আজ শুক্রবার। সকাল আটটা বাইশ। আমি উপন্যাস নিয়ে বসেছি। উপন্যাসের প্রথম পাতাটা লিখব। আহসান সাহেব বলেছেন, প্রথম পাতা লেখাই কঠিন। কোনোরকমে প্রথম পাতা লেখার পর কলমের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যকারও হাতে। তখন আর লিখতে সমস্যা হয় না।

আমি বললাম, অন্যকারও হাতে মানে কী? অন্যকেউটা কে?

আহসান সাহেব বললেন, লেখকরা কেউই পরিষ্কার করে কিছু বলেন না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অন্যকেউটা হলো তার জীবনদেবতা। পুশকিন বলেছেন, অন্যকেউটা তার অদৃশ্য বন্ধু।

জ্ঞানের কথা বাদ। লেখা শুরুর আগে বাসার পরিবেশ বর্ণনা করি। আহসান সাহেব বলেছেন, যে পরিবেশে লেখা হয়, সেই পরিবেশ লেখাতে ছাপ ফেলে। বাসার পরিবেশ হচ্ছে–বাবা কাঁচাবাজারে গেছেন। শুক্রবারে তিনি সাপ্তাহিক বাজার করেন। এই দিন দুপুরে বাসায় ভালো রান্না হয়। খিচুড়ি-মাংস কিংবা মোরগপোলাও। গত সপ্তাহে মোরগপোলাও হয়েছে, আজ মনে হয় খিচুড়ি-মাংস হবে। খিচুড়ি আমার অপছন্দ। ডালমাখা ভাত যা, খিচুড়িও তা। আমার অপছন্দের কথা ছোটবেলায় বলতাম, এখন আর বলি না। অখাদ্য খিচুড়ি সোনামুখ করে খেয়ে ফেলি।

মা ব্যস্ত আছেন দেয়ালের ঝুল পরিষ্কারে। সকিনা (আমাদের কাজের মেয়ে) লম্বা লাঠির মাথায় ঝাড়ু বেঁধে ঘরের ঝুল পরিষ্কার করছে এবং কিছুক্ষণ পরপর খিকখিক করে হাসছে। সকিনার হাসার জন্যে কোনো কারণ লাগে না। যে কোনো কিছুতেই সে হাসতে পারে। হাসির কারণে একবার তার চাকরি নট হয়ে গিয়েছিল। আর কোনো কাজের মেয়ে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে বাবা পাঁচ দিনের মাথায় নিজে আগারগাঁওয়ের বিএনপি বস্তি থেকে তাকে নিয়ে এসেছিলেন। ঘটনাটা বলে নেই।

 বড় মামা বেড়াতে এসেছেন। তিনি আইডিয়েল কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক। অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। বেশিরভাগ সময় উপদেশমূলক জ্ঞানের কথা বলেন। আমি তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কারণ দেখা হলেই তিনি প্রশ্ন করে বসবেন। না পারলে কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে বলবেন, হেসে খেলে জীবন পার করলে তো চলবে না। একটু সিরিয়াস হও। Young lady, life is not a bed of roses. এটা সব সময় মনে রাখবে।

ওই দিনের ঘটনা হচ্ছেবড় মামা এসেছেন। তাঁর পছন্দের ইজিচেয়ারে বসেছেন। গম্ভীর গলায় ডাকলেন, লিপি মা কোথায়? আমি বেজার মুখে তার সামনে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, তুরস্কের কামাল আতার্তুক সম্বন্ধে কী জানো বলো।

আমি বললাম, কিছুই জানি না মামা।

কিছুই জানো না?

জি-না।

আমাদের জাতীয় কবি নজরুল যে আতাতুর্ককে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছেন তার কয়েক লাইন বলতে পারবে?

আমি বললাম, না।

বড় মামা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই সময় সকিনা চায়ের কাপ নিয়ে এল। সে বড় মামার হাতে চায়ের কাপ দিতে যাচ্ছে, তখন বড় মামা বেশ শব্দ করে … দিলেন। কী দিলেন তা কি বোঝা যাচ্ছে? ইংরেজিতে বলে Fart। শব্দটা করে বড় মামা মুষড়ে পড়লেন।

সকিনা বাড়ি কাঁপিয়ে হেসে ফেলে হাতের চায়ের কাপ ফেলে দিল। গরম চা পড়ল মামার পায়ে। করেছিস কী!–বলে মামা একটা চিৎকার দিলেন। মা রান্নাঘর থেকে কী হয়েছে? কী হয়েছে? বলে ছুটে এলেন।

আমি খুব শান্ত মুখে বললাম, কিছু হয় নি মা। বড় মামা একটা পাদ দিয়েছেন। এই যা, শব্দটা বলেই ফেললাম! তবে মূল উপন্যাসে আমি এই ধরনের শব্দ অবশ্যই ব্যবহার করব না। মূল উপন্যাসে এই ঘটনা থাকলে আমি লিখব, কিছু হয় নি মা। বড় মামা শব্দ করে গ্যাস ছেড়েছেন। আচ্ছা এই প্রসঙ্গ থাক। আমি উপন্যাস লেখার সময় বাসার পরিস্থিতি বর্ণনা আগে শেষ করি।

আমার ছোটভাই রুবেল বসার ঘরে গাড়ি চালাচ্ছে। তার বয়স নভেম্বরে চার হবে। সে ভয়ঙ্কর জেদি। বেশির ভাগ সময় গাড়িটায় বসে দুই পায়ে ভর দিয়ে গাড়ি চালায়। মুখে ভরর ভরর শব্দ করে। কিছুক্ষণ পরপর সোফায় বা দেয়ালে ইচ্ছা করে গাড়ি ধাক্কা লাগিয়ে বলে অ্যাক্সিডেন্ট। গাড়িটা বড় মামা তাকে তৃতীয় জন্মদিনে উপহার দিয়েছেন। এই গাড়ির বিশেষত্ব হচ্ছে, এর পেছনের ডালা খোলা যায়। রুবেল অনেক কিছু এখানে লুকিয়ে রাখে। বাসায় যখন কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন রুবেলের গাড়ির ডালা খুললে সেটা পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত যেসব জিনিস পাওয়া গেছে তা হলো–

১. বাসার চাবি।

২. বাবার পার্কার কলমের মুখো।

৩. শ্যাম্পুর বোতল।

৪. রান্নাঘর থেকে নেওয়া ফলকাটার ছুরি।

৫. পাঁচ ছটা কচুর মুখি।

৬. বাবার ইনসুলিনের সিরিঞ্জ।

৭. একটা চায়ের কাপ।

দুতিন পৃষ্ঠার তালিকা দিতে পারি। সাতটার নাম দিলাম যাতে রুবেলের বিচিত্র জিনিস সংগ্রহের বিষয়টি বোঝা যাবে। আমার উপন্যাসে রুবেলের গাড়ির বড় ভূমিকা আছে। যথাসময়ে তা পরিষ্কার হবে।

বলতে ভুলে গেছি, আমি উপন্যাসের নাম বদলে দিয়েছি। এখন নাম দাঁড়কাকের সংসার। নামটা অদ্ভুত না? মাঝে মাঝে তব দেখা পাই নাম শুনলেই পাঠক বুঝে ফেলবে, এটা একটা প্রেমের উপন্যাস। শুরুতেই ব্যাপারটা আমি পাঠককে বোঝাতে চাচ্ছি না। তবে নামকরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয় নি। আমি একজন ঔপন্যাসিকের সাহায্য চাইব। তিনি হিমু, মিসির আলি লেখেন। তাঁর নাম হুমায়ূন আহমেদ। আমাদের স্কুলের অনেক মেয়ে তাঁকে ডাকে হুমায়ূন হাফমেড। আহমেদের বদলে হাফমেড। তিনি নাকি অর্ধেক পাগল।

তবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তার বাসার টেলিফোন নম্বরে গত শুক্রবার টেলিফোন করেছিলাম। একজন টেলিফোন ধরে বলল, স্যার রেস্টে আছেন। আমি দুপুর বারোটায় আবার টেলিফোন করলাম। ওই লোক আবার টেলিফোন ধরে বলল, স্যার রেস্টে আছেন।

আমি বললাম, রেস্টে আছেন মানে কী?

ঘুমাচ্ছেন।

সারা দিন ঘুমালে লেখালেখি কখন করবেন?

ওই লোক টেলিফোন রেখে দিল। আমি বিকাল চারটায় আবার টেলিফোন করলাম। আগের লোকই টেলিফোন ধরে বলল, স্যার রেস্টে আছেন।

আমি গলার স্বর গম্ভীর করে বললাম, আপনার স্যারকে গিয়ে বলুন আমার নাম শাহানা খানম। আমি ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর।

সে বলল, ম্যাডাম, লাইনে থাকুন। অনেকক্ষণ কানে টেলিফোন ধরে রাখার পর সে এসে আগের মতোই বলল, স্যার রেস্টে আছেন। আমি বললাম, আপনি কি উনাকে বলেছিলেন যে, আমি ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর?

বলেছিলাম।

উনি কী বললেন?

স্যার বলেছেন, ডিবি পুলিশের আমি কেঁথা পুড়ি।

এরপর আর টেলিফোন করার অর্থ হয় না। আমি বুঝে গেছি টেলিফোনের লাইনে হবে না। অন্য কোনো লাইন ধরতে হবে। এখনো কোনো বুদ্ধি মাথায় আসছে না, তবে এসে যাবে।

আমি উপন্যাসের প্রথম লাইন লেখার জন্যে তৈরি হয়েছি। কলম হাতে নিয়ে তিনবার বললাম, রাব্বি জেদনি এলমান। এর অর্থ হচ্ছে, হে রব। আমাকে জ্ঞান দাও। পড়াশোনা বা লেখালেখি-বিষয়ক কর্মকাণ্ড শুরু করার আগে তিনবার এই দোয়া পাঠ করলে সাফল্য আসে। এই বিষয় আমাকে বলেছেন হুজুর একরাম।

বাবা হুজুর একরামকে রেখেছিলেন আমাকে কোরান মজিদ পড়া শেখানোর জন্যে। উনার সুফি নুরানি চেহারা। কথাবার্তা অতি মোলায়েম। ও আল্লা, একদিন পড়ার সময় দেখি তিনি পা দিয়ে আমার ডান পা ঘষছেন। আমি পা সরিয়ে নিলাম না। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম, তারপর বললাম, হুজুর! আমার বাঁ পা বেশি চুলকাচ্ছে। বাঁ পাটা আগে চুলকে দিন। তারপর যত ইচ্ছা ডান পা চুলকাবেন। হুজুর পা সরিয়ে নিলেন।

আমি মাকে ঘটনা বললাম। মা বললেন বাবাকে। বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। কঠিন মুখ করে বললেন, লিপি, তোমার মনে আছে পাপ। আজকালকার মেয়েদের মন কলুষিত। পায়ের সঙ্গে পা লেগে গেছে এইটা নিয়ে তুমি দেনদরবার শুরু করেছ। তোমাকে থাপড়ানো দরকার। মানি লোকের মান রক্ষা করবে তা না, উল্টা অপবাদ। সামনে থেকে যাও। পড়া ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা!

আমি যথারীতি হুজুরের সঙ্গে পড়া শুরু করলাম, তবে দ্বিতীয় দিনে জুতা পরে বসেছি। জুতার আগা দিয়ে কষে তার পায়ে গুতা দিলাম। তিনি আউ বলে চিৎকার দিলেন। কিছুক্ষণ পর আরেক গুঁতা। হুজুর উঠে দাঁড়ালেন। এরপর তিনি। আর বাসায় আসেন নি। তবে আমি কিন্তু কোরানপাঠ শিখেছি। মার কাছে শিখেছি। মা বলেছেন আমার গলার স্বর মিষ্টি। আমার কোরানপাঠ শুনলে তার নাকি চোখে পানি আসে। মার কথা সত্যি হতে পারে। অতি অল্পতেই তাঁর চোখে পানি আসে।

সুসংবাদ! উপন্যাসের প্রথম কয়েক লাইন লিখে ফেলেছি–

আমাদের বাড়ির রেলিংয়ে একটা দাঁড়কাক এসে বসেছে। দাঁড়কাকটা সাইজে যথেষ্ট বড়। তার চোখ টকটকে লাল। কাকদের স্বভাব হচ্ছে অকারণে কা কা করে। এই কাকটা সে রকম না। সে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের বাসা দেখছে। কাকা করার ক্ষমতা মনে হয় তার নেই। মানুষের মধ্যে যেমন বোবা। আছে, কাকদের মধ্যেও থাকতে পারে।

আমার ছোটভাই রুবেল মুখে ভরর ভরর শব্দ করে তার গাড়ি নিয়ে রেলিংয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, অ্যাক্সিডেন্ট। দাঁড়কাকটার উড়ে যাওয়ার কথা, সে উড়ে গেল না। তার স্বরে ডেকে উঠল, কা কা। এতে ভয় পেয়ে রুবেল বিকট শব্দে কেঁদে উঠল।

আমি আরও কিছুটা লিখতাম, এর মধ্যে মুখ প্যাঁচার মতো করে বাবা কাঁচাবাজার থেকে ফিরলেন। তিনি একগাদা বাজার করেছিলেন। একটা হাঁস কিনেছিলেন। দাম দেওয়ার সময় হঠাৎ হাঁসটা হাত থেকে ছুটে গেল। বাবা বাজার ফেলে হাঁস ধরতে গেলেন। হাঁস ধরতে পারলেন না। বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এসে দেখেন তার বাজারের ব্যাগ নেই। মানুষের আম যায় ছালা যায়, বাবার হাঁস গেছে বাজার গেছে। এটা কি নতুন বাগধারা হতে পারে না? আহসান সাহেব বলেছেন, লেখকদের নতুন নতুন শব্দ তৈরি করতে হয়। বাগধারা তৈরি করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ অনেক নতুন শব্দ বাংলা ভাষাকে দিয়েছেন। যেমন– বাগানবিলাস, উদয়পদ্ম, নীলমণিলতা।

আমি নিজে কয়েকটা নতুন শব্দ বের করেছি। আমার উপন্যাসে শব্দগুলো দিয়ে দেব। শব্দগুলো এবং তার মানে–

ক : গরবত (গরবত হলো গরম শরবত)
খ : শীরবত (শীরবত হলো শীতল শরবত)
গ : ফামানুষ (ফাজিল মানুষ)।
ঘ : জ্ঞামানুষ (জ্ঞানী মানুষ। যেমন, আহসান সাহেব)
৬ : তর্কি (যে তর্ক করতে ভালোবাসে। যেমন, আমি।)
চ : নোংরি (যে মেয়ে নোংরা কথা বলতে পছন্দ করে। যেমন, প্রতিমা।)

উপন্যাসের আরও খানিকটা লেখা যেত, এর মধ্যে মা ইশারা করে আমাকে রান্নাঘরে যেতে বললেন। মা যখন বাবার আড়ালে কিছু বলতে চান, তখন তিনি রান্নাঘরে চলে যান। আমি রান্নাঘরে চলে গেলাম। মা গলা নামিয়ে বললেন, তোর বাবার শুধু যে হাঁস আর বাজার গেছে তা না, পকেটমারও হয়েছে। রিকশায় উঠে দেখে পাঞ্জাবির পকেটে মানিব্যাগ নেই।

কত টাকা ছিল?

এক হাজার টাকার একটা নোট আর কিছু খুচরা টাকা। তোর বাবা মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আছে।

মন খারাপ করারই কথা।

তুই একটা কাজ করতে পারবি? তোর বাবার হাঁসের মাংস দিয়ে খিচুড়ি খাওয়ার শখ ছিল। তুই একটা হাঁস কিনে আনতে পারবি? হাঁস আর পোলাওয়ের চাল।

পারব। টাকা দাও।

মা বললেন, তুই খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে।

আমি টাকা নিয়ে বাসার গেট থেকে বের হতেই আহসান সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি গাড়ি থেকে নামছেন। উনার একটা কালো রঙের টয়োটা গাড়ি আছে। ড্রাইভার গাড়ি চালায়। ড্রাইভারের নাম কিসমত। আহসান সাহেব বললেন, লিপি, কোথায় যাচ্ছ?

আমি বললাম, হাঁস কিনতে যাচ্ছি। বাসায় আজ হাঁস এবং খিচুড়ি রান্না হবে।

তোমাকে হাঁস কিনতে যেতে হচ্ছে কেন? তোমার বাবা কোথায়?

বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর মনে হয় শরীর খারাপ।

 হাঁস আর কী লাগবে?

হাঁস আর পোলাওয়ের চাল।

আহসান সাহেব বললেন, তোমাকে হাঁস কিনতে যেতে হবে না। তুমি আমার ঘরে আসো, একদান দাবা খেলব। কিসমত হাঁস আর পোলাওয়ের চাল নিয়ে আসবে।

আমি বললাম, কিসমত ভাইকে টাকা দিতে হবে না?

আহসান সাহেব হেসে ফেলে বললেন, না।

ড্রাইভার কিসমত ভাইকে নিয়ে আমার একটা গল্প আছে। একদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, বাসায় কীভাবে ফিরব বুঝতে পারছি না। থম বৃষ্টির সময় ঢাকা শহরে কোনো রিকশা পাওয়া যায় না।

বৃষ্টিতে ভিজে আমি ফিরতে পারি, আমার ভালোই লাগবে। সমস্যা একটাই, মা-পায়জামা ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকবে। সবাই তাকিয়ে দেখবে।

পুরুষমানুষের চোখ আনন্দে চকচক করবে। আমি কী করব ভাবছি, হঠাৎ দেখি কিসমত ভাই। আমি এগিয়ে গেলাম। কিসমত ভাই বললেন, আফা! স্যার গাড়ি পাঠাইছে।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ও আচ্ছা।

 কিসমত ভাই গাড়ির দরজা খুলে দিলে আমি উঠে পড়লাম। আমার একবারও মনে হলো না–কোনোদিনও আমার জন্য গাড়ি পাঠানো হয় নি, আজ পাঠানো হলো কেন? এমন তো হতে পারে কিসমত আমাকে গোপনে কোনো আস্তানায় নিয়ে যাবে।

বরং আমার মনে হলো, আহসান সাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। সাভারে তাঁর বাগানবাড়ির মতো বাড়ি আছে। আমি সেখানে যাব। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। যাকে বিয়ে করব তার সঙ্গে বিয়ের আগে কিছু সময় কাটাতে অসুবিধা কী?

কিসমত ভাই বলল, আফা গান ছাড়ব?  

আমি বললাম, হুঁ।

গাড়িতে গান হচ্ছে, শচীন কর্তার ডাকাতিয়া বাঁশি। আমি ভাবছি–বাহ ভালো তো, আমার জীবনের সঙ্গে মিল আছে। ডাকাতিয়া বাঁশি বাজছে, আমি চলে যাচ্ছি সাভারে।  

ও আল্লা! গাড়ি আমাদের বাসার সামনে থামল। আমি সামান্য মন খারাপ করেই আহসান সাহেবের ঘরে স্কুল-পোশাক পরেই গেলাম। তিনি ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন। আমাকে দেখে বই থেকে চোখ না তুলেই বললেন, গাড়ি গিয়েছিল?

আমি বললাম, হুঁ।

আহসান সাহেব বললেন, বৃষ্টি দেখে গাড়ি পাঠিয়েছি। একদিন দেখলাম বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে ফিরছ।

আমি বললাম, থ্যাংক য়্যু।

আহসান সাহেব বললেন, আজও দেখি গা পুরোপুরি ভেজা। বাসায় যাও। ড্রেস চেঞ্জ করো।

আমি তার ঘর থেকে বের হলাম।

গাড়িতে আসার পরও এত ভিজলাম কীভাবে বলি। আহসান সাহেবের ঘরে ঢোকার আগে ছাদে গিয়ে পুরোপুরি ভিজেছি, যাতে কাপড় গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যায়। অন্য পুরুষের সামনে এভাবে যাওয়া যায় না, তবে যাকে বিয়ে করব তার সামনে যাওয়া যায়। শুধু যে যাওয়া যায় তা না, যাওয়া উচিত। আহসান সাহেব। ফিরেও তাকালেন না, এটাই সমস্যা।

ধুর ছাতা! আমি আহসান সাহেব, আহসান সাহেব করছি কেন? এখন থেকে আহসান ডাকব। মনে মনে ডাকব। তাকে তো আর বলতে পারি না, আহসান, কী বই পড়ছ? আমি তোমার পাশে বসছি, তুমি আমাকে পড়ে শোনাও।

বিয়ের পরেও যে আমি তাকে আহসান বলতে পারব তা মনে হয় না। এই শুনছ! ধরনের কিছু ডাকতে হবে।

আমার মা বাবাকে ডাকে লিপির বাবা। শুনতে অসহ্য লাগে। দুই অক্ষরের নাম হয়ে সমস্যা হয়েছে। আমার নাম যদি মৃন্ময়ী হতো তাহলে মা কথায় কথায়। মৃন্ময়ীর বাবা ডাকতে পারত না।

আমি আমার নাম বদলাব। ডাক নাম ভালো নাম দুটাই। বই যখন ছাপা হবে তখন তো নাম বদলাতেই হবে। আমার ভালো নাম হামিদা বানু। কঠিন। প্রেমের উপন্যাসের লেখকের নাম হামিদা বানু, এটা কখনো হয়? আহসানের কাছে সুন্দর একটা ছদ্মনাম চাইতে হবে। আমি কয়েকটা নাম ঠিক করে রেখেছি। যেমন

১. মৃন্ময়ী চৌধুরী
২. রাজেশ্বরী
৩. চিত্রা সেন

কেউ কেউ বলতে পারে, হিন্দু নাম। আমি বলব, নামের আবার হিন্দু মুসলমান কী? নাম কি কখনো কলেমা পড়ে মুসলমান হয়েছে?

আহসানকে বিয়ে করলে বাবার একটা সমস্যা হবে। ছোট সমস্যা না, বেশ বড় সমস্যা। বাবা শুধু যে আহসানের বন্ধু তা না, বাবা তার কর্মচারী।

কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো। আহসানের তিনতলা বাড়ির একতলার তিনটি রুমে বিনা ভাড়ায় বাবা থাকেন। বিনিময়ে ভাড়াটেদের সমস্যা দেখেন। বাথরুমের কল নষ্ট হয়ে গেলে মিস্ত্রি ডেকে দেন। ইলেকট্রিক লাইনের সমস্যা দেখেন। দুপুরের পর আহসানের এ্যারাম ইন্টারন্যাশনাল অফিসে বসেন। সেখান থেকে বেতন কত পান আমি জানি না, তবে খুব বেশি পান না। কারণ বেশ। টানাটানি করেই আমাদের সংসার চলে।

আহসানের অনেক টাকা। একবার যাদের অনেক টাকা হয়ে যায়, তাদের টাকা বাড়তেই থাকে। আহসানের টাকা শুধু বাড়ছে। সে টাকা খরচ করতে জানে না। আমি জানি। বিয়ের পর ধুমসে খরচ করব। টয়লেটেও এসি লাগাব। বারো ইঞ্চি কালার টিভি বসাব।

বছরে তিন মাস বাইরে বাইরে ঘুরব। প্রথমে যাব শ্রীলংকা। হুমায়ূন হাফমেড শ্রীলংকা ঘুরে এসে একটা বই লিখেছেন, নাম রাবণের দেশে। ওই বইটা পড়ে আমার শ্রীলংকা যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে।

.

বাসায় খিচুড়ি হাঁসের মাংস রান্না হচ্ছে। আর আমি আহসানের সঙ্গে দাবা নিয়ে বসেছি। আমার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এসেছে। আজ তাকে দ্রুত হারিয়ে দিলে কেমন হয়? পুচকি এক মেয়ের কাছে হার মানুষটা কীভাবে নেবে?

আমি মনে মনে চাল গুনছি। আঠার চালের মাথায় আমি ঘোড়ার চালে তাঁকে মাত করলাম। তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, মাত নাকি?

আমি বললাম, জানি না তো।

তিনি বললেন, রাজা নড়াবার জায়গা নেই।

আমি বললাম, তাই তো। কীভাবে হলো?

তিনি মুখ শুকনা করে বললেন, এসো আরেক দান খেলি।

আমি বললাম, না না, আর খেলব না। আপনি হেরে গেছেন। আমার খুব খারাপ লাগছে।

তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, খেলায় হার-জিত থাকবেই। বোর্ড সাজাও। এবার তুমি সাদা নাও।

দ্বিতীয় দফায় তাঁকে হারালাম পনের চালে।

তিনি তৃতীয়বার বোর্ড সাজালেন। আমি দেখলাম তাঁর মুখ হয়েছে পাংশুবর্ণ। চাল দেওয়ার সময় তার হাত অল্প অল্প কাঁপছে। মানুষটার জন্যে এমন মায়া লাগল। চোখে পানি আসার মতো হলো।

তৃতীয় খেলায় তিনি একুশ চালে মাত হলেন। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তুমি দাবা খেলা ভালো জানো। এত দিন আমার সঙ্গে খেলা না-জানার অভিনয় করেছ। ঠিক বলেছি?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

অভিনয়টা কেন করলে?

একটা বাচ্চামেয়ের কাছে হার আপনি নিতে পারবেন না। এই ভেবে অভিনয় করেছি। আর করব না।

তিনি বললেন, কাঁদছ কেন?

আমি বললাম, আপনার জন্যে খুব খারাপ লাগছে, এইজন্যে কাঁদছি। আমি আপনার সঙ্গে আর কোনোদিনই দাবা খেলব না। আপনাকে আমার কাছে হারতে হবে না।

তুমি অদ্ভুত এক মেয়ে।

আমি অদ্ভুত না। আমি খুব খারাপ একটা মেয়ে।

তিনি টিস্যুর বাক্স এগিয়ে দিয়ে বললেন, চোখ মোছো। Compose yourself.

আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি কিছু বলার আগেই দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হলাম। দরজার চৌকাঠে মাথা লেগে কপালের এক কোনা আলুর মতো ফুলে উঠল। মা আমাকে দেখে বললেন, তোর কপালে কী হয়েছে?

আমি বললাম, আমাকে মেরেছে, এইজন্যে কপাল ফুলেছে।

মা অবাক হয়ে বললেন, কে মেরেছে?

আমি বললাম, আহসান সাহেব মেরেছেন। আমার কাছে দাবায় হেরে তিনি দাবার বাক্স ছুঁড়ে মেরেছেন।

মা বললেন, কী বলছিস তুই?

আমি বললাম, মা সত্যি। আল্লাহর কসম।

মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তোদের ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না। উনার মতো মানুষ দাবা বোর্ড ছুঁড়ে মারবেন। এইসব কী?

আমি ঠিক করেছি উনার মাথায় একটা ডিকশনারি ছুঁড়ে মারব। উনি জ্ঞানী মানুষ তো, উনার জন্যে ডিকশনারি।

মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ থেকে বিস্ময়বোধ দূর হচ্ছে না।

.

দুপুরে খেতে বসার ঠিক আগে আগে প্রতিমা উপস্থিত। আমি বললাম, প্রতিমা, তুই ভালো দিনে এসেছিস। আজ বাসায় হাঁস আর খিচুড়ি হচ্ছে।

খাবার টেবিলে বাইরের লোক থাকলে বাবা খুব খুশি হন। কেন খুশি হন তা জানি না। আমরা গরিব মানুষ। কেউ আমাদের খাবারে ভাগ বসালে আমাদের খুশি হওয়ার কথা না।

বাবা প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হাঁসের মাংসের কোন পিস তোমার পছন্দ বলো।

প্রতিমা বলল, কাকা, আপনার কোন পিস পছন্দ সেটা বলুন।

বাবা বললেন, রানের মাংস।

প্রতিমা বলল, তাহলে আমি নেব দুটা রান। আপনাকে রান খেতে দেব না।

এমন কিছু হাসির কথা না, কিন্তু বাবা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে যাচ্ছেন।

প্রতিমা সত্যি সত্যি দুটা রান পাতে নিল। বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কাকা, আমি হাঁসের মাংস খাই না। আমার প্লেটটা আমি আপনার জন্যে সাজিয়েছি। আমি খিচুড়ি খাব ঝোল দিয়ে।

বাবা আবারও হাসতে হাসতে ভেঙে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সকালে মানিব্যাগ এবং হাঁস হারানোর দুঃখ তিনি পুরোপুরি ভুলে গেছেন।

.

প্রতিমাকে আমি উপন্যাসের প্রথম পাতাটা পড়ালাম। সে বিরক্ত হয়ে বলল, শুরুটা আমার করার কথা না? একটা সেক্স-সিকোয়েন্স দিয়ে শুরু। আমি সব গুছিয়ে রেখেছি। খুব রাগ করলাম। তোর সঙ্গে আর কথা বলব না। অংক মিসকে সেকেন্ড চিঠি যা পাঠাব, তাও পড়তে দিব না।

আমি বললাম, চিঠি সঙ্গে এনেছিস?

প্রতিমা বলল, হু। চিঠি পড়াতেই তো এসেছি।

তাহলে দে, পড়ি।

তুই যদি প্রমিজ করিস উপন্যাসের শুরুটা আমাকে লিখতে দিবি, তাহলে পড়তে দেব।

আচ্ছা যা, তোকে লিখতে দেব।

প্রতিমা চিঠি বের করল। দ্বিতীয় চিঠি প্রথমটার চেয়েও ভয়ংকর

ও আমার লুতু লুতু পুতুপুতু গুতু গুতু সোনা। তুমি কেমন আছ লক্ষ্মী? তুমি আমার পক্ষী।

আচ্ছা পুতু পুতু গুতু গুতু, শোনো। তুমি তোমার পাছাটা এত বড় কীভাবে বানিয়েছ? নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো এক্সারসাইজ করো।

আমার কথায় আবার রাগ করছ না তো? তুমি রাগ করলে আমি কিন্তু মরেই যাব।

.

প্রতিমা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকল, আমার উপন্যাসের শুরুটা লিখে দিয়ে গেল। ভয়ংকর এক শুরু।

নগ্ন নায়িকার ঘরে ঢুকেছে ইমন (শুভ্র নাম বদলে ইমন রাখা হয়েছে)। ইমন চট করে দরজা লক করে দিল, কিন্তু বারান্দার জানালাটা রইল খোলা। খোলা জানালা দিয়ে শুধু যে দাঁড়কাক সব দেখছে তা না, শব্দ শুনে একসময় মা এসে জানালা দিয়ে দেখেন তার মেয়ে এবং ইমন আছে 69 অবস্থায়।

আমি প্রতিমাকে বললাম, 69 কী?

প্রতিম হাই তুলতে তুলতে বলল, তোর বোঝার দরকার নেই। যাদের বোঝার তারা ঠিকই বুঝবে।

প্রতিমা চলে যাওয়ার পরে আমি পুরো লেখাটা কপি করে আহসান সাহেবের কাছে গেলাম। আজ তাঁর মেজাজ খুবই ভালো। তিনি আমাকে দেখেই হাসিমুখে বললেন, Hello friend!

আমি হাসলাম। অন্য রকম হাসি। ঠোঁটের এক কোনায় হাসতে হয়।

আহসান সাহেব বললেন, হাতে কাগজ কিসের? উপন্যাস?

জি। শুরুটা লিখে ফেলেছি।

কেমন হয়েছে?

বুঝতে পারছি না, এইজন্যে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। পড়ে দেখুন।

আহসান সাহেব পড়ছেন। আমি তার সামনে বেতের চেয়ারে ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারি না টাইপ মুখ করে বসে আছি। মাঝে মাঝে ঠোঁট গোল করে শিস দেওয়ার চেষ্টা করছি। শিস হচ্ছে না। প্রতিমা খুব সুন্দর শিস দিতে পারে। তার কাছে থেকে শিখতে হবে।

লিপি।

জি।

আহসান সাহেব হাতের লেখা টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ এক কিশোরী। তোমার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।

কী চিকিৎসা?

সাইকিয়াট্রিস্ট ঠিক করবেন কী চিকিৎসা। আমার পরিচিত সাইটেকিয়াট্রিস্ট আছেন। আমি তোমাকে সঙ্গে করে তার কাছে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?

হ্যাঁ, ঠিক আছে। কবে নিয়ে যাবেন?

এখনই নিয়ে যেতে পারি। সে রাত নটা পর্যন্ত রোগী দেখে। এখন সময় হলো সাড়ে সাত। টেলিফোন করে দেখি সে আছে কি না।

টেলিফোনে সাইকিয়াট্রিস্টকে পাওয়া গেল।

আহসান সাহেব অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলেন। আমাকে বললেন, তুমি ড্রেস পাল্টালে পাল্টাও। মাকে বলে আসো।

কী বলব? পাগল হয়ে গেছি তো, তাই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাচ্ছি?

এইসব বলার দরকার নেই। বলো যে আমার সঙ্গে শপিংয়ে যাচ্ছ। এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরবে।

আমি ড্রেস বদলে শাড়ি পরলাম। চোখে কাজল দিলাম।

মা অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কী রে?

আমি বললাম, ব্যাপার জানি না। আহসান সাহেব আমাকে তার সঙ্গে যেতে বললেন। আচ্ছা মা শোনো, উনি যদি আমাকে কোনো হোটেলে নিয়ে যেতে চান তাহলে কী করব?

মা আতংকে অস্থির হয়ে বললেন, হোটেলে কেন নিয়ে যাবে?

আমি গালে পাউডার ঘষতে ঘষতে বললাম, বুড়োরা তরুণী মেয়েদের হোটেলে কেন নিতে চায় তুমি জানো না?

তোর বাবা বাসায় নেই। তাঁকে না জানিয়ে আমি তোকে আহসান সাহেবের সঙ্গে ছাড়ব না।

আমি বললাম, এই কথা আমি উনাকে বলতে পারব না। তুমি বলে আসো। তুমিও পারবে না। আশ্রিতদের এই হলো সমস্যা।

মা ক্ষীণ গলায় বললেন, আমরা আশ্রিত?

আমি বললাম, অবশ্যই।

.

সাইকিয়াট্রিস্ট সাহেবকে দেখে আমার ভালো লাগল। পঞ্চাশের মতো বয়স। মাথাভর্তি সাদা-কালো মেশানো চুল। নাকের নিচে আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো গোঁফ। ভারী কাঁচের চশমার আড়ালে বড় বড় চোখ। তিনি পরেছেন সিল্কের হাফ হাওয়াই শার্ট। হুমায়ূন স্যারের মিসির আলির চেহারা হয়তো এই দ্রলোকের মতো। সাইকিয়াট্রিস্টের নাম আশফাঁক। মনোবিদ্যায় তাঁর Ph.D ডিগ্রি আছে।

তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন (কথোপকথনের সময় আহসান সাহেবকে বাইরে রাখা হলো)।

সাইকিয়াট্রিস্ট : মা। কেমন আছ?

আমি : (শুরুতেই মা ডাকায় আমি বেশ চমকেছি। ভেবে রেখেছিলাম উল্টা পাল্টা কথা বলে সাইকিয়াট্রিস্টকে ভড়কে দেব। এখন মনে হচ্ছে পারব না। যে শুরুতেই মিষ্টি করে মা ডাকে, তার সঙ্গে উল্টা-পাল্টা কথা বলা যায় না।)।

সাইকিয়াট্রিস্ট : প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন? তুমি কেমন আছ?

আমি : চাচা। আমি ভালো আছি।

 সাইকিয়াট্রিস্ট : কতটা ভালো? খুব বেশি, না মোটামুটি ভালো?

আমি : মোটামুটি।

সাইকিয়াট্রিস্ট : তোমার উপন্যাসের প্রথম তিন পাতা আমি পড়েছি। মা, বলো তো তোমার জীবনে কি এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে?

আমি : না।

সাইকিয়াট্রিস্ট : তোমার মধ্যে কি কোনো পাপবোধ আছে?

আমি : না।

সাইকিয়াট্রিস্ট : কারও প্রতি কি তোমার রাগ আছে? প্রচণ্ড রাগ। খুন করতে। ইচ্ছা হয়, এমন?

আমি : আছে। আমার বড় মামার প্রতি আছে।

 সাইকিয়াট্রিস্ট : তার প্রতি রাগের কারণটা বলো তো শুনি।

আমি : বলব না। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।

সাইকিয়াট্রিস্ট : মা শোনো। আমি তোমার ডাক্তার। ডাক্তারকে সব বলতে হয়।

আমি : যখন ছোট ছিলাম, আট ন বছর বয়স, তখন মামা খেলার ছলে আমার শরীরের নানান জায়গায় হাত দিতেন। খুবই অস্বস্তি বোধ করতাম। মামা কেন এরকম করছেন বুঝতাম না। এখন বুঝি।

সাইকিয়াট্রিস্ট : তুমি যে অসম্ভব রূপবতী একজন মেয়ে, এটা কি জানো?

আমি : জানি। মা আমাকে আদর করে পরী ডাকেন। তা ছাড়া নিজেও আয়নায় নিজেকে দেখি।

সাইকিয়াট্রিস্ট : দেখে মুগ্ধ হও?

আমি : হই।

সাইকিয়াট্রিস্ট : তোমার বান্ধবীর সংখ্যা কেমন?

আমি : আমার একজন মাত্র বান্ধবী, তার নাম প্রতিমা।

 সাইকিয়াট্রিস্ট : সে কি দেখতে কদাকার?

আমি : না। অপূর্ব রূপবতী।

সাইকিয়াট্রিস্ট : তোমার চেয়েও?

আমি : মনে হয় সমান সমান। আপনাকে একটা কথা বলি, আমার উপন্যাসের প্রথম তিন পাতা আমার লেখা না। প্রতিমার লেখা।

সাইকিয়াট্রিস্ট; অতিরিক্ত রূপবতীরা রূপের কারণে সবার চেয়ে আলাদা হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে Alienation প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখনই মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

আমি : আমার মধ্যে কোনো মানসিক সমস্যা নেই। আমার বান্ধবী প্রতিমার মধ্যে আছে। আমি কি তাকে নিয়ে আপনার কাছে আসতে পারি?

সাইকিয়াট্রিস্ট : পারো।

বাসায় ফিরলাম রাত সাড়ে নটায়। বাবা তখনো ফিরেন নি। মা এবং বড় মামা বসে আছেন। দুজনের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। বড় মামা বললেন, লিপি, কোথায় গিয়েছিলে?

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আহসান সাহেবের সঙ্গে লং ড্রাইভে গিয়েছিলাম।

বড় মামা বললেন, তুমি বসো এখানে। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

আমি বললাম, এক মিনিট মামা। আসছি। বলেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বাতি অফ করে দিলাম।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ