০৫.

অনেকদিন পর আজ ইস্কান্দর আলি রোজা ভাঙ্গলেন। ইচ্ছাকৃত রোজা ভাঙ্গা না। জোহরের আজানের আগে আগে কোন কারণ ছাড়াই মুখ ভর্তি করে বমি করলেন। রোজা ভাঙ্গার কারণ ঘটল। তাঁর মন বেশ খারাপ হয়ে গেল। এমন যদি হত তার কোন অসুখ করেছে তাহলে একটা সান্ত্বনা থাকত। অসুখ বিসুখ কিছু না, শরীর ভাল। বমি করার ফলে শরীরটা মনে হয় আরো ঝরঝরে হয়ে গেছে। চনমনে ক্ষিধে হচ্ছে। চিকন চালের ভাত এবং সর্ষে ইলিশ খেতে ইচ্ছা করছে। অনেক দিন ইলিশ মাছ খাওয়া হয় না। এই অঞ্চলে ইলিশ পাওয়া যায় না।

বিশেষ কোন খাওয়া খাদ্যের জন্যে মন আনচান করাটা দোষনীয় কি না তিনি বুঝতে পারছেন না। খাওয়া খাদ্য আল্লাপাকের একটা নেয়ামত। কাজেই খাওয়া খাদ্যের জন্যে লোভ হলে সেটা দোষনীয় হতে পারে না। আবার অন্যদিকে সবুরের ব্যাপারটাও আছে। সর্ববিষয়ে সবুর করতে বলা হয়েছে। সেই হিসেবে সুখাদ্যের লোভকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না। নবী করিম দিনের পর দিন শুধু খেজুর খেয়ে থাকতেন। ভাল খাদ্যের জন্যে তার কোন লালচ ছিল না।

ইস্কান্দর আলি রান্না চড়ালেন। রোজা যখন ভেঙ্গেই গেছে নিজের হাতে রান্নাবান্না করা যাক। চারটা চাল সেদ্ধ করবেন। সেদ্ধ চালের সঙ্গে একটা ডিম দিয়ে দেবেন। ভাত এবং ডিম একসঙ্গে সেদ্ধ হবে। শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ আবার লবণ দিয়ে ডিমের ভর্তা করে নেবেন। ডিমের ভর্তা দিয়ে গরম ভাত স্বাদু হবার কথা। ঘরে ভাল গাওয়া ঘি আছে। গরম ভাতের উপর গাওয়া ঘি। ফেনভাতে গাওয়া ঘির কোন তুলনা হয় না। ইস্কান্দর আলির জিভে পানি এসে গেল। তিনি খুবই লজ্জিত বোধ করলেন। জিভের পানি লোকজন দেখতে পায় না এটা একটা ভাল ব্যাপার। চোখের পানির মত যদি জিভের পানি টপটপ করে ঠোঁট গড়িয়ে পড়ত তাহলে খুবই লজ্জার ব্যাপার হত। আল্লাহপাকের অসীম করুণা, তিনি মানুষকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। মানুষ একে অন্যকে লজ্জা দিতে পছন্দ করে কিন্তু আল্লাহপাক তার অতি নগণ্য বান্দাকেও লজ্জা দিতে চান না।

ভাত এবং আলু ভর্তার সঙ্গে ডাল থাকলে কেমন হয়? ঘরে মুগ ডাল আছে। কষ্ট করে একটু ডাল বেঁধে ফেললে হয় না? আজ যখন রোজা রাখা হয় নি, খাওয়া দাওয়াটা ভাল করে করা যাক। তিনি আরেকটা চুলায় আগুন দিলেন। হোক আজকের খাওয়া দাওয়াটা ভাল মত হোক। শুধু ইলিশ মাছটা মাথা থাকে দূর হচ্ছে না। বাটা রাই সরিষা, সামান্য লবণ, একটা দুফালা করে কাঁচা মরিচ দিয়ে মাখিয়ে কলাপাতায় ইলিশ মাছ মুড়ে সামান্য আঁচ দিতে হবে। খেতে হবে গরম গরম। ঠাণ্ডা হল কি স্বাদ চলে গেল। এক্কেবারে বেহেশতি খানা। বেহেশতে ইলিশ মাছ কি পাওয়া যাবে? পাখির মাংসের কথা কোরান মজিদে উল্লেখ আছে। তবে ইলিশ মাছও পাওয়া যাবে। বেহেশতী মানুষ যা চাবে তাই পাবে।

রান্না শেষ করে ইস্কান্দর আলি খাবার আয়োজন করলেন। পাটি পাতলেন। থালা সাজালেন। পিরিচে নিমক দিলেন। লেবু কাটলেন। খাওয়া শুরুর আগে নবী-এ করিম সাল্লাহু আলায়হি সালাম জিভে নিমক হুঁয়াতেন। তিনি পাতে লেবু নিতেন কি-না সে কথা কখনো শুনেন নাই। আরব জাহানে কি লেবু আছে?

আসোলামু আলায়কুম!

ইস্কানদর আলি চমকে তাকালেন। দরজা ধরে একজন রোগা অপরিচিত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা মনে হয় অসুস্থ। ঠোঁট মরা মানুষের মত শাদা। চোখ হলুদ। গায়ের চামড়া কুঁকড়ে আছে। মাথার চুল সামান্য মৃত মানুষের মাথার চুল যেমন আলগাভাবে মাথায় লাগান থাকে এরও তাই। মনে হচ্ছে মাথায় হাত বুলালেই হাতের সঙ্গে সব চুল উঠে আসবে।

কেমন আছেন ইস্কান্দর সাহেব?

জ্বি জনাব ভাল।

কী করছেন?

খাওয়ার আয়োজন করছি।

 আমি তো শুনেছি আপনি সারাবছর রোজা রাখেন।

ভুল শুনেছেন জনাব। যেদিন যেদিন আল্লাহপাকের হুকুম হয় সেদিন সেদিন রাখি। আজ হুকুম হয় নাই। সকালবেলা বমি করেছি। বমি করলে রোজা ভেঙ্গে যায়।

বেছে বেছে আজকের দিনেই রোজা ভাঙ্গলেন। আজ আমি ঠিক করেছিলাম আপনাকে ইফতারী করাব।

অন্য আরেকদিন ইফতার করব জনাব।

আপনি কি আমাকে চিনেন? আমি ছদরুল বেপারী।

মওলানা লজ্জিত গলায় বললেন, জনাব আমি আপনার নাম শুনি নাই।

এটা খুবই আশ্চর্যের কথা যে আপনি আমার নাম শুনেন নাই। যাই হোক কি আর করা। কি রান্না করেছেন?

দরিদ্র মানুষের দরিদ্র আয়োজন জনাব। ডাল ভাত।

আমি যদি আপনার সঙ্গে খাই আপনার কি খাবারে কম পড়বে?

জ্বি না জনাব। আল্লাহপাক যদি আমার এখানে আপনার রিজিক রাখেন তাহলে কম পড়বে না। আসুন খেতে বসি।

ভয় নেই আমি খুব সামান্য খাব। ইদানীং হজমের সমস্যা হয়েছে কিছুই হজম করতে পারি না। জাউ ভাত খেলেও টক ঢেকুর উঠে।

ছদরুল বেপারীর সঙ্গের লোকজন ইস্কান্দর আলির বাড়ির উঠোনে ঘুর ঘুর করছিল। ছদরুল বেপারী হাত ইশারায় তাদের চলে যেতে বললেন।

গরম ভাতের উপর ঘি দিতে দিতে ইস্কান্দর আলি বললেন, অতি দরিদ্র আয়োজন, নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।

ছদরুল বেপারী কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণ চোখে খাবারের ব্যবস্থা দেখতে লাগলেন। তাঁকে সামান্য চিন্তিত মনে হল।

এই মেঘ, রৌদ্রছায়া– পাতে ঘি দিয়েছেন? ঘি খাওয়া আমার জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহপাকের নাম নিয়ে খান আল্লাহ পাকের নাম নিয়ে খেলে ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না।

এটাতো মওলানা ঠিক বললেন না, যা নিষিদ্ধ তা সব সময়ই নিষিদ্ধ। খুন নিষিদ্ধ। আল্লাহপাকের নাম নিয়ে খুন করলেও সেই খুন সিদ্ধ হবে না। যাই হোক বিসমিল্লাহ বলে আমি খাচ্ছি। এত নিষেধ মানলে চলে না।

হাত ধুবেন না জনাব? হাত ধোয়ার পানি দিয়েছি।

 হাত ধোয়ার দরকার নাই।

ছদরুল বেপারী খাবার উদ্দেশ্যে বসলেন না। হঠাৎ খেতে চাইলে একজন মানুষ কি করে সেটা দেখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কি মনে করে খাওয়া শুরু করলেন।

ছদরুল বেপারী এত আরাম করে দীর্ঘদিন খান নি। খাবার এমন স্বাদ হয় তা তিনি মনে হয় ভুলেই গিয়েছিলেন।

মওলানা সাহেব আপনার রান্নার হাত চমৎকার। খুবই আরাম করে খেয়েছি। খুবই তৃপ্তি পেয়েছি। সাধারণ খাবারে এত স্বাদ থাকে ভুলেই গিয়েছিলাম।

ইস্কান্দর আলি বললেন খাওয়া খাদ্যে স্বাদ দেবার মালিক আল্লাহপাক। স্বাদ উঠায়ে নেওয়ার মালিকও আল্লাহপাক।

ছদরুল বেপারী বললেন, আমি শুনেছিলাম মৃত্যুর আগে আগে খাওয়ার স্বাদ চলে যায়। এটা কি সত্যি?

এই বিষয় আমি কিছু জানি না জনাব।

আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। যা খাই কোনকিছুতে স্বাদ পাই না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার মৃত্যুর বেশি দেরি নেই। আজ মনে হচ্ছে মৃত্যুর দেরি আছে। খাওয়ার স্বাদ ফিরে এসেছে।

হায়ত-মউতের মালিক আল্লাহপাক। মানুষ এই বিষয়ে কিছুই জানে না। নবী-এ করিমের একমাত্র পুত্র কাশেম যে শৈশবেই মারা যাবে এটা নবী-এ করীম সাল্লালাহ আলাইহিস সালাম জানতেন না। অথচ তিনি ছিলেন আল্লাহপাকের পেয়ারা দোস্ত।

ছদরুল বেপারী সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আপনার সম্পর্কে অনেক কথাবার্তা শুনেছি। কথা যা শুনেছি তা বোধ হয় সত্য না। মানুষ তিলকে তাল বলতে পছন্দ করে। নেংড়া বিড়াল দেখে এলে চোখ বড় বড় করে বলে, নেংড়া বাঘ দেখে এসেছি। তারপরেও আমার ধারণা আপনি সুখি মানুষ। আপনার কাছে কিছু উপদেশ চাই, উপদেশ দিন।

উপদেশ দেওয়ার মত যোগ্যতা আমার নাই জনাব।

যোগ্যতা আছে কি নাই সেটা আমি বিবেচনা করব। আপনাকে পরামর্শ দিতে বললাম আপনি পরামর্শ দিবেন। তার আগে জেনে রাখুন আমি খুবই দুষ্ট প্রকৃতির লোক। শয়তানের সঙ্গে আমার একটাই অমিল শয়তান অন্যদের খারাপ করার চেষ্টা করে আমি চেষ্টা করি না। নিজে খারাপ কাজ করি। এতেই আমি খুশি। অন্যকে খারাপ বানায়ে খুশি হবার প্রয়োজন আমার নাই। বুঝতে পারছেন কি বলছি?

ইস্কান্দর আলি হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। তার সামনে বসে থাকা লোকটি যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা তিনি বুঝতে পারছেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কথা বলার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। এই ভঙ্গি সে আয়ত্ব করে না। আপনাতেই তার মধ্যে চলে আসে।

ইস্কান্দর আলির ধারণা তার নিজের মধ্যে এই ভঙ্গি চলে এসেছে। তার নিজের কথা বলার ভঙ্গি এখন তাঁর কাছেই অপরিচিত লাগে। কথা বলার সময় মনে হয় সে কথা বলছে না অন্য কথা বলছে।

মওলানা সাহেব?

 জ্বি।

আমি অতি দুষ্ট একজন মানুষ। এটা আমি বিনয় করে বলছি না। বিনয় আমার মধ্যে নাই। অবশ্য আমার মধ্যে অহংকারও নাই। আমি যা, আমি তা। এ নিয়ে বিনয় করারও কিছু নাই, অহংকার করারও কিছু নাই। আমি কি ঠিক বলেছি মওলানা সাহেব?

বুঝতে পারছি না জনাব। আমার জ্ঞান বুদ্ধি অত্যন্ত কম। যে যা বলে আমার কাছে মনে হয় সেটাই সত্যি।

ছদরুল বেপারী আগের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে নতুন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন– আপনি লোকটা হয় অতি চালাক নয় অতি বোকা। কোনটা এখনো ধরতে পারছি না। তবে ধরতে পারব।

জনাব, আপনি মানুষটা কেমন?

আমি বোকা। তবে শয়তানি চালাকি আমার আছে। শুধু আছে বললে কম বলা হয়- অনেক বেশি আছে। আমি আবার নিজের যা মন্দ তা বলে ফেলি। পেটে কিছু রাখি না। আমার হজমের গণ্ডগোল আছে এইজন্যই পেটে কিছু রাখতে পারি না। কথা হজম হয় না বলে বমি করে ফেলি। হা হা হা।

ইস্কান্দর আলি নিচু গলায় বললেন, নিজের মন্দটা বললে দোষ কাটা যায় না। যা মন্দ, বলে বেড়ালেও মন্দ। না বলে বেড়ালেও মন্দ।

দোষ কাটার জন্যে তো বলি না। বলতে ভাল লাগে এই জন্যে বলি। মানুষের এই এক বিচিত্র স্বভাব। যে ভাল কাজ করে সে ভাল কাজের কথা বলে আনন্দ পায়। যে মন্দ কাজ করে সে মন্দ কাজের কথা বলে আনন্দ পায়। আপনার এখানে পান আছে মওলানা সাহেব?

জ্বি না, পান নাই।

 পান খাইতে ইচ্ছা করতেছে।

 আপনে বসেন আমি নিয়া আসি।

দরকার নাই। তারচে বরং গল্পগুজব করি। আপনার চরিত্রে খারাপ কি আছে বলেন তো শুনি। ভাল মানুষ অন্য মানুষের চরিত্রে ভাল কি আছে। শুনতে চায়। খারাপ মানুষ চায় অন্যের খারাপটা শুনতে।

নিজের খারাপ জিনিসটাতো নিজের বলা মুশকিল।

মুশকিল হবে কেন? আপনার খারাপটাতে সবচে ভাল আপনি জানবেন। আমারটা যেমন আমি জানি। আমার খারাপ কি বলব?

দরকার নাই জনাব।

দরকার অদরকার কিছু নাই। শুনেন বলি, বলতে ইচ্ছা করতেছে। আমার সবচে বড় দোষ হল আপনার মেয়ে মানুষের দোষ। কোন মেয়ে মানুষ একবার যদি চোখে লেগে যায় তাহলে সর্বনাশ।

মওলানা তাকিয়ে আছেন। কি আশ্চর্য মানুষ কত সহজেই না কত ভয়ংকর কথা বলছে। যে মানুষ সহজে ভয়ংকর কথা বলে সে সহজে ভয়ংকর কাজও করে।

ছদরুল বেপারী গলা নিচু করে বললেন মেয়ে মানুষের দোষ কাটার কোন তাবিজ কি আছে?

মওলানা ইস্কান্দার বললেন, আমি তাবিজের বিষয়ে কিছু জানি না।

না জানলে কি আর করা?

ছদরুল বেপারী উঠে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দুটা পাঁচশ টাকার নোট এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, টাকাটা রাখেন মওলানা সাহেব। সামান্য উপহার।

চকচকে নতুন নোট। ইস্কান্দর আলির ইচ্ছা করছে বলেন, জনাব আমি আপনার টাকা নিব না। মন্দ মানুষের উপহার গ্রহণ করা নিষেধ আছে। ইস্কান্দর আলি তা বলতে পারলেন না। হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলেন। টাকাটার দরকার। হাত একেবারে খালি। শীত আসছে এই অঞ্চল শীত বেশি পড়ে। লেপ কেনা দরকার। ভাল কাঁপাসি তুলার একটা লেপের দাম তিনশ টাকা। মশারিও কেনা দরকার। তাঁর মশারিটা ইঁদুর খেয়ে ফেলেছে। বড় ইঁদুরের উপদ্রব। ইঁদুর মারা একটা কল কিনতে হবে।

ছদরুল বেপারী সামান্য হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, শুরুতে বলেছিলাম না আপনার উপদেশ চাইতে এসেছি। এটা ঠিক না। আমি কারো উপদেশে চলি না। আবার কারো দোয়ার ধারও ধারি না। আপনার সম্পর্কে নানান কথা শুনি, আপনাকে দেখার ইচ্ছা ছিল। দেখা হয়েছে এতেই আমি খুশি।

ভরপেট খাওয়ার পর ছদরুল বেপারীর শরীর সব সময় হাঁসফাঁস করে, নিশ্বাসেও সামান্য কষ্ট হয়। আর সে রকম কিছু হচ্ছে না। শরীর ঝরঝরে লাগছে। একটা পান খাওয়া দরকার। কাঁচা সুপারি সঙ্গে কড়া জদা। ডাবল একসান। এই গ্রামে চা পান সিগারেটের দোকান এখনো চোখ পড়ছে না। আছে নিশ্চয়ই এখনকার গ্রাম আর আগের মত না। পান ফুরিয়ে গেল তো গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা কর হাটবারের জন্য। বুধবার হাট। বুধবারের আগে পান পাওয়া যাবে না। সে গ্রাম আর নেই।

ছদরুল বেপারী মওলানার ঘর থেকে বের হতেই তার সঙ্গের লোকজনদের দেখা পেল। তারা আশেপাশেই ঘাপটি মেরে ছিল। তাদের দায়িত্ব ছদরুল বেপারীকে ছায়ার মত অনুসরণ করা, তারা সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। তাদের একজনের সঙ্গে পিস্তল আছে। চোরাই পিস্তল না। লাইসেন্স করা পিস্তল। পিস্তলের দাম সাত হাজার টাকা আর লাইসেন্স বের করার ঘুষের দাম এক লাখ দশ হাজার। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া বের হওয়া ছদরুল বেপারীর মত মানুষের সমস্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে শুক্র। আগে শত্রু মিত্র চেনা যেত এখন তাও যায় না। মিত্র ভাবে যে খুব কাছে আসে দেখা যায় সে মহা শত্রু।

গত চার বছরে দুবার ছদরুল বেপারীকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথম বার তো মেরেই ফেলেছিল। বর্শা পেটে ঢুকিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল। সেই আঘাত সামলানো গেছে। দ্বিতীয়বারে অবশ্যি প্রথমবারের মত ভয়ংকার হয় নি। তবে হতে পারতো। এখন ছদরুল বেপারী অনেক সাবধান। তবে সাবধান হয়েও লাভ নেই। কপালে যা থাকবে তাই হবে। বেহুলার মত সাবধান স্ত্রীর স্বামীকেও সাপের কামড় খেতে হয়েছে। লোহার ঘর বানিয়েও রক্ষা হয়নি। তারপরও যতটুকু পারা যায় সাবধান থাকা।

ছদরুল বেপারী একজনকে কাঁচা সুপারি জদা দিয়ে পান আনতে পাঠালেন। সেই সঙ্গে বলে দিলেন মাহফুজকে খবর দিতে। মাহফুজের সঙ্গে জরুরি আলাপগুলো সেরে ফেলা দরকার। আলাপটা ক্লাবঘরে হবে। ক্লাবঘরের উঠানে না হয়ে ঘরের ভেতর হবে। উঠকো মানুষ যেন না থাকে। যদিও জরুরি সব আলাপ অনেক মানুষের সামনে হওয়া দরকার। যাতে সাক্ষী থাকে। ছদরুল বেপারী ক্লাবঘরের দিকে রওনা হলেন। মাহফুজের সঙ্গে কথা বলবেন, ভাঙ্গা মসজিদটা দেখবেন। নতুন একটা মসজিদ এই গ্রামে করে দেয়া যায়। মসজিদ বানিয়ে দেয়ার কথা কেউ এখনো তাকে বলে নি। না চাইতে তিনি কিছু দেন না। তার কাছে চাইতে হবে। বিকেলে যাবেন সুলতান সাহেবের সঙ্গে কথা বলার জন্যে। তারপর সন্ধ্যায় টিপু সুলতান নাটক- ভুজঙ্গ বাবুর অনেক নাম ডাক। তার নাটক আগে দেখা হয় নি। এইবার দেখা যাবে। তিনি সোনার একটা মেডেল স্যাকরার দোকান থেকে নিয়ে এসেছেন। যার অভিনয় ভাল হবে তাকে দেবেন। মেডেল ভুজঙ্গ পাবে এটাতো বলা বাহুল্য। আরেকটা মেডেল থাকলে ভাল হত। মেয়েটাকে দেয়া যেত। নাটকের মাঝখানে সোনার মেডেল ডিক্লেয়ার করা আনন্দময় ঘটনা। চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। নাটক যারা করে তাদের চেয়ে মেডেল যে দিচ্ছে সে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ছদরুল বেপারী ঠিক করলেন আরেকটা মেডেল কিনতে কাউকে পাঠাবেন। মেডেল যে দিতেই হবে এমন কোন কথা নেই, হাতে থাকল। এমনওতো হতে পারে তিনি নাটক দেখতেই গেলেন না। মানুষেরা সিদ্ধান্ত অতি দ্রুত বদলায়। জোয়ার ভাটা হয় নির্দিষ্ট সময়ে। মানুষের জোয়ার ভাটার কোন সময় নেই। নিয়মও নেই। এই জোয়ার এই ভাটা। আবার উল্টোটাও হয়–এই জোয়ার, এই আবার জোয়ার। তারপর আবারও জোয়ার। ভাটার দেখা নেই।

.

আজ কি ছদরুল বেপারীর কপাল ভাল যাচ্ছে? পান খাচ্ছেন অথচ পান ঝাল লাগছে না। তাঁর জিভে কি যেন হয়েছে বলে পান খেতে পারেন না। ঝাল লাগে। ডাক্তার বলেছে ভিটামিন বি এর অভাব সেই ভিটামিনও গাদা খানিক খেয়ে দেখেছেন। লাভ হয় নি। তাকে পান খেতে হয় খুব কষ্ট করে। আজ কষ্ট হচ্ছে না। একটু পর পর পানের পিক ফেলতে হচ্ছে না। পানের পিকেও ঝাল নেই। আশ্চর্য তো।

তিনি বসে আছেন ক্লাবঘরের ভেতরে। জরুরি কিছু আলোচনা করবেন মাহফুজের সঙ্গে। মাহফুজ তার সামনে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে। সে কোন একটা ব্যাপারে চিন্তিত। তার নাটকের জোগাড় যন্ত্রে বোধ হয়। ঝামেলা হয়েছে। ভুজঙ্গ শেষ মুহূর্তে জানিয়েছে তার পাতলা পায়খানা হচ্ছে সে আসতে পারবে না।

ক্লাব ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। ক্লাবঘরের বাইরে ছদরুল সাহেবের লোকজন হাঁটাহাটি করছে। একজন শুধু ভেতরে। তার বগলে চামড়ার একটা ব্যাগ। তার গায়ে ছাই রঙের চাদর। চাদর দিয়ে সে চামড়ার ব্যাগ ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে ব্যাগের কোনা বেরিয়ে পড়ছে, সে তৎক্ষণাৎ অতিরিক্ত ব্যস্ততায় গায়ের চাদরে ব্যাগ ঢাকছে।

ছদরুল বেপারী একটু ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, মাহফুজ মিয়া কেমন আছ?

মাহফুজের নামের শেষে মিয়া নেই ছদরুল বেপারী তার পছন্দের মানুষদের নামের শেষে আদর করে মিয়া যুক্ত করেন। মাহফুজকে তার পছন্দ হয়েছে।

মাহফুজ চিন্তিত গলায় বলল, জ্বি ভাল।

 তোমারে চিন্তিত লাগছে কেন?

 জ্বি-না, আমি চিন্তিত না।

ভুজঙ্গ এখনো আসে নাই?

জ্বি-না। তার অ্যাসিসটেন্ট চলে এসেছে।

মাঝেমাঝে এ রকম হয়- অ্যাসিসটেন্ট আসে। আসল আর আসে না। তখন কি করা লাগে জান? তখন এ্যসিসটেন্টকে ধরে মাইর দিতে হয় গরু চোরের মাইর। বস্তার ভিতরে ঢুকায়ে মাইর। শইল্যে দাগ পড়ব না। হা হা হা।

মাহফুজ কিছু বলল না। ছদরুল বেপারী হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাহফুজ বলল, আপনার কি ইস্কান্দর আলির সঙ্গে দেখা হয়েছে?

ছদরুল বেপারী বললেন, দেখা হয়েছে। তার সঙ্গে খানাপিনা করলাম। বোকা লোক। তবে বোকা লোকরাই সংসারে ঝামেলা তৈরি করে। বুদ্ধিমান লোকদের কাছ থেকে সাবধান থাকার দরকার নাই। বুদ্ধিমান লোকরা নিজেরা ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চায় বলে ঝামেলা করে না। বোকারা এইসব বুঝে না বলে ঝামেলা করে। ইস্কান্দর আলির বিষয়ে তোমাকে সাবধান করে দিলাম। একে গ্রামে রাখা ঠিক না। এখন আমি কাজের কথা শেষ করি। তুমি এমন চিন্তিত মুখ করে বসে থাকবে না। চিন্তা দূর কর। সহজভাবে বস।

মাহফুজ সহজ হয়ে বসার চেষ্টা করল। ছদরুল বেপারী সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমারে আমি সর্বমোট দশ লাখ টাকা দিব। ছয় লাখ নগদ। বাকি চার লাখ টাকার দিব ইট সুরকি। আমার ইটের ভাটা আছে। সেখান থেকে ইটা আনবা। আনার খরচ তোমার। সৎ কাজ করে আমি বেহেশতে যাব। হুরপরীদের সাথে রং ঢং করব এই ইচ্ছা আমার নাই। পরের টাকায় সৎ কাজ করে তুমি যদি বেহেশতে যাইতে পার যাও। সেইটা তোমার ব্যাপার। আমি আর দশটা লোকের মত না। মুখে বলব এত টাকা দিলাম তারপরে আর খোঁজ নাই। আমি যা করি নগদ নগদ করি। তোমার ছয় লাখ টাকা আমি নিয়া আসছি। ঐ কালো চামড়ার ব্যাগে টাকাটা আছে। টাকা গোণার দরকার নাই। টাকা গোণা আছে। তোমাকে কোন রশিদও দিতে হবে না। আমি তোমারেই পুরাপুরি দিলাম। আমি তোমার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছি। তুমি বেতাল কিছুই করবা না। টাকা নষ্ট হবে না। ঠিক বলেছি?

জ্বি ঠিক বলেছেন।

স্কুল কলেজের কাজ শুরু করে দেও। যদি কোনদিন ঠেকে যাও আমি বেঁচে থাকলে আমার কাছে আসবা। পথের ফকির লোক যারা কোটিপতি হয় তারার খুবই টাকার মায়া থাকে। একটা পয়সা খরচ করতে তাদের কলিজায় লাগে। আমার হয়েছে উল্টা। আমার কলিজায় কিছু লাগে না। কারণ আমার কলিজা নাই যাই হোক এখন তোমারে একটা প্রশ্ন বল দেখি আমি যে এত টাকা দান খয়রাত করি– কেন করি? পুণ্যের আশায় যে করি না এটাতো তোমকে আগেই বললাম। তাহলে করি কেন?

জানি না।

এইসব করি যাতে লোকজন আমার দিকে অন্য ভাবে চায়। আমাকে দেখে যেন ফিসফিস করে বলে- ঐ যায় ছদরুল বেপারী। তোমার স্কুল কলেজ তৈরি হবার পর আমি একদিন স্কুলের সামনে রাস্তা দিয়ে লুঙ্গি পরে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে হেঁটে যাব। তখন স্কুলের সব ছাত্র শিক্ষক পড়া বন্ধ করে আমারে দেখবে। ফিসফিস করে বলবে- ছদরুল সাব যায়। এই ফিসফিসানি শোনার জন্যে করি বুঝলা?

জ্বি।

আচ্ছা এখন অন্য একটা বিষয় নাটকের যে মেয়েটারে তুমি এনেছ তার নাম যেন কি?

চিত্রা।

চিত্রা? আমি প্রথমে ভুল শুনেছিলাম। আমি শুনেছিলাম চিতা, অবাক হয়ে ভেবেছিলাম বাঘের নামে মেয়েছেলের নাম হবে কেন? যাই হোক এই মেয়ে তুমি ময়মনসিংহ থেকে এনেছ?

জ্বি।

সে ময়মনসিংহ যাবে কবে?

কাল তাকে আমি দিয়ে আসব।

ছদরুল বেপারী হাই তুলতে তুলতে বলল, তোমার দিয়া আসার দরকার নাই। আমি নিজে কাল ময়মনসিংহ যাব। আমি তারে যেখানে যেতে চায় দিয়া আসব। তোমার দায়িত্ব শেষ। সব দায়িত্ব এখন আমার। তুমি তারে নাটকের শেষে আমার ওখানে পৌঁছায়ে দিবা। ঠিক আছে? থাক তোমার পৌঁছায়া দেয়ার দরকার নাই। আমার লোকজন তারে নিয়া যাবে।

মাহফুজ খুবই অবাক হয়ে তাকাল। মনে হচ্ছে সে কথাগুলোর অর্থও ধরতে পারছে না। ছদরুল বেপারী হাসিমুখে বললেন আমার কথা শুইন্যা তুমি মনে হয় খুব অবাক হইলা।

জ্বি, অবাক হয়েছি।

অবাক হওয়ার কিছু নাই। এই ধরনের মেয়েরা নাটকের বাইরেও এইভাবে কিছু বাড়তি রোজগার করে। এতে তারার নিজেদের সংসার ভাল চলে আর আমার মত দুষ্ট লোকরারও কিছু সুবিধা হয়।

মেয়েটা এ রকম না।

তোমার কাছে হয়ত না। তোমার কাছে এই মেয়ে ভাল ভাল কথা। বলেছে। আমার সাথে বলবে না। যাই হোক তুমি এত দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। এই মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা যা বলার আমার লোকজন বলবে। তারপর যদি এই মেয়ে আমার সঙ্গে ময়মনসিং যেতে চায় আমার সঙ্গে যাবে। আর যদি যেতে না চায় থাকবে। জোর জবরদস্তির কোন ব্যাপার না। সবই হবে আপোষে। এতে কি তোমার অসুবিধা আছে।

জ্বি অসুবিধা আছে। আমি মেয়ের মাকে কথা দিয়ে এসেছি আমি নিজে তাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।

তুমি তোমার কথা রাখার চেষ্টা কর। তুমি তোমার কাজ করার চেষ্টা করবে। আমি আমার কাজ করার চেষ্টা করব।

মাহফুজের মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। পান ঘেঁছার মত শব্দ হচ্ছে। খটখট খটখট খটাখট। খটখট খটখট খটাখট। দাদীজান শুধু যে পান খাচ্ছেন তাই না, মনে হচ্ছে মুচকি মুচকি হাসছেনও। এখন মনে হচ্ছে। কথাও বললেন– আবু ও আবু কি হইছে?

দাদীজান চুপ করেন। আমি বিপদের মইধ্যে আছি।

তোরে বলছিলাম না। মেয়েটারে নিয়া আইস্যা ভাল করস নাই। বলছিলাম, কি বলি নাই?

হ্যাঁ বলছিলেন।

 এখন দেখতেছস কত বড় বিপদ?

হু।

বৃদ্ধা পান ঘেঁছে যাচ্ছেন। খটাখট খটখট শব্দ হচ্ছে। মাহফুজের মাথায় যন্ত্রণা ক্রমেই বাড়ছে।

ছদরুল বেপারী বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে?

মাহফুজ কিছু বলল না। ছদরুল বেপারী নিচু গলায় বললেন, তোমার চোখ টকটকা লাল।

আমার মাথায় যন্ত্রণা।

বেশি?

 হ্যাঁ বেশি।

আমার কথাবার্তা শুনে কি মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে?

 জ্বি।

তাহলে আমি খুবই শরমিন্দা। যাই হোক, তুমি টাকাটা নাও। নিয়ে। চলে যাও।

মাহফুজ বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনার টাকা আমি নিব না। ছদরুল বেপারী মাহফুজের কথায় চমকালেন না, বা বিস্মিতও হলেন না। মনে হয় তিনি ধরেই নিয়েছিলেন মাহফুজ এই ধরনের কথা বলবে। কিংবা তিনি যে কোন ধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত।

তুমি আমার টাকা নিবে না?

জ্বি না।

কেন? আমি দুষ্ট লোক বলে? আমি যে দুষ্ট এটাতো তুমি আগেই জানতে। জানার পরেও তো টাকার জন্য গিয়েছ। যাও নাই?

মাহফুজ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

ছদরুল বেপারী সহজ গলায় বললেন, মানুষ মন্দ হয়। মানুষের টাকা মন্দ হয় না। টাকার গায়ে ভাল মন্দ লেখা থাকে না। ভাল মানুষের টাকা দিয়েও যেমন অতি মন্দ কাজ করা যায়, মন্দ মানুষের টাকা দিয়েও অতি ভাল কাজ করা যায়। এই দেশের বেশির ভাগ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কারা করেছেন? পয়সাওয়ালা লোকেরা করেছেন। যাদের প্রচুর টাকা পয়সা থাকে তারা সেই টাকা পয়সা কিভাবে জোগাড় করে? নানান ফন্দি ফিকির করে জোগাড় করে। ধান্ধাবাজি করে জোগাড় করে, কালোবাজারি করে জোগাড় করে। অতি সৎ যে মানুষ তার ঘরে টাকা জমে না। বুঝেছ? সৎ মানুষের ডাল থাকে তো নুন থাকে না।

জ্বি বুঝেছি।

কাজেই ধরে নিতে পারি এই দেশের বেশির ভাগ সৎ কর্ম করা হয়েছে– নষ্ট মানুষের দানে। যুক্তি কি তুমি মান?

মানি।

এখন তাহলে আমার টাকা নিতে তোমার অসুবিধা নাই।

আমার অসুবিধা আছে। আমি আপনার টাকা নিব না।

মাথার ভেতর খটখট শব্দটা বাড়ছে। বুড়ি বড় যন্ত্রণা করছে। বুড়ি আবার কথা বলা শুরু না করলেই হয়।

মাহফুজ উঠে দাঁড়াল।

 ছদরুল বেপারী বললেন, চলে যাচ্ছ না-কি?

মাহফুজ বলল, জ্বি।

আচ্ছা ভাল। সৎ কাজ সৎ অর্থে করাই ভাল। তোমার চোখ যে রকম লাল হয়েছে, তোমাকে দেখে ভয় লাগছে। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম কর।

ছদরুল বেপারী একজনকে সোনার মেডেল কিনতে পাঠিয়ে দিল। তার এখন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ক্লাব ঘরে খাট পাতা আছে। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়া যায়।

মাহফুজ ক্লাবঘর থেকে বের হল। সে ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। লক্ষণ ভাল না। তার শরীর এখন অতি দ্রুত খারাপ করবে। চোখ হবে পাকা করমচার মত লাল। সে রোদের দিকে তাকাতে পারবে না। তার দাদীজান মাথার ভিতরে এসে পান হেঁচতে হেঁচতে কথা বলা শুরু করবে। বুড়ো-বুড়ি এমিতেই কথা বলে। মৃত্যুর পর বুড়ির কথা বলা খুব বেড়েছে। বুড়ির সব কিছুতেই নাক গলাতে হবে। সব। বিষয়ে কথা বলতে হবে। বুড়ির কোন কথা এখন শোনার দরকার নেই। বুড়ি উল্টাপাল্টা কথা বলতে থাকুক। সে শুধু শুনে যাবে। জবাব দেবে না।

বুড়ির মাথার ভেতর ডেকে উঠল, আবু। ও আবু?

মাহফুজ জবাব দিল না। বুড়ি তাতে দমবার পাত্রী না। সে ডেকেই যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে মাহফুজ এক সময় বলল, কি চাও?

বুড়ি বলল, আমি কিছু চাই না। তুই ভয় পাইছস?

ভয় পাব কি জন্যে?

ছদরুল বেপারীর সাথে বিবাদ করছস ভয় তো পাওনেরই কথা। হে তরে চাইটা খাইয়া ফেলব। হে হইল চাইট্টা খাউড়া।

চুপ কর।

তরে একটা বুদ্ধি দেই।

 কি বুদ্ধি?

বুড়ির বুদ্ধি তুই শুনবি?

না।

তাইলে আর বুদ্ধি দিয়া লাভ কি?

কোন লাভ নাই। তুমি তোমার পান খাও।

আইচ্ছা।

বুড়ি পান ঘেঁছা শুরু করল। খটখট খটখট। খটাখট খটাখট। এরচে বুড়ির কথা শোনা ভাল ছিল। বাঁশের চোঙে পান ঘেঁছার শব্দ অসহ্য লাগছে। সেই বাঁশও ফাটা বাঁশ। এক সঙ্গে দুই তিন রকম শব্দ হচ্ছে।

ও আবু। আবু।

হু।

নাটক বাদ দে, মাইয়াটারে তার মার কাছে পাঠাইয়া দে। এক্ষণ লইয়া রওনা দে। তোর সাথে বাদাইম্যা কিছু পুলাপান আছে। এবারে সাথে কইরা নে।

নাটক করব না?

দূর ব্যাটা নাটক- জানে বাঁচলে নাটক থিয়েটার।

এইসব কথা বইল্যা লাভ নাই দাদীজান। নাটক হবে। প্লের নাম টিপু সুলতান।

নাটকের শেষে ছদরুল বেপারী যখন মেয়ে তুইল্যা নিয়া যাবে তখন তুই কি করবি?

দুনিয়া কি অত সোজা দাদীজান?

হরে ব্যাটা দুনিয়া সোজা। যারার টাকার পয়সা আছে, ক্ষমতা আছে। এরা দুনিয়াটারে সোজা বানাইয়া ফেলতে পারে। ছদরুল বেপারী দুইটা খুন করছে। তার কিছু হইছে? কিছুই হয় নাই।

তুমি চিত্রারে ময়মনসিং পাঠাইয়া দিতে বলতেছ?

আরেকটা বুদ্ধি আছে।

 কি বুদ্ধি?

তুই তো আমার বুদ্ধি শুইন্যা হাসবি। তয় আমি বুড়ি মানুষ, মনে যেটা আসে কইয়া ফেলি, আমার কথায় হাসনেরও কিছু নাই, কান্দনেরও কিছু নাই।

তোমার বুদ্ধিটা কি?

মাইয়াটারে বিবাহ কইরা ফেল।

কি কইলা?

ইস্কান্দর মাওলানারে খবর দিয়া আন তুই। গোসল কইরা একটা পাঞ্জাবী পিন্দা ফেল- ঈদের পাঞ্জাবীটা আছে না?

দাদীজান চুপ করেন।

মাইয়াটারে তো তর পছন্দ হইছে।

কে বলছে পছন্দ হইছে?

আচ্ছা যা পছন্দ হয় নাই মাইয়াটা বিপদে পড়ছে তারে বাঁচাইবি না? মাইয়াটারে বিবাহ করলে তর লাভ বিনে ক্ষতি নাই। তোর মহা লাভ।

কি লাভ?

ভাড়া কইরা নাটকের মেয়ে আননের দরকার হবে না। ঘরেই আছে। নাটকের মেয়ে। হি হি হি।

খবদার দাদী হাসবা না।

আইচ্ছা যা হাসব না। তুই এক কাম কর ছদরুল বেপারীরে গিয়া ক, মেয়েটারে তুই বিবাহ করতেছস। ছদরুল লোক খারাপ, তাই বইল্যা ঘরের বউ নিয়া চইল্যা যাবে না।

আর কথা না দাদী, চুপ।

আচ্ছা যা চুপ করলাম।

পানও খাইতে পারবা না। পান খাওয়া খাওয়ি বন্ধ।

এইটাতে পারব নারে ব্যাটা।

বুড়ি পান ঘেঁচা শুরু করল। মাহফুজ এলোমেলো পা ফেলে তার। বাড়ির দিকে রওনা হল। হাঁটা দূরের কথা, সে দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না। বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে। অথচ তার এখন প্রাইমারী স্কুলের দিকে যাওয়া দরকার। স্কুলের মাঠে স্টেজ বানানো হচ্ছে। সামছু আছে স্টেজের দায়িত্বে। সামছুর কাজ খুবই গোছানো। কোন রকম ঝামেলা হবে না। তারপরও খোঁজ নেয়া দরকার। কিছু চেয়ারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশিষ্টজনরা আসবেন। তারাতো আর পা লেপ্টে চাটাইয়ের উপর বসবেন না। মেয়েদের বসার জন্যে আলাদা জায়গা করার জন্যে বলা হয়েছে। পুরুষ এবং মহিলাদের মাঝখানে চিকের পর্দা থাকার কথা। চিকের পর্দা পাওয়া যাচ্ছে না। হ্যাঁজাকের জন্যে একজনকে নেত্রকোনা পাঠানো হয়েছে। যাকে পাঠানো হয়েছে সে কোন কাজই ঠিকঠাক মত করতে পারে না। যে কাজে কোন ঝামেলা নেই সেই কাজেও সে ঝামেলা পাকায়। হ্যাজাক সে নিয়ে আসবে ঠিকই দেখা যাবে মেনটল আনে নি। নাটকের লোকরা রাতে খাবে। নাটক শুরু করার আগে হালকা কিছু খাবে। শেষ হবার পর ভালমত খাবে। খাবারের দায়িত্ব হয়েছে মনিরুদ্দিনকে, সে কি করল না করল তার খোঁজ নেয়াও দরকা। ভুজঙ্গ বাবুকে আমার জন্যে মনিরকে পাঠানো হয়েছে। ভুজঙ্গ বাবু আবার জিনিস না খেয়ে স্টেজে উঠতে পারেন না। স্টেজে ওঠার আগে এক গ্লাস কেরোসিন হলেও তাকে খেতে হবে। মনির যদি বুদ্ধি করে দুএকটা বোতল নিয়ে আসে তাহলে সমস্যা নেই, না আনলে আরেকজনকে নেত্রকোনা পাঠাতে হবে।

মাহফুজ হাঁটতে শুরু করল। কোন কিছু নিয়েই সে এখন দুঃশ্চিন্তা করবে না। সে চোখ বন্ধ করে সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত শুয়ে থাকবে।

মাহফুজ খাড়াও। তুমি দেখি আন্ধার মত চলতেছ। আমার সামনে দিয়া গেলা আমারে দেখলা না।

মাহফুজ থমকে দাঁড়াল। ক্ষুব্ধ মুখে গণি মিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। রোদ তেমন নেই, তারপরও একজন তার মাথার উপর ছাতা ধরে আছে। মাহফুজ লজ্জিত গলায় বলল, গণি চাচা আমার দিশা নাই, শরীরটা খুব খারাপ করছে। মনে হয় জ্বর আসতেছে।

তোমার শরীর যে খারাপ এইটা বুঝতেছি। চউখ লাল।

গণি মিয়া কি বলছেন মাহফুজের কানে ঢুকছে না। সে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছে।

লোকমুখে শুনতেছি ছদরুল বেপারী ১০ লাখ টাকা নগদ দিতেছে। ঘটনা কি সত্য?

আমি এখনো কিছু জানি না।

দিলে আমি আচাৰ্য্য হব না। পথের ফকির থাইক্যা পয়সা হইছে এই জন্যে পয়সা লোকজনরে দেখাইতে চায়। ছদরুল বেপারীর মা বাজারের নটিবেটি ছিল এইটাতো জান? টাকা দেখাইয়া মার কলংক ঢাকতে চায়। টেকায় কলংক ঢাকে না।

চাচা আমি যাই, শরীরটা খুব খারাপ লাগতেছে।

শোন মাহফুজ, সুলতান সাবের সাথে আমার বসার ব্যবস্থা রাখবা। গেরামে আমার ইজ্জত আছে এইটা খিয়াল রাখবা। ছদরুল তো সুলতান সাবের সাথে বসব। দশ লাখ টাকা দিতাছে সে না বসলে কে বসব? এক ধার দিয়া হে বসুক, আরেকধার দিয়া যেন আমি বসি। দশ লাখ না দিলেও আমি কিছু দিব। আমারতো দশ লাখ দেওনের দরকার নাই। আমার মা তো নটিবেটি ছিল না। কি কও?

মাহফুজ চুপ করে রইল গণি মিয়া বললেন– তিনটা গদিওয়ালা চিয়ার আমি পাঠাইয়া দিছি।

জ্বি আচ্ছা।

পাঁচ দশ মিনিট কথা বলার সুযোগ থাকলে আমারে বলবা। কয়েকটা চুম্বক কথা পাবলিকরে বলব। এতে তোমার লাভ বিনে ক্ষতি হবে না। ঠিক আছে?

জ্বি, ঠিক আছে।

তোমার শরীরের অবস্থা বড়ই শোচনীয়। যাও বিশ্রাম কর গিয়া। আগে শরীর ঠিক রাখবা। ধন দৌলত কিছু না। স্বাস্থ্যই আসল। ছদরুল বেপারীরে দেখ তার কি টাকা পয়সার অভাব আছে? কিন্তু তার স্বাস্থ্যটা দেখ। শুনছি কিছুই হজম করতে পারে না। পানি খাইলেও না- কি বদ হজম হয়। চোকা ঢেকুর ওঠে।

.

মাহফুজ ঘরের দিকে রওনা হল। মাথার যন্ত্রণা বাড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যই হুঁস জ্ঞান বলে কিছু থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এটা খারাপ না। যার হুঁস জ্ঞান নাই তার দুঃশ্চিন্তা নাই। সবচে সুখি মানুষ হল মৃত মানুষ।

.

চিত্রা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিল। তার হাতে নাটকের বই। পাঠ তার মুখস্ত। তারপরেও চোখ বুলিয়ে যাওয়া। মফঃস্বলের নাটকে মেয়েদের রিহার্সেলের দরকার হয় না। নাটকের আগে তাদের স্টেজে তুলে দেয়া হয়। চিত্রা বই থেকে মুখ তুলে খুবই আশ্চর্য হল। মাহফুজ উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন নিজের বাড়িঘর চিনতে পারছে না। মাহফুজকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে টপটপ করে চোখ দিয়ে রক্ত। পড়বে। চিত্রা দেখে আঁৎকে উঠে বলল, আপনার কি হয়েছে? মাহফুজ চট করে জবাব দিতে পারল না। তাকিয়ে রইল। তার কেমন যেন ধাঁধার মত লাগছে। চিত্রা মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে কেন? সকালেও তো এত সুন্দর লাগে নি। অবশ্যি এখন বিকাল। আকাশে সামান্য মেঘ আছে। মেঘলা বিকালে কন্যা সুন্দর আলো বের হয়। সেই আলো মনে হয় বের হয়েছে। সুলতান সাহেবের মেয়ে রানুর চেয়েও তাকে বেশি সুন্দর লাগছে। মনে হয় মেয়েটার শরীর এখন জ্বর নেই। সে গোসল করেছে। গোসলের পর পর যে কোন মেয়ের সৌন্দর্য দশগুণ বেড়ে যায়।

মাহফুজ থেমে থেমে বলল, তুমি কি গোসল করেছ?

চিত্রা বলল,আমি গোসল করেছি কি করি নাই তা দিয়ে আপনার দরকার কি?

জ্বর ছিল তো। জ্বর গায়ে গোসল করা ঠিক না এই জন্যে জিজ্ঞেস করেছি।

হ্যাঁ আমি গোসল করেছি। আপনার কি হয়েছে?

কিছু না।

মাহফুজের মাথা ঘুরছে। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। সে উঠোনেই বসে পড়ল। চিত্রা এগিয়ে এসে মাহফুজের সামনে দাঁড়াল। মাহফুজের মনে হচ্ছে মেয়েটা যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে তার দিকে আসছে।

আপনার শরীর কি আবারও খারাপ করেছে?

হু।

প্রায়ই কি আপনার এরকম শরীর খারাপ করে?

কোন ঝামেলা হলে শরীর খারাপ করে।

কি ঝামেলা হয়েছে?

কোন ঝামেলা হয় নাই। একটু পানি খাব।

আপনি ঘরে এসে শুয়ে পড়ুন। আমি পানি এনে দিচ্ছি।

চিত্রা জ্বর দেখার জন্যে কপালে হাত দিতে গেল। মাহফুজ মাথা সরিয়ে নিল। চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আমি গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখলে কি কোন সমস্যা আছে।

মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, না।

তাহলে মাথা সরিয়ে নিলেন কেন? আমি খারাপ মেয়ে, শরীরে হাত লাগলে শরীর নোংরা হয়ে যাবে, এই জন্যে?

আরে ছিঃ এইসব কি বল?

তাহলে আপনি আমার হাত ধরুন। আপনাকে বিছানায় শুইয়ে দিব। মাথায় মনে হয় পানিও ঢালতে হবে।

মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, তোমাকে সুন্দর লাগছে।

চিত্রা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। মানুষটা মনে হয় জ্বরের ঘোরে কথা বলা শুরু করেছে। জ্বর একবার মাথায় বসলে মাথার ভেতরের অনেক কথা আস্তে আস্তে বের হতে শুরু করে। চিত্রার মনে হয় এই লোকটার মাথার ভেতরে অনেক মজার মজার কথা আছে। কথাগুলো শুনতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। তবে মাথার গভীরে বসে থাকা কথা শুনতে নেই। পাপ হয় তার নিজের মাথার ভেতরেও অনেক ভয়ংকর কথা আছে। সেই কথাগুলো অন্য কেউ শুনলে নিশ্চয়ই তার ভাল লাগবে না। সব মানুষেরই কিছু না কিছু ভয়ংকর কথা থাকে। কথা যত ভয়ংকর মাথার তত গভীরে তার বাস। রানুর মত ভাল মেয়েরও ভয়ংকর কথা কিছু না কিছু থাকবে। মওলানা ইস্কান্দার থাকবে। থাকতেই হবে…।

মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, দাদীজান একটু থামেন।

চিত্রা বলল, কি বলছেন?

মাহফুজ ক্ষীণ গলায় বলল, তোমাকে না। দাদীজানের সঙ্গে কথা বলি।

কোথায় আপনার দাদিজান?

মাহফুজ হতাশ ভঙ্গিতে চারদিকে দেখছে। চিত্রা শক্ত গলায় বলল, আর কথা না। এবার উঠুন। আপনাকে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছি।

মাহফুজ বলল, তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে। অবেলায় গোসল করেছ তো। এই জন্যে। অবেলায় গোসল করলে মেয়েদের খুব সুন্দর লাগে।

চিত্রা বলল, গোসল না করলেও আমি সুন্দর। আর বিড়বিড় করতে হবে না। হাত ধরুন।

মাহফুজ হাত ধরল। হাত ধরে যে তাকে প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে সে কে? তার পরিচিত কেউ? তার গা থেকে অদ্ভুত গন্ধও আসছে। জদার গন্ধের মত গন্ধ। ভাল লাগে, কিন্তু মাথা ধরে যায়। দাদীজানের মুখের পান থেকে কি এই জদার গন্ধ আসছে। পান হেঁচার খটাখট শব্দটা হচ্ছে না। তার অর্থ একটাই- বুড়ি পান খাওয়া শুরু করেছে।

দাদীজান তুমি আছ?

বুড়ি মাথা দুলাতে দুলাতে ছড়া কাটল,

লাউ এর ভিতরে বইয়া বুড়ি
ছেঁচা গুয়া খায়।
 একখান ঠেলা দেওছান দেহি
কদ্দুর দূরা যায়।

বুড়ি ছড়া বলতে বলতে খিকখিক করে হাসছে। মাহফুজ ভেবে পেল না বুড়ির মনে এত আনন্দ কেন!

.

চিত্রার খুবই অদ্ভুত লাগছে। সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় সে আছে, অচেনা একজন মানুষের মাথায় পানি ঢালছে অথচ ব্যাপারটা তার কাছে মোটেই অস্বাভাবিক লাগছে না।

মাহফুজের বাড়িটা মাটির। মাটির বাড়ি বলেই কি বেশি আপন লাগছে? ইটের দালান, টিন বাঁশের বেড়ার বাড়ি তো এত আপন লাগে না।

মানুষ মাটির তৈরি বলেই কি মাটির ঘর-বাড়ি এত আপন লাগে? চিত্রার মা বলতেন- মানুষের আসল ঘর মাটির-কব্বর।

চিত্রা তখন বলত, ওটা ঘর না মা, গর্ত। মাটির নিচে ঘর হয় সাপের আর ইঁদুরের। মানুষের ঘর হবে মাটির উপরে। মৃত্যুর পর মানুষ আর মানুষ থাকে না,তখন সে গর্তে ঢুকে যায়।

চিত্রার মা তখন অতি বিরক্ত হয়ে বলতেন– এর সাথে কথা কইলেও পাপ হয়। বিরাট পাপ।

তোমাকে কি কথা বলার জন্য পা ধরে সাধি? কথা না বললেই হয়। মেয়ের সাথে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া চিত্রার মা কথা বলতেন না। দুজন মানুষ পাশাপাশি বাস করছে, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না।

মাহফুজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। কি ভয়ংকর নির্জন বাড়ি। গ্রামের বাড়ি কখনো এমন নির্জন হয় না। কেউ না কেউ সারাক্ষণ উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে। আজ কেউ নেই। সবাই জড় হয়েছে প্রাইমারী স্কুলের ময়দানে, কিংবা ক্লাবঘরের আশেপাশে। কাউকে পেলে ভাল হত। তাকে ডাক্তারের খোঁজে পাঠানো যেত। এই গ্রামে ডাক্তার থাকেন বলে চিত্রার মনে হয় না। তবে দুবছর পর থাকবে। ডাক্তার থাকবে, হাসপাতাল থাকবে, পাকা রাস্তা থাকবে। রোগীর খবর পেলে সাইকেল বিক্সায় টং টং করতে করতে পাকা রাস্তায় ডাক্তার চলে আসবে।

মাহফুজ পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, দাদীজান পানি খাব। চিত্রা পানি আনার জন্যে উঠে দাঁড়াল। একটা ব্যাপারে চিত্রা খুবই আশ্চর্যবোধ করছে। মানুষটা অসুস্থ হলেই বিড়বিড় করে তার দাদীজানের সঙ্গে কথা বলে।

নিন পানি এসেছি।

মাহফুজ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সেই অবস্থাতেই সে মুখ হা করল। চিত্রা বলল, এই ভাবে তো পানি খেতে পারবেন না। আপনাকে উঠে বসতে হবে। উঠে বসতে পারবেন?

মাহফুজ সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। গ্লাস হাতে নিয়ে সহজ ভঙ্গিতে পানি খেয়ে খাট থেকে নামতে গেল। চিত্রা তাকে ধরে ফেলে বলল, কোথায় যাচ্ছেন?

ক্লাবঘরে যাব।

এই অবস্থায় ক্লাবঘরে যাবেন মানে?

তোমাকে তোমার মার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঝামেলা হয়ে গেছে। বিরাট ঝামেলা। নাটক বন্ধ। এখনই তোমাকে পাঠিয়ে দিব।

ঘটনা কি বলুন তো?

ঘটনা কিছু না তোমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে।

কে আমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে?

আমার দাদীজান।

চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আপনি আমার কথা শুনুন। জ্বরে আপনার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। আপনি কি বলছেন না বলছেন নিজেই জানেন না।

মাহফুজ ক্লান্ত গলায় বলল, এখন তোমাকে পাঠায়ে না দিলে বিরাট ঝামেলা হবে। ছদরুল বেপারীকে তুমি চেন না। ভয়ংকর মানুষ। নাটকের শেষে সে তোমাকে নিয়ে যাবে।

চিত্রা বলল, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আপনাকে এত চিন্তা করতে হবে না।

তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না।

বুঝতে পারব না কেন? এটা তো নতুন কোনো ঝামেলা না। পুরনো ঝামেলা। নাটকের মেয়ে মফঃস্বলে নাটক করতে গিয়েছে আর মফঃস্বলের ক্ষমতাবান মানুষদের কেউ মেয়েটার সঙ্গে রাত কাটাতে চায় নাই এটা তো এখনো হয় নাই।

আমার জন্যে এটা নতুন কিছু না।

এসব আমাদের হিসাবের মধ্যে ধরা থাকে।

আমার মা ছিলেন খারাপপাড়ার খারাপ মেয়ে। আমি নিজেও সেই জিনিস। আপনার এত চিন্তা কি জন্যে? শুয়ে থাকেন।

মাহফুজ শুয়ে পড়ল।

চিত্রা নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছে। মাহফুজ কথাগুলো শুনছে কি শুনছে না তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই।

আপনে যখন ছিলেন না তখন ছদরুল বেপারীর লোক আমার কাছে এসেছিল। তার সাথে কথা হয়েছে। এক রাতের জন্যে আমি পাব দশ এই হাজার টাকা। বুঝেছেন। এই টাকাটা আমার দরকার। আমার মার দরকার।

মাহফুজ তাকিয়ে আছে। তার মাথার তীব্র যন্ত্রণা কমে আসছে। মাথার ভেতর বসে থাকা দাদীজান মনে হয় পান খেয়ে খেয়ে এখন ক্লান্ত। কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমুতে যাবে।

আবু ও আবু!

মাহফুজ চমকে গেল। বুড়ি এখনো ঘুমায় নি। জেগে আছে।

 আবুরে শোন।

 শুনতেছি।

মেয়েটা মিথ্যা কথা বলতেছে। যা বলতেছে সবই মিথ্যা।

আইচ্ছা।

 দুঃখ ধান্ধায় বড় হইছে তো। নানান সময়ে মিথ্যা বলতে হইছে।

আইচ্ছা ঠিক আছে।

তুই মন খারাপ করিস না।

আরে কি যন্ত্রণা, আমি মন খারাপ করব ক্যান?

 মাহফুজের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। মেয়েটা শুধু যে পান ঢালছে তা না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাথার যন্ত্রণা মাহফুজের এখন নেই কিন্তু তার কাছে সবকিছুই কেমন এলোমেলো লাগছে। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মাথা অসম্ভব খালি খালি লাগছে। এরচে বুড়ি যদি পান ছেচতো ভাল লাগতো।

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ