প্রায় আধঘণ্টার উপর ট্রেন থেমে আছে।

কোন থেমে আছে। কেউ বলতে পারছে না। কতক্ষণ থেমে থাকবে তাও কেউ বলতে পারছে না। ব্যাপারটা নিয়ে কাউকে চিন্তিত মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সবাই খুশি। জানালার পাশে একটা সিট নিয়ে লীলা বসেছে। বেঞ্চের সর্বশেষ সিট বলে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে। লীলার পাশেই মঞ্জু। তার হাতে ফ্লাস্ক ভর্তি গরম পানি। চা বানানোর সরঞ্জাম। ভদ্রলোকের প্রধান শখ চলন্ত ট্রেন বা বাসে নিজের হাতে বানিয়ে চা খাওয়া। মঞ্জুর মেজাজ খারাপ। তার আরো কিছুদিন থাকার ইচ্ছা ছিল। জায়গাটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার আগেই চলে যেতে হচ্ছে এটা কেমন কথা? চলে আসার সময় কইতরী এমন কান্না শুরু করল যে তার নিজের চোখেও পানি এসে গেল। তিনি গম্ভীর গলায় ঘোষণা দিলেন– মা, কাঁদিস না। আমি লীলাকে পৌছে দিয়ে চলে আসব। তারপর যতদিন ইচ্ছা নিজের মতো থাকব। ভদ্রলোকের এককথা। আমি ভদ্রলোক।

লীলাদের উল্টোদিকের বেঞ্চে কান্ত হয়ে আনিসুর রহমান শুয়ে আছে। এই গরমেও তার গায়ে মোটা চাদর। শীত লাগছে–এই কথাটা সে কাউকে বলতেও পারছে না। আশেপাশে কেউ থাকলে সুটকেস খুলিয়ে সুটকেস থেকে সে আরেকটা চাদর বার করত। পায়ের তালুতে শীত বেশি লাগছে। একজোড়া মোজা পরলেও হতো। সে চোখ খোলা রাখতে পারছে না। চোখে রোদ লাগছে।

আনিসুর রহমান কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে যাচ্ছে মায়ের কাছে। ডাক্তার দেখিয়ে প্রথমে শরীর সারাবে। পরেরটা পরে দেখা যাবে। তার যাত্ৰাসঙ্গী হয়েছে বড় সাহেবের মেয়ে লীলা। এটা অস্বস্তিকর। পরিচিত কেউ না থাকলে ভালো হতো। পরিচিত কেউ থাকা মানেই কিছু সৌজন্যমূলক কথাবার্তা। অসুস্থ অবস্থায় কোনো কথাবার্তা বলতে ইচ্ছা করে না। কথা শুনতেও ভালো লাগে না। তবে লীলা মেয়েটা ভালো। তার মধ্যে লোক দেখানো ব্যাপারটা নেই। শরীর কেমন? খারাপ লাগছে?— এই জাতীয় কোনো কথাই সে বলছে না। জানোলা দিয়ে মুখ বের করে সে আছে নিজের মতো। মঞ্জু আনিসের কাছে এসে বলল, আমার কাছে বালিশ আছে, নিজের বালিশ বিছানার চাদর ছাড়া আমি বের হই না। আপনাকে দেব?

আনিস বলল, না।

লাগলে বলবেন, লেজা করবেন না। আমার হলো উঠল বাই তো কটক যাই সিস্টেম। ব্যােগ গোছানোই থাকে। ব্যাগে লুঙ্গি, মশারি, দড়ি, টর্চলাইট, হাতুড়ি সব পাবেন। মেডিসিন বক্স একটা আছে, সেখানে যাবতীয় এসেনসিয়াল ড্রাগ পাবেন। পেট খারাপ হয়েছে— ফ্রাজিল আছে। মাথা ধরার ওষুধ আছে, জ্বর কমানোর ওষুধ আছে। থার্মোমিটার আছে। প্ৰেশার মাপার যন্ত্র আছে।

আনিস বলল, ভালো তো!

মঞ্জু বলল, ভালো-মন্দ জানি না। আমি সবসময় তৈরি থাকতে পছন্দ করি। দেখি, আপনার জ্বর কত মেপে দেই।

আনিস বলল, দরকার নেই।

মঞ্জু বলল, অবশ্যই দরকার আছে। আপনার চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। জ্বর একশ দুইয়ের উপরে। জ্বর একশ দুই ক্রস করলে চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়।

প্লিজ, আমার কিছু লাগবে না।

শুনলাম আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফর গুড চলে যাচ্ছেন? চির বিদায়।

হুঁ।

সঙ্গে ক্ল্যাশ হয়েছিল?

হুঁ।

কলেজের প্রফেসরের চাকরি তো ভালো চাকরি। ছাড়লেন কেন? কারো সঙ্গে কি ক্ল্যাশ হয়েছিল?

হুঁ।

কার সঙ্গে?

আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। কিছু মনে করবেন না।

মঞ্জু কিছু মনে করল বলে মনে হলো না। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফ্রাঙ্ক নিয়ে। ফ্লাস্কের মুখ খুলছে না। মনে হয় প্যাচ কেটে গেছে।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এতক্ষণ কামরাভর্তি লোক ছিল, এখন প্রায় ফাকা। এই কামরায় যারা এসেছিল তারা লীলাকে উঠিয়ে দিতে এসেছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল, সিট দখল করে বসে থাকবে যাতে বাইরের কেউ উঠতে না পারে। ট্রেন ছেড়ে দেবার সময় নেমে যাবে।

আনিসের পায়ের কাছে দুই ভদ্রলোক বসেছেন। মনে হয় রাজনীতির লোক। ক্রমাগত বকবক করে যাচ্ছে—

যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেছে, উচিত শিক্ষা হয়েছে। এখন বুঝ কত ধানে কত চাল! ইস্কান্দর মীর্জা সাহেব উচিত কাজ করেছেন।

ইস্কান্দর মীর্জটা কে?

মেজর জেনারেল। কঠিন লোক। বাঙালির জন্যে দরকার কঠিন লোক।

রাজনীতির আলাপে উৎসাহিত হয়ে মঞ্জু। তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো এবং অতি দ্রুত একমত হলো যে, পূর্ববাংলার গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কঠিন চীজ। সে পানি ছাড়াই চিড়া ভিজাতে পারে। আলোচকদের গলা উঁচু থেকে উঁচু হচ্ছে। আনিস একবার শুধু বলল, একটু আস্তে কথা বলবেন? কেউ তা শুনল না।

লীলা জানোলা দিয়ে তাকিয়ে আছে। কেন জানি তার খুব মজা লাগছে। নয়াপাড়া নামের জায়গাটায় সে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে। জায়গাটার জন্যে কিছুটা হলেও তার মনখারাপ লাগা উচিত। তা লাগছে না। ভাবটা এরকম যে সে একটা জরুরি কাজে গিয়েছিল। কাজ শেষ হয়েছে, এখন ফিরে যাচ্ছে। মন খারাপ করা বা বিষন্ন হবার মতো কিছুই ঘটে নি। যদিও লীলার সৎমা খুব কান্নাকাটি করলেন। মস্তিষ্কবিকৃত মানুষের কান্নাকাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কিছু নেই। তারা কারণ ছাড়াই কাব্দে। রমিলা লীলার হাত ধরে বিস্মিত গলায় বললেন, চইল্যা যাবা? লীলা বলল, আমি সারাজীবন এখানে থাকার জন্যে আসি নাই। আপনাদের দেখার শখ ছিল। দেখেছি, শখ মিটেছে। এখন চলে যাচ্ছি।

থাকলে কী হয়?

থাকলে কিছু হয় না। কিন্তু আমি আরো পড়াশোনা করব। এখানে পড়াশোনা করব কোথায়?

পড়াশোনা না করলে কী হয়?

লীলা হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে বলল, আমার প্রসঙ্গে আপনি যে কথা বলেছিলেন তা কিন্তু হয় নি।

কী বলেছিলাম?

আপনি বলেছিলেন। আমি এইখানেই থাকব, কোথাও যাব না।

পাগল-মানুষের কথা।

লীলা বলল, আপনি ভালো থাকবেন। নিজের যত্ন নেবেন।

রমিলা তখন কাঁদতে শুরু করলেন। সৎমায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়া লীলার জন্যে কঠিন হয়ে দাঁড়াল। একসময় সিদ্দিকুর রহমান এসে বললেন, মেয়ের হাত ছাড়ো। তাকে যেতে দাও। রমিলা তৎক্ষণাৎ লীলার হাত ছেড়ে একপাশে গুটিয়ে গেলেন। ভীতচোখে তাকাতে লাগলেন। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, যে যেতে চায় তাকে জাপটে ধরে রাখা যায় না। বুঝেছ? রমিলা ভীত গলায় ফিসফিস করে বললেন, বুঝেছি।

বিদায়মুহূর্তে সিদ্দিকুর রহমান মেয়েকে কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে একটা নাটক হয়েছে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত। চুপচাপ থাকাই বাঞ্ছনীয়।

নাটক তৈরি হয়েছে মাসুদকে নিয়ে। সে ভোরবেলায় এসে উপস্থিত। চোখমুখ শুকনা। মাথার চুল উঠে গেছে। দেখে মনে হয়েছে কয়েক দিন না খেয়ে আছে। গালের চামড়া দেবে আছে। চোখের নিচে কালি। সিদ্দিকুর রহমান কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আছ কেমন?

মাসুদ অস্পষ্ট স্বরে বলল, ভালো।

দেশ-বিদেশ ঘুরলা?

মাসুদ কিছু বলল না। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ফিরে আসলা কেন?

মাসুদ চুপ করে রইল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, জবান বন্ধ কেন? কথা বলো। কার টানে ফিরলা? আমার টানে ফিরো নাই এইটা আমি জানি। আমার জন্যে এত টান কারোর নাই। তুমি তোমার ভাইবোনের জন্যেও ফিরো নাই। ঘরবাড়ির টানেও ফিরো নাই। তুমি কি পরীবানুর টানে ফিরেছ? দেখা হয়েছে তার সাথে?

মাসুদ জবাব দিচ্ছে না। সে আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে। সিদ্দিকুর রহমান আবারো বললেন, পরীবানুর সঙ্গে দেখা হয়েছে? হ্যাঁ কিংবা না একটা কিছু বলো।

মাসুদ বলল, জি দেখা হয়েছে।

পরীবানু তোমাকে দেখে খুশি হয়েছে?

মাসুদ চুপ করে আছে। সিদ্দিকুর রহমান হুক্কায় লম্বা টান দিয়ে সুলেমানকে ডেকে সহজ গলায় বললেন, তোমাকে বলছিলাম মাসুদ যে-ট্রেনে নামবে সেই ট্রেনেই তাকে কানে ধরে তুলে দিবে। এই কাজটা তুমি করো নাই। যা-ই হোক, সকাল দশটায় একটা ট্রেন আছে। ঐ ট্রেনে তুলে দাও।

সুলেমান হ্যাঁ-সূচক ঘাড় কাত করল। সিদ্দিকুর রহমান সহজ গলায় বললেন, কানে ধরে নিয়ে যাবে। ভুল হয় না যেন।

সুলেমান আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

লীলা বিচারপ্রক্রিয়া শুনল। কিছুই বলল না। সে এই বাড়িতে আর থাকছে। না। চলে যাচ্ছে। বাড়ির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যোগ রাখার আর অর্থ হয় না। পৃথিবীর সবকিছু তার নিজের নিয়মে চলে। এই বাড়ি চলবে বাড়ির নিয়মে। এই বাড়ির নিয়ম যদি হয় কথায়-কথায় কানো ধরে ঘোরানো তাহলে তা-ই সই। লীলা যখন তার ব্যাগ গোছাচ্ছিল তখন মাসুদ এসে তার সামনে দাঁড়াল। লীলা বলল, কিছু বলবে? মাসুদ কথা বলে নি। লীলা একবার ভাবল কিছু উপদেশ দেয়। তেমন কোনো উপদেশ তার মাথায় আসে নি। লীলা বলল, তুমি কিছু বলতে চাইলে বলো। মাসুদ তখন বিড়বিড় করে বলল, আমাকে আপনার সঙ্গে নিবেন?

লীলা বলল, না।

মাসুদ বলল, আমি কী করব বলে দেন।

লীলা বলল, তুমি কী করবে সেটা তুমি চিন্তা করে বের করবে।

মাসুদ সামনে থেকে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি তাকে কানে ধরে স্টেশনের দিকে নিয়ে গেল সুলেমান। সুলেমানের পেছনে আছে লাঠি হাতে লোকমান। তাদের পেছনে গ্রামের কিছু লোকজন, কিছু বাচ্চ-কাচ্চা। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব বলে দিয়েছিলেন ছেলেকে যেন পরীবানুর বাড়ির সামনে কিছুক্ষণ রাখা হয়। সেই কাজটা করা হলো। পরীবানু বাড়ি থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ এই দৃশ্য দেখে বাড়িতে ঢুকে গেল।

 

ট্রেন ছুটছে। আকাশ মেঘলা। বাইরের পৃথিবী অন্ধকার দেখাচ্ছে। দেখতে ভালো লাগছে। দূরের গাছপালাকে কুচকুচে কালো লাগছে।

বাবার কাছ থেকে বিদায়ের দৃশ্য কেমন হবে এটা নিয়ে লীলার মনে সামান্য দুশ্চিন্তা ছিল। তবে লীলা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে আবেগঘন কিছু হবে না। বাবা স্বাভাবিক সৌজন্যের কিছু কথাবার্তা বলবেন। লীলা ঠিক করেছে, সে বিদায় নেবার সময় তীক্ষ্ণ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তার দেখার ইচ্ছা এই অতি কঠিন মানুষটার চোখে পানি আসে কি-না। পানি না এলেও চোখ কি ছলছল করবে?

সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, ফি আমানিল্লাহ। যাও। তুমি এসেছিলে, মনে তৃপ্তি পেয়েছি, এর বেশি আমার কিছু বলার নাই। তোমার দাদির একটা গয়না আমার কাছে আছে। আমার খুব শখ গয়নাটা তোমাকে দেই। গয়নাটা নিবে?

লীলা বলল, না।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমার মায়ের একটা খাতা আমার কাছে আছে। নানান সময়ে সে গুটুর গুটুর করে কী সব লিখত। এই বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় সে খাতাটা ফেলে গেছে। মনে হয় ইচ্ছা করেই ফেলে গেছে। তুমি চাইলে খাতাটা তোমাকে দিতে পারি।

ইচ্ছা করে ফেলে যাবে কেন?

খাতায় আমার সম্পর্কে, আমার দাদিজান সম্পর্কে অনেক অন্দমন্দ কথা আছে। মনে হয় তোমার মা চেয়েছিল। আমি লেখা পড়ে মনে কষ্ট পাই।

খাতাটা আমি নিব।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মা শোনো, তোমার পড়াশোনার খরচ, বিবাহের খরচ সব আমি দিতে চাই।

আপনাকে কিছু দিতে হবে না।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বাবা, আমি এখন রওনা দেই।

তোমার জন্যে পালকি আনতে লোক গেছে। পালকি আসুক, তারপরে যাবে।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে লীলা লক্ষ করল, তার বাবার চোখে পানি। তিনি চট করে মাথা সরিয়ে ফেললেন যেন লীলা চোখের পানি দেখতে না পায়।

 

মায়ের লেখা খাতা লীলা বেশ খানিকটা পড়ে ফেলেছে পালকিতে আসতে আসতে–

আজ শুক্রবার। জুম্মাবার। আমার মনে কোনো শান্তি নাই। আমি আজ ফজরের নামাজ পড়িয়া আল্লাহপাককে বলিয়াছি— ও আল্লাহগো, ও দয়াময়, তুমি দয়া করো। তুমি ডাইনির হাত হইতে আমাকে উদ্ধার কর। মানুষ কী প্রকারে এমন হইতে পারে?

আমি আমার দাদি শাশুড়িকে ডাইনি বলিতেছি। ইহা অতীব অন্যায়। কিন্তু কত দুঃখে বলিতেছি, তাহা কি কেউ বুঝিবে? গত বুধবারের ঘটনা। বুধবারে এই অঞ্চলে বিরাট হাট বসে। উনি লোকজন নিয়া হাটে গিয়াছেন। বাড়ি প্রায় খালি। আমার দাদিশাশুড়ি আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমি উনার সম্মুখে উপস্থিত হইতেই উনি বলিলেন, নাতবউ, তোমার বুনি দুইটা এত বড় কেন? বিবাহের পূর্বেই কেউ হাতাপিতা করিয়াছে? বিবাহের পূর্বে হাতাপিতা করলে বুনি বড় হয়।

আমি এতই অবাক হইলাম যে আমার জবান বন্ধ হইল। আমি চুপ করিয়া আছি, তখন ডাইনি বলিল, ব্লাউজ খোল, আমি তোমার বুনি দেখব।

আমি বলিলাম, আপনি যদি আমাকে কোনোদিন এই জাতীয় কথা বলেন। তাহলে আমি খেজুরের কাঁটা দিয়া আপনার চোখ গালাইয়া দিব। আল্লাহর কসাম।

এই হইল ঘটনা। এই ঘটনা আমি কাহাকে বলিব? কে আমার কথা শুনিবে? উনি তাহার দাদিজানের বিষয়ে অন্ধ। কেন অন্ধ তাহাও বুঝি না।

ও আল্লাহপাক, ও দয়াময়, তুমি এই খবিস ডাইনির হাত হইতে আমাকে উদ্ধার করো।

 

লীলা ট্রেনের জানালা থেকে মাথা ভেতরে নিয়ে এলো। হঠাৎ তার খানিকটা মন খারাপ লাগছে। কেন লাগছে তা বুঝতে পারছে না। সে মঞ্জুমামার দিকে তাকাল। বেচারার আরো কিছুদিন থাকার ইচ্ছা ছিল। লীলা জোর করেই তাকে নিয়ে এসেছে। ট্রেনে উঠার সময় তার বেশ মন খারাপ ছিল। এখন আর মন খারাপ নেই। মহাউৎসাহে তিনি রাজনীতির আলাপ জুড়েছেন।

শুনেন, পরিষ্কার হিসাব শুনেন–বাঙালি জাতি যুক্তভাবে কিছু করতে পারে না। বাঙালি বিযুক্ত জাতি। ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াইয়ের জাতি। এখানে যুক্তফ্রন্ট চলে? চলে না। হক সাহেব বিরাট বোকামি করেছেন। আমাদের দরকার লাঠির শাসন। মিলিটারির শাসন। বাঙালি গরমের ভক্ত, নরমের যম। বুঝেছেন কিছু?

লীলা চোখ বন্ধ করে আছে। চলন্ত ট্রেনে তার সবসময় ঘুম পায়। ছাড়া ছাড়া ঘুম না, গাঢ় ঘুম। ঘুমের মধ্যে বিচিত্র সব স্বপ্ন। মঞ্জুমামার রাজনীতির গল্প শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখল— এক থুড়গুড়ি বুড়ি তার পাশে বসে আছে। বুড়ি ফোকলা দাতে পান খাচ্ছে। পানের লাল রস গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বুড়ি বলল, এই মেয়ে তোর নাম লীলা না? তুই আয়নার মেয়ে না?

লীলা বলল, জি।

বুড়ি বলল, তোর মা কি জীবিত আছে না মারা গেছে?

মা মারা গেছেন।

কস কী! আমি তো যাইতেছি তোর মার সাথে সাক্ষাতের জন্যে। মারা গেলে সাক্ষাৎ ক্যামনে হইব?

আপনি কে?

আমি তোর মায়ের দাদি শাশুড়ি। তুই তো আমারে কদমবুসিও করলি না। কদমবুসি কর।

আমি আপনাকে কদমবুসি করব না।

অবশ্যই করবি। তোর বাপ করে, তুই করবি না। এইটা কেমন কথা?

বুড়ি কদমবুসি করানোর জন্যে লীলার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল। তখনি লীলার ঘুম ভাঙিল। হাত ধরে টানাটানি করছেন মঞ্জুমামা। তার মুখ আতঙ্কগ্ৰস্ত। লীলা বলল, কী হয়েছে মামা?

খুবই খারাপ অবস্থা। অবস্থা ফর্টি নাইন।

অবস্থা ফর্টি নাইন মানে কী?

ঐ লোক তো মারা যাচ্ছে।

আমাদের সঙ্গে যে যাচ্ছে। কলেজের টিচার।

আনিসুর রহমান সাহেব? জ্বর বেড়েছে?

জ্বর বাড়াবাড়ি না। উনি নিজেই এখন আগ্নেয়গিরি।

বলো কী!

বদনায় পানি ঢেলে এই জ্বর কমানো যাবে না। দমকলে খবর দিতে হবে। এরকম সিরিয়াস রোগী সঙ্গে আনাই ঠিক হয় নি। হুশ করে মারা যাবে। আমরা ডেড়বডি নিয়ে পড়ব বিপদে। শরীরে হাত রাখলে হাত গরমে পুড়ে যাচ্ছে, আবার পায়ের তলা বরফের মতো ঠাণ্ডা। এটা খারাপ লক্ষণ।

লীলা উঠে এলো। আনিসের মাথার কাছে বসতে বসতে বলল, আপনার জ্বর নাকি খুব বেড়েছে? আনিস জবাব দিল না। লীলা বলল, আপনি তো থারথার করে কাপছেন। শীত লাগছে?

জি।

লীলা আনিসের কপালে হাত রাখল। আনিস চমকে উঠল। হিম-শীতল হাত। লীলা বলল, আপনি যখন ট্রেনে উঠেছেন তখনো কি আপনার এত জ্বর ছিল?

জ্বর ছিল, এতটা ছিল কি-না জানি না।

আপনার মাথায় পানি ঢালা দরকার। ট্রেনের কামরায় পানি ঢালব কীভাবে বুঝতে পারছি না।

কিছু করতে হবে না। ধন্যবাদ।

লীলা বলল, আপনি তো আমাদের সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছেন না, আপনি যাবেন আপনার মায়ের কাছে। ভৈরব স্টেশনে নামবেন তাই না?

হুঁ।

স্টেশন থেকে একা যাবেন?

আনিস বিড়বিড় করে বলল, জানি না।

জানি না মানে কী?

আনিস জবাব দিল না। তার শরীর কাঁপছে। থারথার করে কাঁপছে। মুখে ফেনা জমছে। মঞ্জু বলল— ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনার মৃগী বেরাম আছে। ভালো বিপদে পড়লাম দেখি!

লীলা বলল, বিপদ তো বটেই, কী করা যায় সেটা ভেবে বের করো।

আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না।

লীলা বলল, সামনের স্টেশনে ট্রেন থামবে। সেখানে আমরা উনাকে নিয়ে নেমে পড়ব। সেখান থেকে রিটার্ন ট্রেন যদি পাওয়া যায় তাহলে ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাব। আর যদি ট্রেন না পাওয়া যায় তাহলে মহিষের গাড়ি কিংবা গরুর গাড়িতে বাড়ি ফিরব। আমরা তো মাত্র একটা স্টেশন পার হয়েছি। বেশিদূর তো যাই নাই।

মঞ্জু বিরক্ত মুখে বলল, লীলা, তোর তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

লীলা বলল, মামা, আমার মাথা খারাপ হয় নি। আমার চেয়ে ভালো বুদ্ধি যদি কিছু তোমার মাথায় আসে তুমি বলো, আমি শুনিব। উনার জ্বর যেভাবে বাড়ছে উনি তো কিছুক্ষণের মধ্যে কোমায় চলে যাবেন।

কোমায় যাক কিংবা সেমিকোলনে যাক, আমরা কি তাকে নিয়ে ফেরত যাব না-কি! এই লোকের দরকার চিকিৎসা। তাকে কোনো একটা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। বাড়িতে নিয়ে লাভ কী? বাড়িতে কি হাসপাতাল আছে?

হাসপাতাল না থাকলেও সেবাযত্ন আছে। বাজারে পাশ করা ডাক্তার আছে।

বাড়িতে ফেরত যাবি?

হুঁ।

ঘটনা। যদি তার আগেই ঘটে যায় তাহলে কী করবি?

লীলা জবাব দিল না। সে আনিসের কপালে আবারো হাত রাখল। আনিস চমকে উঠল। তার কাছে মনে হচ্ছে, বরফের একটা খণ্ড তার মাথায় কেউ রেখেছে। বরফের ভেতর থেকে শুকনা বকুল ফুলের গন্ধের মতো গন্ধ নাকে আসছে। বরফ যেমন ঠাণ্ডা, বকুল ফুলের গন্ধটাও ঠাণ্ডা। নাকের ভেতর দিয়ে গন্ধটা ঢুকছে, সবকিছু ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। আনিস বলল, পানি খাব। বলেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। মেঘলা দিন, কামরার ভেতর তেমন আলো নেই, তবু সে চোখ মেলে রাখতে পারছে না। চোখের ভেতর কড়া আলো ঢুকে যাচ্ছে। চোখ কড়াকড়ি করছে।

কেউ-একজন চামচে করে তার ঠোটে পানি ধরছে। সেই কেউ-একজনটা কে? একটু আগে সে তাকে চিনতে পারছিল, এখন আর চিনতে পারছে না। তবে চেনা-চেনা লাগছে। ও আচ্ছা! মনে পড়ছে—যূথি। মা’র সঙ্গে রাগ করে সে কাঁচি দিয়ে খ্যাচ করে মাথার একগাদা চুল কেটে ফেলে, চুলের শোকে কেঁদে অস্থির। সে যূথিকে বলেছিল, এই যূথি, তুই তো তোর কাটা চুলগুলি ফেলেই দিবি— এক কাজ কর, আমাকে দিয়ে দে। যূথি বলল, তুমি চুল দিয়ে কী করবে? সে বলল, জমা করে রাখব। একটা কোটায় ভরে সুটকেসে রেখে দেবী। যূথি বলল, চুল রেখে কী হবে? আসল মানুষটাকে রেখে দাও। বলেই কী ভয়ঙ্কর লজ্জা যে পেল! পরের তিনদিন তার আর দেখা নাই। এত যার লজ্জা সে কীভাবে অবলীলায় বলল, চুল রেখে কী হবে? আসল মানুষটাকে রেখে দাও। যূথির বয়স তখন কত হবে, চোদ-পনেরোর বেশি হবে না। এই বয়সে মেয়েদের আবেগও বেশি থাকে, লজ্জাও বেশি থাকে। বয়স যত বাড়তে থাকে লজা-আবেগ দুটাই কমতে থাকে।

আনিসের বুক শুকিয়ে আসছে। সে বিড়বিড় করে বলল, যূথি, পানি খাব। যূথি চামচে করে ঠোঁটে পানি দিচ্ছে। এত ঠাণ্ডা পানি সে কোথায় পেয়েছে কে জানে! মনে হচ্ছে সমস্ত মুখ ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, যূথির সঙ্গে এইভাবে ট্রেনে দেখা হয়ে গেল! বেচারির ঘাড়ে এসে পড়ল রোগীর যত্ন। চামচে করে পানি খাওয়াতে হচ্ছে। আনিসের যখন টাইফয়েড হলো তখনো যূথি খুব সেবা করেছে। যূথি মেয়েটার জন্মই হয়েছে সেবা করার জন্যে। আনিসের হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। সে ক্লান্ত গলায় বলল, যূথি, তোমার চুলগুলি আমি খুব যত্ন করে রেখেছি। একটা হরলিক্সের কৌটায় ভরে সুটকেসে রেখে দিয়েছি। যূথি বলল, শুধু রেখে দিলে তো হবে না। মাঝে মাঝে বের করে রোদে দিতে হবে। সাজি মাটি দিয়ে ধুতে হবে।

কথাগুলি কি সত্যি যূথি বলছে, না অন্য কেউ বলছে? যূথি খুব নরম করে কথা বলে, এমন কঠিন করে কাটা কাটা ধরনের কথা বলে না। কে কথা বলছে চোখ মেলে দেখতে পারলে হতো। চোখ মেলা যাচ্ছে না। আনিস বুঝতে পারছে সে গভীর অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ হচ্ছে, কিন্তু সে ট্রেনে করে যাচ্ছে না। সে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে।

আরে এ তো দেখি আরেক ঘটনা। মালেকভাইকে দেখা যাচ্ছে। মালেক ভাইয়ের চোখে কালো চশমা। চাদর দিয়ে শরীর ঢাকা।

মালেক ভাই, ছাড়া পেলেন কবে?

আনিস!

জি মালেক ভাই।

মারা যাচ্ছ না-কি?

জি।

মৃত্যু খারাপ জিনিস না। মৃত্যু ভালো জিনিস।

জি।

সাহসী মানুষ মৃত্যুকে হাসিমুখে গ্ৰহণ করে।

জি।

আনিস, তুমি কি সাহসী?

জি না।

স্বদেশী আন্দোলনের সময় ছেলেগুলি যে ফাঁসিতে ঝুলেছে তারা সবাই যে ভয়ঙ্কর সাহসী ছিল তা-না। পরিস্থিতি তাদের সাহসী করেছে।

জি।

স্বদেশী আন্দোলন থেকে মুসলমান ছেলেরা পিছিয়ে গেল কেন আনিস?

আমি জানি না মালেক ভাই।

কেন জানবে না? অবশ্যই জানো। আমি তোমাকে ব্যাখ্যা করেছি।

এখন আমার কিছু মনে পড়ছে না মালেক ভাই। আমার শরীর খুব খারাপ। আমার জ্বর এসেছে। আমার মাথা এলোমেলো।

তাহলে আমি বলি, তুমি শোনো।

মালেক ভাই, আজ বাদ থাক।

বাদ থাকবে কেন? তুমি চোখ বন্ধ করে শোনো। তোমার পাশে যে রূপবতী বসে আছে সে কে?

তার নাম যূথি।

যূথি বলছি কেন? তার নাম তো লীলাবতী।

ও হ্যাঁ, লীলাবতী। জ্বরের কারণে আমার মাথার ঠিক নাই। কী বলতে কী বলছি।

মেয়েটার সঙ্গে তোমার প্রেম হয়ে যায় নাই তো?

জি না।

গুড। ভেরি গুড। প্রেম হচ্ছে হৃদয়ের দুর্বলতা। আমরা সর্বক্ষেত্রে হৃদয়ের দুর্বলতা পরিহার করব।

জি।

এখন শোনো, মুসলমান ছেলেরা কেন স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরে গেল।

আজ থাক মালেকভাই। শোনো, মন দিয়ে শোনো–স্বদেশীরা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ বই থেকে প্রেরণা পেত। এই বইয়ের মূলমন্ত্র বন্দেমাতরম গান–

বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।
তুংহি দূৰ্গা দশপ্রহরণ ধারিণী…

কোনো মুসলমান ছেলে কি এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নিতে পারে?

আপনি তো মুসলমান না! আপনি আল্লাহই বিশ্বাস করেন না।

আমার কথা আসছে কেন? আমি তো স্বদেশী আন্দোলন করছি না। আমি একজন কমিউনিষ্ট। আমি সাম্যের কথা বলি–বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্য।

মালেক ভাই, আমার মাথাটা একটু তুলে ধরবেন! আমি বমি করব।

ঐ মেয়েটাকে বলো–কী যেন তার নাম? লীলাবতী।

পণ্ডিত ভাস্করাচার্যের একমাত্র কন্যা–লীলাবতী।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ