০৫.

টুকুনের বাবা-মা টুকুনকে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে এসেছেন। ভদ্রলোকের নাম এম. আলম। শিশু হাসপাতালের খুব বড় ডাক্তার। গম্ভীর চেহারা হলে ও তাকে দেখে মনে হয় –তিনি মজার মজার গল্প জানেন।

টুকুনের বাবা বললেন, আমার এই ছেলেটাকে ভাল করে একটু দেখুন তো ডাক্তার সাহেব।

ডাক্তার সাহেব বললেন, কি হয়েছে ওর?

ওর মাথায় কোন সমস্যা হয়েছে কিনা সেটা দেখুন।

মাথায় সমস্যার কথা কেন বলছেন? কি খোবা, তোমার মাথা ব্যথা করে?

টুকুন বলল, না।

 তাহলে সমস্যা কি তোমার? পড়া মনে থাকে না?

 পড়া মনে থাকে।

মুনা বললেন, ওর বাইরে থেকে কোন সমস্যা নেই ডাক্তার সাহেব। পড়াশোনায় ভাল। বুদ্ধিমান। প্রচুর খেলাধুলা করে। হঠাৎ একদিন বলা শুরু করল– একটা কাক নাকি তার সঙ্গে কথা বলে।

মুনাকে কথা শেষ না করতে দিয়েই ডাক্তার সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, এই সামান্য কারণে তাকে আপনি আমার কাছে নিয়ে এসেছেন? আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার পরিস্কার মনে আছে –আমি একটা টেডি বিয়ারের সঙ্গে কথা বলতাম। এটা কোন ব্যাপারই না।

রশিদ সাহেব বললেন, আমি জানি এটা কোন ব্যাপার না। আমি বা আমার স্ত্রী– আমরা কেউ তেমন গুরুত্ব দেইনি কিন্তু ইদানিং নতুন সমস্যা হয়েছে। সে বলছে তার সঙ্গে একটা ঝেং-এর বাচ্চা থাকে।

কিসের বাচ্চা?

ঝেং-এর বাচ্চা। একটি অদৃশ্য প্রাণী। যাকে কেউ দেখতে পায় না। শুধু সে দেখতে পায়।

ডাক্তার সাহেব বললেন, বলুক না। এটাকে গুরুত্ব দেয়ার কি আছে? বাচ্চাদের অনেক ধরনের ফ্যান্টাসি থাকে। একটু বুদ্ধি হলেই সব কেটে যাবে। আপনাদের চিন্তিত বোধ করার কোনই কারণ নেই।

রশিদ সাহেব বললেন, চিন্তিত বোধ করার কারণ একেবারেই যে নেই তা না। ও এখন সারাক্ষণই আছে তার ঝেং-এর বাচ্চা নিয়ে। তাকে গোসল করাচ্ছে। গা মুছে দিচ্ছে। স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা হাল্কাভাবে নেয়ার উপায় এখন আর নেই। এই যে আপনার কাছে এসেছি– আমার ছেলে তার ঝেং-এর বাচ্চা নিয়ে এসেছে।

ডাক্তার সাহেব হাসিমুখে বললেন, তাই নাকি খোকা?

টুকুন বলল, হ্যাঁ।

কোথায় সে?

ঐ তো, আপনার টেবিলে বসে আছে।

ডাক্তার সাহেব টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শূন্য টেবিল মনে হল তিনি খানিকটা হতাশ হয়েছেন। হয়ত আশা করেছিলেন কিছু দেখবেন। ডাক্তার সাহেব টুকুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ঝেং-এর বাচ্চা কি খায়?

কাগজ খায়।

 সব ধরনের কাগজ খায়?

 জি না। খবরের কাগজ খায় না।

টাকা খায়? টাকাও তো কাগজে ছাপা।

খেতে পারে। আমি কখনো ওকে টাকা খেতে দেইনি।

 আচ্ছা, এই চকচকে নোটটা রাখলাম। দেখি ও খায় কি-না।

ডাক্তার সাহেব একটা পাঁচশ টাকার নোট টেবিলে রাখলেন।

 টুকুন বলল, আপনার সামনে তো খাবে না। কেউ সামনে থাকলে খায় না।

ডাক্তার সাহেব বললেন, তুমি আদর করে বল, তুমি আদর করে বললে হয়ত খাবে।

টুকুন বলল, খাও তো টুন টুন, খাও তো।

পাঁচশ টাকার নোট পড়ে রইল। টুকুন বলল, ও খাবে না। আমরা তাকিয়ে আছি তো এই জন্যে খাবে না।

ডাক্তার সাহেব বললেন, ও তাহলে টাকা খাবে না?

টুকুন বলল, আমরা সবাই তাকিয়ে আছি তো তাই খাবে না। তাকিয়ে না থাকলে হয়ত খেয়ে ফেলত। ও খুব লাজুক।

ওর স্বভাব-চরিত্র কি বল দেখি?

শান্ত স্বভাব। খুব ভদ্র।

দাঁত আছে?

আছে। আমাদের যেমন সাদা দাঁত ওরগুলি তেমন নয়। ওরগুলি হালকা নীল।

 দাঁত মেজে দিতে হয়?

আমি মাঝে মাঝে আমার টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজে দেই।

মুনা বললেন, ডাক্তার সাহেব, এখন আপনি বলুন –আমরা যখন দেখি একটা ছেলে অদৃশ্য এক প্রাণীর দাঁত মেজে দিচ্ছে তখন কেমন লাগে?

ডাক্তার সাহেব মুনার কথার জবাব না দিয়ে বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার পাঁচশ টাকার নোটটা কোথায় গেল?

তাই তো। টেবিলে ফেলে রাখা পাঁচশ টাকার নোটটা নেই।

টুকুন বলল, আমার মনে হয় ঝেং-এর বাচ্চা নোটটা খেয়ে ফেলেছে। আমরা যখন অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিলাম তখন সে এক ফাঁকে কপ করে খেয়ে ফেলেছে।

ডাক্তার সাহেব বললেন, শোন খোকা, কেউ কিছু খায়নি। বাতাসে নোটটা টেবিল থেকে নিচে পড়ে গেছে। এক্ষুণি তা খুঁজে বের করা হবে।

ডাক্তার সাহেব ব্যস্ত হয়ে টেবিলের নিচে খুঁজতে লাগলেন। ময়লা ফেলার ঝুড়ির সব কাগজ মেঝেতে ঢেলে ফেলা হল। টুকুনের বাবা-মাও খুঁজতে লাগলেন। টুকুনও খুঁজছে। নোট নেই। ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, বাতাসে হয়ত জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেছে। এই হয়েছে। এছাড়া আর কিছু না। তিনি তাঁর এ্যাসিসটেন্টকে বাইরে খুঁজতে পাঠালেন। কিছু পাওয়া গেল না।

ডাক্তার সাহেব বললেন, বুঝতে পেরেছি কি হয়েছে –নোটটা জানালা দিয়ে। বাইরে চলে গেছে। কেউ একজন খুঁজে পেয়ে নিয়ে গেছে। এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। রশিদ সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, কিছু যদি মনে করেন, আমি আপনাকে টাকাটা দিয়ে দি।

আরে না, আপনি কেন টাকা দেবেন! ভাল কথা, এই অদৃশ্য জন্তুর অস্তিত্বে আপনারা কি বিশ্বাস করেন?

জি-না।

এমন কিছু কি ঘটেছে যাতে এই জন্তুটিকে বিশ্বাস করতে হয়?

না, এমন কিছু ঘটে নি।

তাহলে তো কোন সমস্যাই নেই। এই ছেলে কি ভাবছে না ভাবছে এটা বড় কথা নয়। আমার মনে হয় আপনার ছেলে এইচ. জি. ওয়েলএর ইনভিজিবল ম্যান বইটা পড়েছে। পড়ার পর তার মাথায় অদৃশ্য জন্তুর ধারণা ঢুকে গেছে। আপনারা প্রশ্রয় দেবেন না। তাহলেই হল।

আমরা প্রশ্রয় দিচ্ছি না।

দিচ্ছেন না তাও কিন্তু না। প্রশ্রয় দিচ্ছেন– এই যে ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছেন, এও এক ধরনের প্রশ্রয় দেয়া।

ডাক্তার সাহেব টুকুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, খোকা তুমি কি অদৃশ্য মানব বইটা পড়েছ?

টুকুন গম্ভীর গলায় বলল, মানুষ অদৃশ্য হতে পারে না। অদৃশ্য হয় ঝেং এর বাচ্চা।

ডাক্তার সাহেব বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে।

রশিদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। টুকুনকে বললেন, উনাকে স্নামালিকুম দাও।

 টুকুন বলল, স্লামালিকুম।

ডাক্তার সাহেব বললেন, খোকা, তুমি কি তোমার ঝেং-এর বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছ?

জি, নিয়ে যাচ্ছি।

গুড।

তাঁরা চলে যাবার পর ডাক্তার সাহেবের ভুরু কুঞ্চিত হল, কারণ টেবিলে রাখা তাঁর ডায়েরীর অর্ধেকের মত পাতা নেই। মনে হচ্ছে এইমাত্র ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে। অথচ এই ডায়েরীটা তার খুবই দরকারী। জরুরী ঠিকানা, টেলিফোন নাম্বার লেখা। ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বসে রইলেন।

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ