বেঁটে মানুষ ভালো দৌড়তে পারে না। বেঁটে মানুষের পা থাকে খাটো। খাটো পায়ে লম্বা স্টেপ নেয়া যায় না। কিন্তু বল্টু প্রায় উড়ে যাচ্ছে। যে অসাধ্য সাধন করল, ছুটন্ত ট্রেন প্রায় ধরে ফেলল। তার বন্ধুরা ট্রেনের দরজা-জানালায় ভিড় করে আছে। রানা হাত বের করে আছে। একবার বল্টুর হাত ধরতে পারলেই টেনে তুলে ফেলবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে-বল্টুর পাশাপাশি ছুটছে মুনা। ট্রেনের কামরা থেকে মুখ বের করে যারা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে তাদের সবার মনে প্রশ্ন–এই মেয়েটা পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে কেন? এর তো দারুচিনি দ্বীপে যাবার কথা না। মুনাও যে শেষ মুহুর্তে বল্টুর সঙ্গে দৌড়াতে থাকবে এবং অবিকল বল্টুর মতোই ট্রেনের দরজার হাতল চেপে ধরবে, তা সে নিজেও বুঝতে পারে নি। যখন বুঝতে পেরেছে তখন আর সময় নেই। ট্রেনের চাকার গতির কাঁপন। বেগ ক্রমেই বাড়ছে। এখন প্লাটফর্মে নেমে যাবার উপায় নেই।

প্ল্যাটফর্মে হতভম্ব মুখে মুনার বাবা সোবহান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এখনো পুরো ঘটনাটা বুঝতে পারছেন না। মেয়েটা হঠাৎ তার পাশ থেকে এমন ছুটতে শুরু করল কেন? কেনইবা দৌড়ে ট্রেনে উঠে পড়ল? ট্রেনে তার বড় ভাই আছে, এটা একটা ভরসা। অবশ্য সঞ্জু না থাকলেও সমস্যা হতো না। এই ছেলেমেয়েরা তাঁর মেয়েটার কোনো অনাদর করবে না। এরা সঞ্জুর বন্ধু, তিনি এদের খুব ভালো করেই চেনেন। মুনা ট্রেনের জানালা থেকে মুখ বের করে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। সোবহান সাহেব এত দূর থেকে সেই হাসি দেখলেন না। তবে তিনি হাত নাড়লেন। হাত নেড়ে একধরনের অভয় দিলেন, বলার চেষ্টা করলেন, সব ঠিক আছে।

বাবার দিকে তাকিয়ে মুনার কান্না পাচ্ছে। একা একা দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকে কী অসহায় দেখাচ্ছে! যেন একজন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মানুষ, যার সব প্ৰিয়জন একটু আগেই ট্রেনে করে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে, যাদের আর কখনোই ফিরে পাওয়া যাবে না।

মুনার মনে হচ্ছে, তার বাবা কাঁদছেন। তিনি অল্পতেই কাঁদেন। মুনা যখন এসএসসি পরীক্ষা দিতে গেল সেদিনও তিনি কাঁদলেন। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আহা, দেখতে দেখতে মেয়েটা এত বড় হয়ে গেল! আজ এসএসসি দিচ্ছে। দুদিন পরে বিয়ে দিতে হবে।

যেদিন এসএসসির রেজাল্ট হলো সেদিনও কাঁদলেন। রুমাল চোখে চেপে ধরে গাঢ় স্বরে বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি মা, খুবই খুশি। সেকেন্ড ডিভিশন এমন খারাপ কিছু না, ম্যাট্রিকের সেকেন্ড ডিভিশনও খুব টুটাফ! বাবা তার জন্যে রাজশাহী সিল্কের শাড়ি কিনে আনলেন। পরীক্ষা পাসের উপহার। মুনার জীবনের প্রথম শাড়ি। সারা জীবনে মুনা নিশ্চয়ই অনেক জাম-কাপড় কিনবে। অনেক শাড়ি কিনবে-কিন্তু জীবনের প্রথম শাড়িটার কথা কখনো ভুলবে না। আচ্ছা, এই তথ্য কি বাবা জানেন?

বাতাসে মুনার চুল উড়ছে, গায়ের ওড়না উড়ছে। আর সে মনে মনে বলছে, কেন আমার বাবা এত ভালো মানুষ হলেন? কেন? কেন?

দলের সবাই চোখ বড় বড় করে মুনার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কথা বলছে না। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটান্তে সময় নিচ্ছে। ট্রেনের অন্য যাত্রীরাও ব্যাপারটা বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। মুনাকে তেমন বিচলিত মনে হচ্ছে না। দৌড়ে ট্রেনে এসে ওঠার পরিশ্রমে সে ক্লান্ত। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সারা মুখে ঘাম। ওড়নার প্রান্ত দিয়ে সে মুখের ঘাম মুছল। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে রানার সামনে। বসার জায়গা আছে। ইচ্ছে করলে বসতে পারে, বসছে না। ছেলেরা সিগারেট খাবে বলে আলাদা বসেছে। মুনা মেয়েদের দেখতে পারছে না। সে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েদের দিকে পেছন ফিরে।

সবার প্রথমে নিজেকে সামলাল রানা। সে থমথমে গলায় প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলল, তুই কী মনে করে ট্রেনে লাফিয়ে উঠলি? চুপ করে আছিস কেন? জবাব দে; আনসার মি। এরকম ইডিওটিক একটা কাজ করলি কীভাবে?

মুনা কিছু বলল না। সে তার বড় ভাই সঞ্জুর দিকে তাকাল। সঞ্জু জানালা দিয়ে মুখ বের করে আছে। মনে হচ্ছে ট্রেনের কামরায় এত বড় নাটকীয় ঘটনা যে ঘটে যাচ্ছে, তার সঙ্গে সঞ্জুর কোনো যোগ নেই। সে বাইরের অন্ধকার দেখতেই পছন্দ করছে। ভাবটা এরকম যেন অন্ধকারে অনেক কিছু দেখার আছে। মুনা নামের ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী এই মেয়েটিকে সে চেনে না।

রানা এবার হুঙ্কার দিল, কথা বল! মুখ সেলাই করে রেখেছিস কেন? কী মনে করে তুই লাফ দিয়ে চলন্ত ট্রেনে উঠে পড়লি? পা পিছলে চাকার নিচে গিয়ে মরেও তো যেতে পারতিস।

মরি নি তো! বেঁচে আছি।

ভাগ্যক্রমে বেঁচে আছিস। কেন উঠলি এখন বল।

মুনা সহজ গলায় বলল, আমি নিজেও জানি না কেন উঠেছি। জানলে বলতাম। ঝোঁকের মাথায় উঠেছি। এখন আমাকে কী করতে হবে? ক্ষমা চাইতে হবে? কার কাছে ক্ষমা চাইব? তোমাদের কাছে, না ট্রেনের কাছে?

কথা ঘোরাচ্ছিস কেন? স্ট্রেইট কথার স্ট্রেইট জবাব দে।

আনুশকা বলল, রানা, আপাতত তোমার জেরা বন্ধ রাখো। মেয়েটা হাঁপাচ্ছে। ও শান্ত হোক। মুনা, তুমি এখানে বসো।

আমি বসব না।

বসবে না কেন?

আমি তেজগাঁ স্টেশনে নেমে যাব। আমাকে নিয়ে আপনাদের কাউকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

রানা গম্ভীর গলায় বলল, তেজগাঁ নেমে যাবি মানে? এই ট্রেন তেজগাঁ থামে না। ফার্স্ট স্টপেজ ভৈরব।

আমি চেইন টেনে ট্রেন থামাব। তারপর বেবিট্যাক্সি নিয়ে বাসায় চলে যাব।

রানা হুংকার দিয়ে বলল, তোর সাহস বেশি হয়ে যাচ্ছে মুনা। তুই টু মাচ সাহস দেখাচ্ছিস। মেয়েদের টু মাচ কারেজ ভয়ংকর।

মুনা ঝাঁঝালো গলায় বলল, তুমি, উলটা-পাল্টা ইংরেজি বলবে না তো রানা ভাই, অসহ্য লাগে।

আমি উলটা-পালটা ইংরেজি বলি?

হ্যাঁ, বলো। আর অকারণ ধমক দাও। শুধু শুধু আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? আমি কী করেছি?

কথা নেই, বার্তা নেই, তুই লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লি আর এখন বলছিস, আমি কী করেছি?

বলেছি তো, নেমে যাব। বলার পরেও ধমকাচ্ছ কেন?

মুনার গলা ভারি হয়ে এলো। নিজেকে সামলানোর আগেই চোখে পানি এসে গেল। অয়ন ভাই দেখে ফেলছে না তো? সে বিবৰ্ণ মুখে অয়নের দিকে তাকাল। যা ভয় করেছিল, তাই। অয়ন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। মুনা কান্না চাপতে গিয়ে আরো সমস্যায় পড়ল। সমস্ত শরীর ভেঙে কান্না আসছে।

রানা বিব্রত গলায় বলল, কান্না শুরু করলি কী মনে করে? স্টপ ক্রাইং। শেষে ধাবড়া খাবি।

মুনা আরো শব্দ করে কেঁদে উঠল।

ট্রেনের গতি কমে আসছে। তেজগাঁ চলে এলো বোধহয়। ট্রেন থামবে না, তবে ধীরগতিতে এগুবে। মুনা দরজার দিকে এগুচ্ছে। রানা বলল, তুই যাচ্ছিস কোথায়? মুনা জবাব দিল না। আনুশকা উঠে এলো। মুনার পিঠে হাত রেখে কোমল গলায় বলল, মুনা, তুমি আমার পাশে এসে বসো। তুমিও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছ।

মুনা ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে গিয়ে কী করব? আপনারা বন্ধুরা গল্প করতে করতে যাবেন। আমি কী করব? আমি কার সঙ্গে গল্প করব?

আনুশকা মুনার কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমার কিন্তু ধারণা, গল্প করার মানুষ তোমারও আছে। তোমাকে কাঁদতে দেখে সে খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। তুমি যদি তেজগাঁ স্টেশনে নেমে পড়ো সেও নেমে পড়বে।

আপা, আপনি চুপ করুন তো!

বেশ, চুপ করলাম। তুমিও শান্ত হয়ে বসো। আমার পাশে বসতে ইচ্ছা না হলে যেখানে ইচ্ছা বসে। বসবে আমার পাশে?

না।

মুনা করিডোর ধরে এগুচ্ছে। রানা যাচ্ছে তার পেছনে পেছনে। এই মেয়েকে চোখের আড়াল করা ঠিক হবে না। ডেঞ্জারাস মেয়ে। কী করে বসে কে জানে? হয়তো ফট করে লাফ দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে গেল। যে চলন্ত ট্রেনে উঠতে পারে, সে নামতেও পারে। রানা নরম গলায় বলল, মুনা শোন, আমার ওপর রাগ করিস না। এতগুলি লোক নিয়ে যাচ্ছি, টেনশানে মেজাজ হট হয়ে থাকে—যাচ্ছিস কোথায়? বোস- জানালার সিটি খালি আছে।

মুনা বসল। রানা তার পাশে বসতে বসতে বলল, তোর পাশে কিছুক্ষণ বসি, তোর রাগ কমলে উঠে যাব।

আমার রাগ কমেছে। তুমি উঠে যেতে চাইলে উঠে যেতে পারো।

এতগুলি মানুষকে গাইড করে নিয়ে যাওয়ার টেনশান তুই বুঝবি না।

তুমি গাইড করে নিচ্ছ মানে? গাইড করে নেয়ার এর মধ্যে কী আছে? সবাই ট্রেনে উঠেছে—ট্রেন যাচ্ছে।

ব্যাপারটা এত সোজা না রে মুনা। একটা দলকে নিয়ে বেড়াতে যাবার কী সমস্যা তা শুধু দলপতিই জানে। আর কেউ জানে না। দলপতি হলো একটা দলের সবচে লোনলি মানুষ। নিঃসঙ্গ শেরপা।

তুমি বুঝি দলপতি?

বলতে বলতে মুনা ফিক করে হেসে ফেলল। রানার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বড় ফিচেল টাইপ মেয়ে। এই মেয়ে ভোগাবে বলে মনে হয়। তেজগাঁ স্টেশনে চেইন টেনে তাকে নামিয়ে দেয়াই ভালো ছিল। রানা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, টিকেট চেকার এলে কী বলব বুঝতে পারছি না। দুজন যাচ্ছে উইদাউট টিকেট। তুই আর জয়ী। একজনেরটা হলে সামাল দেয়া যেত। দুজনেরটা কীভাবে সামলাব?

জয়ী অ্যাপায় টিকেট নেই?

ওরা টিকেট থাকবে কেন? ওরা কি যাওয়ার কথা? ওকে স্টেশনে দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। টেনশনে ব্ৰহ্মতালু শুকিয়ে গেছে। অথচ সবাই নির্বিকার। যেন কিছুই হয় নি। এদের নিয়ে বের হওয়াটাই চূড়ান্ত বোকামি হয়েছে। ভেরি গ্রেট মিসটেক মিসটেক অব দ্য সেনচুরি।

জরী বসেছে জানালার পাশে; সে জানালা দিয়ে মুখ বের করেছে। নিজেকে আড়াল করার জন্যে বড় করে ঘোমটাও দিয়েছে। তাকে লাগছে নতুন বৌয়ের মতোই। আর আসলেই তো সে নতুন বৌ! আজি তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সব ঠিকঠাক মতো হলে এতক্ষণে সে থাকন্ত বাসরঘরে, স্বামীর সঙ্গে। স্বামীর অধিকার ফলাবার জন্যে লোকটা হয়ত এতিক্ষণ তাকে নিয়ে চটকা-চটকি শুরু করত।

জরী বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে। তার দুহাতে মেহেদির সুন্দর ডিজাইন। গায়ের শাড়িটি লাল বেনারসি। গয়না যা ছিল সে খুলে হাতব্যাগে রেখেছে। শাড়ি বদলানো হয় নি। আনুশকার একটা শাড়ি নিয়ে ট্রেনের বাথরুমে গিয়ে বদলে এলে হয়। ইচ্ছা করছে না। বেনারসি পরে ট্রেনের জানালায় মাথা রেখে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগছে। অনেক দিন পর নিজেকে মুক্ত লাগছে। জয়ী তার বন্ধুদের প্রৰ্তি কৃতজ্ঞতাবোধ করছে। তার বন্ধুরা কেউ এখনো জিজ্ঞেস করে নি, কেন জরী বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এলো। সবাই এমন ভাব করছে যেন এটাই স্বাভাবিক। এখানে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। জরী ঠিক করেছে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না, সে নিজ থেকেই বলবে। কিছুই সে গোপন করবে না, কারণ তারা যাচ্ছে দারুচিনি দ্বীপ। তারা ঠিক করে রেখেছে, দারুচিনি দ্বীপে তাদের মধ্যে কোনো আড়াল থাকবে না। তারা তাদের মধ্যকার সব ক্ষুদ্রতাতুচ্ছতা দূর করবে!

জরীর পাশে বেশ কিছু খালি জায়গা; মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করেই সবাই মিলে জরীকে আলাদা থাকতে দিচ্ছে। সবচে ভালো হতো সে যদি অন্য কোনো কামরায় খানিকক্ষণ বসে থাকতে পারত! তা সম্ভব না। বিয়ের সাজে সাজা একটি মেয়ে কোনো-এক কামরায় সঙ্গীহীন একা বসে আছে, এই দৃশ্য কেউ সহজভাবে নিতে পারবে না, বরং এই-ই ভালো। সে আছে বন্ধুদের মাঝে। বন্ধুরা তাকে আলাদা থাকতে দিচ্ছে। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছেও না। এখন তারা চা খাচ্ছে। ট্রেনের বুফো কারের কুৎসিত চা। কিছুক্ষণ পরপর তাই খাওয়া হচ্ছে। মহানন্দে খাওয়া হচ্ছে। সেই খাওয়ারও একেক সময় একেক কায়দা, এখন খাওয়া হচ্ছে পিরিচে। দশজন ছেলেমেয়ে পিরিচে ঢেলে শব্দ করে চা খাচ্ছে। মোটামুটি অদ্ভুত দৃশ্য। কামরার অন্য যাত্রীরা কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না। কুড়ি-একুশ বছরের একদল ছেলেমেয়েকে সবসময়ই বিপজ্জনক ধরা হয়। এদের কেউ ঘাঁটাতে চায় না।

যাত্রীদের মধ্যে একজনের কৌতূহল প্রবল হওয়ায় সে বিপজ্জনক কাজটি করে ফেলল। মোতালেবকে বলল, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

মোতালেব তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন করেছেন। মানব সম্প্রদায় কোথায় যাচ্ছে তা সে জানে না। জানলে মানব সম্প্রদায়ের আজ এই দুৰ্গতি হত না।

যাত্রীদের বেশির ভাগই হাসছে। শুধু প্ৰশ্নকর্তা এবং মোতালেব এই দুজন গম্ভীর মুখে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। মোতালেবের অনেক দায়িত্বের একটা হচ্ছে পুরো দলটাকে হাসাতে হাসাতে নিয়ে যাওয়া। সে এই দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করছে।

সবাই সেছে, শুধু জরী হাসছে না। সে অন্ধকারের দিকে তাবিয়ে আছে। এক সময় সে মনে মনে বলল, আল্লাহ, তুমি আমার মনটা ভাল করে দাও।

আনুশকা বলল, জরী, তোর ঠাণ্ডা লাগবে। মাথা ভেতরে টেনে নে। কচ্ছপের মতো সারাক্ষণ মাথা বের করে রাখছিস কেন?

জরী বলল, আমার ঠাণ্ডা লাগছে না।

বাইরে দেখার কিছু নেই, অন্ধকারে শুধু শুধু তাকিয়ে আছিস।

জরী শান্ত গলায় বলল, এই মুহুর্তে আমার অন্ধকার দেখতেই ভাল লাগছে।

ফিলসফিারের মতো কথা বলছিস যে?

আচ্ছা, আর বলব না।

চল, তোকে নিয়ে চা খেয়ে আসি।

জায়গা ছেড়ে নড়তে ইচ্ছা করছে না।

আয় তো তুই।

জরী উঠল। আনুশকা জরীর হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, চোখ মোছ। তোর চোখে পানি। মুখের হাসি সবাইকে দেখানো যায়, চোখের পানি কাউকে দেখাতে নেই।

তুই নিজেও তো ফিলসফারের মতো কথা বলছিস।

ফিলসফি ছোঁয়াচে রোগের মতো। একজনকে ধরলে সবাইকে ধরে। কিছুক্ষণ পরে দেখবি, আমাদের বল্টুও ফিলসফারের মতো কথা বলা শুরু করবে।

তারা দুজন একই সঙ্গে বলুন্টুর দিকে তাকাল। বল্টু বলল, তোমরা যাচ্ছ কোথায়?

চা খেতে যাচ্ছি।

চলো, আমিও যাব। তোমাদের বডিগার্ড হিসেবে যাব।

বল্টু, তোমাকে যেতে হবে না। তুমি যেখানে বসে আছ সেখানে বসে থাক। নো মুভমেন্ট।

বলুন্টু নামটা না ডাকলে হয় না? আমার সুন্দর একটা নাম আছে-অয়ন।

আনুশকা বলল, এমন কাব্যিক নাম তোমাকে মানায় না। বল্টু হলো তোমার জন্যে সবচে লাগসই নাম। বল্টু। মি. ব।

 

বুফেকার একেবারে শেষ মাথায়। এদের অনেকক্ষণ হাঁটতে হল। আনুশকা এখনো জরীর হাত ধরে আছে। হাত ধরাধরি করে এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাওয়া বেশ ঝামেলার ব্যাপার, কিন্তু হাত ছাড়ছে না। আনুশকা বলল, জরী, তোর কোন জার্নিটা সবচে ইস্ট্ররৈস্টিং মনে হয়?

ট্রেন জানি।

আমারো, কী জন্যে বল তো?

চারদিকে দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।

হয় নি। ট্রেনে চলার সময় ঝিক ঝিক শব্দ হতে থাকে। এক ধরনের তাল তৈরি হয়, নাচের তাল। এইজন্যেই ভাল লাগে।

আমি এইভাবে কখনো ভাবিনি।

আমিও ভাবিনি। বাবার কাছে শুনেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাই বোধহয় ট্রেন জানি ভাল লাগার আসল কারণ।

কামরায় গাড়িভরা ঘুম, রজনী নিঝুম।

ট্রেনে উঠলেই আনুশকার এই লাইনগুলো মনে হয়। এখনো মনে হচ্ছে, যদিও কারো চোখেই ঘুম নেই—রজনীও নিঝুম নয়। ট্রেনের শব্দ ছাড়াও আকাশে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি কি হবে? হলে খুব ভাল হয়। আনুশকা বলল, এক কামরা থেকে আরেক কামরায় যাবার ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং না?

জরী বলল, হুঁ। সায় দেবার জন্যে সায় দেয়া। সে আসলে কিছু শুনছে না। তার শুনতে ইচ্ছা করছে না। সব মানুষই দিনের কিছু সময় নিজের সঙ্গে কথা বলে। পাশের অতি প্ৰিয়জনও কী বলছে না বলছে তা কানো যায় না।

আনুশকা বলল, এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাবার ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং কেন বল তো?

জানি না।

প্রতিটি কামরার আলাদা অস্তিত্ব আছে। এক-একটি কামরা পার হচ্ছি, আর মনে হচ্ছে—আমরা আলাদা অস্তিত্ব অতিক্রম করে করে এগুচ্ছি।

হুঁ।

তুই আমার কথা কিছুই শুনছিস না। মন দিয়ে শুনলে হেসে ফেলতি। কারণ আমি খুব সস্তা ধরনের ফিলসফি করছি।

আচ্ছা।

 

বুফেকারের ম্যানেজার বলল, কাটলেট আর বোম্বাই টোস্ট ছাড়া কিছু নেই।

আনুশকা বলল, কাটলেট এবং বোম্বাই টোষ্ট খাবার জন্যে আমরা আসি নি। আমরা চা খেতে এসেছি।

চা নাই। ওভালটিন আছে।

ওভালটিন, ওভালটিন কে খায়? বাংলাদেশ হচ্ছে চায়ের দেশ। এখানে পাওয়া যাবে চা। বিদেশিদের জন্যে কফি। ওভালটিন কেন?

ম্যানেজার হাই তুলল। জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করল না। ওভালটিন বিক্রি করলে লাভ অনেক বেশি থাকে। এই তথ্য মেয়ে দুটিকে দেবার তার প্রয়োজন নেই। আনুশকা বলল, ভাই, আপনি এমন বিশ্ৰী করে হাই তুলবেন না। আমরা চা খেতে এসেছি। চা খাব। আপনি কোত্থেকে জোগাড় করবেন তা আপনার ব্যাপার।

এগারোটার পর সার্ভিস বন্ধ।

বন্ধ সার্ভিস চালু করুন। আমরা ঐ কোণায় বসছি। চা না খেয়ে যাব না। শুনুন, চিনি যেন কম হয়। গাদাখানিক চিনি দিয়ে সরবত বানিয়ে ফেলবেন না।

ম্যানেজারের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে আবার হাই তুলল। চলতি ট্রেনে ছোটখাটো ঝামেলা হয়। এসব পাত্তা দিলে চলে না। চা অবশ্য সে সহজেই দিতে পারে। টি-ব্যাগ আছে, গরম পানি আছে। কিন্তু দরকারটা কী? মেয়ে দুটি খানিকক্ষণ বসে থেকে বিরক্ত হয়ে চলে যাবে। রাগারাগিও হয়তো করবে। করুক না। অসুবিধা কী?

সুন্দরী মেয়ে রাগারগি করলেও দেখতে ভালো লাগে। ম্যানেজার মনে মনে অতি কুৎসিত একটা গালি দিল। সুন্দর সুন্দর মেয়েদের এইসব গালি দিতেও ভালো লাগে। ওদের শুনিয়ে গালিটা দিতে পারলে হয়তো আরো ভালো লাগত। সেটা সম্ভব না।

জরী এবং আনুশকা মুখোমুখি বসেছে। জানালা খোলা। খোলা জানালায় হু হু করে হাওয়া আসছে। এদের শাড়ির আঁচল পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে। আনুশকা বলল, কী বাতাস দেখেছিস?

হুঁ।

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ—দারুণ বৃষ্টি হবে। ঝমোঝমিয়ে একটা বৃষ্টি দরকার। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলেই তোর মনের মেঘ কেটে যাবে।

মন বিশেষজ্ঞ হলি কবে থেকে?

অনেক দিন থেকে। আমি নিজেই রোগী, নিজেই ডাক্তার। আমার নিজের মন কীভাবে খারাপ হয়, কীভাবে ভালো হয়, তা আমি মনিটার করি। মনিটার করতে করতে আমার এখন একধরনের ক্ষমতা হয়েছে। মন ভালো করার কৌশল আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না।

বৃষ্টি নামলেই আমার মন ভালো হয়ে যাবে?

ইয়েস ম্যাডাম।

তোর মন হয়তো ভালো হবে। কিন্তু সবার মন তো আর তোর মতো না। আমরা সবাই আলাদা আলাদা।

আলাদা হলেও এক ধরনের মিল আছে। দুঃখ পেলে সবারই মন খারাপ হয়। সবাই কাঁদে। কেউ শব্দ করে, কেউ নিঃশব্দে।

জরী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সবাই যে কাঁদে তা কিন্তু না, কেউ কেউ হোসেও ফেলে।

আনুশকা চুপ করে গেল। জরী বলল, চা কিন্তু এখনো দেয়নি। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে দেবে না। দেখ দেখ, কী বিশ্ৰী করে তাকাচ্ছে!

আনুশকা বলল, কী ব্যাপার, এখনো যে চা আসছে না?

ম্যানেজার বলল, একবার তো বলেছি। এগারোটা বাজে, সব বন্ধ।

আমরা কিন্তু চা না খেয়ে যাব না।

ম্যানেজার মনে মনে তার প্রিয় গালটা দিল। আফসোস, এরা শুনতে পাচ্ছে না। শুনতে পেলে দৌড়ে পালিয়ে যেত। সে যেখানে বসেছে সেখান থেকে মেয়ে দুটিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। তাতে অসুবিধা নেই। পেছন দিক থেকে একজনের পেটের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ফর্সা পেট দেখতে ভালো লাগছে। এখান থেকে অনুমান করা যায় গোটা শরীরটা কেমন।

আনুশকা ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, কী, চা দেবেন না?

ম্যানেজার বলল, না।

আনুশকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না শব্দটা শুনতে কী খারাপ লাগে। লক্ষ করেছিস জরী? এথচ এই শব্দটাই আমরা সবচে বেশি শুনি।

আমরা নিজেরাও প্রচুর বলি।

আমি বলি না। আমি সব সময় হ্যাঁ বলার চেষ্টা করি।

সবার সাহস তো তোর মতো না।

আনুশকা বলল, আমি আসলে কিন্তু ভীতু ধরনের একটি মেয়ে। সবসময় সাহসী মুখোশ পরে থাকি। আমাদের মধ্যে সত্যিকার সাহসী যদি কেউ থাকে, সে হল তুই নিজে।

আমাকে সাহসী বলছিস কেন?

বিয়ের আসর থেকে তুই পালিয়ে এসেছিস। তোর গায়ে এখনো বেনারসী শাড়ি। কটা মেয়ে এই কাজ করতে পারবে?

কাজটা কী আমি ঠিক করেছি?

তা তো আমি বলতে পারব না। তুই বলতে পারবি। আমি বাইরে থেকে তোর ব্যাপারে কি মতামত দেব?

যে ছেলেটার সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছিল,সেই ছেলেটা ভাল না, মন্দ ছেলে।

মানুষের ভাল-মন্দ চট করে বোঝা যায় না। তোর সঙ্গে তো ছেলেটার পরিচয়ই হয়নি। তুই বুঝলি কী মন্দ?

বিয়ের দুদিন আগে সে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাচ্ছিল। গাড়িতে করে যাচ্ছি, হঠাৎ সে আমার গায়ে হাত দেয়। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। আমরা পেছনের সীটে।

গায়ে হাত দেয় মানে কী? হাতে হাত রাখে? যে ছেলে জানে দুদিন পর তোর সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে, সে অবশ্যই তোর হাতে হাত রাখতে পারে। আমি তাতে কোনো সমস্যা দেখি না।

হাতে হাত রাখা নয়। অন্য ব্যাপার, কুৎসিত ব্যাপার। আমি মুখে বলতে। পারব না। এবং এই ব্যাপারটা ড্রাইভারের সামনে ঘটে। ড্রাইভার গাড়ির ব্যাকভিউ মিররে পুরো ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছিল। সে ছিল নির্বিকার, কারণ এ-জাতীয় ঘটনা এই গাড়িতে আরও ঘটেছে। এটা ড্রাইভারের কাছে নতুন কিছু ছিল না।

তুই তখন কী করলি?

কঠিন গলায় ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। তারপর গাড়ির দরজা খুলে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম।

কী ঘটেছিল বাসার সবাইকে বললি?

হ্যাঁ, বিয়ে ভেঙে দেয়ার জন্য আমি আমার বড় চাচার পা পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। বড় চাচা রাজি হলেন না, কারণ ছেলের নাকি মস্তানদের সঙ্গে ভাল কানেকশন। এরকম কিছু করলে ভয়ংকর ক্ষতি হবে।

জেনেশুনে তোর বড় চাচা এমন একজন ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে ঠিক করলেন?

হ্যাঁ, করলেন। কারণ ঐ ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হলে চাচার ব্যবসার সুবিধা হয়।

বিয়ের আসর থেকে তুই পালিয়ে এলি কীভাবে?

বড় চাচী ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে বসেছিলাম। বড় চাচী পালিয়ে যেতে বললেন।

আগে তো শুনেছিলাম, তোর এই চাচী তোকে দেখতে পারে না।

মানুষকে চট করে চেনা যায় না, আনুশকা। এই চাচী আমাকে সত্যি সত্যি অপছন্দ করতেন। সারাক্ষণ কঠিন সব অপমান করতেন। আমরা যে তাঁর বাড়ির আশ্রিত অন্নদাস এই কথা দিনের মধ্যে খুব কম হলেও দশবার মনে করিয়ে দিতেন। অথচ এই তিনিই আমার চরম দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমার মা আমার পাশে এসে দাঁড়াল না, আমার বাবাও না। কে পাশে এসে দাঁড়াল? আমার বড় চাচী।

আনুশকা বলল, চার ব্যাপারটা মন থেকে তাড়াতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এক কাপ চা খেতে না পারলে মারা যাব। কী করা যায় বল তো?

জরী বলল, এখন আর শুধু একটা জিনিসই করা যেতে পারে। ঐ লোকটার পায়ে ধরা। সেটা কি ঠিক হবে? সামান্য এক কাপ চায়ের জন্যে পা ধরা? তাও যদি সুন্দর পা হত একটা কথা ছিল।

আনুশকা অন্যমনস্ক গলায় বলল, পায়ে ধরে সাধা, রা নাহি দেয় রাধা—এই দুটা লাইন রবীন্দ্রনাথের কোন গল্পে আছে বল তো?

জানি না। বলতে পারব না। হঠাৎ কবিতার লাইন কেন?

আনুশকা বলল, তোর পায়ে ধরার কথা থেকে মনে এল। আমাদের মন বিচিত্ৰ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছোটাছুটি করে।

গল্পগুচ্ছে আছে জানি, কিন্তু কোন গল্প মনে পড়ছে না। আমার কিছু মনে না এলে খুব অস্থির লাগে। মাথায় চাপা যন্ত্রণা হয়। আমার ইচ্ছা করছে ডেকে ডেকে সবাইকে জিজ্ঞেস করি।

হ্যালো ম্যানেজার সাহেব, বলুন তো পায়ে ধরে সাধা, রা নাহি দেয় রাধা-এই লাইন দুটো রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের কোন গল্পে আছে?

ম্যানেজার কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। জরী বলল, শুভ্র বলতে পারবে। যদি কেউ জানে শুভ্ৰ জানবে।

 

শুভ্ৰ শুকনো মুখে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেট ধরানোর অস্বস্তিতে সে প্ৰায় মরে যাচ্ছে। মোতালেবের চাপাচাপিতে এটা করতে হয়েছে। মোতালেব হুঙ্কার দিয়ে বলেছে-খাবি না মানে? খেতে হবে। গুড বয় হয়ে অনেক দিন পার করেছিস। আর না। এখন আমরা ব্যাড বয় হব।

ব্যাড বয় হলে সিগারেট খেতে হবে?

অবশ্যই খেতে হবে। সিগারেট খেতে হবে। গাঁজা খেতে হবে। শার্টের বুকের বোতাম খোলা রাখতে হবে। মেয়েরা আশেপাশে থাকলে অশ্লীল রসিকতা করতে হবে। খোল, শার্টের বুকের বোতাম খোল, যাতে বুকের লোম দেখা যায়। তোর বুকে লোম আছে?

শুভ্রর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। মোতালেব বলল, লজ্জায় তুই দেখি টমেটোর মতো হয়ে গেছিস। ফুসফুস ভর্তি করে সিগারেটের ধোঁয়া নে, দেখবি লজ্জা কেটে যাবে। লাজুক মানুষ এইজন্যেই সিগারেট বেশি খায়। লজ্জা ঢাকার জন্যে খায়। গাঁজা খেলে কী হয় জানিস?

না।

লজ্জা বেড়ে যায়। গাঁজা হলো লজ্জা বর্ধক। বিরাট বডিবিল্ডারও দেখবি গাজার কল্কেতে টান দিয়ে মিহি মেয়েলি গলায় কথা বলবে। গাঁজার অন্য মজা।

শুভ্ৰ বলল, তুই গাঁজা খেয়েছিস?

অবশ্যই খেয়েছি। গাঁজা খেয়েছি। কালিপূজার সময় ভাং-এর যে সরবত করে তাও খেয়েছি। ভাং-এর সরবত খেলে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হয়। কী হয় শুনতে চাস?

চাই।

এই তো পথে আসছিস। আমার ধারণা ছিল তুই বলবি শুনতে চাই না। দাঁড়া, তোকে বলব। কী হয়। তার আগে জরী আর আনুশকাকে নিয়ে আসি। ওরা কোথায়?

চা খেতে গিয়েছে বুফেকারে।

চল, ওদের নিয়ে আসি। ভাং খেলে কী হয় এটা শুনলে মেয়েরা খুব মজা পায়। এটা বলতে হবে মেয়েদের সামনে।

শুভ্রর খেতে ইচ্ছা করছে না। সিগারেট হাতে নিয়ে হাঁটতে লজা-লজা লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, সে কোনো অপরাধ করে ফেলেছে এবং মা পরিষ্কার দেখছেন। এক্ষুনি যেন তিনি বলবেন, শুভ্র বাবা, তোমার হাতে কী?

মোতালেব বলল, সবাই মিলে ছাদে বসে যেতে পারলে ইন্টারেস্টিং হতো। ট্রেনের ছাদে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকলে দারুণ লাগে।

শুভ্ৰ বলল, ভয় লাগে না?

প্রথম দুতিন মিনিট ভয় লাগে। তারপর আর লাগে না। আনুশকা ওদের দেখেই বলল, ঐ ম্যানেজার আমাদের চা দিচ্ছে না। আধ ঘণ্টার মতো বসে আছি। একটু বলে দেখো না।

মোতালেব বলল, তোমার মতো রূপবতীকে চা দেয় নি, আমাকে দেবে? হাতি-ঘোড়া গেল তল, মোতালেব বলে কত জল?

তোমার তো অনেক টেকনিক আছে।

আচ্ছা দেখি। একটা নিউ টেকনিক অ্যাপ্লাই করে দেখি। শুভ্ৰ, তুই আয় আমার সঙ্গে। এই টেকনিকে ম্যান পাওয়ার লাগে।

শুভ্ৰ বাধ্য ছেলের মতো রওনা হলো। সে ভেবেছিল, তার হাতে সিগারেট দেখে জরী বা আনুশকা কিছু বলবে। তারা কিছু বলে নি। শুধু জরী সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসে। বাচ্চা ছেলে বাবার জুতায় পা ঢুকিয়ে হাঁটার চেষ্টা করলে মারা যেমন ভঙ্গিতে হাসে সেই ভঙ্গির হাসি।

মোতালেব কাঁচুমাচু মুখে ম্যানেজারকে বলল, ভাইজান, রূপবতী দুই মহিলা আধা ঘণ্টার উপর বসে আছে। এদের চা দিচ্ছেন না কেন?

বুফেকার বন্ধ।

এখানে আসার পথে দেখলাম টি-পটে চা নিয়ে ফার্স্ট ক্লাসের দিকে যাচ্ছে।

আগে অর্ডার ছিল।

ভাই, আমরা গল্পগুজব করতে করতে ছুটি কাটাতে যাচ্ছি। দেন না। দশটা টাকা না হয় বেশি রাখেন। নো প্রবলেম।

বললাম তো, হবে না।

এরা আমাদের দুজনকে আশা করে পাঠিয়েছে। এর নাম শুভ্ৰ। অতি ভালো ছেলে। শুভ্রর প্রেস্টিজের একটা ব্যাপারও আছে। চা নিয়ে যেতে না পারলে মেয়েগুলির সামনে শুভ্রর মান থাকবে না।

এক কথা কয়বার বলব? আপনারা কেন বিরক্ত করছেন?

তাহলে কি এদের নিয়ে উঠে চলে যাব?

সেটা আপনার ইচ্ছা।

ভাইজান, আমরা কিন্তু মানুষ ভালো না। এখন আমরা দুইজন আপনার গায়ে থুথু দেব। থু করে একদলা থুথু ফেলব।

হতভম্ব ম্যানেজার বলল, কি বললেন?

আপনার গায়ে থুথু ফেলব।

ফাজলামি করছেন নাকি?

জি না ব্রাদার, ফাজলামি করছি না।

শুভ্ৰ, এর গায়ে থুথু ফেল তো।

শুভ্ৰ সঙ্গে সঙ্গে থু করে থুথু ফেলল। এবং থুথু ফেলে তার নিজেরই বিস্ময়ের সীমা রইল না। এটা সে কি করল? কীভাবে করতে পারল?

ম্যানেজার লোকটা কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে!

শুভ্র করুণ চোখে তাকাল মোতালেবের দিকে।

মোতালেব সহজ গলায় বলল, এখন আমরা যাই। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে যাই। আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করব। পনেরো মিনিটের মধ্যে যদি চা না আসে তা হলে ট্রেনের দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে তোকে নিচে ফেলে দেব। আমার ভাল নাম মোতালেব। বন্ধুরা বলে মোতা মিয়া। একবার এক পাজীর গায়ে পিসাব করে দিয়েছিলাম। সেই থেকে মোতা মিয়া নাম।

মোতালেবরা জরীদের কাছে ফিরে গেল। জরী বলল, চা আসছে?

মোতালেব বলল, বুঝতে পারছি না। তবে সম্ভাবনা আছে। অষুধ দিয়ে এসেছি। অষুধে কাজ হবে কি না জানি না। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। আবার উল্টা অ্যাকশনও হতে পারে।

অষুধটা কী?

মাইল্ড ডোজের সালফা ড্রাগ দেয়া হয়েছে। সালফা ড্রাগে কাজ না হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হবে। ব্ৰড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক।

জরী বলল, শুভ্রর মুখটা এমন মলিন লাগছে কেন? কী হয়েছে শুভ্র?

শুভ্ৰ জবাব দিল না। চোখ নিচে নামিয়ে নিল। লজ্জায় সে মাথা তুলতে পারছে না।

আনুশকা বলল, আচ্ছা শুভ্ৰ, এই লাইন দুটা কোথায় আছে বলতে পারবে?

পায়ে ধরে সাধা
রা নাহি দেয় রাধা।

শুভ্ৰ ক্ষীণ গলায় বলল, গল্পগুচ্ছে আছে।

গল্পের নাম কী?

গুপ্তধন।

Thank you learned কানাবাবা। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।

প্ৰশংসাবাক্যেও শুভ্রের কিছু হল না। তার মুখ মলিন হয়েই রইল। তার শুধু মনে হচ্ছে, যদি কোনোদিন মা এই ঘটনা জানতে পারেন তার কেমন লাগবে? মা অবশ্যই জানতে চাইবেন সে কেমন করে এই কাজটা সে করল? তখন সে কী বলবে? কিংবা মা হয়তো কিছুই জানতে চাইবেন না। শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকবেন। সে তো আরো ভয়াবহ।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ