০৭.

আজ ছুটির দিন। ছুটির দিন দুপুরে টুকুন কখনো ঘুমায় না। আজ তার এতই মন খারাপ যে চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল– ঘুম ভাঙল দাঁড়কাকের ডাকে —

ও টুকুন! টুকুন! অসময়ে ঘুমুচ্ছ? ব্যাপারটা কি? দুপুরে কেউ ঘুমায়?

 টুকুন উঠে বসল। কাক একসঙ্গে অনেকগুলি প্রশ্ন করল,

 ব্যাপার কি?

 মন খারাপ কেন?

কাঁদছিলে নাকি?

 হয়েছে কি?

টুকুন বলল, ছোট ফুপু রিসার্চ করে বের করেছেন ঝেং-এর বাচ্চা বলে কিছু নেই।

রিসার্চ করে বের করে ফেলেছে?

হু।

কি বলল সে?

 বলল, এমন কিছু থাকতে পারে না যে শুধু কাগজ খায় –আর কিছু খায় না।

এই কথা বলল?

হু।

শোন টুকুন, ঝেং-এর বাচ্চা আছে। প্রতিটি সরকারি অফিসে একটা-দুটা করে ঝেং-এর বাচ্চা আছে। এরা কি করে জান? এরা দরকারী ফাইল খেয়ে ফেলে। প্রায়ই শোন না ফাইল পাওয়া যায় না? পাওয়া যায় না কেন? ঝেং-এর বাচ্চারা খেয়ে ফেলে। এরা বেঁচেই আছে সরকারি ফাইল খেয়ে।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

দলিলপত্রের রেকর্ড যেখানে থাকে সেখানেও ঝেং-এর বাচ্চারা থাকে। তারা মহানন্দে রেকর্ডপত্র খেয়ে ফেলে।

কেউ কিছু বলে না?

না, বরং খুশি হয়।

ছোট ফুপুর রিসার্চ তাহলে ঠিক না?

উঁহু।

একটা কাগজে উনি প্রতিবেদন লিখেছেন। আপনি একটু পড়ে দেখবেন?

প্রতিবেদন ফেদন পড়তে ভাল লাগে না। চোখেও ডিসটার্ব করছে। তুমি পড়। আমি শুনি।

টুকুন পড়ে শোনাল। দাঁড়কাক গম্ভীর ভঙ্গিতে শুনল। পড়া শেষ হলে বলল, বোগাস। রিসার্চ কিছুই হয়নি। তোমার ছোট ফুপুর মাথা মোটা।

উনার মাথা মোটেই মোটা না। গত বছর ফিজিক্স অনার্স পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছেন।

এইটাই তো মাথামোটার লক্ষণ। মাথামোটারা পড়ার বই ছাড়া কিছু বুঝে না– শুধু বই পড়ে আর ফাস্ট-সেকেন্ড হয়। ঐ যে তোমাদের রবীন্দ্রনাথের কথাই ধর। কাক নিয়ে যিনি এত সুন্দর একটা কবিতা লিখলেন —

বৈশাখ মাসে কাক গাছে বসে থাকে।

তিনি কি কখনো ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েছেন? হননি। তুমি তোমার ছোট ফুপুকে বলবে –ফুপু, আপনার মাথা মোটা।

এটা বলা যাবে না। শুনলে উনি খুব রাগ করবেন।

রাগ করলেও বলা উচিত। সত্য গোপন করতে নেই। কি অদ্ভুত মাথামোটা মেয়ে– চোখে দেখা যাচ্ছে না। কাজেই বলে দিল জিনিস নেই। অনেক কিছুই আছে কিন্তু চোখে দেখা যায় না– যেমন ধর তোমার ইলেট্রন প্রোটন। এদের ওজন আছে, কিন্তু ওজন খুব কম। সাধারণ পাল্লাপাথরে মাপা যায় না। সে ঝেং-এর বাচ্চার ওজন মাপার জন্যে সাধারণ একটা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে এসেছে– কি রকম মাথামোটা মেয়ে –উফ! যাও তো টুকুন– টেলিফোন করে আমার কথাগুলি বলে আস।

টুকুন টেলিফোন করতে উঠে গেল।

 হ্যালো ছোট ফুপু!

কে টুকুন?

 কাকটা এসেছিল।

ও আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম ঝেং-এর বাচ্চা পাওয়ার পর কাক বাবাজী দূর হয়েছেন। উনি তাহলে দূর হননি?

না।

ভাল কথা। উনি কি বললেন?

উনি বললেন– তোমার মাথা মোটা।

আমার মাথা মোটা?

হ্যাঁ?

আর উনার মাথা খুব সরু?

ছোটফুপা উনার নিজের মাথার কথা কিছু বলেন নি। তোমারটার কথা বলেছেন।

কেন আমার মাথা মোটা সেটা বলেনি?

বলেছেন। উনি বলেছেন চোখে না দেখা গেলেই যে একটা জিনিস থাকবে না, তা না। ইলেকট্রন দেখা যায় না। কিন্তু ইলেক্ট্রন আছে।

অবশ্যই আছে। কিন্তু গাধা– ইলেট্রন দেখা না গেলেও ইলেকট্রনের কাজকর্ম দেখা যায়। তারে হাত দিলে শক খেতে হয়। শক খায় ইলেকট্রনের জন্যে। তোর ঝেং-এর বাচ্চা কিছু করে না। কাউকে শক দেয় না। এমন যদি হত ঘরের সব কাগজপত্র খেয়ে ফেলতো তাহলেও বুঝতাম।

তুমি এত রেগে রেগে কথা বলছ কেন ছোট ফুপু?

রেগে রেগে কথা বলছি –কারণ আমি রেগে গেছি। তুই তোর ঐ কাকটাকে বলিস –ছোট ফুপু বলেছেন –আপনি একটা গাধা। বলতে পারবি না?

না।

না কেন?

কারণ উনি গাধা না। পাখি কখনো গাধা হয় না। ছোট ফুপু, তোমার মাথা আসলেই মোটা।

টুকুন শুনল ছোট ফুপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। টুকুন ভয়ে ভয়ে বলল, কি হয়েছে ছোট ফুপু?

কিছু হয়নি।

 তুমি কাঁদছ?

হ্যাঁ, আমি কাঁদছি। চব্বিশ বছর বয়স হয়েছে আমার। কেউ আমাকে মাথামোটা বলেনি। তুই বলেছিস। আমি কাঁদব না?

আমি বলিনি ছোট ফুপু। কাক বলেছে।

কাক-টাক সব বাজে কথা। এগুলি তোর মনের কথা।–

ছোট ফুপু টেলিফোনেই বাচ্চা মেয়েদের মত কাঁদতে লাগলেন। টুকুনের খুব মন খারাপ হল। এরকম কাণ্ড হবে সে কখনো ভাবেনি। তার নিজেরো কান্না পেতে লাগল। ছোট ফুপুকে সে যে কি ভালবাসে তা শুধু সে-ই জানে। আর কেউ জানে না।

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ