রেল স্টেশনের এত সুন্দর নাম আছে নাকি? “সোহাগী”। এটা আবার কেমন নাম? দিলু বললো—আপা, কি সুন্দর নাম দেখছ?

নিশাত কিছু বললো না। তার ঠাণ্ডা লেগেছে। সারারাত জানালার পাশে বসেছিলো। খোলা জানালায় খুব হাওয়া এসেছে। এখন মাথা ভার ভার। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত নাক দিয়ে জল ঝরতে শুরু করবে। দিলু বললো—আপা স্টেশনের নামটা পড়ে দেখ না। প্লীজ।

পড়েছি। ভাল নাম।

দিলুর মন খারাপ হয়ে গেলো। সে আশা করেছিলো নিশাত আপাও তার মত অবাক হয়ে যাবে। চোখ কপালে তুলে বলবে—ও মা, কেমন নাম! কিন্তু সে আজকাল কিছুতেই অবাক হয় না। কথাবার্তা বলে স্কুলের জিওগ্রাফী আপার মত। নিশাত বললো—দিলু, দেখত বাবু কোথায়? দুধ খাবে বোধহয়।

দিলু বাবুকে কোথাও দেখতে পেলো না। এমন দুষ্টু হয়েছে। ওয়েটিং রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে হয়ত। কাছে গেলেই টু দেবে। ধরতে গেলেই আবার ছুটে যাবে।

ওয়েটিং রুমের সামনে একগাদা জিনিসপত্রের সামনে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। বিরক্ত মুখ। তিনি দিলুতে দেখেই বললেন—একেকজন একেক দিকে চলে গেছে। ব্যাপারটা কি? তোর মা কোথায়?

জানি না তো।

তোর মাকে খুঁজে বের কর।

আমি পারব না বাবা, আমি বাবুকে খুঁজছি।

বাবুকে খুঁজলে তোর মাকে খোঁজা যাবে না এরকম কথা কোথাও লেখা আছে?

সবাই আজ এরকম করে কথা বলছে কেন? কোথায়ও বেড়াতে গেলে সবার খুব হাসিখুশি থাকা উচিত। কিন্তু এখানে সবাই কেমন রেগে কথা বলছে। রাগটা তার উপরই। ট্রেনে মা তিনবার বললেন—দিলু পা নাচাচ্ছ কেন? পা নাচানো একটা অসভ্যতা। চুপ করে বস। পা নাচানোর মধ্যে আবার সভ্যতা অসভ্যতা কি? যত আজগুবি কথা।

দিলু।

বল।

তোর মাকে খুঁজে বের কর। আমার পাইপের তামাক রেখেছে কোথায় সে?

আমি কি করে জানব? আমি রাখলে আমি জানতাম। আমি তো রাখিনি।

দিলুর বাবা ওসমান সাহেব রাগী চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। ওসমান সাহেবের বয়স আটান্ন। কিন্তু দেখায় আরো বেশী। শরীর হঠাৎ ভারী হয়ে গেছে। মাথার সমস্ত চুল পাকা। মেজাজের পরিবর্তনও হয়েছে হঠাৎ করেই। এখন আর কিছুতেই ধৈর্য রাখতে পারেন না। তিনি দিলুর উপর ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেলেন। দিলুর বয়স এই মার্চে চৌদ্দ হবে। নাকি পনেরো? মেয়েদের এই বয়সটা অন্য রকম। এই বয়সে চেনা মেয়েগুলিকেও অচেনা লাগে। মনে হয় অন্য বাড়ির মেয়ে। এদের উপর কিছুতেই রাগ করা যায় না।

দিলু পরেছে একটা ধবধবে সাদা স্কার্ট। পায়ে মোজা ও জুতা দুই-ই লাল। মাথায় দু’টি লম্বা বেণী। শীতের সকালের রোদে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে বড় অচেনা লাগছে। এর উপর রাগ করা যায় না। ওসমান সাহেব বাক্স-পেটরা হাতড়াতে লাগলেন। পাইল ধরানোর ইচ্ছা হচ্ছে। অনিয়ম করা যায়। ছুটি হচ্ছে অনিয়মের জন্যে।

দিলু ওয়েটিং রুমে কাউকে দেখল না। তবে ওয়েটিং রুমের বাথরুমের দরজা বন্ধ। ভেতরে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। কেউ আছে নিশ্চয়ই। মা বোধহয় বাবুকে বাথরুম করাচ্ছেন। দিলু ডাকলো—বাথরুমে কে? জল পড়ার শব্দ থেমে গেলো। দিলু আবার বললো—বাবু তুমি? কোন সাড়া নেই। তার মানে মা। মা একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাথরুম থেকে কথা বলবেন না।

দিলু যদি বলে—মা, গায়ে মাখার সাবান আছে? মা জবাব দেবেন না। বাথরুম থেকে কথা বলা নাকি অসভ্যতা। এর মধ্যে অসভ্যতার কি আছে?

খুট করে দরজা খুললো। দিলু দেখলো ভেজা মুখে জালিম ভাই বের হয়ে আসছেন।

কিরে দিলু ইমার্জেন্সি নাকি? যা ঢুকে পড়।

ছিঃ কি অসভ্যতা। জামিল ভাইয়ের একেবারেই কাণ্ডজ্ঞান নেই। মেয়েদের কেউ বাথরুমে যাবার কথা ওভাবে বলে নাকি? সে যে বড় হচ্ছে এটা কি জামিল ভাইয়ের চোখে পড়ে না। এখন শাড়ী পড়লে অনেকেই তাকে আপনি করে বলে। জামিল ভাই বোধ হয় তাকে কখনো শাড়ী পরা দেখেনি।

জামিল ভাই, বাবুকে দেখেছেন?

না।

মা’কে দেখেছেন?

না। কেন?

আপা খুঁজছে বাবুকে। আর বাবা খুঁজছে মা’কে।

ওরা মনে হয় স্টেশনের বাইরে হাঁটতে গেছে। চল যাই খুঁজে নিয়ে আসি। তোকে তো দারুন লাগছেরে দিলু। ট্রেনে কি এই ড্রেসেই ছিলি নাকি?

হুঁ।

মাই গড। তখন তো চোখেই পড়েনি।

জামিল দেখলো দিলু খুব লজ্জা পাচ্ছে। এর কারণ সে ঠিক বুঝতে পারলো না। মেয়েটি কি বোড় হয়ে যাচ্ছে নাকি?

‘দেখতে দারুন লাগছে’ এই কথায় কান টান লাল করার মানেটা কি? জামিল তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো।

দিলু তুই যেন কোন ক্লাসে এবার?

ক্লাস নাইনে। ইস আপনি যেন জানেন না!

কোন গ্রুপ, সায়েন্স নাকি আর্টস?

সায়েন্স।

বাপরে বাপ, সায়েন্স! ইলেকটিভ অংকে গোল্লা খাবি তো।

কেন, গোল্লা খাব কেন?

মেয়েরা অংক-মানসাংক এসব জানে নাকি?

জামিল পাঞ্জাবির পকেট থেকে চিরুনি বের করে বাথরুমের আয়নায় চুল আঁচড়াতে গেলো। দরজা পর্যন্ত বন্ধ করলো না। কি বাজে অভ্যাস। দিলু শুনলো চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জামিল ভাই গুন গুন করে গান গাচ্ছে—আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত পাখি গায়।

এই শীতে বসন্তের গান? দিলু বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখলো। সুরেরও কোন ঠিকঠিকানা নেই। বাথরুমে ঢুকলেই গান গাইতে হবে এমন কোন কথা আছে?

চল দিলু, দেখি কাউকে পাওয়া যায় কিনা।

 

ওসমান সাহেব একটা কালো ট্রাঙ্কের উপর বসে আছেন। তাঁর মুখে বিরক্তির ভাব এখন আর নেই। পাইপের তামাক পাওয়া গেছে। পাইপ তৈরী করা হয়েছে। বাতাসের জন্য আগুন ধরাতে পারছেন না। জামিলদের বেরুতে দেখে হাসিমুখে বললেন—জামিল, আমাকে এখানে বসিয়ে একেকজন একেকদিকে কেটে পড়েছে, ব্যাপারটা কি বল তো?

সম্ভবত ছুটির দিনে আপনাকে কেউ ভয়-টয় পায় না। আপনাকে নিরীহ মনে করে।

ওসমান সাহেব শব্দ করে হাসলেন। এত শব্দে তিনি কখনো হাসেন না। দিলুও হাসলো। কাউকে হাসতে দেখলেই দিলুর হাসি পায়। ওসমান সাহেব বললেন—কি রকম মিসম্যানেজমেন্ট হয়েছে দেখলে? স্টেশনে জীপ নিয়ে থাকার কথা। জীপতো—নেই-ই, একজন মানুষ পর্যন্ত নেই।

এসে পড়বে।

কিছু মুখে দেয়া দরকার। এতবেলা হয়েছে, সবার ক্ষিধে পেয়েছে।

বেলা কিন্তু চাচা বেশী হয়নি, মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। সকাল হয়েছে মাত্র।

তাই নাকি?

ওসমান সাহেব বেশ অবাক হলেন। জামিল বললো, আমি দেখি চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

ঐখানে একটা চায়ের দোকান আছে।

ঐ চা কি মুখে দেয়া যাবে?

চেষ্টা করতে দোষ কি। লেট আস ট্রাই।

ওসমান সাহেব আবার শব্দ করে হাসলেন। তাঁর মেজাজ সম্ভবত ভাল হতে শুরু করেছে, দিলুও হাসলো। এখন বেশ পিকনিক পিকনিক লাগছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ