অমানুষ — হুমায়ূন আহমেদ

মেয়েটির মধ্যে কিছু-একটা আছে যা পুরুষদের অভিভূত করে দেয়। রূপের বাইরে অন্যকিছু।

অসামান্য রূপসী মেয়েদেরকেও প্রায় সময়ই বেশ সাধারণ মনে হয়। এই মেয়েটি সেরকম নয়। এবং সে নিজেও তা জানে।

মেয়েটির চোখ দুটি ছোট ছোট এবং বিশেষত্বহীন। গালের হাড় উঁচু হয়ে আছে। ছোট্ট কপাল কিন্তু তবু কী অদ্ভুত দেখতে! কী মোহময়ী!

তার পরনে সাধারণ কালো রঙের একটি লম্বা জামা। পিঠের অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে মনে হয় মেয়েটির গায়ের রং ঈষৎ নীলাভ। দেখলেই হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করে। 

মেয়েটি প্রকাণ্ড জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে ছিল। তাকে দেখে বোঝায় উপায় নেই সে কিছু ভাবছে কি না। এইজাতীয় মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝা যায় না। এদের চোখ সাধারণত ভাবলেশহীন হয়ে থাকে।

মামণি!

মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অ্যানি এসে ঢুকেছে। অ্যানির পায়ে ঘাসের স্লিপার। চলাফেরা নিঃশব্দ।

অ্যানি

কী মামণি?

তোমাকে বলেছি না ঘরে ঢুকতে হলে জিজ্ঞেস করে ঢুকবে?

অ্যানি লজ্জিত ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে মা’র দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি অবিকল মায়ের মতো দেখতে। শুধু চোখ দুটি আরো উজ্জ্বল, আরো গম্ভীর।

অ্যানি, তুমি এগারোয় পড়েছ, এখন তোমার অনেক কিছু শিখতে হবে, ঠিক না?

জি, মা।

এখানে আমি তোমার বাবার সঙ্গে থাকতে পারতাম? পারতাম না?

পারতে।

আমাদের অনেক ব্যাপার আছে যা তোমার দেখা বা শোনা উচিত নয়।

অ্যানির গাল লাল হয়ে উঠল। সে মায়ের দিকে সরাসরি তাকাতে পারল না।

কিছু বলবার জন্যে এসেছিলে, অ্যানি?

হু

বলে ফ্যালো।

মা, ঘরে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না। বড় একা একা লাগে। আমি আবার স্কুলে যেতে চাই।

তুমি তো একা থাকছ না, মিস মারিয়াটা আছেন। আছেন না?

মিস মারিয়াটাকে আমার ভালো লাগে না। মা, আমি স্কুলে যেতে চাই।

বললেই তো যেতে পারছ না। তোমার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না হয়ে তোমাকে স্কুলে পাঠাব না। যাও, এখন শুয়ে পড়োগে।

অ্যানি তবুও দাঁড়িয়ে রইল। রুন বড় বিরক্ত হল। তার গলার স্বরে অবিশ্যি সেই বিরক্তি প্রকাশ পেল না।

অ্যানি, তুমি আরকিছু বলবে?

আমি স্কুলে যেতে চাই মা।

সেকথা তো আমি একবার শুনেছি। আবার বলছ কেন? যাও ঘুমুতে যাও। একই কথা বারবার শুনতে ভালো লাগে না।

অ্যানি নিঃশব্দে চলে গেল। রুন মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল। তার মেয়েটি অসামান্য রূপসী হয়েছে। এরকম রূপবতীদের অনেকরকম ঝামেলার মধ্যে বড় হতে হয়। তার নিজের যখন মাত্র দশ বছর বয়স তখন তার মুখে রুমাল বেঁধে তাকে জোর করে…। না, এইসব নিয়ে তার এখন আর ভাবতে ভালো লাগে না। রুন অল্প খানিকটা মার্টিনি ঢেলে গ্লাস হাতে করে সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখল ভিকির গাড়ি এসে ঢুকছে।

ভিকি ব্যবসার ব্যাপারে রোম গিয়েছিল। তার আরো দুদিন পরে ফেরার কথা। রুন অবিশ্যি মোটেই অবাক হল না। ভিকি প্রায়ই এরকম করে। অসময়ে এসে উপস্থিত হয়। রুনের বিষয়ে তার কিছু সন্দেহ আছে। অসময়ে এসে দেখতে চায় রুনের সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ আছে কি না। রুন হাসিমুখে বলল, আগেই এসে পড়লে যে?

কাজ হয়নি তাই ফিরে এলাম।

ডিনার দিতে বলব?

ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, খেয়ে এসেছি। ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে রুন।

মার্টিনি তৈরি করে দেব? অলিভ আছে।

দাও।

মার্টিনির গ্লাসটি এক চুমুকে শেষ করল ভিকি। তার মানে সে কোনো-একটি বিষয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত। ব্যবসা নিয়ে? কিন্তু ব্যবসা তো তার অনেকদিন থেকেই খারাপ যাচ্ছে। এটা তো নতুন কিছু নয়।

রুন!

শুনছি, বলো।

বসো। সামনের চেয়ারটাতে বসো। তোমার সঙ্গে ঠাশ্ৰা মাথায় কিছু কথাবার্তা বলা দরকার। জরুরি।

রুন বসল না। আরেক গ্লাস মার্টিনি তৈরি করে পাশে এসে দাঁড়াল। ভিকি গম্ভীর স্বরে বলল, তোমাকে খরচ কমাতে হবে, রুন। অনেকটাই কমাতে হবে।

রুন খিলখিল করে হেসে উঠল।

হাসির কথা না। এই পেইন্টিংটি আমি রোমে যাবার পর কিনেছ তুমি। ওর দাম কত?

খুব সস্তা। নয় লক্ষ লিরা!

ভিকির মুখ পলকের জন্যে ছাই হয়ে গেল।

নয় লক্ষ লীরা!

হু। কার আঁকা দেখবে, মেসি! অদ্ভুত না? মোতিস এ-ছবি আর আঁকেনি। তোমার ভালো লাগছে না?

ভিকি বহু কষ্টে রাগ সামলাল! রেগে গেলে রুনের সঙ্গে তর্ক করা অসম্ভব। রুনকে বোঝাতে হবে। ঠান্ডা মাথায়, পরিষ্কার যুক্তি দিয়ে। রুন দয়া করে একটা জিনিস বুঝতে চেষ্টা করো। আমার অবস্থা ভালো না। খারাপ। খুবই খারাপ।

কীরকম খারাপ?

এ-বছরও লোকসান দিয়েছি। এদিকে ব্যাংকের কাছে বিরাট বড় দেনা।

কত বড়?

প্রায় এক কোটি লিরা।

রুন নিঃশব্দে হাসল। ভিকি ভেবে পেল না এই অবস্থায় এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কেউ হাসে কী করে।

হাসছ কেন?

তোমার নার্ভাস অবস্থা দেখে।

 বাস্তবকে বুঝতে শেখো, রুন। প্লিজ।

রুন হাসিমুখে সামনের চেয়ারটায় বসল। এমন অবস্থা তোমার হল কেমন করে? তোমাদের এতদিনের সিল্ক ইন্ডাস্ট্রির হঠাৎ করে এমন ভগ্নদশা হল কেন?

ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, আমাদের মেশিনপত্র সমস্তই পুরনো। আমাদের নতুন স্পিনিং মেশিন কিনতে হবে। খরাটস জাতীয় মেশিন। নতুন মেশিন না বসালে আমরা হংকং-এর চীনাদের সঙ্গে পারব না। ওরা এখন অর্ধেক খরচে চমৎকার সিল্ক দিচ্ছে বাজারে।

কিনলেই হয় নতুন মেশিন।

টাকা পাব কোথায়? ব্যাংক থেকে লোন নিতে হবে। তার জন্যে গ্যারান্টি দরকার। সেজন্যেই বলছি খরচপত্র কমাও।

হংকং-এর চীনাদের জন্যে আমার জীবনযাত্রা বদলাতে হবে?

বদলাতে বলছি না, খরচপত্র কমাতে বলছি।

রুন উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। ভিকি দেখল সে ক্লসেটের কাছে দাঁড়িয়ে কাপড় খুলে ফেলছে। ভিকি চোখ ফেরাতে পারছে না। যত দিন যাচ্ছে রুনের বয়স কমছে। রুন হালকা সুরে বলল, চলো, ঘুমুতে যাই।

বসো একটু। রাত বেশি হয়নি।

গায়ে কোনো কাপড় নেই অথচ কী সহজ ভঙ্গিতে রুন চলাফেরা করছে। ভিকি একটু চিন্তিত বোধ করল। রুন তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে চাইছে। নিশ্চয়ই কোনো-একটা কারণ আছে। কী হতে পারে সেটি? রুন একটি সিগারেট ধরিয়ে ভিকির সামনের চেয়ারটায় বসল। নরম স্বরে বলল, অ্যানি স্কুলে যেতে চাইছে।

যাক। যাওয়াই তো উচিত।

মেয়র‍্যানদের মেয়ের মতো ওকেও যদি কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়, তখন?

ভিকি বিরক্ত হয়ে বলল, মেয়র‍্যানরা হচ্ছে ইতালির সবচে ধনী পরিবার। ওদের মেয়েদের কিডন্যাপ করে দুকোটি লিরা মুক্তিপণ চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার কী আছে?

রুন গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার যে কিছু নেই তা তো আর যারা কিডন্যাপ করে তারা জানে না। আমি নিজেও তো জানতাম না তোমার এই অবস্থা।

ভিকি একটি সিগারেট ধরাল। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। রুনের সঙ্গে তর্ক করতে হলে মাথা শান্ত রাখতে হয়। ভিকি ধীরস্বরে বলল, রুন, যারা কিডন্যাপিং করছে তারা মাফিয়ার লোকজন, তা তো জান?

জানি।

মাফিয়ার সমস্ত খোঁজখবর রাখে। কার কী অবস্থা তা তাদের অজানা নয়, বুঝতে পারছ? কাজেই তুমি নিশ্চিন্তে অ্যানিকে স্কুলে পাঠাতে পার।

রুন উঠে দাঁড়াল। কী চমৎকার একটি শরীর। কে বলবে এই মেয়েটির বয়স চল্লিশ? সিলিঙের নরম আলো যেন ঠিকরে পড়ছে তার গায়ে। জলকন্যার মতো লাগছে। রুন গম্ভীর গলায় বলল, সুইজারল্যান্ডে একটি চমৎকার স্কুল আছে। জেনেভার কাছে। অনেক ইতালিয়ান ছেলেমেয়ে সেখানে পড়ে। আমি অ্যানিকে সেই স্কুলে দিতে চাই। টেয়ারদের ছোট মেয়েটি ভরতি হয়েছে সেখানে। চমৎকার স্কুল।

ভিকি স্তম্ভিত হয়ে গেল। এসব কী বলছে সে! দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বলল, আসল জিনিসটাই তুমি বুঝতে পারছ না। আমরা টাকা নেই। মেয়েকে সুইজারল্যান্ডে রেখে পড়ানো আমায় সাধ্যের বাইরে। তা ছাড়া অ্যানিরও ভালো লাগবে না। এত দূরে সে একা একা থাকতে পারবে না।

একা একা থাকবে কেন? আমিও থাকব। একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করব জেনেভার কাছে। তুমি হপ্তায় হপ্তায় এসে দেখে যাবে। প্লেনে মাত্র একঘণ্টা লাগে।

এতক্ষণ আমি কী বলেছি তা তুমি বুঝতে চেষ্টা পর্যন্ত করনি রুন। টাকা কোথায় আমার?

রুন পা দোলাতে দোলাতে বলল, এখানকার বাড়িটা বিক্রি করে ফ্যালো। এত সুন্দর বাড়ি, প্রচুর দাম পাবে। সেই টাকার অর্ধেক দিয়ে জেনেভায় একটা বাড়ি কেনা যায়।

ভিকি থেমে থেমে বলল, আমার এই বাড়িটাও ব্যাংকের কাছে মর্টগেজড। আমার ধারণা ছিল তুমি তা জান।

রুন উত্তর দিল না। উঠে গিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাল। ভিকি বলল, অ্যানিকে মিলানের স্কুলেই যেতে হবে। এই হচ্ছে শেষ কথা।

বেশ, সে যাবে মিলানের স্কুলে। তুমি তার নিরাপত্নার ব্যবস্থা করো। নিরাপত্তার ব্যবস্থা–তার মানে?

ওর একটা বডিগার্ড রেখে দাও। এখন তো সবারই আছে। নিখমুদের দুমেয়ের জন্যেই বডিগার্ড আছে।

রুন, তুমি কি জান কত খরচের ব্যাপার সেসব?

আমি জানি না। জানতে চাই না। তুমি যদি অ্যানির বডিগার্ডের ব্যবস্থা না কর তা হলে ওকে আমি সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যাব।

রুন, বডিগার্ড রাখা মানেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সবাই ভাববে, ওদের অনেক টাকাপয়সা।

রুন হাসিমুখে বলল, ভাবলে অসুবিধে কী?

রুন প্লিজ একটা জিনিস দ্যাখো। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ইতালিতে স্কুলে যায় যাদের বাবা-মা আমাদের চেয়ে অনেক ধনী, কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে কোনো বডিগার্ড নেই।

না থাকুক। আমার কিছুই যায় আসে না। ওরা তো আর আমার ছেলেমেয়ে না।

আমার অসুবিধেটা তুমি দেখছ না। একটা বাড়তি খরচ। শুধুশুধু একটা ঝামেলা।

রুন দৃঢ়স্বরে বলল, আজকাল সব ছেলেমেয়ের জন্যে বডিগার্ড আছে। এরেডোসের আছে, টুরেল্লার আছে, এমনকি কেয়োলিনদের পর্যন্ত আছে।

ভিকি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। ব্যাপারটা এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে। বডিগার্ড একটি মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দামি একটা গয়নার মতো। রুন ভিকির গলা জড়িয়ে ধরল, তুমি একবার এতরার সঙ্গে কথা বলো। সে নিশ্চয়ই তোমার টাকাপয়সার ঝামেলা মেটাবার ব্যাপারে সাহায্য করবে। ও তো অনেককেই বুদ্ধি দেয়।

ভিকি উত্তর দিল না। রুনের এই দূরসম্পর্কের ভাইটিকে সে সহ্য করতে পারে না। তার ধারণা, রুনের সঙ্গে ঐ ভাইটির গোপন মেলামেশা আছে। এই ভাইটির কথা উঠলেই রুনের মধ্যে একটা গদগদ ভাব দেখা যায়। রুন আরেকবার বলল, বুঝলে ভিকি, তুমি এতরার সঙ্গে কথা বলো। সে তোমাকে চমৎকার বুদ্ধি বাতলাবে।

রুন এসে ভিকির কোলে বসে পড়ল। গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আর গম্ভীর হয়ে থাকার দরকার নেই। হাসো এবার।

ভিকি হাসতে পারল না। টেনে টেনে বলল, বডিগার্ডের ব্যাপারটি নিয়ে তুমি কি এতরার সঙ্গে কথা বলেছ?

উহু

ভিকির মনে ক্ষীণ একটা আশা হল। যদি এতরাকে দিয়ে রুনকে বোঝানো যায় তা হলে হয়তো কাজ হবে। এতরা যদি বলে বডিগার্ড রাখার ব্যাপারটি হাস্যকর তা হলে রুন নিশ্চয়ই শুনবে। ভিকি এটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।

০২.

অ্যানির ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।

সে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিচে নেমে এল। কী আশ্চর্য, বাগানে বেতের চেয়ারে বাবা বসে আছেন। সে চেঁচিয়ে ডাকল, বাবা।

কীরে বেটি? এত সকালে ঘুম ভেঙেছে?

হু।

ভালো ঘুম হয়নি রাতে?

 না। দুঃস্বপ্ন দেখেছি বাবা।

কী দেখেছিস?

অ্যানি জবাব দিল না। ভিকি মেয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, দেখেছিস একটা প্রকাণ্ড দৈত্য তাড়া করছে। তাই না?

অ্যানি হাসল কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। সে যে-দুঃস্বপ্ন দেখেছে সেরকম দুঃস্বপ্নের কথা কাউকে বলা যায় না। নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতে হয়; সবচে প্রিয় যে বান্ধবী তাকেও বলা যায় না।

অ্যানির একটু মন-খারাপ হল। তার যত বয়স বাড়ছে ততই গোপন জিনিসের সংখ্যা বাড়ছে। যেমন এতরা চাচার কথাই ধরা যাক। ইদানীং এতরা চাচা তাকে দেখলেই আদর করার ছলে জড়িয়ে ধরেন। মুখে কী মিষ্টি মিষ্টি কথা, আরে আমাদের অ্যানির মনটা খারাপ কেন? কী হয়েছে আমাদের অ্যানির?

অ্যানি পরিষ্কার বুঝতে পারে এ সবই হচ্ছে ভান! এতরা চাচাকে এখন আর একটুও ভালো লাগে না। সেদিন এসে মাকে বলল, ওয়াল্ট ডিজনির একটা মুভি হচ্ছে, অ্যানিকে দেখিয়ে আনব বলে ভাবছি।

মা মহাখুশি। হাসতে হাসতে বলল, বেশ হয়। বেচারি একা একা থাকে। নিয়ে যাও।

অ্যানি বলল, সে যাবে না। তার মুভি দেখতে ভালো লাগে না। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি যেতে হল। মায়ের অবাধ্য হওয়ার সাহস তার নেই।

মুভিহল অন্ধকার হতেই এতরা চাচা তার কোমর জড়িয়ে ধরলেন। অ্যানি স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ করল মাঝে মাঝে সেই হাত নিচে নেমে যাচ্ছে। এইসব কথা কাকে বলবে সে? মাকে? মা নিশ্চয়ই উলটো তার ওপর রাগ করবেন। কারণ এতরা চাচাকে মা খুব পছন্দ করেন। এটাও অ্যানির ভালো লাগে না। এতরা চাচা সময়ে অসময়ে আসে বাড়িতে। মা তাকে নিয়ে দক্ষিণে গেস্টহাউসে চলে যান। গেস্ট হাউসে গিয়ে দরজা বন্ধ করার কী মানে? এমন কী কথা তার সঙ্গে যা দরজা বন্ধ করে বলতে হয়?

ভিকি দেখল অ্যানি গম্ভীর হয়ে বসে আছে। সে হালকা স্বরে বলল, আমার মামণি এত গম্ভীর কেন?

অ্যানি চাপাস্বরে বলল, এখানে চুপচাপ বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না বাবা। আমি স্কুলে যেতে চাই।

খুব শিগ্‌গিরই যাবে মা।

কবে?

তোমার মা চাচ্ছেন তোমার জন্যে একজন বডিগার্ড রাখতে। এই ব্যাপারটি নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। যদি না রাখলে চলে তা হলে তুমি এই হপ্তা থেকে যেতে পারবে। আর যদি রাখতে হয় তা হলে একটু দেরি হবে।

অ্যানি মুখ উজ্জ্বল করে বলল, বডিগার্ড রাখলে খুব মজা হবে বাবা।

মজা কিসের?

ঐ লোকটি কেমন বন্দুক-টন্দুক হাতে নিয়ে থাকবে। ভাবতেই আমার মজা লাগছে, বাবা।

মামণি, এর মধ্যে মজার কিছু নেই। সমস্ত ব্যাপারটি হাস্যকর। খুবই হাস্যকর।

আমার কাছে তো বেশ লাগছে বাবা। ভিকি কিছু বলল না। অ্যানি বলল, তুমি কি চা খাবে? চা আনব তোমার জন্যে?

চা বানাতে পার তুমি?

হুঁ, খুব পারি।

বেশ তো, খাওয়া যাক এক কাপ চা।

অ্যানি হাসিমুখে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। ভিকির একটু মন-খারাপ হল। অ্যানি এখানে খুব নিঃসঙ্গ। ভিকি তাকে সময় দিতে পারে না। রুনও পারে না। মেয়েটির কোনো সঙ্গীসাথি নেই।

চা ভালো হয়েছে বাবা?

চমৎকার হয়েছে।

মনে হচ্ছে একটু বেশি কড়া হয়েছে।

 আমার কড়া চা পছন্দ।

অ্যানি হাসিমুখে বলল, আমি যদি বলতাম চা বেশি হালকা হয়েছে তা হলে তুমি বলতে আমার হালকা চা পছন্দ–ঠিক না বাবা?

তা ঠিক। ভিকি, অ্যানি দুজনেই গলা ছেড়ে হেসে উঠল।

.

রেস্টুরেন্টটি ছোট কিন্তু শহরের নামী রেস্টুরেন্টগুলির মধ্যে এটি একটি। এতরা ইতালি শহরে সবচে ভালো প্রসকিউটু (কচি বছরের গোশত) রান্না করে–এ ধরনের একটা কথা চালু আছে। ভিকি প্রসকিঊটু পছন্দ করে না, কিন্তু তবু এখানে এসেছে। কারণ এ রেস্টুরেন্টটি এতরার খুব প্রিয়, সে প্রায় রোজই এখানে লাঞ্চ খেতে আসে।

 ভিকি বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকবার পর এতরা এসে উপস্থিত। চমৎকার একটা নীল রঙের শার্টের উপর হালকা গোলাপি একটা টাই পরেছে এতরা। কে বলবে এই লোকটির বয়স চল্লিশের ওপর।

দেরি করে ফেললাম নাকি, ভিকি?

না, খুব দেরি না।

লাঞ্চের অর্ডার দিয়েছ?

এখনও দিইনি। কী খেতে চাও তুমি?

এতরা হাসিমুখে বলল, আমরা বাধা মেনু ভিটেলো টনাটু, প্রসকিউটু এবং এক বোতল বারগুল্ডি।

বারগুভির গ্লাসে চুমুক দিয়ে এতরা ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, এখন বলো, তোমার সমস্যাটা কী?

ভিকি ইতস্তত করতে লাগল। নিজের সমস্যা অন্যের কাছে বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এতরার যত দোষই থাকুক, ওর মাথাটা খুব পরিষ্কার। তা ছাড়া, ওর ভালো কানেকশন আছে। প্রচুর লোকজনের সঙ্গে ওর চেনাজানা।

কী ব্যাপার, চুপ করে আছ যে? বলো।

তুমি বোধহয় জান না আমার ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে।

ঠিক জানি না বললে ভুল হবে। তবে কতটা খারাপ তা জানি না।

বেশ খারাপ।

এত খারাপ হল কী করে?

 ভিকি জবাব দিল না।

এতরা বলল, আমার কাছে ঠিক কী পরামর্শ তুমি চাও?

আমার যা দরকার তা হচ্ছে মোটা অঙ্কের কিছু টাকা

মোটা অঙ্কের টাকা জোগাড় করা তোমার জন্যে কঠিন হবার কথা নয়। তোমার স্ত্রীর প্রচুর টাকা আছে।

আমি ওর কাছে হাত পাততে চাই না।

বুঝলাম। স্ত্রীর কাছে হাত না পাতাই ভালো, তাতে দাম কমে যায়।

এতরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি ব্যাংকে চেষ্টা করেছ? তোমার যা নামডাক তাতে ব্যাংক থেকে সহজেই মোটা টাকা লোন পাবে। ভরাডুবি না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক তোমাকে টাকা দেবে। তুমিও সেটা জান, জান না?

ভিকি উত্তর দিল না। এতরা বলল, তুমি কি চেষ্টা করেছ?

 বিশেষভাবে করিনি।

তা হলে করো। টাকার সমস্যা কোনো সমস্যা নয়। অন্তত তোমার জন্যে নয়। তুমি চাইলে আমি দুএকজন ব্যাংকারের সাথে কথা বলতে পারি। অবিশ্যি আমি তার কোনো প্রয়োজন দেখি না। তোমাকে সবাই চেনে।

আমাকে না। আমার বাবাকে চেনে।

একই কথা। তোমার বাবাকে চিনলেই তোমাকে চেনা হয়। এখন বলো, তোমার আসল প্রবলেম কী? তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তোমার মনে আরোকিছু আছে।

ভিকি আরেকটা বারগুরি অর্ডার দিয়ে চুপ করে রইল। যেন ভাবছে সমস্যাটি বলা ঠিক হবে কি না?

চুপ করে আছ কেন, বলে ফ্যালো।

ভিকি দীর্ঘ সময় নিয়ে বডিগার্ডসংক্রান্ত সমসাটি বলল। এতরা হাসিহাসি মুখে শুনল। তার ভাব দেখে মনে হল, সে খুব মজা পাচ্ছে। ভিকি বলল, এখন বলো, আমার কী করা উচিত।

একটা বডিগার্ড রাখো। এই একমাত্র সমাধান।

ভিকি বড় বিরক্ত হল। এতরা এই কথা বলবে সে ভাবেনি। তার ধারণা ছিল বডিগার্ড রাখার হাস্যকর দিকটি এতরার চোখে পড়বে। এতরা একটি সিগারেট ধরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, বডিগার্ডের ব্যাপারটি এখন রুনের একটি প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুনকে আমি যতটুকু জানি তাতে মনে হচ্ছে বডিগার্ড না রাখা পর্যন্ত সে শান্ত হবে না। একজন বুদ্ধিমান স্বামীর প্রধান কাজ হচ্ছে স্ত্রীকে শান্ত রাখা।

কিন্তু এত টাকা আমি পাব কোথায়?

রীতিমতো প্রফেশনাল লোক রাখলে অনেক টাকা লাগবে, বলাই বাহুল্য। কিন্তু তোমার তো আর প্রথম সারির লোকের প্রয়োজন নেই, ঠিক না?

ঠিক।

কাজেই কোনোরকম একজন কাউকে কয়েক মাসের জন্যে রেখে দাও। রুন শান্ত হলেই ছাড়িয়ে দাও, ব্যস চুকে গেল।

এরকম লোক কোথায় পাওয়া যায়?

এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলেই পাওয়া যাবে। আমার ওপর ছেড়ে যাও। আমি জোগাড় করে দেব। আগামী হপ্তায় তুমি তোমার বডিগার্ড পাবে। ঠিক আছে?

ভিকি কিছু বলল না। এতরা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আর কোনো সমস্যা আছে? থাকলে বলে ফেলো।

না, আরকিছু নেই।

তা হলে এই কথা রইল। সোমবার তুমি বডিগার্ড পাবে। এখন তা হলে উঠি। চমৎকার লাঞ্চের জন্যে ধন্যবাদ। আর শোনো ভিকি, তুমি মুখ এমন হাঁড়ির মতো করে রাখবে না। একটু হাসো। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি গভীর সমুদ্রে পড়েছ।

এতরা বেরিয়ে গেল। ভিকি নিজের মনে বলল, আমি গভীর সমুদ্রেই পড়েছি। অতলান্তিক জলে।

.

এতরা তার কথা রাখল। হপ্তা শেষ হবার আগেই একজন বিদেশী মানুষ এসে হাজির।

তোমার সঙ্গে বন্দুক আছে?

হ্যাঁ।

দেখাতে পার?

লোকটি জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট রিভলভার বের করল। ভিকি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল সেটার দিকে।

কী নাম এটির?

বেরেটা ৪৮।

ভিকি শিশুর মতো আগ্রহে রিভলবারটি হাতে তুলে নিল। কী সুন্দর। ছিমছাম! ছোট্ট একটি জিনিস।

এর লাইসেন্স আছে?

আছে।

এর মধ্যে কি গুলি ভরা আছে?

আছে।

তুমি এইজাতীয় রিভলভার আগে ব্যবহার করেছ?

করেছি।

কী সর্বনাশ! তুমি আগে বলবে তো?

ভিকি সাবধানে রিভলভারটি নামিয়ে রাখল। শুকনো গলায় বলল, তোমার কাগজপত্র কী আছে দেখি।

লোকটি কাগজপত্রের একটা চামড়া-বাঁধানো ফাইল নামিয়ে রাখল। ভিকি প্রথমবারের মতো পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল লোকটির দিকে।

লোকটি ইতালিয়ান নয়। বিদেশী। গায়ের চামড়া কালো। পুরু ঠোঁট। বড় বড় চোখ। অদ্ভুত একধরনের কাঠিন্য আছে। কোথায় সে কাঠিন্যটি তা ধরা যাচ্ছে না। ভিকি নিচুস্বরে বলল, তুমি কি কখনো মানুষ মেরেছ?

হা।

ভিকির গা শিরশির করে উঠল।

কতজন মানুষ মেরেছ?

এর উত্তর জানা কি সত্যি প্রয়োজন?

না-না, উত্তর না দিলেও হবে। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

ভিকি ফাইল খুলল। নাম : জামশেদ হোসেন। বয়স : ৫৫

ভিকি অনেকক্ষণ নামটির দিকে তাকিয়ে রইল। কী অদ্ভুত নাম।

তোমার দেশ কোথায়?

 ফাইলে লেখা আছে। ফাইল খুললেই পাবে।

হ্যাঁ লেখা আছে ফাইলে। পরিষ্কার সব লেখা। লোকটি কথাবার্তা বেশি বলতে চায় না। এটা ভালো। বডিগার্ড এরকমই হওয়া উচিত। ভিকি পড়তে শুরু করল।

জাতীয়তা : বাংলাদেশী।

সেটি আবার কোন দেশ?

ইন্ডিয়া ও বার্মার মাঝামাঝি ছোট্ট একটা দেশ।

তোমার পাসপোর্ট আছে? ইতালিতে যে আছ তার কাগজপত্র আছে?

আছে।

কী ধরনের কাগজপত্র

লোকটি গম্ভীর স্বরে বলল, আমি ফ্রেঞ্চ লিজিওনে দীর্ঘদিন ছিলাম। তারপর কিছুদিন ছিলাম ইতালিয়ানদের সঙ্গে জিরাল্ডায়, আলজিয়ার্সে। আমার কাগজপত্র সেই সূত্রে পাওয়া।

ভিকি অবাক হয়ে বলল, আলজিয়ার্সে কিসে ছিলে?

ফার্স্ট প্যারাট্রপ রেজিমেন্টে।

বল কী! তুমি বাংলাদেশের লোক হয়ে লিজিওনে ঢুকলে কী করে?

লোকটি জবাব দিল না। ভিকি বলল, লিজিওনে ঢোকার আগে তুমি কোথায় ছিলে?

অনেক জায়গায় ছিলাম। আমি একজন ভাড়াটে সৈনিক, মিঃ ভিকি। যে পয়সা দিয়েছে আমি তার জন্যেই যুদ্ধ করেছি। আমি কোথায় ছিলাম, কী ছিলাম সেসব জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আমাকে যদি তোমার পছন্দ হয় তা হলে রাখতে পার। পছন্দ না হলে বিদেয় হব।

ভিকি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। এতরা এই লোকটিকে পাঠিয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে ঠিক লোক পাঠায়নি। অবস্থা যা তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই লোক খাঁটি পেশাদার লোক।

ভিকি নিঃশব্দে কাগজপত্র পড়তে লাগল।

অসাধারণ লিজিওনারি হিসেবে তাকে পরপর দুবার অর্ডার অব ভেলর দেয়া হয়।

ভিকি বড়ই অবাক হল। এতরা এই লোকটিকে পাঠানোর আগে আরো দুজনকে পাঠিয়েছিল। ভিকি তাদের সঙ্গে একটি কথা বলেই বিদেয় করে দিয়েছে। সে দুজন রাস্তার গুল্ডা ছাড়া কিছুই না। কেউ জীবনে কখনো বন্দুক ধরেছে কি না সে সম্পর্কেও সন্দেহ আছে। বডিগার্ড হিসেবে ওদের রাখলে রুন রেগে আগুন হত, বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই লোকটি অদ্ভুত। ভিকি বলল, তুমি কি কফি খাবে?

না।

খাও-না! খাও। ভালো কফি।

লোকটি চুপ করে রইল। ভিকি কফি আনতে বলে নিচুস্বরে জানাল, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু একটি কথার জবাব দাও। এত কম টাকায় তুমি কাজ করতে রাজি হচ্ছ কেন?

লোকটি কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, মিঃ ভিকি, আমি একজন অ্যালকোহলিক। বডিগার্ড হিসেবে আমার কোনোই মূল্য নেই এখন। বয়স হয়েছে। শরীর নষ্ট হয়ে গেছে।

ভিকি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

মিঃ এতরা আমাকে বলেছেন তোমার যেনতেন একজন লোক হলেই চলে। প্রফেশনাল লাগবে না।

তা ঠিক। আসলে আমার স্ত্রীর চাপে পড়েই একজন বডিগার্ড রাখতে হচ্ছে। আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করার কোনো কারণ নেই। স্ত্রীদের চাপে পড়ে আমাদের অনেক কিছুই করতে হয়। ভালো কথা, তুমি কি বিবাহিত।

না।

ভালো, খুব ভালো।

লোকটি নিঃশব্দে কফি খেয়ে যাচ্ছে। ভিকি বলল, ইয়ে, তুকি কি বড়রকমের অ্যালকোহলিক?

না।

মাতাল হয়ে যাও?

না।

আরেকটি কথা তোমাকে বলা দরকার। এমন হতে পারে যে তিনমাস পর তোমাক আমার দরকার হবে না। এতরা নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে সেটা?

হ্যাঁ, বলেছে।

আরেকটি কথা। তোমাকে রাখব কি না সেটি নির্ভর করছে আমার স্ত্রীর ওপর। বুঝতেই পারছ, ওর জন্যেই তোমাকে রাখা।

বুঝতে পারছি।

চলো, আমার স্ত্রী সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। অবিশ্যি তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বেশ পছন্দ হয়েছে। তোমার নামটি যেন কী?

জামশেদ। জামশেদ হোসেন।

অদ্ভুত নাম। এর অর্থ কী?

আমার জানা নাই।

রুন অবাক হয়ে বিদেশী লোকটির দিকে তাকাল। লম্বা। রোগা। একটু যেন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার চুল সাদা-কালো, ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। পরনে কালো রঙের একটি জ্যাকেট, জ্যাকেটের মাঝখানের বোতামটি নেই তবে জ্যাকেট এবং ট্রাইজার দুটিই বেশ পরিষ্কার। রুন কঠিন স্বরে বলল, তুমি তো ইতালিয়ান নও।

না।

ভিকি বলল, ইতালিয়ান না হলেও চমৎকার ইতালিয়ান বলতে পারে।

রুন বলল, তোমর বয়সও অনেক বেশি!

হ্যাঁ, পঞ্চান্ন।

ভিকি হড়বড় করে বলল, বয়স হলেও এই লাইনে সে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। কাগজপত্র দেখলেই বুঝবে। আজকাল এই লাইনে অভিজ্ঞ লোক পাওয়া খুব মুশকিল।

রুন বলল, তোমার দেশ কোথায়?

বাংলাদেশ।

সেটি আবার কোথায়?

উত্তর দিল ভিকি, বার্মা এবং ইন্ডিয়ার মাঝামাঝি একটি ছোট্ট দেশ।

রুন, তুমি বরং মিঃ জামশেদের কাগজপত্রগুলো দ্যাখো।

রুন বলল, তুমি কি আজ থেকে কাজে লাগতে পারবে?

হ্যাঁ।

দোতলার একটি ঘরে তুমি থাকবে। অ্যানিকে স্কুলে নিয়ে যাবে এবং ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। তোমার সাঙ্গে বন্দুক আছে?

আছে।

এসো, তোমাকে ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি।

রুন বেরিয়ে গেল। জামশেদ গেল তার পিছুপিছু। ভিকি সোফায় বসে ঘামতে লাগল। রুন ফিরে এসে একটা ঝগড়া বাধাবে, জানা কথা। এসেই চিৎকার শুরু করবে,

এই বুড়ো হাবড়াকে কোত্থেকে ধরে এনেছ?

কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। রুন ফিরে এসে শান্তস্বরে বলল, লোকটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। তবে …

তবে কী?

লোকটির দিকে তাকালে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।

বিদেশী লোক, তাই।

না, তা নয়। অন্য একধরনের অস্বস্তি। অস্বস্তি ঠিক না, ভয় বলতে পার।

ভিকি অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য, ভয় লাগবে কেন?

জানি না কেন। শুধু মনে হচ্ছিল একটা পেশাদার খুনি। কত লোককে যে মেরেছে কে জানে!

ভিকি চুপ করে রইল। রুন বলল, লোকটির চোখ দেখেছ। পাথরের তৈরি বলে মনে হয়। ঠিক না?

আমি বুঝতে পারছি না কী বোঝাতে চাচ্ছ তুমি!

ওর মনে দয়ামায়া রহম বলে কিছু নেই।

এরকম লোকই তো তুমি চেয়েছিলে, রুন।

রুন চিন্তিত মুখে বলল, তা অবিশ্যি ঠিক।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ভিকি। বড় ঝামেলা চুকেছে। মাস দুএক পর বিদেয় দিলেই হবে। এই টাইপের লোকদের নিজের ঘরে রাখা ঠিক না। তা ছাড়া বিদেশী লোক। বিদেশীদের বিশ্বাস করতে নেই।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ