০৩.

মিস মারিয়াটা, আমাদের ঘরে যে নতুন একজন মানুষ এসেছে তাকে তুমি দেখেছ?

না।

আমিও দেখিনি। সে কিন্তু বিদেশী, মিস মারিয়াটা।

তুমি পড়ায় মন দিচ্ছ না অ্যানি।

আজকে আমার পড়তে ইচ্ছে করছে না।

ইচ্ছা না করলেও পড়তে হবে।

অ্যানিকে অ্যালজেব্রার বই খুলতে হল। সে দুতিনটা অঙ্ক শেষ করেই বলল, মিস মারিয়াটা, ঐ বিদেশী কিন্তু ভয়ংকর লোক। ফটফট গুলি করে মানুষ মারে।

মানুষ মারা যদি তার কাজ হয় তা হলে তো মারবেই। সবাই তার নিজের কাজ করতে হয়। ঠিক না?

হ্যাঁ ঠিক। ওর কাজ কিন্তু মানুষ মারা না। ওর কাজ হচ্ছে আমাকে দুষ্ট লোকের হাত থেকে রক্ষা করা। সেরকম কোনো লোক দেখলেই সে একেবারে শেষ করে দেবে। দ্রুম দ্রুম।

মিস মারিয়াটার মধ্যে কোনো উৎসাহ দেখা গেল না। সে আবার পড়াতে শুরু করল। অ্যানি ছাড়া পেল সন্ধ্যার আগে-আগে। এবং ছাড়া পাওয়ামাত্র ছুটে গেল দোতলায়। লোকটির ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়েও অ্যানি কিছুই শুনল না। লোকটি অসময়ে ঘুমুচ্ছে নাকি অ্যানি দরজায় টোকা দিতেই ভারী গলায় লোকটি কথা বলল, কে

আমি কি তোমার ঘরে আসতে পারি?

খুট করে দরজা খুলে গেল।

আমার নাম অ্যানি।

কোনো উত্তর নেই। লোকটি তাকিয়ে আছে শুধু।

আমি কি তোমার ঘরে একা বসতে পারি?

লোকটি দরজা থেকে সরে দাঁড়াল।

অ্যানি হাসিমুখে বলল, তোমাকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। আমার কথা বলার লোক নেই।

লোকটি ভারীস্বরে বলল, বাচ্চাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি না। বাচ্চাদের আমি পছন্দ করি না।

অ্যানি স্তম্ভিত হয়ে গেল। থেমে থেমে বলল, আমি বাচ্চা নই। আমার এপ্রিল মাসে বারো হবে।

লোকটি কথা বলল না। অ্যানি বলল, আমি যদি কিছুক্ষণ তোমার ঘরে বসি তা হলে কি তুমি বিরক্ত হবে?

হ্যাঁ।

অ্যানির চোখে প্রায় জল এসে পড়ছে। সে বহু কষ্টে নিজেকে সামলাল। লোকটি মৃদুস্বরে বলল, একটি জিনিস তোমাকে বুঝতে হবে, অ্যানি। আমি নতুন কেনা কোনো খেলনা না। আমাকে রাখা হয়েছে তোমার নিরাপত্তার জন্যে, এইটুকুই আমি দেখব, এর বেশি না। যদি এ জিনিসটি পরিষ্কার বুঝতে পার তা হলে তা তোমার জন্যেও ভালো আমার জন্যেও ভালো।

অ্যানি ধরাগলায় বলল, তুমি কি আমাকে চলে যেতে বলছ?

হ্যাঁ।

অ্যানির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল।

রুন এসে ঢুকল তার কিছুক্ষণ পর। সে ইতস্তত করে বলল, অ্যানি খুব কাঁদছে।

লোকটি জবাব দিল না। রুন বলল, আমার এই মেয়েটি খুব সেনসেটিভ, ওর সঙ্গে ভাব করতে হবে খুব ধীরে ধীরে। একবার ভাব হলেই বুঝবে খুব মিষ্টি মেয়ে ও।

মিসেস রুন, আমি তোমার মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে আসিনি। ওসব আমি পারি না। আমার দ্বারা ওসব হয় না।

ও।

তোমরা যে-কাজের জন্যে আমাকে রেখেছে সে-কাজ আমি ঠিকমতো করতে চেষ্টা করব, এর বেশি আমার কাছে কিছু আশা করবে না।

রুন আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু লোকটি আর কথা বলল না। রুন ভাবল এই বিদেশী লোকটিকে রাখা হয়তো ঠিক হয়নি।

মিস মারিয়াটাও একই কথা বলল, বিদেশীদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই, মিসেস রুন।

মিস মারিয়াটার অবিশ্যি সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। সে গলা খাদে নামিয়ে বলেই ফেলল, কোনো একদিন হয়তো দেখা যাবে এই লোকই আপনাদের গুলি করে মেরে রেখে পালিয়েছে।

রুন বিরক্ত হয়ে বলেছে, আমাদের মারবে কেন?

মিসেন রুন, ওদের কোনো কারণ-টারন লাগে না, ওরা হচ্ছে বর্ন কিলার। ওরা স্বাভাবিক মানুষ না, মিসেস রুন।

কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়। ভাড়াটে সৈনিকরা অস্বাভাবিক মানুষ তা বলাই বাহুল্য। বন্য পশুর মতো জীবন কাটিয়ে হঠাৎ করে কেউ পোষ মানে না। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে।

মিসেস রুন, লোকটাকে বিদেয় করে দিন।

দেখা যাবে কী করা যায়। আমার কাছে তেমন কিছু খারাপ মনে হচ্ছে না।

ভালোও তো মনে হচ্ছে না, ঠিক না?

রুনের মনে একটি কাঁটা বিঁধে রইল। অস্পষ্ট সন্দেহের একটি তীক্ষ্ণ কাঁটা।

.

হ্যালো, রুন?

হ্যাঁ।

আমি এতরা।

হ্যালো, এতরা।

নতুন বডিগার্ড কি কাজ শুরু করেছে।

হ্যাঁ, করেছে।

 পছন্দ হয়েছে তোমার?

 রুন জবাব দিল না।

এতরা বলল বললো, জবাব দিচ্ছ না কেন?

 রুন ইতস্তত করে বলল, ভালোই তো।

অ্যানির পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ হওয়াহওয়ির কী আছে? বডিগার্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? স্কুলে নিয়ে যাবে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। ব্যস।

এতরা গলার স্বর একধাপ নামিয়ে ফেলল, শোনো, একটা প্রবলেম হয়েছে।

কী প্রবলেম?

আমি এজেন্সিতে খোঁজ নিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছে লোকটিকে রাখা ঠিক হবে না।

কেন?

ও একজন ডেঞ্জারাস লোক। আগে বুঝতে পারিনি।

রুন শান্তস্বরে বলল, এরকম কাজের জন্যে তো ডেঞ্জারাস লোকই দরকার।

তা দরকার, তবু আমার মনে হচ্ছে একে ছাড়িয়ে দেয়া ভালো। আমি সন্ধ্যাবেলা এসে আলাপ করব। তুমি থাকছ তো?

হ্যাঁ, সেও থাকবে।

এতরার মনে হল রুন খানিকটা নিরাশ হল।

আচ্ছা, আমি আসব সন্ধ্যায়।

.

লাঞ্চের সময় রুন দেখল অ্যানি অস্বাভাবিক গম্ভীর। কিছুই মুখে দিচ্ছে না।

রান্না পছন্দ হচ্ছে না তোমার, অ্যানি?

পছন্দ হবে না কেন! বেশ ভালো রান্না।

তবে খাচ্ছ না কেন?

আমার ভালো লাগছে না।

 রুন খানিক্ষণ চুপ থেকে বলল, লোকটা কি তোমাকে কোনো কড়া কথা বলেছে?

না।

ওর ঘর থেকে বের হয়ে তুমি খুব কাঁদছিলে, তাই জিজ্ঞেস করছি।

এমনি কাদছিলাম। ও আমাকে কোনো কড়া কথা বলেনি।

রুন অবাক হয়ে বলল, লোকটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে নাকি?

হা, পছন্দ হয়েছে।

অ্যানি স্পষ্টস্বরে আবার বলল, লোকটিকে আমার ভালুকের মতো লাগে মা। প্রকাণ্ড একটা বুড়ো ভালুক।

এই ভালুক কিন্তু তুলোভরা ভালুক না যে সারাদিন কোলে করে ঘুরে বেড়াবে। এই ভালুকের ধারালো নখ আছে।

অ্যানি খিলখিল করে হেসে ফেলল।

 হাসছ কেন?

এমনি হাসছি।

কারণ ছাড়া হাসা এবং কারণ ছাড়া কান্না এস মোটেই ভালো লক্ষণ না। কাল থেকে তুমি রীতিমতো স্কুলে যেতে শুরু করবে। লোকটি নিয়ে যাবে এবং নিয়ে আসবে। ওর সঙ্গে বেশি মিশতে চেষ্টা করবে না। এই লোকটি মেলামেশা বেশি পছন্দ করে না।

তুমি লোকটি লোকটি বলছ কেন মা? ওর একটি নাম আছে। জামশেদ। মিঃ জামশেদ বলবে।

ঐসব বিদেশী নাম আমার মুখে আসে না।

চেষ্টা করলেই আসবে। বলো আমার সঙ্গে—জামশেদ।।

বলেছি ত বিদেশী নাম আমি উচ্চারণ করতে পারি না।

মা, ওকে যদি আমি বুড়ো ভালুক বলি, তা হলে কি ও রাগ করবে?

জানি না। তুমি বড় বাজে কথা বল।

মিস মারিয়াটা বলছিলেন, বুড়ো ভালুক নাকি ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে পারে।

এরকম বলার কারণ কী?

মিস মারিয়াটার এরকম মনে হচ্ছে। আমার কিন্তু তা মনে হয় না মা।

মনে না হলেই ভালো।

আমার কাছে মনে হয়, বুড়ো ভালুক খুব একটা চমৎকার মানুষ।

রুন উঠে পড়ল। বসে থাকলেই অ্যানির বকবকানি শুনতে হবে। বড় বেশি কথা বলছে সে। মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।

.

গাড়ি চলছে থার্ড অ্যাভিনিউ দিয়ে।

পেছনের সিটে অ্যানি বসে আছে। তার সঙ্গে দূরত্ব রেখে বসেছে জামশেদ। জামশেদ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দুপাশের পথঘাট লক্ষ করছে। সুবিধাজনক জায়গাগুলি দেখবার চেষ্টা। যেসব জায়গায় হঠাৎ করে হামলা হতে পারে। অত্যন্ত ব্যস্ত রাস্তা। এখানে গাড়ির উপর হামলা চালানোর সম্ভাবনা খুবই কম। যদি কিডন্যাপিং-এর চেষ্টা হয় তবে তা হবে স্কুলের আশপাশে। ব্যস্ত রাস্তায় নয়। তবু রাস্তা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।

জামশেদ তার হাঁটুর উপর মেট্রোপলিটান ম্যাপটি বিছিয়ে দিল। লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিতে লাগল থার্ড অ্যাভিনিউতে কটি এক্সিট আছে তার ওপর। পেট্রোল পাম্প কটি আছে তাও দেখতে হবে। বড় ভ্যানজাতীয় গাড়ি লুকিয়ে রাখার সবচেয়ে সহজ জায়গা হচ্ছে পেট্রোল পাম্প। নষ্ট হয়ে গেছে এই অজুহাতে প্রকাণ্ড একটা গাড়ি সেখানে দীর্ঘ সময় ফেলে রাখা যায়। এতে কারোর মনে কোনোরকম সন্দেহ জাগে না।

স্কুল পর্যন্ত তিনটি পেট্রোল পাম্প দেখা গেল। জমশেদ ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, স্কুলে যাবার তো অনেকগুলি পথ আছে। তুমি কি সবসময় থার্ড অ্যাভিনিউ দিয়ে যাও?

হ্যাঁ। এই রাস্তায় ট্রাফিক কম।

এর পর থেকে কখনো পরপর দুদিন এক রাস্তায় যাবে না। আমাদের এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কেউ আগে থেকে বুঝতে না পারে আমরা কোন রাস্তায় যাব।

ঠিক আছে। আমি একেক দিন একেক রাস্তায় যাব।

জামশেদ ইতস্তত করে বলল, রওনা হবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করবে কোন রাস্তা। আমি বলে দেব। তুমি কিছু ঠিক করবে না।

ড্রাইভারটি আহত স্বরে বলল, আমি কুড়ি বছর ধরে এদের গাড়ি চালাচ্ছি। তুমি আমাকেও বিশ্বাস করছ না?

না। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।

যে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না তার পৃথিবীতে বাস করা কষ্টকর। পৃথিবীতে বাস করতে হলে মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়।

জামশেদ ছোট একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে তোমার পছন্দের রাস্তাতেই যাবে।

ধন্যবাদ।

তুমি আমাকে তা হলে বিশ্বাস করতে পারছ?

না। আমি তো বলেছি আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।

ও।

সিসিলিয়ান ড্রাইভার অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে পড়ল।

অ্যানি সারা পথে চুপচাপ বসে ছিল। একটা কথা জানবার জন্যে তার খুব ইচ্ছা করছিল। লোকটির হাতে এরকম একটা লম্বা কাটা দাগ কোত্থেকে হল? দুহাতেই গভীর দাগ। যেন কেউ একটা ধারালো কিছু দিয়ে কবজির নিচ থেকে দুটি হাত কেটে ফেলতে চেষ্টা করেছিল। অ্যানি শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেসই করে ফেলল, মিঃ জামশেদ, আমি কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

কোনো উত্তর নেই।

শুধু একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

করো।

তোমার হাতে কী হয়েছে?

আলজিয়ার্সে আমি একবার গ্রেফতার হয়েছিলাম, তখন হাত কেটে গিয়েছিল।

কারা তোমাকে গ্রেফতার করেছিল?

 উত্তর নেই।

তারা কি তোমাকে মারধোর করেছিল?

হ্যাঁ, করেছিল।

অ্যানি ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে জামশেদের হাতের কাটা দাগ স্পর্শ করল। জামশেদ কঠিন ভঙ্গিতে হাত সরিয়ে নিল। রুক্ষস্বরে বলল, কেউ আমার গায়ে হাত রাখলে আমার ভালো লাগে না। আর কখনো গায়ে হাত দেবে না। আর শুধুশুধু প্রশ্ন করবে না। মনে রাখবে কথাটা। আমার এসব ভালো লাগে না।

অ্যানি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তার চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। সে চায় না কেউ দেখে ফেলুক। কেউ দেখে ফেললে বড় লজ্জার বাপার হবে।

শোনো অ্যানি, কাঁদবে না। কাদার মতো কিছু হয়নি। অকারণে কান্না আমি সহ্য করতে পারি না।

অ্যানি ফেঁপাতে ফোঁপাতে বলল, তুমি কখনো কাঁদ না?

উত্তর নেই।

যখন আমার মতো ছোট ছিলে তখনও কাঁদনি?

জামশেদ থেমে থেমে বলল, পৃথিবীটা খুব ভালো জায়গা নয়। অনেকরকমের দুঃখকষ্ট আছে পৃথিবীতে। এখানে ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কেঁদে বুক ভাসালে হয় না।

তুমি যখন বড় হবে তখন জানবে অনেক কুৎসিত ও কদর্য ব্যাপার হয় এখানে। 

অ্যানি ফোপাতে ফোপাতে বলল, তুমি আমাকে যত ছোট ভাবছ আমি তত ছোট না। আমি অনেক কুৎসিত ব্যাপারের কথা জানি কিন্তু আমি কাউকে সেসব বলতে পারি না। আমার কোনো বন্ধু নেই।

.

দোতলার লবিতে বসে জামশেদ কফি পাচ্ছিল। মারিয়া নামের যে-মেয়েটি কফি নিয়ে এসেছে সে কিছুক্ষণ গল্প জমাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু তা সঙ্গত কারণেই জমেনি। জামশেদের সঙ্গে কখনো গল্প জমে না। 

জামশেদ চারদিক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখছিল। বাড়িটি সেরকম সুরক্ষিত নয়। চারদিকের দেয়াল নিচু। যে-কেউ অনায়াসে দেয়াল টপকাতে পারবে। তার ওপর কোলাপসেবল গেটটিতে বেশির ভাগ সময়ই তালা থাকে না। ভিকির সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে। তিনটি জিনিস করা দরকার। দেয়াল কমপেক্ষ তিন ফুটের মতো বাড়াতে হবে এবং গেটে সর্বক্ষণ তালা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং একটি ভালো জাতের কুকুরের ব্যবস্থা করতে হবে।

জামশেদ কফি খেতে খেতে ভাবল, শরীর যদি আগের মতো থাকত তা হলে এসবের দরকার হত না। কিন্তু শরীর আগের মতো নেই, নষ্ট হয়ে গেছে। এখন একধরনের আলস্য বোধ হয়। দারুণ ক্লান্তি লাগে। মাঝে মাঝে দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। কেউ কি এখনও আছে যে তাকে চিনতে পারবে? এজাতীয় ভাবনা ইদানীং তার হয়। তখনই তাকে নেশা করতে হয়। সস্তা ধরনের নেশা, ঝাঁঝালো ব্ল্যাক নাইট কিংবা টক রাম। লিভার অতি দ্রুত পচিয়ে ফেলবার মহৌষধ। লিভারটি সুস্থ রেখেই-বা কী লাভ

জীবন ফুরিয়ে আসছে। ঘণ্টা বেজে গিয়েছে, কান পাতলে শোনা যায়। এ সময়ে কোনোকিছুর জন্যেই কোনো মমতা থাকে না।

জামশেদ উঠে দাঁড়াল। মারিয়া সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, কফিপটে আরো কফি আছে। খেতে চাইলে ঢেলে নাও। জামশেদ তার উত্তরে কিছু বলল না। সে নিজের ঘরে চলে এল। এ-ঘরের জানালাগুলো ছোট ছোট। অর্থাৎ ঘরটি ভৃত্যশ্রেণীর লোকদের জন্যে। তাতে কিছুই যায় আসে না। ঘরটি প্রশস্ত এবং লাগোয়া বাথরুম আছে। বাথরুমটি ঝকঝকে পরিষ্কার। তা ছাড়া বুকশেলফ আছে একটি, প্রচুর ইংরেজি পেপারব্যাক সেখানে। বই পড়ার তার তেমন অভ্যেস নেই। তবু মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

তুমি হাততালি দেবে, মারিয়া। তোমার হাততালির সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়াব। শব্দ করে হাততালি দেবে।

জামশেদ তাকিয়ে দেখল অ্যানি লনে দৌড়াতে শুরু করেছে। সিঁড়ির কাছে কোমরে হাত দিয়ে মারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। জামশেদ অবাক হয়ে লক্ষ করল মেয়েটি বেশ ভালো দৌড়াচ্ছে। দেখে যতটা দুর্বল মনে হয় ততটা দুর্বল নয় সে। বেশ ভালোই ছুটছে। তবে স্টার্টিং হচ্ছে না। মেয়েটির রিফ্লেক্স অ্যাকশন ভালো না। অনেকখানি নষ্ট করছে শুরুতেই। জামশেদের হঠাৎ ইচ্ছে হল নিচে নেমে যেতে, আর ঠিক তক্ষুনি অ্যানি চেঁচিয়ে বলল, মিঃ জামশেদ, আমি স্কুল স্পোর্টসে নাম দিয়েছি। ওয়ান হানড্রেড মিটার।

জামশেদ জানালার পাশ থেকে সরে এল। তার এখন সুটকেস খুলে কনিয়াকের বোতলটি বের করার ইচ্ছা হচ্ছে। প্রবল ইচ্ছা। জামশেদ ঘরের দরজা বন্ধ করে সুটকেস খুলল। নিচে অ্যানি খুব হৈচৈ করছে। চেঁচিয়ে বলছে, মারিয়া, তোমাকেও দৌড়াতে হবে আমার সঙ্গে। একা একা দৌড়াব নাকি? উঁহু, তা হচ্ছে না। মারিয়া স্প্যানিশ ভাষায় কী যেন বলল। তার উত্তরে অ্যানি গলা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। জামশেদের কাছে মনে হয় অ্যানি মেয়েটি বেশ ভালো।

.

ভিকি একটা দুঃসংবাদ পেয়েছে।

 ওরিয়েন্ট মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ম্যানেজার টেলিফোন করে বলেছে এক কোটি লিরা ঋণ আপাতত দিতে পারছে না ওরা। তবে নতুন স্পিনিং মেশিন কেনা হলে সেই মেশিন বন্ধক রেখে কিছু দেয়া যেতে পারে।

ভিকি আকাশ থেকে পড়ল। খবরটি অপ্রত্যাশিত। ওরিয়েন্ট মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে খোলাখুলি কথা হয়েছিল। যোগাযোগ এতরার করে দেয়া। ম্যানেজার বলেছিল, ঋণ পাবার কোনো অসুবিধা হবে না। হঠাৎ করে এরকম হল কেন কে জানে! 

ভিকি কী করবে ভেবে পেল না। সিল্ক ইন্ডাস্ট্রি বিক্রি করে দেয়াই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি; সিনথেটিক কাপড়ের ব্যবসাতে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু তার জন্যে যে সাহস দরকার সে সাহস ভিকির নেই। তাদের তিন পুরুষের ব্যবসা হচ্ছে সিল্ক নিয়ে। সিল্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। ডুবলেও সিল্কের মধ্যেই ডুবতে হবে।

হ্যালো, এতরা?

হ্যাঁ। কী ব্যাপার, এই সাতসকালে?

ওরিয়েন্ট মার্কেন্টাইল লোন দিচ্ছে না।

বল কী?

 হ্যা। আজকেই কথা হয়েছে।

কীজন্যে দিচ্ছে না কিছু বলেছে?

না।

আচ্ছা, আমি জিজ্ঞেস করে জানব।

ভিকি ক্লান্ত স্বরে বলল, এখন আমার কী করণীয় সেটা বলো।

বিদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। ওদের হার্ট অনেক বড়। ঋণ চাইলে এত ধানাইপানাই করে না। তুমি আমেরিকান এক্সপ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করো। মিঃ অলিভার লরেন্স নামে এক ভদ্রলোক আছেন সেখানে। ওঁর সঙ্গে কথা বল।

দেখি।

দেখাদেখির কিছু নেই। আজকেই যোগাযোগ করো। আচ্ছা, একটা কথা, মিলান শপিং মলে তোমার একটা ঘর আছে না?

আছে।

সেটাও কি মর্টগেজড?

হা।

কোন ব্যাংক?

সিটি ব্যাংক।

তোমার অবস্থা তো করুণ বলেই মনে হচ্ছে। যাক, ঘাবড়াবার কিছু নেই। একটা কিছু হবেই। ব্যাংক ছাড়াও তো ঋণ দেবার লোক আছে।

ভিকি শঙ্কিত গলায় বলল, আমি ব্যাংক ছাড়া বাইরের কোনো লোন নিতে চাই না।

না চাওয়াই উচিত। ইন্টারেস্টের রেট খুবই চড়া।

 সেজন্যে না। মাফিয়াদের সঙ্গে জড়াতে চাই না।

এতরা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, জলে নামলে কুমিরের সঙ্গে ভাব রাখাই ভালো।

এতরা, ভাব বেশি করতে চাই না।

আচ্ছা-আচ্ছা, ঠিক আছে। ভিকি!

শুনছি।

এই রোবারে বাচ্চাদের জন্যে একটা মেলা হচ্ছে। সার্কাস, ম্যাজিক-শো এইসব হবে, চিলড্রেন্স নাইট। একটা বড় জাহাজ ভাড়া করছে ওরা। জাহাজের মধ্যেই সব ব্যবস্থা। তুমি অ্যানি এবং রুন এদের নিয়ে ঘুরে আসো। মন ভালো থাকবে।

আমি এই কদিন কোথাও বেরুব না। অ্যানির ভালো লাগত। তুমি যেতে চাইলে অ্যানিকে নিয়ে যেতে পার। আমি কোথাও নড়ব না।

.

মিঃ অলিভার লরেন্স লোকটি অত্যন্ত মিষ্টভাষী। সে ভিকির ঋণের কাগজপত্র সব হাসিমুখে দেখল। কফি খাওয়াল। মিডল ইস্টের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে শেষ পর্যায়ে বলল, মিঃ ভিকি, ইতালিয়ানরা পারতপক্ষে বিদেশী ব্যাংকের কাছে লোন চায় না। এদিক দিয়ে তারা খুব জাতীয়তাবাদী। বিদেশী ব্যাংকের কাছে ওরা তখনই আসে যখন দেশী ব্যাংক ওদের ঋণ দেয় না। কথাটা কি ঠিক নয়?

হ্যাঁ, তা ঠিক।

আপনাকে স্থানীয় ব্যাংকগুলো লোন দিচ্ছে না কেন, মিঃ ভিকি?

ভিকি সরাসরি কোনো জবাব দিতে পারল না। লরেন্স অলিভার হাসিমুখে বলল, আমার মনে হয় পিওর সিল্ক থেকে আপনার সরে আসা উচিত। পিওর সিল্কের বাজার ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।

ভিকি চুপ করে রইল। লরেন্স অলিভার বলল, আপনাদের যে পরিবারিক নামাক আছে তার ওপর নির্ভর করেই আমরা আপনাকে লোন দিতে রাজি আছি, তবে আপনাকে পিওর সিল্ক থেকে সরে আসতে হবে।

ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, তা সম্ভব নয়।

সম্ভব নয় কেন?

মিঃ লরেন্স, সিল্ক ব্যবসা আমাদের অনেক দিনের ব্যবসা। আমার দাদা ছিলেন রাস্তার ছোকরা। সিল্ক ব্যবসা করেই তিনি কোটিপতি হয়েছিলেন। তিন-পুরুষের সেই ব্যবসা আমি নষ্ট করব তা হয় না।

লরেন্স অলিভার মৃদু হাসল।

আপনি হাসছেন কেন?

হাসছি কারণ আপনি ব্যবসার জন্যে ফিট নন। আপনি সেন্টিমেন্টাল।

সেন্টিমেন্টাল হওয়া কি খুব দোষের? ভিকি চুপ করে গেল।

আমি দুঃখিত যে কিছু করতে পারছি না। তবে আপনি যদি ব্যবসার ধারা বদলাতে চান তা হলে আমরা সঙ্গে দেখা করবেন। আমি নিশ্চয়ই সাহায্য করব।

ভিকি মৃদুস্বরে বলল, তা সম্ভব নয়।

.

রুন ত্রিশ হাজার লিরা দিয়ে নতুন একটা ড্রেস কিনেছে। অনেকটা জাপানি কিমানোর মতো দেখতে। হালকা সবুজ রঙের ওপর নীল নকশা। ঘরে আনার পর তার মনে হল, ঘন সবুজের ওপর ঘন নীল নকশার যে ড্রেসটি ছিল সেটিও সন্ধ্যাবেলার জন্যে চমৎকার। রুন সেটাও কিনে আনল। একই ডিজাইনের উপর আরো দুটো ড্রেস ছিল। সে দুটোও কিনে ফেলবে কি না এই বিষয়ে সে ঠিক মনস্থির করতে পারল না। সবগুলি কিনে ফেলবার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে তা হলে তাকে দেখে অন্য কেউ একই ডিজাইনের পোশাক সঙ্গে সঙ্গে কিনতে পারবে না। আর না কেনার পেছনে যুক্তি হচ্ছে, ভিকি রাগ করবে।

ভিকি অবিশ্যি রাগ করল না, ভাবলেশহীন চোখে তাকিলে দেখল। রুন হালকা গলায় বলল, খরচ একটু বেশি পড়ে গেল, কিন্তু দ্যাখো-না, এত চমৎকার ডিজাইন রোজ রোজ পাওয়া যায় না। আর সবুজ রঙের গাম্ভীর্যটুকু দ্যাখো। চোখ ফেরানো যায় না। তুমি খুশি হয়েছ তো?

হ্যাঁ, হয়েছি।

না, ঠিক খুশি হওনি। একটু রাগ তোমার মধ্যে আছে। কিন্তু আমি ড্রেসটা গায়ে দিয়ে আসি, দেখবে কী অদ্ভুত লাগে। ভালো কথা, ঐ লোকটা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। খুব নাকি জরুরি।

কোন লোকটা?

আমাদের বডিগার্ড। ওর নাম মনে থাকে না আমার।

কী চায় সে?

 আমি জানি না। আমাকে কিছু বলেনি।

বেশ, ডাকো।

.

ভিকি মন দিয়ে ওর কথা শুনল। লোকটি ঘরের চারদিকের দেয়াল তিনফুট উঁচু করতে চায়, একটি কুকুর রাখতে চায়।

 মিঃ ভিকি, তোমার বাড়ি খুবই অরক্ষিত। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে তোমার বাড়িতেই ঘটবে।

জামশেদ, তুমি একটা কথা ভুলে যাচ্ছ। আমার মেয়েকে কেউ কিডন্যাপ করবে না। তোমাকে আমি রেখেছি শুধু আমার স্ত্রীকে খুশি করবার জন্যে। তুমি তার কাছে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রতীক।

এই কথা তুমি কিন্তু আমাকে আগে বলনি।

এখন বললাম। এখন থেকে জেনে রাখো

 ও।

এখানে থাকতে তোমার কেমন লাগছে?

জামশেদ জবাব দিল না।

 ভিকি বলল, অ্যানি অবিশ্যি খুব খুশি। তোমাকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে।

জামশেদ অবাক হয়ে তাকাল। তাকে পছন্দ করবার তেমন কোনো কারণ নেই। বরং অপছন্দই হবার কথা।

তোমাকে ও কী বলে ডাকে জান? বুড়ো ভালুক।

বুড়ো ভালুক?

তোমাকে নাকি ওর বুড়ো ভালুকের মতো লাগে।

আমার মেয়েটিকে কেমন লাগে তোমার চমৎকার না?

 শিশুদের আমি ঠিক পছন্দ করি না, মিঃ ভিকি। ওদেরকে কখনোই ভালো লাগে না।

তা-ই বুঝি?

হ্যাঁ

পছন্দ না করার কারণ কী?

আছে হয়তো কোনো কারণ। আমি ঠিক জানি না। কারণ নিয়ে কখনো ভাবিনি।

০৪.

রুন দারুণ বিরক্ত হল।

একজন লোক আগ্রহ করে নিতে চাইছে, কিন্তু মেয়ে যাবে না। এর মানে কী? কতরকমের মজার ব্যবস্থা আছে। সারারাত জেগে সার্কাস-টার্কাস দেখবে, তা না, অ্যানি মুখ গোজ করে আছে।

কেন যাবে না, অ্যানি?

আমার ভালো লাগে না।

ভালো না লাগার কী আছে এখানে।

 বললাম তো আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।

 সার্কাস দেখতে তোমার ভালো লাগে না?

অ্যানি চুপ।

 পুতুলনাচ দেখতে ভালো লাগে না?

কোনো জবাব নেই।

 তার ওপর প্যান্টোমাইম আছে।

অ্যানি টেনে টেনে বলল, তুমি যদি যাও তা হলে আমি যাব না।

রুন বিরক্ত স্বরে বলল, আমি তোমার কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। তুমি যাবে এবং হাসিমুখে যাবে। একটা লোক এত টাকা খরচ করে টিকিট এলেছে, না, সে যাবে না! দিনরাত ঘরে বসে থেকে এটা তোমার হয়েছে।

মা, আমি কোথাও যেতে চাই না।

এ ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাই না। তুমি তোমার কাপড় গুছিয়ে রাখো। সন্ধ্যাবেলা এতরা চাচা তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে।

অ্যানি তার বাবাকে গিয়ে ধরল, বাবা, আমি ঐ জাহাজে যেতে চাই না।

কেন মা?

আমার ভালো লাগছে না।

 শরীর খারাপ?

না, শরীর ঠিকই আছে?

তা হলে কি মন-খারাপ? মন-খারাপ হলে তো যাওয়াই উচিত। তা হলে মন ভালো হবে। তা ছাড়া বহু টাকা খরচ করে তোমার এতরা চাচা টিকিট কেটেছেন। সেটা দেখতে হবে না?

আমার একটুও ইচ্ছা করছে না বাবা।

ইচ্ছে না করলেও আমাদের অনেক কিছু করতে হয়। তুমি না গেলে তোমার মা খুব রাগ করবেন। তোমার মা রাগ করলে কী অবস্থা হয় তা তো তুমি জানোই। জানো না?

জানি।

 যাও মা, ঘুরে আসো। বেশ লাগবে তোমার। মনে হবে কেন যে আগে আসতে চাইনি!

.

রাত দশটার পর জামশেদ দরজা বন্ধ করে দেয়। আজকেও করে দিয়েছে। সুটকেস খোলা হয়েছে। হুইসকির পেটমোটা বোতল বের হয়েছে। বোতলের মুখ খোলবার আগেই দরজায় আলতো করে টোকা পড়ল।

কে?

 কোনো উত্তর নেই। জামশেদ বোতলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল।

কে?

কোনো উত্তর নেই। জামশেদ দরজা খুলে দেখে ঘাসের স্লিপার পায়ে দিয়ে অ্যানি দাঁড়িয়ে আছে শুকনোমুখে।

কী ব্যাপার?

আমি তোমার সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই।

না।

কথাটা সকালে বললে হয় না?

এসো, ভেতরে এসে বলো।

অ্যানি নিঃশব্দে ভেতরে এল। জামশেদ দেখল মেয়েটির চোখ ফোলা। নিশ্চয়ই দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদছে।

কী বলবে বলো।

কাল সন্ধ্যায় এতরা চাচা আমাকে একটা জাহাজে নিয়ে যাবে। সেখানে সারারাত ধরে সার্কাস-টার্কাস হবে।

অ্যানি দম নেয়ার জন্যে থামল। জামশেদ কিছুই বলল না।

আমি সেখানে যেতে চাই না।

 ও।

ঐ লোকটা ভালো না। আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। আমি আগের মতো ছোট না।

তুমি তোমার বাবা-মাকে বলেছ?

 বলেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি?

তুমি কি বলেছ এতরা চাচা লোকটি খারাপ?

না।

অ্যানি ফুঁপিয়ে উঠল। জামশেদ ভারী গলায় বলল, যাও, ঘুমুতে যাও। অনেক রাত হয়েছে। নাও, এই তোয়ালেটা দিয়ে চোখ মোছো।

অ্যানি চোখ মুছে শান্তস্বরে বলল, শুভ রাত্রি, মিঃ জামশেদ।

শুভ রাত্রি।

.

এতরা এসে পড়ল পাঁচটার মধ্যেই। তার গায়ে চমৎকার একটা সার্জের কোট। পিঠে বাটিকের কাজ-করা চামড়ার একটা ব্যাগ।

অ্যানি, তৈরি তো?

রুন বলল, হ্যাঁ, তৈরি হচ্ছে। আর ঝামেলার কথা বল কেন, হঠাৎ করে বলছিল সে যাবে না। তার নাকি ভালো লাগছে না।

কী আশ্চর্য, ভালো লাগছে না কেন? কোথায়, অ্যানি কোথায়?

সাজগোজ করছে।

যাচ্ছে তো এখন?

হ্যাঁ, যাচ্ছে।

যাক, তাও ভালো।

অ্যানি লাল রঙের একটি ম্যাক্সিজাতীয় ড্রেস পরেছে। ড্রেসটির জন্যেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক অ্যানিকে বেশ বড় বড় লাগছে। পনেরো-ষোলো বছরের তরুণীর মতো। রুন অবাক হয়ে বলল, বাহ, চমৎকার লাগছে তো? গালে কি তুমি রুজ দিয়েছ, অ্যানি?

নাহ।

রুজ ছাড়াই গাল এমন লাল দেখাচ্ছে? আশ্চর্য তো! এতরা, দ্যাখো, আমার মেয়েকে দ্যাখো। পরীর মতো লাগছে না?

হ্যাঁ, তা লাগছে। মেয়ে মায়ের মতোই হয়েছে।

গেটের পাশে জামশেদ দাঁড়িয়ে ছিল। এতরা অ্যানিকে নিয়ে গেটের কাছে আসতেই সে বলল, মিঃ এতরা, অ্যানিকে যে তুমি জাহাজে নিচ্ছ, সেখানকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমি তো কিছু জানি না।

তোমার জানার কোনো দরকার আছে কি?

আছে। আমাকে বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে অ্যানির নিরাপত্তার জন্যে। কাজেই অ্যানি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব।

এতরা স্তম্ভিত হয়ে গেল। বলে কী এই উজবুক। আমি একে নিয়ে যাচ্ছি এটা কি যথেষ্ট নয়?

না মিঃ এতরা, মোটেই যথেষ্ট নয়। আমি সঙ্গে যাচ্ছি।

এতরা দেখল, লোকটির কালো চোখ পাথরের মতো কঠিন। এ যাবেই সঙ্গে, এতে ভুল নেই।

অ্যানির ফ্যাকাশে ঠোঁটে যেন রক্ত ফিরে এসেছে। সে মনে হচ্ছে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসি গোপন করতে চেষ্টা করছে।

তোমাকে সঙ্গে নেয়ার জন্য কোনো বাড়তি টিকিট নেই।

তা হলে আজ যাওয়াটা বাতিল করতে হবে।

আমার মনে হয় একটা ছোট ব্যাপারকে এখানে অনেক বড় করে দেখা হচ্ছে।

আমার তা মনে হয় না মিঃ এতরা।

এতরা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল।

 জামশেদ শান্তস্বরে বলল, চেষ্টা করলে এখনও হয়তো আরো একটি টিকিট জোগাড় করা যেতে পারে।

এত সময় আমার নেই। আমি একজন ব্যস্ত মানুষ।

 তা হলে বরং অন্য কোনোদিন হবে।

এতরা জবাব দিল না।

.

ভিকি অনেক রাতে ঘুমুতে এসে দেখে রুল জেগে আছে। ব্যাপারটি অস্বাভাবিক। রুন এত রাত পর্যন্ত জাগে না। রাত জাগলে তার চোখের নিচে কালি পড়ে। এটি সে হতে দেয় না। শরীর ঠিক রাখার জন্যে অনেক কঠিন নিয়ম মেনে চলে সে।

ভিকি বলল, কী ব্যাপার, এখনও জেগে আছ যে? দেড়টা বাজে।

তোমার জন্যে জেগে আছি।

কিছু হয়েছে নাকি?

ঐ লোকটার চাকরি নট করে দাও।

কার চাকরি নট করব?

 জামশেদ না কী যেন নাম-অ্যানির বডিগার্ড।

ব্যাপারটা কী?

অত্যন্ত অভদ্র ব্যবহার করেছে সে।

 কার সঙ্গে? তোমার সঙ্গে?

না, এতরার সঙ্গে। এতরা ভীষণ রেগে গেছে।

ঘটনাটা খুলে বলল রুন। ভিকি গম্ভীর হয়ে বলল, এটা বলার জন্যেই তুমি এত রাত পর্যন্ত জেগে বসে আছে?

ঘটনাটা তোমার কাছে খুব সাধারণ মনে হচ্ছে? এতবড় অপমান করল সে এতরাকে। শেষ পর্যন্ত এতরা অ্যানিকে রেখে গেল।

এতরার অপমানিত বোধ করার তো কোনো কারণ নেই। লোকটি তার ডিউটি করেছে।

ডিউটি? কিসের ডিউটি?

অ্যানির নিরাপত্তার দিকে লক্ষ রাখার ডিউটি। লক্ষ রাখা—যাতে কেউ অ্যানিকে কিডন্যাপ না করে।

রুন রেগে গিয়ে বলল, কে কিডন্যাপ করবে অ্যানিকে?

 আমারও তো সেই প্রশ্নই ছিল। কিন্তু তখন তুমিই আমাকে অন্যরকম বুঝিয়েছ।

বেশ, আমি ভুল করেছি।

বডিগার্ডের ভূত তোমার ঘাড় থেকে নেমেছে?

 রুন জবাব দিল না।

বডিগার্ডের আর তা হলে প্রয়োজন নেই?

না।

খুব ভালো।

এখন বলো কবে তাড়াচ্ছ লোকটাকে?

বললেই তো আর হুট করে তাড়ানো যায় না। চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হলে খুব ভালো কারণ থাকতে হবে। নয়তো ইউনিয়নের ঝামেলায় পড়ব।

কিন্তু চাকরি দেবার সময় তো তুমি বলেছিলে টেম্পোরারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট, বলনি?

হ্যাঁ, তা বলেছি। কিন্তু টেম্পোরারি অ্যাপয়েন্টমেন্টেও তিনমাস শেষ হবার আগে নোটিস দেয়া যায় না। তুমি এত ব্যস্ত হয়ে উঠলে কেন?

এতরা খুব রাগ করেছে। একে তো এতরাই জোগাড় করে এনেছিল। এতরা আমাকে বলেছে ঐ লোকটি না বিদেয় হওয়া পর্যন্ত সে এ-বাড়িতে আসবে না।

না আসুক। তার আসতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?

তার মানে? কী বোঝাতে চাচ্ছ তুমি?

কিছুই বোঝাতে চাচ্ছি না। ভোর হোক তখন দেখা যাবে। এখন ঘুমাও! অসংখ্য ঝামেলা আমার মাথায়। এইসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে হৈচৈ করতে ভালো লাগছে না।

তোমার আবার কী ঝামেলা?

ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া যাচ্ছে না। একটা থেকে না পাওয়া গেলে অন্যটা থেকে পাওয়া যাবে। ভিকি কথা না বাড়িয়ে ঘুমুতে গেল। রুন মাথার চুল আঁচড়াতে আচড়াতে বলল, ঐ লোকটি মনে হল অ্যালকোহলিক। মারিয়া জানালা দিয়ে দেখেছে রাতের বেলা বোতল নিয়ে বসে ও।

এটুআধটু ড্রিংক তো সবাই করে।

তা করে, কিন্তু কেউ দরজা-টরজা লাগিয়ে করে না। আমি এ-বাড়িতে কোনো মাতালকে রাখব না।

সকাল হোক, আলাপ করে ঠিক করব কী করা যায়। এখন দয়া করে ঘুমুতে যাও।

.

টুক টুক করে টোকা পড়ছে দরজায়। জামশেদ ভারীস্বরে বলল, কে?

আমি। আমি অ্যানি।

কী চাই?

 আমি তোমাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছি।

ঠিক আছে। এবার যাও।

আমি তোমার জন্য কয়েকটা গোলাপ ফুল এনেছিলাম।

 ফুল লাগবে না। তুমি যাও।

অ্যানি তবুও দীর্ঘ সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। মারিয়া কফির পেয়ালা হাতে বাইরে বেরিয়ে দেখল অ্যানি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা তার ভালো লাগল না। একটা ভয়ংকর লোকের দরজার সামনে ভোরবেলায় ফুল-হাতে দাঁড়িয়ে থাকাটা চট করে চোখে লাগে। ব্যাপারটা রুনকে বলতে হবে। মারিয়া ডাকল, অ্যানি!

হ্যালো, মারিয়া।

কী করছ একা একা?

 কিছু করছি না।

 ফুল কার জন্যে?

অ্যানি হাসিমুখে বলল, বুড়ো ভালুকের জন্যে।

হঠাৎ ফুল কেন? কোনো বিশেষ কারণ আছে?

আছে। তোমাকে বলা যাবে না।

মারিয়ার ভ্রূ কুঞ্চিত হল। ব্যাপারটা তার মোটেও ভালো লাগছে না।

.

জামশেদকে একদিনের ছুটি দেয়া হয়েছে।

তার ছুটির প্রয়োজন ছিল না তবু নিতে হল। ভিকি বারবার বলল, ঘুরেটুরে আসো। সারাক্ষণ ঘরে বন্দি হয়ে থাকার দরকার নেই। অ্যানির স্কুল নেই, সে বাড়িতেই থাকবে।

জামশেদের যাবার তেমন জায়গা নেই। মিলান শহরটিকে সে খুব ভালো চেনে না। দশ বছর আগে এখানের অলিগলি চেনা ছিল। এখন আর নেই। দশ বছর খুব দীর্ঘ সময়, এই সময়ে খুব চেনা জিনিসও খুব অচেনা হয়ে যায়।

রাস্তাঘাট বদলে গেছে। শহর অনেক পরিচ্ছন্ন হয়েছে। ডেলকা নদীর দুপাশে বস্তিজাতীয় যেসব ঘরবাড়ি ছিল তাঁর কোনো চিহ্নও নেই। আকাশছোঁয়া দালান উঠেছে দুপাশে। প্রশস্ত ছয় লেনের রাস্তা। ঝলমলে নিওন আলো।

সন্ধ্যার আগে জামশেদ একতলা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। রেস্টুরেন্টটি শহরের উপকণ্ঠে একটি দরিদ্র অঞ্চলে। অল্প আলোর একটি বাতি জ্বলছে। সে-আলোতে রেস্টুরেন্টের নাম অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে–পিজা অ্যান্ড লাসানিয়া হাউস। লেখাটি ইংরেজিতে।

 রেস্টুরেন্ট ফাঁকা। এক কোনায় একটি বুড়োমত ভদ্রলোক ঝিমুচ্ছে। অন্য প্রান্তে একটি অল্পবয়েসী মেয়ে একা একা বসে আছে। মেয়েটি ঘনঘন ঘড়ি দেখছে। নিশ্চয়ই কারো জন্য অপেক্ষা করছে সে।

কাউন্টারে অল্পবয়স্ক একটি ছোকরা বসে আছে। জামশেদ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল, আমি একজন আমেরিকানের খোঁজ করছি, তার নাম বেন ওয়াটসন।

ছেলেটি সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। থেমে থেমে বলল, কীজন্যে খোঁজ করছেন?

ও আমার পরিচিত।

বেন এখানে নেই।

সে এখানে আছে। কখন আসবে সে?

জানি না।

আমি তার জন্যে অপেক্ষা করব।

ইচ্ছা হলে করুন।

জামশেদ একটি অন্ধকার কোনা বেছে নিল বসবার জন্যে। কাউন্টারের ছেলেটি এসে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবে? ভালো পিজা আছে।

না।

 কনিয়াক আছে। দেব?

দিতে পার।

লিরা আছে তো তোমার কাছে?

 আছে।

এখানে আগে দাম দিতে হয়।

জামশেদ হাজার লিরার একটি নোট বের করল।

 ছেলেটি নোট নিতে নিতে বলল, বেন ওয়াটসনের সঙ্গে তোমার কী দরকার?

আছে একটা দরকার।

তুমি কি পুলিশের লোক?

না।

জামশেদ লক্ষ করল মাস্তান ধরনের একটি ছেলে ঢুকেছে। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না টলছে। ছেলেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির টেবিলের সামনের। নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা বাধাতে চায়। জমিশেদ কানখাড়া করল।

মিস, আমি কি তোমার টেবিলে বসতে পারি?

আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি দয়া করে অন্য টেবিলে বসো।

যার জন্যে অপেক্ষা করছ সে তো আসছে না।

আসবে।

যখন আসবে তখন ছেড়ে দেব।

 জামশেদ লক্ষ করল মেয়েটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল।

 উঠছ কেন?

আমি অন্য কোথাও বসব।

কেন, আমাকে পছন্দ হচ্ছে না?

পছন্দ অপছন্দে কথা না। আমি বাড়ি চলে যাব।

এখনই বাড়ি যাবে কেন? রাত তো মাত্র শুরু।

কাউন্টারের ছেলেটি বলল, এই, ঝামেলা করবে না।

 ঝামেলা?

এটা মাতলামির জায়গা না।

 কী, তুই আমাকে মাতাল বললি?

মাতাল-টাতাল বলিনি। যাও, অন্য কোথাও যাও।

এইখানে এই মেয়ের হাত ধরে বসে থাকব, দেখি কোন শালা কী বলে।

লোকটি পকেট থেকে আধহাত লম্বা একটি ছোরা বের করল।

মেয়েটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। বুড়ো ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে এই ঝামেলায় থাকতে চায় না। কাউন্টারের ছেলেটিও ভয় পেয়েছে।

জামশেদ উঠে এগিয়ে গেল। খুব ঠাণ্ডাস্বরে, বলল, মেয়েটিকে ছেড়ে দাও।

কেন? তুই ফুর্তি করতে চাস?

ওর হাত ছাড়ো।

মাতালটা হাত ছেড়ে দিল কিন্তু নিমিষেই বাঁ হাতে ছোরাটা তুলল। তোলার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ছোরা সে অতীতে অনেকবার ব্যবহার করেছে। আজকেও করবে। কারণ মদের প্রভাবে তার বুদ্ধি ঘোলা হয়ে গেছে।

জামশেদ দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করল। ছোকরা লেফট হ্যাল্ডার কি না তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অনেক সময় প্রতিপক্ষকে ধোকায় ফেলবার জন্যে এই কাণ্ডটি করা হয়। আক্রমণের ঠিক আগের মুহূর্তে ছোরা চলে আসে ডান হাতে।

জামশেদ একদৃষ্টে মাতালটির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অপেক্ষার মতো কষ্টকর কিছুই নেই। তা ছাড়া বয়সের জন্যে ইন্দ্রিয় আগের মতো সজাগ রাখা যায় না। জামশেদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। এগিয়ে আসছে, এখন ঝাঁপিয়ে পড়বে। যা ভাবা গিয়েছিল তা-ই, সে তার ডান হাতটিই ব্যবহার করবে। ধোঁকা দেবার উদ্দেশ্যেই বাঁ হাতে রেখেছে ছুরি। হাতবদল হবার আগমুহূর্তেই কিছু-একটা করতে হবে।

মেয়েটি কুলকুল করে ঘামছিল। সে দেখল, ছুরি-হাতে বাঘের মতো বয়স্ক লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাতালটি। মেয়েটি চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ মেলে যে-দৃশ্য দেখল তার জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না। দেখল বয়স্ক লোকটি নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। চার-পাঁচ ফুট দূরে চিত হয়ে পড়ে আছে মাতালটি। খুব সম্ভব তার নাক ভেঙে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। সে দারুণ অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে বয়স্ক লোকটিকে।

জামশেদ তার টেবিলে ফিরে আসতেই ছেলেটি দৌড়ে এল।

স্যার, ভালো কনিয়াক আছে, দেব?

না। টাকা লাগবে না।

না। আমি এখন উঠব।

স্যার, আপনি যদি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন তা হলে বেনের সঙ্গে দেখা হবে। বেন ওয়াটসন একটার দিকে আসবে।

জামশেদ উঠে দাঁড়াল।

স্যার, একটু যদি বসেন।

না, এখন আমি যাব।

বেন ওয়াটসনকে আপনার কথা কী বলব?

কিছু বলতে হবে না।

আপনার নাম?

আমার নাম বলার কোনো প্রয়োজন নেই।

আপনি কি আবার আসবেন?

হ্যাঁ, আসতে পারি। না-ও আসতে পারি।

জামশেদ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই মেয়েটিকে দেখতে পেল। সে খুব সম্ভব জামশেদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। জামশেদকে বের হতে দেখেই দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল। আমি আপনাকে ধন্যবাদ দেবার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

ধন্যবাদ দেবার কোনো প্রয়োজন নেই।

আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?

জামশেদ সেকথার উত্তর না দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, মেয়েদের এত রাতে এক একা বাইরে থাকাটা ঠিক না।

আমি আমার এক বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আমার বন্ধু একজন পুলিশ অফিসার।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। শুভ রাত্রি।

শুভ রাত্রি।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ