পনের বছর পরের কথা।

আশ্বিন মাস। স্বাধীন-বাংলা সার্কাস পার্টির মালিক হারুন সরকারের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে, পানি ঢালছে আসমানী। জামদানী এবং পয়সা দুজনই আড়াল থেকে দৃশ্যটা দেখছে। দুজনের মুখেই চাপা হাসি। শুধু আসমানী গম্ভীর হয়ে আছে। গম্ভীর হয়ে থাকলেও তার চোখে হাসি চিকমিক করছে। তিন বোনের হাসি আনন্দের উৎস পানি ঢালার সময় হারুন সরকারের কর্মকাণ্ড। সে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো ক্রমাগত মাথা ডানে বামে দোলাচ্ছে। নিশানা ঠিক করে পানি ডালা যাচ্ছে না।

সার্কাস পার্টির আজ শো আছে। শোর আগে হারুন সরকারের মাথায় যন্ত্রণা হয়, প্রেসার বেড়ে যায়। বুকে চাপ ব্যথা হয়। তখন দীর্ঘ সময় ধরে মাথায় পানি ঢালতে হয়। পানি ঢালার কাজটা সব সময় করে আসমানী। দুলন্ত মাথায় নিশানা ঠিক রেখে পানি ঢালা খুবই কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজ আসমানী

আনন্দ নিয়ে করে। কাজটা মজার। তিন বোনই খুব মজা পায়।

এখন বাজছে পাঁচটা। শো শুরু হবে সন্ধ্যা সাতটায়। কখনো এত আগে থেকে পানি ঢালার প্রয়োজন হয় না। আজ প্রয়োজন পড়েছে, কারণ আজ প্রথম শো। প্রথমটা ধরে গেলে বাকিগুলিও ধরবে। প্রথমটা না ধরলে আর ধরবে না।

সার্কাসের জন্যে জায়গাটা ভালো। ইবাদত নগর। বড় গঞ্জ। সুতার কারখানা আছে, ইটের ভাটা আছে। মনু নদীর পাড়ে গঞ্জ। সেই নদীতে ব্রিজ বানানো হচ্ছে। শত শত মানুষ ব্রিজ বানানোতে লেগে আছে। সাদা চামড়ার কিছু সাহেব সুবাও আছে। এরা তাঁবু খাটিয়ে নদীর পাড়েই থাকে। ভাটি অঞ্চলের সঙ্গেও জায়গাটার যোগ আছে। ভাটি অঞ্চলের মানুষ আমোদ ফুর্তির জন্যে পয়সা খরচ করতে ডরায় না। যাত্রা-সার্কাসে ঘেটু গান এদের খুব পছন্দের জিনিস।

ইবাদত নগরের একটাই সমস্যা দুটা সিনেমা হল আছে। যেখানে সিনেমা হল আছে সেখানে সার্কাসের শো করা কঠিন। হল মালিকরা নানান ঝামেলা করে। যে কদিন সার্কাস চলে সেই কদিন সিনেমায় লোক হয় না। রুটি রুজির ব্যাপার, ওরা সমস্যা করবেই। স্থানীয় ক্ষমতাবান লোকরাও সমস্যা করে। তাদের সমস্যা অন্যরকম। তারা খোজ করে সার্কাসে মেয়ে কী আছে। তারা সার্কাসের মেয়েদের সঙ্গে প্রাইভেট আলাপ করতে চায়। থানাওয়ালাদেরও ব্যাপার আছে। থানাওয়ালাদের শুধু ফ্রি পাস দিলে হয় না। ফ্রি পাসের সাথে টাকাপয়সা দিতে হয়। তাদের খুশি রাখতে হয়। গঞ্জ মানেই গঞ্জের মাস্তান। সার্কাস যতদিন চলে এই মাস্তানরা সার্কাসের দলের সঙ্গেই থাকে। নানান ফদি-টন্দি করে এদেরকে ঠাণ্ডা রাখতে হয়। মদ খাওয়াতে হয়। টাকা-পয়সা দিতে হয়।

নতুন কোনো জায়গায় সার্কাসের দল নিয়ে যাওয়ার পর পর হারুন সরকার ঠিক করে–আর না, এই শেষ। দল ভেঙে দেয়া হবে, যে যার বাড়ি চলে যাবে। সে নিজে চলে যাবে নেত্রকোনায় তার গ্রামের বাড়িতে। দুতিনটা পুকুর কাটিয়ে পাঙ্গাশ মাছের চাষ করবে। আজকাল পাঙ্গাশ মাছের চাষ খুবই লাভজনক। কিংবা শুকনা মরিচের ব্যবসা করবে। সেটাও না পেলে জমি-জিরাত বেচে ছোট কোনো হোটেলে ঘর ভাড়া করে থাকবে। সে একা মানুষ। একটা মানুষের জীবন কাটানো কোনো সমস্যা না।

মাথায় পানি দেয়া শেষ হয়েছে, হারুন হাতের ইশারায় আসমানীকে পানি ঢালতে নিষেধ করল। আসমানী বলল, আপনার মাথার যন্ত্রণা কমেছে? হারুন সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। মেজাজ খারাপ অবস্থায় কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কথা বললে সেই কথা মাথার ভিতরে চলে যায়। মাথার ভিতরে গিয়ে দপদপ করে।

হারুন বলল, যাও, সামনে থেকে যাও। তৈয়বকে পাঠাও।

আসমানী হাতের গামছা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, মাথাটা মোছেন।

হারুন বলল, মাথা মোছার দরকার নাই। আমার কি মাথা ভর্তি চুল আছে যে আধা ঘণ্টা ধরে মাথা ঘষাঘষি করতে হবে? চিন্তায় চিন্তায় মাথার সব চুল পড়ে গেছে। সামনে দাঁড়ায়ে থেকো না, তৈয়বকে পাঠাও। আরেকটা কথা–মাথায় পানি ঢালার সময় লক্ষ করেছি তোমার দুবোন আমাকে দেখায়ে দেখায়ে ফিক ফিক করে হাসাহাসি করতে ছিল। আমি তো জোকারি করতে ছিলাম না। হাসাহাসির কারণ কী? এইরকম যেন না হয়।

আসমানী বলল, আপনি ডাক দিয়ে ধমক দিয়ে দেন।

হারুন বলল, শোর আগে আগে আর্টিস্টকে ধমক দেয়া নিষেধ। এতে আর্টিস্টের মেজাজ খারাপ হয়। মেজাজ খারাপ হলে খেলা খারাপ হয়। দাঁড়ায়ে আছ কেন? তৈয়বকে খবর দিতে বললাম না?

তৈয়ব আলী দলের ম্যানেজার। বেটে খাট মানুষ। বিশাল শরীরের গোলগাল একজন মানুষ। শরীরের তুলনায় মাথাটা ছোট। ঠোট না নড়িয়ে সে কথা বলতে পারে। এই ক্ষমতাটা তার কাজে আসে। কারণ সে শুধু দলের ম্যানেজার না, সে সার্কাসের জোকার। জোকারকে কিছু বিশেষ বিদ্যা জানতে হয়। তৈয়ব আলী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একা আসর জমিয়ে রাখে। অতি সাধারণ কর্মকাণ্ডের মধ্যেও সে এমন কিছু করে যে দর্শকরা হেসে গড়াগড়ি খায়। শো শুরু হয় তাকে দিয়ে। সে হাড় জিরজিরে একটা ঘোড়া নিয়ে উপস্থিত হয়। দর্শকদের ঘোড়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়–এ আমার পরিবার, স্ত্রী, ওয়াইফ। সে কথা বলছে কিন্তু ঠোট নড়ছে না। পাথরের মতো মুখ। দর্শকরা শুরুতেই হকচকিয়ে যায়। ঘোড়াকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবার পর সে ঘোড়ার গায়ে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে, ও আমার স্বপ্নের রানী, আদরের ঘোড়াকুমারী, কেমন আছ গো? তখন ঘোড়া ফোঁস করে উঠে গা ঝাড়া দেয়। তৈয়ব আহত গলায় বলে, ফোস ফোস করতেছ কেন? দর্শকদের হাসি শুরু হয়। হাসি চূড়ান্ত পর্বে যায় যখন সে পকেট থেকে একটা ব্রা বের করে ঘোড়াকে পরানোর চেষ্টা করে।

তৈয়ব এসে হারুন সরকারের সামনে দাঁড়িয়েছে। তার পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখ। সে দাড়িয়েছে মাথা নিচু করে দলের মালিকের চোখে চোখ রেখে সে কখনো কথা বলে না।

হারুন বলল, তৈয়ব, অবস্থা কী?

কীসের অবস্থা?

টিকিট বিক্রির কী অবস্থা?

মোটামুটি।

হারুন বিরক্ত গলায় বলল, মোটামুটি, ভালো, মন্দ–এই জাতীয় কথা আমাকে বলবে না। কত টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে?

টিকিট বিক্রির খবর নেই নাই।

খবর নেও নাই কেন?

টিকিট এখনো বিক্রি হইতেছে এই জন্যে খবর নেই নাই।

থানাওয়ালার কাছে লোক পাঠিয়েছিলে?

হুঁ।

সব ঠিক আছে?

হুঁ।

আর কোনো সমস্যা আছে?

বাজারের মসজিদের ইমাম সাহেব ঝামেলা করতেছে। বলতেছে সার্কাস হতে দিবে না।

উনার সমস্যা কী?

উনি বলেছেন যাত্রা, সার্কাস এইগুলো বেদাতি কাজ কর্ম। নাচ গান হয়। এইগুলো হইতে দিবেন না।

ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম দেখি।

আপনে চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা নিতেছি।

কী ব্যবস্থা?

তৈয়ব বিরস মুখ করে চুপ করে রইল। হারুন রাগী গলায় বলল, কী ব্যবস্থা নিতেছ শুনি।

তৈয়ব বলল, আমি ব্যবস্থা নিতেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।

হারুন নিঃশ্বাস ফেলল। তৈয়বের উপর অবশ্যই ভরসা করা যায়। সে যখন বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে তখন বুঝতেই হবে যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভালো ব্যবস্থা। তৈয়বের মতো জোকার পাওয়া যেমন কঠিন তার মতো ম্যানেজার পাওয়াও কঠিন।

বাজনাদারদের দলকে পাঠায় দেও, একটা চক্কর দিবে। হাতির পিঠে করে পাঠাও।

বাজনাদার পাঠায়েছি। হাতির পিঠে দেই নাই। এরা ভ্যান গাড়িতে করে গেছে।

হাতির পিঠে দাও নাই কেন? হাতি দেখলে সবাই বুঝত আমাদের দল ভালো। পুতু পুতু দুধ-ভাত দল না। হাতি ঘোড়া আছে। সব কিছুর পাবলিসিটি লাগে।

তৈয়ব চুপ করে রইল।

খাম্বার মতো দাঁড়ায়ে থাকবা না, কথা বলো। হাতি পুন্দের চিপায় লুকায়ে রাখলা কোন হিসাবে?

হাতির শরীর ভালো না।

হারুন চমকে উঠে বলল, বলো কী! কী হয়েছে?

খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সর্বনাশ!

হারুনের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। হাতি তার নিজের না। হাতি পোষার মতো বড় দল তারটা না। হাতি ভাড়া করা। বায়নার টাকা ছাড়াও প্রতি শোতে তিনশ টাকা ভাড়া দিতে হয়। হাতির কিছু হলে হাতির মালিক জহির উদ্দিন তাকে ছাড়বে না। হাতির ভাড়া বাবদ জহির উদ্দিনের দশ হাজার টাকা পাওনা হয়েছে। পাওনা টাকার জন্যে যে-কোনোদিন লোক পাঠাবে। তখন কী উপায় হবে কে জানে।

তৈয়ব ঠাণ্ডা গলায় বলল, চিন্তা করবেন না।

হারুন রাগী গলায় বলল, বেকুবের মতো কথা বলবে না। বেকুবের মতো কথা আমার পছন্দ না। হাতি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আমি চিন্তা করব না? আনন্দে নাচব! ব্যান্ড মাস্টারকে ডাক দাও। বাজনা বাজাক, আমি ড্যান্স দেই।

আমি ব্যবস্থা নিতেছি।

তুমি কী ব্যবস্থা নিবে? তুমি কি হাতির ডাক্তার? সব সময় ফাজিলের মতো কথা। যাও, সামনে থেকে যাও।

আপনি দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়েন।

ওরেব্বাসরে! তুমি তো শুধু হাতির ডাক্তার না, তুমি দেখি আবার মানুষেরও ডাক্তার। যাও যাও, সামনে থেকে যাও।

হারুনের মাথার দুপাশে দপদপ করছে। আবারো মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে থাকার উপদেশটা খারাপ না। ঘুম হবে না, কিন্তু ঝিমভাব আসবে। ঝিমভাবের কারণে মাথার যন্ত্রণা কমে যাবে। হারুন মনে মনে বিড়বিড় করল–আল্লাহপাক, আজকের দিনটা পার করে দাও। আর না, সব ছেড়ে ছুড়ে দিব। প্রয়োজনে মওলানা ডাকিয়ে তওবা করব। মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্ব করে আসব। মদিনা শরীফে গিয়ে নবিজির মাজার জিয়ারত করব। আজকের দিনটা পার করে দাও মওলা।

 

প্রবল হাসির শব্দ। মনে হচ্ছে এক সঙ্গে শতশত মানুষ হা-হা করছে। হাসির শব্দে তাঁবুর তিরপল খুলে মাথায় পড়ে গেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হারুন বিছানায় উঠে বসল। মাথার উপর তাঁবু পড়ে নি। সব ঠিকঠাক আছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার ঘুম না ভাঙিয়েই শো শুরু করে দিয়েছে। হাসির শব্দের উৎস জোকারের জোকারি। এখন নিশ্চয়ই ঘোড়া এবং তৈয়বের কথাবার্তা হচ্ছে। ঘোড়াকে ব্রা পরানোর চেষ্টা চলছে। যেভাবে হাসির শব্দ আসছে শো অবশ্যই জমে গেছে। ঘোড়ার খেলার পরই হবে পাখির খেলা। হালকা জিনিসের পরপরই ভারী কোনো কিছু দেয়া যায় না। পাখির খেলা সবসময় জমে না। মাঝে-মাঝে খুব জমে যায়, আবার মাঝে-মাঝে দর্শকরা চেঁচিয়ে উঠে–রন কর। বন কর। ঐ পক্ষীওয়ালা, বাড়িত যা। মাঝে মাঝে হাত তালিতে কান ফাটার উপক্রম হয়। আজ কী হবে কে জানে!

হারুন বিছানা থেকে নামল। তাঁবুর পেছন দিয়ে বের হয়ে দর্শকের দিক দিয়ে ঢুকল। দর্শক কেমন হয়েছে দেখা দরকার। পাখির খেলা জমে কি-না সেটাও দেখা দরকার। পাখির খেলা জমে গেলে বাকি খেলা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা নেই। শেষ আইটেম দড়ির খেলা। যার শেষ ভালো তার সব ভালো। দড়ির খেলাটা মারাত্মক। স্বাধীন বাংলা সার্কাসের আসল খেলা। তিন বোন দশ মিনিট ধরে খেলা দেখায়। এই দশ মিনিট দর্শকরা প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকে। আঠারো ফুট উপরে দড়ি টানানো। তিন বোন প্রথমে দড়ির উপর দিয়ে সাবধানে হেঁটে যায়। তাদের দেখেই মনে হয় তারা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে খুব ভয় পাচ্ছে। এখনি পড়ে যাবে এখনি পড়ে যাবে ভাব। ভয় পাওয়ার কথা। দড়ির নিচে কোনো নায়লনের নেট নেই। একবার পড়লে অবশ্যই মৃত্যু। আগে নেট থাকত। দেখা গেল নিচে নেট বিছানো থাকলে দর্শকরা মজা পাচ্ছে না। কারণ তারা জানে দড়ির উপর থেকে পড়ে গেলে কোনো ক্ষতি নেই, ব্যাথা পাবে না। জালে আটকে যাবে। যেই নায়লনের নেট সরিয়ে দেয়া হলো অমনি খেলা জমে গেল। সার্কাসে মানুষ বিপদজনক খেলা দেখতে আসে। নিচে নায়লনের শক্ত নেট ফিট করে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটায় কোনো বিপদ নেই।

বিপদজনক অবস্থায় দড়ির উপর দিয়ে অতি সাবধানে হেঁটে যাওয়া দেখেই দর্শকরা হতভম্ব হয়। যে দড়ির উপর হেঁটে যাচ্ছে তার জন্যে খানিকটা মায়াও হয়। মেয়েগুলি দড়ির এক প্রান্তে চলে এলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তখন শুরু হয়। আসল খেলা। মেয়ে তিনটি দড়ির উপর দৌড়াতে শুরু করে। লাফালাফি করছে, দৌড়াচ্ছে, হাসছে। সেই সঙ্গে বাজছে তুমুল বাজনা। দর্শকরা হৃদপিণ্ড গলার কাছে নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের টেনশান আর সহ্য হয় না। খেলা শেষ হলে তারা বাঁচে। সার্কাস পার্টির জন্যে এরকম একটা আইটেমই যথেষ্ট। সেখানে স্বাধীন বাংলা সার্কাসের চার পাঁচটা ভালো আইটেম আছে। জাদুকর প্রফেসর মতিন আছে। যে তার সার্টের পকেট থেকে জ্বলন্ত আগুন বের করে সেই আগুনে সিগারেট ধরায়। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ে কান দিয়ে। মুখে সিগারেট টানছে, ভুমভুম করে দুকান দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। ডিম থেকে পাখি বের করে সেই পাখিকে কাঠের বাক্সে রেখে ফু দিতেই পাখি হয়ে যায় খরগোস।

হারুন দর্শকদের পেছনের সারির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। দর্শক সমাগম ভালো। আজ প্রথম শো, অনেকেই পাশ নিয়ে ঢুকেছে, তারপরেও বলতে হবে দর্শক সমাগম ভালো। অনেক মহিলা এসেছে। মহিলা দর্শক আল্লাহর নেয়ামতের মতো। এরা পুরুষদের মতো বাড়িতে গিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকবে না। পাড়া বেড়াতে বের হবে। এর তার সঙ্গে গল্প করবে। যা দেখেছে তার চেয়েও বেশি বলবে। হারুন মহিলা গুনতে শুরু করেছে। আহারে, এক বেচারি কিছুই দেখতে পারছে না। তার বাচ্চাটা বড়ই বিরক্ত করছে। খুন খুন করে কাঁদছে। এটা একদিক দিয়ে ভালো। বাচ্চার মা আবারো আসবে। উপস্থিত থেকেও যে জিনিস দেখা যায় না তার মায়া বড়ই কঠিন মায়া।

পাখির খেলা শুরু হয়েছে। খাঁচায় ছটা টিয়া পাখি নিয়ে পাখিওয়ালা ঢুকেছে। পাখিওয়ালার নাম খসরু। তার চেয়ে রোগা মানুষ বাংলাদেশে দ্বিতীয় কেউ আছে কি-না সন্দেহ। যখন স্টেজে দাঁড়ায় তখন মনে হয় আরবি অক্ষর আলীফ দাঁড়িয়ে আছে। খসরু পাতিলের তলার মতো কালো। মাথার সমস্ত চুল পেকে যাওয়ায় মেন্দি লাগিয়ে সে চুল রঙ করেছে। এখন তার মাথা ভর্তি লাল চুল। লাল এবং কালোর কিস্তুত চেহারা। এটা একদিক দিয়ে ভালো, সার্কাসের লোকজনের চেহারা যত কিম্ভুত হবে তত ভালো।

হারুন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার প্রথমেই মনে হলো খসরুর পোশাকটা ঠিক হয় নাই। সাধারণ শার্ট প্যান্ট পরে ঢুকেছে। প্যান্টটা ময়লা। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। পাখিওয়ালাকে পোশাক কিনে দিতে হবে। সে টিয়াপাখির খেলা দেখায়, তার পোশাক হবে টিয়া পাখির মতো। সবুজ প্যান্ট, সবুজ শার্ট। মাথায় হলুদ টুপি। দূর থেকে দেখে তাকে যেন মনে হয় লম্বা একটা টিয়া পাখি।

দর্শকমণ্ডলী! নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী। আমি পাখিওয়ালা। আমার নাম খসরু। টিয়া খসরু। আমি ছয়টা টিয়া পাখি নিয়ে এসেছি। খাঁচার ভিতরে আছে বলে দূর থেকে আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। দিলাম খাচা খুলে।

খাঁচা খোলা হলো। ছয়টা পাখি নিমিষের মধ্যে খাঁচা থেকে বের হয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল। টিয়া খসরু শূন্য খাচা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যান্ড বাদকের দল কিছুক্ষণ তুমুল বাজনা বাজাল। বাজনা থামার পর খসরু বলল–খাচা খুলে দিলে খাঁচার পাখি উড়ে যায়। আর ফিরে আসে না। দেখি এদের কী অবস্থা! আয় আয়–সবুজ পক্ষী ঘরে আয়।

খসরুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পাখি উড়ে উড়ে এসে খাঁচায় ঢুকতে লাগল। খসরু পাখি গুনছে–এক-দুই-তিন-চার…

দর্শকদের তালি পড়তে শুরু করেছে। তালিরও একটা ব্যাপার আছে। দর্শকদের মধ্যে সার্কাসের নিজস্ব কিছু লোক আছে। বাবুর্চি আছে, বাবুর্চির হেল্পাররা আছে। তাদের কাজ হলো প্রতিটা আইটেমের শেষে তালি শুরু করা। একজন শুরু করলে দশজন শুরু করে। সার্কাস জমে যায়। দৈ জমার জন্যে দৈএর বীজ দিতে হয়। সার্কাস জমার জন্যে দিতে হয় হাততালির বীজ।

টিয়া খসরু আবার কথা বলা শুরু করেছে। তার গলার আওয়াজ ভালো। এত দূর থেকেও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।

দর্শকমণ্ডলী! নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, স্বামীস্ত্রী, লাইলী-মজনু অর্থাৎ প্রেমিক-প্রেমিকা… আপনারা খাওয়া-খাদ্য নিয়া মারামারি দেখেছেন। খাওয়া-খাদ্য নিয়া মানুষ মারামারি করে, জন্তু-জানোয়ার মারামারি করে। এক হাড়ি নিয়া দুই কুত্তার টানাটানি দেখেন নাই? অবশ্যই দেখেছেন। অখন দেখবেন দুই পাখির খাদ্য নিয়া টানাটানির খেলা।

দুটা টিয়া পাখি পাতলা একটা টোস্ট বিসকিটের দুপ্রান্ত ধরে উড়ছে। স্থির হয়ে উড়ছে, আবার চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে উড়ছে। দেখার মতো দৃশ্য। হাততালি শুরু হয়েছে। হাততালির সঙ্গে শিস দেয়ার শব্দ আসছে। একজন মহিলা মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে পাশের আরেক মহিলার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, বুবু দেখছ, কী আচানক!

পাশের মহিলা বলল, এইগুলা কিছু না–ট্রেনিং। ট্রেনিং দিয়া বানাইছে। ট্রেনিং দিলে পশু-পক্ষী পারে না এমন কাম নাই।

হারুন আগ্রহ নিয়ে মহিলাদের কথা শুনছে। কত ধরনের মানুষ কত ধরনের কথা বলে। কেউ কেউ জ্ঞানী, তাদের কাছে কোনো খেলাই ভালো লাগে না। আবার কিছু কিছু লোক আছে যা দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়। এরা মুগ্ধ হবার জন্যেই আসে। এরাই প্রকৃত দর্শক। এদের খেলা দেখিয়ে আরাম আছে। এদের জন্যেই সার্কাস।

ও বুবু দেখ দেখ–কারবার দেখ!

পক্ষী খাওয়া-খাদ্য নিয়া ঝাপ্টা ঝাল্টি করে, এইগুলান কত দেখছি।

হারুন মনে মনে বলল, দূর হারামজাদী, এই জিনিস তুই তোর জন্মে দেখস নাই। তোর ভাগ্য ভালো তুই স্বাধীন বাংলা সার্কাসে ঢুকছস।

টিয়া খসরু এখন শেষ খেলা দেখাচ্ছে। সে হাত সোজা করে রেখেছে। ছটা পাখি তার হাতে বসা। এমনভাবে বসে আছে যেন এরা জীবন্ত পাখি না, এরা পুতুল। খসরু পাখিদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের খেলা দেখে দর্শকরা খুবই মজা পেয়েছেন। ইনাদের সালাম দাও। ডানা তুলে সালাম দাও।

পাখিগুলির প্রত্যেকটি তাদের বাম দিকের ডানা খানিকটা তুলল। একটা ডান দিকেরটা তুলে ফেলেছিল, অন্যদের দেখে ভুল সংশোধন করল। দর্শকরা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।

খসরু বলল, এখন তোমরা ইস্কুলের ছাত্র। পড়া পার নাই। হোমওয়ার্ক কর নাই। মাস্টার শাস্তির হুকুম দিয়েছেন। এক ঠ্যাং-এ দাঁড়ানোর শাস্তি। দেখি এক ঠ্যাং-এ দাঁড়াও।

পাখি ছটাই এক ঠ্যাং-এ দাঁড়াল।

তুমুল তালি পড়ছে। শিস বাজছে। সার্কাস জমে গেছে।

পাখির আইটেম মোটামুটি দুর্বল আইটেম। এই আইটেমেই যখন পার পেয়ে গেছে অন্যগুলো উড়াল দিয়ে যাবে। খসরু ভালো দেখিয়েছে। তাকে সবুজ একটা পোশাক বানিয়ে দিতেই হবে। পপলিনের সবুজ কাপড় পাওয়া গেলে কালই দরজির দোকানে বানাতে দেয়া হবে। হারুন তাঁবু থেকে বের হলো। অজু করে দুরাকাত শোকরানা নামাজ পড়তে হবে। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা কী তার খোঁজ নেয়া দরকার। ভালো কাজ-কর্মের পরে ভালো খাওয়াদাওয়া দরকার। রাতে খিচুড়ি করতে বলা হয়েছিল। চাল-ডাল আর শজির খিচুড়ি। এখন মনে হচ্ছে সঙ্গে মাংস থাকা দরকার। খিচুড়ির সঙ্গে ঝাল গরুর মাংস।

হাতির খোঁজও নেয়া দরকার। হাতি খাওয়া-দাওয়া কি শুরু করেছে?

গোপনে হাত জোড় করে হাতিকে বলতে হবে, ভুল-ত্রুটি কিছু হলে ক্ষমা করে দাও। খাওয়া-দাওয়া কর। তুমি মারা পড়লে, আমি গরিব মানুষ, আমি জানে মারা পড়ব। আমার পুরা দল মারা পড়বে। হারুন মোটামুটি নিশ্চিত হাতি মানুষের কথা বোঝে। এবং সমস্ত পশু-পাখির মধ্যে হাতির অন্তরেই মায়া বেশি।

হারুন নামাজে দাঁড়াবার আগে হাতির ঘরে যাওয়া ঠিক করল।

পর্দা ঘেরা জায়গায় হাতিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাতি শুয়ে আছে। হাতির পাশে জামদানী বসে আছে। সে হাতির গুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যটা হারুনের ভালো লাগল। জামদানী নামের এই মেয়েটার অন্তরেও মহব্বত আছে। মহব্বত ছাড়া কিছু হয় না। সার্কাসের মতো বড় একটা দল এক সঙ্গে রাখতে হলে সবার জন্যে সবার মহব্বত থাকতে হবে। মানুষ মায়া করবে পশুর জন্যে, পশু মায়া করবে মানুষের জন্যে। সবাই বাধা থাকবে মায়ার শিকলে।

হারুন রাগি গলায় বলল, (নকল রাগ। আসমানী, জামদানী, পয়সা–এই তিন মেয়ের উপর সে কখনো রাগ করে না। কিন্তু ভাব দেখায় সারাক্ষণ রেগে আছে।) তুমি এইখানে কী কর? শো টাইমে সবসময় তৈরি থাকতে হয়। তুমি তো খেলার ড্রেসও এখনো পর নাই।

জামদানী কিছু বলল না। চুপ করে রইল।

শো টাইমে নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে। মনে মনে ইয়া মুকাদ্দিমু, ইয়া মুকাদ্দিমু এইটা জপবে। ইয়া মুকাদ্দিমুর অর্থ হলো–হে অগ্রসরকারী। তোমাদের খেলাটা রিস্কের খেলা। এই খেলায় মন স্থির রাখার জন্যে আল্লাখোদার নাম নিতে হয়। হাতির কাছে কী করতেছিলা?

কিছু না।

মেয়েছেলের হাতির ঘরে যাওয়া ঠিক না। তিনটা জায়গা আছে মেয়েছেলের জন্যে নিষিদ্ধ। পানের বরজ, হাতিশালা, আরেকটা জায়গার নাম মনে আসতেছে না। মনে আসলে বলব। নিষিদ্ধ কী জন্যে?

আরে কী যন্ত্রণা! নিষিদ্ধ কী জন্যে আমি জানি নাকি? আমি তো নিষিদ্ধ করি নাই। কথা বাড়াবা না। যাও, ঘরে যাও। দুই মিনিটের মধ্যে খেলার ড্রেসে তোমাকে দেখতে চাই।

জামদানী ক্ষীণ গলায় বলল, হাতিটার কী হয়েছে আমি জানি।

হারুন বিরক্ত গলায় বলল, ফাইজলামি কথা আমার সঙ্গে বলবা না। আমি ফাইজলামি কথা একেবারেই পছন্দ করি না। তুমি হাতির ডাক্তার না। তুমি দড়ি খেলার খেলোয়াড়। তোমার কাজ দড়ির উপরে। হাতির শুড় হাতানী তোমার কাজ না। এই জগতে সব মানুষের আলাদা আলাদা কাজ দেয়া আছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজ ঠিকমতো করবে। তাতে সংসার ঠিকমতো চলবে। বুঝেছ?

জি।

ঠিকমতো বুঝেছ? না এক কান দিয়ে ঢুকায়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দিয়েছ?

ঠিকমতো বুঝেছি।

ঠিকমতো বুঝলে ভালো। আবার বেশি বুঝে ফেলবা না। বেশি বুঝে ফেললে খারাপ। তোমার বড় বোন আসমানী, সে সময় সময় বেশি বুঝে। আমি খবর পেয়েছি সে বাবুর্চিকে গিয়ে বলেছে সে তার তিন বোনের জন্যে আলাদা রান্না করবে। তিনজনের জিনিসপত্র তারে যেন আলাদা করে দিয়ে দেয়া হয়। এইসব কী ফাইজলামি? সার্কাসের দল হলো একটা সংসার। সংসারে দুই-তিন জায়গায় পাক হয় না। এক জায়গায় পাক হয়। বুঝেছ?

জি।

ঠিকমতো বুঝেছ?

জি।

যাও, ঘরে যাও। দুই মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে থাক। দোয়াটা যে। বলেছিলাম মনে আছে?

জি মনে আছে।

বলো দেখি।

জামদানী ভীত গলায় বলল, মনে নাই।

দোয়াটা হলো ইয়া মুকাদ্দিমু। যাও, জপতে জপতে যাও।

জামদানী চলে গেল। হারুন হাতির সামনে বসল। হাতি তাকিয়ে আছে তার দিকে। এত বড় একটা জানোয়ার অথচ কী পুতি পুতি চোখ। অথচ পেঁচার মতো ছোট পাখির কী বিরাট দুই চোখ? হারুন বলল, কীরে ব্যাটা, খাওয়া বন্ধ কী জন্যে? রাগ করেছ? বলেই মনে হলো ভুল হয়েছে। ব্যাটা হবে না। এটা মাদী হাতি। সার্কাসে কখনো মর্দ হাতি রাখা হয় না। সব সময় মাদী হাতি রাখা হয়। মর্দ হাতি সময় সময় মাথা গরম করে, তখন তাদের সামলানো কঠিন। মাদী হাতি কখনো মাথা গরম করে না।

হারুন বসে বসেই এক পা এগুলো। নরম গলায় বলল, তোকে ব্যাটা বলেছি বলে মনে কষ্ট পাস নাই তো? আদর করে ব্যাটা বলেছি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস কী জন্যে? তোর কী হয়েছে বল দেখি। কেউ কিছু বলেছে? তোর যদি স্পেশাল কিছু খেতে ইচ্ছা করে তাহলে বল–ব্যবস্থা করি। তেঁতুল খাবি? এক কেজি তেঁতুল এনে দেই। হারুন ভয়ে ভয়ে হাত বাড়াল। সে সার্কাস দলের মালিক। জন্তু-জানোয়ার নিয়েই তার কাজ। তারপরেও সে খুবই ভীতু ধরনের মানুষ। হাতির দিকে হাত বাড়াতে তার ভয় ভয় লাগছে।

হাতির গায়ে হাত লাগার আগেই হাতি শব্দ করে নড়ে উঠল। হারুন লাফ দিয়ে সরে গেল। সাহস দেখানোর কোনো দরকার নেই।

হারুন শোকরানা নামাজ অতি দ্রুত শেষ করল। তিন মেয়ের দড়ির খেলার সময় সে উপস্থিত থাকবে। আজ পর্যন্ত এমন কোনো দিন যায় নি যে তিন মেয়ে দড়ির খেলা দেখাচ্ছে আর সে সেখানে উপস্থিত নেই। মেয়ে তিনটাকে সে নিজে খেলা শিখিয়েছে। প্রথম যখন তিনবোন এলো তখন ছোটটার বয়স তিন বছর। তিনজনের একজনকে রাগ করে ধমক দিলে তিনজন মিলে একসঙ্গে কান্নাকাটি শুরু করে দিত। দেখে রাগও লাগত, আবার মায়াও লাগত। একজনের জ্বর হয়েছে কিছু খাবে না, বাকি দুজনও খাবে না। একজনকে নতুন কাপড় কিনে দিলে সে পরবে না। তিনজনকেই কাপড় কিনে দিতে হবে। মেয়েগুলিকে নিয়ে হারুনকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কষ্ট বৃথা যায় নাই। মানুষের কোনো কষ্টই বৃথা যায় না।

সার্কাসের দল টিকিয়ে রাখতে হবে মেয়ে তিনটার জন্যে। দল ভেঙে দিলে মেয়ে তিনটা যাবে কোথায়? এই তিন কন্যার যাবার জায়গা নেই।

 

রাত এগারোটা। হারুন সরকারের ঘরের দরজা বন্ধ। ঘরের ভেতর সে আছে আর আছে বাবুর্চির এসিসট্যান্ট কালু। হারুন সরকার পা ছড়িয়ে বসেছে। কালু পা টিপে দিচ্ছে। খুব আয়োজন করে পা টিপা হচ্ছে। একটা বাটিতে সরিষার তেল নেয়া হয়েছে। আরেকটা বাটিতে পানি। প্রথমে সরিষার তেল দিয়ে ডলা দেয়া হচ্ছে। সেখানেই পানি দিয়ে আবারো ডলা হচ্ছে।

হারুন সরকারের পায়ে সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে হাড়ির ভেতর যন্ত্রণা হয়। ভোতা ধরনের ব্যথা। কোনো কোনো দিন ভোতা ব্যথাটা শেষপর্যন্ত ভোতাই থাকে। কিন্তু মাঝে মধ্যে ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠে। আজ ব্যথা এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে, তবে তা তীব্র ব্যথায় মোড় নিতে পারে। হারুন সরকার ভীত ভঙ্গিতে বসে আছে। ব্যথার গতি বোঝার চেষ্টা করছে। কালুর হাতের কাছে দড়ি আছে। ব্যথা তীব্র হয়ে গেলে দড়ি দিয়ে শক্ত করে পা পেঁচিয়ে বাঁধতে হবে। হারুনের হাতে কালার গ্লাস। গ্লাসে কেরু কোম্পানির জিন। কাসার গ্লাসে কেরু কোম্পানির জিন খাওয়া হারুন শিখেছে তার ওস্তাদ মনু মিয়ার কাছে। মনু মিয়া জিনের সঙ্গে এক দুই বিচি তেঁতুল দিয়ে দিত। জিনিসটা হতো ভয়ঙ্কর। আজ তেঁতুল পাওয়া যায় নি। তেঁতুল ছাড়া জিন খেতে পানশা পানশা লাগছে। নেশা হবে বলে মনে হচ্ছে না। নেশা না হলে সমস্যা আছে। পায়ের ব্যথা সহ্য করা যাবে না।

কালু।

জি।

আজকের শো কেমন হয়েছে?

ফাটাফাটি হইছে। যারা দেখছে মরনের আগের দিনও তারার মনে থাকব।

আইটেম ভালো হয়েছে কোনটা?

সব আইটেম মারাত্মক হইছে। এ বলে আমারে দেখ, সে বলে আমারে দেখ।

তারপরেও তো উনিশ-বিশ আছে।

কালু গম্ভীর গলায় বলল, সবই বিশ। উনিশের কারবার আমরা করি না।

হারুনের মন এমনিতেই ভালো ছিল, কালুর কথায় মন আরো ভালো হলো। হারুনের কেন জানি মনে হচ্ছে ব্যথাটা আজ খারাপের দিকে যাবে না। পায়ে দড়ি বাঁধার প্রয়োজন পড়বে না।

খেলা খুব জমেছিল?

কালু গম্ভীর গলায় বলল, মারাত্মক। বিলাতি সাহেবের চউক উঠে গেছিল মাথার চান্দিতে।

হারুন আগ্রহ নিয়ে বলল, বিলাতি সাহেব ছিল না কি?

ছিল, দুইটা ছিল। ব্রিজ বানাইতেছে তার ইনজিনিয়ার। এর মধ্যে একজন বাংলা কথা পরিষ্কার বলতে পারে। সে আইসা হামকি ধামকি।

হামাকি ধামকি কী জন্যে?

বলে কী, দড়ির ডেনজারাস খেলা দেখাও? প্রটেকশন নাই। নিচে কেউ নাই। একসিডেন্ট হবে। মানুষ মারা যাবে। আমি মনে মনে বলি–যা ব্যাটা লালমুখা। মানুষ মারা গেলে আমরার যাবে। তোর বাপের কী?

আমি তো কিছু জানি না। এই ঘটনা কখন ঘটল?

শো শেষ হওনের পরে। ম্যানেজার সাহেবের সাথে কথা বলেছে। তোমরা শো করতে পারবে না। স্টপ। এইসব হাবিজাবি বলতে ছিল।

কই আমাকে তো ম্যানেজার কিছু বলল না।

সব কথা আপনের কানে তোলা হয় না। ম্যানেজার পেটের মধ্যে রেখে দেয়। পেট থেকে বাইর কইরা দুএকটা কথা বলে, বাকিগুলা ভাত-তরকারির সাথে হজম কইরা ফেলে।

তাই না-কি?

অবশ্যই। আমরার ম্যানেজারের পেট শক্ত। পেটে যেই জিনিস যায় সেইটাই হজম। আলীশান একটা খবর ম্যানেজারের কাছে আছে। ম্যানেজার আপনেরে দেয় নাই। দিব কি দিব না, তার নাই ঠিক।

কী খবর?

কালু চুপ করে গভীর মনোনিবেশে পা টিপছে। আলীশান খবর হুট করে বলে ফেললে খবরের মান থাকে না। হারুন বিরক্ত হয়ে বলল, খবরটা কী?

বগা চাচার ইন্তেকাল হয়েছে!

বগা চাচাটা কে?

জহির উদ্দিন সাবেরে সবেই ডাকে বগা চাচা। পাতলা পুতলা শইল, এই কারণে।

জহির উদ্দিনটা কে? ঠিক মতো জবাব দে। কথা পেঁচাইস না। কথা পেঁচাইলে লাথ দিয়া বিছনা থাইক্যা ফালায়ে দিব।

কালু আহত গলায় বলল, জহির উদ্দিন সাব হাতির মালিক। তারে আপনে নামে চিনবেন না সেইটা ক্যামনে বুঝব। লাথ মাইরা ফেলতে চাইলে ফেলেন। আমরা গরীব। আমরার জন্ম হইছে লাথ খাওনের জন্যে।

চুপচাপ তেল মালিশ কর। কথা বন্ধ।

কালু পায়ে তেল মালিশ করে যাচ্ছে। হারুন এমন ভঙ্গিতে বসে আছে যেন সে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। চারপাশে কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। জহির উদ্দিন মারা গেছে এরচে আনন্দের সংবাদ আর কী হতে পারে। লটারিতে লাখ টাকা পাওয়ার আনন্দের মতো আনন্দ। হাতির মালিক মারা গেছে। হাতি এখন আর কাউকে ফেরত দিতে হবে না। পাওনা টাকাও দিতে হবে না। স্বাধীন বাংলা সার্কাস পার্টি এখন একটা হাতির মালিক।

কালু বলল, হাতির মালিক তো স্যার এখন আমরা।

হারুন বলল, আমরা হাতির মালিক হব কী জন্যে? জহির উদ্দিন সাবের ওয়ারিশানরা হাতির মালিক। কোর্টের কাগজপত্র নিয়া ওয়ারিশান আসলে হাতি ফিরত দিব।

ম্যানেজার সাব ভিন্ন কথা বলেছে।

কী ভিন্ন কথা?

ম্যানেজার সাব বলেছেন হাতি খরিদের বায়না দলিল গত মাসে করা হয়েছে। জাহির উদ্দিন সাব মাসে মাসে টেকা উসল হবে এই কড়ারে হাতি বেচে দিয়েছেন।

হারুন অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, চিন্তাভাবনার মধ্যে থাকি। পায়ে যন্ত্রণা। এইসব কারণে আসল কথা মনে থাকে না। হাতি যে আমরা খরিদ করে নিয়েছি এই কথাটা ভুলে গেছি। খরিদ অবশ্যই করেছি। কাগজপত্র ম্যানেজারের কাছে আছে। টাকা-পয়সাও যতদূর মনে হয় দেওয়া হয়ে গেছে। দেখি ম্যানেজারকে জিজ্ঞাস করি। অল্প কিছু যদি বাকি থাকে দিয়ে দেওয়া দরকার। ঋণ রাখা আমার পছন্দ না। ঠিক আছে তুমি যাও। আজ মনে হয় ব্যথা উঠবে না। ম্যানেজাররে পাঠাও! আমার গ্লাস খালি। গ্লাসে জিনিস দিয়ে যাও। তেঁতুলের জোগাড় দেখবা। এই জিনিস যদি আমারে তেঁতুল ছাড়া খাইতে হয় তাইলে তোমার খবর আছে। কানে ধইরা তাঁবুর চাইর দিকে তোমারে চক্কর দেওয়াব। বুঝেছ?

জি বুঝেছি।

ম্যানেজাররে পাঠাও। পা ছেছড়াইতে ছেছড়াইতে যাবা না। বন্দুকের গুলির মতো যাও।

কালু বিষণ্ণ মুখে বের হয়ে গেল। হারুন তেঁতুল বিহীন জিনের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বুঝল তার নেশা হয়েছে। জিনের নেশা হুট করে উঠে, তাই হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে তার যে জগৎ ছিল এখন সে জগৎ নাই। এখনকার জগৎ আন্দময় জগৎ। হঠাৎ হাতির মালিকানা পেয়ে যাওয়া একটা কারণ হতে পারে।

তৈয়ব এসে বলল, আমারে ডেকেছেন?

হারুন বিরক্ত গলায় বলল, না ডাকলে তুমি আস না? তুমি নবাব সিরাজউদ্দৌলা হয়েছ?

তৈয়ব মেঝেতে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখল। হারুন গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, জহির সাব ইন্তেকাল করেছেন–এই খবর কবে পেয়েছ?

গতকাল।

গতকাল খবর পেয়েছ, আমাকে দেও নাই কেন? না-কি ভুলে গেলা স্বাধীন বাংলা সার্কাসের মালিক আসলে কে? তুমি তো ভেবে বসে আছ তুমিই মালিক। মনে রাখবা তুমি দুই পয়সা দামের ম্যানেজার। এক মিনিটের নোটিশে পাছায় লাথি মেরে তোমারে রাস্তায় ফেলে দিতে পারি। পারি কি-না বলো।

জে পারেন।

এখন বলো এত বড় একটা সংবাদ লুকায়ে রেখেছ কেন?

তৈয়ব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। হারুন কড়া গলায় বলল, ফোস ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়বা না। বলো, কী ব্যাপার?

তৈয়ব শান্ত গলায় বলল, উনার মৃত্যুসংবাদ প্রচার করার আগে হাতিটা যে আমরা আগেই খরিদ করেছি এইটা প্রচার করা দরকার। তা না হলে সবেই ভাববে হাতির মালিক মারা গেছে আর আমরা হাতি মেরে দিয়েছি।

হারুন কিছু না বলে পরপর কয়েক দফা জিনের গ্লাসে চুমুক দিল। ম্যানেজারের প্রতি এই মুহূর্তে অত্যন্ত প্রসন্ন বোধ করছে হারুন। প্রসন্ন ভাবটা সে গোপন রাখবে কী রাখবে না বুঝতে পারছে না। বড় একটা দল চালাতে হলে অনেক কিছু ভাবতে হয়। বড় দল চালানোর কিছু কঠিন নিয়মকানুন আছে। একটা প্রধান নিয়ম হলো দলের কারো উপর খুশি হলে খুশি ভাব গোপন রাখতে হবে। যার উপর খুশি তাকে তা কখনো জানানো যাবে না।

তৈয়ব বলল, আমি যাই।

হারুন বলল, ঘটনা তো কিছুই শুনলাম না, যাই যাই করছ কেন?

হাতির অবস্থা ভালো না। পশু ডাক্তারের সন্ধানে যাব। সদরে একজন ভেটেনারি সার্জন আছে। তাকে নিয়ে আসব।

আচ্ছা যাও। একটা জিনিস শুধু খেয়াল রাখবা, আমি তোমার উপর বেজার। যে-কোনো সময় লাথি দিয়ে তোমাকে দল থেকে বের করে দিব। আমার এখানে কারো চাকরিই পার্মানেন্ট না। আমি যে কাউকে এক সেকেন্ডের নোটিশে দল থেকে বের করে দিতে পারি। নিজেকেও পারি। আমিই সার্কাস দলের মালিক। আমিই নিজেকে দল থেকে বের করে দিলাম। ভালো না?

জি ভালো।

জামদানী মেয়েটাকে আমার কাছে পাঠাও। হাতির বিষয়ে সে কী যেন কথা বলেছিল, কথাটা শুনি।

ওরা ঘুমায়ে পড়েছে।

ঘুম থেকে ডেকে তুলে পাঠাও। দেশের যেমন বাদশা থাকে–সার্কাস দলেরও বাদশা থাকে। বাদশার হুকুম শুনতে হয়।

তৈয়ব বের হয়ে গেল। হারুন মাথায় ছোট্ট একটা চক্কর অনুভব করল। নেশা জমে গেছে। শরীর হালকা লাগছে। মনে ফুর্তির ভাব প্রবল হচ্ছে। এই সময়টা খারাপ। এখন যদি দুঃখের কোনো কথা মনে পড়ে তাহলে ফুর্তির বদলে মন ভরে যাবে দুঃখে। তখন টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকবে। নেশা খুব খারাপ জিনিস। শুরু হলো আনন্দের জন্যে, শেষ হলো দুঃখে। ভেউ ভেউ কান্না। চোখের পানি নাকের সর্দিতে মাখামাখি। সর্বশেষ ঘর ভাসিয়ে বমি। বমির উপর শুয়ে থাকা।

জামদানী ঘরে ঢুকল। সে কিছু বলার আগেই হারুন আনন্দিত গলায় বলল–কী খবর কী খবর কী খবর?

নেশা ভালোমতো ধরেছে। নেশার নিয়ম হলো ভালোমতো ধরলে সব বাক্য তিনবার চারবার করে বলা হয়। তারপরেও মনে হয় ঠিকমতো বলা হলো না। কিছু যেন বাকি থেকে গেল।

জামদানী বলল, কী জন্যে ডেকেছেন?

হারুন বলল, খুব জরুরি একটা কাজে ডেকেছি। জরুরি কাজটা কী ভুলে গেছি। দাঁড়ায়ে আছে কেন, বসো।

জামদানী বসল। হারুন আগ্রহ নিয়ে বলল, নেশা করলে কী হয় জানো? অল্প নেশা করলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে। নেশা একটু বেশি হয়ে গেলে স্মৃতিশক্তি ধুপ করে পড়ে যায়। আমারটা ধুপ করে পড়ে গেছে। ও আচ্ছা! মনে পড়েছে–তুমি বলেছিলে হাতির কী অসুখ হয়েছে তুমি জানো। সাপের অসুখের বিষয়ে যে জানে তাকে বলে সর্পরাজ। তোমার টাইটেল দিলাম হস্তিরানী। হা হা হা।

হারুন হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থায় চলে গেল। হাসি থেকে তার হেঁচকি উঠে গেল। হেঁচকির ফাঁকে ফাঁকে বলল, বলো দেখি হস্তিরানী, আমার হাতির অসুখটা কী?

জামদানী শান্ত গলায় বলল, হাতিটার সন্তান হবে, প্রসব ব্যথা উঠেছে।

হারুন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কী বললা?

জামদানী বলল, হাতিটার সন্তান হবে।

হারুন বলল, উল্টা পাল্টা কথা বলে তুমি আমার নেশা কাটায়ে দিয়েছ। অনেক কষ্টের নেশা, তৈরি করতে সময় লাগে। যাও, ঘুমাতে যাও। একটা কথা মনে আসল আর বলে ফেললা–এটা ঠিক না। তুমি হাতির লেডি ডাক্তার না। যাও আমার সামনে থেকে।

 

হারুন অনেকদিন পর মনের আনন্দে নেশা করল। জিনের পুরো বোতল শেষ করার পর লুকিয়ে রাখা ভদকার একটা বোতল বের করা হলো। একা একা মদ্যপান করা যায় না। এখন হারুনের সঙ্গী কালু। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কালুকে হারুনের বন্ধুর মতো লাগছে। সে যে বাবুর্চির অ্যাসিসটেন্ট, তার প্রধান কাজ চুলায় লাকড়ি দেয়া, খড়ি ফাড়া–এটা আর মনে হচ্ছে না। বরং হারুনের মনে হচ্ছে কালু যথেষ্ট জ্ঞানী একজন মানুষ। তার সঙ্গে সুখ দুঃখের কথা যেমন আলাপ করা যায় তেমনি জটিল সমস্যার সমাধানও চাওয়া যায়। হারুন কালুর পিঠে হাত রেখে বলল, জহির সাহেবের মৃত্যুতে বড় কষ্ট পেয়েছি। কালু বলল, কষ্ট পাওয়ার কথা। কতদিনের পুরনো চিনা জানা লোক।

হারুন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউ নাই, একটা লোক ফুট করে মরে গেল।

কালু বলল, এটা খারাপ না। দুঃখ করার কেউ নাই।

হারুন বলল, দুঃখ করার একেবারে কেউ না থাকাটাও ঠিক না। এক দুইজন থাকবে, মৃত্যুর পরে ভেউ ভেউ করে কাঁদবে।

কালু বলল, অবশ্যই।

হারুন বলল, আমারও তো জহির সাবের মতোই অবস্থা। তারও কেউ ছিল না। আমারও কেউ নাই। সেও ছিল হাতির মালিক। আমিও হাতির মালিক। এখন ইচ্ছা করতেছে ঘর-সংসার করি। বয়সটা হয়ে গেছে সমস্যা পাঁচপঞ্চাশ।

কালু বলল, পাঁচপঞ্চাশ কোনো বয়সই না।

হারুন বলল, জামদানীর মতো একটা মেয়ে পাওয়া গেলে ভালো হতো। খুবই ভালো একটা মেয়ে। মাথায় সামান্য গণ্ডগোল আছে। এটা থাকবেই। সব ভালো মানুষের মাথায় সামান্য গণ্ডগোল থাকে।

কালু বলল, অতি সত্য কথা। একমাত্র আপনাকে দেখলাম–অতি ভালোমানুষ কিন্তু মাথা পরিষ্কার। মাথায় কোনো গণ্ডগোল নাই।

মাথায় গণ্ডগোল নাই তোমাকে কে বলল! গণ্ডগোল অবশ্যই আছে। গণ্ডগোল না থাকলে নিজের মেয়ের মতো যাকে বড় করেছি তাকে বিয়ে করতে চাই। ছিঃ ছিঃ, ভাবতেও লজ্জা।

কালু বলল, আরেক গ্লাস খান, তাহলে লজ্জাটা কমে যাবে।

দাও, আরেক গ্লাস। আজ বমি না হওয়া পর্যন্ত খাব। যা থাকে কপালে।

হারুন তার কথা রাখল, বমি করে ঘর ভাসিয়ে না দেয়া পর্যন্ত ক্রমাগত খেয়ে গেল। রাত তিনটায় সে এবং কালু যখন নিজেদের বমির উপর অর্ধচেতন হয়ে পড়ে আছে তখন খবর এলো–হাতির একটা মেয়ে বাচ্চা হয়েছে। হারুন খবরটার গুরুত্ব কিছুই বুঝল না। মাথা তুলে খবরটা শুনে আবারো বমির উপর শুয়ে পড়ল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ