তিনজনই বোরকা পরেছে।

পয়সার খুব মজা লাগছে। সে সবাইকে দেখছে, তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে। এখন মনের আনন্দে ঘোরাফেরা করা যায়। কেউ বুঝবে না সে কে। তবে ইবাদত নগর ছছাট জায়গা। ছোট জায়গায় বোরকা পরা তিনজন হাঁটাহাঁটি করছে এটা চোখে পড়বেই। চোখে পড়লেও সমস্যা হবে না। কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করবে না, আপনারা কে? তারা যে সার্কাসের মেয়ে এটা কি বুঝবে? বুদ্ধি থাকলে বুঝবে।

জামদানী বলল, আমার দম বন্ধ লাগে।

পয়সা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। দমবন্ধ লাগার কথায় হাসির কিছু নেই। পয়সার সমস্যা হলো যখন তার মন ভালো থাকে তখন যে-কোনো কথায় সে হাসে। আজ তার মন ভালো। মন ভালো হবার প্রধান কারণ–হাতি তার বাচ্চার কাছে কাউকেই ঘেঁসতে দিচ্ছে না। শুধু পয়সার ব্যাপারে কিছু বলছে না। পুরো সার্কাসের দলে পয়সা একমাত্র মেয়ে যাকে হাতি তার বাচ্চার কাছে যেতে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, হাতিটার সঙ্গে পয়সার ঘনিষ্ঠতাই সবচে কম।

আসমানী বলল, পয়সা, হাসি বন্ধ কর। খামাখা হাসি।

পয়সা বলল, খামাখা হাসি না। জাম বুবুর দমবন্ধ এই জন্যে হাসি।

পয়সা জামদানীকে সংক্ষেপ করে ডাকে জাম বুবু। জামের সঙ্গে মিলিয়ে আসমানীকে ডাকে আম বুবু। সবকিছুর একটা নাম দিয়ে দেয়ার প্রবণতা পয়সার আছে। হাতির বাচ্চার নাম সে দিয়েছে এলং। জামদানীর সঙ্গে এই নাম নিয়ে কথা কাটাকাটিও হয়েছে। জামদানী বলেছে, এলং আবার কী নাম? বাচ্চাটা এত সুন্দর। সুন্দর একটা নাম দে। পয়সা মুখ বাঁকা করে বলেছে–সুন্দর নাম তুমি দাও। আমি এরে ডাকব এলং।

জামদানীর মেজাজ খারাপ হয়েছে, কারণ সে জানে যত সুন্দর নামই দেয়া হোক শেষপর্যন্ত পয়সার দেয়া নামই স্থায়ী হয়ে যাবে। এত সুন্দর একটা বাচ্চাকে সবাই এলং এলং ডাকবে। পয়সা যে নাম দেয় সেটাই শেষপর্যন্ত স্থায়ী হয়ে যায়। সার্কাস দলের ম্যানেজার তৈয়বের নাম সে দিয়েছে কুতুকুতু। দলের সবাই ম্যানেজারকে এখন আড়ালে কুতুকুতুই ডাকে। পাখিওয়ালা খসরুর নাম হয়েছে হাগারু।

বোরকা পরে তিনবোন কোথায় যাবে এখনো ঠিক করা হয় নি। খুব বেশিদূর যাবে এরকম মনে হয় না। এরা সার্কাসের তাঁবুর আশেপাশেই ঘোরাফেরা করবে। সার্কাস দলের মানুষদের এই নিয়ম। এক তাঁবুর নিচে দিনের পর দিন থাকার কারণে তাদের নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়। পুতো দল ছাড়া বের হয়ে এরা স্বস্তি বোধ করে না। যেখানেই যাক দৃষ্টিসীমার ভেতর সার্কাসের তাঁবু থাকতে হবে।

আসমানী বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়। চল এলং-কে দেখে তারপর যাই। একটা মজা করব।

জামদানী বলল, কী মজা?

আসমানী বলল, এখন তো আমরা বোরকা পরা। মুখের পর্দা ফেলে দিলে হাতি দেখতে পারবে না কে কোন জন। দেখি তারপরেও সে পয়সাকে চিনতে পারে কি-না।

পয়সা বলল, পারবে।

জামদানী বলল, পারবে না, একশ টাকা বাজি।

পয়সা বলল, পঞ্চাশ টাকা বাজি।

জামদানী বলল, পঞ্চাশ টাকা না, একশ টাকা। সাহস থাকলে একশ টাকা বাজি ধর।

আমার কাছে একশ টাকা নাই। আমার কাছে যা আছে আমি সেটাই তো বাজিতে ধরব।

আচ্ছা যা, পঞ্চাশ টাকাই বাজি।

তাহলে আম বুবুর কাছে পঞ্চাশ টাকা জমা রাখ।

জমা রাখার দরকার কী?

পয়সা বলল, আমি একবার তোমার কাছে বিশ টাকা জিতেছিলাম, তুমি আমাকে সেই টাকা দাও নাই।

এইবার তুই যদি বাজিতে জিতিস তাহলে ঐ বিশ টাকাও দিয়ে দেব। আর যদি হারিস তাহলে কোনোদিনও ঐ বিশ টাকার কথা তুলতে পারবি না।

আচ্ছা যাও তুলব না।

জামদানী বাজিতে হেরে গেল। হাতি আসমানী জামদানী কাউকেই কাছে। আসতে দিচ্ছে না অথচ পয়সাকে কিছুই বলছে না। পয়সা তীক্ষ গলায় ডাকল–এলং, ঐ এলং। হাতির বাচ্চা হাতির চারপায়ের মাঝখানে লুকিয়ে আছে। সেখান থেকে শুড় বের করে পয়সাকে ছুঁয়ে দিল। পয়সা হেসে ভেঙে পড়েছে। পয়সার সঙ্গে সঙ্গে দুবোনও হাসছে।

তিনজনের হাসির শব্দ হারুন সরকারের মাথায় তীরের ফলার মতো বিধছে। সে চিৎকার করে বলল, হাসি বন্ধ। যদিও সে চিৎকার করছে কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনোই আওয়াজ বের হলো না। তার অবস্থা খুবই খারাপ। যন্ত্রণায় মাথা ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে। রাতে সে বমির উপর পড়েছিল। এখন বমি নেই। কালু সব পরিষ্কার করেছে। ভেজা গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে দিয়েছে। এখনো হারুন সরকারের মাথায় ভেজা গামছা। শীতে শরীর কাঁপছে। জ্বর আসার লক্ষণ।

এই অবস্থায় মাথায় ভেজা গামছা রাখা ঠিক না। ভেজা গামছার কারণে মাথার যন্ত্রণাটা সামান্য কম লাগে বলে গামছা সরানো যাচ্ছে না। গায়ে চাদর দিয়ে দিলে শীতের কাঁপুনি বন্ধ হতো। দিয়ে দিবে কে? কালু গেছে ডাক্তার আনতে। হারুন সরকার চাপা গলায় ডাকল, কালু, কালু! সে জানে কালু আশেপাশে নেই। তারপরেও তাকে ডাকার কারণ গলার স্বর ফিরে এসেছে কিনা তা পরীক্ষা করা। গলার স্বর ফিরে নি। ফ্যাসফাস আওয়াজ বের হচ্ছে। কেউ যে তাকে দেখতে আসবে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। যখন-তখন তার ঘরে ঢোকা নিষেধ আছে।

মেয়ে তিনটা এখনো হাসছে। হাতির বাচ্চা দেখে হাসছে এটা বোঝা যাচ্ছে। বাচ্চাটা এখনো দেখা হলো না। সবাই দেখেছে অথচ হাতির মালিক সে-ই দেখে নি– এটা বিরাট একটা আফসোসের ব্যাপার। হাতির বাচ্চা এবং হাতির মা এই দুজনকে নিয়ে কোনো একটা খেলা বের করতে হবে। বল ছোড়াছুড়ি খেলা। মা-হাতি একটা বল ছুড়ে মারল তার বাচ্চার দিকে, বাচ্চা সেই বল ফেরত পাঠাল। লাল রঙের বিরাট একটা বল লাগবে। সেই বল খুব ভারী হলেও হবে না। আবার হালকা হলেও হবে না। হাতি অতি বুদ্ধিমান প্রাণী, যেকোনো খেলা সে অতি দ্রুত শিখে ফেলে। কেউ কেউ আবার নিজে নিজেও খেলা বের করে।

হারুন সরকার কল্পনায় দেখছে–হাতি এবং হাতির বাচ্চা লাল বল ছোড়াছুড়ির খেলা খেলছে। এই কল্পনা করাটা ঠিক হয় নি। কড়া লাল রঙ এখন মাথার ভেতর ঢুকে দপদপ করছে। হারুন সরকার কল্পনায় বলের রঙ লাল থেকে নীল করল। তাতে লাভ হলো না। রঙ বদলাল না। বরং আরো গাঢ় হলো। মাথার উপর রাখা ভেজা গামছা শুকিয়ে গেছে। আবারো ভিজিয়ে মাথার  উপর দেয়া দরকার। কে দেবে? কালু হারামজাদা সেই যে গিয়েছে আর আসার নাম নেই। ডাক্তার আনতে হিন্দুস্থান চলে গেছে কি-না কে জানে। একটা শান্তি হয়েছে। মেয়ে তিনটার হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে না। কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে না। হারুন সরকার আবার ডাকল, কালু, কালু! কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। আগে ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ হতো। এখন সে আওয়াজও নেই। মৃত্যুর আগে আগে মানুষের জবান বন্ধ হয়। তারও কি জবান বন্ধ হয়ে গেছে! সে মারা যাচ্ছে না তো? সে দুরুদে শেফা পড়ার চেষ্টা করল। শেফা’ শব্দের অর্থ আরোগ্য। এই দুরুদ পাঠে রোগমুক্তি ঘটে।

দুরুদটা হারুন সরকারের জানা আছে। এখন মনে আসছে না। প্রথম শব্দটা মনে হলেই বাকি সবটা মনে হবে। প্রথম শব্দটাই মনে পড়ছে না। আল্লাহুম্মা দিয়ে কি শুরু হয়েছে? আল্লাহুম্মার পরে কী? সাল্লিআলা?

 

তিন কন্যা চলে এসেছে মনু নদীর পাড়ে। সেখানে বিরাট কর্মযজ্ঞ। একই সঙ্গে নদী শাসন হচ্ছে। বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ড শুভেচ্ছা সেতুর জন্যে পাইলিং করা হচ্ছে। নদীর চরে গােটা পঁচিশেক নানান আকৃতির নানান বর্ণের তাঁবু। মাটিকাটা শ্রমিকদের জন্যে লম্বা টিনশেডঝকঝকে নতুন টিনে আলো ঝলমল করছে। কয়েকটা দৈত্যাকৃতি ক্রেন। ক্রেন চলাচল করে রেললাইনের উপর দিয়ে। ওয়ার্কশপ থেকে নদীর পাড় পর্যন্ত রেললাইন বসানো হয়েছে। বিপুল কর্মকাণ্ড দেখতে ভালো লাগে। দূর দূরান্ত থেকে শুধুমাত্র ব্রিজ বানানো দেখার জন্যে লোকজন আসছে।

পয়সা মুগ্ধ গলায় বলল, কী অবস্থা! জাম বুবু দেখ দেখ, রেললাইন বসায়ে ফেলেছে। রেললাইনের উপরে এইগুলান কী?

জামদানী বলল, আমি কি জানি? তুই যতটুক জানিস, আমি ততটুকই জানি।

ধুরুম ধারুম শব্দ কীসের?

জানি না।

জাম বুবু দেখ, চায়ের দোকান বসেছে। বুবু আস, চা খাই।

তারা খুব আনন্দ করে চা খেল। পয়সা বলল, চল একটা নৌকা ভাড়া করে যেখানে পিলার বসাচ্ছে ঐখানে যাই।

আসমানী বলল, কোনো দরকার নাই।

পয়সা বলল, দরকার আছে।

আসমানী বলল, কী দরকার?

আমার কাছে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। এইটাই দরকার। বুবু, স্পিড বোটগুলো দেখেছ কত সুন্দর! সুন্দর না?

জামদানী বলল, হুঁ সুন্দর।

পয়সা বলল, দেখে মনে হচ্ছে বিরাট মজার সার্কাস।

আসমানী বলল, উল্টা-পাল্টা কথা বলিস না তো পয়সা। সার্কাস আর ব্রিজ তৈরি এক জিনিস?

আমার কাছে এক জিনিস। চল নৌকা ভাড়া করি।

আসমানী বলল, না।

পয়সা বলল, তোমরা না গেলে আমি একা যাব।

সাহস থাকলে যা একা।

তোমরা কি ভেবেছ আমার সাহস নেই? তোমাদের ছাড়া একা যেতে পারব না? আমি কিন্তু যেতে পারব।

জামদানী বলল, পঞ্চাশ টাকা বাজি, যেতে পারবি না।

পয়সা গটগট করে এগোচ্ছে। একবারও পেছনের দিকে তাকাচ্ছে না। জামদানী ভীত গলায় বলল, বুবু, ও সত্যি সত্যি চলে যাবে না তো?

আসমানী বলল, না, ও নদীর পাড় পর্যন্ত যাবে। নৌকার মাঝিদের সঙ্গে কথা বলবে। ভাব করবে যেন সত্যি সত্যি নৌকায় উঠছে।

যদি সত্যি সত্যি যায়?

গেলে যাবে। একা একা নৌকা নিয়ে নদীর মাঝখান পর্যন্ত যাওয়ার সাহস থাকা তো ভালোই।

জামদানী বলল, চল আমরাও যাই।

না।

আমরা কী করব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকব?

হুঁ। আয় এক কাজ করি, চায়ের দোকানটার আড়ালে চলে যাই। যেন পয়সা আমাদের না দেখতে পায়। যেন ভাবে আমরা তাকে ফেলে চলে গেছি।

দুই বোন চায়ের দোকানের আড়ালে চলে গেল।

 

পয়সার খুব ইচ্ছা করছে পেছনে তাকিয়ে দেখতে তার দুই বোন কী করছে, কিন্তু সে তাকাচ্ছে না। সে ঠিক করে ফেলেছে নৌকা ভাড়া পাওয়া গেলে মাঝ নদী পর্যন্ত যাবে। তার দুই বোন ভয়ে আধমরা হয়ে যাবে। মোটামুটি মজার একটা ব্যাপার। তারা তিন বোন দড়ির উপর ভয়ঙ্কর খেলা দেখায়। তখন তাদের খুব সাহসী মনে হয়। আসলে তারা তিনজনই খুব ভীতু। এক খাট ছাড়া তিনজন ঘুমোতে পারে না। সেই ঘুম নিয়েও সমস্যা–মাঝখানে কে শোবে? যারা দুই পাশে শোয় তাদের সারাক্ষণ ভূতের ভয় করে। এই বুঝি খাটের নিচ থেকে মরা মানুষের হাত ছুঁয়ে দিল।

তিনজনের কেউই সাঁতার জানে না, কাজেই পানিকেও খুব ভয়। নৌকায় উঠলেই তাদের মনে হয় এই বুঝি বড় একটা ঢেউ এসে নৌকা কাত করে দিল। সেখানে একা একা মাঝ নদী পর্যন্ত যাওয়াটা খুব সাহসী কাজ। অনেকদিন থেকেই পয়সার ইচ্ছা সে সাহসী কোনো কাজ করে। সুযোগটা পাওয়া গেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।

পাড় থেকে মাঝ নদী পর্যন্ত যাবার নৌকা পাওয়া যাচ্ছে। ভাড়াও বেশি না। রিজার্ভ নৌকায় গেলে বিশ টাকা ভাড়া। দলের সঙ্গে গেলে দু টাকা। খেয়াপারানি নৌকাও আছে। তার ভাড়া এক টাকা। এপাড় থেকে ওপাড়ে গেলে মাঝনদীতে ব্রিজ বানানোর কর্মকাণ্ড দেখা যায়।

একটা সমস্যা অবশ্যি আছে। মাঝে মাঝে স্পিডবোট অতি দ্রুত আসা যাওয়া করছে। তখন বিরাট ঢেউ উঠছে। ছোট ছোট নৌকাগুলি এমনভাবে দুলছে দেখে মনে হয় এই বুঝি ডুবে গেল।

দেশী নৌকার ঘাট ছেড়ে পয়সা এখন এগোচ্ছে স্পিডবোটগুলির দিকে। কাছ থেকে দেখবে এই তার পরিকল্পনা। পয়সা ঠিক করে রেখেছে স্পিডবোটগুলির কাছে গিয়ে সে একবার পেছন দিকে তাকাবে।

হ্যালো মিস!

পয়সা ভয়ঙ্কর চমকে গেল। বিদেশী এক সাহেব পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ এত নীল যে মনে হচ্ছে নীল রঙ চোখ থেকে গড়িয়ে এখনি নিচে পড়ে যাবে।

সাহেব পরিষ্কার বাংলায় বলল, সার্কাসে আপনার দড়ির খেলা মনোহর হয়েছে।

আশ্চর্য, বোরকা পরা অবস্থায় এই সাহেব তাকে চিনল কীভাবে? সাহেবও কি হাতির মতো? পয়সা বোরকার পর্দা সরিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল–আপনি কী করে আমাকে চিনলেন?

তিনটা বোরকা পরা মেয়ে হাঁটে। দূর থেকে দেখে চিনেছি।

আপনি এত সুন্দর বাংলা কার কাছে শিখেছেন?

আমি তিন বছর এই দেশে আছি। আমি সবার সঙ্গে খুব বেশি কথা বলি। এই জন্যে সুন্দর বাংলা বলি। আমি গ্রাম্য বাংলাও বলতে পারি।

বলুন তো শুনি।

ভাত খাইচুইন–এর অর্থ ভাত খেয়েছেন? ময়মনসিংহের ভাষা।

আপনি এখানে কী করেন?

আমি নদী শাসন করি।

নদী কি দুষ্ট ছেলে যে নদী শাসন করবেন?

নদী দুষ্ট ছেলে না। নদী দুষ্ট মেয়ে। বড়ই খেয়ালি। তাকে সব সময় শাসনে রাখতে হয়।

কীভাবে শাসন করেন। বেত দিয়ে মারেন? না-কি ধমক দেন?

সাহেব হাসছে। হাসির শব্দ এতই জোরালো যে অনেক দূরের লোকজনও মাথা ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। পয়সা খুবই মজা পাচ্ছে। একজন সাহেবের সঙ্গে কথা বলছে–মজাটা এই জন্যে না, মজা লাগছে এই কারণে যে তার দুই বোন দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে নিশ্চয়ই চমকাচ্ছে। ভয়ে অস্থির হচ্ছে। তারা আরো বেশি ঘাবড়ে যাবে যদি সে এই সাহেবের সঙ্গে স্পিডবোটে করে একটা চক্কর দিয়ে আসে।

আমার নাম নি পোর্টার।

বলেই সাহেব হাত বাড়াল। হাত যে হ্যান্ডশেক করার জন্যে বাড়ানো হয়েছে এটা বুঝতে পয়সার কিছুক্ষণ সময় লাগল। ছেলেরা ছেলেরা হ্যান্ডশেক করে কিন্তু ছেলে এবং মেয়েও কি হ্যান্ডশেক করে? পয়সা খুবই অস্বস্তি এবং লজ্জার সঙ্গে হাত বাড়াল। অস্বস্তির সঙ্গে মজার ভাবটাও তার মধ্যে আছে। দেখুক তার দুই বোন। দেখে আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাক।

তোমার নাম কী?

আমার নাম পয়সা।

পয়সা মানে কী?

আপনি এত সুন্দর বাংলা জানেন, পয়সার অর্থ জানেন না?

না।

না জানলে অন্যকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবেন, আমি বলব না।

আচ্ছা আমি জেনে নেব। তুমি কি নদীর মাঝখানে যে পাইলিং হচ্ছে সেটা দেখতে যাবে? স্পিডবোটে করে একটা চক্কর দিয়ে আনব?

হ্যাঁ যাব।

তোমার দুই বোনও কি যাবে? আমার ধারণা স্পিডবোটে করে গেলে ওরাও খুব মজা পাবে।

ওরা যাবে কি-না জানি না। গেলেও অন্যদিন যাবে। আজ আমি একা যাব।

নি পোর্টার খুশি খুশি গলায় বলল, এ দেশের মেয়েরা অপরিচিত পুরুষ মানুষের সঙ্গে এত কথা বলে না। তুমি যে বলছো তাতে আমি অবাক হয়েছি।

পয়সা বলল, আমি সার্কাসের মেয়ে। সার্কাসের মেয়েরা অনেক কিছু পারে যা অন্যরা পারে না।

আসমানী এবং জামদানী অবাক হয়ে দেখল তাদের সবচে ছোট বোন লালমুখ এক বিদেশীর সঙ্গে গটগট করে স্পিডবোটে গিয়ে উঠল। স্পিডবোট চলে যাচ্ছে মাঝনদীতে। লাল মুখটাই স্পিডবোট চালাচ্ছে। সে নানান রকম কায়দা-কানুন করছে। স্পিডবোটকে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। ডানে নিচ্ছে বায়ে নিচ্ছে।

জামদানী ফিসফিস করে বলল, এইসব কী হচ্ছে?

আসমানী জবাব দিল না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এক্ষুণি ফেরা দরকার। মাগরেবের পরে পরেই শো শুরু হবে। শো শুরু হবার আগেই যদি তিন বোন উপস্থিত না থাকে তাহলে হুলস্থূল হয়ে যাবে।

 

স্বাধীন বাংলা সার্কাস পার্টির জন্যে আজ মহা শুভ দিন। সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। লাইনে এখনো অনেকে আছে। এদের ঢুকাতে হলে আলাদা করে চাটাই বিছাতে হবে। বিশিষ্ট দ্রলোকেরাও এসেছেন। এসডিও সাহেবের ছেলেমেয়েরা এসেছে। সিও রেভি তাঁর স্ত্রী এবং দুই শালিকে নিয়ে এসেছেন। থানার ওসি সাহেবের স্ত্রী তার কয়েকজন বান্ধবী নিয়ে এসেছেন। এরা সবাই পাস নিয়ে সার্কাস দেখবেন। সবচে ভাললা চেয়ারগুলিতে বসবেন। খেলার মাঝখানে তাদের ঠাণ্ডা কোক-ফান্টা খাওয়াতে হবে। তারপরেও এই ধরনের মানুষ যত আসে তত ভালো, সার্কাসের নাম ফাটে।

শো শুরুর টাইম হয়ে গেছে। তুমুল শব্দে বাদ্য বাজনা বাজছে। বাজনার শব্দ সরাসরি হারুন সরকারের মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার কাছে মনে হচ্ছে মাথা ছিড়ে পড়ে যাবে।

কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার দেখে গেছেন। ডাক্তার শুকনা গলায় বলেছেনহাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। মনে হয় রেসপিরেটরি ট্রাকে ইনফেকশন। সোজা বাংলায় নিউমোনিয়া।

হারুন সরকার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আমি হাসপাতালে যাব না। ওষুধপত্র যা দেওয়ার দেন। গলায় প্রচণ্ড ব্যথা। গলার ব্যথাটা কমান।

গলায় ব্যথা সকালে ছিল না। সকালে গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিকালের পর থেকে গলায় আওয়াজ ফিরে এসেছে। কিন্তু ব্যথা প্রচণ্ড। হারুন সরকারের ধারণা মাথার যন্ত্রণাটাই নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। এখন এসেছে গলায় গলা থেকে নামবে বুকে। বুক থেকে পেটে।

ডাক্তার সাহেব বললেন, নিউ জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিলাম। ইনশাল্লাহ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফল পাবেন।

হারুন সরকার বলল, আমি চব্বিশ ঘণ্টা বাঁচব না। তার আগেই ঘটনা ঘটে যাবে।

এটা হারুন সরকারের কথার কথা না। সন্ধ্যার পর থেকে তার এরকম মনে হচ্ছে।

শো শুরু হয়ে গেছে। হারুন সরকার একা শুয়ে আছে। শো-র সময় সবাইকে শো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। রোগীর পাশে বসে থাকার মতো বাড়তি কেউ তখন থাকে না।

হারুন সরকারের খুবই একা লাগছে এবং ভয় ভয় করছে। ভয়ের কারণ অতি বিচিত্র। তার কাছে মনে হচ্ছে খাটের নিচে কেউ একজন হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। যে বসে আছে সে মানুষের মতো হলেও মানুষ না। তার গা-ভর্তি ললাম। হাতের আঙুল পাঁচটা না। শুয়োপোকার পায়ের মতো অসংখ্য আঙুল। শুয়োপোকার পা যেমন কিলবিল করে, তার আঙুলগুলিও কিলবিল করছে। লোকটা ঘাপটি মেরে বসে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। সে হারুন সরকারকে তার কিলবিল আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেবে। কাজটা সে কখন করবে তা-ও হারুন সরকার জানে, যখন ঘরে কেউ থাকবে না এবং যখন হারুন সরকার চোখ বন্ধ করে থাকবে। এই ভয়েই হারুন সরকার চোখ বন্ধ করতে পারছে না। যদিও তাকিয়ে থাকতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। হারুন সরকার হতাশ গলায় ডাকল, তৈয়ব, তৈয়ব!

তৈয়ব স্টেজের মাঝখানে। সে তার ঘোড়া নিয়ে নানাবিদ রসিকতা করছে। দর্শকরা হেসে এ ওর গায়ে গড়াগড়ি করছে। তৈয়ব আজ নতুন একটা আইটেম চেষ্টা করছে। ঘোড়ার ঠোটে লিপস্টিক দেয়া। ঘোড়ার ভেজা ঠোঁটে লিপস্টিক বসছে না এটাই সমস্যা। লিপস্টিক বসলে আরো মজা হতো। তৈয়ব ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরে গাঢ় স্বরে বলছে–ওগো রাগ করে থেকো না গো! তোমার জন্যে ছুনু এনেছি, পাউডার এনেছি, লিপস্টিক এনেছি। আমার দিকে তাকায়ে একটু হাস। লক্ষ্মী সোনামনি।

ঘোড়া ঘোৎ করে একটা শব্দ করল। তাঁবুর সমস্ত লোক একসঙ্গে হেসে উঠল।

পয়সা সাজঘরে কাপড় বদলাচ্ছে। তাদের ডাক আসতে এখনো অনেক। দেরি। এত আগে কাপড় পরে বসে থাকতে তার ভালো লাগে না। আজ বাধ্য হয়ে পরছে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা। কারণ নদীর ঘাট থেকে ফেরার পর তার দুই বোন তার সঙ্গে কথা বলছে না। কোনো কথাই বলছে না। কথা না বলার মতো বড় কোনো অপরাধ তো সে করে নি। একজন বিদেশীর সঙ্গে স্পিডবোটে করে নদীতে কয়েকটা চক্কর দিয়েছে।

পয়সা পায়ে ফেট্টি বাঁধতে বাঁধতে বলল, তৈয়ব চাচাকে দেখে মনেই হয় তিনি এত মজা করতে পারেন। কী গম্ভীর মানুষ! দেখলেই ভয় লাগে। তাই জাম বুবু?

জামদানী উত্তর দিল না। খানিকটা ঘুরেও বসল, যেন পয়সা তার চোখে চোখ না রাখতে পারে।

পয়সা বলল, তোমরা কেন আমার উপর রাগ করেছ আমি কি জানতে পারি?

আসমানী এবং জামদানী এই প্রশ্নের জবাব দিল না। আসমানী বিরক্ত চোখে তাকাল।

পয়সা বলল, তোমরা আমার সঙ্গে কথা না বললে আমার কিছু যায় আসে না।

আসমানী বলল, কেন যায় আসে না? তুই কি কথা বলার লোক খুঁজে পেয়েছিস?

পয়সা বলল, হ্যাঁ পেয়েছি।

আসমানী বলল, লালমুখ বান্দরটাকে পেয়েছিস?

পয়সা বলল, হ্যাঁ আমি সার্কাসের মেয়ে। আমার জন্যে বান্দরই ভালো। আমি আগামীকাল আবার তাঁর সঙ্গে গল্প করতে যাব।

জামদানী বলল, তোকে দাওয়াত দিয়েছে?

হ্যাঁ।

কোথায়, তাঁবুতে?

হ্যাঁ, তাঁবুতে। উনার সঙ্গে চা খাব। কফি খাব। উনি যদি হাত ধরতে চান–হাত ধরাধরি করব।

জামদানী বলল, হাত ধরাধরি করবি?

হ্যাঁ করব।

আসমানী শান্ত ভঙ্গিতে বোনের কাছে উঠে এলো। প্রচণ্ড শব্দে বোনের গালে চড় বসিয়ে দিল।

পয়সা চড় খাবার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সে টুলের উপর থেকে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ে গেল। সে অবাক হয়েছে। তার বড়বোন তার গায়ে হাত তুলতে পারে এটা সে কোনোদিনও ভাবে নি। মেঝে থেকে উঠে সে আগের জায়গায় বসল। পায়ে ফেট্টি বাধা শেষ করল এবং মনে মনে ঠিক করল আগামীকাল সে অবশ্যই ‘মিস্টার পটর পটর’-এর কাছে যাবে। চা খাবে। কফি খাবে। মিস্টার পটর পটর যদি তার হাত ধরতে চায় সে হাত বাড়িয়ে দেবে। তার হাত এমন কোনো পবিত্র হাত না যে কেউ ধরতে পারবে না।

তিন বোনের ডাক পড়েছে। সার্কাসের শেষ দশ মিনিট। এই দশ মিনিট সবাই যেন দমবন্ধ করে বসে থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। যার শেষ ভালো তার সব ভালো। মানুষ শুরুটা কখনো মনে রাখে না। শেষটা মনে রাখে।

দড়ির উপর উঠেই পয়সা ঠিক করল সে যে রাগ করেছে এটা সে দু’ বোনকে বুঝিয়ে দেবে। দুই বোন দড়িতে পা দিয়েই বুঝবে ছােটজন রেগে আছে। পয়সা দড়িতে পা ফেলবে অন্যভাবে। দড়ির যেভাবে কাঁপার কথা সেই। ভাবে কাঁপবে না। অন্যভাবে কাঁপবে। দড়ির এই বিশেষ কম্পন অন্য কেউ বুঝতে পারবে না, যারা দড়ির উপর আছে তারা বুঝবে।

দড়িতে পা দিয়েই জামদানীর মুখ শুকিয়ে গেল। সে তাকাল আসমানীর দিকে। দড়ির খেলায় তিন বোনের ভেতর জামদানী সবচে’ দুর্বল। দড়ির কম্পনের একটু উনিশ বিশ হলেই সে নার্ভাস হয়ে পড়ে। আসমানী পয়সার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করল। চোখের অনুরােধ। পয়সা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে দু হাত তুলে একটা চক্কর দিয়ে দড়ির দুলুনি ঠিক করে ফেলল। জামদানীর পা কাঁপছিল। তার পা কাঁপা ঠিক হয়ে গেল।

তালিতে তাঁবু ফেটে পড়ছে। আজকের দড়ির খেলা অন্য অনেক দিনের খেলার চেয়েও ভালো হয়েছে। মুহাম্মদ বশির মােল্লা নামের এক মাছের ব্যবসায়ী পয়সার নামে একটা স্বর্ণপদক এবং এক হাজার টাকা পুরস্কার ঘােষণা করেছেন। এই পদক আগামীকাল দেয়া হবে। তালি তালি আবারাে তালি। এই তালি মুহম্মদ বশির মােল্লা নামের মানুষটার জন্যে।

বশির মােল্লাকে মঞ্চে নিয়ে আসা হয়েছে। লুঙ্গি ফতুয়া পরা থলথলে একজন মানুষ। মুখভর্তি পান। পানের রস গড়িয়ে পড়ছে। বশির মােল্লা ফতুয়ায় সেই রস মুছে ফেলছে। পানখাওয়া লাল দাঁত বের করে সে দর্শকদের দিকে হাত নাড়ল। পয়সা বলল-হাদু! বাড়িতে যা। আসমানী এবং জামদানী দু’জনই মুখ কঠিন করে রেখেছে। পয়সার কোনো কথায় তারা হাসবে না। দু’জনেরই হাসি পাচ্ছে। তারা হাসি চেপে রেখেছে। পয়সা বলল, জাম বুবু দেখ কাণ্ড! হাঁদু বাবা হাসছে আর তার ভুঁড়ি কাঁপছে। এমন ভুঁড়ি কাঁপানি হাসি এর আগে দেখেছ?

জামদানী হেসে ফেলল। হাসি ছোঁয়াচে রোগ। জামদানীর সঙ্গে সঙ্গে আসমানীও হাসছে।

হারুন সরকারের সামনে শুকনা মুখে তৈয়ব দাঁড়িয়ে আছে। হারুন সরকারের মনে হচ্ছে খুব জরুরি একটা কথা তৈয়বকে বলা দরকার। জরুরি কথাটা কী সেটাই এখন মনে পড়ছে না। হারুন সরকার খুবই হতাশ বোধ করছে। অথচ কথাটা জরুরি, এখনই বলা দরকার।

তৈয়ব বলল, আপনার অবস্থা তো ভালো না।

কে কী বলছে তা হারুন সরকারের মাথায় ঢুকছে না। সে জরুরি কথাটা মনে করার চেষ্টা করছে। তার ব্যথা আরো বেড়েছে। ঘাড় থেকে ব্যথা নেমে এসেছে বুকে। বুকে চাপ ভাব হচ্ছে। নিঃশ্বাসেও কষ্ট হচ্ছে।

তৈয়ব বলল, আপনাকে তো হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার।

হাসপাতালে যাব না।

এখানে পড়ে থাকলে আপনি মারা যাবেন।

হাসপাতালে গেলেও মারা যাব।

এখানে ভালো হাসপাতাল আছে। আমি খোজ নিয়েছি। মিশনারি হাসপাতাল। চিকিৎসা ভালো।

কথাটা মনে পড়েছে। হারুন কথাটা বলতে যাবে তখনই প্রচণ্ড কাশি শুরু হলো। কাশি যখন শেষ হলো তখন আর কথাটা মনে নেই।

হারুন সরকারকে মিশনারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলো রাত দশটায়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কথাটা তার পুরোপুরি মনে পড়েছে। হাতির বাচ্চাটা তার দেখা হয় নি। তৈয়বকে সে বলতে চেয়েছিল–বাচ্চাটা ঘরে নিয়ে আস, একবার দেখি। এখন আর এইসব কথা মনে করে লাভ নেই। হাসপাতালে হারুন একা। বারান্দায় কালু হাঁটাহাঁটি করছে। কালুকে হাতির কথা বলা অর্থহীন। সে নিশ্চয়ই হাতির বাচ্চাটা হাসপাতালে নিয়ে আসবে না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ