জুন মাস। আগ্রার উপর দিয়ে কয়েকদিন ধরেই লু হাওয়া বইছে। পিঙ্গল আকাশে মেঘের দেখা নেই। লোকজন দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসা। কিছু মিঠাইয়ের দোকান খোলা। মিঠাইয়ের উপর ভিনভন্ন করছে মাছি। গরম কাল মাছিদের প্রিয় সময়। গরমে তারা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।

আগ্রার পথেঘাটে ময়ুরের ঝাঁক। তাদের দৃষ্টি আকাশের দিকে। তারা কুৎসিত শব্দে ডাকে, চক্রাকারে ঘোরে, একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গরমে এদেরও মাথা খারাপের মতো হয়ে গেছে। ময়ুর পেখম মেলার জন্যে অস্থির। বৃষ্টির দেখা নেই বলে পেখম মেলতে পারছে না।

আগ্রার অধিবাসীরা আজ খানিকটা উত্তেজিত। প্ৰধান কাজির নির্দেশে তিন অপরাধীর শাস্তি হবে। বিশেষ ধরনের শাস্তি বলেই উত্তেজনা। তিনি অপরাধীর জন্যে তিনটি গাধা হত্যা করা হয়েছে। গাধাগুলির চামড়া ছিলানো হয়েছে। অপরাধীদের গাধার চামড়ার ভেতর ঢুকিয়ে চামড়া সেলাই করে দেওয়া হবে। তারপর তাদের শুইয়ে দেওয়া হবে ঘোড়ার গাড়িতে। এই গাড়ি আগ্রা শহরময় ঘুরবে। প্রচণ্ড গরমে গাধার চামড়া এঁটে বসে যাবে অপরাধীদের গায়ে। তাদের মৃত্যু হবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে।

তিন অপরাধী গাধার চামড়ায় মোড়া অবস্থায় ঘোড়ার গাড়ির পাটাতনে শুয়ে আছে। ঘোড়ার গাড়ি চলছে। ঘোড়ার গাড়ির চালকের হাতে রুপার ঘণ্টা। সে মাঝে মাঝে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। ঘণ্টাধ্বনি শাস্তির ঘোষণা। প্ৰচণ্ড গরমে গাধার চামড়া অপরাধীদের গায়ে ঐটে বসছে। তাদের একজন পানি পানি’ বলে অস্ফুট শব্দ করছে। গাড়ির পেছনে এক দঙ্গল ছেলেপুলে। তাদের উৎসাহের সীমা নেই। তারা মাঝে মাঝে ঢ়িল ছুড়ছে। যখনই কোনো ঢ়িল গাধার চামড়ায় আবৃত অপরাধীদের উপর পড়ছে, তখনই তারা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠছে।

 

গরম অসহনীয় বোধ হওয়ায় সম্রাট গোসলখানায় দরবারে খাস’ বসিয়েছেন। তাঁর প্রিয় অমাত্যরা গোসলখানায় জড়ো হয়েছেন। সম্রাট হাম্মামে বুক পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন। দুজন খোজা বালক মাঝে মাঝে তার মাথায় পানি ঢালছে। পানিতে গোলাপগন্ধ। অসংখ্য গোলাপ পাপড়ি ছড়িয়ে পানিতে এই গন্ধ আনা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় পানি শীতল করা হয়েছে। শীতলকরণ-পদ্ধতি চালু আছে। সম্রাট যতক্ষণ হাম্মামে থাকবেন ততক্ষণ এই প্রক্রিয়া চলবে।

পানির শীতলকরণ-পদ্ধতি যথেষ্টই বৈজ্ঞানিক। বাষ্পীভবনের সময় পানি কিছু উত্তাপ নিয়ে বাম্পে পরিণত হয়। উত্তাপ নেওয়ার কারণে পানি ঠাণ্ডা হয়। প্ৰকাণ্ড সব মাটির জালার গায়ে পানি ঢেলে বাতাস দেওয়া হচ্ছে। এতে বাষ্পীভবন-প্রক্রিয়া দ্রুত হচ্ছে।

সম্রাটকে ঘিরে আছেন দরবারে খাসের অমাত্যজন। মন্ত্রীসভার সকল সদস্য আছেন। দুজন সেনাপতি আছেন। আজকের দরবারে খাসে আফগান শের খাঁর বিষয়ে আলোচনা হবে। শের খাঁ শক্তি সঞ্চয় করেই যাচ্ছে। তার বিষয়ে কখন কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা সম্রাট বলবেন। আলোচনায় অন্যরাও অংশ নিতে পারবে, তবে কে অংশ নেবে। তা সম্রাট আঙুলের ইশারায় ঠিক করবেন। ইচ্ছামতো মতামত জাহির করার সুযোগ নেই। গোপন আলোচনা খোজাদের সামনেই হচ্ছে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। গোসলখানায় উপস্থিত সব খোজাই বধির। কানে গলন্ত সীসা ঢেলে তাদের কান নষ্ট করা হয়েছে।

সভা শুরুর আগে আগে সম্রাট একটি শের আবৃত্তি করলেন—

মুরাদই লাখ বুড়া চাহে তো কেয়া হোতা হ্যায় ওই হোতা হ্যায় যো মঞ্জরে খোদা হোতা হ্যায়। (শত্রুরা আমার যতই অনিষ্ট কামনা করুক তাতে কিছুই হবে না। ঈশ্বর যা মঞ্জুর করবেন তা-ই হবে আমার ভাগ্যলিপি।)

দরবারিরা একসঙ্গে বললেন, মারহাবা! মারহাবা! সম্রাট হাসলেন। দ্বিতীয় শের আবৃত্তি করলেন—

হর মুসিবৎকো দিয়া এক তবসুমসে জবাব ইসতরাহ গরদিসে দৌড়োকে রুলায়া হ্যায় ম্যায়নে। (দুর্দিন ভেবেছিল সে আমাকে কাদাবে। উল্টা হাসিমুখে আমি তাকে কাঁদিয়েছি।)

আবারও আওয়াজ উঠল, মারহাবা! মারহাবা!

প্রধান উজির বললেন, গোস্তাকি মাফ হয়। এই অপূর্ব শের কার কলম থেকে বের হয়েছে?

সম্রাট বললেন, এই শের তোমাদের বাদশাহর কলম থেকে এসেছে। সে হিন্দুস্থানের বাদশাহ হলেও অন্তরে একজন অক্ষম দুর্বল কবি।

প্রধান উজির কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, সম্রাট ইশারায় তাঁকে থামিয়ে সভা শুরু করলেন। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে অমাত্যদের মধ্যে গৌণ একজনকে হাম্মামে নামতে বললেন। সম্রাটের সঙ্গে স্নান করা পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। যাকে হাম্মামে নামতে বলা হলো, তাঁর চেহারা অতি সাধারণ। মধ্যম আকৃতির কৃশকায় একজন মানুষ। তাঁর নাম বৈরাম খাঁ। (মোঘল ইতিহাসের প্রধান পুরুষদের একজন।) গোসলখানায় যখন দরবারে খাস বসে তখন উপস্থিত সবাই পানিতে নামার প্রস্তুতি নিয়ে আসে। যেন সম্রাটের হুকুম পাওয়ামাত্র পানিতে নামতে পারে।

সম্রাট বললেন, এখন একটি পত্র পাঠ করা হবে। পত্রপাঠের পর পত্রের উপর আলোচনা। পত্ৰ পাঠিয়েছেন। আফগান পাঠান—শের খাঁ।

সম্রাটের নির্দেশে প্রধান উজির পত্ৰ পাঠ করলেন।

পত্র

প্রেরক : দাসানুদাস সেবক শের শাহ।

প্রাপক : আল সুলতান আল আজম ওয়াল খাকাল আল মুকাররাম, জামিই সুলতানাত-ই-হাকিকি ওয়া মাজাজি, সৈয়দ সালাতিন, আবুল মোজাফফর নাসির উদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ূন পাদশাহ, গাজি জিলুল্লাহ।

হে মহান সম্রাট, হিন্দুস্থানের রক্ষাকর্তা ও মালিক। আল্লাহপাকের অনুগ্রহের ফুটন্ত গোলাপী। মহান কবি ও চিত্রকর হুমায়ূন।

হে বাদশাহ, আপনি কি অধম শের খাঁ’র উপর নারাজ হয়েছেন? হিন্দুস্থান হলো গুজবের বাজার। সেই বাজারের বর্তমান দুৰ্গন্ধময় গুজব হলো— আপনি অধম শের খাঁ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

হে সম্রাট! আমি কি এমন কিছু করেছি। যার জন্যে আপনার বিরাগভাজন হয়েছি? চুনারের দুর্গ আমার পুত্র কুতুব খাঁর দখলে, এটা সত্য। সম্রাটের আদেশ পাওয়ামাত্র কুতুব খাঁ দুর্গের চাবি আপনার পবিত্র হাতে তুলে দিয়ে আপনার পদচুম্বন করবে। তবে আপনার কোনো প্রতিনিধির হাতে না। আপনি স্বয়ং উপস্থিত হলে তবেই দুর্গের চাবি আপনার হস্ত মোবারকে দেওয়া হবে। আমি পুত্রকে নিয়ে বঙ্গদেশের ভেতরে চলে যাব। এর অন্যথা কখনো হবে না।

হে পবিত্র সম্রাট, আপনি গুপ্তচর মারফত খবর নিয়ে নিশ্চয়ই জেনেছেন আমি আমার নিজের নামে খুৎবা পাঠ করাই না। মহান মোঘল সম্রাট হুমায়ূনের নামেই জুমার নামাজে খুৎবা পাঠ করা হয়। টাকশাল থেকে আমার নামে কোনো মুদ্রা তৈরি হচ্ছে না।

এই অধম যেখানে সম্রাটের সেবায় নিযুক্ত তখন আপনি তার উপর বিরাগ হচ্ছেন, অথচ আমি যতদূর জানি আপনার ভাই আসকারি মীর্জা এবং কামরান মীর্জা তাদের নামে খুৎবা পাঠ করছেন। টাকশালে তাদের নামে স্বর্ণমুদ্রা তৈরি হচ্ছে। এরকম কিছু মুদ্রা আপনার কাছে পাঠালাম।

মহান সম্রাট, আপনার দুই ভাইয়ের নাম এখানে এনে যদি অপরাধ করে থাকি তাহলে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আপনার মহান পিতা বঙ্গদেশের ফল আমি অত্যন্ত পছন্দ করতেন। আমি আম এবং আরও কিছু বঙ্গদেশীয় ফল আপনার সেবার জন্যে পাঠালাম। এই সঙ্গে একটি বিষ্ণুমূর্তি। বিষ্ণুমূর্তিটির ওজন এগারো সের। সম্পূর্ণ স্বর্ণনির্মিত, এর চোখ নীলকান্তমণির। এই বিষ্ণুমূর্তি বিষয়ে প্রচলিত গল্প হলো, ভয়াবহ বিপদের আগে আগে সে অশ্রু বর্ষণ করে। রহস্যময় বিষয়ে আপনার আগ্রহের কথা জানি বলেই বিষ্ণুমূর্তি বিষয়ে প্রচলিত গল্পটি জানালাম।

ইতি
শের খাঁ
আপনার দাসানুদাস সেবক।

রোশন কাকু (আমীর) বললেন, আমি শের খাঁ’র পত্রে সন্তোষ বোধ করছি।

বৈরাম খাঁ বললেন, দুষ্টলোকের ছলনায় ভোলার কোনো কারণ দেখি না।

কাকু বললেন, শের খাঁ তার নামে খুৎবা পাঠ করে না, এটা তো সত্য। তার নামে মুদ্রা বের হয় নি, এটাও সত্য।

বৈরাম খাঁ বললেন, খুৎবা পাঠ করলেই সম্রাটের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে। শের খাঁ বুদ্ধিমান বলেই খুৎবা পাঠ করছে না। শক্তি সঞ্চয় করছে। চুনার দুর্গ যদি শের খাঁ’র দিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে সম্রাটের যে-কোনো প্রতিনিধির কাছে দুর্গ দেবে। স্বয়ং সম্রাটকে কেন উপস্থিত হতে হবে?

উজির তর্দি বেগ খান বললেন, আপনি কি মনে করেন সম্রাটের যুদ্ধযাত্রা করা উচিত?

বৈরাম খাঁ বললেন, অবশ্যই উচিত। এবং এখনই যুদ্ধযাত্রা করা প্রয়োজন।

তৰ্দি বেগ বললেন, এখনই কেন?

বৈরাম খাঁ বললেন, সম্রাটের অনুমতি পেলে আমি ব্যাখ্যা করব কেন কালবিলম্ব না করে যুদ্ধযাত্রা করা উচিত।

সম্রাট বললেন, অনুমতি দেওয়া হলো।

বৈরাম খাঁ বললেন, শের খাঁ হলো ধূর্ত শেয়াল। সুন্দর একটি চিঠি পাঠিয়ে সে সম্রাটকে শান্ত করেছে। সে কল্পনাও করছে না সম্রাট এরকম একটি চিঠি পাওয়ার পরও যুদ্ধযাত্রা করবেন। কাজেই সে নিশ্চিন্ত আছে। রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো প্ৰস্তুতি তার নেই। এই সুযোগে মোঘল সৈন্য অতর্কিতে শের খাঁ’র ঘাড়ের উপর পড়লে চিরদিনের মতো আফগান শক্তির পতন হবে।

সম্রাট বললেন, আলোচনা বন্ধ। সবাইকে আমি হামামখানায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

উপস্থিত অমাত্যদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। সবাই পানিতে নামল।

সম্রাট শের খাঁ’র পাঠানো ফল এবং বিষ্ণুমূর্তি গোসলখানায় আনার নির্দেশ দিলেন। বিষ্ণুমূর্তি দেখে সম্রাট বিস্মিত হলেন। এত সুন্দর কাজ! সম্রাট বললেন, যে কারিগর এই মূর্তি তৈরি করেছে তার উদ্দেশে মারহাবা।

সবাই বললেন, মারহাবা!

প্রধান উজির বললেন, রাজকোষে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি থাকা বাঞ্ছনীয় না। মূর্তি গলিয়ে সোনা করে রাজকোষে জমা হোক।

হুমায়ূন বললেন, না। এই মূর্তি যেমন আছে তেমন থাকবে। আমি আজ তার সঙ্গে স্নান করব।

বিষ্ণুমূর্তি হাম্মামে নামিয়ে দেওয়া হলো। বঙ্গদেশের ফলগুলির মধ্যে একটি সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। অত্যন্ত রসালো ফল। মুখে দিলেই জিভের রঙ বদলে কালো হয়ে যাচ্ছে। এই ফলের কী নাম কেউ বলতে পারল না। ফলটি কালো জাম, কিংবা তুঁত।]

হুমায়ূন গোসলখানায় ঘোষণা দিলেন শের খাঁ’র বিষয়ে তাঁর কোনো উদ্বেগ নেই। তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করার কিছু নেই। বাহাদুর শাহ পরাজিত হয়েছে। পর্তুগীজদের হাতে সে নিহত। সে অপুত্ৰক বিধায় তাকে এবং তার বংশধর নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই। সেই উপলক্ষে তেমন কোনো আনন্দ-অনুষ্ঠান হয় নি। দুই মাসব্যাপী আনন্দ উৎসব হবে। এই দুই মাসে প্রতিদিন দশজন করে সাধারণ প্ৰজা আমার সঙ্গে রাজকীয় খানায় অংশগ্রহণ করবে।

 

মাগরেবের নামাজের পর হুমায়ূনকে জানানো হলো, গাধার চামড়া পরিয়ে যে তিন অপরাধীকে সারা দিন ঘুরানো হয়েছে তাদের দু’জন মারা গেছে। একজন এখনো জীবিত। হুমায়ূনের নির্দেশে চামড়া থেকে মুক্ত করে তাকে সম্রাটের সামনে আনা হলো। তার দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। তার সমস্ত শরীর ফুলে গেছে। চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। সম্রাট বললেন, তোমার নাম কী?

সে অতি কষ্টে বলল, সম্রাট, আমি একজন মৃত মানুষ। মৃত মানুষের নাম থাকে না।

তুমি কী অপরাধ করেছিলে?

আপনার এক আমীর আমার অতি আদরের কন্যাকে তার হেরেমে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি সেই নির্দেশ পালন করি নাই। এটাই আমার অপরাধ। আমাকে মিথ্যা হত্যা মামলায় জড়ানো হয়েছিল। মহান কাজি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।

আমার সেই আমীরের নাম কী?

সে নাম বলতে পারল না। ততক্ষণে তার হেঁচকি উঠেছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে ঠোঁট নাড়ছে কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হলো। (*আমীরের নাম তর্দি বেগ খান। সম্রাট আকবরের সময় বৈরাম খাঁ তাঁকে হত্যা করেন।)

সম্রাট হুমায়ূন এর পরপর একটি রাজকীয় ফরমান জারি করলেন।

যে-কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে সম্রাটের অনুমতি নিতে হবে।

এ ছাড়াও তিনি যুদ্ধে ব্যবহার হয় এমন একটি দামামার ব্যবস্থা করলেন। কোনো প্ৰজা যদি মনে করে তার উপর বিরাট অবিচার করা হচ্ছে, তাহলে সে দামামায় বাড়ি দিয়ে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে।

এই কাজটা করতে হবে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। এই সময় সম্রাটের শোবার ঘরের জানোলা খুলে যায়। তিনি জানালায় মুখ বের করে প্রজাদের দর্শন দেন। এই দর্শনের নাম ঝড়োয়া কি দর্শন’। প্রজারা সম্রাটকে দেখে আশ্বস্ত হয় যে, সম্রাট বেঁচে আছেন। রাজত্ব ঠিকমতো চলছে।

 

বাঁশিতে ভৈরবীর সুর বাজছে। সূর্য উঠছে। সম্রাট হুমায়ূন ঝড়োয়া কি দর্শন’ দেবেন। প্রজার দল উপস্থিত।

জানোলা খুলে গেল। সম্রাটের প্রিয় নফর জওহর আবিতাবচি রেশমি পর্দা সরাল। সম্রাটের হাসিহাসি মুখ দেখা গেল। সম্রাটের হাতে একটি ফুটন্ত গোলাপী। তিনি গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে জানালার নিচে সমবেত প্রজাদের দিকে ছুড়ে দিলেন। সম্রাটের ফুল হাতে পাওয়ার জন্য প্রজারা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আর ঠিক তখনই দামামার শব্দ হলো। সম্রাট ভ্রাক্ত কুঞ্চিত করে তাকালেন।

বিচার পেতে ব্যর্থ প্রজারাই শুধু এই দামামায় ঘা দিতে পারে। কে ঘা দিল?

দামামার পাশে সারা শরীর কালো বোরকায় ঢাকা এ জেনানা দেখা যাচ্ছে। সে দামামায় বাড়ি দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

সম্রাট নির্দেশ দিলেন আজ সন্ধ্যায় দরবারে-আম’ বসবে। সেখানে এই জেনানার বক্তব্য প্রথম শোনা হবে। দরবারে আমে প্রবেশের জন্য এই মহিলাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে বলা হলো।

‘ঝড়োয়া কি দর্শন’ শেষ হয়েছে। সম্রাট নিজের ঘরে ফিরে গেছেন। তিনি কিছুক্ষণ কোরান পাঠ করবেন। কোরান পাঠের পর একটি বই পড়বেন। মূল বই হিন্দুস্তানি ভাষায় লেখা (মনে হয় সংস্কৃত কিংবা আদি বাংলা,-লেখক)। সম্রাটের নির্দেশে বইটি ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। বইয়ের শিরোনাম–

অদৃশ্য হইবার মন্ত্র

বইতে হিন্দু যোগীরা কীভাবে অদৃশ্য হন তার বিষদ বর্ণনা এবং মন্ত্র দেওয়া আছে। যেসব উপকরণের উল্লেখ আছে তা হলো, শ্মশানে ভাঙা কলসির মাথা (কালো রঙ), বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তির পাঁজরের হাড়, যে–দড়িতে ফাঁসি হয়েছে সেই দড়ি। প্রথম রজস্বলা কিশোরীর দূষিত রক্ত। ত্ৰিমুখী রুদ্ৰাক্ষ। বেশ্য রমণীর যৌনকেশ… ইত্যাদি।

 

দরবারে আমে বিচারপ্রার্থী তরুণী উপস্থিত। সম্রাটের নির্দেশে সে মুখের নেকাব খুলেছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির রূপ দেখে সম্রাট হতভম্ব। কী সুন্দর বড় বড় চোখ। চোখের দীর্ঘ পল্লব। সম্রাট বললেন, নাম?

তরুণী আভূমি নত হয়ে বলল, বাঁদির নাম আসহারি।

পরিচয়?

সম্রাটকে দেওয়ার মতো কোনো পরিচয় এই বাঁদির নেই। আমি আপনার হেরেমে বাস করি। আপনার মহান পিতা বাদশাহ বাবরকে একবার গান গেয়ে শোনাবার সৌভাগ্য হয়েছিল।

তোমার অভিযোগ কী?

মহান সম্রাট বাদশাহ বাবর আমার গান শুনে খুশি হয়ে আমায় সমওজনের স্বর্ণমুদ্রা দিতে হুকুম করেছিলেন। আমি তা পাই নাই। অবশ্য খাজাঞ্জিখানা থেকে আমাকে সমওজনের তাম্রমুদ্রা দেওয়া হয়। সেটাও কাগজ-কলমে।

তোমার অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষী আছে?

আমার হৃদয় একমাত্র সাক্ষী। আর কোনো সাক্ষী নাই।

সম্রাট দাওয়াতদারকে (লিখনিসামগ্ৰীর ব্যবস্থাপক। প্রতিদিনের হিসাবরক্ষক।) বললেন, ঐদিনের ঘটনা কী তা যেন রেকর্ড ঘেঁটে জানানো হয়। প্রতিদিনের ঘোষণার কপি কিতাবাদারের (গ্রন্থাগারিক) কাছেও থাকে। তাকেও রেকর্ডপত্র বের করতে বলা হলো।

আসহারি বলল, সম্রাট আমার আর্জি শুনেছেন, এতেই আমার জীবন ধন্য। পুরাতন রেকর্ড খোঁজার প্রয়োজন নেই।

সম্রাট বললেন, কী প্রয়োজন আর কী প্রয়োজন না, তা তোমার কাছ থেকে জানতে আমি আগ্রহী না। আমি আগ্রহী সেই গানটি শুনতে যা আমার মহান পিতা শুনেছিলেন। তুমি কি গান শোনাতে প্রস্তুত হয়ে এসেছ?

জি জাহাঁপনা। সঙ্গীতের আসর বসল। বাদ্যকররা আসহারির সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আসহারির গলার সমন্বয় করল।

আসহারি গান করল। গান শেষ হওয়ামাত্র সম্রাট হুমায়ূন ঘোষণা করলেন, পুরাতন নথিপত্র পরে ঘাটা হবে। এই মুহুর্তে গায়িকার ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা তাকে দেওয়া হোক। আমি এই গায়িকাকে আগ্রার বুলবুল সম্মানে সম্মানিত করলাম। আজ থেকে তার নামের আগে আগ্রার বুলবুল ব্যবহৃত হবে।

সভার নিয়ম অনুযায়ী সবাই একসঙ্গে বলল, মারহাবা! মারহাবা!

সম্রাট বললেন, আগ্রার বুলবুল আসহারি, তোমার কি আর কিছু বলার আছে?

আসহারি বলল, আছে। সম্রাটের অভয় পেলেই বলতে পারি।

বলো।

আমি হেরেমবাসী। এতগুলি স্বর্ণমুদ্রা লুকিয়ে রাখা হেরেমে সম্ভব না। আমি আমার এই সম্পদ রাজকোষে জমা দিতে চাই। সম্রাট অনেক জনহিতকর কাজে রাজকোষের সম্পদ ব্যবহার করেন। আমার সামান্য অর্থ সেই কাজে ব্যবহৃত হলেই আমি খুশি হব।

সম্রাট বললেন, তা-ই করা হবে। আমি আগ্রার বুলবুলের কথায় সন্তোষ লাভ করেছি।

দরবারে আম শেষ হওয়ার পর সম্রাট একটা ফরমান জারি করলেন। সেই ফরমানে বলা হলো—এখন থেকে সম্রাট যেখানে যাবেন, প্রমোদভ্রমণ হোক বা যুদ্ধযাত্রা, আগ্রার বুলবুল তাঁর সঙ্গে থাকবে। সে দশজন খোজা প্রহরী থাকবে। মিরনসুর’ পরগনা খেলাত হিসেবে আগ্রার বুলবুলকে দেওয়া হলো। এই পরগনার আয় আগ্রার বুলবুল আসহারি পাবে।

 

দুই মাসব্যাপী উৎসব শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড দাবদাহ। হঠাৎ শীতল হয়ে গেল। আগ্রার উপর ভারী বর্ষণ, এই সঙ্গে শিলাবৃষ্টি। দুই সের ওজনের একটি শিলা এক প্রজা নিয়ে এল বাদশাকে দেখাতে। সম্রাট খুশি হয়ে তাকে একটা আশরাফি দিলেন। এতবড় শিলা তিনি আগে কখনো দেখেন নি। তিনি তাঁর দিনলিপিতে লিখলেন, আল্লাহপাকের রহমত এবং নিদর্শন চারদিকে ছড়ানো। আমরা অন্ধ বলেই তা দেখি না। প্ৰকাণ্ড এক শিলার মাধ্যমে পরম করুণাময় তার নিদর্শন তাঁর দীন সেবককে দেখালেন। সোবাহানাল্লাহ।

শিলাখণ্ড গলিয়ে তার পানি সম্রাট পান করলেন। পানিতে বারুদের গন্ধ তাকে বিস্মিত করল। এটা কি কোনো যুদ্ধের আলামত? তাঁকে কি যুদ্ধযাত্রা করতে বলা হচ্ছে?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ