।

চিত্রা দরজা খুলে বের হল আনন্দে সে ঝলমল করছে। মনে হল সে তার জীবনের সবচে আনন্দের সংবাদটা দিচ্ছে।

মাওলানা সাহেব! আপনার একটা পরীর মতো সুন্দর মেয়ে হয়েছে।

মাওলানা কিছু বলার আগেই রশীদ উদ্দিন বললেন, অতি সুসংবাদ। নবী এ করিম বলেছেন যার প্রথম সন্তান কন্যা সে মহা সৌভাগ্যভান। আজান দেয়া প্রয়োজন। মেয়েটার কানে আল্লাহর নাম ঢুকুক।

মাওলানা বললেন, মেয়েটার চেহারা দেখে তারপর আজান দেই?

রশীদ উদ্দিন বললেন, আগে আজান তারপর চেহারা।

মাওলানা আজান দিলেন।

আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার…

শিশুটিকে শাড়ি দিয়ে জড়িয়ে মায়ের বুকের কাছে দেয়া হয়েছে। মা এই হাসছেন, এই কাঁদছেন। হঠাৎ তিনি চমকে উঠে বললেন, ডাক্তার আপনি না বললেন মেয়ে। এতো ছেলে।

আশহাব হাসতে হাসতে বলল, একটু ঠাট্টা করলাম।

ছেলের মা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসে বললেন, ডাক্তার তুমি এত দুষ্ট কেন?

মাওলানাকে আসল খবর দেয়ার পর তিনি আনন্দে অভিভূত হয়ে রশীদ উদ্দিনকে জড়িয়ে ধরলেন। মনে হচ্ছে কন্যা সন্তানের আনা ভাগ্যের তাঁর প্রয়োজন নেই। তার জন্যে ছেলেই যথেষ্ট।

.

ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সেলুন কারে বাতি এসেছে। আবুল খায়ের সাহেব একা বসে আছেন। তাকে ফেলে সবাই নেমে গেছে এই ধাক্কা থেকে তিনি এখনো মুক্ত হতে পারছেন না। তিনি সিগারেট ধরিয়েছেন। গলার টক ভাবটা চলে গেছে। সিগারেট টানতে তার খারাপ লাগছে না। ব্লাডি মেরি একটা খেলে মন্দ হত না।

স্যার!

আবুল খায়ের চমকে তাকালেন। তার পেছনে সবুর দাঁড়িয়ে। যার কানে ধরে উঠবোস করাতেই নাটকের শুরু।

স্যার সবাই কই?

নেমে গেছে।

কই নেমে গেছে?

জঙ্গলে।

কেন স্যার?

খায়ের সাহেব স্বাভাবিক গলায় বললেন, তোমরা একজনকে মেরে আধমরা করেছ, নেংটো করে পাঠিয়েছ এতে সবাই গেছে ভড়কে।

সবুর দুঃখিত গলায় বলল, কাজটা ঘটেছে মূসা ভাইয়ের কারণে। উনি ইউনিয়ন সেক্রেটারি। আমি উনার হাতে পায়ে ধরতে বাকি রাখছি।

মূসা সাহেবের এখনকার পরিকল্পনা কি?

কোনো পরিকল্পনা নাই স্যার। মূসা ভাই আপনার সঙ্গে দেখা করবে। ক্ষমা চাবে। তাকে নিয়ে আসি স্যার? আপনাকে চা দেব। চা খাবেন?

খাব।

ডিনার কখন দেব স্যার?

ভেবে দেখি।

খায়ের সাহেবের মোবাইল টেলিফোন বাজছে। সুরমা টেলিফোন করেছেন। মোবাইল বিপ্লবের ফসল। জঙ্গল থেকেও কথা বলা যাচ্ছে।

সুরমা বললেন, এই আমার মনে হয় পা ভেঙে গেছে। ট্রেন থেকে যখন পুলিশ আমাদের উপর গুলি করল তখন দৌড় দিতে গিয়ে খাদে পড়ে গেছি। এখন পা নড়াতে পারছি না।

সরি টু হিয়ার দ্যাট।

বার হাজার টাকা দামের শাড়ি। ছিঁড়ে কুটি কুটি।

সরি টু হিয়ার দ্যাট।

তোমার অবস্থা কি?

এখনো বেঁচে আছি। রাখি কেমন?

রাখি রাখি করছ কেন?

রাখি রাখি করছি কারণ মূসা সাহেবের সঙ্গে আমার এপয়েন্টমেন্ট। উনি যে কোনো সময় চলে আসবেন।

মূসা সাহেব কে?

আমাদের শাস্তি দেয়ার মূল পরিকল্পনা উনার। উনি রেল ইউনিয়নের লোক।

কি সর্বনাশ!

খায়ের সাহেব লাইন কেটে দিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার কাছে অতি জরুরি একটা টেলিফোন এল। তাঁকে জানানো হল মন্ত্রীত্ব চলে যাওয়া বিষয়ে যে কথা প্রাইম মিনিস্টারের অফিসের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে তা পুরোপুরিই গুজব। এ ধরনের গুজব রটনায় প্রাইম মিনিস্টার নিজে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। গুজবের পেছনে কারা আছে বের করতে বলেছেন। প্রাইম মিনিস্টার নিজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন।

আবুল খায়ের সাহেবের চা চলে এসেছে। তিনি চায়ে চুমুক দেয়া মাত্র প্রাইম মিনিস্টারের টেলিফোন এল। তিনি তিন চার মিনিট কথা বললেন।

সবুর বিনয়ী ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। টেলিফোন শেষ হওয়া মাত্র বলল, স্যার মূসা ভাইকে কি আনব?

এখন না।

চা কেমন হয়েছে স্যার?

চা ভালো হয়েছে। তুমি সামনে থেকে যাও। আমি কিছুক্ষণ একা থাকব।

সবুর চলে গেল। আবুল খায়ের টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি নিশ্চিত অন্ধকার কেটে গেছে এখন একের পর এক টেলিফোন আসতে থাকবে। সবার আগে রেলমন্ত্রীর টেলিফোন আসার কথা। এত দেরি হচ্ছে কেন?

টেলিফোন বাজছে। মন্ত্রী মহোদয় টেলিফোন ধরলেন না। কারণ সুরমা টেলিফোন করেছে। সুরমা’র টেলিফোন ধরার কিছু নেই। এখন হয়ত জানা যাবে যে সে এক পাটি স্যান্ডেল খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি বিড় বিড় করে বললেন, I have no business with you.

.

রেল মন্ত্রী না, প্রথম টেলিফোন করলেন পূর্ত প্রতিমন্ত্রী হেলালউদ্দিন, তাঁর গলায় আনন্দ।

খায়ের ভাই।

হুঁ।

মাঝখানে মোবাইল অফ রেখেছিলেন? কল করি লাইন যায় না।

অফ থাকতে পারে।

আরে গ্রেট খায়ের ভাই! আপনার ব্যাপারটা তো পুরো রিউমার। খবর পেয়েছেন না?

হুঁ।

একটা সোর্স থেকে খবর পেলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা হয়েছে।

হুঁ।

মাঝখানে রেলের একটা হাঙ্গামা হয়ে গেল। এই নিয়ে তোলপাড় হয়ে গেছে–আমি স্ট্রংলি কয়েকজনকে ধরেছি।

হেলাল রাখি? আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।

সে কি! কি হয়েছে? আপনি এত কাজ করেন শরীর খারাপ হবারই কথা। ভাবী আছে ভাবীকে দিন। ভাবীর সঙ্গে কথা বলি।

‘তোমার ভাবী একটু ব্যস্ত আছেন।’ বলেই খায়ের সাহেব টেলিফোনের লাইন কেটে দিলেন। তিনি বসেছেন জানালার পাশে। ট্রেনের চাকায় ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে। জানালার ও পাশের বন জঙ্গল ঘরবাড়ি দ্রুত সরে যাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। সবচে ভাল লাগছে অনেক দূরের বাড়িঘরের হারিকেন বা কূপীর আলো। ছোটবেলায় এইসব আলো দেখতে ভয় ভয় লাগতো। তাকে কে যেন বলেছিল ঐগুলা জ্বীনের চোখ। জ্বীন কখনো তাকিয়ে থাকে, কখনো চোখ বন্ধ করে। এই জন্যেই দূরের আলো কখনো দেখা যায় কখনো দেখা যায় না।

খায়ের সাহেবের মনে হল ট্রেনে করে তিনি উল্টা যাত্রা শুরু করেছেন। ট্রেন অতি দ্রুত তাকে শৈশবে নিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে একজন লজিং মাস্টার থাকতেন। নাম আক্কাস। আক্কাস স্যার তাকে অংক আর ইংরেজি শেখাতেন। অংক এবং ইংরেজির বাইরে আরেকটা জিনিস শেখাতেন। তিনি সেই শিক্ষার নাম দিয়েছিলেন সত্য শিক্ষা।

মিথ্যা কথা মানুষ কি জন্যে বলে জানিস?

জি না।

মিথ্যা কথা বলতে আরাম এই জন্যে মানুষ মিথ্যা কথা বলে। সত্যি কথা বলতে বেআরাম।

বেআরাম কেন?

জানি না কেন। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। মিথ্যা কথা হুট করে মুখ দিয়ে বের হয়। সত্যিটা বের হয় না। আজিব ব্যাপার।

তাদের এই লজিং স্যার পরে স্কুলেই চাকরি পান। সত্যি কথা বলার বদঅভ্যাসের কারণে তার চাকরি চলে যায়। সেবার স্কুলের উন্নয়নের জন্যে একশো বস্তা গম বরাদ্দ হয়েছিল। হেডমাস্টার সাহেব নিজে দশ বস্তা রেখে অন্য সব শিক্ষকদের দুই বস্তা করে দিলেন। স্কুল কমিটির সেক্রেটারি পেলেন পাঁচ বস্তা। গভর্নিং বডির মেম্বাররা তিন বস্তা করে। একজন শুধু গম নিলেন না, তার নাম আক্কাস মাস্টার। তিনি শুধু যে গম নিলেন না, তা-না জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানালেন। তদন্ত হল। তদন্তে প্রমাণিত হল আক্কাস আলি স্কুলের শিক্ষকদের সম্মান নষ্ট করার জন্যে এই কাজ করেছেন। নিজে সাধু সেজে অন্যদের চোর বানাতে চেয়েছেন।

আক্কাস মাস্টারের শুধু যে চাকরি গেল তা-না, অন্যদের নামে বিশেষ করে স্কুল কমিটির সেক্রেটারি রজব মিয়ার নামে মিথ্যা অভিযোগ আনার শাস্তিও হল। আক্কাস মাস্টারকে কানে ধরে রজব মিয়ার বাড়ির সামনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হল। তার পাঞ্জাবীর বুকে সেফটি পিন দিয়ে একটা কাগজ লাগিয়ে দেয়া হল। সেখানে লেখা

“আমি চোর”

আক্কাস মাস্টার কাঁদছিল। তাকে কাঁদতে দেখে বালক খায়েরের হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে গেল। সে ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। তার বাবা এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, বাবা কি হইছে? কান্দ কেন? সে কিছুই বলে না শুধু কাঁদে। তার মা তখন বললেন, আক্কাস মাস্টার কানে ধইরা কানতেছে এইটা দেইখা তোমার পুলা কানতেছে।

খায়েরের বাবা অতি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার পুলার অন্তরে এত মায়া? এত মায়া আমার পুলার অন্তরে! তিনি তৎক্ষণাৎ হাত তুলে দোয়া করলেন, হে আল্লাহপাক আমার ছেলের অন্তরের এই মায়া যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকে। আমিন।

খায়েরের যখন আট বৎসর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। আজ তার বয়স ৫৯-এর কিছু বেশি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর আজ তার বাবার কথা মনে পড়ল এবং চোখে পানি এসে পড়ল। তার পরহেজগার বাবার প্রার্থনা আল্লাহপাক শোনেন নি। শৈশবের মায়ার কিছুমাত্র তার মধ্যে নেই। তিনি এই সমাজে অতি দুষ্ট মানুষ হিসেবে পরিচিতি।

.

ট্রেন থেমে পড়েছে। স্টেশন ছাড়াই থেমেছে। দু’দিকে শালবন। নিঝুম এক জায়গা। জানা গেছে ইনজিনে কি এক ঝামেলা হয়েছে। ড্রাইভার ইনজিন সারাবার চেষ্টা করছে। কিছু যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। অনেকে ভীড় করেছে ইনজিনের পাশে।

.

মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা ভাল না। প্লেসেন্টা এখনো বের হয়নি। অস্বাভাবিক রক্তপাত হচ্ছে। এই মহিলাকে অতি দ্রুত হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। জঙ্গলে ট্রেন থেমে থাকলে গুরুতর সমস্যা হবে। মাওলানা সমস্যার ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। পুত্র লাভ উপলক্ষে তিনি শোকরানা নামাজ শেষ করেছেন। আনন্দিত মুখে বার বার তার কামরায় উঁকি দিচ্ছেন। বাচ্চা কোলে নিয়ে সাজেদা বেগম বসে আছেন। সমস্যার জটিলতা তিনি বুঝতে পারছেন। একটু পর পর তিনি চিত্রাকে বলছেন, বৌমা খোঁজ নাও ট্রেন কখন ছাড়বে। কামরায় আশহাব আছে। সে ক্ষণে ক্ষণে মার কাছ থেকে ধমক খাচ্ছে–তুই তো গাধা ডাক্তার। কিছু করতে পারছিস না এটা কেমন কথা। তুই কি নকল করে পাস করেছিস যে কিছু জানিস না। গাধার গাধা। তোর বাপ ছিল গাধা। তুইও গাধা!

এমন কঠিন সময়ে মাওলানা উঁকি দিল এবং সবগুলি দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করল, খালাম্মা ছেলে কি আমার মতো হয়েছে?

সাজেদা বললেন, ছেলের গালে ছাগলা দাড়ি নাই। ছেলে তোমার মতো হয় নাই। ছেলে কার মতো হয়েছে এই চিন্তা বাদ দাও। তোমার বৌকে বাঁচাবার চেষ্টা কর।

মাওলানা বললেন, কঠিন দোয়ার মধ্যে আছি খালাম্মা। দেখবেন কিছুক্ষণের মধ্যে ইনজিন ঠিক হবে ইনশাল্লাহ। আমরা একটানে ময়মনসিংহ পৌঁছে যাব।

সাজেদা বললেন, আল্লাহপাক কি ইনজিন ঠিক করার জন্যে ফেরেশতা পাঠায়েছেন?

মাওলানা বললেন, এই ধরনের কথা বলবেন না খালাম্মা। বিরাট পাপ হবে। এইসব খোদা নারাজি কথা।

খোদা তোমার আমার মতো না। এত্ত সহজে তিনি নারাজ হন না। তুমি আমার সামনে থেকে যাও। তুমি হচ্ছ রামছাগল। ট্রেন থেকে নেমে দেখ কাঁঠাল গাছ পও কি-না। যদি পাও পাতা ছিঁড়ে পাতা খাও।

.

ড্রাইভার সাহেব বলেছেন, ইনজিনের মূল পিস্টন ভেঙে গেছে। উদ্ধারকারী ইনজিন না এলে কিছু করা যাবে না। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। রশীদ উদ্দিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন। তাঁর সামনে আশহাব চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।

রশীদ উদ্দিন বললেন, মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা কি? সে কি চার-পাঁচ ঘন্টা সারভাইভ করবে?

আশহাব বলল না, আমাদের হাতে বড় জোর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে।

রশীদ উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন।

আশহাব বলল, স্যার কোথায় যান।

রশীদ উদ্দিন জবাব দিলেন না।

.

আবুল খায়ের সাহেব সেলুন কারের সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। তাঁর কামরায় বৃদ্ধ যে মানুষটা ঢুকছে তার চেহারা অবিকল আক্কাস মাস্টারের মতো। অথচ আক্কাস মাস্টার চার বছর আগে মারা গেছেন। তিনি নিজে তার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন।

সেই লুঙ্গি পরা মানুষ। মাথায় মাফলার। আক্কাস মাস্টারেরও একই ব্যাপার ছিল। লুঙ্গি, শীত-গ্রীষ্মে মাফলার। খায়ের সাহেব উঠে দাঁড়াবেন না কি বসেই থাকবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি এক ধরনের অস্বস্থির মধ্যে পড়ে গেলেন।

আমার নাম রশীদ উদ্দিন। আমি আপনার কাছে একটি আবেদন নিয়ে এসেছি।

খায়ের সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি আবেদন

রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার সামনে বসে বলি। আমাকে দুই মিনিট সময় যদি দেন।

বসুন।

রশীদ উদ্দিন বললেন, ট্রেনের একজন যাত্রী মহা বিপদে পড়েছে। তার একটি সন্তান হয়েছে। এখন শুনতে পাচ্ছি প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। তাকে অতি দ্রুত কোনো একটা হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার। আপনি যদি ব্যবস্থা করে দেন তাহলে মেয়েটি বেঁচে যায়।

খায়ের সাহেব বললেন, আমি কি ভাবে ব্যবস্থা করব? ইনজিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কখন ঠিক হবে তার নেই ঠিক।

রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনি অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আপনার পক্ষে এই অবস্থাতেও ব্যবস্থা করা সম্ভব।

খায়ের সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি একটা ভুল করছেন– মন্ত্রীদের হাতে আলাদিনের চেরাগ থাকে না। চেরাগ ঘসে তারা দৈত্য আনতে পারে না। যদি চেরাগ থাকতো আমি চেরাগের দৈত্যকে বলতাম সে ম্যাজিক কার্পেটে করে রোগী সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে নিয়ে চিকিৎসা করাতে।

রশীদ উদ্দিন সহজ গলায় বললেন, স্যার আপনার কাছে ম্যাজিক কার্পেট আছে।

আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?

জি-না। আমি অংকের শিক্ষক। অংকের শিক্ষকরা রসিকতা বুঝতেও পারে না। করতেও পারে না।

রশীদ উদ্দিন দ্বিতীয়বার চমকালেন। আক্কাস মাস্টারও অংকের শিক্ষক ছিলেন। খায়ের সাহেব বললেন, আপনার রোগীর প্রতি আমি যথেষ্ট সিমপ্যাথি বোধ করছি কিন্তু বুঝতেই পারছেন আমার কিছু করার নেই।

রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনি টেলিফোন করেই একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে পারেন। দশ মিনিটে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার চলে আসবে। মহিলার জীবন রক্ষা হবে। আমি কি আমাদের পবিত্র গ্রন্থ থেকে একটা আয়াত বলব?

খায়ের সাহেব চুপ করে রইলেন। রশীদ উদ্দিন বললেন, আল্লাহপাক বলছেন, যে একটি জীবন রক্ষা করে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই রক্ষা করে আর যে একটি জীবন নষ্ট করে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই ধ্বংস করে।

খায়ের সাহেব পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আমি ঢাকায় আমার বাড়ির ছাদে তিনটা হেলিকপ্টার রেখে দিয়েছি। টেলিফোন করব আর উড়ে চলে আসবে।

তার মানে কিছু করতে পারছেন না?

না।

দু-এক জায়গায় টেলিফোন করে দেখেন কাজ হতেও তো পারে। সিচুয়েশনটা চিন্তা করুন বনের মধ্যে ট্রেন আটকে আছে। একজন মৃত্যুপথযাত্রী। ট্রেনের এক যাত্রী মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ঘটনা শুনে মর্মাহত হলেন। নানান ঝামেলা করে হেলিকপ্টার আনালেন। রোগী ঢাকা পাঠানো হল। হেলিকপ্টার যখন উড়তে শুরু করবে তখন ট্রেনের শত শত যাত্রী চিৎকার করে বলবে–আবুল খায়ের খান, জিন্দাবাদ। তারা মন থেকে বলবে। তাদেরকে ভাড়া করে আনতে হয়নি। নিজের পকেট থেকে একটা পয়সা খরচ না করেও আপনি স্বতস্ফূর্ত জিন্দাবাদ ধ্বনি শুনবেন।

আবুল খায়ের বললেন, আপনি কি বিদায় হবেন?

রশীদ উদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আপনাকে কুৎসিত একটা গালি দিতে ইচ্ছা করছে। যে গালি শুনলে আপনার পিত্তি জ্বলে যাবে এ রকম গালি। তা না দিয়ে একটা ভদ্র গালি দিচ্ছি। হাজার হলেও আপনি মন্ত্রী মানুষ–তুই গু খা। ফ্রেস গু না, তিন দিনের বাসি গু। যার উপর নীল রঙের মোটা মোটা মাছি ভোঁ ভোঁ করে উড়ছে। মন্ত্রীকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে রশীদ উদ্দিন বের হয়ে গেলেন।

.

এতক্ষণ খায়ের সাহেব সিগারেট হাতে বসেছিলেন এখন সিগারেট ধরালেন। তার ভুরু কুচকে আছে। টেবিলে রাখা টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। ধরবেন না, ধরবেন না করেও তিনি টেলিফোন ধরলেন। তাঁর স্ত্রী টেলিফোন করেছে।

সুরমা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, হ্যালো। হ্যালো।

হুঁ।

এতবড় একটা ঘটনা। তুমি আমাকে কিছুই জানাও নি। আমি খবরটা শোনার পরেই জঙ্গলের মধ্যে দুই রাকাত শুকরানা নামাজ পড়েছি। একটা ছাগল সদকা মানত করেছি। ময়মনসিংহ পৌঁছেই ছাগল দিয়ে দিব।

ভাল।

এই শোনো রেলমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি নিজেই টেলিফোন করেছিলেন। আমরা জঙ্গলে পড়ে আছি শুনে উনি হতভম্ব। যাই হোক ব্যবস্থা করেছেন। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।

খায়ের সাহেব বললেন, কি ভাবে?

তোমাদের ট্রেন আটকে বসে আছে না?

হ্যাঁ। ইনজিন নষ্ট।

ইনজিন নষ্ট তোমাকে কে বলেছে? ইনজিন ঠিকই আছে। রেলমন্ত্রীর নির্দেশে ট্রেন আটকা। আমাদেরকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এক বগির একটা ট্রেন তোমাদের কাছে যাবে। আমরা সেলুনে উঠব তারপর ট্রেন ছাড়বে।

ও আচ্ছা।

তোমার কথাবার্তায় প্রাণ নেই কেন বল তো? এদিকে আমরা খুব হৈ চৈ করছি। জঙ্গলের মধ্যেই কনসার্ট। কি যে মজা হয়েছে। যমুনা এবং যমুনার স্বামী সাম্বা নাচ নেচেছে। ওরা যে সাম্বা নাচতে জানে আমার ধারণাই ছিল না। সেলুন কারে পৌঁছানোর পর ঐ নাচটা আবার করতে বলব।

আচ্ছা।

আমি আর কি ঠিক করেছি জান, এক রাতে জঙ্গলে প্রোগ্রাম করব। তোমার সব বন্ধু-বান্ধবরা থাকবে। জোছনা রাত। রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হবে। ঐ যে উনার বিখ্যাত গান–’আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।‘

হুঁ।

.

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চিত্রা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। চোখের সামনে একটা মেয়ে মরে যাচ্ছে এই দৃশ্যটা সে নিতেই পারছে না। মাওলানার স্ত্রী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার ছেলের দিকে। ছেলেও ড্যাব ড্যাব করে মা’কে দেখছে। কি অদ্ভুত এবং কি করুণ এক দৃশ্য। এই দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করা মুশকিল। চিত্রা বের হয়ে চলে এসেছে।

বাথরুমের পাশের ঘরের দরজা খুলল। একজন ভদ্রমহিলা এসে চিত্রার পাশে দাঁড়ালেন। চিত্রাকে চমকে দিয়ে তার পিঠে হাত রাখলেন। নরম গলায় বললেন, মাগো! আমি খবর পেয়েছি মেয়েটা মারা যাচ্ছে। কেঁদে কি আর মৃত্যু ফেরানো যায়।

চিত্রা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, মৃত্যু ফেরাবার জন্যে কাঁদছিনা। কষ্টে কাঁদছি। এক ঘণ্টা সময় হাতে পেলেও মৃত্যু ফেরানো যেত।

মহিলা বললেন, মা আমি ব্যবস্থা করছি। একটা হেলিকপ্টার আনার ব্যবস্থা করছি। এই জায়গার ঠিক লোকেশন দরকার। রেলের কাউকে খবর দিয়ে আনতে পারবে? যার মাধ্যমে ঠিক ঠিক লোকেশনটা আমি জানতে পারি?

হতভম্ব চিত্রা বলল, আপনি কিভাবে হেলিকপ্টার আনবেন? আপনার পরিচয় জানতে পারি?

মহিলা বললেন, আমার একটাই পরিচয়। আমি একজন দুঃখী মা। ছেলের ডেডবডি নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি। আমার একটাই ছেলে। ছেলের বাবা মারা গেছেন দশ বছর আগে। সময় নষ্ট করে লাভ নেই তুমি রেলের কোনো একজনকে ডাক।

.

ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার রওনা হয়েছে। দু’জন মাত্র যেতে পারবে। রোগীর সঙ্গে যাচ্ছে তার ছেলে এবং আশহাবের মা সাজেদা বেগম। তিনি চিত্রাকে ডেকে কঠিন ভঙ্গিতে বলেছেন–বৌমা আমার ছেলেকে তোমার হাতে রেখে গেলাম। চোখে চোখে রাখবে। সুযোগ পেলেই যেন চুকচুক করে কিছু না খায়। এতদিন আমি দেখেছি। এখন তুমি বাড়ির বৌ তুমি দেখবে।

রশীদ উদ্দিন পাশেই ছিলেন। তিনি চমকে উঠে বললেন, তোমরা এই ফাঁকে বিয়েও করে ফেলেছ। আশ্চর্য তো!

সাজেদা বিরক্ত হয়ে বললেন, আশ্চর্য হবার কি আছে? বয়স হয়েছে বিয়ে করবে না? ধেং ধেং করে প্রেম করে বেড়াবে? কৃষ্ণ লীলা আমার পছন্দ না। আমি প্রেম করার বিপক্ষে। প্রেম যদি করতেই হয়–বিয়ের পরে করা উচিত। সবচে ভাল হয় না করলে।

রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার কথাবার্তা আমার অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। আপনার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হওয়া অতীব জরুরি।

সাজেদা আঁচল তুলে ঘোমটা দিতে দিতে চিত্রাকে বললেন, বৌমা। বুড়াটাকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো। বেলাজ বুড়া।

.

মন্ত্রী সাহেবের আত্মীয়স্বজন চলে এসেছেন। তারা সেলুন কারে উঠেছেন।

ট্রেনের ইনজিন ঠিক হয়ে গেছে। এক্ষুনি ট্রেন ছাড়বে। যাত্রীরা হেলিকপ্টারের চারদিকে ভীড় করে আছে বলে ট্রেন ছাড়া যাচ্ছে না।

হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করেছে। যাত্রীরা বিকট শ্লোগান দিল, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবুল খায়ের! জিন্দাবাদ’। তারা ধরেই নিয়েছে এই কাজটা মন্ত্রী সাহেব থাকাতেই সম্ভব হয়েছে।

সুরমা তার বোন এবং ভগ্নিপতির সঙ্গে হাত-পা নাড়িয়ে গল্প করছেন– তোর দুলাভাইয়ের মানুষের প্রতি মমতাটা কি রকম দেখলি। চিনে না, জানে

একজনের জন্যে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছে। তার যত মমতা পাবলিকের জন্যে নিজের ফ্যামিলির দিকে সে ফিরেও তাকায় না।

যমুনা বলল, আপা তুমি দুলাভাইকে একটা বক্সিং দাও।

সুরমা বললেন, আমি পারব না। তুই দিয়ে আয়।

যমুনা উঠে গেল। খায়ের সাহেবের পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, দুলাভাই! আপনি এত ভাল কেন?

.

কিছুক্ষণের গল্প শেষ। পাঠকদের সামান্য কৌতূহল থাকতে পারে চিত্রা এবং আশহাবের কি হল। ওরা কি বিয়ে করেছে? না-কি যে যার পথে গিয়েছে। অংকবিদ রশীদ উদ্দিনেরই বা কি হল?

রশীদ উদ্দিনের কি হল বলতে পারছি না। উনি পোটলা পুটলি নিয়ে ভুল এক স্টেশনে নেমে পড়েছেন। তার পিছনে পিছনে কি মনে করে জানি মাওলানাও নেমে পড়েছেন।

চিত্রা সাজেদা বেগমের কামরায় ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। গভীর রাতে বাতি-টাতি নিভিয়ে সে ফিস ফিস করে লিলিকে টেলিফোন করল–

এই লিলি হ্যালো। একটা গোপন কথা শুনবি?

অবশ্যই শুনব।

আমি একজনের প্রেমে পড়েছি।

বলিস কি?

অনেকক্ষণ তাকে দেখতে পাচ্ছি না, দুঃখে-কষ্টে আমার মন ভেঙে যাচ্ছে।

লোকটা কে?

ডাক্তার। আশহাব নাম।

উনি কোথায়?

আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

লিলি বলল, গাধামী করবি না। এক্ষুনি দরজা খুলে তাকে ভেতরে ডেকে নে।

কি অজুহাতে ডাকব?

যে কোনো অজুহাতে ডাকবি। মেয়েদের অজুহাতের অভাব আছে নাকি? চিত্রা দরজা খুলে বলল, আমার ক্ষিধে লেগেছে। খাব। খাবারগুলি গরম করে আনার ব্যবস্থা করো তো। চিত্রা মানুষটাকে তুমি তুমি করে বলছে তার মোটেও খারাপ লাগছে না। তার মাথায় একটা দুষ্টামিও ঢুকেছে। সে ঠিক করেছে খাবার সময় আশহাবকে চমকে দিয়ে বলবে, আমি হা করছি আমাকে খাইয়ে দাও।

.

ট্রেন অন্ধকারে ছুটে চলছে। সেলুন কারে গান হচ্ছে–আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। ট্রেনের যাত্রা কি জোছনা স্নাত কোনো অলৌকিক বনের দিকে?

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ