প্ৰস্তাবনা

 একুশ খুব অদ্ভুত একটা বয়স।

এই বয়সে মাথায় বিচিত্র সব পাগলামি ভর করে। বুকের ভেতর থাকে এক ধরনের অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার একটি রূপ হলো—কী যেন নেই, কী যেন নেই অনুভূতি। সেই কী যেন নেই-কে খোঁজার চেষ্টাও এই বয়সেই প্রথম দেখা দেয়। পৃথিবীর বেশিরভাগ সাধুসন্ত এই বয়সে গৃহত্যাগ করেন।

চার বছর আগে জানুয়ারি মাসের এক প্রচণ্ড শীতের রাতে একুশ বছর বয়েসি একদল ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে বসেছিলাম। উপন্যাসের নাম দারুচিনি দ্বীপ। সেই উপন্যাসে একদল ছেলেমেয়ে ঠিক করল, তারা দল বেঁধে বেড়াতে যাবে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে। সেখানে কাটাবে পূর্ণচন্দ্রের একটি অপূর্ব রাত। আমি উপন্যাস শেষ করব জোছনার সুন্দর একটা বৰ্ণনা দিয়ে। পাত্র-পাত্রীদের আমি কিন্তু প্রবাল দ্বীপ পর্যন্ত নিতে পারিনি। তার আগেই উপন্যাস শেষ করতে হয়েছে, কারণ-আমি নিজে তখনো দ্বীপে যাইনি। স্বপ্নের সেই দ্বীপ কেমন আমি জানতাম না।

এখন জানি। সেই অপূর্ব দ্বীপে আমি নিজে এক টুকরো জমি কিনে কাঠের একটা ছোট্ট ঘর বানিয়েছি। তারনাম দিয়েছি সমুদ্র বিলাস। ফিনিক-ফোটা জোছনায় আমি দেখেছি জ্বলন্ত সমুদ্র-ফেনা। আহা, কী দৃশ্য! সেই প্রায় পরাবাস্তব ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, ঐ তরুণ-তরুণীদের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাই-না সমুদ্রের কাছে!

যেখানে শেষ করেছিলাম দারুচিনি দ্বীপ সেখান থেকেই শুরু হোক নতুন গল্প রূপালী দ্বীপ। আসুন, রূপালী দ্বীপের পাত্র-পাত্রীদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ঘণ্টা পড়ে গেছে। কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে এক্ষুনি ছেড়ে দেবে চিটাগাং মেল। দারুচিনি দ্বীপের যাত্রীরা সবাই উঠে পড়েছে ট্রেনে। একজন শুধু ওঠেনি। সে হলো বল্টু। বল্টুর ভালো নাম অয়ন। অর্থাৎ পর্বত। পর্বত নাম হলেও এই ছোটখাটো মানুষটা মাথা নিচু করে প্ল্যাটফর্মের অন্ধকার কোণায় দাঁড়িয়ে। সে যাচ্ছে না, অথচ তারই যাবার আগ্রহ ছিল সবচে বেশি। সে চাঁদার টাকাটা জোগাড় করতে পারে নি। অথচ তার আশা ছিল, শেষ মুহুর্তে হলেও টাকা জোগাড় হবে। হয় নি।

প্লাটফর্মে দারুচিনি দ্বীপের দলটাকে বিদায় জানাতে মুনা এসেছে বাবার সঙ্গে! মুনার ভাই সঞ্জু যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মুনা তার ভাইকে বিদায় জানাতেই এসেছে। এই প্রকাশ্য কারণের বাইরে আছে একটি অপ্রকাশ্য কারণ। প্রকাশ্য কারণ হলো–অয়ন। মুনা আসলে এসেছে। অয়নকে বিদায় জানাতে। অতি প্রিয়জনদের হাত নেড়ে বিদায় জানাতে খুব কষ্ট হয়, আবার এই কস্টের সঙ্গে এক ধরনের আনন্দও থাকে। মুনা মার কাছ থেকে টাকা চুরি করে অয়নকে একটা হালকা নীল রঙের স্যুয়েটার কিনে দিয়েছে। কথা ছিল এই স্যুয়েটার গায়ে সে ট্রেনে উঠবে। মুনা কল্পনার দৃষ্টিতে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে– অয়ন নীল রঙের স্যুয়েটার পরে ট্রেনের কামরা থেকে গলা বের করে তার দিকে তাকিয়ে খুব হাত নাড়ছে। আর সে দেখেও না দেখার ভান করছে। সে, ঠিক করে রেখেছে, ভালো করে তাকাবেও না। অয়ন ভাইয়ের দিকে ভালো করে তাকালেই তার চোখে পানি এসে যায়। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা কেন হয় কে জানে? আজ সে এটা হতে দেবে না। কিছুতেই তাকাবে না। দরকার হলে চোখ বন্ধ করে রাখবে।

গার্ড সবুজ ফ্ল্যাগ দোলাচ্ছে। সবাই ট্রেনে উঠে পড়েছে। শুধু মোতালেব প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন চোখে এদিক-ওদিক দেখছে। সবাই আছে। এক্ষুনি ট্রেন ছেড়ে দেবে। তাহলে কি অয়ন  যাচ্ছে না? মোতালেব ভাইকে জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা লাগছে। মুনার ধারণা, প্রশ্নটি করলেই মোতালেব ভাই অনেক কিছু টের পেয়ে যাবেন। তিনি তুরু কুঁচকে তাকবেন। যে তাকানোর অর্থ হচ্ছে- হঠাৎ করে অয়নের কথা কেন? ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা যে কী তা মুনা কাউকে বলতে চায় না। কাউকে না। অয়নকে তো কখনোই না। মরে গেলেও সে তার গোপন ভালোবাসা কাউকে জানাবে না। অন্যদের মতো অয়নকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবে। অন্যরা যেমন ডাকে বল্টু। সেও ডাকবে বল্টু ভাই।

মোতালেব ট্রেনের কামরায় উঠতে যাচ্ছে। মুনা আর থাকতে পারল না। প্রায় ফিসফিস করে বলল, মোতালেব ভাই, অয়ন ভাইকে তো দেখছি না। উনি আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছেন না?

মোতালেব বিরক্ত মুখে বলল, যাওয়ার তো কথা, গাধাটা এখনো কেন আসছে না কে জানে? ট্রেন মিস করবে। গাধাটা সবসময় এরকম করে। আগে একবার পিকনিকে গেলাম। সে গেল না। পরে শুনি চাঁদার টাকা জোগাড় হয় নি। আরে, একজন চাঁদা না দিলে কী হয়? সবাই তো দিচ্ছি।

মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল, ওনার কি টাকার জোগাড় হয় নি?

মোতালেব বলল, কী করে বলব আমাকে তো কিছু বলেনি।

মুনা অসম্ভব রকম মন-খারাপ করে বাবার কাছে চলে এলো। আর তখনি সে অয়নকে দেখল। অয়ন শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায়, সে চাচ্ছে না কেউ তাকে দেখে ফেলুক। মুনা চেঁচিয়ে ডাকল, অয়ন ভাই! অয়ন ভাই!

অয়ন প্ল্যাটফর্মে গাদা করে রাখা প্যাকিং বাক্সগুলির আড়ালে সরে গেল। মুনা এগিয়ে গেল। পিছনে এলেন সোবাহান সাহেব।

মুনা বলল, অয়ন ভাই, আপনি যাচ্ছেন না? ট্রেন তো ছেড়ে দিচ্ছে।

অয়ন কী বলবে ভেবে পেল না। সোবাহান সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন, দৌড়ে গিয়ে ওঠে। সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছে।

অয়ন নিচু গলায় বলল, চাচা, আমি যাচ্ছি না।

যাচ্ছ না কেন?

টাকা জোগাড় করতে পারিনি। একজনের দেয়ার কথা ছিল, সে শেষ পর্যন্ত…

গার্ড বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে। ট্রেন নড়তে শুরু করেছে। অয়ন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।

মুনার চোখে পানি এসে গেছে। সে ভেজা চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।

সোবাহান সাহেব পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে শান্তগলায় বললেন, বাবা, এই নাও, এখানে ছয়শ টাকা আছে। তুমি যাও। দৌড়াও।

অয়ন ধরা গলায় বলল, বাদ দিন চাচা। আমি যাব না।

অয়নের খুব কষ্ট হচ্ছে। সে কখনোই কোথাও যেতে পারে না, সে জন্যে খুব কষ্ট তো তার হয় না। আজ কেন হচ্ছে?

সোবাহান সাহেব বললেন, এক থাপ্পড় দেব। বেয়াদব ছেলে। দৌড় দাও। দৌড় দাও।

মুনা বলল, যান অয়ন ভাই, যান। প্লিজ।

অয়ন টাকা নিল।

সে দৌড়াতে শুরু করেছে। তার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে মুনা। কেন ছুটছে তা সে নিজেও জানে না।

দলের সবাই জানালা দিয়ে মুখ বের করে তাকাচ্ছে। মোতালেব এবং সঞ্জু হাত বের করে রেখেছে—কাছাকাছি এলেই টেনে তুলে ফেলবে। এই তো আর একটু। আর একটু……।

সোবাহান সাহেব চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছেন -হে মঙ্গলময়! এই ছেলেটিকে দারুচিনি দ্বীপে যাবার ব্যবস্থা তুমি করে দাও।

ট্রেনের গতি বাড়ছে।

গতি বাড়ছে অয়নের। আর ঠিক তার পাশাপাশি ছুটছে মুনা। সে কিছুতেই অয়নকে ট্রেম মিস করতে দেবে না। কিছুতেই না।

এখন থেকেই শুরু হলো আমাদের নতুন গল্প…

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ