লীলাবতীর হাতের লেখা গোটা-গোটা। প্রতিটি অক্ষর স্পষ্ট। একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে নেই। মনে হতে পারে, সে প্রতিটি অক্ষর আলাদা করে লেখে এবং লিখতে সময় লাগে। আসলে তা না। সে অত্যন্ত দ্রুত লেখে। কিছুদিন পর-পর হঠাৎ করে তার লিখতে ইচ্ছা করে। লেখার ইচ্ছােটা যেমন হঠাৎ আসে। সেরকম হঠাৎই চলে যায়। খাতা-কলম নিয়ে বসার পেছনে লীলার মায়ের বেশ বড় ভূমিকা আছে। মা’র মৃত্যুর অনেক পরে ট্রাঙ্ক ঘাটতে গিয়ে লীলা তার মার লেখা কিছু কাগজপত্র পেয়েছে। ছােট ছােট টুকরো কাগজ। মজার মজার সব লেখা। কোনোটা চার-পাঁচ লাইন, কোনোটা আবার দেড়-দুই পাতা। কিছু লেখার শুরু আছে, শেষ নেই। সাংকেতিক ভাষায় লেখা কিছু কাগজও আছে। সেখানে সংকেত উদ্ধার কীভাবে করতে হবে তাও লেখা। যেমন এক জায়গায় লেখা–

ইহা সাংকেতিক পত্র। পড়িবার নিয়ম— যে অক্ষর পাঠ
করিবেন তাহার আগের অক্ষর ধরিতে হইবে।

উদাহরণ,

খড়িয— ইহার অর্থ করিম। খ হইবে ক, ড় হইবে র, য হইবে ম।

লীলা প্রতিটি লেখা পড়ে খুবই মজা পেয়েছে। লেখাগুলি সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মাঝে মাঝে পড়ে। কিছু কিছু সাংকেতিক চিঠির অর্থ সে উদ্ধার করতে পারে নি। যেমন একটা লেখা এরকম—

মত ৪০ নত ২৭ যত ১১
পিতা ৯৩২ মাতা ০৭ ভগ্নি ১২
অতঃপর ০০১২০৩৪০০৯৯২১
পক্ষী ৫ স্বৰ্গ ৩ আকাশ
১১-৩১-৫১-৯১-১৮

সাংকেতিক লেখার অর্থ উদ্ধারের কোনো সূত্রও মহিলা রেখে যান নি। লীলার ধারণা কোনো একদিন সাংকেতিক লেখার অর্থ তাঁর মেয়ে উদ্ধার করবে। এমন আশা নিয়েই সংকেতগুলি তৈরি করা। সে যেমন আগ্রহ করে মার লেখা পড়েছে, একদিন তার মেয়েও সেরকম আগ্রহ করে লীলার লেখা পড়বে। যখন লীলা লিখতে বসে তখন এই ব্যাপারটা তার মাথায় থাকে। এমন কিছু লেখা যাবে না। যা পড়ে তার মেয়ে মন-খারাপ করে। একবার লেখা শুরু হয়ে যাবার পর আর মেয়ের কথা লীলার মনে থাকে না।

মেঘলা সকাল। জানালা দিয়ে সামান্য আলো আসছে। পর্দা সরিয়ে দিলে কিছু আলো পাওয়া যেত। লীলা পর্দা সরায় নি। আধো আলো আধো অন্ধকারেই তার লিখতে ভালো লাগে। সে লিখছে—

গতকাল রাতে আমার খুব ভালো ঘুম হয়েছে। অথচ ভালো ঘুম হবার কথা ছিল না। আমার ঢাকায় যাবার কথা ছিল। আমি ঢাকায় না গিয়ে আবারো বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছি। সঙ্গে করে এক রোগীকে নিয়ে এসেছি। ভদ্রলোক স্থানীয় এক কলেজের শিক্ষক। তার নাম আনিস। ভদ্রলোক কুজো হয়ে হাঁটেন বলে তাঁর নাম কুঁজা মাস্টার। এই নামেই সবাই তাঁকে ডাকে।

বাড়িতে তাকে ফিরিয়ে আনা ঠিক হয় নি। কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তাঁর শরীর এখন ভয়ঙ্কর খারাপ। জ্বর একশ চার-একশ পাচের মধ্যে। মাথায় পানি ঢাললে জ্বর কিছু কমে। পানি ঢালা বন্ধ করলেই হুট করে বেড়ে যায়। রাতেই ডাক্তার ডেকে আনা হয়েছে। ডাক্তার রোগী দেখে বলেছেন, অবস্থা ভালো না। আজ রাতেই ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

ডাক্তাররা এ ধরনের কথা বললে আতঙ্কগ্ৰস্ত হতে হয়। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ডাক্তারের ভয়ঙ্কর কথা শোনার পরও কেউ আতঙ্কগ্ৰস্ত হলো না। পরে আসল রহস্য জানলাম। এই ডাক্তার (সতীশ পাল) নাকি নিদান ডাক্তার। রোগীর অবস্থার সামান্য উনিশ-বিশ দেখলেই তিনি নিদান ডাকেন। অর্থাৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, রোগী টিকবে না। যাদের সম্পর্কে তিনি এ-ধরনের কথা বলেছেন তারা কেউই না-কি মারা যায় নি। বরং যাদের সম্পর্কে নিদান ডাকা হয় নি তাদের কেউ-কেউ চলে গেছে। নিদান ডাক্তার সতীশবাবু যে-রোগী সম্পর্কে বলেন রোগী টিকবে না সেই রোগীর আত্মীয়স্বজনরা না-কি খুবই খুশি হন। হাস্যকর সব কাণ্ড! তবে সবার কথাবার্তায় আমি মজা পেয়েছি। ডাক্তার সাহেবের একটা ব্যাপার আমার ভালো লেগেছে— তিনি রোগীকে রেখে চলে যান নি। রোগীকে সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে গেছেন। সবচে যেটা অদ্ভুত, আমার বাবাও সঙ্গে গেছেন। এই বিষয়ে পরে লিখব।

খুব ক্লান্ত ছিলাম। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। ভেবে রেখেছিলাম গরম পানি দিয়ে গোসল করেই সরাসরি বিছানায় চলে যাব, তখন শুনলাম আমার মা আমার জন্যে রান্না করেছেন। কাজেই খিদে না থাকলেও খেতে বসতে হবে। আমি খুব সহজেই লিখলাম আমার মা, আসলে লেখা উচিত আমার সৎমা। সৎমা শুনতে ভালো লাগে না, লিখতেও ভালো লাগে না। এরচে সরাসরি মা লেখাই ভালো। এই মহিলা মানসিকভাবে অসুস্থ। কিন্তু আমি লক্ষ করেছি, বেশির ভাগ সময় তিনি আমার সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন। আমাদের দুজনের যখন কথাবার্তা হয় তখন বাইরে থেকে শুনে কারোর বোঝার সাধ্য নেই যে তিনি অসুস্থ। এই মহিলার কিছু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে বলেও আমার মনে হয়। মাঝে মাঝে ভবিষ্যতের কিছু কথা বলেন। সেগুলি ফলে যায়। কাকতালীয় হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।

আমার এই মা গতরাতে কাঁঠালের বিচি দিয়ে মুরগির মাংস রান্না করেছেন। কাঁঠালের বিচি তরকারি হিসেবে আমার খুব অপছন্দ। মানুষ কাঁঠাল যখন খায় তখন কাঁঠালের বিচিটা মুখে থাকে। মুখ থেকে বের করে। যে-জিনিসটা একজনের মুখ থেকে এসেছে সেটা খেতে আমার ঘেন্না করে। আমি খেতে বসলাম। মা নিজেই ভাড় বেড়ে দিলেন। তরকারির বাটিতে চামচ ডুবিয়ে তিনি থমকে গেলেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, মা, তুমি কাঁঠালের বিচি খাও না। তাই না? আমি বললাম, আপনি কী করে বুঝলেন?

তিনি তার জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, আমি মাংস আর ঝোল দিয়ে খাব। তিনি বললেন, না। তুমি একটু বসো, আমি ডিমের সালুন রান্না করে দিব। আমার সময় লাগবে না।

এই মহিলাকে একটা ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। আজ দেখি তিনি স্বাধীন মানুষের মতো চলাফেরা করছেন। তবে তাকে যে দূর থেকে লক্ষ করা হচ্ছে এটা আমি বুঝতে পারছি। বাবা লক্ষ করছেন। সুলেমান নামের বডিগার্ড ধরনের একজন কর্মচারী, সেও লক্ষ করছে।

রান্না করার সময় তিনি সহজ-স্বাভাবিক মানুষের মতো টুকটাক গল্প করতে লাগলেন। কী সুন্দর গল্প বলার ভঙ্গিা! হাত নাড়ছেন, শরীর দোলাচ্ছেন।

বুঝছে মা, আমার একটা ছোট ভাইন ছিল। তার নাম চঞ্চলি। চঞ্চল ছিল, এইজন্যে নাম চঞ্চলি। আমরা দুই ভাইন পুষকুনির পাড়ে গিয়েছি, তখন হঠাৎ আমার পা পিছল খাইল। আমি পড়ে গেলাম পানিতে। সাঁতার জানি না। ড়ুইবা যাইতেছি, তখন চঞ্চলি আমারে বাচানোর জন্যে লাফ দিয়া পানিতে পড়ল। আমি ঠিকই পানি থেকে উঠলাম, চঞ্চলি উঠল না। তবে তারে আমি প্রায়ই দেখি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথায় দেখেন?

আমার আশেপাশে দেখি। আমার বিছানায় বসে আমার সাথে গফসফ করে। হাসে। একবার সারা রাইত আমার সাথে শুইয়া আছিল।

এখন কি উনি আশেপাশে আছেন?

না এখন নাই। কেউ ধারে কাছে থাকলে আসে না। লজ্জা পায়।

আমি বললাম, মা, আপনি যা দেখেন সেটা চোখের ভুল। মৃত মানুষের ফিরে আসার ক্ষমতা থাকে না।

উনি আমার এই কথাটা খুব শান্ত ভঙ্গিতে শুনলেন। তারপর বললেন, হইতে পারে, আমি পাগল-মানুষ। পাগল-মানুষের তো কোনো দিশা থাকে না।

আমি আপনার চিকিৎসা করাতে চাই। ভালো চিকিৎসা। ঢাকায় নিয়ে আপনাকে বড় বড় ডাক্তার দেখাব। প্রয়োজনে দেশের বাইরে নিয়ে যাব। আপনার আপত্তি আছে?

আছে। আপত্তি আছে গো মা।

আপত্তি কেন?

ভালো হয়ে গেলে চঞ্চলিরে। আর দেখব না।

উনাকে হয়তো দেখবেন না। কিন্তু তার বদলে ভালো ভালো অনেক কিছু দেখবেন।

ভয়ঙ্কর খারাপ জিনিস দেখেছি গো মা। ভালো কিছু আমার দেখতে ইচ্ছা করে না।

ভয়ঙ্কর খারাপ কী দেখেছেন?

বলব। তোমারে একদিন বলব। কোনো-একজনরে বলতে ইচ্ছা করে।

এখনি বলুন, পরে আপনার মনে থাকবে না।

মনে থাকবে।

ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত খেলাম। তিনি পাশে বসে খাওয়ালেন এবং সারাক্ষণই পিঠে হাত দিয়ে রাখলেন। এত মমতায় তিনি কি তার নিজের ছেলেমেয়েকে কোনোদিন খাইয়েছেন? এই সুযোগ তাঁর পাওয়ার কথা না।

লীলা।

জি?

মাগো, খেয়ে মজা পাইতেছ?

পাচ্ছি।

চালতা দিয়ে ছোট মাছের তরকারি। আমি খুব ভালো রাঁধতে পারি। তোমারে রাইন্ধা খাওয়াব। ইনশাল্লাহ।

আচ্ছা।

আমার আরেকটা শখ আছে মা। পাগল-মাইনষের শখ। শখটা তুমি পূরণ করবা?

অবশ্যই করব। আপনি বলুন কী শখ?

একটা রাইত আমার সঙ্গে থাকবা। দু’জনে বিছানায় শুইয়া সারারাত গফসাফ করব।

অবশ্যই। আপনি যদি বলেন আমি আজই আপনার সঙ্গে ঘুমুতে পারি।

ভয় লাগবে না?

ভয় লাগবে কেন?

আমি পাগল-মানুষ। ঘুমের মধ্যে আমি যদি তোমার গলা চাইপ্যা ধরি?

না, আমার ভয় লাগবে না।

মহিলা খিলখিল করে হাসতে শুরু করলেন। হাসি আর থামেই না।

এই মহিলা প্রায়ই সিমাসা বলেন। সিমাসা হলো ধাঁধা। যেমন–

ভোলা মিয়ার শয়তানি
বাইরে লোহা ভিতরে পানি।

এর অর্থ হলো নারিকেল। আমার মা হলেন সিমাসা রানি। তিনি অসংখ্য সিমাসা জানেন। আবার সিমাসা মুখে মুখে তৈরিও করতে পারেন।

যাই হোক, রাতে আমি আমার নিজের ঘরে ঘুমুতে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা এসে উপস্থিত হলেন। তার সঙ্গে ফিরে আসার পর আমার কোনো কথা হয় নি। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি, তিনি আমাকে দেখে খুবই আনন্দিত হয়েছেন। তিনি হয়তো ভেবেছেন আমি নিজেই তার কাছে যাব। আমি যাই নি। তিনিও আমাকে ডাকেন নি। হয়তো আমাকে ডাকতে তাঁর অহঙ্কারে বেধেছে। এখন সমস্ত অহঙ্কার একপাশে ফেলে নিজেই এসেছেন। আমি বললাম, বাবা, কিছু বলবেন? তিনি বললেন, না। তিনি আমার ঘরে রাখা চেয়ারে বসলেন। আমি বললাম, বাবা আপনি খেয়েছেন? তিনি না-সূচক মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, আমি তো জানি না যে আপনি এখনো খান নি। তিনি বললেন, জানলে কী করতে?

জানলে আপনাকেও সঙ্গে নিয়ে খেতে বসতাম।

তিনি বললেন, আমার একা একা খাওয়ার অভ্যাস।

আমি বললাম, আমি যে-কয়দিন আপনার সঙ্গে থাকব আপনি আমার সঙ্গে খাবেন। বাবা কিছু বললেন না। কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো তিনি খুশি হয়েছেন। খুশির ভাবটা চাপতে চেষ্টা করছেন। চাপতে পারছেন না। আমি বললাম, রাত অনেক হয়েছে, খেতে চলুন। বলেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি ঘুমাও। আমি বললাম, আপনার খাওয়া হোক, তারপর ঘুমাব। আপনি যখন খাবেন আমি সামনে বসে থাকব।

বাবার খাবার সময় আমি পাশে বসে রইলাম এবং একটা কাণ্ড করে তাকে পুরোপুরি হকচাকিয়ে দিলাম। খাবার সময় মা যেভাবে আমার পিঠে হাত রেখেছিলেন। আমি ঠিক তা-ই করলাম। বাবার পিঠে হাত রাখলাম। আমি ভেবেছিলাম। তিনি খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকাবেন। তিনি তা করলেন না। যেভাবে খাচ্ছিলেন সেইভাবেই খেয়ে গেলেন। খাওয়া শেষ করে মুখে পান। দিলেন। সুলেমান এসে তার হাতে হুক্কা ধরিয়ে দিল। তিনি হুঙ্কার নিলে টান দিচ্ছেন। গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হচ্ছে। হুক্কার শব্দটা যে এত মজার তা আগে লক্ষ করি নি। শব্দটার মধ্যে ঘুমপাড়ানি ভাব আছে। আমার মনে হচ্ছে, বিশাল খটটার একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ভালো লাগত।

লীলা!

জি?

ঘুম পাচ্ছে মা?

জি।

তাহলে ঘুমাও। আরাম করে ঘুমাও। এই খাটে তোমার মা ঘুমাত।

বাবার এই কথা আগেও একবার শুনেছি। সেবার বিস্মিত হয়েছিলাম। আজ হঠাৎ বলে ফেললাম, শুধু মা ঘুমান নি। মার পরে আরো একজন ঘুমিয়েছেন। কথাটা বলেই আমার মনে হলো আমি কাজটা ঠিক করি নি। এই কথাটা না বললেও চলত। আমি লক্ষ করলাম। বাবার হুক্কা টানা বন্ধ হয়ে গেছে। তার মুখের চামড়া একটু যেন শক্ত হয়ে গেল। তিনি হুক্কার নল একপাশে রেখে শরীর ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বড় করে নিঃশ্বাস টেনে কথা বলা শুরু করলেন–লীলা শোনো। তোমার মা’র মৃত্যুর অনেক দিন পরে আমি বিবাহ করি। তোমার মা এবং আমি যে-খাটে ঘুমাতাম, সেই খাটটা খুলে রেখে দেয়া হয়েছিল। তুমি আসার পর খাটটা জোড়া লাগানো হয়েছে। তুমি বিষয়টা লক্ষ করো নাই। অতিরিক্ত বুদ্ধিমান মানুষদের সমস্যা কী জানো মা? তাদের প্রধান সমস্যা….

এই পর্যন্ত বলেই তিনি চুপ করে গেলেন। হুঙ্কার নলটা টানতে শুরু করলেন। আবারো ঘুম-পাড়ানি গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হচ্ছে। আমি বললাম, আপনি আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। তিনি বললেন, যাও, ঘুমাতে যাও। তিনি এখন আর মায়ের খাটে আমাকে ঘুমুতে বললেন না। প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পাল্টাবার জন্যেই হয়তো বললেন, আনিস ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তিত আছি। ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তুমি ভালো করেছ না মন্দ করেছ বুঝতে পারছি না। নিতান্তই পল্লীগ্রাম, চিকিৎসার সুব্যবস্থাও নাই।

আমি বললাম, উনাকে নিয়ে ঢাকা পর্যন্ত যাবার অবস্থা ছিল না।

মা যেমন আমার পিঠে হাত রেখে আমাকে হকচকিয়ে দিয়েছিলেন, বাবা এখন তা-ই করলেন, এমন একটা কথা বললেন যে আমি নিজে পুরোপুরি হ’কচাকিয়ে গেলাম। তিনি হঠাৎ হুক্কা টানা বন্ধ করে আমার দিকে তাকালেন— শান্ত গলায় বললেন, এই ছেলেটাকে কি তোমার পছন্দ?

আমি জবাব দিলাম না। বাবা বললেন, অনেক সময় মানুষ তার নিজের পছন্দের কথা নিজে বুঝতে পারে না। বোকাদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে না। বোকারা খুব ভালোমতো জানে কোনটা তার পছন্দ, কোনটা তার পছন্দ না। মাসুদের কথা ধরো। সে ভালোমতো জানে পরীবানু নামের মেয়েটাকে তার পছন্দ। এই মেয়েটার জন্যে যা-কিছু মানুষের পক্ষে করা সম্ভব তা সে করবে। মাসুদ যদি তোমার মতো অতি বুদ্ধিমান কেউ হতো তাহলে সে তার পছন্দের ব্যাপারটা ধরতে পারত না। তার মাথার মধ্যে নানান হিসাব-নিকাশ খেলা করত।

আপনার ধারণা আমার খুব বুদ্ধি?

হ্যাঁ, আমার তা-ই ধারণা।

আমি বললাম, অসুস্থ মানুষটাকে দেখে আমার খুব মায়া লেগেছে। পছন্দ বলতে এইটুকুই। আপনি যে-অর্থে পছন্দের কথা বলছেন— সেই অর্থে না।

বাবা বললেন, না হলেই ভালো।

না হলেই ভালো কেন?

অপদার্থ ধরনের ছেলে। অপদাৰ্থ মানুষরা তাদের আশেপাশের মানুষকেও অপদাৰ্থ বানিয়ে ফেলে। তাছাড়া তার মাথাও কিঞ্চিৎ খারাপ বলে আমার ধারণা।

আপনার এরকম ধারণার পেছনে কারণ কী?

চোখের চাউনি দেখে মনে হয়েছে। পাগলদের চোখের চাউনি সাধারণ মানুষের মতো না। পাগলদের দৃষ্টি আমার মতো ভালো কেউ জানে না। এই প্রসঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন নেই। যাও, ঘুমাতে যাও। আমার মনটা আজ কিঞ্চিৎ খারাপ। কিঞ্চিৎ না, একটু বেশিই খারাপ। মন-খারাপ নিয়ে আমি কথা বলতে পারি না।

মন-খারাপ কেন?

বাবা চাপা গলায় বললেন, সুলেমান আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছে। এটা জানতে পেরেছি বলেই মন-খারাপ। এরা আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে— কথা গোপন করবে, এটা আমি কল্পনাও করি নি।

আমি বললাম, কী কথা গোপন করেছে?

বাবা শান্ত গলায় বললেন, মাসুদ পরীবানু মেয়েটিকে গোপনে বিবাহ করেছে। মৌলানা ডেকে বিবাহ। এই ঘটনা সুলেমান-লোকমান দুজনই জানে। কিন্তু কেউ আমাকে কিছু বলে নাই।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি কি নিশ্চিত মাসুদ বিয়ে করেছে?

হুঁ। ব্যাপারটা সবাই জানে। শুধু আমি জানি না। আনিস মাস্টারও জানে।

আপনি এখন কী করবেন?

আমার কী করা উচিত?

পরীবানুকে বাড়িতে নিয়ে আসা উচিত।

কথাটা চিন্তা-ভাবনা করে বলেছ?

আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। বাবা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তাঁর চোখে পলক পড়ছে না। নিম্পলক চোখে তাকিয়ে তিনি কী দেখার চেষ্টা করছেন? আমার চোখে উন্মাদের দৃষ্টি আছে কি না?

তুমি বলতে চোচ্ছ পরীবানু মেয়েটিকে এই বাড়িতে নিয়ে আসা উচিত?

জি।

আর মাসুদের ব্যাপারে কী করণীয়? আচ্ছা থাক, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। তুমি ঘুমাও। ফি আমানিল্লাহ। দরজার খিল লাগায়ে শুয়ে পড়ে। একা ভয় পাবে না তো?

জি না।

রমিলা মাঝেমধ্যে খুব চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ তার চিৎকার শুনলে ভয় পেতে পার।

আমি ভয় পাব না।

বাবা খাট থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তোমার উপর দায়িত্ব দিলাম। এই বাড়িতে পরীবানুকে আনার। পরীবানুর দায়িত্ব তোমার। মাসুদের দায়িত্ব আমার।

বাবা চলে গেলেন। তখনো আমি জানি না যে আনিস সাহেবকে নিয়ে বাবা নিজেই ময়মনসিংহ রওনা হয়েছেন। এটা আমি জানলাম। পরদিন সকালে। আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না।

এখন আমি আমার ভাই মাসুদ সম্পর্কে কিছু বলি। প্রথমে চেহারার বর্ণনা— সুপুরুষ। স্বাস্থ্য ভালো। চোখ বড় বড় (আমার বাবার চোখও বড় বড়, এটা মনে হয়। আমাদের পারিবারিক বিশেষত্ব। সবার চোখ বড় বড়)। মাথার চুল কোকড়ানো।

স্বভাব— কথা কম বলে। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। তাকে দেখলেই মনে হয় কোনো ভয়ে সে অস্থির হয়ে আছে। কথা বলার সময় সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকাবে। ভীতু প্রকৃতির ছেলে, তবে গলার স্বর ভারী এবং গম্ভীর। সে গান-বাজনা কেমন শিখেছে জানি না, তবে সে শিস বাজিয়ে পাখিদের শিসের নকল করতে পারে। তার শিস বাজানোর সুন্দর একটা ঘটনা বলি। আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে শহরবাড়ি যাচ্ছি। একটা বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে পথ। হঠাৎ মাসুদ বলল, বুবু, একটা মজা দেখবে?

আমি বললাম, কী মজা?

মাসুদ হাত মুখের কাছে ধরে শিস দিতে লাগল। বুলবুলি পাখি যেরকম শিস দেয় সেরকম শিস। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বুলবুলি পাখি শিস দিতে লাগল। তারপর আরো কয়েকটা। আমি অবাক। মাসুদ বলল, বুবু, আমি ঘুঘু পাখির ডাক ডাকতে পারি। আমি যখন ঘুঘুর ডাক ডাকি, তখন বনের ঘুঘুও ডাকে।

বাবা বাড়িতে নেই, ময়মনসিংহ গিয়েছেন–এই খবর পেয়েই মনে হয়। মাসুদ বাড়িতে উপস্থিত। এমনভাবে সে হাঁটাহাঁটি করছে যেন সে-ই বাড়ির কর্তা। মুখভর্তি পান। পান চিবিয়ে বেশ কায়দা করে পানের পিক ফেলছে। আমি বললাম, মাসুদ, তুমি না-কি বিয়ে করেছ?

মাসুদ পানের পিক ফেলে বলল, করতেও পারি।

আমি বললাম, করতেও পারি। আবার কী? হয় বলো করেছি। অথবা বলো করি নাই।

মাসুদ বলল, আমি অধিক কথা বলি না।

আমি বললাম, বাবা খুব রাগ করেছেন।

মাসুদ বলল, আমি এইসব কেয়ার করি না।

সে যে সত্যিই কেয়ার করে না এটা বুঝাবার জন্যেই বোধহয় ছিপ নিয়ে মাছ মারতে গেল। সেই মাছ মারার আয়োজনও বড়। একজন গেল তার মাথায় ছাতি ধরার জন্যে। একজন গেল হারমোনিকা বাদক। একজন ঢোল নিয়ে গেল।

ঘটনা কী হচ্ছে দেখতে গেলাম। দেখি মচ্ছবি বসে গেছে। মাসুদের মাথার উপর চাঁদোয়া টানানো হয়েছে। কনসার্ট হচ্ছে, হারমোনিকা বাজছে, বাঁশি বাজছে, ঢোল-তবলা বাজছে। দলে মঞ্জুমামাও উপস্থিত। তার হাতে খঞ্জনি। তিনি মহানন্দে মাথা দুলিয়ে খঞ্জনি বাজাচ্ছেন।

মাসুদ ভালোই বাড়াবাড়ি করল, দুপুরে খাসি কিনে আনতে লোক পাঠাল। তার না-কি খিচুড়ি এবং খাসির মাংস খেতে ইচ্ছা করছে। এই মাংস সে নিজেই রাধবে।

রাধুক। তার যা ইচ্ছা সে করুক। আমাদের সবার জগৎ আলাদা। মাসুদের জগৎ মাসুদের। আমারটা আমার।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ