মাসুদ একটা কাঠবাদাম গাছের নিচে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। কাঠবাদাম গাছের পাতা বড় বড়— ছায়াময়। সে তার মাথা ছায়ায় রেখে শরীর রোদে মেলে। দিয়েছে। শীতকালের রোদের চিড়বিড়ানি সমস্যা থাকলেও রোদ আরামদায়ক। আরামে মাসুদের ঘুম এসে যাচ্ছে। সে ঠিক করেছে কিছুক্ষণ ঘুমাবে। দুপুরে চাপ খাওয়া হয়েছে, এখন দরকার ঘুম। অজগর সাপের মতো ঘুম। অজগর সাপ আস্ত ছাগল গিলে একনাগাড়ে সাতদিন ঘুমায়। সেও এখন অজগর।

ঘুমের আগে আগে নানান চিন্তা করতে তার ভালো লাগে। বেশির ভাগ চিন্তাই থাকে পরীবানুকে নিয়ে। যেমন সে তার নতুন কেনা হারকিউলিস্ সাইকেলে করে ধর্মপাশা যাচ্ছে। সাইকেলের পেছনে বসেছে পরীবানু। সাইকেল যাচ্ছে শা, শা করে। পরীবানু আতঙ্কে চিৎকার করছে— আস্তে চালাও, আস্তে। সে পরীবানুর কোনো কথাই শুনছে না। সাইকেলের গতি আরো বাড়াচ্ছে। একসময় সাইকেল থেকে মোটর গাড়ির মতো ভটভট শব্দ হতেও শুরু করেছে। সাইকেল হয়ে গেল মোটরসাইকেল।

চিত্তার মধ্যে যাত্ৰাদলের দৃশ্যও থাকে। যাত্ৰাদলের নাম নিউ অপেরা পার্টি। যাত্ৰাদলের অধিকারী এবং প্রধান অভিনেতা সে নিজে। পরী করে সামান্য সখির পার্ট। পরীর জীবনের প্রধান ইচ্ছা যাত্ৰাদলের মূল অভিনেতা মাসুদ সাহেবের সাথে একটা পাট করা। লজায় সে তার মনের গোপন কথা কাউকে বলতে পারে না। শুধু চোখের পানি ফেলে। একদিন এই দৃশ্য সে দেখে ফেলল। মেয়েটির কাছে গিয়ে বলল, কাদো কেন? তোমার অন্তরে কিসের যাতনা?

মেয়েটা গানের সুরে বলল—

আমার কথা আমি জানি না
জানে বনের পাখি
আমার কষ্ট হয় না পষ্ট
আমারে দেয় ফাঁকি।

বাবা সিদ্দিকুর রহমান সাহেব। চিন্তাটা চলে যাচ্ছে খারাপ দিকে। বাবাকে নিয়ে খারাপ চিন্তা করা ঠিক না। কিন্তু মাসুদ চিন্তাটাকে আটকাতে পারছে না। মাসুদ কল্পনায় দেখছে, তার বাবা ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে। কুঁজা মাস্টারকে হাসপাতালে ভর্তি করে তিনি হাসপাতালের বাইরে এসে সিগারেট ধরালেন। সতীশ ডাওগারকে পাঠালেন জর্দা দিয়ে পান নিয়ে আসতে। সতীশ ডাক্তার পান আনতে গেল। সিদ্দিকুর রহমান সিগারেটে টান দিলেন, এই সময় তার শুরু হলো বুকে ব্যথা। তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। তাকে ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি দেখার দায়িত্ব এখন থেকে আমার একমাত্র পুত্র মাসুদের। তাকে খবর দিয়ে আনো। বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে তাকে কিছু উপদেশ দিব। আমার সময় শেষ। বলতে বলতেই মৃত্যু। চারদিকে বিরাট হৈচৈ, কান্নাকাটি।

বাবার মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করতে অস্বস্তি লাগায় মাসুদ তার চিন্তাটাকে সামান্য ঘুরিয়ে দিল। নতুন চিন্তায় তিনি মারা গেলেন না। তবে তাঁর পক্ষাঘাত হলো। সমস্ত শরীর অবশ। কথাও পরিষ্কার বলতে পারেন না। কিছু কথা বোঝা যায়, কিছু যায় না। তাকে খাটিয়াতে করে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন— এখন থেকে যাবতীয় কাজ-কর্ম দেখবে আমার একমাত্র পুত্র মাসুদুর রহমান। আমি যেহেতু বেশিদিন বাঁচব না, সেই কারণে ধুমধাম করে পুত্রের বিবাহ দিতে চাই। স্যাকরা খবর দিয়ে আনো। আমি আমার পুত্রবধু পরীবানুকে গয়না দিয়ে মুড়ে দিব। দাড়িপাল্লায় ওজন করে সোনা দিব। দাড়িপাল্লার একদিকে থাকবে পরীবানু আরেক দিকে সোনা।

মাসুদ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাল। ঘুম থেকে উঠে খোঁজ নিল তার বাবা ফিরেছেন কি-না। জানা গেল। তিনি ফিরেন নাই। মাসুদ তখন বাজারের দোকান থেকে তার সাইকেল বের করল। এই সাইকেল সে গত বছর গোপনে কিনেছে। লুকিয়ে রেখেছে বাজারের দোকানে। আজ সাইকেল বের করার শুভ দিন। সাইকেলে ডায়নোমো বসানো লাইট আছে। ডায়নোমার একটা অংশ ঘুরন্ত চাকার সঙ্গে লাগিয়ে দিলেই বাতি জ্বলে। বাতির খুবই পাওয়ার। দিনের মতো আলো হয়ে যায়। সাইকেলের ঘণ্টাও সুন্দর। জলতরঙ্গের মতো শব্দ হয়।

পরীবানু তার সাইকেলের ব্যাপারটা জানে না। সাইকেল নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে কি-না— এই বিষয়েও মাসুদ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। মনে হয় যাওয়াটা ঠিক হবে না। পরীবানুর অতিরিক্ত প্রশ্ন করা স্বভাব। সাইকেল দেখে একহাজার প্রশ্ন করবে। মেয়েছেলের প্রশ্নের জবাব দেওয়া এক দিগদারি।

সাইকেল কিনেছ টাকা পেয়েছ। কোথায়? টাকা কি চুরি করেছ? কী সর্বনাশ, তুমি চোর!

দিগদারি প্রশ্ন শুনতেও ভালো লাগে না, প্রশ্নের জবাব দিতেও ইচ্ছা করে না। মাসুদ পরীবানুর বাড়ির কাছাকাছি এসে সিদ্ধান্ত নিল, পরীবানুর সঙ্গে দেখা করবে না। বরং সাইকেল নিয়ে চলে যাবে ধর্মপাশা। ধর্মপাশা এখান থেকে দশবারো মাইল। কাঁচারাস্তা হলেও ডিসট্রিক বোর্ডের সুন্দর সড়ক। খানাখন্দ কম। সাইকেল নিয়ে একটানে চলে যাওয়া যাবে।

ধর্মপাশায় গুনীন সুরুজ মিয়া থাকেন। তন্ত্ৰ-মন্ত্রের সাগর। জানেন না হেন জিনিস নেই। কোনো মুসলমানের কালী সাধনা থাকে না। উনার কালী সাধনাও আছে। মাসুদ কয়েকবারই তার কাছ থেকে জিনিসপত্র নিয়েছে। ফল পাওয়া গেছে। উনার মন্ত্র পড়া সুরমার নাম-ডাক আছে। এই সুরমা চোখে মেখে কঠিন হাকিমের সামনে দাঁড়ালে ঘটনা ঘটে। হাকিম যখন সুরমা দেয়া চোখের দিকে তাকান তখনই একশান হয়, হাকিমের দিল নরম হয়। যতবার তাকাবেন। ততবার দিল নরম হবে। গুনিন সুরুজ মিয়ার সুরমা চোখে দিয়ে অনেক খুনের আসামি খালাস পেয়ে গেছে।

মাসুদ পড়া সুরমার জন্যে সুরুজ মিয়াকে দশ টাকা। গত মাসের সাত তারিখ দিয়ে গেছে। অমাবস্যা ছাড়া সুরমায় মন্ত্র দেয়া যায় না। মাঝখানে অমাবস্যা গেছে। এখন ধর্মপাশা গেলে সুরমা নিয়ে আসা যাবে। মাসুদ ঠিক করে রেখেছে, এখন থেকে বাবার সামনে পড়ার আগে চোখে সুরমা দিবে। তার বাবা তো হাকিমের মতোই।

ধর্মপাশায় যাবার আরেকটি কারণ আছে। ধর্মপাশার নূর হোসেনের কাছে হারমোনিয়াম কেনার জন্যে একশ’ টাকা দিয়ে রেখেছে। নূর হোসেন বাদ্য-বাজনার জিনিস ভালো চেনে। মাসুদের দরকার মেলডি কোম্পানির ডাবল রিড হারমোনিয়াম। নূর হোসেনের কলিকাতা থেকে হারমোনিযাম আনিয়ে রাখার কথা। কলিকাতার সাথে নূর হোসেনের যোগাযোগ আছে। সে যদি হারমোনিয়াম এনে থাকে তাহলে সাইকেলের কেরিয়ারে করে নিয়ে আসবে। নয়াবাজারের দোকানে লুকিয়ে রাখবে। মাসুদের বাবা নয়াবাজারে কখনোই যান না।

আকাশে পঞ্চমীর চাঁদ। ফাঁকা সড়ক। সড়কের ধুলায় চাঁদের আলো পড়েছে। চিকচিক করছে। সড়কটাকে মাসুদের মনে হচ্ছে নদীর মতো। কিছুদূর গিয়েই মাসুদের মনখারাপ হয়ে গেল। পরীবানুর জন্যে মন টানছে। এমনই মন টানছে যে পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। ধর্মপাশা আরেক দিন যাওয়া যাবে। আজ রাতটা না হয় পরীবানুর সঙ্গে কাটুক। পরীবানু তার বিবাহিতা স্ত্রী। সে যদি পরীবানুর সঙ্গে থাকে কারো কিছু বলার নাই। সে পরীবানুর বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে সাইকেলের ঘণ্টা দিতে পারে। গলা উচিয়ে ডাকতেও পারে— পরী! পরীবানু!

মাসুদ সড়কের মাঝখানে ব্রেক কষে সাইকেল থামাল। সে অনেকদূর এসে পড়েছে। অর্ধেকের বেশি। এখন সে কী করবে? ধর্মপাশা যাবে না পরীবানুর কাছে ফেরত যাবে? লটারি করলে হয়। লটারিতে যেটা ওঠে। সেটা। লটারি করার বুদ্ধি কী? মাসুদ ঠিক করল, সে সাইকেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার চোখ থাকবে রাস্তার দুই দিকে। যদি সে দেখে ধর্মপাশার দিক থেকে কেউ আসছে তাহলে সে রওনা হবে ধর্মপাশা। যদি দেখা যায় নয়াপাড়ার দিক থেকে কেউ আসছে তাহলে যাবে নয়াপাড়া। রাত তেমন হয় নি। কিন্তু চারদিক নীরব। রাস্তায় কোনো লোক চলাচল নেই। মাসুদ অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করতে তার খুবই ভালো লাগছে।

 

সাইকেলের ঘণ্টা বাজাতে হলো না, তার আগেই পরীবানু দরজা খুলে বের হয়ে এলো। তার হাতে কুপি। কুপির লাল আলো পড়েছে তার মুখে। কী সুন্দর যে তাকে লাগছে! সাইকেল হাতে মাসুদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে মোটেই অবাক হলো না। যেন সে জানত নিশিরাতে মাসুদ এসে উপস্থিত হবে।

মাসুদ গলা নিচু করে বলল, সবাই কি ঘুমে?

পরীবানু বলল, হুঁ।

তোমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ?

পরীবানু বলল, সাইকেল রেখে হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে যাও। কল পাড়ে সাবানা-গামছা আছে।

মাসুদ বলল, কল চাপার শব্দে তোমাদের বাড়ির লোকজনের যদি ঘুম ভেঙে যায়?

পরীবানু বলল, ঘুম ভাঙলে ভাঙবে। তুমি কি পৃথিবীর সবাইকেই ভয় পাও?

মাসুদ বলল, আরে না। ভয় পাব কী জন্যে? ভাব দেখাই যে ভয় পাই। আসলে পাই না।

পরীবানু কাল চাপছে। মাসুদ চোখে-মুখে পানি দিচ্ছে। পানি গরম। মাসুদ বলল, একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছি। গরমের সময় টিউব কলের পানি থাকে ঠাণ্ডা। আর শীতের সময় গরম। ঘটনা চমৎকার না?

হুঁ।

তুমি এত গম্ভীর কেন? মন কি কোনো কারণে খারাপ?

না।

জব্বর ভুখ লাগছে। ঘরে কি চিড়-মুড়ি আছে?

পরীবানু জবাব দিল না। মাসুদ বলল, কিছু না থাকলে নাই। গল্প করে রাত পার করে দিব। খালি পেটে আলাপ ভালো জমে এটা জানো?

না।

খালি পেটে আলাপ ভালো জমে, ভরা পেটে জমে ঘুম। হা হা হা। ভালো বলেছি না?

হুঁ।

মাসুদ পরীবানুর ঘরের মেঝেতে পাতা পাটিতে বসে আছে। তার সামনে থালায় গরম ভাত। সঙ্গে বেগুন দিয়ে ডিমের সালুন। মাসুদের অতি পছন্দের জিনিস। ভাত কিছুক্ষণ আগে রান্না হয়েছে। ধোঁয়া উঠছে। ভাতের উপর গরম ঘি দুই চামচ ঢালা হয়েছে। ঘিয়ের সুঘাণে মাসুদ মোহিত হয়ে গেল।

মাসুদ বলল, কে রাঁধল? তুমি?

পরীবানু বলল, আমার বাড়িতে কি দশটা দাসী-বান্দি আছে?

অতি সুখাদ্য হয়েছে।

এখনো তো মুখে দেও নাই। বুঝলে কীভাবে?

দর্শনে বুঝা যায়। পহেলা দর্শনধারী।

পরীবানু হাতে পাখা নিয়ে বসেছে। গরম ভাত পাখা নেড়ে ঠাণ্ডা করছে। তার ঠোঁটে চাপা হাসি। সেই হাসি একটু বাড়ল। শব্দময় হলো। সে সঙ্গে সঙ্গেই হাসি বন্ধ করে বলল, দর্শনে সব বোঝা যায় না। তোমাকে দেখে বোঝার উপায় নাই যে তুমি বোকা।

আমি বোকা?

হুঁ।

মাসুদ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, পরী শোনো, আমি বোকা হই। আর যাই হই এখন বিরাট এক দায়িত্ব আমার হাতে।

কী দায়িত্ব?

খাঁ বাড়ির সবকিছু এখন আমার দেখা লাগবে, উপায় নাই। বাবার অবস্থা খারাপ। পক্ষাঘাত হয়েছে, উনার নড়ার অবস্থা না।

তোমাকে বলেছে কে?

খবর আসছে। সাইকেল নিয়া এইজন্যে টেলিগ্রাফ অফিসে গেলাম। পোষ্টমাস্টার সাহেবের সঙ্গে কথা বললাম। টেলিগ্রাফ উনার কাছে এসেছে।

পরীবানু বলল, বাবার অবস্থা কি খুবই খারাপ?

ডাক্তাররা বলেছে উনি টিকতে নাও পারেন।

তুমি তাহলে এখানে বসে আছ কেন? ময়মনসিংহ যাও।

যাব। কাল সকালে যাব। তোমারে খবরটা দিতে আসছি।

পরীবানু পাখা দিয়ে হাওয়া করা বন্ধ করে শান্ত গলায় বলল, সবসময় মিথ্যা বলা ঠিক না। সবসময় মিথ্যা বললে অভ্যাস হয়ে যাবে। সত্য কথা বলতে পারবা না।

মাসুদ খাওয়া বন্ধ করে আহত গলায় বলল, কোনটা মিথ্যা বললাম? যাও কোরান মজিদ আনো। কোরান মজিদে হাত দিয়া বলব— যা বলেছি। সত্য বলেছি। বসে আছ কেন? কোরান মজিদ নিয়ে আসো।

বামেলা করো না। ভাত খাও।

আমি যে সত্য বলতেছি— এটা ফয়সালা না হলে ভাত মুখে দিব না। ভাত এখন আমার কাছে শিয়ালের গু।

পরীবানু বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি সত্য বলতেছ। আমার ভুল হয়েছে। মাফ চাই।

মাসুদ বলল, বাপজানের অসুখ নিয়া আমি মিথ্যা বলব না। এটা তোমার বোঝা উচিত।

পরীবানু বলল, একবার তো বলেছি। ভুল করেছি। সালুন ভালো হয়েছে?

হ্যাঁ ভালো হয়েছে। ডিমের সালুন আমার প্রিয়। অত্যধিক প্রিয়। একটা ডিম দিয়ে আমি দুই গামলা ভাত খেতে পারি।

মাসুদ খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। বারান্দায় গেল হাত ধুতে। পরীবানু। জগে করে পানি ঢালছে, মাসুদ হাত ধুচ্ছে। মাসুদের মন আনন্দে পূর্ণ। পরীবানু। আশপাশে থাকলেই তার ভালো লাগে। আজ অন্যদিনের চেয়েও বেশি ভালো লাগছে। পরীবানু বলল, তোমারে একটা খবর দেওয়া হয় নাই। তোমার বাবা সন্ধ্যার সময় ফিরে আসছেন। খবর পাঠায়েছেন, আগামীকাল সন্ধ্যার পর আমাকে তুলে নেবেন।

মাসুদের মুখ হা হয়ে গেল।

পরীবানু সহজ গলায় বলল, পান দিব?

মাসুদ জবাব দিতে পারল না। সে পরীবানুর দিকে তাকিয়ে আছে। পঞ্চমীর চাঁদ ড়ুবে যাচ্ছে। তার কিছু আলো এখনো অবশিষ্ট আছে। সেই আলোয় পরীবানুকে কী সুন্দর যে লাগছে!

পরীবানু বলল, তুমি এই বাড়িতে থাকবে, না চলে যাবে?

মাসুদ বলল, বুঝতেছি না। আমার কী করা উচিত?

পরীবানু বলল, তোমার নিজ বাড়িতে চলে যাওয়া উচিত।

কেন?

তোমার বাবা হঠাৎ খোঁজ করে যদি তোমাকে না পান তাহলে মিজাজ খারাপ করবেন।

মাসুদ বলল, আমার উপরে উনার মিজাজ আর খারাপ হবে না। আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। ধর্মপাশার সুরুজ গুনীনের পড়া সুরমা চোখে দিয়া রাখব। সঙ্গে সঙ্গে একশান।

পরীবানু হাসছে। শব্দ করেই হাসছে।

মাসুদ আহত গলায় বলল, হাসো কেন?

পরীবানু বলল, তুমি পুলাপানের মতো কথা বলবা, আমি হাসব না!

মাসুদ বলল, পুলাপানের কথা কী বললাম?

পরীবানু বলল, যাও বাড়িতে যাও।

মাসুদ বলল, বাড়িতে যাব না। ধর্মপাশা যাব। সুরমা নিয়া আসব। সাইকেলে শ্যা শা করে চলে যাব।

নতুন সাইকেল কিনেছ?

হুঁ।

টাকা কই পেয়েছ?

মাসুদ বলল, টাকা-পয়সা মেয়েছেলের দেখার বিষয় না। টাকা-পয়সা নিয়া

কথা বলব না।

মেয়েছেলে কী করবে? ভাত সালুন রানবে?

হুঁ।

প্রতি বৎসর একটা করে সন্তান দিবে?

কী প্যাচাল শুরু করলা? পান দিবা বলছিলা পান কই? সামান্য জর্দা দিও। জর্দা বিহীন পান আর নুন বিহন সালুন একই।

পরীবানু বলল, তুমি যে আমাকে মিথ্যা বললা এই বিষয়ে কিছু বলব না?

মাসুদ কিছু বলল না। উদাস চোখে সাইকেলের দিকে তাকিয়ে রইল।

 

মাসুদ পান চিবাচ্ছে। আড়চোখে পরীবানুর দিকে তাকাচ্ছে। পরীবানুর মুখের ভাব দেখার চেষ্টা করছে। মাসুদ যখন মুখ ভর্তি করে পান খায় তখন যদি পরীবানু আশপাশে থাকে তাহলে একটা ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পরীবানু তার হাত বাড়িয়ে দেয় মুখের চাবানো পানের জন্যে। এই ঘটনা আজ ঘটছে না। পরীবানু হাত বাড়াচ্ছে না। মাসুদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে কি তার মিথ্যা কথায় রাগ করেছে? স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে টুকটাক মিথ্যা বলবে, এতে দোষ হয় না।

পরী!

হুঁ।

পান খাবে?

না।

রাগ করেছ না-কি?

না, আমার শরীরে এত রাগ নাই। তাছাড়া মা কি ছেলের উপর রাগ করতে পারে?

মাসুদ হতভম্ব গলায় বলল, মা কে? আর ছেলে কে?

পরীবানু হাসতে হাসতে বলল, আমি মা, তুমি ছেলে। মনে নাই তুমি আমাকে মা ডাকলা? পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলা?

রাগে মাসুদের গা জুলে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে পরীবানুর গালে ঠাশ করে একটা চড় লাগাতে। স্ত্রীকে শাসন করার জন্যে মাঝেমধ্যে তার গায়ে হাত তোলা জায়েজ আছে। জুম্মাঘরের ইমাম শুক্রবারে খুতবা পাঠের পর বলেছেন। উনি তো না জেনে বলেন নাই। জেনেশুনে বলেছেন।

পরীবানুর গালে সে যে একটা চড় বসাবে— এই বিষয়ে মাসুদ পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল, কিন্তু তার রাগ সেরকমভাবে উঠছে না। সব দিন তার রাগ দ্রুত উঠে না।

পরী!

হুঁ।

এই ধরনের কথা আর কোনোদিন বলব না।

আচ্ছা বলব না।

পরীবানু মাসুদের মুখের কাছে হাত বাড়িয়েছে। এখন সে পান খাবে। মাসুদের আবার মন খারাপ হয়ে গেল। মাসুদের মুখে কোনো পান নেই। রাগের কারণে পান গিলে ফেলেছে।

মাসুদ বলল, পরী, আমার একটা কথা রাখবা?

পরীবানু বলল, তোমার একটা কথা না, সব কথাই রাখব।

মাসুদ বলল, কথাটা কী শুনলে তুমি পিছাইয়া পড়বা। যদি রাখো তাহলে ভবিষ্যতে তোমার দশটা অপরাধ ক্ষমা করব।

কথাটা কী?

রাত অনেক হয়েছে। গ্রামের মানুষজন ঘুমে। আসমানে চাঁদও নাই। অন্ধকার।

কথাটা বলো।

তুমি আমার সাইকেলের পিছনে বসো। আমি তোমারে নিয়া ঘুরব। কেউ কিছু জানব না। রাজি আছ?

পরীবানু ক্ষীণস্বরে বলল, হুঁ।

 

মাসুদ গাছপালার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে সাইকেল চালাচ্ছে। একসময় সে নদীর দিকে চলল। নদীর পাড়ে চর পড়েছে। ফাঁকা চরে সাইকেল চালানোর মজাই অন্যরকম। পরীবানুর শুরুতে ভয় ভয় লাগছিল, এখন মজাই লাগছে। সে ক্ষণে ক্ষণে চাপা গলায় হাসছে।

কে? মাসুদ না? মাসুদ, এদিকে আসো।

নদীর চরে সিদ্দিকুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর একপাশে লোকমান একপাশে সুলেমান। সুলেমানের হাতে বন্দুক। তাঁর গলার স্বর শুনেই মাসুদ সাইকেল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সিদ্দিকুর রহমান আবার ডাকলেন, মাসুদ কাছে আসো।

মাসুদ বাবার কথার পর পরই সাইকেল নিয়ে ঝড়ের গতিতে বের হয়ে গেল। পরীবানুর কথা একবারও তার মনে হলো না। সিদ্দিকুর রহমান লোকমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, লোকমান, তুমি মেয়েটাকে তার বাড়িতে পৌছে দিয়ে আসো।

 

নদীর পাড় ঘেঁসে সিদ্দিকুর রহমান হাঁটছেন। সুলেমান তার পিছু পিছু যাচ্ছে। সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। রাত-বিরাতে এইভাবে বের হওয়া ঠিক না। কখন কী ঘটে তার কি ঠিক আছে?

সুলেমান!

জি চাচাজি।

আমার গাধা ছেলে স্ত্রীকে সাইকেলের পিছনে নিয়া চক্কর দিতেছিল। দৃশ্যটা তোমার কাছে কেমন লাগল?

ভালো না চাচাজি। বিরাট অন্যায় হয়েছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার কাছে ভালো লেগেছে। আমি আনন্দ পেয়েছি। গাধাটাকে আমি ডেকেছিলাম কী জন্যে জানো? গাধাটাকে ডেকেছিলাম একটা কথা বলার জন্যে। কথাটা হলো–যা তুই যতক্ষণ ইচ্ছা সাইকেলে করে চঞ্চর দে।

সুলেমান চাপা নিঃশ্বাস ফেলল। সে এতদিন ধরে মানুষটার সঙ্গে আছে, তারপরেও মানুষটার বিষয়ে সে কিছুই জানে না। এটা কেমন করে হয়?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ