০৩.

নুহাশ স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে। মুনারা-মা তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। নুহাশের কাঁধে বইয়ের ব্যাগ, হাতে পানির বোতল। মুনার-মাকে সে কিছু নিতে দেবে না। রিকশায় যাবার সময় মুনার-মা তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে থাকে। তাতেও নুহাশের আপত্তি, সে বড় হয়েছে তাকে হাত ধরে ধরে রাখা যাবে না। তাছাড়া বুয়ার গা থেকে মশলার গন্ধ আসছে।

স্কুলের কাছাকাছি এসে নুহাশ বলল, স্কুলে যেতে ইচ্ছা করছে না বুয়া।

বাসায় চইল্যা যাবা?

হু।

আম্মায় হুনলে রাগ হইব।

অনেকদিন স্কুলে কামাই হয়েছে। আজও যদি না যাওয়া হয় তাহলে মা সত্যি সত্যি রাগ করবে। নুহাশের সঙ্গে রাগ করলে মা হৈচৈ বা বকাঝকা করে না–কথা বন্ধ করে দেয়, আর কেমন ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে। এরচে বকাঝকা ছিল ভাল।

নুহাশ বলল, আমার বোধ হয় জ্বর আসছে। জ্বর নিয়ে কি স্কুলে যাওয়া উচিত?

না, উচিত না। দেখি জ্বর কেমন?

 মুনার-মা গায়ে হাত দিল। গা ঠাণ্ডা। জ্বর নেই।

 জ্বর আছে না বুয়া?

উঁহু, শইল ঠাণ্ডা।

শরীর ঠাণ্ডা হওয়াও এক ধরনের জ্বর। আসল জ্বরের চেয়েও খারাপ।

 তা হইলে চল বাসায় যাই গিয়া।

বাসায় যেতেও ইচ্ছা করছে না।

 মুনার-মা বিস্মিত হয়ে বলল, কই যাইতে চাও?

বাবার কলেজে চল না বুয়া। তুমি তো চেন। চেন না? মিনহাজের কলেজ মুনার-মা চেনে। কয়েকবার এসেছে। কিন্তু হুট করে নুহাশকে নিয়ে কলেজে উপস্থিত হওয়াটা কি ঠিক হবে? আম্মা শুনলে প্রচণ্ড রাগবে। নুহাশ বলল, চল না বুয়া।

রিকশা ভাড়া তো নাই। যামু ক্যামনে?

আমার কাছে টাকা আছে। আমি স্কুল ব্যাগে হরলিক্সের কৌটাটা নিয়ে এসেছি।

মিনহাজকে কলেজে পাওয়া গেল না। আজ তার ক্লাস ছিল এগারোটায়, কিন্তু সে দশদিনের আনড লিভ নিয়েছে। আগামী দশদিন আসার কোন সম্ভাবনা নেই। কলেজের একজন স্যার বললেন, তোমার বাবাকে কিছু বলতে হবে খুকী?

নুহাশ কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, না।

 বাসায় চলে যাও। নিশ্চয়ই তোমার বাবা এতক্ষণে বাসায় চলে গেছে।

আচ্ছা।

নুহাশ বাসায় গেল না। কলেজের করিডোরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে-বাবা হুট করে কলেজে চলে এসে তাকে চমকে দেবে। এ রকম কতবার হয়েছে। আসার যখন কথা না, তখন বাবা এসে উপস্থিত। একবার তারা নানাবাড়ি গিয়েছে–জামালপুর। দুপুরের ট্রেনে গেছে। বাবা যায় নি। তার নাকি খুব জরুরি কাজ। সকালে কলেজে পরীক্ষার ডিউটি আছে। প্রিন্সিপ্যাল ছুটি দেবে না। এত মন খারাপ হল নুহাশের! ট্রেনে উঠল কাঁদতে কাঁদতে। মা বলল, বাবা সঙ্গে যাচ্ছে না তো কি হয়েছে। তার কাজ আছে। কাজেই সে যাচ্ছে না। বেড়ানোর চেয়ে কাজ বড় না?

নুহাশের নানা বাড়ি পৌঁছল সন্ধ্যাবেলা। বাড়িতে ঢুকে দেখে বাবা নানীজানের পালংকে পা তুলে হাসিমুখে সবার সঙ্গে গল্প করছে। নুহাশের দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর তোমাদের কি খবর? নুহাশ এতই অবাক হল যে মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। তার মনে হল এটা বোধ হয় স্বপ্ন। রেবেকা বলল ব্যাপার কি? মিনহাজ হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের একটা সারপ্রাইজ দিলাম। পরীক্ষার ডিউটি অন্য একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে সোজা চলে গেলাম বাস স্টেশনে। বাস করে এক ধাক্কায় জামালপুর। কি, সারপ্রাইজড হয়েছ?

নুহাশের ধারণা, বেশ কিছুক্ষণ কলেজের করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকলে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে বাবা এসে উপস্থিত হবে।

মুনার-মা বলল, চল যাই গিয়া। কতক্ষণ খাড়াইয়া থাকবা?

আচ্ছা চল।

নুহাশের মনে হল সে অনেকদিন বাবাকে দেখছে না, অনেক অনেক দিন। আজ দেখা হলে খুব ভাল হত। অনুস্বার কবিতাটা শোনা যেত। বাবা নুহাশকে নিয়ে একটা কবিতা বানিয়েছে। কবিতার নাম অনুস্বার কবিতা। খুব জটিল কবিতা। এমিতে মানে বোঝা যায় না। কিন্তু মানে আছে।

নুহাশ আব্বুটিং

(নুহাশ আব্বু)

গোলটা চক্ষুং
(তার চোখ গোল)
হাসটুং করছিং
 (সে হাসি করছে অর্থাৎ হাসছে)
ফিকফিকিং
(ফিকফিক করে)
হাসটুং দেখং, আদর লাগছিং
 (হাসি দেখে আদর লাগছে)

নুহাশ জ্বর নিয়ে ফিরল। এতে সে এবং মুনার-মা দুজনই বেশ খুশি হল। মাকে আর মিথ্যা বলতে হবে না। সত্যি সত্যি জ্বর এসেছে।

জ্বর হওয়া নুহাশের অভ্যাস হয়ে গেছে। খারাপ লাগে না বরং চাদর গায়ে দিয়ে জানালার কাছে বসে থাকতে ভাল লাগে। মুনার-মা বলল, কিছু খাইবেন আফা?

না।

 সরবত বানাইয়া দেই, লেবু দিয়া?

উঁহু।

 জ্বর তাইলে কমব।

সরবত খেলে জ্বর কমবে না। জ্বর কেন হয় তা কি তুমি জান মুনার মা?

জানব না ক্যান? আল্লাহ্ পাক জ্বর দেয় বইল্যাই জ্বর হয়।

দূর। আল্লাহ্ এমন খারাপ জিনিস আমাদের দেবেন কেন? উনি দেবেন। ভাল ভাল জিনিস।

জ্বর খারাপ জিনিস না আফা। জ্বর ভাল জিনিস। জ্বর হইলে পাপ কাটা যায়।

কি যে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তুমি বল বুয়া।

পুব দিকের জানালা খোলা। জ্বর গায়ে নুহাশ জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দুটি ভিখিরী মেয়ে ঠিক জানালার নিচে খেলা করছে। অদ্ভুত খেলা। একজন অন্যজনকে ঠেলছে এবং খিলখিল করে হাসছে। এই খেলার নাম বোধ হয় ঠেলাঠেলি খেলা। নুহাশ ডাকল-অ্যাই অ্যাই। ওরা দুজনও একই সঙ্গে বলল–অ্যাই অ্যাই। বলে হেসে একজন অন্যজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। এত আনন্দ এদের!

দুপুরে এল শিল-পাটা ধার করানোর মানুষটা। নুহাশের তখন জ্বর বেড়েছে। সে শুয়ে আছে চাদর গায়ে জড়িয়ে। এখন তার কিছুই ভাল লাগছে না। দেয়ালগুলিকে মনে হচ্ছে অনেক বেশি শাদা। চোখে লাগছে। শিল-পাটা ধার করানোর লোকটা ঠিক তার জানালার কাছে এসে মিষ্টি করে বলছে–শিল-পাটা ধার করাইবেন? শিল-পাটা। অবিকল যেন একটা গান। গান শুনতে শুনতে নুহাশ ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল। নুহাশের গায়ে জ্বর নেই। শরীর ঝরঝরে। খুব খিদে হয়েছে। ঘুম ভেঙেই সে শুনল মা কার সঙ্গে যেন উঁচু গলায় কথা বলছেন। কার সঙ্গে? বাবা কি চলে এসেছে? নুহাশ কান পেতে রাখল। না–বাবা আসে নি। মেজোমামা।

নুহাশের একজনই মামা। তিনি নুহাশের মার চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড়। তবু নুহাশ কেন তাকে মেজোমামা ডাকে সে নিজেও জানে না।

তার নাম জাহেদুল করিম। বিমানের পাইলট। বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকেন। খুব গম্ভীর ধরনের মানুষ। তবু কেন জানি নুহাশের তাকে খুব ভাল লাগে। তিনি এ বাড়িতে আসার মানেই হল–কোন-না-কোন উপহার নুহাশের জন্যে নিয়ে এসেছেন। তিনি খালি হাতে এ বাড়িতে এসেছেন এমন দুর্ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটে নি।

মেজোমামার সঙ্গে মা ঝগড়া করছে কেন? বড় ভাইদের সঙ্গে কখনো কি ঝগড়া করা যায়? যায় না। নুহাশের কোন বড় ভাই থাকলে সে কখনো তার সঙ্গে ঝগড়া করত না। বড়দের ঝগড়া ছোটদের শোনা উচিত না–তবু নুহাশ শুনছে। কারণ মা কেন ঝগড়া করছে তা জানতে ইচ্ছে করছে।

মেজোমামা : (গলা খুব গম্ভীর) তুই বলতে চাচ্ছিস যে তোদের অ্যাডজাস্টমেন্ট হচ্ছে না? [অ্যাডজাস্টমেন্ট ব্যাপারটা কি নুহাশ বুঝতে পারছে না। এক সময় মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

মা : না অ্যাডজাস্টমেন্ট হচ্ছে না। অতীতেও হয় নি, ভবিষ্যতেও হবে না। আমরা দুজন দুই মেরুর মানুষ। [মেরুর মানুষ আবার কি? এস্কিমো?]

মেজোমামা : তুই তবে চাস কি?

মা : আমি ঠিক করেছি ওর সঙ্গে বাস করব না।

 মেজোমামা : বাস করব না বলতে কি মিন করছিস?  [মিন করছিসটা আবার কি?]

মা : আমি সেপারেশন নেব ভাইয়া। আমি নুহাশকে নিজের মত করে মানুষ করব।

মেজোমামা : সেপারেশন নিবি?

মা : হ্যাঁ নেব। সেপারেশন ছাড়া পথ নেই। [সেপারেশন কি নুহাশ জানে। তাদের ক্লাসের একটি মেয়ে মিথিলার বাবা-মার সেপারেশন হয়েছে। বাবাটা অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। সেই মেয়েটা একদিন স্কুলে এসেছিল। ও আল্লা দেখতে কি যে কুৎসিত!]।

মেজোমামা : চট করে বলে ফেললি সেপারেশন?

মা : চট করে তো বলি নি ভাইয়া। আমি এটা নিয়ে তিন বছর চিন্তা করেছি। তোমাদের কাউকে কিছু বলি নি। ওর সঙ্গে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।

মেজোমামা : আমার তো ধারণা তুই এখনি পাগল হয়ে গেছিস… কথা শোন রেবেকা! ব্যাপারটা হল কি…

মা : তুমি আমাকে কিছু বুঝাতে এসো না ভাইয়া। লাভ হবে না। আমি আজ অফিসে যাই নি। এক লইয়ারের কাছে গিয়েছি। ওকে উকিলের চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি।

মেজোমামা: কি বললি?

মা : বুঝতে পারছি–তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না। উকিলের চিঠির কপি আমার কাছে আছে। দেখতে চাইলে দেখতে পার।

মেজোমামা: আই সি।

মা : ভাইয়া চা খাবে?

মেজোমামা : না, চা খাব না। নুহাশকে দেখে চলে যাব। তোর অবগতির জন্যে জানাচ্ছি- নুহাশের বাবাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করি।

মা : সেটা আমি জানি। ওর চরিত্রে কিছু মজার ব্যাপার আছে যা সবাইকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু তোমরা ওর সঙ্গে জীবনযাপন কর না। আমি করি। আমার কাছে কিছুই মজার বলে মনে হয় না। তুমি কি চলে যাচ্ছ ভাইয়া?

মেজোমামা: হ্যাঁ চলে যাচ্ছি।

.

মেজোমামা চলে যাবার আগে নুহাশের ঘরে ঢুকলেন। নুহাশ লাফ দিয়ে উঠল।

কেমন আছিস রে নুহাশ টুনটুন?

ভাল আছি মেজোমামা।

 জ্বর বাঁধিয়েছিস শুনলাম।

 হ্যাঁ মামা বাঁধিয়েছি।

জ্বর বেশিদিন বেঁধে রাখিস না। বেশিদিন বেঁধে রাখলে গায়ের সঙ্গে লেগে যাবে, আর ছাড়ানো যাবে না।

এবার তুমি আমার জন্যে কোন উপহার আন নি মামা?

এনেছি।

 কি এনেছ?

আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ।

সত্যি মামা?

 হ্যাঁ সত্যি। ঐ প্যাকেটে আছে।

নুহাশ হতভম্ব গলায় বলল, ঘষলে দৈত্য চলে আসে?

দূর পাগলী। দৈত্য আসবে কোত্থেকে? এটা একটা খেলনা। আলাদিনের প্রদীপের মত করে বানিয়েছে। ভেতরে দুটা পেনসিল ব্যাটারী আছে। ঘষলে প্রদীপের মাথা থেকে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হয়। মোটর সাইকেলের মত কিছুক্ষণ ভটভট শব্দ হয়। লাল নীল আলো বের হয়। হংকং থেকে কিনলাম।

নুহাশ দুঃখিত গলায় বলল, সত্যিকার প্রদীপ কিনলে না কেন মামা?

পাগলী কি বলে, সত্যিকার প্রদীপ পাব কোথায়? পাওয়া গেলে তো ভালই হত। এই সময়ে যে জিনিসটার সবচে বেশি দরকার তা হল আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ। যাই পাগলী।

নুহাশের মেজোমামা দুঃখী দুঃখী মুখে চলে গেলেন। মামাকে এত দুঃখিত হতে নুহাশ এর আগে কখনো দেখে নি। নুহাশের এতই মন খারাপ হল যে সে উপহারের প্যাকেটটা পর্যন্ত খুলল না।

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ