নিশাত একটা কাঠের বেঞ্চিতে লাল চাদর গায়ে দিয়ে বসেছিলো। রোদ পড়েছে তার মুখে। শীতের বাতাসে তার কপালে ছোট ছোট কিছু চুল নাচছে। সে বসে আছে বিষন্ন ভঙ্গিতে। তার ফর্সা গালে লাল চাদরের আভা পড়েছে। দিলু ফিস ফিস করে বললো—আপা কত সুন্দর, দেখেছেন?

হ্যাঁ, দেখলাম।

আপাকে ডেকে সঙ্গে নিয়া যাই?

ডাক। ডাকলেই হয়।
দিলু ডাকলো—আপা, এই আপা। নিশাত ওদের দু’জনকে দেখলো। কিছু বললো না। মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মুখ ঘুরিয়ে নেবার ভঙ্গিটি—রাগী ভঙ্গি। সে এমন রেগে আছে কেন?

আপা, আমাদের সঙ্গে যাবে? আমরা স্টেশনের বাইরে হাঁটতে যাচ্ছি। না। বাবু কোথায়?

বাবু মা’র সঙ্গে। ওদের খুঁজতে যাচ্ছি। তুমিও চলো।

না, আমি যাব না।

চল না আপা।

এক কথা বার বার বলতে ভাল লাগে না। তোর যা।

দিলু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। আপা মাঝে মাঝে এমন কড়া করে কথা বলে। এত সুন্দর একটি মেয়ে এরকম কঠিন করে কথা বলবে কেন? দিলু হাঁটতে শুরু করলো।

জামিল ভাই, এগুলো কি গাছ?

জানি না কি গাছ।

কৃষ্ণচূড়া না কি?

না, কৃষ্ণচূড়া না। কৃষ্ণচূড়ার পাতা তেঁতুল গাছের পাতার মত। এগুলি খুব সম্ভব জারুল। কচুরিপানার মত ফুল হয় এদের। নীল রঙের খুব সুন্দর।

এই স্টেশনের নামটা কত সুন্দর দেখেছেন?

নামটার একটা গল্প আছে, জান?

কি গল্প?

এখানে এক রাজা ছিলেন। রাজার একটি মাত্র মেয়ে। মেয়ের নাম সোহাগী। রাজ্যে পানির খুব কষ্ট। রাজা ঠিক করলেন এমন এক পুকুর কাটবেন যে, রাজ্যে পানির কষ্ট থাকবে না। তিনি সত্যি প্রকাণ্ড এক পুকুর কাটলেন। কিন্তু আশ্চর্য, একফোঁটা পানি নেই। সে বৎসর খুব খরা। রাজ্যের লোক হাহাকার করছে। রাজা শুকনো মুখে পুকুর পাড়ে বসে আছেন, তখন শুনলেন কে যেন বলছে—তোমার কন্যাকে পানিতে নামিয়ে দাও, জল আসবে। রাজা সোগাগীরে নামিয়ে দিলেন এবং বললেন—কোন ভয় নেই মা, জল আসতে শুরু করলেই তোমাকে টেনে তুলে ফেলবো।

মেয়ে পুকুরে নামামাত্রই চারদিক থেকে হু হু করে জল আসতে লাগলো। রাজা তাকে আর টেনে তুলতে পারলেন না। পুকুরটির নাম হলো সোহাগী পুকুর। জায়গাটার নাম হলো সোহাগী।

যান, এটা সত্যি না। বানিয়ে বানিয়ে বলছেন।

বানাব কেন? সোহাগী পুকুর সত্যি সত্যি আছে। জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। আর তুমি যদি ভরা পূর্ণিমার রাতে পুকুর পাড়ে বসে থাক তাহলে সোগাগীর কান্নাও শুনবে। ঐ মেয়েটি ভরা পূর্ণিমায় কাঁদে।

কেন?

পূর্ণিমার রাতে সে পুকুরে নেমেছিলো তাই। প্রতি পূর্ণিমাতেই সে আসে।

দিলু অন্য দিকে মুখ ফেরালো। তার চোখ ভিজে আসছে। তার খুব অল্পতেই কান্না পায়।

 

নিশাত দেখলো—ওরা লোহার গেট পার হয়ে স্টেশনের ওপাশের কাঁচা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জামিল ভাই গল্প করছেন হাত নেড়ে নেড়ে। কি গল্প কে জানে। মুগ্ধ হয়ে শুনছে দিলু। দিলুকে আজ অন্যদিনের চেয়েও একটু বড় লাগছে। এত বড় মেয়ের স্কার্ট পরা ঠিক না। চোখে লাগে। মাকে বলতে হবে।

লোকজন বিশেষ নেই চারদিকে। শুধু একজন বুড়ো খুব মন দিয়ে নিশাতকে দেখছে। এই প্রচণ্ড শীতেও তার গায়ে শুধু একটা গেঞ্জি। নিশাত প্রথমে ভেবেছিলো ভিক্ষা চায় বুঝি। কিন্তু না, এ ভিক্ষুক নয়। ভিক্ষুকদের এতটা কৌতূহল থাকে না। তারা সরাসরি ভিক্ষা চায়। না পেলে চলে যায় অন্য কোথাও।

নিশাতের নাক দিয়ে জল পড়তে শুরু করেছে। দু’টি প্যারাসিটামল খেয়ে নেয়া দরকার। নিশাত উঠে দাঁড়ালো। বুড়োটি বললো—কই যাইবেন গো মা? আশ্চর্য, কত সহজেই মা ডাকলো। প্রশ্ন করতেও কোন সংকোচ নেই। যেন কতদিনের চেনা।

আমরা যাব নীলগঞ্জ।

ডাকবাংলোয়?

জ্বি।

নিশাত চলতে শুরু করলো। তার পিছনে পিছনে গেঞ্জি গায়ে বুড়োটি আসছে। আরো কিছু জানতে চায় হয়তো। গ্রামের মানুষদের খুব কৌতূহল। ওরা প্রশ্ন করতে ভালবাসে।

 

জামিল একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। দিলু বললো—এখানে চা খাবেন? যা ময়লা। জামিল বললো—গ্রামে ঝকঝকে তকতকে রেস্টুরেণ্ট কোথায়? এটা মন্দ কি।

বার তের বছরের একটা ছেলে চা বানাচ্ছিলো। তার সামনে কাঠের একটা লম্বা বেঞ্চে রোদে পিঠ মেলে দু’জন লোক বসে চা খাচ্ছে। তাদের একজন বললো “আপনেরা যাইবেন কোনখানে?”

নীলগঞ্জ।

ওরে ব্যাস মেলা দূর। যাইবেন ক্যামনে?

জীপ আসার কথা।

রাস্তা তো ঠিক নাই। জীপগাড়ি আওনের পথ নাই।

তাই নাকি?

জ্বি। এইজন কি আপনের মাইয়া?

না আমার বোন।

দিলু দেখলো দু’টি লোকই গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে। তার বড় অস্বস্তি লাগতে লাগলো। জামিল ভাই এই বেঞ্চে বসেই চা খাবেন নাকি? লোক দু’টির কৌতূহলের সীমা নেই। একজন বললো—সাব আপনের নাম?

আমার নাম জামিল

আপনে করেন কি?

মাস্টারি করি ভাই। দেখি, একটু বসার জায়গা দেন।

দিলু অবাক হয়ে দেখলো ওরা সবাই বেঞ্চি ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসলো। আগের মতই তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। এতটুকু সংকোচ নেই। জামিল বললো—দেখি, দু’কাপ চা দাও তো। দিলু খাবি তো?

খাব।

লোক দু’জনের একজন বললো—বজলু, সাবরে আর মাইয়াডারে কুকি বিসকুট দে। খালি পেডে চা খাওন ঠিক না। ছেলেটি দু’টি লম্বা বিসকিট হাতে করে এগিয়ে দিলো। দিলু নিলো না কিন্তু জামিল নিলো এবং চায়ে ভিজিয়ে বাচ্চাদের মত খেতে লাগলো। কি যে সব কাণ্ড জামিল ভাইয়ের। দেখতে বড় মজা লাগে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ