ভাইয়া মারা গেল উনিশ দিনের দিন। সে কমায় চলে গিয়েছিল, শেষের পাঁচদিন আশে পাশের জগৎ সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। মৃত্যুর আগে আগে পূর্ণ জ্ঞান ফিরে পেল। দুলু আপাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল–আরে দুলু তুমি! তুমি এখানে কি করছ?

দুলু আপা সবাইকে অগ্রাহ্য করে কাছে এগিয়ে গেলেন। ভাইয়ার হাত ধরে বিছানার কাছে বসলেন। ভাইয়া অস্বস্তি এবং লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেল। সে তাকাতে লাগল আমাদের দিকে। একটু চেষ্টাও করল হাত ছাড়িয়ে নিতে। তার কিছুক্ষণ পর ভাইয়ার মৃত্যু হল। আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বারান্দায় সানগ্লাস পরা ছেলেটি একা একা দাঁড়িয়ে। তার চোখে আজ সানগ্লাস নেই। সে কাদছে। ময়লা রুমালে ক্রমাগত চোখ মুছছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ আমার ভাই–ফানি ম্যান আজ মারা গেছে। সে তো কাঁদবেই। সে একা কেন সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে আজ চিৎকার করে কাঁদতে হবে। শুধু আমি কাঁদব না। আমি কিছুতেই কাঁদব না। আমি রাস্তায় রাস্তায় সুখী মেয়ের মত ঘুরে বেড়াব।

ভাইয়ার ঘর থেকে বের হয়েই দেখি বারান্দায় রেলিং ধরে আভা দাঁড়িয়ে আছে। আপা তাকে খবর দিয়ে এনেছে। সে ঘরে ঢুকে নি। দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। আমাকে দেখে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি বললাম, আমার ভাইয়া ফানি ম্যান রঞ্জু মারা গেছে।

আভা কিছুই বলল না। ঘরে ঢুকল না বা উঁকি দিয়ে দেখল না–ক্লান্ত পায়ে হাসপাতালের লম্বা করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। আভার গায়ে আকাশী রঙের শাড়ি। এই শাড়ি সে ইচ্ছা করেই পরে এসেছে। ফানি ম্যান রঞ্জুর নীল শাড়ি খুব পছন্দ। কে জানে কোন এক উপলক্ষে এই নীল শাড়ি হয়ত সেই আভাকে কিনে দিয়েছে।

এই পৃথিবী পরম রহস্যময়। হাসপাতাল থেকে রাস্তায় নামমাত্র আমি যে মানুষটিকে এতদিন ধরে খুঁজছি তার দেখা পেলাম। তিনি প্রথম দিনের মত রিকশা করে ফিরছেন। হাতে বাজারের ব্যাগ। আমি ছুটে গিয়ে বললাম, কেমন আছেন?

তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, চিনতে পারছি না তো, কে?

চিনতে পারছেন না?

না। কে তুমি?

ওগেনকি দেসু কা?

ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, এর মানে?

আমি শান্তগলায় বললাম, এটা জাপানী ভাষা আপনি বুঝবেন না।

ভদ্রলোক রিকশা থামিয়েছেন। আমি এগিয়ে যাচ্ছি। প্রতি মুহূর্তেই অপেক্ষা করছি তিনি পেছন থেকে কোমল গলায় ডেকে উঠবেন–রেনু। এই রেনু। আর আমি তাকে কাঁদতে কাঁদতে বলব, জানেন এই কিছুক্ষণ আগে আমার ভাই মারা গেছে। ওর নাম রঞ্জু। ফানি ম্যান রঞ্জু।

আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। সন্ধ্যা হতে বেশী বাকি নেই। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের সমস্ত হলুদ বাতি জ্বলে উঠবে। কুৎসিত নোংরা শহরটাকে মনে হবে সোনালী শহর।

——–

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ