বাসা ছেড়ে দেয়ার জন্যে যে একমাস সময় দেয়া হয়েছিল সেই একমাস সাতদিন আগে পার হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে কেউ কিছু বলছে না। সুলায়মান চাচার তিন মেয়ে এবং তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে আমাদের বেশ কবার দেখা হয়েছে। তাঁরা আমাদের কিছু বলেন নি। সবাই এমন ভাব করেছেন যেন আমাদের দেখতে পান নি। কোন বিচিত্র কারণে আমরা অদৃশ্য হয়ে আছি। সামনে থাকলেও আমাদের দেখা যায় না। রহস্যটা কি আমরা বুঝতে পারছি না। তবে সবাই এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগছি। না সবাই না। ভাইয়া কোন কিছুতে ভুগছে না। সে তার জাপানী ভাষা নিয়ে ব্যস্ত। তার জাপানী ভাষার ফাইনাল পরীক্ষা। পাশ করলে সার্টিফিকেট পাবে। তার ধারণা একজন পাশ করলেও সে পাশ করবে। সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে এখন সে জাপানী পড়ছে।

খাবার টেবিলেও জাপানী ভাষা ছাড়া অন্য কোন কথা বলছে না।

বুঝলি খুকী, আমরা যেমন এক দুই করে জিনিস গুনি জাপানীরা তাই করে। তবে একেক রকম জিনিসের জন্যে একেক ধরনের এক দুই ব্যবহার করে। জাতি হিসেবে এরা খুব পাগলা।

তোমার কথা কিছুই বুঝলাম না।

সমতল জিনিস, যেমন–রুমাল, তক্তা এইসব গোনার জন্যে তাদের এক রকম সংখ্যা। এক হল ইচিমাই, দুই হল নিমাই, তিন হল সালমাই। আবার জন্তু এবং মাছ গোনার জন্য অন্য রকম সংখ্যা। এক হল ইপপিকি, দুই হল নিহিকি, তিন হল সানবিকি। লম্বা জিনিস যেমন–কলম, কলা, ছাতা এগুলি গোনার জন্য অন্য রকম সংখ্যা। এক হল ইপপেন, দুই হল নিহোন, তিন হল সানবোন।

পাগল নাকি?

অফকোর্স পাগল। ওরা যখন শুনে আমরা সব কিছু গোনার জন্যে এক দুই ব্যবহার করি এখন ওরাও চোখ কপালে তুলে বলে–পাগল নাকি হা-হা-হা।

মা এবং আপা কেউই ভাইয়ার এই সব আলাপে অংশ গ্রহণ করে না। আপা মাঝে মধ্যে কিছু বললেও মা কখনো বলেন না। ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। ভাইয়া বেশ কবার মিটমাটের চেষ্টা করেছে, লাভ হয়নি। মা আরো ঠাণ্ডা হয়ে গেছেন। বলা যেতে পারে বাসার পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক।

আপার টিচার তার দুই বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন। অনেকক্ষণ গল্প-টল্প করলেন। চা খেলেন। ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য প্রশ্ন করলেন। উত্তর যা পেলেন তার কোনটিই তাদের পছন্দ হল না। কিছু কিছু উত্তর শুনে রীতিমত ভুভুকে গেলেন। প্রশ্নের উত্তর বেশীর ভাগই দিল ভাইয়া। সে না দিয়ে যদি আমি দিতাম তাহলে হয়ত বা কিছুটা সামলে দিতাম। ভাইয়া সে সুযোগ দিল না। প্রশ্ন-উত্তরগুলি এরকম?

স্যার : এই বাড়ি কি আপনাদের নিজের?

ভাইয়া : পাগল হয়েছেন। ভাড়া বাড়ি। তাও অনেকদিন ভাড়া দেয়া হচ্ছে না। যে কোন মুহূর্তে বের করে দেবে।

স্যার : গ্রামের বাড়িতে নিশ্চয়ই জমিজমা আছে?

ভাইয়া : কিছুই নেই। সামান্য ছিল, বাবা তা বিক্রি করে ক্যাশ টাকা করেছিলেন ব্যবসার জন্যে। পাটের ব্যবসায় লাগানো হয়েছিল–লাভ হয়নি। আমও গেছে ছালাও গেছে।

স্যার : আপনার বাবা ব্যবসা করেন?

ভাইয়া : বাবা যা করেন তাকে ব্যবসা বলা ঠিক হবে না। তাতে ব্যবসা শব্দটার অমর্যাদা হবে। বাবাকে ভদ্র ফেরিওয়ালা বলতে পারেন। তিনি এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় আনেন।

স্যার : ইনি কি আছেন বাসায়?

ভাইয়া : না, উনি যে কোথায় আছেন আমরা জানি না! চার মাস ধরে বাড়ির সঙ্গে কোন যোগ নেই।

স্যার : (পুরোপুরি ঘাবড়ে গিয়ে) কেন?

ভাইয়া : বুঝতে পারছি না। সম্ভবত আমাদের পছন্দ করেন না।

এজাতীয় বাক্যালাপের পর বিয়ের কথা একশ হাত পানির নীচে চলে যাওয়ার কথা। গোলও তাই। ভদ্রলোক শুকনো মুখে চলে গেলেন।

আপা বলল, আবার আসবে। এক সপ্তাহের মধ্যে অসবে। কোন জায়গায় কিছু ঠিক করতে না পেরে আসবে।

ঠিক করতে পারবে না কেন?

চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝিস না কেন? ঘোড়ার মত মুখ। এই চিজকে কে শখ করে বিয়ে করবে? আমার কাছে আবার আসা ছাড়া গতি নেই। আবার আসবে। শেষ মুহূর্তে আসবে।

যদি আসে তুমি রাজি হবে?

জানিনা, হয়ত হব। এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না। পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। ঘোড়া টাইপ একটা ছেলেকে বিয়ে না করলে পালানো যাবে না।

তুমি এমন হয়ে যাচ্ছ কেন?

আপা সরু চোখে তাকাল।

সে আরো সুন্দর হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই সুন্দর হচ্ছে। এটাও আমাদের জন্যে ভয়ের কথা। সুন্দরী মেয়েদের সমস্যার অন্ত নেই। বাসার সামনে আজে বাজে ধরণের কিছু ছেলে এখন জটলা পায়। এর মধ্যে একজনকে দেখলে ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে মোটর সাইকেলে চড়ে আসে। মাথা ভর্তি বাড়ি চুল। চোখ সানগ্লাসে ঢাকা। সে একা আসে না। তার কোমর জড়িয়ে ধরে আরেকজন বসে থাকে। সেই জন রোগী টি টিঙে। সম্ভবত চামচা টাইপের কেউ। চোখে সানগ্লাসওয়ালা মোটর সাইকেল থেকে নেমে পা ফাঁক করে পঁড়ায়। চামচাটা পান এনে দেয় সিগারেট এনে দেয়। পাশে দাঁড়িয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসে।

আমাদের বাসটাই যে এদের লক্ষ্য তা অত্যন্ত পরিস্কার। কারণ এরা তাকিয়ে থাকে আমাদের বাসার দিকে। কোন কোন দিন দুটা মোটর সাইকেলে করে চারজন এসে উপস্থিত হয়। এরা কখনো বসে না। পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকে। সম্ভবত দাঁড়িয়ে থাকাটাই স্টাইল। এক বিকেলে সানগ্লাসওয়ালা আমাদের বাসার কড়া নাড়ল। আমি দরজা খুললাম। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে বললাম, কি চান?

সানগ্লাসওয়ালা বলল, আগুন দরকার। দেয়াশলাই আছে?

আমি দেয়াশলাই এনে দিলাম। সে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মীরা কি বাসায়?

হ্যাঁ বাসায়, কেন?

না এম্নি জিজ্ঞেস করলাম।

সে লম্বা লম্বা পা ফেলে মোটর সাইকেলের দিকে রওনা হল। আমি বললাম, দিয়াশলাই দিয়ে যান।

ও সরি, ক্যাচ ধরতো।

বলে দূর থেকে দেয়াশলাই ছুড়ে দিল। তার সঙ্গীরা হেসে উঠল। আমি কঠিন মুখ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এর বেশী আমার আর কি বা করার আছে। আমাদের পাশের বাড়ির ভাড়াটের স্ত্রী একদিন এসে কথায় কথায় আমার মাকে বললেন–আপা বড় মেয়েটাকে আপনি তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিন।

মা বললেন, কেন?

সবাই কি সব বলাবলি করে, শুনে ভয় লাগে শেষটায় যদি কোন কেলেংকারী হয়।

কি বলাবলি করে?

গুণ্ডা টাইপের ছেলে রোজ আসে। এদের বিশ্বাস নেই। ধরুন খালি বাসায় এরা যদি কোন দিন এসে মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তখন কি করবেন? এরকমতো হচ্ছে আজকাল। খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়–অপহরণ, ধর্ষন। আপা, আপনি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করুন কিংবা দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিন।

এ জাতীয় কথায় আতংকগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক। আমরা আতংকগ্রস্ত হই। কিন্তু ভাইয়া নির্বিকার। সে হাসতে হাসতে বলল, যারা ঘন্টার পর ঘণ্টা পা ফাক করে দাঁড়িয়ে থাকে তাদেরকে ভয়ের কিছু নেই। এরা হামলেস ভেজিটেবল। কাজকর্ম নেই বলে দাঁড়িয়ে থাকে।

আমি ভাইয়াকে বললাম, তুমি তাদের কিছুই বলবে না?

কিছু বললে ওদের গুরুত্ব দেয়া হবে। এরা এটাই চাচ্ছে। কিছু না বলাই ভাল।

ওদের কাণ্ডকারখানা আমার কিন্তু ভাল লাগছে না। ওরা কোন একটা মতলব করছে।

মানুষের বাড়ির সামনে পা মেলে দাঁড়িয়ে কেউ মতলব করে না। তুই খামাখা চিন্তা করিস নাতো। চিন্তা করে কখনো কোন সমস্যার সমাধান হয় না।

অতি তুচ্ছ সব সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার কোন মানে হয় না। আমাদের সামনে বিশাল সমস্যা।

বিশাল সমস্যাটা কি?

যথাসময়ে জানতে পারবি।

এখনি বল।

ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাচ্ছি। ছোট খাট সব লক্ষণ আমার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে। রাস্তায় নামলেই পরিচিত লোকজনদের দেখি–যারা আসলে ত্রিসীমানায় নেই। যেমন গতকাল রেসকোর্সের পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি–পাবলিক লাইব্রেরীর দিকে, কি মনে করে ডান দিকে তাকালাম, দেখি সুলায়মান চাচা। রেসকোর্সের ভেতর একটা গাছের নীচে বসে আছেন।

কি বলছ তুমি?

হ্যাঁ তাই। বসে বসে বাদাম খাচ্ছেন। আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন। প্রচণ্ড একটা শক খেলাম–ছুটে গেলাম, দেখি সুলায়মান চাচা না।

অন্য একজন।

এটাতো ভাইয়া এমন কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার না।

একবার ঘটলে অস্বাভাবিক না। বার বার ঘটলেই অস্বাভাবিক। আমি আভাকে দেখেছি তিনবার। অথচ কোন বারই আভা ছিল না। ছিল অন্য মহিলা। একবার দেখলাম আভা রিকশা করে যাচ্ছে–আমাকে দেখে ডাকল–এ্যাই এ্যাই। আমি রাস্তার ওপাশে ছিলাম, দৌড়ে পার হলাম–আরেকটু হলে একটা টেম্পোর নীচে পড়তাম। যাই হোক রাস্তা পার হয়ে দেখি অন্য মেয়ে। তারপর বাবার কথা ধর–বাবাকেতো প্রায়ই দেখি।

আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। সে সহজ গলায় বলল, নানান ঝামেলা এবং যন্ত্রণায় ব্রেইন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পাগলের সঙ্গে সব সময় ঘোরাঘুরি করি–সেটাও একটা ব্যাপার।

এখনও পাগলের সঙ্গে ঘোরাঘুরি কর?

হুঁ। করি। মানুষ হিসেবে এর অসাধারণ। অতি ভদ্র। আমি ওদের সঙ্গে জাপানী ভাষায় কথা বলি। ওরা এমন ভাব করে যেন কথা বুঝতে পারছে। কিছু কিছু আবার বুঝতেও পারে।

ভাইয়া চুপ করতো?

আচ্ছা যা চুপ করলাম।

চা খাবে? চা বানিয়ে আনব?

নিয়ে আয়।

আজ তুমি বেরুবে না?

না। শরীরটা ভাল লাগছে না।

চা এনে দেখি ভাইয়া চাদর গায়ে ঘুমুচ্ছে। তার গায়ে জ্বর। বেশ ভাল জ্বর।

বিকেলে জ্বর গায়েই সে বেরুল। টিউশানি আছে। ছাত্রের পরীক্ষা। টিউশানি মিস করলে সমস্যা হবে। ছাত্রের মা ভয়ংকর কড়া। এই টিউশনি হাত ছাড়া করা যাবে না। এরা টাকা ভাল দেয়। আমি বললাম, তুমি আমাকে ঠিকানা দাও ভাইয়া–আমি পড়িয়ে আসি। জ্বর গায়ে তুমি বেরুতে পারবে না।

ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, জ্বরকে পাত্তা দিলে জ্বর মাথায় চড়ে বসবে। অসুখ বিসুখ হলে এদের অগ্রাহ্য করতে হয়। অগ্রাহ্য করলে এরা লজ্জায় পালিয়ে যায়। এদের লজ্জা বেশী।

ভাইয়া রাতে প্রবল জ্বর নিয়ে ফিরল। কয়েকবার বমি করে নেতিয়ে পড়ল। আমি এবং আপা সারারাত জেগে রইলাম। মা দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখলেন–ভেতরে ঢুকলেন না। আশ্চর্য! এখনো তাঁর রাগ পড়ে নি। ঘরে থার্মোমিটার নেই, তাপ কত দেখতে পারছি না। ভাইয়া আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে আছে। মাঝে মাঝে চোখ মেলে তাকাচ্ছে। টকটকে লাল চোখ। ঠোঁট শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে কিন্তু মুখ হাসি হাসি।

আপা বলল, ভাইয়া কেমন লাগছে?

ভাইয়া বলল, কামিনারি দে দেতোও গা কিমাশিতা।

এর মানে কি?

মানে হচ্ছে–বজ্র পড়ায় বাতি নিভে গেলো।

ঘুমুতে চেষ্টা কর তো ভাইয়া।

চেষ্টা করছি, লাভ হচ্ছে না। পৃথিবী যে নিজের অক্ষের উপর ঘুরে এই ব্যাপারটা আগে বিশ্বাস করিনি। এখন করছি। আমার চারদিক বন বন করে ঘুরছে। জয় বিজ্ঞান।

আমি বললাম, চুপচাপ শুয়ে থাক।

ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, শুয়েই তো আছি দাঁড়িয়ে আছি নাকি?

শেষ রাতের দিকে ভাইয়ার জ্বর একটু নামল, সে বিছানায় উঠে বসল। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, খুব ট্রাবল দিয়েছি এখন ঘুমুতে যা।

শরীর ভাল লাগছে?

খানিকটা লাগছে। মা কি জেগে আছে?

হুঁ। বারান্দায় বসে আছেন।

মাকে ডেকে আনতো। মার রাগ ভাঙ্গাবার ব্যবস্থা করি।

মা ঘরে এলেন। ভাইয়া বলল, বসো মা।

মা বসলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর স্বাস্থ্য যে এতটা খারাপ হয়েছে আগে লক্ষ্য করিনি। ছায়ার মত একজন মানুষ। ভাইয়া হাত বাড়িয়ে মার হাত ধরল। মাকে টেনে পাশে বসিয়ে বলল, বাবা কোথায় আছেন এই সম্পর্কে অনেক চিন্তাচ ভাবনা করে একটা থিওবী বের করেছি। তোমাকে বলি শোন–বাবার একটা চিঠির কথা তোমার মনে আছে? যেখানে বেনাপোল বর্ডার দিয়ে সুপারি আসার কথা লেখা, ঐ চিঠি থেকে আমার ধারণা হয়েছে–বাবা বেনাপোল গিয়েছিলেন। তারপর লোভে লোভে বর্ডার ক্রস করেছেন। ব্যবসার জন্যেও যেতে পারেন আবার দেশ দেখার জন্যেও যেতে পারেন। তাঁর তো ঘোরার বাতিক আছে। ঐখানে ইণ্ডিয়ান পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। তারা বাবাকে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। খবরের কাগজে দেখেছি কোলকাতার জেলে সত্তুর জনের মত বাংলাদেশী আছে। বিনা পাসপোর্টে যারা যায় তাদের ছমাসের মত জেল হয়। ছমাস প্রায় হতে চলল। আমার ধারণা, বাবার ফিরে আসার সময় হয়েছে।

আমরা সবাই হতভম্ভ হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।

ভাইয়া বলল, আমি কোলকাতায় খোজ নেবার চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। টী

ভাইয়া তোষক উল্টে পাসপোর্ট বের ককুল।

মা শোন, তুমি যে ভাব, বাবার ব্যাপারে আমার কোন মাথাব্যথা নেই, এটা ঠিক না। আমার কোন বন্ধুবান্ধব নেই মা। বাবা ছিলেন বন্ধুর মত। তুমি যতটুকু আগ্রহ নিয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছ আমি তার চেয়ে কম আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি না। বাবা একদিন ফিরে আসবে এবং হাসতে হাসতে বলবে–ফানি ম্যান, ভেরী ফানি ম্যান। এটা শোনার জন্যে আমি কতটুকু ব্যস্ত তা তুমি কোনদিন বুঝবে না। আমি জ্বরে মরে যাচ্ছিলাম, তুমি দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলে। একবার

ভেতরেও ঢুকলে না। তোমার এই অপরাধ আমি কোনদিন ক্ষমা করব না বলে ভেবেছিলাম, মত পাল্টেছি। তোমাকে ক্ষমা করা হল। এখন তুমি ঘুমুতে যাও মা। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

মা ঘর থেকে চলে যাবার পর পর আমি বললাম, তুমি যে কথাটা বললে তা কি নিজে বিশ্বাস কর?

ভাইয়া রাগী গলায় বলল, বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস না করলে পাসপোর্ট করিয়েছি শুধু শুধু?

আমি নীচু গলায় বললাম, আমার কাছে একটা লোক এসেছিল সে …

ভাইয়া আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, চুপ কর। পাগলের মত কথা বলবি না। একজন একটা কথা বললেই বিশ্বাস করতে হবে?

সত্যি হতেও তো পারে।

ভাইয়া চোখ লাল করে বলল, যা তুই আমার সামনে থেকে। গেট আউট। গেট আউট।

মা ভাইয়ার চিক্কার শুনে ছুটে এসে বললেন, কি হয়েছে।

ভাইয়া হাসি মুখে বলল, কিছুই না। রেনুকে একটা হিটলারী ধমক দিয়ে দেখলাম–ধমক দিতে পারি কি–না। ভাল কথা মা তোমাদের বলতে ভুলে গেছি আমার একটা চাকরি হচ্ছে। দুলুর বাবা, মন্ত্রী সাহেব নিজেই আমাকে ডেকে চাকরি দিতে চেয়েছেন। ভাল একটা খবর ভেবেছিলাম চাকরি পাবার পর দেব। আগে ভাগেই দিয়ে ফেললাম। এখন দয়া করে একটু হাস মা। অনেকদিন তোমার মুখের হাসি দেখি না।

দ্বিতীয় দিনে ভাইয়ার জ্বর দুপুর বেলার দিকে খুব বাড়ল। একবার বমি করল। বমির সঙ্গে টাটকা রক্ত। আমি হকচকিয়ে বললাম, রক্ত কেন?

ভাইয়া বলল, টনসিল থেকে রক্ত আসছে। খামাখা মুখ এরকম করিস না। জ্বর নেমে যাচ্ছে।

সত্যি সত্যি বিকেলের দিকে জ্বর নেমে গেল।

ভাইয়ার অসুখের কথা কাউকে আমরা বলিনি কিন্তু দুলু আপা কোত্থেকে যেন খবর পেয়ে চলে এলেন। একবার ভাইয়ার ঘরে উঁকি দিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন।

অনেকদিন তুই আমাদের বাসায় আসিস না। কারণটা কি বল তো?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, মন্ত্রীর বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করে না। তবু একদিন গিয়েছিলাম। গেটে পুলিশ ধরল। হেন তেন কত প্রশ্ন। কার কাছে যাবেন? কেন যাবেন? শেষে রাগ করে চলে এসেছি।

দুলু আপা প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, দুদিন পর পর তোর ভাইয়ার জ্বর হয় কেন বল তো?

জানি না।

অকারণে রোদে ঘোরাঘুরি করে। জ্বর হবে না তো কি? আমি দুদিন দেখেছি, ঝঝ রোদে হাঁটছে। সঙ্গে পাগল ধরনের একজন মানুষ।

পাগল ধরনের না আপা। সত্যিকারের পাগল। ভাইয়া আজকাল পাগল ছাড়া কারো সঙ্গে মেশে না! তোমার সঙ্গে ভাইয়ার খুব ভাল মিল হবে। তুমিও পাগল।

দুলু আপার মুখ টকটকে লাল হয়ে গেল–খানিকটা লজ্জায়, খানিকটা আনন্দে।

পৃথিবীর সবচে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে একটি মেয়ের লম্বা ও আনন্দ মেশানো লালচে মুখ। দুলু আপার দিকে তাকিয়ে থাকতে এত ভাল লাগছে।

আমি বললাম, আপা তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে এটা কি সত্যি?

মোটেই সত্যি না। আরেকটা কথা তোকে বলি–তুই যে আমাকে একবার বলেছিলি চিঠি লিখতে। আমি ঠিক করেছি লিখব।

খুব ভাল করেছ। আমার কাছে দিও। পৌঁছে দেব।

তোকে পৌঁছাতে হবে না। আমার চিঠি আমিই পৌঁছাব।

আমি বললাম, ভাইয়া জেগে আছে। আপা তুমি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করবে?

দুলু আপা দ্বিতীয়বার লজ্জায় লাল হয়ে বললেন, না। আমি যাই রেনু। অের ভাইয়ার জ্বর বাড়লে আমাকে খবর দিস। মন্ত্রীর মেয়ে বলে অবহেলা করিস না।

 

ভাইয়ার জ্বরের তৃতীয় দিনের কথা। মা ঘরে নেই–তার এক মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছেন। সম্ভবত টাকা ধার করতে গেছেন। ঘরে একটি টাকাও নেই। আমিও আমার অভ্যাস মত ঘুরতে বের হয়েছি। হাঁটাহাঁটি করছি ঐ রাস্তায় যদি মবিনুর রহমান নামের মানুষটির দেখা পেয়ে যাই। একদিন না একদিন দেখা তো হবেই। এই দিকেই কোথাও তাঁর বাসা। এই রাস্তাতেই তাকে যাওয়া আসা করতে হয়। হাল ছেড়ে ঘরে বসে থাকার কোন মানে হয় না।

বাসায় আছে শুধু আপা একা। ভাইয়ার বেশ জ্বর। সে এই জ্বর নিয়েই আপার সঙ্গে হাসি তামাশা করছে। এক সময় বলল, মুখ ভর্তি দাড়ি গোফ–গাল চুলকাচ্ছে–মীরা, রেজারটা এনে দে, দাড়ি কামাব। আর শোন্ বাবার টু ইনওয়াল আয়নাটাও আন তো।

আপা রেজার এবং সাবান এনে দেখে ভাইয়া খাটের নীচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। আপা দরজা খুলে ছুটে বের হয়ে এল। কাঁদতে কাঁদতে সানগ্লাস পরা ছেলেটার কাছে গিয়ে বলল–আমার ভাইয়া মরে যাচ্ছে। আমার ভাইয়া মরে যাচ্ছে।

সানগ্লাস পরা ছেলে অসাধ্য সাধন করল। একা ভাইয়াকে কোলে নিয়ে বের হয়ে এল। বেবীটেক্সি করে নিয়ে গেল হাসপাতালে। হাসপাতালে আপা ক্রমাগত কাদছিল। ছেলেটা আপাকে প্রচণ্ড ধমক দিল–কান্নাকাটি করার এখন সময়? বিপদের সময় কান্নাকাটি–একেবারে অসহ্য। চুপ করেন তো।

ডাক্তাররা ভাইয়ার অসুখ ধরতে পারলেন না। তাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি অবশ্যি হল না। কারণ দুলু আপার বাবা (সেচ ও যোগাযোগ মন্ত্রী) দুবার এসে রুগীকে দেখে গেছেন। তাঁর নির্দেশে রুগীকে জেনারেল ওয়ার্ড থেকে কেবিনে নেয়া হয়েছে। চিকিৎসার জন্যে একটা মেডিকেল বোর্ড তৈরী করা হয়েছে।

দুলু আপা সারাক্ষণ আছেন ভাইয়ার পাশে। কোন রকম সংকোচ নেই। রুগীর গা স্পঞ্জ করতে হয়। দুলু আপা অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলেন, দেখি তোয়ালেটা আমার কাছে দাও তো। আমি গা স্পঞ্জ করে দিচ্ছি। ভাইয়া লাল চোখে দুলু আপার দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন–কে আভা নাকি? মাই গড, তুমি কোথেকে খবর পেলে? আমি তোমাকে খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করেছি। তুমি কোথায় ডুব দিয়েছিলে বল তো?

দুলু আপা কিছুই বলেন না। চুপ করে থাকেন। তাঁর চোখ মমতা ও বেদনায় ছল ছল করে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ