০৪.

রেবেকা অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়েছিল। আজ ছুটির শেষ দিন। সে নুহাশকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরে চা খেতে বসেছে তখনি কলিং বেল বাজল। দরজা খুলল রেবেকা নিজেই। মিনহাজ দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে রজনীগন্ধার কয়েকটা স্টিক। কিন্তু মিনহাজের মুখও শুকনো।

রেবেকা কঠিন গলায় বলল, কি ব্যাপার?

কোন ব্যাপার না। কেমন আছ?

ভালই আছি, খারাপ থাকব কেন? উকিল নোটিস পেয়েছ? তোমার বন্ধু বদরুলের ঠিকানায় পাঠিয়েছিলাম।

পেয়েছি।

কখন পেলে?

গত রাতে। আমি একটু দিনাজপুর গিয়েছিলাম কান্তজীর মন্দির দেখতে। ফিরে এসে দেখি এই ব্যাপার। একটু বসি রেবেকা।

রেবেকা মনে মনে হাসল। মিনহাজ আজ তার নিজের ঘরেই বসার অনুমতি চাইছে। রেবেকা বলল, ফুলগুলি কি আমার জন্যে?

হু।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছ?

 মিনহাজ হাসল। রেবেকা বলল, দয়া করে হাসবে না। তোমার হাসি আমার অসহ্য বোধ হয়। উকিল নোটিস সম্পর্কেও আমাকে কিছু বলতে চেষ্টা করবে না বা বোঝাতে চাইবে না। আমি যা করেছি অনেক ভেবেচিন্তেই করেছি। যাতে সবার মঙ্গল হয় সেই ব্যবস্থাই করেছি।

মিনহাজ করুণ গলায় বলল, তোমাকে এবং নুহাশকে ছাড়া আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব না।

ভুল বলছ। আমরা দুজন তোমার কাছে কোন ব্যাপারই না। তুমি ব্যস্ত তোমার নিজের ভুবন নিয়ে। তোমার নিজের ভুবন খুব ইন্টারেস্টিং। সেই তুলনায় আমরা মোটেও ইন্টারেস্টিং নই। আমাদের কোন কিছুতেই তোমার কিছু যায় আসে না।

ভুল বললে রেবেকা।

 ভুল বলি নি। আমি এক্ষুণি প্রমাণ করে দিতে পারি। প্রমাণ করব?

 কর।

 বেশ, তাহলে বল তো আমি কোথায় কাজ করি? কোন্ অফিসে? অফিসটা কোথায়? অফিসে আমার নিজের একটা টেলিফোন আছে। সেই টেলিফোনের নাম্বার কত?

মিনহাজ কিছু বলছে না। বিব্রত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। রেবেকা হাসতে হাসতে বলল, আমি গত চার বছর ধরে চাকরি করছি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এই চার বছরে তুমি জানতে চাও নি–আমার চাকরিটা কি? জানার আগ্রহ হয় নি ..

মানে ব্যাপারটা হচ্ছে কি …।

ব্যাপার-ট্যাপার কিছু না। এটা হল তোমার প্রকৃতি। তোমার প্রকৃতির এই অংশ সবার অজানা। সবাই তোমার প্রকৃতির উজ্জ্বল দিকটা জানে। যাই হোক, চা বানিয়ে দিচ্ছি। চা খাও। চা খেয়ে চলে যাও।

নুহাশ কখন ফিরবে?

স্কুল শেষ হলেই ফিরবে। ভাল কথা, নুহাশ কোন স্কুলে পড়ে বল তো?

অগ্রণী।

আগে অগ্রণীতে পড়তো। তারপর স্কুল বদল করা হয়েছে। এখন সে পড়ে হলি ক্রসে। স্কুল বদলের সেই খবর তুমি জান না। ভাল কথা, ওর জন্ম তারিখ জান? বল তো কত?

দশই জুলাই।

রেবেকা হাসতে হাসতে বলল, হয় নি। হবে না জানতাম। দশই জুলাই আমার জন্মদিন। নুহাশের নয়। চা দুধ দিয়ে দেব, না দুধ ছাড়া?

চা খাব না।

তাহলে তো ভালই। এখন চলে যাও।

বিকেলে একবার আসি? নুহাশের সঙ্গে দেখা হয় নি।

বিকেলে এলে দেখা হবে না। আমি ওকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব। তোমার আসার দরকার কি? মায়া যা আছে তাই থাকুক, বাড়িয়ে লাভ নেই। আরেকটা কথা, আমি এই বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি।

যাচ্ছ কোথায়?

একটা অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে উঠব। ভাড়া একটু বেশি, কিন্তু সিকিউরিটি ভাল।

অ্যাপার্টসেন্টটা কোথায়? ঠিকানা কি?

রেবেকা হাই তুলতে তুলতে বলল, একদিনে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা দিতে চাও না?

 এই মুহূর্তে চাচ্ছি না। আমি এখন একটু শুয়ে থাকব।

চলে যেতে বলছ?

হ্যাঁ, ফুলগুলি দয়া করে নিয়ে যাও। বাসি ফুল দিয়ে ঘর ভর্তি করতে চাই না।

মিনহাজ উঠে দাঁড়াল। তার মুখ বিষণ্ণ। দরজা দিয়ে বেরুতে গিয়ে সে চৌকাঠে ধাক্কা খেল। সে তাকাল রেবেকার দিকে। রেবেকা বলল, তোমার মন এখন যত খারাপ বলে মনে হচ্ছে তত খারাপ থাকবে না। মুক্তির আনন্দ পাবে। এক কাজ কর-কুয়াকাটা বলে একটা জায়গায় তোমার যাবার খুব শখ ছিল–ঐখানে চলে যাও। সমুদ্রে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় দুটাই দেখবে। ইন্টারেস্টিং হবে।

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। মিনহাজ বৃষ্টিতেই নেমে গেল। এগুতে লাগল ভিজতে ভিজতে। রেবেকার একটু খারাপ লাগছে। এই খারাপ লাগাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না। শেকসপিয়ারের একটা কথা আছে। হ্যামলেট বলছিল– I have to be cruel, only to be kind. রেবেকা তাই করছে। এর বেশি কিছু না।

.

দুদিন পর মিনহাজ আবার এল।

এবার তার হাতে কুড়িটা টাটকা গোলাপ। এক বাক্স চকলেট, এবং একটা বার্বি ডল। কলিং বেল টিপতে গিয়ে দেখল-দরজায় বিরাট তালা ঝুলছে। জানালা-টানালা সব বন্ধ। তবু অভ্যাস বসে তিন-চার বার কলিং বেল টিপল। কোন শব্দ হল না।

মিনহাজ গেল বাড়িওয়ালা সিদ্দিক সাহেবের কাছে। সিদ্দিক সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ওরা যে চলে গেছে আপনি জানেন না?

জ্বি-না।

সে কি! দুদিন ধরে মাল নেয় হচ্ছে। আজ সকালে বিছানা বালিশ নেয় হল। বাড়ি ছাড়ার সময় আপনার মেয়েটা খুব কাঁদছিল। এমন কান্না! দেখে আমার নিজের চোখেও পানি এসে গেল।

মিনহাজ কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। সিদ্দিক সাহেব বললেন বাড়ি যে ছেড়ে দেবে সেটা তো জানতেন?

মিনহাজ ইতস্তত করে বলল– জ্বি জানতাম।

 কোথায় গেছে সেই ঠিকানা আছে না?

 জ্বি আছে।

সেখানে চলে যান। আমিও একবার যাব। ঠিকানা জানি না অবশ্যি। আপনি বলুন, ঠিকানাটা লিখে নেই। আপনার মেয়েটার জন্য মন কাঁদছে– একদিন গিয়ে দেখে আসব।

মিনহাজ বলল, জায়গাটা চিনি-মালিবাগের দিকে। ঠিক অ্যাডড্রেস জানি না। জেনে এসে আপনাকে লিখে দিয়ে যাব।

সিদ্দিক সাহেবের বাড়ি থেকে বের হয়ে মিনহাজ দীর্ঘ সময় পার্কে একা একা বসে রইল। দুপুরে চকলেটের টিন মাথায় নিচে দিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখল-নুহাশকে নিয়ে সে পার্কে বেড়াতে এসেছে। নুহাশ তার কাঁধে। একদল বাচ্চাকাচ্চা তাদের ঘিরে আছে। সে অনুস্বার কবিতা পড়ছে। বাচ্চারা খুব মজা পেয়ে হাততালি দিচ্ছে, এবং মুখে বিচিত্র শব্দ করছে। যেমন :

মিনহাজ : নুহাশ আবাবুটিং
 বাচ্চারা : টিং টিং টিং
 মিনহাজ : গোলটা চক্ষুং
বাচ্চারা : উং উং উং।
 মিনহাজ : খুব হাসটুং
বাচ্চারা : টুং টুং টুং
মিনহাজ : ফিকফিকিং
 বাচ্চারা : ইং ইং ইং

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ