০৬.

অপালার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। খুব ভাল পরীক্ষা হওয়ায় তার মন ভাল। সে পরীক্ষার পরদিনই একটা ক্যামেরা নিয়ে টুকুনদের বাসায় উপস্থিত। এখন সে টুকুনের বিখ্যাত ঝেং-এর ছানা নিয়ে গবেষণা করবে। ক্যামেরা এনেছে। ঝেং-এর বাচ্চার ছবি তুলে, ছবি প্রিন্ট করবে। যদি ছবিতে কিছু আসে। বেশকিছু ছবি তোলা হল। সিঙ্গেল ছবি, টুকুনের কোলে বসিয়ে ছবি। ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে, ফ্ল্যাশ লাইট ছাড়া।

টুকুন বলল, ছবিতে কি ওকে দেখা যাবে ছোট ফুপু?

অপলা বলল, না দেখা যাবে না। যে জিনিস চোখে দেখা যায় না সে জিনিস ক্যামেরাতেও ধরা পড়ে না।

তাহলে ছবি তুলছ কেন?

 এমনি তুলছি।

অপলা শুধু যে ছবি তুলল তাই না, আরো কিছু কাণ্ড করল। ওজন মাপার যন্ত্রে জন্তুটার ওজন নেয়ার চেষ্টা করল। না এর কোন ওজন নেই।

অপলা বলল, এখন তোর ঝেং-এর বাচ্চাকে আমরা চৌবাচ্চার পানিতে চুবিয়ে ধরে রাখব।

তাতে কি হবে?

দেখব বেঁচে থাকার জন্যে এর অক্সিজেনের দরকার আছে কি না। ধর, এটাকে নিয়ে আয়, আমরা চৌবাচ্চার পানিতে চুবাব।

না, এর কষ্ট হবে।

কষ্ট হলে ছটফট করবে। তখন ছেড়ে দিস। তোর হাতেই তো থাকবে।

ঝেং এর বাচ্চাকে চৌবাচ্চার পানিতে চুবানো হল। কিছু হল না। অপলা বলল, আচ্ছা, তোর এই জন্তুটার উপর আমি যদি বসে পড়ি তাহলে ওর কি হয়?

কিছুই হয় না। চ্যাপ্টা হয়ে যায়। তুমি উঠে দাঁড়ালে আবার ঠিক হয়ে যায়।

চল এটাকে কোন একটা ক্লিনিকে নিয়ে যাই। এক্সরে করাব। এক্সরে করে দেখব কি ব্যাপার।

তাও করা হল। অপলা নানান পরীক্ষার পর একটি রিপোর্ট লিখল। সেই রিপোর্ট টাইপ করে টুকুনের হাতে দিয়ে বলল, নে গাধা, বাংলায় লিখে এনেছি। যাকে বলে নিখুঁত বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন। বসে বসে পড়, তারপর মাথা থেকে ঝেং-এর বাচ্চা দূর কর। তুই সবাইকে যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছিস। আর না।

অপলা যা লিখে এনেছে তা হল–

ঝেং-এর বাচ্চা
একটি বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন

নাম : ঝেং-এর বাচ্চা।

প্রজাতি : অজানা। (টুকুনের ধারণা– এটি চার কানের অদৃশ্য জন্তু)

ওজন :  শূন্য।

দৈর্ঘ ও উচ্চতা : শূন্য।

 বর্ণ ও গন্ধ: নাই।

 খাদ্য : গ্রহণ করে না। (টুকুনের ধারণা –কাগজ খায় যদিও তা প্রমাণ করা যায়নি।)

ফটোগ্রাফি এবং এক্সরে পরীক্ষা : কিছু পাওয়া যায়নি।

অক্সিজেন গ্রহণ : তথাকথিত জন্তুটি অক্সিজেন গ্রহণ করে না। পানির নিচে, এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড পূর্ণ বাক্সে জন্তুটিকে দীর্ঘ সময় রেখে দেখা গেছে সে ভালই আছে।

 ঘাত সহনশীলতা : প্রচণ্ড চাপেও জন্তুটির কিছু হয় না। জন্তুটি স্থিতিস্থাপক। টানলে রবারের মত বাড়ে ( টুকুনের বক্তব্য। কারণ আমরা কেউ তা দেখতে পাচ্ছি না।]

 রাসায়নিক সক্রিয়তা : বস্তুটি রাসায়নিকভাবে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। পানি, তীব্র এসিড ও তীব্র ক্ষার তার কিছুই করে না।

বস্তু ভেদ্যতা : জন্তুটি যে কোন বস্তুর ভেতর দিয়ে যেতে পারে। একে টিনের ট্রাংকের ভেতরে বন্ধ করে রাখলেও এ ট্রাংকের ভেতর দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। সিমেন্টের দেয়ালের ভেতর দিয়ে পারাপার করতে পারে (টুকুনের ধারণা)।

 গবেষকের পরীক্ষার ফলাফল : পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বিবেচনা করে গবেষক এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, অদৃশ্য জন্তু জনৈক কিশোরের কষ্টকল্পনা। এই কল্পনাকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেয়া যায় না। কিশোরকে বলা হচ্ছে সে যেন তার এই অদৃশ্য জন্তু, তথাকথিত ঝেং-এর বাচ্চাকে অনতিবিলম্বে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসে। তার নিজের এবং পরিবারের শান্তির জন্যে এটি অত্যন্ত প্রয়োজন।

 টুকুন মুখ কালো করে প্রতিবেদন পড়ল। অপলা হাই তুলে বলল, পড়েছিস?

হু।

তোকে তিন দিন সময় দেয়া হল। তিন দিনের ভেতর এই যন্ত্রণার মুক্তি চাই। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় যা পাওয়া গেল, তোকে বললাম।

আচ্ছা।

মুখ হাড়ির মত করে রেখেছিস কেন? মুখ হাড়ির মত করে রাখার কিছু নেই।

অপলা শিস দিতে দিতে চলে গেল। মন খারাপ করে নিজের ঘরে টুকুন চুপচাপ বসে রইল। ঝেং-এর বাচ্চাকে নিয়ে আজ আর খেলতেও ইচ্ছা করছে না। শুধুই কাঁদতে ইচ্ছা করছে। মৃদুলা যদি একটু বড় হত তাহলে তার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটত। সে এখনো এত ছোট। সে এখন শুধু দাঁড়াতে শিখেছে, অল্প অল্প হাঁটাও শিখেছে। কথা বলা ঠিকমত শেখেনি। কাগজ ছেঁড়া ছাড়া অন্য কিছু এখনো ভালমত পারে না। সে কাগজ ঘেঁড়ে। ঝেং-এর বাচ্চা তার কোলে বসে থাকে। কোলে বসে বসেই খায়। টুকুনের ধারণা– মৃদুলা ঝেং-এর বাচ্চাকে দেখতে পায়। সে কথা বলতে পারে না বলে ঘটনাটা অন্যদের বলতে পারে না।

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ