সম্রাট হুমায়ূনের বাম হাতে একটি অদ্ভুত সুন্দর হালকা নীল রঙের বৈদুৰ্যমণি (Lapis Lazuli)। ডান হাতে একটি চিঠি। চিঠি পাঠিয়েছেন রাজস্থান থেকে রাজপুত রানী কর্ণাবতী। চিঠির সঙ্গে কয়েকগাছি হলুদ সুতা।

সম্রাট চিঠি পড়ছেন না। চিঠি এবং বৈদুৰ্যমণি এক হাত থেকে আরেক হাতে চালাচালি করছেন। যখন চিঠি ডান হাতে তখন বৈদুৰ্যমণি বাম হাতে। দৃশ্যটি সম্রাটের দুই ভগ্নি গুলবদন এবং গুলচেহরা। চিকের আড়াল থেকে দেখে মজা পাচ্ছে। দরবার চলাকালে এই দুই বোন চিকের আড়াল থেকে দরবারের কাজকর্ম দেখে। সম্রাটের অন্তঃপুরের আত্মীয়স্বজন রাজদরবার দেখার জন্যেই চিকের ব্যবস্থা। যারা দেখবে তারা দরবারের লোকজনের কাছে অদৃশ্য।

প্রধান উজির বললেন, সম্রাট কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত ?

সম্রাট হ্যা-সূচক মাথা নাড়লেন।

চিন্তার বিষয় কি জানতে পারি ?

হ্যাঁ পারেন। জাদুবিদ্যার বইটি এখানো জোগাড় করা গেল না। এই নিয়ে আমি চিন্তিত ।

সম্রাট হিন্দুস্থানের জাদুবিদ্যা নামের একটি বইয়ের সন্ধান পেয়েছেন। বইটি আছে তার ছোটভাই কামরান মীর্জার কাছে। সে সংগ্রহ করেছে কান্দাহারের এক দুর্গ থেকে।

সম্রাট হুমায়ূনের এই বইটি পড়ার খুব ইচ্ছা। বইটি নাকি লেখা হয়েছে প্যাচার রক্ত দিয়ে। দিনের বেলা বইয়ের লেখা অস্পষ্ট থাকে, রাতে স্পষ্ট হয়। সম্রাট তার ভাইয়ের কাছে বইটি চেয়ে পত্র দিয়েছেন। কামরান মীর্জা পত্রের জবাব দেন নি।

উজির বললেন, রানী কর্ণাবতীর পত্রটি কি আপনি পড়বেন? গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।–

সম্রাট চিঠি পড়তে শুরু করলেন

আমি আপনাকে ভাই ডাকলাম। আমাদের নিয়ম অনুযায়ী ভাইকে রাখি পাঠালাম। আমি মহাবিপদে পড়েছি। গুজরাটের বাহাদুর শাহ আমার দুর্গ অবরোধ করেছেন। দুর্গ রক্ষার প্রয়োজনীয় শক্তি আমার নেই। দুর্গে এক হাজার রাজপুত রমণী এবং তিন হাজার শিশু আছে। বাহাদুর শাহ দুর্গে প্রবেশ করলে আমাদের মৃত্যুবরণ করা ছাড়া উপায় নেই।

এখন বোন ভাইকে ডাকছে। ভাই কি বোনকে উদ্ধার করবে?

বোন ভাইয়ের জন্যে একটি বৈদুৰ্যমণি পাঠিয়েছে। কারণ বোন শুনেছে তার ভাই ছবি আঁকেন। বৈদুৰ্যমণি চূর্ণ করে যে নীল রঙ হবে তার দ্যুতি অসাধারণ। বোন কর্ণাবতী আশা করছে তার ভাই এই রঙ ব্যবহার করে একটা ছবি আঁকবে।

ইতি
রানী কর্ণাবতী

সম্রাট চিঠিটি তার প্রধান উজিারের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। প্রধান উজির চিঠি পড়ে বললেন, রত্ন পাঠিয়ে দিন রাজকোষে। চিঠির জবাব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

ভাই বোনের চিঠির জবাব দেবে না?

রানী কর্ণাবতী বিপদের বোন। বিপদে পড়েছেন বলেই ভাই পাতিয়েছেন। বিপদে না থাকলে এবং তার শক্তি প্ৰবল থাকলে তিনি মোঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ করতেও পিছপা হতেন না। তা ছাড়া আপনি নিজেও এখন মহাবিপদে আছেন।

কী রকম?

আপনার ভাই কামরান মীর্জা শক্তি সঞ্চয় করছেন। তিনি পাঞ্জাব দখল করেছেন। তিনি যে-কোনো সময় আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন। একই কথা আপনার আরেক ভাই হিন্দাল মীর্জা সম্পর্কেও সত্যি। এদের চেয়েও অনেক বড় সমস্যা তৈরি করতে যাচ্ছে পাঠান শের খাঁ। সে বাংলা জয় করেছে। আগ্রার দিকে তার যাত্রা শুধু সময়ের ব্যাপার।

হুমায়ূন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত হতে বলুন। আমি স্বয়ং চিতোরের দিকে রওনা হচ্ছি।

এই সিদ্ধান্ত সমরবিশারদদের সঙ্গে আলোচনার পর নিন।

সমরবিশারদরা আপনার মতোই কথা বলবে। কিন্তু আমি আমার বিপদগ্ৰস্ত বোনের পাশে দাঁড়াতে চাই।

শাহানশাহ, রাজনীতিতে আবেগের স্থান নেই।

হুমায়ূন বললেন, আমার রাজনীতিতে আছে। একজনের চরম বিপদে আমি তার পাশে যখন দাঁড়াব, তখন দেখা যাবে আমার চরম বিপদেও কেউ একজন আমার পাশে এসে দাড়াবে। (* হুমায়ূনের কথা সত্যি হয়েছিল। রাজ্যহারা পথের ফকির হুমায়ূনকে সাহায্য করেছিলেন পারস্য সম্রাট। সেখানেও একটি চিঠির ভূমিকা ছিল।)

প্রধান উজির বিরক্তি চাপার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। সম্রাটের কোনো কর্মকাণ্ডই সম্রাটসুলভ না। তিনি বাস করেন সম্পূর্ণ নিজের জগতে। সেই জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে সুরা, আফিম এবং কবিতা। তুরস্ক থেকে এক কবি এসেছে, রাজসভায় তাকে উচ্চস্থান দেওয়া হয়েছে। কবির নাম দিদির আলী।

সম্রাট গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করাকে এখন রাজকার্যের অংশ ভাবছেন। সারাক্ষণ শুভ-সময় অশুভ-সময় নির্ণয় করে চলেছেন। তিনি পোশাকও পরছেন গ্রহ-নক্ষত্র বিবেচনা করে। রবিবারে পরছেন। হলুদ পোশাক। সেদিন তিনি রাজ্য পরিচালনা-বিষয়ক সভা করেন।

সোমবার পরেন সবুজ পোশাক। ঐদিন তিনি আনন্দে থাকেন। রাজসভায় গীত-বাদ্য হয়।

মঙ্গলবারে লাল, মঙ্গলগ্রহের লাল রঙের পোশাক পরেন। সেদিন যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর মেজাজ থাকে উগ্র। সামান্য অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেন।

আজ মঙ্গলবার। সম্রাট লাল পোশাক পরেছেন। যুদ্ধযাত্রা ঘোষণা দেওয়ার এইটিই কি কারণ?

প্রধান উজির আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সম্রাট তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তীর ধনুক নিয়ে আসুন। একটি তীরের আগায় বাহাদুর শাহর নাম লেখা থাকবে। আরেকটির আগায় আমার নাম। আমি নিজে তীর ছুড়ে দেখব কোনটি আগে যায়। যার তীর আগে যাবে, সে-ই যুদ্ধে জিতবে।

সম্রাটের তীর অনেক আগে গেল।

পরদিন (বুধবার) ফজরের নামাজের পর হুমায়ূন চিতোরের দিকে সসৈন্যে রওনা হলেন। দুপুরে এক হিদের পাড়ে সৈন্যরা দ্বিপ্রহরের খাবারের জন্যে থামল। তখন বাহাদুর শাহ্র বিশেষ দূত সম্রাট হুমায়ূনের কাছে একটি চিঠি দিলেন। চিঠিতে লেখা—

সম্রাট হুমায়ূন,

অতি ভক্তিভরে নিবেদন করছি যে, আমি মোঘল সম্রাটের একজন দীন সেবক মাত্র। আমি বর্তমানে ধৰ্মযুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেছি। ওলেমারা রানী কর্ণাবতীর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকে জেহাদ অ্যাখ্যা দিয়েছেন।

সম্ভবত আপনার কাছে তথ্য নাই যে, এই দুর্গে অনেক মুসলমান রমণী বন্দি অবস্থায় আছেন। রাজপুত পুরুষরা তাদের ব্যবহার করে।

নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নৃত্যগীত এবং আরও অনেক অশ্লীল কুৎসিত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হয়।

আমি অনুরোধ করব যে, আপনি এই যুদ্ধযাত্রা স্থগিত করবেন। আমি আপনার সম্মানে এক বাক্স মণিমুক্তা, চারটি আরবি ঘোড়া এবং একটি হাতি পাঠালাম। এই হাতিটা আমার প্রিয়, এর নাম কুশ।

ইতি
আপনার সেবক
বাহাদুর শাহ

হুমায়ূন যুদ্ধযাত্রা স্থগিত করলেন না। জোহরের নামাজের পর সেনাবাহিনী দ্রুত অগ্রসর হতে লাগল। বাহাদুর শাহ খবর পেলেন হুমায়ূন যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি সঙ্গে করে এনেছেন তাঁর গোলন্দাজ বাহিনী। গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান তিকি খাঁ কামান চালনায় বিশেষ পারদর্শী। হুমায়ূনের বিশেষ কামান ফিরোজাকে দুটা হাতি টেনে নিয়ে আসছে। মাঝারি। কামানগুলি টানছে মাদ্রাজি বলদ। বন্দুকধারীরা কামানের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কামান অগ্রসর হবে না, তবে বন্দুকধারীরা অগ্রসর হবে।

সম্রাটের তীরন্দাজ বাহিনীর নেতৃত্বে আছে আফগান তীরন্দাজ প্রধান শাহ জুম্মা। তাঁর সম্পর্কে কথিত আছে, লক্ষ্যবস্তু দেখার পর তিনি চোখ বন্ধ করে তীর ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারেন।

হুমায়ূনের অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা ছিল ত্ৰিশ হাজার। তারা অগ্রবর্তী তীরন্দাজ দলের পেছনে পেছনে যাচ্ছিল।

বাহাদুর শাহ সম্রাট হুমায়ূনের দ্রুত এগিয়ে আসার খবর শুনলেন। তিনি পালিয়ে যাওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ করে দুর্গ অবরোধকারী সৈন্যদের উল্লাসধ্বনি করতে বললেন। দুর্গের বাইরে বিরাট হৈচৈ হতে লাগল।

রানী কর্ণাবতী বাইরে হঠাৎ হৈচৈ শুরু হয়েছে কেন জানতে বাহিনীর যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে হুমায়ূন পরাজিত হয়েছেন। হাতির পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে নিহত হয়েছেন বলেই বাহাদুর শাহর শিবিরে আনন্দ উল্লাস।

জহরব্রত পালনের জন্যে আগুন প্রস্তুত ছিল। রানী কর্ণাবতী সবাইকে নিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রানীর আদেশে দুর্গের তিন হাজার শিশুকেও কুয়ায় নিক্ষেপ করা হলো। যেন এরা শত্রুর হাতে পড়ে নিগৃহিত না হয়।

বাহাদুর শাহ দুর্গে প্রবেশ করতে পারলেন না। হুমায়ূনের বাহিনী চলে এসেছে। তিনি পালিয়ে গেলেন।

রানী কর্ণাবতীর মৃত্যু হুমায়ূনকে দুঃখে অভিভূত করল। তিনি তৎক্ষণাৎ বাহাদুর শাহর পেছনে ছুটলেন। রানী কর্ণাবতীর মৃত্যু আরেকজনের মনে গভীর রেখাপাত করল। তিনি বাহাদুর শাহর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান রুমী খাঁ। তিনি তাঁর দলবল নিয়ে হুমায়ূনের সঙ্গে যুক্ত হলেন।

 

চিতোরের দুর্গ শ্মশান। দুর্গের বাইরে বাহাদুর শাহের অতি প্রিয় দুই হাতি বিকট চিৎকার করছে এবং ছোটাছুটি করছে। হুমায়ূনের হাতে বাহাদুর শাহর প্রিয় দুই হাতি পড়বে তা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না বলে নিজের হাতে এদের শুড় কেটে দিয়েছেন। হাতি দুটির নাম শিরজা ও পতাসিকার। বাহাদুর শাহর প্রসিদ্ধ দুই কামান লায়লা এবং মজনু যেন হুমায়ূনের হাতে না পড়ে সেই ব্যবস্থাও হলো। বাহাদুর শাহ নিজে কামান দুটি নষ্ট করলেন। (* সূত্র: ডক্টর হরিশংকর শ্ৰীবাস্তব, মোঘল সম্রাট হুমায়ূন।)

বাহাদুর শাহ পালিয়ে মাণ্ডু দুর্গে আশ্রয় নিলেন।

হুমায়ূন মাণ্ডু পৌঁছালেন ত্ৰিশ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে। তিনি মাণ্ডু দুর্গ অবরোধ করলেন। সারা দিন ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছিলেন ক্লান্ত। এশার নামাজ শেষ করে সেনাপতিদের ডেকে বললেন, আমি জানি মাণ্ডু দুর্গ দখল করা কঠিন। কিন্তু আমি বাহাদুর শাহকে ধরতে চাই। এমন ব্যবস্থা করা হোক যেন রাতের ভেতর দুর্গ দখল হয়।

লম্বা লম্বা মই তৈরি করা হলো। মই দুর্গের গায়ে লাগিয়ে তীরন্দাজরা দুর্গপ্রাচীরে উঠে গেল। একদল তীরন্দাজ দুর্গের প্রধান দরজা খুলে দিল।

বাহাদুর শাহ দড়ি বেয়ে দুর্গ থেকে পালিয়ে গেলেন। দুর্গের ভেতরের মানুষজন কেউ বলল না, বাহাদুর শাহ কীভাবে পালিয়েছেন কোন দিকে যাচ্ছেন। হুমায়ূন তখন এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন, গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরলেন। এর অর্থ, সবাইকে হত্যা করো।

ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ শুরু হলো। মোঘল সৈনিকের তলোয়ারের নিচে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হলো। সেদিন মঙ্গলবার হওয়ায় রক্তাম্বর পরে হুমায়ূন উন্মাদ হয়ে গেলেন। তাকে দেখে তার সৈন্যরাও উন্মাদ হয়ে গেল।

মাণ্ডুবাসীদের যে রক্ষা করে, তার কথা এখন বলা যাক। তার নাম বচ্ছু (মতান্তরে মঞ্চ)। এই বচ্ছু বাহাদুর শাহ’র অতি প্রিয় এক গায়ক। বাহাদুর শাহ যেখানে যান। সেখানেই সে যায়।

রক্তাম্বর পরা সম্রাট হুমায়ূনের দিকে বচ্ছু গান গাইতে গাইতে এগিয়ে গেল। গানের কথা—রক্তের রঙের চেয়ে বৃক্ষের সবুজ রঙ কি কম সুন্দর?…

হুমায়ূন গায়কের কণ্ঠ শুনে অভিভূত হলেন। তাঁর কাছে মনে হলো, তিনি তাঁর জীবনে এত মধুর সঙ্গীত শোনেন নি। বচ্ছু সম্রাটের সামনে দাঁড়াল। সম্রাট বললেন, তুমি কি জানো যে তুমি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গায়ক?

বচ্ছু বলল, জানি। আমি তোমার জাদুকরী ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছি। বলো কী চাও? আমি চাই আপনি পোশাক বদলে সবুজ পোশাক পরুন। সম্রাট সবুজ বস্ত্র পরলেন। হত্যাযজ্ঞ সঙ্গে সঙ্গে থামল। সম্রাট বললেন, তুমি আর কী চাও?

বচ্ছু বলল, যারা বন্দি আছে তাদের মুক্ত করে দিন। হুমায়ূন বললেন, সবাই মুক্ত। আমি তোমার আরও একটি ইচ্ছা পূর্ণ করব। বলো কী চাও?

আমি আমার গুরু বাহাদুর শাহের কাছে যেতে চাই।

হুমায়ূন দুর্গের প্রধান ফটক খুলে বচ্ছুকে চলে যেতে দিলেন। হুমায়ূনের প্রধান উজির বললেন, আপনি কী করছেন?

সম্রাট বললেন, এই গায়ক যদি আমার রাজ্য প্রার্থনা করত। আমি তাকে দিয়ে দিতাম।

মাণ্ডু থেকে পালিয়ে বাহাদুর শাহ আহমেদাবাদের চম্পানী দুর্গে অবস্থান নিলেন। মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। বাহাদুর শাহের গোলন্দাজবাহিনী কামান বসানোর আগেই সম্রাট হুমায়ূন চম্পানীর দুর্গ অবরোধ করলেন। বাহাদুর শাহ আবার পালালেন, তিনি আশ্রয় নিলেন কম্ব দুর্গে। হুমায়ূন এক ঘণ্টার মধ্যে কম্ব দুর্গে উপস্থিত হলেন।

কম্ব দুর্গ থেকেও বাহাদুর শাহকে পালাতে হলো। এবার তার সঙ্গে গায়ক বচ্ছু। পালাবার সময় তিনি বলেছিলেন, আমার সঙ্গে বচ্ছু আছে আমার আর কিছুই লাগবে না।

হুমায়ূন দুর্গের ভেতর মাগরেবের নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে তার ইমামকে ডেকে পাঠালেন। ইমামকে বললেন, মাগরেবের নামাজে আপনি সূরা ফিল পাঠ করেছেন?

ইমাম বললেন, জি জনাব।

সূরা ফিলের শানে নজ্বল এবং তর্জমা আমাকে শোনান।

ইমাম বললেন, ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে নবীয়ে করিম (দঃ)-এর জন্মবর্ষের ঘটনার বর্ণনা নিয়ে এই সূরা নাযেল হয়। ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা হস্তীবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণ করেছিলেন, তখন আল্লাহর আদেশে ছোট ছোট আবাবিল পাখি দিয়ে ইয়েমেনের বাদশাহকে পরাস্ত করা হয়েছিল। সূরা ফিলের এই হলো ঘটনা। আল্লাহ্পাক বলেছেন, হে রসুল! তুমি কি দেখো নি তোমার আল্লাহ হাতিওয়ালাদের সাথে কেমন আচরণ করলেন? তাদের সমস্ত আয়োজন কি আল্লাহ ব্যর্থ করে দেন নি?

সম্রাট বললেন, আপনি আমাকে ইয়েমেনের বাদশাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যে এই সূরা পাঠ করেছেন?

ইমাম বললেন, আমার ভুল হয়েছে। সম্রাট বললেন, আপনি বাহাদুর শাহর অনুরক্ত বলেই এই কাজটি করলেন। কী আশ্চর্য, আমার প্রধান শক্রর প্রতি যে অনুরক্ত, আমি তার পেছনে দিনের পর দিননামাজ পড়েছি!

হুমায়ূন আবার রক্তপোশাক পরলেন। বাহাদুর শাহ তাঁকে যে হাতিটি দিয়েছেন কুশ তিনি সেই হাতি আনতে বললেন। হাতি হাজির করা হলো।

সাম্রাট বললেন, আজ মাগরেবে যে সূরা পাঠ করা হয়েছে তার নাম ফিল অর্থাৎ হাতি ইমাম, আপনার প্রয় বাহাদুর শহর দেওয়া সেই হাতির পায়ের চাপে পিষ্ট করে আমি আপনাকে হত্যার নির্দেশ দিলাম। এই আদেশ এশার নামাজের আগেই যেন কার্যকর হয়। (*ঐতিহাসিক আবুল ফজল লিখেছেন, এই ঘটনার পর হুমায়ূন অত্যন্ত অনুতপ্ত হন। তিনি সারা রাত একফোঁটা ঘুমাতে পারেন নি। সারা রাত শিশুর মতো কেঁদেছেন। পরদিন ফজরের নামাজের আগে তিনি তার রক্তপোশাক পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। বাকি জীবন তিনি আর এই ভয়ঙ্কর বস্ত্ৰ পরিধান করেন নি।)

নির্দেশ কার্যকর করা হলো।

কম্ব দুর্গ থেকে বাহাদুর শাহ পালিয়ে গেলেও তাঁর ধনরত্ন নিতে পারলেন না। সবই হুমায়ূনের হাতে পড়ল। ধনরত্নের বাইরে পেলেন বাহাদুর শাহের পোষা তোতাপাখি।

এই পাখি নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পারে। রুমী খাঁকে সে যতবার দেখে ততবারই বলে, ফট রুমী হারামখোর। ফট রুমী হারামখোর। এর অর্থ হারামখোর রুমীর উপর অভিসম্পাত।

সম্রাটের প্রধান খেলা এখন হলো পাখির সঙ্গে সময় কাটানো। কম্ব বিজয়ের পর সম্রাট তোতাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে শ্ৰেষ্ঠ আমি না বাহাদুর শাহ?

তোতা বলল, আল্লাহ আকবর।

পাখির মতে আল্লাহই শ্রেষ্ঠ। সম্রাট সন্তোষ লাভ করলেন। তোতাকে স্বর্গীয় পক্ষী উপাধি দিলেন। তার জন্যে সোনার খাঁচা বানানোর নির্দেশ দিলেন।

সম্রাটকে পানি খাওয়ানোর দায়িত্বে নিযুক্ত জওহরকে এই পক্ষীর সেবক নিয়োগ করলেন। (এই জওহর সম্রাট হুমায়ূনের একটি জীবনী রচনা করেন। সম্রাটভগ্নি গুলবদনের পরেই জওহরের জীবনীকে প্রামাণ্য ধরা হয়।) সম্রাটের নির্দেশে এই তোতাপাখির একটি ছবি আঁকা হয়। ছবিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এখনো সংরক্ষিত আছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ