লীলাদের বাড়ি মঞ্জুর পছন্দ হয়েছে। এ বাড়িতে আজ তাঁর তৃতীয় দিবস। পছন্দের মাত্রা প্রতিদিনই বাড়ছে। লক্ষণ ভালো নয়। চক্রবৃদ্ধি হারে যদি পছন্দ বাড়তে থাকে তাহলে একসময় দেখা যাবে তিনি এখানেই স্থায়ী হয়েছেন। তিনি কোথাও স্থায়ী হতে চান না। শিকড় বসানো গাছের স্বভাব। তিনি গাছ না, মানুষ। মানুষের কোথাও শিকড় বসাতে নেই।

তবে এই বাড়ির প্রতিটি মানুষকে তার মনে ধরেছে। সবচে মনে ধরেছে লীলার দুই বোনকে। কইতরী এবং জইতরী। আদর করে এদেরকে এখন তিনি ডাকছেন ‘কই’ এবং জই। কইতরী তার সঙ্গে আছে ছায়ার মতো। জাইতরী তাকে লক্ষ করে দূর থেকে। সে হয়। দরজার আড়াল থেকে তাকে দেখবে কিংবা গাছের আড়াল থেকে দেখবে। কইতরীর মতো রূপবতী বালিকা তিনি তাঁর জীবনে দ্বিতীয়টি দেখেন নি— এই ঘোষণা কয়েকবারই দেওয়া হয়েছে। কইতরীকে নিয়ে তিনি খানিকটা দুশ্চিন্তাও বোধ করেছেন। অতি বড় রূপসী ঘর পায় না— এই প্রবাদের কারণে। তাছাড়া মেয়েটির চুলও লাল। লাল চুলের মেয়েরা কোথাও স্থায়ী হতে পারে না। তাদের কলমিলতার মতো ঘুরে বেড়াতে হয়।

উঁচু কপালি চিড়ল দন্তী পিঙ্গল কেশ
ঘুরবে কন্যা নানান দেশ।

মঞ্জুর সেবার জন্যে যাকে নিযুক্ত করা হয়েছে তাকেও তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। লোকটির নাম বন্দু। বয়স ত্ৰিশের মতো। গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের ক্ষীণকায় একজন মানুষ। ছয় ফুটের মতো লম্বা। সে মনে হয় তার শারীরিক দৈর্ঘের কারণে লজ্জিত। তার চেষ্টা কুঁজো হয়ে, বাঁকা হয়ে লম্মা শরীরটা যতটা পারে কমিয়ে রাখা। বন্দুর দোষ হলো, সে সারাক্ষণ কথা বলে। আর তার গুণ হলো, সেইসব কথা শুনতে ভালো লাগে।

দুপুরবেলা বদু মঞ্জুর সারা শরীরে সরিষার ঝাঝানো তেল মাখিয়ে দলাইমলাই করে। আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে ঘুম পেয়ে যায়। তখন তার মনে হয়, মানবজীবনের সার্থকতা এই দলাই-মলাইয়ে। সবচে মজার কথাগুলি বদু এই সময় বলে।

বুঝছেন স্যার, আমার চাচাজি কিন্তুক হুঁ হুঁ হুঁ…।

হুঁ হুঁ হুঁ আবার কী? পরিষ্কার করে বলো।

সবকিছু পরিষ্কার করে বলা যায় না। স্যার। কিছু ভাবে বুঝতে হয়। ভাবে বুঝেন। নজর কইরা ভাব দেখেন।

কী ভাব দেখাব?

বাঁশের আগাত লণ্ঠন জ্বালাইছে, দেখেন নাই? এখন বলেন দেখি ঘটনা!

বলতে পারছি না। কী ঘটনা?

পাকা দালান থুইয়া টিনের ঘরে থাকে, বলেন দেখি কী ঘটনা?

বলতে পারছি না। কী ঘটনা?

চাচাজির জিন-সাধনা আছে। এই হইল ঘটনা।

কী সাধনা?

জিন-সাধনা। উনার দুই পালা জিন আছে। এরা দুই ভাই।

কী উল্টা-পাল্টা কথা বলো?

শুনতে না চাইলে বলব না। জবান বন্ধ করলাম। তয় আমি ছিলাম। তার পাংখা বরদার। রাইতের পর রাইত আমি তারে পাংখা দিয়া হাওয়া দিছি। তার অনেক ঘটনা স্বচক্ষে দেখা।

কী দেখেছ?

সেটা তো বলব না।

কেন বলব না?

সব কিছু বলা ঠিক না। পাগলা হন্টন সাবের ভূত থাকে শহরবাড়িত। মাঝে মধ্যে সে গিয়া বড় স্যারের সাথে ইংরেজিতে গফসফ করে। সেই গফসফও আমি শুনেছি।

কী শুনেছ?

সেটা তো আফনেরে বলব না। আমার অন্ত শখ নাই। গোপন জিনিস। আমি লাড়াচাড়া করি না।

বড় সাহেব সম্পর্কে যত কথাই তিনি শোনেন না কেন, মানুষটাকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। শুধু পছন্দ নয়, বেশ পছন্দ। তার কাছে মনে হচ্ছে, এমন বিনয় এবং ভদ্রতা তিনি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছেন। শরীফ ঘরের মানুষদের মধ্যেই শুধু এই জিনিস দেখা যায়। লীলার বাবা যে অতি বড়ঘরের মানুষ এই বিষয়ে তিনি এখন একশ ভাগ নিশ্চিত।

 

সিদ্দিকুর রহমান গতকাল দুপুরে মঞ্জুকে বলেছেন, আপনি আমার মেয়েটাকে কষ্ট করে নিয়ে এসেছেন। আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। আমি আপনাকে সামান্য সম্মান করতে চাই।

মঞ্জু বিস্মিত গলায় বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারছি না। সম্মানের মধ্যেই তো আছি। নতুন করে আর কী সম্মান করবেন?

একটু বিশেষ সম্মান করতে চাই।

মঞ্জু অবাক হয়ে বলেছেন, আচ্ছা ঠিক আছে। করেন, কী করতে চান। আমি দেখতে চাই ব্যাপারটা কী? সন্মান পাওয়ার জন্যে নয়, ঘটনা কী জানার জন্যে।

মঞ্জু ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। এখনো কিছু ঘটে নি। কবে ঘটবে বোঝা যাচ্ছে না। সিদ্দিকুর রহমান যে ব্যাপক কিছু করবেন। এটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। যে-কোনো বড় কর্মকাণ্ডের জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি লাগে। সমস্যা একটাই, লীলা হয়তো হুট করে বলে বসবে–একদিনের জন্যে বাবার দেশ দেখতে এসেছিলাম। দেখা হয়েছে। এখন চলে যাই। আমার শখ মিটে গেছে।

লীলাকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব ব্যাপার। লীলা যদি বলে চলো যাই, তাকে যেতেই হবে। যে সব মেয়ের নাক খাড়া এবং যাদের চিবুক ঘামে তাদের নিয়ে এই সমস্যা। তাদের কথা আগ্রাহ্য করা যায় না। লীলার নাক খাড়া এবং তার চিবুক ঘামে। খুবই খারাপ লক্ষণ।

বড় সম্মান তাকে কী দেখানো হবে এটা নিয়ে তিনি একধরনের দুশ্চিন্তার মধ্যেই আছেন। কারো সঙ্গে যে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবেন। সেই সুযোগও হচ্ছে না। তিনি যে কামরায় থাকেন তার পাশের কামরাতেই আনিসুর রহমান বলে এক যুবক থাকে। জাইতরী, কইতরী দুই বোনকে সন্ধ্যাবেলায় পড়ায়। জয়গির টাইপ ব্যাপার হবে। মঞ্জু। কয়েকবারই তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করবার জন্যে গিয়েছিলেন। সে প্রতিবারই মুখ শুকনো করে বলেছে, আমার শরীরটা ভালো না। পরে কথা বলি?

বিরাট অভদ্রতা। মঞ্জু তার অভদ্রতা ক্ষমা করেছেন। এই যুবক লীলাদের বাড়ির কেউ নয়। বাইরের মানুষ। বাইরের মানুষের অভদ্রতা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। ব্যাটা থাকুক তার মতো। তিনি থাকবেন তার মতো।

তিনি তাঁর মতোই আছেন।

তিনি শহরবাড়ি এবং মূল বাড়িতে এমনভাবে ঘুরছেন যেন এটা তার নিজেরই বাড়িঘর। তাঁর চলাফেরা, আচার-আচরণে কোনোরকম দ্বিধা লক্ষ করা যাচ্ছে না। মূল বাড়ির দক্ষিণের আমবাগানের একটা অংশ তিনি উপস্থিত থেকে পরিষ্কার করিয়েছেন। সেখানে চৌকি পাতা হয়েছে। ছায়াময় এই জায়গা তার পছন্দ হয়েছে। তিনি ঘোষণা করেছেন— দুপুরবেলায় এখানে তিনি ঘুমাবেন। জায়গাটার তিনি একটা নামও দিয়েছেন— ছায়াবীথি। তিনি ঠিক করেছেন কেউ নেত্রকোনা শহরে গেলে ছায়াবীথি নামের একটা সাইনবোর্ড আনিয়ে বড় আমগাছটায় লাগিয়ে দেবেন।

তাঁর সবচে’ পছন্দ হয়েছে বড় পুকুর। বাড়ির সামনে দুটো পুকুর। একটার নাম বড় পুকুর, আরেকটার নাম কাঁচা পুকুর। পুকুরভর্তি মাছ। সাধারণ ছিপ ফেলে বিঘত সাইজের কয়েকটা নলা ধরে তিনি উত্তেজিত। বড় মাছ ধরার জন্যে হুইল বড়শির ব্যবস্থা করতে বলেছেন। পিঁপড়ার ডিমের সন্ধানে বদু গেছে।

বদু আবার এইসব বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানী। তার কাছে শুনেছেন— সব পিঁপড়ার ডিম মাছ খায় না। হিন্দু পিঁপড়ার ডিম মাছে খায়।

পিঁপড়াদের মধ্যেও যে হিন্দু-মুসলমান আছে তিনি জানতেন না। বদু তাঁর অজ্ঞতায় বিস্মিত হয়ে বলেছে— পিঁপড়ার যে হিন্দু-মুসলমান আছে এইটা সবেই জানে। লাল পিঁপড়া হইল হিন্দু। আর কালা পিঁপড়া মুসলমান। মুসলমান পিঁপড়া কামড় দেয় না, হিন্দু পিঁপড়া দেয়।

মঞ্জু, বড়ই বিস্মিত হয়েছেন। যতই দিন যাচ্ছে বদু নামের এই লম্বুটাকেও তাঁর ততই পছন্দ হচ্ছে। লম্বা মানুষের বুদ্ধি কম থাকে বলে তিনি শুনেছিলেন, এখন মনে হচ্ছে–এটা খুবই ভুল কথা।

বদুর কাছ থেকে অভদ্র শিরোমণি আনিসুর রহমান সম্পর্কেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। বদি বলেছে–লোক খারাপ না, তয় মাথা সিক্সটি নাইন আছে।

বদুর মুখে ইংরেজি সিক্সটি নাইন শুনে তিনি মজা পেয়েছেন।

সিক্সটি নাইনটা কী বদু?

মাথাত গণ্ডগোল। বেশি বই পড়ার কারণে এইটা হইছে।

বেশি বই পড়ে না-কি?

দিন রাইত বই নিয়েই আছে।

কী বই পড়ে?

ইংরেজি মিংরেজি সব কিসিমই পড়ে। রাইত ঘুমায় না, লেখে।

কী লেখে?

জানি না। কী লেখে। লেখে আর বারিন্দায় হাঁটে।

মঞ্জু লোকটির সঙ্গে পরিচয়ের জন্যে কিছু আগ্রহ এখন অনুভব করছেন। যে লোক দিন-রাত বই পড়ে, রাত জেগে লেখে, তার অভদ্রতা ক্ষমা করা যায়।

তার যে আরেকটা নাম আছে। এইটা জানেন?

কী নাম?

কুঁজা মাস্টার। কুঁজা হইয়া হাঁটে তো, এইজন্যে কুঁজা মাস্টার নাম। অনেকে আবার ডাকে হুঁজা মাস্টার।

 

কুঁজা মাস্টার নান্দাইল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক আনিসুর রহমানের মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ। মেজাজ বেশি খারাপ হলে তার কিছু শারীরিক সমস্যা হয়। জ্বর আসে, হাতের তালু জ্বালা করতে থাকে। একটা পর্যায়ে মাথা ঘুরতে থাকে।

তার জ্বর এসেছে, হাতের তালু জ্বালা করছে। মাথাঘোরা এখনো শুরু হয় নি। মনে হচ্ছে দুপুরের দিকে শুরু হবে। তার মেজাজ-খারাপের অনেকগুলি কারণ আছে। অনেক কারণের প্রধান কারণ হলো, গত চার মাসে কোনো বেতন হয় নি। কলেজের প্রিন্সিপাল আলহাজু আতাউল গনি সাহেবের কাছে গতকাল আনিস গিয়েছিল। ভদ্রলোক অমায়িক হাসি হেসে বলেছেন— এত অস্থির হচ্ছেন কেন? ইয়াংম্যান, লাইফের শুরুতে স্ট্রাগল করতে হবে না? যারা বড় হয় সবাইকে স্ট্রাগাল করতে হয়।

আনিস হতাশ গলায় বলল, এই মাসেও বেতন হবে না? আতাউল গনি আবারো হাসতে হাসতে বললেন, এই মাসে একটা কিছু ব্যবস্থা ইনশাল্লাহ করব। আপনার তো খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে না। বিরাট মানুষের বাড়িতে জায়গির থাকেন। শুনেছি ঐ বাড়িতে দশ পদের নিচে রান্না হলে বাবুর্চিকে কানে ধরে চক্কর দেওয়ানো হয়। সত্যি না-কি?

রান্না অনেক পদ হয় এটা সত্যি, কানে ধরে চক্কর দেওয়ার বিষয় জানি না। আপনি কি আমাকে হাতখরচের কিছু দিতে পারেন?

হাতখরচ পা-খরচ কোনো খরচই:দেয়া যাবে না। কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরতে হবে। মিনিস্টার সাহেবের কলেজ। উনি আবার একটু বেকায়দায় পড়ে গেছেন বলে আমাদের সমস্যা হচ্ছে। খুবই সাময়িক সমস্যা। মিনিস্টার সাহেবকে জানানো হয়েছে। আপনি এত অস্থির কেন? থাকা-খাওয়ার কোনো প্রবলেম তো আপনার হচ্ছে না? প্রবলেম হলে বলেন। জায়গির চেঞ্জ করে অন্য জায়গায় দিয়ে দেই।

থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা আনিসের হচ্ছে না। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের পাকা দালানের দোতলার একটা ভালো ঘর তাকে দেয়া হয়েছে। ঘরের জানালাগুলি গ্রামের পাকা বাড়ির জানালার মতো খুপরি খুপরি না। বড় বড় জানালা। দক্ষিণ দিকের জানালা খুললে হুহু করে বাতাস বয়। প্রচণ্ড গরমের সময়ও রাতে জানালা খুলে রাখলে রীতিমতো শীত লাগতে থাকে। খাওয়াদাওয়ারও কোনোরকম অসুবিধা নেই। ঘরে এসে খাবার দিয়ে যায়। এত খাবার আনে যে পাঁচ-ছয়জন মানুষ খেতে পারে। কম করে খাবার দিতে অনেকবার বলা হয়েছে, কোনো লাভ হয় নি।

পরের বাড়িতে দিনের পর দিন থাকা-খাওয়ার যে অস্বস্তি আছে সেই অস্বস্তিও আনিস এখানে বোধ করে না। কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষক এই ধরনের ব্যবস্থায় থাকেন। গ্রামের দিকে এটা মোটামুটি চালু ব্যবস্থা। বিত্তবান মানুষরা কলেজের শিক্ষকদের বাড়িতে জায়গির রাখতে পছন্দ করেন। এতে সমাজে প্রতিপত্তি বাড়ে।

থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে আনিসকে কিছুই করতে হয় না। সিদ্দিক সাহেবের মেয়ে দুটিকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় কিছুক্ষণ বসতে হয়। দুই মেয়ের সামনে থাকে দুই হারিকেন। আনিসের বাঁ-হাতে থাকে চিকন তেল মাখানো বেত। (বেতে তেল মাখানোর কাজটা বদি খুব আগ্রহের সঙ্গে করে।) মেয়ে দুটি নিজের মনে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ে। আনিস তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলে না। যেন তার কাজ বেত হাতে বসে থাকা। একসময় ভেতরবাড়ি থেকে তাদের খাওয়ার ডাক আসে। তারা আনিসের দিকে তাকিয়ে ভীত গলায় বলে, স্যার যাই? আনিস উত্তর দেয় না। তারা কিছুক্ষণ উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করে চলে যায়।

মাঝে মাঝে আনিসের মন খারাপ থাকে। তখন সে বলে, তের-এর ঘরের নামতা বলো। এই নামতা জাইতরী কইতরী কারোরই মনে থাকে না। তারা একে অন্যের দিকে তাকায়। একসময় ভয়ে ভয়ে শুরু করে— তের এক্কে তের। তের দুগোনে ছাব্বিশ। তিন তেরং…

তিন তেরং কী?

দুই বোন বলতে পারে না। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। আনিসের হাতের বেত ঝড়ের মতো নেমে আসে।

কলেজ থেকে ফেরার পর আনিসের কিছুই করার নেই। পত্রিকায় কর্মখালি দেখে দরখাস্ত তৈরি করা তার এখন প্রধান কাজ। সে বিচিত্ৰ সব চাকরির জন্যে দরখাস্ত পাঠিয়েছে। বন বিভাগের আমিনের পদেও দরখাস্ত পাঠানো হয়েছে। কোনো হ্যাঁ-সূচক জবাব এখনো আসে নি, শুধু পাকিস্তান লাইটস নামের একটা কোম্পানি থেকে সাম্প্রতিক সময়ে তোলা তিন কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি চেয়ে পাঠিয়েছে। নেত্রকোনা থেকে ছবি তুলে ছবি পাঠানো হয়েছে। আর তাদের কোনো খোঁজ নেই।

শেরে বাংলা কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব অবিশ্যি তাকে ডেকে বলেছেনকর্মখালি দেখে অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে কোনো লাভ নেই। সব পাতানো খেলা। কে চাকরি পাবে, কে পাবে না। সব ঠিক করা থাকে। আই ওয়াশ হিসেবে কর্ম খালি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার রেজাল্ট ভালো। অনার্সে সেকেন্ড ক্লাস ফাস্ট আর এমএ-তে সেকেন্ড ক্লাস থার্ড হওয়া খেলা কথা না। ভিতরে জিনিস থাকতে হয়। জিনিস মাথার মধ্যে নিয়ে বিনাবেতনের কলেজে পচে মরবেন কেন? আমি শেরে বাংলাকে ধরে একটা ব্যবস্থা ইনশাল্লাহ করে দেব। আমি হাজি মানুষ। মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছি না। ধৈর্য ধরুন। ধৈর্য। আসল জিনিস ধৈর্য। শেরে বাংলার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমার বড়ভাই বিবাহ করেছেন চাখারে— সেইসূত্রে পরিচয়।

আনিস ধৈর্য ধরে আছে কারণ তার এখন অন্য কিছু ধরার নেই। সে বসে আছে পুকুরপাড়ে, নারিকেল গাছের ছায়ায়। সূর্য সরে যাওয়ায় ছায়াও সরে গেছে। আনিসের গায়ে রোদ চিড়বিড় করছে, তারপরেও সে সরে বসছে না। লাগুক রোদ। জ্বর তো গায়ে আছেই, সেই জ্বর আরো বাড়ুক। সবচে ভালো হয় অচেতন হয়ে পড়ে থাকলে। জগতে কী ঘটছে বোঝার উপায় থাকবে না।

গত পরশু সে কলেজের শিক্ষক প্রণববাবুকে জিজ্ঞেস করেছিল, কপৰ্দক মানে কী? আমরা যে বলি কপর্দকহীন অবস্থা— তার অর্থটা কী? প্রণববাবু বললেন, কপর্দক হলো কড়ি। প্রাচীন আমলে মুদ্রার সর্বনিম্ন মান ছিল কড়ি। যার কাছে একটা কড়িও নাই সে-ই কপর্দকহীন।

গত এক মাস পাঁচদিন ধরে আনিস কপর্দকহীন। বাড়িতে চিঠি পাঠাতে দুই আনা লাগে, সেই দুই আনাও তার কাছে নেই। দোক গান থেকে সিগারেট বাকিতে কেনা হচ্ছে। দোকানদার এখনো বাকিতে দিচ্ছে। আর কতদিন দেবে কে জানে! জুরটা ভালোমতো এলে ভালো হয়। সিগারেট খাবার ইচ্ছা মরে যায়।

খাম কেনার টাকার অভাবে দেশের বাড়িতে মাকে চিঠি লেখা হচ্ছে না। মা চিন্তিত হয়ে চিঠির পর চিঠি পাঠিয়ে যাচ্ছেন– বাবা, তুমি পত্র দিতেছ না কেন? তোমার শরীর ভালো আছে তো? আমি অইত্যান্ত চিন্তিত। তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর রাগ করিয়াছ?

মা চিঠিপত্র বেশ গুছিয়ে লেখেন। শুধু কিছু-কিছু বানান লেখেন অন্যরকম করে। যেমন তিনি কখনো অত্যন্ত লিখবেন না। লিখবেন আইত্যান্তি।

আনিস কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখল। মনে হয় রোদে বসে থাকার কারণে জ্বর আরো বেড়েছে। খাম কেনার টাকা থাকলে মাকে চিঠি লিখে জানানো যেত। সামান্য দুচার টাকা যোগাড় করা সমস্যা না, কিন্তু সামান্য দুচার টাকার জন্যে হাত পাতা সমস্যা।

মাকে চিঠিটা এখন লিখে রাখা যায়, তারপর যদি কলেজের বেতন হয় তাহলে খাম কিনে চিঠি পাঠানো হবে।

আনিস রোদে পুড়তে পুড়তে মাকে চিঠি লিখতে শুরু করল—

মা,

আমি অইত্যান্ত ভালো আছি। অইত্যান্ত সুখে আছি। আমার গায়ের উপর সুখ ঝরে ঝরে পড়ছে।…

কদৰ্পক জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত মাকে লেখা চিঠি আনিস পাঠাতে পারবে না, তবে মালেক ভাইকে লেখা পোস্টকার্ডটা পাঠাতে পারবে। পোষ্টকার্ড কিনে চিঠি লেখা হয়েছে। জেলখানায় খামের চিঠি লেখা যায় না। পোস্ট কার্ডের চিঠি পাঠাতে হয়।

মালেক ভাই নিরাপত্তা আইনে বন্দি আছেন। প্রথমে ছিলেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে, এখন তাকে পাঠানো হয়েছে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে। জেলারের কেয়ার অফে তাকে চিঠি দিলে চিঠি পৌছানোর কথা। চিঠি দেয়া যাচ্ছে না। কারণ পোস্টকার্ডটা স্থানীয় পোস্টাপিস থেকে পাঠানো ঠিক হবে না। আইবির লোকজন গন্ধ শুকে শুকে এখানে চলে আসতে পারে। পোস্টকার্ডটা পোষ্ট করতে হবে। ময়মনসিংহ শহর থেকে। কে যাবে ময়মনসিংহ? যাওয়ার ভাড়া কোথায়?

মালেক ভাইয়ের চিঠিটা আনিস এমনভাবে লিখেছে যেন অতি ঘরোয়া চিঠি। কেমন আছেন, ভালো আছি’ গোছের চিঠি। পুলিশ এই চিঠি পড়ে যেন কিছুই না বোঝে। যেন টের না পায় চিঠিটা লিখেছে মালেক ভাইয়ের দলেরই একজন। আনিস লিখেছে–

ভাইজান গো! আসসালাম। পর সমাচার। আমি ভালো আছি। বাড়ির সকলেই ভালো আছে। ধলাগরুটির একটি বখনা বাছুর হইয়াছে। বাছুরটার রঙ কালো। কুড়িটা ডিম দিয়া রাজহাঁস বসাইয়াছিলাম। দুঃখের বিষয় মাত্র তিনটা ডিম ফুটিয়াছে। বাকি সবই নষ্ট।

আমি ভালো আছি। লেখাপড়া নিয়া আছি। সামনেই পরীক্ষা। পাশ করিব কি-না ইহা আল্লাহপাকই জানেন। আপনি আমাকে প্রচুর পড়িতে বলিয়াছেন, আমি সেইমতো পড়াশোনার চেষ্টা নিয়েছি। অজপাড়াগাঁয়ে থাকি, বইপত্র জোগাড় হয় না। শুনিলে আশ্চর্য হইবেন, সামান্য একটা ডিকশনারিও পাওয়া দুস্কর।

আপনি ভালো থাকিবেন। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ব নিবেন। আপনাকে সালাম। মাননীয় জেলার সাহেবকেও সালাম।

ইতি–
আপনার অতি আদরের
আনিস

মাগরেবের নামাজ শেষ করে সিদ্দিকুর রহমান বাড়ির উঠোনে ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তার সামনে বড় একটা জলচৌকি। তিনি জলচৌকিতে পা রেখেছেন। কিছুক্ষণ আগে তিনি একটা দুঃসংবাদ পেয়েছেন। বড় ছেলে মাসুদ বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। নান্দাইল রেলস্টেশনে তাকে ট্রেনে উঠতে দেখা গেছে। তার গায়ে ছিল। হলুদ রঙের শার্ট। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সে কোথায় যায়। উত্তরে সে বলেছে— আসামে যাই।

সিদ্দিকুর রহমান তেমন চিন্তিত বোধ করছেন না। ছেলে পালিয়ে গেছে— এটা তেমন কোনো দুঃসংবাদ না। তিনি চিন্তিত বোধ করেছেন দ্বিতীয় দুঃসংবাদটার জন্যে। দ্বিতীয় দুঃসংবাদ তিনি এখনো পান নি— তবে পাবেন। দুঃসংবাদ কখনো একা আসে না, সে সঙ্গে করে তার বড়ভাইকে নিয়ে আসে। প্রথম আসে ছোটভাই— ছােট দুঃসংবাদ। তারপর আসে বড়ভাই— বড় দুঃসংবাদ।

বড় দুঃসংবাদটা কী হতে পারে? কারো মৃত্যু-সংবাদ? সিদ্দিকুর রহমান সিগারেট ধরালেন। চাপা গলায় ডাকলেন, লোকমান!

ইজিচেয়ারের পেছন থেকে লোকমান জবাব দিল, জি। সে ইজিচেয়ারের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। তাকে দেখা যাচ্ছিল না। বাইরের কেউ উঠোনে পা দিলে তার কাছে মনে হবে, বিরাট উঠোনের মাঝখানে সিদ্দিকুর রহমান একা বসে আছেন।

লোকমান, আমার মেয়ে কই?

শহরবাড়িত গেছেন। ডাক দিয়া আনব?

না। মাসুদ যে পালায়ে গেছে কাউরে কিছু বলে গেছে?

জি বলেছে। মাস্টার সাবরে বলে গেছে।

সে যে পালায়ে যাবে মাস্টার সাব জানত?

জি।

মাস্টার সাব জানার পরেও আমাকে জানায় নাই কেন?

লোকমান জবাব দিল না। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, যাও মাস্টারকে খবর দিয়া আনো। তাকে বলবা তার সঙ্গে চা খাব।এইজন্যে ডেকেছি। কোনোরকম বেয়াদবি করবা না।

জি আচ্ছা।

সিদ্দিকুর রহমানের হাতের সিগারেট নিভে গেছে। তিনি নেভা সিগারেটই টান দিচ্ছেন। আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চারদিকের জঙ্গল আলো হতে শুরু করেছে। যদি পূর্ণিমা হয় তাহলে প্রবল জোছনা হবে। আজ কুয়াশা নেই। মেঘশূন্য আকাশে পূর্ণিমা দেখার মতো জিনিস। তিনি বেলিফুলের গন্ধও পাচ্ছেন। বাগানে বেলিফুলের গাছে নিশ্চয়ই অসংখ্য ফুল ফুটেছে। পূর্ণিমায় সব বেলিগাছে ফুল ফোটে। যেসব বেলিগাছ পূর্ণিমাতেও ফুল ফোটাতে পারে না তারা বন্ধ্যা গাছ। এইসব গাছ তুলে ফেলতে হয়। সিদ্দিকুর রহমানের ইচ্ছা করছে মেয়েকে নিয়ে বেলিফুলের বাগানে যেতে। যেসব গাছে ফুল ফোটে নি সেসব গাছ টেনে তুলে ফেলতে। তবে আগে নিশ্চিত হতে হবে আজ পূর্ণিমা কি না। মাস্টার বলতে পারবে। চাঁদ–তারার হিসাব তার কাছে খুব ভালো আছে। সমস্যা হচ্ছে, এই সময়ে বেলিফুল ফুটে না। বেলি বর্ষার ফুল। তাহলে গন্ধটা আসছে কোথেকে? মনের ভুল?

আনিসকে দেখে সিদ্দিক সাহেব চমকে উঠলেন। চোখ টকটকে লাল। ফরসা গালও লালচে হয়ে আছে। ইটার ভঙ্গিও অন্যরকম। মাতালের মতো হেলেন্দুলে হাঁটা। হাঁটার মধ্যে তাকানোর মধ্যে কেমন যেন ডোন্ট কেয়ার ভাব। এমনিতে সে মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে কুঁজা হয়ে হাঁটে। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তার আলাদা নাম আছে— কুঁজা মাস্টার।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আনিস, কেমন আছো?

আনিস বলল, আমি অইত্যান্ত ভালো আছি। আপনি চা খেতে ডেকেছেন, চা খাব না। আমার ধারণা। আপনি চা খেতেও ডাকেন নি। চা খাওয়াটা অজুহাত। আপনি আমাকে কিছু বলার জন্য ডেকেছেন।

সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হলেন। মাস্টার এরকম ভঙ্গিতে কথা বলছে কেন? তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে বসতে বললেন, কিছু বলার জন্য ডাকি নাই। একটা বিষয় জানার জন্যে ডেকেছি। আজ কি পূর্ণিমা?

জি, পূর্ণিমা। আশ্বিনা পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমায় ভূত দেখা যায় আর আষাঢ়ি পূর্ণিমায় সাধু মানুষ দেখা যায়। আষাঢ়ি পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ গ্ররহত্যাগ করেছিলেন।

গৃহত্যাগ কেন করেছিলেন?

সংসার থেকে সেই রাতেই তার মন উঠে গিয়েছিল। মানুষ যখন হঠাৎ অসম্ভব সুন্দর কোনো জিনিস দেখে তখন বিচিত্র কারণে সবকিছু থেকে তার মন উঠে যায়।

আমি তো আমার দীর্ঘ জীবনে অনেক সুন্দর জিনিস দেখেছি। আমার তো মন উঠে নাই।

হয়তো উঠেছে, আপনি বুঝতে পারেন নাই। মানুষ অন্য মানুষের মন কিছুকিছু বুঝতে পারে, নিজের মন কিছুই বুঝতে পারে না।

তুমি কথা তো খুব গুছিয়ে বলো।

জি, আমি কথা গুছিয়ে বলতে পারি। এটা কোনো বড় ব্যাপার না। যে লোক ট্রেনে স্বপ্নে পাওয়া বড়ি বিক্রি করে সেও খুব গুছিয়ে কথা বলে।

বড় ব্যাপার কোনটা?

বড় ব্যাপার হলো যে কথা বলছে সে জানে কি-না কী বলা হচ্ছে।

তুমি জানো?

জি আমি জানি।

খুবই ভালো কথা। এখন আমাকে আরেকটা জিনিস বলো, আমার ছেলে যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে এটা তুমি জানতে। জানার পরেও আমাকে বিষয়টা জানাও নি। আমাকে জানালে আমি আমার ছেলেকে আটকাতে পারতাম। জানাও নি কেন?

আনিস বলল, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার বুদ্ধি আমি তাকে দিয়েছিলাম। আমি বুদ্ধি দিয়েছি আবার আমি সেটা আপনাকে বলে দেব–তা তো ঠিক না। সাপ হয়ে দংশন করব, ওঝা হয়ে ঝাড়ব— তা তো হয় না।

সিদ্দিকুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, পালিয়ে যাবার বুদ্ধি তুমি দিয়েছ?

জি।

কেন?

আপনি তার জন্যে খুবই লজ্জাজনক শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। অপমানটা সে নিতে পারছিল না। আমাকে বলল। ইঁদুর-মারা বিষ খাবে। আমার কাছে মনে হলো, বিষ খাওয়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করার জন্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার বুদ্ধি দেয়াই ভালো।

যে বলে ইঁদুর-মারা বিষ খাবে সে কোনোদিন খায় না। বলে কয়ে বিষ খাওয়া হয় না।

কেউ-কেউ আবার বলে-কয়ে খায়। একেকজন মানুষ একেক রকম। ভরাপূর্ণিমায় কেউ বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যায়, আবার কেউ দরজা বন্ধ করে ঘুমায়।

মাসুদকে তুমি কবে ফিরে আসতে বলেছ?

আমি কিছু বলি নাই। তবে সে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। সে গৃহী ধরনের ছেলে। বাড়ি ছেড়ে বেশি দিন বাইরে থাকতে পারবে না।

তুমি কি কোনো ফুলের গন্ধ পাচ্ছ?

জি-না। আমার নাক বন্ধ।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ?

আনিস বলল, সামান্য খারাপ। মনে হয় জ্বর এসেছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, যাও শুয়ে থাকো।

আনিস চলে যাচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান ভুরু কুঁচকে আনিসের দিকে তাকিয়ে আছেন। আনিস কী অদ্ভূত ভঙ্গিতে হেলেদুলে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে পায়ের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে সে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাবে। লোকমান বলল, হুক্কা আইন্যা দেই? সিদ্দিকুর রহমান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন, যদিও তার তামাক খেতে ইচ্ছা করছে না। নির্জন উঠানে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না, আবার উঠে যেতেও ইচ্ছা করছে না।

জোছনা প্রবল হয়েছে। বাড়ির পেছনের কামরাঙা গাছের ছায়া তার গায়ে পড়েছে। কামরাঙা গাছের চিড়ল-বিড়ল পাতার ছায়া জোছনায় সুন্দরভাবে এসেছে। বাতাসে গাছ কাঁপছে, ছায়াও কাঁপছে। সিদ্দিকুর রহমান নিজের গায়ের ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দৃশ্যটা তাঁর কাছে সুন্দর লাগছে, তবে মাস্টারের কথামতো এই সুন্দর দৃশ্য দেখে তার মনে কোনো ভাব তৈরি হচ্ছে না।

লোকমান!

জি?

মাসুদ এক-দুই দিনের মধ্যে ফিরে আসবে। যেদিন ফিরে আসবে সেদিনই কানে ধরে তাকে ট্রেনে তুলে দিবে। আমার হুকুমের অপেক্ষা করবে না।

জি আচ্ছা।

লোকমান হুক্কার নল তাঁর হাতে তুলে দিল। তিনি নল টানছেন। ভুড়ুক ভুড়ুক শব্দ হচ্ছে। শব্দ শুনতে তাঁর ভালো লাগছে।

কন্যার বাপ হুক্কা খায়
বুনকা বুনকা ধোঁয়া যায়।

সুন্দর সিমাসা। কে তাকে বলেছিল? রমিলা বলেছিল। একদিন তিনি বারান্দায় বসে হুক্কা টানছেন, হঠাৎ রমিলা ঘরের ভেতর থেকে বলে উঠল— কন্যার বাপে হুক্কা খায়, বুনকা বুনকা ধোঁয়া যায়। কী কারণে জানি রমিলার সিমাসা তার খুবই ভালো লাগল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রমিলাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন— ঘরের ভেতর থেকে কী বললা আরেকবার বলো। রমিলা ভয়ে অস্থির হয়ে বলল, আমার ভুল হইছে মাপ কইরা দেন। সিদ্দিক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ভুলের কী হইছে? সুন্দর সিমাসা বলেছি, আমার পছন্দ হয়েছে। রমিলা তার পরেও বলল, আর কোনোদিন বলব না। আমারে ক্ষমা দেন। তিনি দুঃখিত হয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে যাও, ক্ষমা দিলাম।

অতি সুন্দর এই সিমাসাটা লীলাকে বললে কেমন হয়? হুক্কায় টান দিয়ে বুনকা বুনকা ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলবেন। লীলা নিশ্চয় মজা পাবে। মেয়েটা নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কী ভাবছে কে জানে! তাকে পাশে বসিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করলে বোঝা যেত সে কী ভাবছে। কিন্তু তাকে ডেকে এনে আয়োজন করে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। যদি তার আসতে ইচ্ছা করে সে আসবে নিজের মতো। সে কবে চলে যাবে? যেরকম হুট করে এসেছিল— সেরকম হুট করেই কি চলে যাবে? যদি সে একবার ঠিক করে চলে যাবে তাহলে তাকে আটকানো যাবে না। তার মাকেও আটকানো যায় নি। এই মেয়েটা পুরোপুরি তার মা’র স্বভাব পেয়েছে। মাতৃ-স্বভাবের মেয়ে জীবনে সুখী হয় না। পিতৃ-স্বভাবের মেয়ে সুখী হয়। এই নিয়েও একটা সিমাসা আছে। সিমাসটা যেন কী? সিদ্দিকুর রহমান ভুড়ুক ভুড়ুক শব্দে হুক্কা টানছেন, চোখ বন্ধ করে সিমাসা ভাবার চেষ্টা করছেন। কিছুটা মাথায় আসছে, কিছুটা আসছে না—

মা-স্বভাবী দেখান হাসি
কন্যা থাকেন ভঙ্গে
বাপ-স্বভাবী সুখ-কপালি
কন্যা থাকেন রঙ্গে।

এই তো মনে পড়েছে। কন্যা থাকেন রঙ্গে। রঙ্গে থাকা অনেক বড় ব্যাপার। তিনি মনে-প্ৰাণে চাচ্ছেন তার কন্যা থাকবে রঙ্গে।

 

লীলা তার সৎমার খাওয়া দেখছে। রমিলা খুব গুছিয়ে ভাত খাচ্ছেন। পাটিতে বসেছেন— সামনে জলচৌকি, সেখানে ভাত-তরকারি। ঘোমটা দিয়ে বসেছেন। অসুস্থ মানুষের হুসাহাস খাওয়া না, ফেলে ছড়িয়ে একাকার করাও না। যেন তিনি এ-বাড়ির নতুন বউ। নতুন বউ বলেই ঘোমটা টেনে লাজুক-লাজুক ভঙ্গিতে খেতে হচ্ছে।

রমিলার ঘরে আলো নেই। ঘরের বাইরে জানালার পাশে হারিকেন রাখা হয়েছে। তার আলো ভেতরে পড়েছে। সেই আলো কাটা বেছে ছোটমাছ খাবার জন্যে যথেষ্ট না। অসুস্থ মহিলার ভাত খাওয়া দেখে লীলার রাগ লাগছে। কষ্টও লাগছে। সাৰ্ব্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য এই মহিলার একজন কাউকে দরকার। সেরকম কেউ নেই। লীলার বাবা সুস্থ-সবল একজন মানুষ। তার পেছনে ছায়ার মতো দুজন লোক আছে। যেন একজন মানুষের দুটা ছায়া। অথচ অসহায় এই মহিলাকে দেখার কেউ নেই। তার নিজের ছেলেমেয়েরাও একবার এসে খোঁজ নেয় না। খুশির মা বলে একজন মহিলা প্রতিদিন একবার আসেন। মনে হচ্ছে এই মহিলার উপরই দায়িত্ব। খুশির মা খুবই কাজের মেয়ে, তার পরেও সে তো এ-বাড়িতে থাকে না। লীলা লক্ষ করেছে, তার সৎমায়ের খাবারের সময়েরও কোনো ঠিক নেই। আজ তিনি সন্ধ্যাবেলায় খেতে বসেছেন। গতকাল দুপুরে তিনি কিছুই খান নি। এই ব্যাপারটা নিয়ে লীলা খুশির মার সঙ্গে কথা বলেছে। খুশির মা বলেছে–আম্মাজিগো, উনি যখন ভাত খাইতে চাইবেন তখন ভাত দিলে খাইবেন। না চাইলে ভাত দিলে উনি খুবই রাগ করেন।

লীলা বলল, খুবই রাগ করেন মানে কী? রাগ করলে কী করেন— ভাতের থালা-বাটি উল্টে ফেলেন?

সেইটা করলে তো ভালোই ছিল আম্মাজি। বেশি রাগলে পরনের কাপড় খুঁইল্যা দাঁত দিয়া ছিড়েন। বড়ই লইজার বিষয়। এইজন্যেই তো উনার দেখভালের জন্যে বাইরের লোক রাখা হয় না। উনার নিজের ছেলেমেয়েরা উনারে দেখতে আসে না। লইজ্জা পায়।

কথাগুলি লীলার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো না। সব যুক্তি মন গ্ৰহণ করে না। এই যুক্তিও করছে না।

লীলাকে চমকে দিয়ে রমিলা হঠাৎ ক্ষীণ স্বরে বললেন, মাগো, কী দ্যাখো?

লীলা বলল, আপনার খাওয়া দেখি।

রমিলা চাপা হাসি-মাখানো গলায় বললেন, খাওয়ার মধ্যে কী আছে গো মা? খাওয়া তো রঙ্গিলা নাইচ না যে দেইখ্যা মজা পাইবা!

লীলা বলল, খাওয়া রঙ্গিলা নাচ না হলেও খাওয়া দেখার মধ্যে আনন্দ আছে। আপনার ছেলেমেয়েরা যখন খেতে বসত। তখন আপনি পাশে বসে তাদের খাওয়া দেখতেন না? দেখে আনন্দ পেতেন না?

তুমি তো দূর থাইক্যা দেখতেছ। কাছে বইসা খাওয়া দ্যাখো।

আসছি। বাবার কাছ থেকে চাবি নিয়ে এসে দরজা খুলে আসছি।

চাবি চাইলে তোমার বাবা চাবি দিব না। এক কাজ করো, তোমার বাপের ঘরে যাও। সেই ঘরে কাঠের দুইটা বড় আলমারি আছে। কালা রঙের আলমারির তিন নম্বর ড্রয়ারে চাবি আছে।

আপনি জানেন কীভাবে?

আমি অনেক কিছু জানি। কেউ আমারে কিছু না বললেও আমি জানি। মাসুদ চইল্যা গেছে— কেউ আমারে কিছু বলে নাই। কিন্তু আমি জানি।

কেউ আপনাকে কিছু না বললেও তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছে, সেখান থেকে আপনি শুনেছেন।

এইটা ঠিক বলছ মা। আমার কান খুবই পরিষ্কার। যাও চাবি দিয়া দরজা খুঁইল্যা আমার সাথে বসো। আমি খাওয়া বন করলাম। তুমি সামনে বসলে খাওয়া শুরু করব।

লীলা চাবি আনতে বাবার ঘরে ঢুকল। চাবি যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে। সে চাবি হাতে নিয়ে ঘুরল আর তখন সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চাবি নিয়া কই যাও? ঘটনাটা হঠাৎ ঘটায় চট করে লীলার মাথায় কোনো জবাব এলো না। সে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তালা খুলে তুমি তোমার সৎমারে আজাদ করতে চাও?

তা না। উনি ভাত খাচ্ছেন, আমি সামনে বসে থাকব।

সামনে বসে থাকার দরকার নাই।

আমি উনাকে কথা দিয়ে এসেছি। সামনে বসে খাওয়াব। উনি খাওয়া বন্ধ করে বসে আছেন।

যখন-তখন যে-কোনো মানুষরে কথা দিবা না। কথা অনেক দামি জিনিস।

লীলা শান্ত গলায় বলল, কথা দামি জিনিস বলেই তো আমি আমার কথা রাখব।

না।

का। একজন অসুস্থ মানুষকে আমি কথা দিয়ে এসেছি। উনি আমার কথা বিশ্বাস করে খাওয়া বন্ধ করে বসে আছেন। আমি যদি এখন তার কাছে না। যাই তাহলে উনি খাবেন না।

না খেলে না খাবে। পাগল-মানুষ এক-দুই বেলা না খেলে কিছু হয় না।

আপনি এমন একটা ছোট কথা কী করে বললেন?

সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে একটা ঘটনা শোনো–মরিয়ম নামের একটা মেয়েকে রেখেছিলাম যে তোমার সৎমায়ের দেখভাল করবে। ভাটি অঞ্চলের গরিব ঘরের মেয়ে। রমিলা একদিন কী করল শোনো— মরিয়মরে ভুলিয়ে-ভালয়ে দরজা খুলাল। তারপর হুট করে ঘর থেকে বের হয়ে বঁটি দিয়ে তারে কোপ দিল। আমি মরিয়মকে প্রথমে নেত্রকোনা, তারপর ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সেখানেই সে মারা যায়। মামলা-মোকদ্দমা যেন না হয়। সেজন্যে আমাকে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়েছে। মরিয়ম গরিব ঘরের মেয়ে বলে অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি কেন আমি এত সাবধান। আমার কথা শোনো— যেখানে চাবি ছিল সেখানে রাখো।

লীলা বলল, উনি আমাকে কিছু করবেন না। উনি আমাকে পছন্দ করেন।

সিদ্দিকুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, মরিয়মকেও রমিলা খুব পছন্দ করত। তাকে রমিলা ডাকত— ময়না সোনা। এই নিয়া তোমার সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। দাও, ঘরের চাবি আমার হাতে দাও।

লীলা বাবার হাতে চাবি দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি আপনার এখানে দুদিন থাকব ভেবে এসেছিলাম, চারদিন থেকেছি। কাল সকালে চলে যাব।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমাকে যদি চাবি দিয়ে দেই তাহলে কি আরো কয়েকদিন থাকবে?

না।

আচ্ছা ঠিক আছে। কাল যেতে চাও, কাল যাবে।

আমি যাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম, মঞ্জুমামা, তিনি বাড়ি ফেরার জন্যে অস্থির হয়েছেন। আর আমার নিজেরও এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।

কাল সকালেই তুমি যাবে?

জি।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমাকে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। নিজের খুশি আমি প্রকাশ করতে পারি না। রাগ প্রকাশ করতে পারি। পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে। এক ধরনের মানুষ রাগ প্রকাশ করতে পারে, খুশি প্রকাশ করতে পারে না। আরেক ধরনের মানুষ খুশি প্রকাশ করতে পারে, রাগ প্ৰকাশ করতে পারে কলা।

লীলা বিস্মিত হয়ে বলল, এই কথাগুলি কি আপনি নিজে চিন্তা করে বললেন?

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, না, আমি এত সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারি না। এইগুলি মাস্টারের কথা। মাস্টারের সঙ্গে তোমার দেখা হয় নাই?

না, দেখা হয় নি। উনার কথা শুনেছি। সবাই উনাকে কুঁজা মাস্টার ডাকে।

হুঁ।

শুনেছি আপনি তাকে খুব পছন্দ করেন?

হুঁ, করি।

কেন?

জানি না। মানুষের পছন্দ-অপছন্দ হিসাব মেনে হয় না। পছন্দ-অপছন্দের কোনো ব্যায়াকরণ নাই।

এটাও কি কুঁজা মাস্টারের কথা?

এটা আমার কথা। মা শোনো, যাও চাবি নিয়ে রমিলার ঘরে যাও। তার সামনে বসে তাকে খাওয়াও। আমি সোলেমানকে বলে দিচ্ছি, সে আশেপাশে থাকবে। তেমন কিছু ঘটলে সামলাবে।

লীলা তাকিয়ে আছে। সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে বুঝতে চেষ্টা করছে। বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে অভয়দানের ভঙ্গিতে হাসলেন।

লীলা তার সৎমায়ের সামনে বসে আছে। তার মনে ক্ষীণ অস্বস্তি। অস্বস্তির কারণ, তার কেন জানি মনে হচ্ছে— এই অসুস্থ মহিলা হঠাৎ এক নলা ভাত তার মুখের সামনে ধরে আদুরে গলায় বলবেন, মা খাওগো। লীলা। এই মহিলার হাতের নলা কখনো মুখে নিতে পারবে না। অসুস্থ মানুষকে সে কিছু বুঝিয়েও বলতে পারবে না। অসুস্থ মানুষ যুক্তি মানে না। তারা একবার অপমানিত বোধ করলে সেই অপমানবোধ মনের গভীরে ঢুকে যায়। তাদের এলোমেলো জগৎ হঠাৎ করে আরো এলোমেলো হয়। তার ফল শুভ হয় না।

তোমার নামটা বড় সুন্দর, লীলা। নামটা কে রাখছে গো?

মা রেখেছেন।

তোমারে খুব আদর করত?

সব মা-ই তো ছেলেমেয়েদের আদর করে। এমন মা কি আছে যে ছেলেমেয়েদের অনাদর করে?

আমি করি। আমি যেমন করি তারাও করে। এই যে আমার ছেলেটা বাড়িঘর ছেড়ে পালায়ে গেল, আমারে মুখের দেখাও দেখল না।

লীলা কী বলবে ভেবে পেল না। অসুস্থ রমিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তুমি কবে যাইবা গো মা?

আমি কাল সকালে যাব।

রমিলা এই কথা শুনে হেসে ফেললেন। মুখে ভাতের নলা তুলতে যাচ্ছিলেন, সেই নলা নামিয়ে রেখে হেসে কুটি-কুটি হলেন। লীলা বলল, হাসেন কেন?

তোমার কথা শুইন্যা হাসি।

আমার কথাটা কি খুব হাসির?

হুঁ হাসির। তুমি কোনোদিন যাইবা না। এইখানেই থাকবা।

ভবিষ্যদ্বাণী করছেন?

যেটা ঘটব সেইটা বললাম। মিলাইয়া দেইখো।

আচ্ছা মিলিয়ে দেখব।

খাওয়া শেষ হইছে গো মা, এখন হাত ধুব।

আসুন আপনার হাত ধুইয়ে দিই।

রমিলা লীলার এই কথায় আবারো হেসে কুটি-কুটি হলেন। এইবার আর লীলা জিজ্ঞেস করল না, কেন হাসেন। রমিলা হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললেন, আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমার মুখে একটা ভাতের নলা তুইল্যা দেই। তুমি ঘিন্না পাইবা বইলা দিলাম না। তোমারে দেইখা মনে হয় তোমার ঘিন্না বেশি।

লীলা তাকিয়ে আছে। রমিলা খুব হাসছেন।

 

আনিসের জ্বর খুব বেড়েছে। সে প্ৰলাপ বিকা শুরু করেছে। সে ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। কী বলছে সে নিজে জানে না। একটা ব্যাপার তার খুব ভালো লাগছে— সে যা বলতে চাচ্ছে বলতে পারছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

অসম্ভব রূপবতী একটি মেয়ে চিন্তিত মুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্যাপারটাও তার খুব ভালো লাগছে। মেয়েটি একা দাঁড়িয়ে নেই, তার সঙ্গে আরো অনেকে আছে। সিদ্দিক সাহেবও আছেন। কিন্তু অন্য কাউকেই আনিস স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছে। আনিস মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ভাববেন না যে আমি আপনাকে চিনি না। আপনাকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি। আপনি সিদ্দিক সাহেবের বড় মেয়ে লীলাবতী। আপনার নাম উল্টো করলে কী হয় জানেন— তীবলালী। আমার নাম উল্টো করলে মেয়েদের নাম হয়ে যায় সনিআ। আমার মা আপনাকে দেখলে কী বলত জানেন? আপনাকে দেখলে বলত, আইত্যান্ত সুন্দরী কন্যা। আমার মা অত্যন্ত বলতে পারে না। মাঝখানে একটা ই লাগিয়ে আইত্যান্ত।

লীলাবতী নামের মেয়েটা আনিসকে কী যেন বলল। আনিস তার কথা শুনতে পেল না। সে এখন কারো কথাই শুনতে পাচ্ছে না, শুধু নিজের কথাগুলি পরিষ্কার শুনছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ