০৪.

আজ টুকুনের জন্মদিন।

টুকুন ভেবেছিল জমকালো জন্মদিন হবে। লোকজনে বাড়ি ভরে যাবে। বিরাট একটা কেক আসবে। সাতটা মোমবাতি জ্বলবে। সে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভাবার সময় মনে মনে একটা জিনিস চাইবে। যা চাইবে তাই হবে। এই হল নিয়ম। দেখা গেল জন্মদিনে কেউ আসছে না।

রশিদ সাহেব বিকেলে অফিস থেকে ফিরলেন খালি হাতে। উপহারের কোন প্যাকেট তাঁর হাতে দেখা গেল না। এক সময় টুকুন তার মার কাছে গিয়ে বলল, জন্মদিনের কেক আনতে কে যাবে মা?

তিনি বললেন, কেউ যাবে না। তোমাকে গত জন্মদিনে আমরা কি বলেছিলাম? সাত বছর বয়স পর্যন্ত জন্মদিন হবে। তারপর আর হবে না। তোমার বাবার এসব পছন্দ না। আমারো না।

কেউ আসবে না মা?।

না, কেউ আসবে না। কাউকে আসতে বলিনি। তবে কেউ যদি নিজ থেকে চলে আসে তাহলে আসবে। যেমন ধর তোমার ছোট ফুপু। সে তো আসবেই।

উপহারও আনবে। তাই না মা?

হ্যাঁ উপহার আনবে।

তোমরা কি কিছু কিনেছ আমার জন্যে?

আমরা একটা উপহার কিনেছি। তবে তা তোমাকে দেয়া ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। তোমার বাবা চিন্তা করছেন। তিনি যদি মনে করেন তোমাকে দেয়া যায় তাহলে হয়তো বা দেয়া হবে।

কতক্ষণ লাগবে তাঁর চিন্তা শেষ করতে?

তা তো বলতে পারি না।

টুকুন মন খারাপ করে ঘুরতে লাগল। তার কিছু ভাল লাগছে না। অবশ্যি সে এখনো আশা ছাড়েনি। তার কেন জানি মনে হচ্ছে সন্ধ্যার পর দেখা যাবে এক এক করে বাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে। তাদের টুকুনের জন্মদিনের কথা বলা হয়নি, তবে তারিখটা তাঁদের মনে ছিল বলে নিজে থেকেই চলে এসেছেন। এত মানুষজন এসেছে দেখে শেষ মুহূর্তে বাবা বলবেন –আচ্ছা ঠিক আছে, একটা কেক না হয় কিনে নিয়ে আসি।

সন্ধ্যার পরও কেউ এল না। এমন কি ছোট ফুপুও না। তবে ছোট ফুপু টেলিফোন করলেন।

হ্যালো টুকুন সোনা, শুভ জন্মদিন।

টুকুন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।

ছোট ফুপু টুকুনের কাঁদো গলা ধরতে পারলেন না। তিনি হাসিমুখে বললেন, খুব মজা হচ্ছে, তাই না?

হু।

কেক কি কাটা হয়ে গেছে?

এখনো হয়নি।

টুকুনের চোখে এবার সত্যি সত্যি পানি এসে গেল। টেলিফোনে চোখের পানি দেখা যায় না বলে রক্ষা। দেখা গেলে সমস্যা হত।

টুকুন!

জ্বি!

তোর গলা এমন শুনাচ্ছে কেন? সর্দি লেগেছে নাকি?

হু।

ছোট ফুপু বললেন, আমার কোন অসুখ-বিসুখ হলে ভাল হত। বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করতে পারতাম। অসুখ-বিসুখ কিছু হচ্ছে না। দিনরাত ফিজিক্স পড়তে হচ্ছে। এখন পড়ছি ফুয়িড ডায়নামিক্স –অতি বিশ্রী জিনিস।

আমার উপহার কিনেছ ছোট ফুপু?

না, কেনা হয়নি। ঘর থেকে বের হতে পারি না –উপহার কিনব কি? একসময় কিনে এসে দিয়ে যাব।

আচ্ছা।

ভাল কথা, তোর কাক কি উপহার নিয়ে এসেছে?

আসেনি।

কি মনে হয় তোর –আসবে?

জানি না।

এলে টেলিফোন করিস।

আচ্ছা।

টুকুন তার নিজের ঘরে চুপচাপ বসে রইল। আজ মৃদুলাও এই ঘরে নেই। তার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগেছে। চোখ লাল। নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝরছে। মুনা তাকে নিয়ে যাবেন ডাক্তারের কাছে। তাকে গরম কাপড় পরানো হচ্ছে।

রশিদ সাহেব এসে টুকুনকে ডেকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, আমার সামনে চেয়ারের উপর শান্ত হয়ে বস তো টুকুন।

টুকুন বসল।

তোমার মনটা কি খারাপ? মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

 মনে হয় ঠাণ্ডা লাগবে।

 তোমার জন্মদিন হচ্ছে না –এই জন্যে মন খারাপ না তো?

টুকুন কিছু বলল না। চুপ করে রইল। রশিদ সাহেব বললেন, তোমাকে তো আগেই বলেছি গতবারই ছিল শেষ জন্মদিন। বলিনি?

হ্যাঁ।

বুঝলে টুকুন– ঢাকা শহরে অসংখ্য ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে যারা এই প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। গায়ে দেবার মত ওদের একটা গরম সুয়েটার পর্যন্ত নেই। সেখানে হৈচৈ করে জন্মদিন করা ঠিক না। আমি তোমার জন্মদিনের টাকা দিয়ে উলেন গরম কাপড় কিনে ওদের বিলি করেছি। ভাল করিনি?

হ্যাঁ।

তুমি মুখে অবশ্যি বলছ হ্যাঁ তবু মন খারাপ করে আছ। আজ তোমার কাছে খারাপ লাগছে কিন্তু যখন বড় হবে তখন খারাপ লাগবে না। তখন ভাল লাগবে। তখন বলবে, বাবা যা করেছেন ভাল করেছেন এদেশের সব বাবাদের এটা করা উচিত।

আমি যাই বাবা?

না বোস। আমার কথা শেষ হয়নি। আমি তোমার জন্যে একটা উপহার কিনেছি –দেখ পছন্দ হয় কি না।

বাবা টুকুনের হাতে উপহার তুলে দিলেন। কি যে সুন্দর উপহার! এত বড় একটা রঙ-তুলির বাক্স। ব্রাশই হচ্ছে তিনটা। এত বড় রঙের বাক্স মনে হয় পৃথিবীতে আর নেই। এই একটাই বোধহয় তৈরি হয়েছিল। বাবা কিনে নিয়ে এসেছেন।

পছন্দ হয়েছে টুকুন?

হ্যাঁ। খুব পছন্দ হয়েছে। খুব খুব খুব।

রশিদ সাহেব বললেন, তুলির বাক্সটা তো তোমার হাতে দেয়া যাবে না, বাবা। এটা থাকবে আমার ড্রয়ারে তালাবন্ধ। তোমার যখন ছবি আঁকতে ইচ্ছা করবে আমার সামনে বসে ছবি আঁকবে।

কেন বাবা?

কারণ তোমার হাতে রঙ-তুলি দিলেই তুমি ছবি এঁকে সারা দেয়াল ভর্তি করবে। এটা তোমাকে করতে দেয়া হবে না। এখন কি ছবি আঁকতে চাও?

না।

বেশ, আমি তাহলে ড্রয়ার তালাবন্ধ করে রাখছি।

.

টুকুনের বাবা-মা মৃদুলাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। টুকুন একা একা তার ঘরে বসে রইল। বাড়িতে সে অবশ্যি একা না, রহিমার মা আছে। সে রান্নাঘরে রান্না করছে। টুকুনের কিছুই ভাল লাগছে না। সুকুমার রায়ের বই নিয়ে বসল। পড়ার চেষ্টা করল।

চলে হন হন  ছোটে পন পন
 ঘোরে বন বন  কাজে ঠন ঠন
বায়ু শন শন  শীতে কন কন
কাশি খন খন  ফোড়া টন টন
 মাছি ভন ভন  থালা ঝন ঝন

অন্য সময় এই কবিতা এত ভাল লাগত! আজ একেবারে মাথা ধরে যাচ্ছে। টুকুন বই বন্ধ করল, আর তখনি কাকটা এসে বসল জানালার পাশে। গম্ভীর গলায় বলল, শুভ জন্মদিন।

টুকুন বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।

কাকটা বলল, গেস্টরা সব চলে গেছেন?

হু।

আমি ইচ্ছা করেই দেরি করে এলাম। লোকজনের ভিড় ভাল লাগে না। বয়স হয়েছে তো। হৈচৈ-এ মাথা ধরে যায়। কেক কাটা হয়েছে?

কেক কেনা হয়নি।

 সে কি! কেন?

বাবা বললেন, আর জন্মদিন হবে না। এখন থেকে জন্মদিনের টাকায় গরীবদের গরম কাপড় কিনে দেবেন।

ও আচ্ছা।

 উনি লেখক তো, এই জন্যে গরীবদের কষ্ট দেখলে তাঁর খারাপ লাগে।

এ আবার কেমন কথা? গরীবদের কষ্ট দেখলে শুধু লেখকদের কেন সবারই খারাপ লাগে। আমি তো লেখক না। আমি হলাম গিয়ে কাক। আমার নিজেরই খারাপ লাগে। যাই হোক, তুমি মন খারাপ করবে না।

মন খারাপ করিনি।

এই ত মিথ্যা কথা বললে– মুখ অন্ধকার করে বসে আছ আর মুখে বলছ মন। খারাপ করিনি। হাস তো।

টুকুন হাসলো।

কাক বলল, তোমার হাসি খুব সুবিধার লাগছে না। মনে হচ্ছে কষ্ট করে হাসছ। গল্প শুনবে? গল্প শুনতে চাইলে গল্প বলতে পারি, বলব?

বলুন।

এক দেশে ছিল এক কাক। কাকটা এক টুকরা মাংস খুঁজে পেয়ে খুব খুশি হয়ে গাছের ডালে বসল। তখন একটা শিয়াল ঠিক করল কাককে বোকা বানিয়ে মাংসটা নিতে হবে …।

এই গল্প আমি জানি। এটা ঈশপের গল্প।

 ঈশপ ভূল গল্প বলেছে। আসল গল্প বলেনি। আসল গল্পটা তোমাকে শুনাচ্ছি। তারপর হল কি –শিয়ালটা বলল, কাক ভাই, কাক ভাই! কি মধুর তোমার গানের গলা! তুমি যখন সকাল বেলা কা কা সুরে গান গাও এত ভাল লাগে। ভৈরবি রাগিনীতে আর কোন পাখি এমন কা কা করতে পারে না। একমাত্র তুমিই পার। তুমি আমাকে একটা গান গেয়ে শুনাও না। গান শোনার জন্যে প্রাণ ছটফট করছে।

কাক শিয়ালের চালাকি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল। সে কা কা করবে আর মুখ থেকে মাংসের টুকরা নিচে পড়ে যাবে। শিয়াল সেটা খাবে মহানন্দে। কাজেই কাকটা করল কি– পায়ে নখ দিয়ে মাংসের টুকরা চেপে রেখে সুন্দর করে গান গাইল। গানের কথাগুলি হল :

কা কা কা
শিয়াল ব্যাটা বোকা, কা কা কা।
মহা বোকা, বেজায় বোকা, কা কা কা।

বুঝলে টুকুন –এটা হল আসল গল্প। ঈশপের গল্পটা নকল। তোমার বাবা তো লেখক মানুষ। তাঁকে বল তো আসল গল্পটা লিখে ফেলতে।

আচ্ছা বলব।

আর শোন, তোমার জন্মদিনে খালি হাতে আসা ঠিক হবে না দেখে সামান্য উপহার নিয়ে এসেছি। জানি না তোমার পছন্দ হবে কি না।

টুকুন আনন্দিত গলায় বলল, কি এনেছেন?

একটা ঝেং-এর বাচ্চা।

কিসের বাচ্চা?

 ঝেং-এর।

টুকুন বিস্মিত হয়ে বলল, কই আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

ঝেং-এর বাচ্চা চোখে দেখা যায় না, টুকুন। ঝেং-এর বাচ্চা হয় অদৃশ্য। শুধুমাত্র পাখিরাই ঝেং-এর বাচ্চা দেখতে পায়। ঝেং এর বাচ্চা ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। খেলবে কিন্তু কেউ চোখে দেখবে না।

বাহ, কি মজা!

মজা তো বটেই। তা ছাড়া ঝেং-এর বাচ্চাগুলি কাউকে কামড়ায় না –কিছু করে না। মাঝে মাঝে শুধু সুড়সুড়ি দেয়।

হাত দিলে বোঝা যায়?

 না, হাত দিয়েও কিছু বুঝবে না।

বাহ, মজা তো।

দারুণ মজা।

ঝেং-এর বাচ্চা কি খায়?

কাগজ খায়। তোমাদের বাসায় তো কাগজের অভাব নেই। বাবা লেখক মানুষ। তাছাড়া মৃদুলা তো ক্রমাগতই কাগজ ছিঁড়ছে।

ঝেং-এর বাচ্চা কি কথা বলতে পারে?

না। তবে মাঝে মাঝে খিল খিল করে হাসে। তাও খুব আস্তে। খুব মন দিয়ে না শুনলে বুঝতেও পারবে না।

ঝেং এর বাচ্চা এখন কোথায় আছে?

ও এখন তোমার বিছানায় বসে আছে।

ও দেখতে কেমন?

খুব সুন্দর। ছোট্ট উলের বলের মত। খরগোশের মত বড় বড় কান। তবে দুটা কান না, চারটা কান।

লেজ আছে?

 না, লেজ নেই।

আমি ওকে কাগজ দিলে কি ও খাবে?

না। মানুষের সামনে ঝেং-এর বাচ্চা কখনো কিছু খায় না। যখন কেউ থাকে না তখন সে কপ করে কাগজ গিলে ফেলে।

ইশ, কি আশ্চর্য!

তুমি খুশি হয়েছ টুকুন?

 দারুণ খুশি হয়েছি। আপনাকে ধন্যবাদ।

কাক উড়ে চলে গেল। টুকুনের ইচ্ছা করছে ঝেং-এর বাচ্চার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে। তা সম্ভব নয়। একে চোখে দেখা যায় না। টুকুন গাঢ় গলায় বলল, ঝেং-এর ছানা, আমি খুব খুশি হয়েছি। খুব খুশি। এই নাও তোমাকে কিছু কাগজ দিলাম। খিদে লাগলে খেও। আমি এখন ছোট ফুপুকে টেলিফোন করতে যাচ্ছি।

.

হ্যালো ছোট ফুপু।

 কিরে টুকুন! হাঁপাচ্ছিস কেন?

 দারুণ ব্যাপার হয়েছে, ছোট ফুপু।

দারুণ ব্যাপার আমারো হয়েছে। সারা সকাল সারা দুপুর ফ্লুয়িড ডায়নামিক্স পড়ে পড়ে এখন মনে করতে গিয়ে দেখি সব ভুল মেরে বসে আছি। কিছু মনে নেই। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। তোর দারুণ ব্যাপারটা কি?

কাক এসেছিলেন।

 ও আচ্ছা, এসেছে তাহলে! খালি হাতে এসেছে, না কিছু নিয়ে এসেছে?

নিয়ে এসেছেন।

কি আনল –মরা ইঁদুর, না মুরগির নাড়িভুড়ি।

উনি ঝেং-এর বাচ্চা নিয়ে এসেছেন।

কিসের বাচ্চা বললি?

 ঝেং-এর বাচ্চা।

সেটা আবার কি?।

খরগোশের কানের মত লম্বা লম্বা চারটা কান আছে। গোল, উলের বলের মতো।

তুই দেখে বলছিস?

 না ছোট ফুপু। ঝেং-এর বাচ্চা তো দেখা যায় না। ঝেং-এর বাচ্চা হয় অদৃশ্য।

অদৃশ্য!

 হ্যাঁ অদৃশ্য। ওদের গায়ে হাতও দেয়া যায় না।

বুঝলি কি করে চারটা বড় বড় কান?

কাক বলে গেছেন।

ও আচ্ছা।

ঝেং-এর বাচ্চা কি খায় জান?

না।

কাগজ খায়। আর কিছু খায় না।

অপলা টেলিফোনেই ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, টুকুন তুই তো বুদ্ধিমান ছেলে। ক্লাসের সব পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হোস। এই বয়সেই সুকুমার রায়ের সব কবিতা মুখস্থ। তুই কি করে বিশ্বাস করিস যে ঝেং-এর বাচ্চা বলে একটা জিনিস আছে যাকে চোখে দেখা যায় না? যার গায়ে হাত দেয়া যায় না। অথচ এর চারটা খরগোশের মত লম্বা লম্বা কান। মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেল। আর বাবা-মাকে ঝেং-এর বাচ্চা সম্বন্ধে কিছু বলবি না। আমার মনে হয় বললে বকা খাবি। আমি টেলিফোন রাখলাম।

ছোট ফুপু খট করে টেলিফোন রেখে দিল। টুকুন মন খারাপ করে নিজের ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল, তার বিছানার উপরে একগাদা ঘেঁড়া কাগজের একটিও নেই। নিশ্চয়ই ঝেং-এর বাচ্চা খেয়ে ফেলেছে।

টুকুন আবার ছুটে গেল টেলিফোন করতে।

হ্যালো ছোট ফুপু।

আবার কি হল?

 ঝেং-এর বাচ্চা কি করেছে জান?

অপলা গম্ভীর গলায় বলল, ঝেং-এর বাচ্চা সম্পর্কে কোন কথা শুনতে চাই না। অন্য কিছু বলার থাকলে বল। আছে কিছু বলার?

না।

বেশ, তাহলে টেলিফোন নামিয়ে রাখ। আর আমাকে ডিসটার্ব করবি না। মনে থাকে যেন। আমার কিছু পড়া হয়নি। নির্ঘাৎ থার্ড ক্লাস পাব। তুই কি চাস আমি থার্ড ক্লাস পাই?

না চাই না।

তাহলে টেলিফোন নামিয়ে রাখা এবং মন দিয়ে আমার কথাটা শোন। কথাটা হচ্ছে– আবার টেলিফোন করবে না।

আচ্ছা।

খোদা হাফেজ টুকুন।

খোদা হাফেজ ছোট ফুপু।

টুকুন টেলিফোন নামিয়ে রাখল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার টেলিফোন করল। সে জানে ছোট ফুপু খুব রাগ করবে তবুও টেলিফোন করল, কারণ আসল কথাই বলা হয়নি। ঝেং-এর বাচ্চা কাগজ খেয়ে ফেলেছে –এটাই বলা হয়নি।

হ্যালো ছোট ফুপু।

হুঁ।

আবার ফোন করেছি বলে রাগ করেছ?

করেছি। প্রচণ্ড রাগ করেছি।

আমি শুধু একটা কথা বলে টেলিফোন নামিয়ে রাখব।

বেশ বল একটা কথা।

 ঝেং-এর বাচ্চা কাগজ খেয়ে ফেলেছে।

কি খেয়ে ফেলেছে?

কাগজ। আমার বিছানার উপর অনেক কাগজ ছিঁড়ে রেখেছিলাম। ঐগুলি খেয়ে ফেলেছে। এখন কোন কাগজ নেই।

শোন টুকুন– ঝেং-এর বাচ্চা কোন কাগজ খায়নি। রহিমা বুয়া ঝাঁট দিয়ে ফেলেছে। তাকে জিজ্ঞেস কর।

আচ্ছা করছি।

টুকুন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না, কারণ কলিংবেল বাজছে। তার বাবা-মা চলে এসেছেন। টুকুন দৌড়ে গেল সদর দরজার দিকে।

রশিদ সাহেব মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে একটা কেক কিনে এনেছেন। শুধু কেক না, আটটা মোমবাতিও আছে।

রাতের খাবার শেষ হবার পর মোমবাতি জ্বালানো হল। মা বললেন, চোখ বন্ধ করে মনে মনে কিছু চাও এবং মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নেভাও। এক ফুঁ দিয়ে নেভাও। এক ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারলে মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে।

টুকুন চোখ বন্ধ করে এক ফুঁ দিল এবং মনে মনে বলল, আমি যেন ঝেং-এর বাচ্চাকে দেখতে পাই। চোখ মেলে দেখল সব মোমবাতি নিভে গেছে। তারচেয়েও বড় কথা– সে ঝেং-এর বাচ্চাটাকে দেখতে পাচ্ছে। শরীরটা মনে হচ্ছে নরম কঁচের তৈরি। চোখ দুটি হালকা গোলাপী। চারটা লম্বা কান বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে।

টুকুন উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, ঝেং-এর বাচ্চা! ঝেং-এর বাচ্চা! ঐ দেখ ঝেং-এর বাচ্চা! আমি দেখতে পাচ্ছি।

রশিদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, কি বলছ টুকুন?

টুকুন বলল, একটা ঝেং-এর বাচ্চা বসে আছে বাবা। কান নাড়ছে। দেখ দেখ, কি সুন্দর করে কান নাড়ছে।

কিসের বাচ্চা বললে?

 ঝেং-এর বাচ্চা।

ঝেং-এর বাচ্চা ব্যাপারটা কি?

একটা অদৃশ্য প্রাণী। এই প্রাণীটা কেউ চোখে দেখতে পারে না। এর চারটা। লম্বা লম্বা কান আছে। ও চেয়ারটায় বসে আছে বাবা।

তুমি দেখতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ পাচ্ছি।

রশিদ সাহেব অনেকক্ষণ মন খারাপ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মুনাকে বললেন, এতদিন ছিল কাক। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে– ঝেং এর বাচ্চা। কি করি বল তো?

মুনা টুকুনের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, কোথায় তোর ঝেং-এর বাচ্চা?

ঐ তো বসে আছে।

 যা ধরে নিয়ে আয়। টুকুন ঝেং-এর বাচ্চা ধরতে গেল। বাচ্চা পালিয়ে গেল না। বরং হাত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে হাতে উঠে এল। টুকন ঝেং-এর বাচ্চা কোলে নিয়ে এগিয়ে আসছে। তার বাবা-মা, দুজনই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। কারণ তাঁরা কিছুই দেখছেন না।

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ