০৪.

রানু লেট রাইজার। সকাল নটার আগে সে বিছানা থেকে নামে না। কিন্তু গ্রামে এসে তার সিস্টেম কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। যত রাতেই সে ঘুমুতে যায় না কেন ভোরবেলা পাখির কিচিমিচিতে ঘুম ভাঙে। পাখিদের হল্লা এলার্ম বেলের চেয়েও তীব্র ও তীক্ষ্ণ। পাখিদের চেঁচামেচিতে সে অভ্যস্ত নয় বলেই ভোরবেলা ঘুম ভাঙার ব্যাপারটা ঘটছে বলে রানুর ধারণা। রানু এতে বিরক্ত না। বরং সকালবেলা জেগে ওঠাটা তার ভাল লাগছে। ঘুম-ঘুম চোখে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা। সকাল হওয়া দেখা। পাখিদের এক গাছ থেকে আরেক গাছে ঝাঁপ দেয়ে দেখা। তারপর সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নামা। একতলায় নামার সঙ্গে সঙ্গে রমিজ হাতে এককাপ চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয়। আগুন-গরম ধোয়া ওঠা চা। সকালের এই অংশটাও রানুর পছন্দ। রমিজ অন্য কাজকর্ম তেমন পারে না বা পারলেও করে না, তবে রানুকে দেখামাত্র অতিদ্রুত চা বানানোর কাজটা খুব ভাল পারে। শুধু একটাই দোষ কাপটা থাকে কানায় কানায় ভর্তি। প্রতিবারই রানু বলে এমন ভর্তিকাপ দেবেন না। প্রতিবারই রমিজ মাথা কাত করে বলে, জ্বি আচ্ছা আপা। আবার প্রতিবারই এই ভুল করে।

আজ রানু অন্যদিনের চেয়েও সকালে উঠেছে। শীত শীত লাগছিল বলে চাদরটা গায়ে দিয়ে চলে এসেছে। বিছানার চাদর জড়ানোয় তাকে দেখাচ্ছে কোলবালিশের মত। মা দেখতে পেলে খুব রাগতেন। ভাগ্যিস তিনি এখানে নেই। উঠানে দাঁড়িয়ে রানু মুগ্ধ হয়ে গেল। প্রতিদিনই মুগ্ধ হয়, আজকের মুগ্ধতাটা অন্যদিনের চেয়ে বেশি। কারণ আজ রেলিং-এ অদ্ভুত সুন্দর একটা পাখি বসে আছে। পাখিটার গায়ের পালক ময়ূরের পালকের মতো গাঢ় নীল। ঠোঁট টকটকে লাল। পাখিটা রানুকে ঘাড় কাত করে দেখল। আশ্চর্যের ব্যাপার উড়ে চলে গেল না। যেন সে বুঝতে পেরেছে রানু নামের মেয়েটাকে ভয় পাবার কিছু নেই। বিছানার চাদর গায়ে দিয়ে কোলবালিশ সেজে চলে এলেও সে খুব ভাল মেয়ে।

কাক ছাড়া অন্য কোন পাখি মানুষকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। কাজেই নীল-পালকের পাখি এক সময় উড়ে গেল বাগানের দিকে। রানু পাখি কোথায় গেল দেখতে গিয়ে অন্য একটা দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

তার বয়সী সুন্দর একটি মেয়ে বাগানে একা-একা হাঁটছে। মেয়েটির হাতে চায়ের কাপ। মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মেয়েটার মাথা ভর্তি চুল। চা খেতে খেতে সে নানান দিকে মাথা দুলাচ্ছে বলে মাথার চুল। পর্দার মতো দুলছে। সে আবার বিড়বিড় করে পাগলের মত কি যেন বলছে। আবার হাসছেও।

অচেনা একটা মেয়ে চা খেতে খেতে তাদের বাগানে হাঁটার ব্যাপারটা কী? এটা স্বপ্নের কোন দৃশ্য না-তো। রানুর কিছু কিছু স্বপ্ন বাস্তবের মতো স্পষ্ট হয়। এখানেও কী তাই হচ্ছে।

মেয়েটি এখন তাকে দেখতে পেয়েছে। চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি স্থির। রানুর মনে হল মেয়েটার গায়ে রঙ ময়লা হলেও খুবই মায়াকাড়া চেহারা। বয়সও মনে হচ্ছে তার চেয়ে কম। তবে কালোমেয়েদের বয়স সহজে বোঝা যায় না। যা তাদের বয়স তারচেয়েও তাদের অনেক কম দেখায়। রানু সিঁড়ি বেয়ে নামছে। একবার মনে হল মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার আগে গায়ের চাদরটা ফেলে যাওয়া দরকার। তারপরই মনে হল থাক না চাদর।

রমিজ মনে হয় চায়ের কাপ নিয়ে তৈরিই ছিল। রানু সিঁড়ির গোড়ায় নামতেই হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল। রানু বলল, মেয়েটা কে?

রমিজ বলল, নাটকের মেয়ে।

নাটকের মেয়ে মানে কি?

টিপু সুলতান নাটক যে হইব তার মেয়ে। ময়মনসিংহ থাইক্যা ভাড়া কইরা আনছে।

আমাদের এই বাগানে সে কি করছে?

বেড়াইতেছে। শহরবন্দরে থাকে গেরামের বাগান দেখে নাই। দেইখ্যা মজা পাইতেছে।

তা মজা পাক কিন্তু আমাদের এই বাগানে সে কিভাবে এল?

রাত্তিরে আমরার বাড়িত ছিল। আফনেরা ঘুমাইয়া পড়ছিলেন তহন মাহফুজ ভাই নিয়া আসছে।

আমাদের এখানেই কি তার থাকার কথা ছিল?

এই বাড়ি ছাড়া আর কই থাকব? আর থাকনের জাগা আছে?

 মেয়েটার নাম কি?

নাম জানি না আফা।

রানু এগিয়ে গেল। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা এখনো অদ্ভুত লাগছে। এবং এখন কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে তার ভাল লাগবে। গ্রামে আসার পর থেকে সারাক্ষণ বাবার বক্তৃতা ধরনের কথা শুনে শুনে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আসল বক্তৃতা তিনি এখনো দেন নি। এই কদিন যা হয়েছে তা আসল বক্তৃতার রিহার্সেল। আসল বক্তৃতা নিশ্চয়ই ভয়াবহ হবে। বক্তৃতা ছাড়াও বাবা আজকাল তুচ্ছ বিষয় নিয়েও অনেক বেশি কথা বলেন। ব্যাপারটা মনে হয় বয়সের কারণে হচ্ছে। বয়স্ক মানুষ যে কোন কাজে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, শুধু কথা বলায় তাদের ক্লান্তি নেই।

রানু মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলল, আপনি কেমন আছেন?

চিত্রা নিচু গলায় বলল, ভাল আছি।

আপনি যে রাতে আমাদের বাড়িতে ছিলেন জানতাম না। ঘুম ভেঙ্গেই আপনাকে দেখে চমকে গেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম স্বপ্ন দেখছি। আপনার নাম কি?

চিত্রা।

আমার ডাক নাম রানু। আমি এই বাড়ির মেয়ে।

আমি জানি।

রমিজ নিশ্চয়ই আপনাকে সব বলেছে।

জ্বি।

আমাদের বাগানটা খুব সুন্দর না?

 খুব সুন্দর।

পুকুর-ঘাট দেখেছেন? পুকুর-ঘাট আরো সুন্দর। পুকুরটা অবশ্যি সুন্দর না। সবুজ শ্যওলা এমনভাবে পড়েছে যে পানি দেখা যায় না। তবে বাঁধানো ঘাটটা খুব সুন্দর। চলুন আপনাকে পুকুর-ঘাট দেখাই। আপনি কদিন থাকবেন?

আজ রাতটা থাকব।

পরশু যাবেন?

জ্বি।

তাহলে খুবই ভাল। আপনি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন। আমরাও পরশু যাচ্ছি। বাবার বোধ হয় আরো কয়েকদিন থাকার ইচ্ছা কিন্তু আমার অসহ্য লাগছে।

রানুর মনে হল মেয়েটা ঠিক সহজ হতে পারছে না। প্রশ্ন করলে জবাব দিচ্ছে ঠিকই। নিজ থেকে কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে খুব লজ্জা পাচ্ছে। নাটক-থিয়েটারের মেয়েদের এত লজ্জা থাকার কথা না। তাদের অনেকের সঙ্গে মিশতে হয়। অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়।

রানু বলল, রাতে আপনার ঘুম কেমন হয়েছে।

ভাল হয় নাই।

নতুন জায়গা ঘুম ভাল হবার কথা না। আমারও একই অবস্থা। কোন নতুন জায়গায় গেলে প্রথম রাতে আমার এক ফোঁটা ঘুম হয় না। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়লেই দরজা ভেঙে ছয়-সাত জন ষণ্ডাগুণ্ডা ঢুকে পড়বে। যতবার বিছানায় যাই ততবারই মনে হয় দরজা ঠিকমতো লাগান হল না। বিছানা ছেড়ে উঠে ছিটকিনি পরীক্ষা করি। বিছানায় আবারও ঘুমুতে যাই। তখন আবারও মনে হয় ছিটকিনি দেয়া হয়নি। অথচ আগেই ছিটকিনি দেখে এসেছি। আপনারও কি সেরকম হয়?

না। কাল রাতে আমার ঘুম হয় নি অন্য কারণে।

কারণটা কি আমাকে বলা যাবে?

জ্বি-না বলা যাবে না।

বলতে ইচ্ছা না হলে বলতে হবে না।

রানু চিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। চিত্রা মাথা নিচু করে হাসল। চিত্রার মনে হল কাল রাতে ঘুম না হবার কারণটা এই অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটাকে বলা যেতে পারে। এতে দোষের কিছু হবে না। চিত্রা হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা আপনাকে বলি। কাল রাতে ক্ষিধার জন্যে ঘুম হয় নি।

তার মানে?

সারাদিন নৌকায় কিছু খাওয়া হয় নি। মাহফুজ ভাই অনেক রাতে এ বাড়িতে রেখে গেছেন। তখনো খাওয়ার কথা কিছু বলেন নাই। রেখেই চলে গেছেন।

একটা পুরো দিন আর পুরো রাত আপনি না খেয়ে কাটিয়েছেন?

চিত্রা আবারও হাসল। রানু বলল, আমার খুব রাগ লাগছে। আপনি খাবার দেয়ার কথা মাহফুজ ভাইকে বলতে পারলেন না।

বলার ইচ্ছা করছিল কিন্তু বলতে পারি নাই।

রানু বলল, আই এ্যাম সরি। আই এ্যাম সো সরি। আমার খুবই খারাপ লাগছে।

আপনার খারাপ লাগবে কেন?

আমার বাড়িতে একটা মেয়ে না খেয়ে থাকবে আর আমার মন খারাপ লাগবে না? আপনি এক মিনিট দাঁড়ান। আমি রমিজ ভাইকে নাস্তার কথা বলে আসছি। আরেকটা কথা, আপনার পায়ে কি কোন সমস্যা? পা টেনে টেনে হাঁটছেন।

কাল রাতে এখানে আসার সময় কাঁটা ফুটেছে। বের করতে পারি নি।

আচ্ছা দাঁড়ান আমি ব্যবস্থা করছি।

কি ব্যবস্থা?

বাবাকে বলব। উনি ব্যবস্থা করবেন। যে কোন সমস্যা বাবা সমাধান করতে পারেন। সমস্যা জটিল হোক বা সহজই হোক। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন, আমি আসছি। হাঁটাহাঁটি করার দরকার নেই।

চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। তার খুবই অবাক লাগছে। বিছানার চাদর গায়ে দিয়ে একটা মেয়ে এসেছে। সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছিল তখন মনে হচ্ছিল উড়তে উড়তে নামছে। এখন আবার পাখির মতই উড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দ্রুত যাচ্ছে বলে গায়ের চাদর পাখির ডানার মত পাখা মেলেছে। মেয়েটা এত সুন্দর সেটাও একটা বিস্ময়কর ঘটনা। মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে? চিত্রার বয়স উনিশ। সে তার উনিশ বছর বয়সে এত সুন্দর মেয়ে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে মেয়েটাকে পাশে নিয়ে সে ছবি তুলত। সেই ছবি মাকে দেখিয়ে বলত, মা দেখ পরীর মেয়ের সঙ্গে ছবি তুলেছি।

মা অবশ্যই ছবি দেখে নানান খুঁত বের করত। চোখ ছোট, নাক মোটা, হাঁটা ভাল না।

সে তখন মাকে চেপে ধরত, ছবি দেখে কি করে বুঝলে হাঁটা ভাল না। ছবিতে কি মেয়েটা হাঁটছে? তোমার নিজের ঠ্যাং নেই বলে তোমার কাছে মনে হয় জগতের সব মেয়ের হাঁটা খারাপ।

চিত্রার মন একটু খারাপ হয়ে গেল। নৌকা থেকে নামার পর থেকে একবারও মার কথা মনে হয় নি। এই প্রথম মনে হল। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার সে মাকে কত দ্রুতই না ভুলে যেতে পারছে। ময়মনসিংহ ফিরে গিয়ে সে যদি দেখে মা মারা গেছেন তাহলে সে খুব কি কষ্ট পাবে? হ্যাঁ, কষ্ট পাবে। তবে ভয়াবহ কষ্ট না। কষ্টের চেয়ে বেশি হবে দুঃশ্চিন্তা। সে থাকবে কোথায়? যাবে কার কাছে?

রানু এসে পাশে দাঁড়াল। হড়বড় করে বলল, পরোটা বানাতে বলে এসেছি। পরোটা আর গোশত। রাতের গোশত আছে। ঐটা গরম করে দেবে। আর ডিম ভেজে দেবে। ঠিক আছে?

চিত্রা গম্ভীর গলায় বলল, না হবে না। আমি পোলাও কোর্মা খাব। আর রুই মাছ ভাজা খাব।

চিত্রা কথাগুলো এমনভাবে বলল যে রানুর প্রথমে মনে হল মেয়েটা সত্যি সত্যি পোলাও কোর্মা খেতে চাচ্ছে। রহস্য করে যে কথা বলে সে

কথা শেষ করে ফিক করে হসে ফেলে। এই মেয়ে হাসছেও না। কথা শেষ করে আরো গম্ভীর হয়ে গেছে। বাহ্ মজার মেয়ে তো।

রানু বলল, আমি তোমাকে তুমি করে বলি? আমার বয়েসী কোন মেয়েকে আমি বেশিক্ষণ আপনি বলতে পারি না। তোমার বয়স কত?

উনিশ।

রানু প্রায় চেঁচিয়ে বলল, কি আশ্চর্য আমার বয়সও উনিশ। আমার একটা স্বভাব কি জান? যাকে আমার পছন্দ হয় আমি শুধু তার সঙ্গে আমার মিল খুঁজে বের করতে থাকি।

চিত্রা বলল, আমাদের দুজনের মধ্যে বড় একটা মিল আছে। তুমি অনেক মিল খুঁজে বের করলেও এই মিল কখনো বের করবে না।

রানু বলল, কি মিল?

চিত্রা বলল, আমরা দুজনই মেয়ে।

রানু হেসে ফেলল। মেয়েটাকে এত অল্প সময়ে তার এত পছন্দ হচ্ছে। কেন সে বুঝতে পারছে না।

রানু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আচ্ছা শোন, তোমার মাথায় কি মাঝে মাঝে অদ্ভুত পাগলামী আসে।

কি রকম পাগলামী?

যেমন ধর এক গাদা ঘুমের অসুধ খেয়ে ফেলা। ব্লেড দিয়ে হাতে আঁচড় দেয়া?

না, এরকম পাগলামী আমার মধ্যে নেই।

আমার কিন্তু আছে। একবার আমি কি করেছিলাম শোন, পেন্সিল কাটারের যে ব্লেড আছে, সেই ব্লেড স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলেছি। তারপর সেই ব্লেড দিয়ে হাতের গোড়া থেকে কব্জি পর্যন্ত কেটেছি। তুমি ভেবেছ একটা দাগ দিয়েছি? তা না অসংখ্য দাগ দিয়েছি। সেই গদা এখনো আছে। আমি যে ফুল হাতা ব্লাউজ পরেছি এই জন্যে পরেছি। নাশতা খাওয়া হোক তারপর আমি তোমাকে দাগ দেখাব।

চিত্রা অবাক হয়ে তাকাল। রানু বলল, এখন তোমার কাছে মনে হচ্ছে না আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ? শুধু যে হাতে দাগ দিয়েছি তা না, সারা শরীর দাগ দিয়েছি। এমন সব জায়গায় দিয়েছি যা কাউকে দেখানো যায় না। তবে তোমাকে দেখাব।

কেন এরকম কর?

রানু হাসতে হাসতে বলল, জানি না কেন করি।

.

শুধু যে অধিক শোকে মানুষ পাথর হয় তা-না অধিক রাগেও মানুষ পাথর হয়। সুলতান সাহেব হয়েছেন। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে চা খাচ্ছেন। প্রচণ্ড রাগের কিছুই তার চোহরায় নেই। তিনি বরং অন্যদিনের চেয়েও শান্ত। তবে সিগারেট ধরাবার সময় তিনি লক্ষ করলেন তার হাতের আংগুল সামান্য কাঁপছে। ঘটনাটা রাগ চেপে রাখার কারণেই ঘটছে তা বোঝা যাচ্ছে। তিনি এই কিছুক্ষণ আগে রানুর কাছে শুনেছেন থিয়েটারের একটি মেয়ে গত রাতে তার বাড়িতে ছিল। মেয়েটার নাম চিত্রা।

সুলতান সাহেব বললেন, ও আচ্ছা।

 এমনভাবে বলছেন যেন থিয়েটারের মেয়ে থাকতেই পারে।

রানু বলল, কি কাণ্ড দেখ বাবা। মেয়েটা চব্বিশ ঘণ্টা কিছু খায় নি। এক লোক গভীর রাতে তাকে এ বাড়িতে ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেছে। আর তার কোন ট্রেস নেই। ভোরবেলায় যে সে এসে খোঁজ নেবে তাও এখন পর্যন্ত নেয় নি।

সুলতান সাহেব আবারও বললেন, ও আচ্ছা।

তারপরও ঘটনা আছে। মেয়েটার পায়ে কাঁটা ফুটেছে। বাবা তোমাকে পায়ের কাঁটা বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।

সুলতান সাহেব মেয়ের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন।

তুমি চা খাও বাবা। আমি চিত্রার সঙ্গে গল্প করতে করতে নাস্তা খাব।

রানু ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে গেল। প্রচণ্ড রাগে সুলতান সাহেব জমে গেলেন। মওলানা ইস্কান্দার আলির কথা তিনি অবিশ্বাস করেছিলেন, এখন দেখা যাচ্ছে মওলানা সত্যি কথাই বলেছে। খারাপ একটা মেয়েকে সত্যি সত্যি তার বাড়িতে এনে তুলেছে। এরা তাকে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজন মনে করে নি।

এই মুহূর্তেই মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া দরকার। কিন্তু তা তিনি রানুর জন্যেই করতে পারবেন না। জগতের জটিলতা সম্পর্কে রানুর ধারণা নেই। সে পৃথিবীকে দেখছে শাদা চোখে। রানুর দৃষ্টি আহত না করে তাকে আগাতে হবে। মেয়েটিকে বের করে দিতে হবে এমনভাবে যে রানুর কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হবে। মাহফুজ নামের ছেলেটিকেও একটা কঠিন শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা যেন তার অনেক দিন মনে থাকে। ধরাকে কেউ কেউ সরা মনে করে। এই ছেলে সরাও মনে করছে না। পিরিচ মনে করছে। রমিজকে পাঠিয়ে স্কাউভ্রালটাকে কান ধরে নিয়ে আসা দরকার। তবে তিনি তা করবেন না। তিনি একজন ডিপ্লোমেট। কোন ডিপ্লোমেটই কখনো হুট করে কিছু করে না। তারা সময় নেয়। মহেন্দ্রক্ষণের জন্যে অপেক্ষা করে। তিনিও করবেন। হাসিমুখেই অপেক্ষা করবেন। রোজ যেমন গ্রামের ভেতর দিয়ে একটা চক্কর দেন, আজও দেবেন। ভেঙে পড়া মসজিদটা একবার দেখতে যেতে হবে। মসজিদের ইটগুলো রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আর্কিওলজি বিভাগের কেউ এসে দেখুক। মসজিদ দেখতে গিয়ে মাহফুজ ছেলেটাকে ডেকে পাঠানো যেতে পারে। সেটা ঠিক হবে না। নিজের বাড়ির বাইরে তিনি যেখানেই গেছেন তাঁকে ঘিরে লোকজন জমা হয়েছে। কঠিন কথা সাক্ষী রেখে বলতে হয় না। মাহফুজকে নিজের বাড়িতেই ডেকে পাঠাতে হবে। তখন তার সঙ্গে যে কথাগুলো বলবেন সব ঠিক করে রাখতে হবে। প্রথম কথাটা হল

মাহফুজ সন্ধেবেলা তোমাদের নাটকে আমি যেতে পারব না। আমি পাবলিক ফাংশান থেকে দূরে থাকতে চাই। সারাজীবন তাই থেকেছি ভবিষ্যতেও তাই থাকব।

আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমাকে কিছু না বলে কোয়েশ্চেনেবল ক্যারেক্টারের একটা মেয়েকে রেখে গেছ। এই কাজটা শুধু যে ঠিক করো নি তা না। অপরাধ পর্যায়ের একটা কাজ করেছ। আধঘন্টার মধ্যে মেয়েটিকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে। এবং এই কাজ যে তুমি আমার নির্দেশে করেছ তা যেন আমার মেয়ে না জানে। এখন আমার সামনে থেকে বিদেয় হও।

এই মেঘ, রৌদ্রছায়! কোনো মানুষই ভেবে রাখা কথা ঠিকঠাক বলতে পারে না। কোথাও না কোথাও গুবলেট করে ফেলে। সুলতান সাহেবের ব্যাপারে এরকম কখনো হয় না। যে-কথা যেভাবে বলবেন বলে তিনি ভাবেন সেই কথা তিনি ঠিক সেই ভাবেই বলতে পারেন।

সুলতান সাহেব সকালের নাশতা একা একা করলেন। এই সময় রানু তার সামনে থাকে। আজ সে খুব সম্ভব নষ্ট মেয়েটির সঙ্গে আছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। ভালমানুষের সঙ্গ কখনোই ইন্টারেস্টিং হয় না। মন্দ মানুষের সঙ্গ ইন্টারেস্টিং হয়। যে যত মন্দ তার সঙ্গ ততই আনন্দময়।

নাশতা শেষ করে সুলতান সাহেব কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। তারপর কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। কিছু একটা লিখতে ইচ্ছা করছে। কী লিখবেন বুঝতে পারছেন না। গুছিয়ে কাউকে একটা চিঠি লিখতে পারলে হত। চিঠি লেখার তার মানুষ নেই। তিনি লিখেন সরকারি চিঠি। সেই চিঠি কোন মানুষকে লেখা হয় না। সরকারি কোন পদধারীকে লেখা হয়। সেইসব চিঠিতে কখনো লেখা থাকে না– ভাই আপনার শরীর এখন কেমন যাচ্ছে?

রানু দরজা ধরে দাঁড়াল। সুলতান সাহেব বললেন, কিছু বলবি?

 রানু বলল, আমি কিছু বলব না। তোমার কি আরেক কাপ চা লাগবে?

না।

কি লিখছ?

 কিছু লিখছি না।

কিছু লিখছ না তাহলে কলম হাতে বসে আছ কেন?

বন্দুক হাতে বসে থাকলেই যে গুলি করতে হবে এমন কথা নেই। ঠিক তেমনি কলম হাতে বসলেই লিখতে হবে এমন কথা নেই। তুই নাশতা করেছিস?

হ্যাঁ।

মেয়েটা নাশতা করেছে।

চিত্রার শরীরটা ভাল না বাবা। একটা পারাটার সামান্য একটা টুকরা মুখে দিয়ে বেচারী আর খেতে পারেন নি। আমি গায়ে হাত দিয়ে দেখেছি জ্বর। বেশ জ্বর, এখন শুয়ে আছেন।

জ্বর নিয়ে নাটক করবে কিভাবে?

আমিও সেই কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, কোন অসুবিধা হবে না। একবার না-কি একশ তিন জ্বর নিয়ে নাটক করেছেন।

মাহফুজ ছেলেটা কি জানে তার অভিনেত্রী অসুস্থ?

আমি খবর পাঠিয়েছি।

মাহফুজ এলেই ওকে আমার কাছে পাঠাবি।

আচ্ছা।

 দুই কাপ চা নিয়ে আয়।

দুই কাপ কেন?

এক কাপ তোর জন্যে এক কাপ আমার জন্যে। আয় চা খেতে খেতে বাপ-বেটিতে কিছুক্ষণ গল্প করি।

বিশেষ কিছু বলবে?

হ্যাঁ।

দিনেরবেলা বিশেষ কথা শুনতে ইচ্ছে করে না বাবা। বিশেষ কথা শুনতে হয় রাতে। তোমার বিশেষ কথা রাতে শুনব।

কথা না শুনলি, আয় একসঙ্গে চা খাই।

আসছি। বাবা, তুমি কিন্তু এখনো চিত্রার পায়ের কাঁটা তোলার ব্যবস্থা কর নি। আমার মনে হচ্ছে পা খুঁচাখুঁচি করেই সে ইনফেকশন বাঁধিয়েছে। একজন ডাক্তার আনাও।

গণ্ডগ্রামে হৈ করে ডাক্তার পাওয়া মুশকিল। দেখি কি করা যায়।

.

সুলতান সাহেব রানুর সঙ্গে যেসব কথা বলবেন বলে ঠিক করেছেন তা গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। কোন কথাটার পর কোনটা বলবেন। সিঁড়ি গেঁথে গেঁথে ওঠা। স্টেপগুলো এমন হবে যে খুব সহজে টপকানো যায়। যেন হাঁপ না ধরে।

প্রথম শুরুটা করবেন ধর্ম বিষয়ক আলোচনা দিয়ে বুঝলি রানু আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শুধু যে পৃথিবী নামক গ্রহেই মানুষ এসেছে তা তো না। আরো অনেক গ্রহেই এসেছে। এর উল্লেখ কিন্তু কোরান শরীফে আছে। সূরা জাসিয়ার ৩৬ নং আয়াতে বলা আছে–

All praise be to Allah Sustainer and nourisher. Of the Heavens, and Sustainer and nourisher Of the Earth. Sustainer and nourisher Of the worlds

এই সূরায় পরিষ্কার করে বলা হয়েছে তিনি পৃথিবীর পরিচালক, আসমানের পরিচালক এবং জগতসমূহের পরিচালক। রানু তখন নিশ্চয়ই বলবে কি আশ্চর্য, কোরান শরীফে এই কথা আছে? তিনি বলবেন– কোরান শরীফে আরো অনেক আশ্চর্য কথা বলা হয়েছে যা আধুনিক বিজ্ঞান বলছে। যেমন ধর ইউনিভার্স সৃষ্টি হল বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে। তারপর থেকে কি হচ্ছে বিশ্বব্রাহ্মণ্ড ছড়িয়ে পড়ছে। একে বলা হয় expanding Universe. সূরা যরিনার সাতচল্লিশ নম্বর আয়াতে আছে —

We created the Heaven with a
Twist of the (Divine) Hand.
And surely we are expanding it.

গেট দিয়ে সংকুচিত ভঙ্গিতে একজন ঢুকছে। যে ঢুকছে তাকে রানু আগে কোনদিন দেখেনি তবু সে চট করে চিনে ফেলল– লোকটা আর কেউ না মাহফুজ। লোকটা এমন সংকুচিতভাবে ঢুকল কেন? সে-তো কোন রাজবাড়িতে ঢুকছে না। গেটে দারোয়ান নেই যে দারোয়ান তাকে ঢুকতে দেবে না। মানুষটার সার্টের একটা বোতাম লাগানো নেই। এই ব্যাপারটা খুব চোখে পড়ছে। খাবার সময় কারো ঠোঁটের কাছে যদি একটা ভাত লেগে থাকে এবং সে সেটা না জানে তখন অস্বস্তিতে রানুর গা কিটকিট করে। তার ইচ্ছে করে পেপার নেপকিন দিয়ে সে নিজেই ভাতটা সরিয়ে দেয়।

ঘরে কি কোন বোতাম আছে? লোকটার শার্টে একটা বোতাম কি লাগিয়ে দেয়া যায় না? আচ্ছা লোকটার গলার স্বর কেমন? গলার স্বর রানুর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কারো গলার স্বর পছন্দ না হলে তাকে রানুর কখনোই পছন্দ হবে না। সে যত ভাল লোকই হোক কিছুই যায় আসে না। মাহফুজ নামের মানুষটা দেখতে সুন্দর। অবশ্যি চোখের কাছে একটা বোকা বোকা ব্যাপার।

মাহফুজ রানুর সামনে দাঁড়াতেই রানু বলল, মাহফুজ সাহেব, আপনি ভাল আছেন?

মাহফুজ থতমত খেয়ে বলল, জ্বি।

রানু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল-মানুষটার গলার স্বর ভাল। শুধু ভাল না বেশ ভাল। গলার স্বর শুনলেই মনে হয় মানুষটা তার নিজের কেউ। যার সঙ্গে ফাজলামি করা যাবে। রসিকতা করা যাবে। ধমক-ধামক দেয়া যাবে। রানু বলল, আপনি সারা গ্রামে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফেলেছেন, আপনি কি জানেন বিজ্ঞাপনে দুটা বানান ভুল? প্রধান বানান ভুল, অতিথি বানানও ভুল। যেহেতু বাবা প্রধান অতিথি তিনি ভুল বানান দেখে খুব রাগ করেছেন। আপনি আজ যাবার সময় আমার কাছ থেকে শুদ্ধ বানান জেনে যাবেন এবং বিজ্ঞাপনের বানানগুলো ঠিক করবেন।

মাহফুজ বলল, জ্বি আচ্ছা।

আপনার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ আছে। আপনি একটা মেয়েকে এখানে রেখে গেছেন রাতে খাবার ব্যবস্থা করেন নি।

মাহফুজ বিব্রত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। রানু বলল, আপনার বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ হচ্ছে চিত্রার পায়ে কাঁটা ফুটেছে, আপনি কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করেন নি। শাস্তি হিসেবে এখন আমি আপনাকে পায়ে একটা কাঁটা ফুটিয়ে দেব। মুখ হাসি হাসি করে লাভ নেই। আমি মোটেই ঠাট্টা করছি না।

মাহফুজের বিস্ময়ের সীমা রইল না। মেয়েটির রূপ আগুনের মতো। বিস্ময়ের জন্যে এটাই যথেষ্ট। এমন রূপবতী মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়। কিন্তু সবচে বড় কথা হচ্ছে মেয়েটির সহজ কথা বলার ভঙ্গি। মেয়েটিকে লাগছে দীঘির মতো, যার পানি কাকের চোখের মতো পরিষ্কার। পুকুরের মাঝখানের বালু কণাগুলোও দেখা যাচ্ছে। কণাগুলোও সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করছে।

রানু বলল, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনো শেষ হয় নি। আপনি চিত্রাকে ধমক দিয়েছেন কেন?

মাহফুজ বলল, ধমক দেই নাই।

অবশ্যই ধমক দিয়েছেন। যখন ঝড় শুরু হল, নৌকা দুলছে। তখন আপনি চিত্রাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সাঁতার জান?

সেই বেচারী এমি ঝড়ের কারণে ভয়ে অস্থির। সে বলল, সাঁতার জানি না। তখন আপনি ধমকাতে শুরু করলে-কেন সাঁতার জান না। বিরক্তিতে ভূরু-টুরু কুঁচকে ফেলেছিলেন। সে সাঁতার জানে না সেটা তার ব্যাপার। তার ব্যাপারে আপনি ধমকা-ধমকি করবেন কেন? আপনি কি প্লেন চালাতে পারেন? নিশ্চয় পারেন না। এখন যদি আপনাকে আমি ধমকাতে শুরু করি কেন প্লেন চালাতে পারেন না, সেটা কি ঠিক হবে?

প্লেন চালানো আর সাঁতার তো এক জিনিস না।

অবশ্যই এক জিনিস। প্লেনও আকাশে সাঁতার কাটে। এখন আপনি ভেতরে যান। চিত্রা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। আপনার আসার কথা ছিল খুব ভোরে-এখন বাজে দশটা। এই আপনার খুব ভোর?

মাহফুজ চিত্রার ঘরে ঢুকে গেল।

.

ট্রেতে করে চা নিয়ে রানু উপস্থিত হল। ট্রেতে দুকাপ না তিন কাপ চা। সুলতান সাহেব দেখলেন রানুর পেছনে মাহফুজ মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রানু বলল, বাবা মাহফুজ সাহেব এসেছেন। তোমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যেতে চাচ্ছিলেন। তোমাকে দেখলেই না-কি উনার ভয় লাগে আমি জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। তুমি বকা দিয়ে দাও তো।

বকা দেব?

উনি চিত্রা মেয়েটিকে চব্বিশ ঘন্টা না খাইয়ে রেখেছেন। ওর পায়ে কাঁটা ফুটেছে। কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করেন নি।

সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। এটা তার শোবার ঘর। রানু তার শোবার ঘরে একজনকে নিয়ে উপস্থিত হবে এটা তিনি ভাবেন নি। মাহফুজ এসে তার পা ধরে সালাম করতে করতে বলল- মনটা খুবই খারাপ ছিল স্যার। একঘণ্টা আগে মনটা এত ভাল হয়েছে যে বলার না।

সুলতান সাহেব বললেন, এক ঘন্টা আগে বিশেষ কি ঘটনা ঘটল?

ভুজঙ্গ বাবুর অ্যাসিসটেন্ট চলে এসেছেন। অ্যাসিসটেন্ট বলল, ভুজঙ্গ বাবু সন্ধ্যা নাগাদ চলে আসবেন। ভুজঙ্গ বাবু বলেছিলেন আসবেন কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হয় নাই। এই জন্যে বিকল্প ব্যবস্থাও রেখেছিলাম।

ভুজঙ্গ বাবুটা কে?

টিপু সুলতানের পাঠ করবেন। বাড়ি গৌরীপুর। মারাত্মক অভিনেতা। আসল নাম মনোয়ার হোসেন। একবার যাত্রায় ভুজঙ্গ নামে পাঠ করলেন। তারপর থেকে নাম হয়ে গেল ভুজঙ্গ বাবু।

ও আচ্ছা।

 ভোটার লিস্টেও উনার নাম ভুজঙ্গ বাবু।

ও।

এদিকে চিত্রা বাবার বিছানায় কাত হয়ে পড়েছে। আমার টেনশান আর কিছুতেই কমে না। একটা কমে তো আরেকটা তৈরি হয়।

মাহফুজ তাঁর সামনে বসেই চুকচুক করে চা খাচ্ছে। তিনি তাকে কিছুই বলতে পারছেন না।

প্লে একটু রাত করে শুরু হবে স্যার। দূর দূর থেকে লোকজন আসবে। এদের ঠিকঠাক মতো বসতে দিতে হবে। আরেকটা ভাল খবরও স্যার আছে–মেরাজকান্দার ছদরুল ব্যাপারী আসবেন।

ছদরুল ব্যাপারীটা কে?

ব্যবসা করেন।

কিসের ব্যবসা?

উনার অনেক ধরণের ব্যবসা আছে। তবে সবচে চালু ব্যবসা হল বিড়ির ব্যবসা। উনি বিশেষ অতিথি। উনার সম্পর্কে অনেক আজেবাজে বদনাম আছে। তবে উনি বিরাট দানশীল মানুষ।

সুলতান সাহেব বিরস মুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। আজকের অনুষ্ঠানে একজন বিড়ির ব্যবসায়ীর পাশে তিনি বসবেন। তিনি নিশ্চিত সেই ব্যবসায়ী লুঙ্গি পরেই মঞ্চে উপস্থিত হবে। তার সারা গা থেকে বিড়ির গন্ধ আসবে এটাই স্বাভাবিক।

ছদরুল ব্যাপারীর অবশ্যি আমাদের অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল না। উনি আসবেন মওলানা ইস্কান্দার আলির দোয়া নিতে। এই খবর পেয়ে আমি চেপে ধরলাম। আপনার কথাও বললাম-তখন রাজি হয়েছেন।

সুলতান সাহেব শুকনো মুখে বললেন, আমার কথা বলার দরকার হল কেন?

আপনি এত বড় একজন মানুষ। আপনার কথা আমি বলব না?

.

মাহফুজ আনন্দে ঝলমল করছে। আনন্দের উৎস ছদরুল ব্যাপারী। ব্যাপারী সাহেব বড় ধরনের কোন দান করবেন এটাই কী মাহফুজ আশা করছে? সেই আশাতেই তাকে বিশেষ অতিথি করা হল। তাকে প্রধান অতিথি করার মূলেও এই আশা কাজ করছে। এই গ্রামে তার জায়গা-জমি আছে। তেমন হুলুস্থুল ধরনের কিছু না, কিন্তু আছে। এই বাড়িটা আছে। সে-সব দান করার কথা তিনি ভাবছেন না। জমি-জমা কিছু আছে বলেই তিনি ছুটি ছাটায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে আসতে পারেন। সামান্য হলেও একটা যোগসূত্র আছে। সেটা যাতে থাকে সেই চেষ্টা তাকে করতে হবে।

তাছাড়া কয়েকটা পাকা দালান বানিয়ে স্কুল-কলেজ চালু করে দিলেই হয় না। সেই স্কুল-কলেজ যাতে চালু থাকতে পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হয়। শিক্ষকদের বেতন, ছাত্র-ছাত্রী জোগাড়। অনেক কিছুই আছে। সেই অনেক কিছুর কথা স্কুল-কলেজের উদ্যোক্তাদের মনে থাকে না। মানুষ অতি বুদ্ধিমান প্রাণী হলেও তার দৃষ্টি মোটামুটি বর্তমানেই আটকে থাকে। ভবিষ্যৎ সে দেখতে পারে না। বা দেখতে পারলেও দেখতে চায় না। সুলতান সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে রানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, রানু মা, আমি মাহফুজের সঙ্গে কিছু কথা বলব।

রানু বলল, তুমি চাও না আমি সেই কথাগুলো শুনি? আমাকে চলে যেতে বলছ।

সুলতান সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রানু উঠে চলে গেল। মনে হল সে খানিকটা হলেও অপমানিত বোধ করছে। সুলতান সাহেব পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললেন, মাহফুজ তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলার জন্যে রানুকে সরিয়ে দিলাম। রানু অসুস্থ। আমি চাই না সে এইসব কথা শুনুক বা এইসব কথা তাকে কোনভাবে অ্যাফেক্ট করুক।

মাহফুজ অবাক হয়ে বলল, উনার কি অসুখ?

তার কি অসুখ সেটা আমাদের আলোচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ না তারপরেও বলছি তার অসুখটা শারীরিক না। মানসিক। সে কিছু ব্যাক্তিগত দুর্যোগের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। যার চাপ সে সহ্য করতে পারে নি। তার কিছু মানসিক সমস্যা হয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট তার চিকিৎসা করছে। আমি যে মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছি এই কারণেই এসেছি। তাকে আলাদা করে একা কিছু সময় দেবার জন্যে এসেছি।

মাহফুজ কিছু বলল না। সে তাকিয়ে রইল। তার তাকিয়ে থাকার ভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে সে খুবই দুঃখিত বোধ করছে। সুলতান সাহেব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন- আমি আমার মেয়েকে সবরকম ঝামেলার বাইরে রাখতে চাই। অথচ তুমি ঝামেলাই তৈরি করেছ। তুমি কোন রকম কথাবার্তা ছাড়া কোয়েশ্চেনেল চরিত্রের একটি মেয়েকে আমার বাড়িতে এনে তুলেছ।

স্যার আপনি…।

কথার মাঝখানে কথা বলবে না। আমার কথা শেষ হোক তারপর যা বলার বলবে। তুমি ঐ মেয়েটিকে আমার এখান থেকে নিয়ে যাবে। এখনি নিয়ে যাবে।

জি আচ্ছা।

রাতে তোমার এই নাটকের যন্ত্রণায় আমাকে জড়াবে না। কাউকে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি করতে হলে তাঁর পূর্ব সম্মতির প্রয়োজন আছে। তুমি আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস কর নি…

স্যার আপনি না গেলে…

কথার মাঝখানে কথা বলতে তো নিষেধ করেছি। তারপরেও কথা বলছ কেন? নেভার ডু দ্যাট এগেইন। আমি কয়েকটা দিন একা থাকতে এসেছি। আমাকে একা থাকতে দাও। আমার যা বলার বলেছি এখন তুমি যেতে পার। মেয়েটিকে নিয়ে যেও।

মাহফুজ শুকনো গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা।

সুলতান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আর শোন মেয়েটির পায়ে না কি কাঁটা ফুটেছে। দয়া করে কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করবে।

.

রানু খুবই অবাক।

একটা মেয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। তাকে এখন নিয়ে যেতে হবে কারণ নাটকের রিহার্সের হবে। কি উদ্ভট কথা। মাহফুজ মাথা নিচু করে বলল, রিহার্সেল লাগবেই। ভুজঙ্গ বাবু বলে পাঠিয়েছেন। উনি খুবই মেজাজী মানুষ। শেষে দেখা যাবে নাটক ফেলে উনি চলে গেলেন।

চলে গেলে চলে যাবেন। প্রয়োজন হলে আমি ভুজঙ্গের সঙ্গে কথা বলব। আমাকে ভুজঙ্গের কাছে নিয়ে চলুন।

চিত্র বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল, এত ঝামেলা করে লাভ নেই আমি যাই। রিহার্সেল শেষ করে চলে আসব।

রানু বলল, আমি কি রিহার্সেল দেখার জন্যে যেতে পারি?

মাহফুজ বলল, না। ভুজঙ্গ বাবু বাইরের কারো সামনে রিহার্সেল করেন না।

রানুর মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেল। চিত্রা মেয়েটাকে তার অসম্ভব ভাল লেগেছে। এত ভাল লেগেছে যে তাকে তার চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করছে না। তার প্রধান সমস্যা এটাই, যাকে ভালো লাগে তাকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষরা সবাই চোখের আড়ালে চলে যায়। চিত্রা রিহার্সেল শেষ করে এখানে চলে আসবে এটা এখন আর তার মনে হচ্ছে না। চিত্রা আর আসবে না। মেয়েটার সঙ্গে গল্পই করা হল না। রানু ঠিক করে রেখেছিল পুকুরঘাটটা পরিষ্কার করে সেখানে ইটের চুলা পেতে আজ সে নিজে রান্না করবে! পাশে থাকবে চিত্রা। রান্না করতে করতে গল্প করবে। বনভোজন বনভোজন ভাব চলে আসবে। শ্যাওলা পরিষ্কারের পর যদি দেখা যায় পুকুরের পানি টলটল পরিষ্কার তাহলে তারা দুজন কিছুক্ষণের জন্যে হলেও পানিতে নামবে। কিছুই করা হল না। রানু বাগানে চলে গেল।

নীল পালকের পাখিটা বাগানে নিশ্চয়ই কোথাও আছে। পাখিটাকে খুঁজে বের করতে হবে। সঙ্গে একটা দূরবীন থাকলে ভাল হত। চোখে দূরবীন লাগিয়ে পাখি খোঁজা।

সুলতান সাহেবকে বারান্দায় দেখা যাচ্ছে। তিনি নেমে আসছেন। রানু জানে তিনি এখন বারান্দায় আসবেন। কোন জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন। ভাবতেই রানুর অসহ্য লাগে। রানু এখন কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। বাবাকে সে কি কঠিন গলায় বলতে পারে না যে তুমি আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও। তুমি সঙ্গে থাকলে পাখিটা আমি খুঁজে পাব না। হ্যাঁ, নিশ্চয় পারে।

কী করছিস রে মা?

পাখি খুঁজছি।

কী পাখি খুঁজছিস?

 নীল পালকের একটা পাখি।

ঠোঁট কী লাল?

হু।

তাহলে মাছরাঙ্গা। মাছরাঙ্গা পাখির বিশেষত্ব জানিস?

রানু শান্ত গলায় বলল, বিশেষত্ব জানি না। এবং বিশেষত্ব জানার আমার কোন ইচ্ছাও নেই। তুমি দয়া করে এখন পাখি বিষয়ক কোন বক্তৃতা শুরু করবে না। আমি একা একা বাগানে বেড়াতে এসেছি। বক্তৃতা শুনতে এখন ইচ্ছা করছে না।

 সুলতান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন কারণে কি তোর মনটা বিক্ষিপ্ত?

হা বিক্ষিপ্ত।

কারণটা বলা যাবে?

হ্যাঁ যাবে। কারণ হচ্ছ তুমি।

আমি?

হ্যাঁ তুমি। তুমি মাহফুজ সাহেবকে বলেছ চিত্রা মেয়েটিকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে। বল নি?

সুলতান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ করলেন তাঁর মেয়ে থরথর করে কাঁপছে। এটাতো ভাল কথা না।

রানু বলল, চিত্রাকে যে তুমি বিদেয় করেছ এ ব্যাপারে আমি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত।

কিভাবে নিশ্চিত হলি?

মাহফুজ সাহেবের সঙ্গে আমি অনেকক্ষণ গল্প করেছি। তাকে বলেছি চিত্রা অসুস্থ। তিনি বলেছেন বিশ্রাম নিক। সন্ধেবেলা নাটকের আগে গেলেই হবে। আর তারপরই তোমার সঙ্গে উনার কথা হল। সুলতান সাহেব তখন বলতে শুরু করলেন ভুজঙ্গ বাবুর সঙ্গে রিহার্সেল। এতক্ষণ ভুজঙ্গ বাবু ছিলেন না। তোমার সঙ্গে কথা বলার পরই ভুজঙ্গ বাবু উদয় হলেন। বাবা তুমি কি সুলতান সাহেবকে বল নি চিত্রা মেয়েটিকে নিয়ে চলে যেতে।

বলেছি। কেন বলেছি জানতে চাস?

না, আমি জানতে চাই না। জানতে চাইলেই তুমি দশ বারোটা সুন্দর যুক্তি দেখাবে। যুক্তিগুলো খুবই গ্রহণযোগ্য মনে হবে। আমি যুক্তি শুনতে যাচ্ছি না। শুধু যুক্তি কেন আমি তোমার কোন কথাই শুনতে চাচ্ছি না।

আমার কোন কথাই শুনতে চাচ্ছিস না।

না। কারণ তুমি একজন ভান সর্বস্ব মানুষ। আমি ভান পছন্দ করি।

আমি ভান সর্বস্ব মানুষ?

অবশ্যই। তুমি কখনো লুঙ্গি পর না। তুমি অনেকবার বলেছ লুঙ্গি হচ্ছে একটা নোংরা এবং অশালীন পোষাক, অথচ তুমি যখনই গ্রামে আস তখনি লুঙ্গি নিয়ে আস। এবং গ্রামের পথে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াও। কারণ গ্রামের লোকজন এই ব্যাপারটা দেখে বলবে- আহা মানুষটা কত সহজ সরল।

রানু তুই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিস। এরকম উত্তেজিত হবার মত কোন ঘটনা ঘটে নি।

আমি তোমার মত না বাবা। আমি সাধারণ মানুষের মত। উত্তেজিত হবার মত কোন ঘটনা দেখলে আমি উত্তেজিত হই। তুমি কখন হও না। তোমার মাথা সব সময় ঠাণ্ডা। পনের বছর আগে তুমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পেরেছিলে। আমার তখন বয়স কত? দুবছর। আমাকে মার সঙ্গে যেতে দাও নি। আমার দেখাশোনার জন্যে আরেকটি বিয়ে তুমি করেছ। সেটিও করেছ খুব ঠাণ্ডা মাথায়।

Young lady compose yourself.

 Thanks. I will try.

সুলতান সাহেব সিঁড়ি বেয়ে আবারও উঠে গেলেন। রানু একা একা পাখি খুঁজতে লাগল। পাখিটা বাগানেই কোথাও আছে। লুকিয়ে আছে পাতার আড়ালে। রানুর ধারণা এক্ষুণি পাখিটাকে পাওয়া যাবে।

.

চিত্রা কেমন এলোমেলো পা ফেলছে। মাহফুজ চিন্তিত বোধ করছে। সুলতান সাহেবের বাড়ি থেকে তার বাড়ি অনেকখানি পথ। মেয়েটার জ্বর যদি খুব বেশি হয় তাহলে সে এতখানি পথ হেঁটে যেতে পারবে না। কপালে হাত দিয়ে কি দেখবে জ্বর কত? এটা কি ঠিক হবে? না, ঠিক হবে না।

চিত্রা বলল, ভুজঙ্গ বাবু কখন এসেছেন?

মাহফুজ বলল, উনি এখনো আসেন নি। তার অ্যাসিসটেন্ট চলে এসেছে।

আপনি যে বললেন, ভুজঙ্গ বাবু এসেছেন। রিহার্সেল করবেন।

মিথ্যা কথা বলেছি। তোমাকে নিয়ে আসার জন্য বলেছি।

কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

আমার বাড়িতে।

 ঐ বাড়িতেই তো আমি খুব ভাল ছিলাম।

মাহফুজ নিচু গলায় বলল, আমার বাড়িতেও খুব ভাল থাকবে। চাদর গায়ে গিয়ে শুয়ে থাকবে। বিশ্রাম হবে। শরীর খারাপ করেছে এখন বিশ্রাম দরকার। ভাল বিশ্রাম না হলে রাতে নাটক টানতে পারবে না।

চিত্রা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, ঐ বাড়ি থেকে কি আমাকে বের করে দিয়েছে? সুলতান সাহেব নামের মানুষটা কি বলেছে আমাকে এক্ষুণি বিদেয় করে দিতে হবে।

মাহফুজ বলল, আরে না। কি বল তুমি। সুলতান সাহেব এরকম মানুষই না। তুমি অসুস্থ শুনে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমাকে বললেন- এক্ষুণি ডাক্তার জোগাড় করতে। আমার মাথায় একশ ঝামেলা, এর মধ্যে কোথায় ডাক্তার পাব তুমিই বল।

চিত্রার চোখমুখ কঠিন হয়ে গিয়েছিল মাহফুজের কথায় আবার স্বাভাবিক হল। সে হাঁটতে শুরু করল। তবে মেয়েটার শরীর মনে হয় বেশ খারাপ। মনে হচ্ছে হাঁটতেই পারছে না।

মাহফুজ বলল, তুমি দেখি খুবই আশ্চর্য মেয়ে। তুমি ভেবে বসলে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। হা হা হা।

চিত্রা গম্ভীর গলায় বলল, এ রকম হা হা করবেন না। বাড়ি থেকে বের করে দেবার ঘটনা আমার জীবনে আগে ঘটেছে বলেই আমি বলেছি। একবার রাত দুটার সময় আমাকে বের করে দিল। রাত একটার সময় নাটক শেষ হয়েছে। আমি ঘরে গিয়ে মেকাপ তুলছি তখন যে বাড়িতে আমার থাকার জায়গা সেই বাড়ির একজন বুড়ো মানুষ এসে খুবই খারাপ ভাষায় আমাকে বের হয়ে যেতে বললেন। যারা আমাকে সেই বাড়িতে তুলেছিল তারাও কেউ নেই। আমাকে রেখে চলে গেছে। কি যে বিপদে পড়লাম।

সুলতান সাহেব সেরকম না। ইনি অন্য ধরনের মানুষ।

চিত্রা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল, তিনি যে অন্য রকম মানুষ তা তাঁর মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যায়। মেয়েটা কি আশ্চর্য রূপবতী। মনে হয় তুলি দিয়ে আঁকা।

.

মাহফুজের বাড়িতে যেতে হলে ক্লাবঘরের সামনে দিয়ে যেতে হয়। ক্লাবঘরের সামনে বেশ ভিড়। কাঠের সবকটা চেয়ার রোদে পাতা হয়েছে। একটা বেঞ্চও বের করা হয়েছে। হাতলওয়ালা চেয়ারটায় ছদরুল ব্যাপারী বসে আছেন। ছদরুল ব্যাপারী কখনো একা ঘুরাফেরা করেন না। সঙ্গে চার পাঁচজন লোক থাকে। এখনো আছে। গ্রামের লোকজন তাদের ঘিরে আছে। ছদরুল ব্যাপারী মাহফুজকে দেখে হাত ইশারায় ডাকল। মাহফুজ অবাক হয়ে এগিয়ে গেল। ছদরুল ব্যাপারী এখন আসার কথা না। তার আসার কথা সন্ধ্যার আগে আগে। তিনি মওলানা ইস্কান্দার আলির জন্যে ইফতার নিয়ে আসবেন। ইস্কান্দার আলিকে ইফতার খাইয়ে নাটক দেখে চলে যাবেন। কি মনে করে সকালে এসেছেন কে জানে।

ছদরুল ব্যাপরীর মুখ ভর্তি পান। তিনি অনেক আয়োজন করে গলা খাকাড়ি দিয়ে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন মাহফুজ মিয়া ভাল আছ?

জি, ভাল আছি।

একটু আগে আগে চইলা আসলাম। ভাবলাম তোমাদের অঞ্চলটা ঘুরা দিয়া দেখি।

জ্বি খুব ভাল করছেন।

ঐ যে দূরে দাঁড়ায় আছে মেয়েটা কে, নাটকের না?

 জ্বি।

নাটক কেমন করে?

খুব ভাল করে।

নাম কি?

 চিত্রা।

 মেয়েটার কি শইল খারাপ?

 জ্বি, জ্বর এসেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তারে কোথায় নিয়া যাইতেছ যাও। তোমার কাজকর্ম কর। আমারে নিয়া ব্যস্ত হবা না। আমি তোমাদের অঞ্চলটা ঘুরা দিয়ে দেখব। ইস্কান্দার সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা বলব।

জ্বি আচ্ছা।

 সুলতান সাবের সাথেও দেখা করা দরকার- এমন বিশিষ্ট মানুষ।

আপনি দেখা করতে চাইলে নিয়ে যাব।

নিয়ে যাইতে হবে না। আমার যেখানে যাইতে ইচ্ছা করে নিজেই চইল্যা যাই।

ছদরুল ব্যাপারী আবারও পানের পিক ফেলল। এবারও আগের মতো আয়োজন করে পিক ফেলা। শুধু পিক ফেলাতেই ঘটনা শেষ হয় না। পিক ফেলে সেই পিকের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘটনার ইতি হয়।

চিত্রা দূর থেকে মানুষটাকে দেখছে। তার কাছে মনে হচ্ছে একজন মৃত মানুষ চেয়ারে বসে আছে। রক্ত শূন্য মুখ। হলুদ চোখ। বসে থাকার ভঙ্গির মধ্যেই ক্লান্তি এবং অবসাদ। মনে হচ্ছে এই মানুষটা অনেকদিন ধরে ঘুমুতে পারে না। তার খুব ভাল ঘুম দরকার। চেয়ারে সে বসে আছে ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি জেগে নেই।

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ