সোমবার আমার জন্যে অশুভ। শুধু অশুভ বললে কম বলা হবে, ভয়ংকর ভয়ংকর অশুভ। এমন কোনো সোমবার যায় নি যেদিন আমার জীবনে খারাপ কিছু ঘটে নি।

আজ যে সোমবার মনেই ছিল না। মা যখন বললেন, লিপি, তোর ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে। তখনই মনে হলো, আজ সোমবার না তো! মাকে বললাম, আজ কি সোমবার?

মা বললেন, সোমবার মঙ্গলবার জানি না। তুই ঘরের জিনিসপত্র বের করে ফেল।

আমি গলা স্বাভাবিক করে বললাম, কেন?

মা আনন্দিত গলায় বললেন, তোর বড় মামা এই ঘরে থাকবে।

তাঁর না হোটেলে ওঠার কথা?

নিজের বোনের বাড়ি থাকতে সে হোটেলে কেন উঠবে?

বড় মামার আমাদের বাসায় এসে ওঠার কারণটা বলি। রামপুরায় তাঁর বাড়ি আছে। পাঁচ কাঠা জমির ওপর বাড়ি। অনেক দিন থেকেই ডেভেলপারের সঙ্গে বড় মামা দেনদরবার করছিলেন। তারা পুরনো বাড়ি ভেঙে দশতলা বাড়ি করবে। তারা কিছু নেবে, বড় মামা কিছু পাবেন। ডেভেলপারদের সঙ্গে দরে বনছিল না। এখন মনে হয় বনেছে।

আমি বললাম, আমি কোথায় থাকব?

তুই পুবের ঘরে থাকবি।

পুবের ঘরটা তো স্টোররুম।

জিনিসপত্র সরিয়ে ফেললেই সুন্দর ঘর হবে। আমি গুছিয়ে দেব। জানালায় নতুন পর্দা দেব।

মার আনন্দে ঝলমল মুখ দেখে আমি নিজের কষ্ট ভুলে গিয়ে এমন ভাব করতে থাকলাম যেন বড় মামা আসায় আমিও খুশি। আনন্দ রাখার জায়গা পাচ্ছি না। এমন অবস্থা।

এখন মার খুশির কারণ ব্যাখ্যা করি। ডেভেলপাররা যে ফ্ল্যাটবাড়ি করবে মা সেখান থেকে ওয়ারিশান সূত্রে ফ্ল্যাট পাবে। আমার দুই মামা। ছোট মামা কলেজে পড়ার সময় কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মারা গেছেন। এখন বড় মামা। ও মা এই দুজনই শুধু নানাজানের সম্পত্তির মালিক।

বড় মামার দুই ছেলে এবং এরা দুজনই অস্ট্রেলিয়ায়। ইন্ডিয়ান কী এক রেস্টুরেন্টে কাজ করে। মামিও ছেলেদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মামা-মামির সম্পর্ক ভয়ানক খারাপ।

আমি, মা আর সকিনা মিলে বিকেলের মধ্যে মামার ঘর গুছিয়ে ফেললাম। বাবা নিজেই প্লাস্টিক পেইন্ট করলেন। এইসব কাজ তিনি ভালো পারেন।

বড় মামা সন্ধ্যাবেলায় একটি এসি নিয়ে উপস্থিত হলেন। যে ঘরে তিনি থাকবেন সেখানে এসি বসবে। তিনি গরম সহ্য করতে পারেন না। এসির সঙ্গে মিস্ত্রি এসেছে। সে এক ঘণ্টার মধ্যে এসি বসিয়ে দিল।

আমার পরিচিত ঘরটা চোখের সামনে অন্যরকম হয়ে গেছে। ঘরের দেওয়াল হালকা নীল। এই গরমেও ঘর শীতকালের মতো ঠান্ডা। বিছানায় নতুন চাঁদর। একটা কোলবালিশও কেনা হয়েছে। খাটের পাশে বেডসাইড কার্পেট দেওয়া হয়েছে। নতুন দেয়ালঘড়ি লাগানো হয়েছে।

বড় মামা তার ঘর দেখে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। মাকে বললেন, সব ঠিক আছে। আজ আর উঠব না। ঘরে কাঁচা রঙের গন্ধ। গন্ধটা মরুক। নতুন একটা ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি কিনব। আগেরটা নষ্ট হয়ে গেছে। ছবি ওঠানামা করে।

মা বলল, ভাইজান, আর কী কী লাগবে বলুন, আমি ব্যবস্থা করব।

বড় মামা বললেন, তোকে কিছুই ব্যবস্থা করতে হবে না। ব্যবস্থা যা করবার আমিই করব। এখন আমার কিছু কথা মন দিয়ে শোন, সকালে আমি চার-পাঁচটা পত্রিকা পড়ি। পত্রিকার নাম দিয়ে যাব, হকারকে পত্রিকা দিতে বলবি। পত্রিকার বিল আমি দেব।

মা বললেন, আপনি কেন দেবেন?

বড় মামা বললেন, তোদের অবস্থা আমি জানি, এইজন্যে আমি দিব। শুধু পত্রিকার বিল না, মাসে এক হাজার করে টাকা দিব। মাসের এক তারিখে সারা মাসের চাল ডাল তেল মসলা কিনে দেব।

বাবা বললেন, ভাইজান, এইসব কী বলেন?

পেইংগেস্টরা যে রকম থাকে আমি সেই রকম থাকব। এই বিষয়ে আর কোনো কথা শুনব না।

বড় মামা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলেন। সেখান থেকে এক হাজার টাকার দুইটা চকচকে নোট বের করে বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ঘর ঠিক করেছ, খরচপাতি হয়েছে, এই টাকাটা রাখো।

মা বাবার দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলেন টাকা না রাখতে, বাবা টাকা রাখলেন। এমন ভাব করলেন যেন চোখের ইশারা বুঝতে পারেন নি।

বড় মামা চলে যাওয়ার পর বাবা আমাকে নিয়ে বারান্দায় গেলেন, গলা নামিয়ে বললেন, ডেভেলপারের সঙ্গে তোমার মামার কী চুক্তি হয়েছে সেটা জানা দরকার। ডেভেলপাররা চুক্তির সময় ক্যাশ টাকা দেয়। সেই টাকায় তোমার মার অংশ আছে। সেই টাকা কোথায়?

আমি বললাম, এইসব আমাকে কেন বলছ? আমার সঙ্গে তো ডেভেলপারদের কোনো চুক্তি হয় নি।

বাবা বললেন, তোমার সঙ্গে শেয়ার করছি। তুমি আবার তোমার মাকে কিছু বলতে যেয়ো না। তোমার মা ভাববে আমি লোভী।

আমি বললাম, তুমি তো লোভীই। লোভী না হলে এমন চিন্তা করতে না।

বাবা বললেন, বাস্তব চিন্তা করছি। তোমার বড় মামা ধুরন্দর প্রকৃতির মানুষ। শেষে দেখা গেল তোমার মা কিছুই পেল না।

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, কিছু না পেলে কী আর করা!

আমার এই হাই নকল। আমি ইচ্ছা করলেই ঘনঘন হাই তুলতে পারি। কোনো আলাপ পছন্দ না হলে আমি হাই তুলি।

বাবা যে বললেন, বড় মামা ধুরন্দর প্রকৃতির, এটা ঠিক আছে। একটা ঘটনা বললেই তার প্রকৃতি বোঝা যাবে। আমার নানিজানের প্রচুর গয়না ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর বড় মামা আমার মাকে বললেন, মৃত্যুর সময় মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা নষ্ট হয়ে যায়। অস্বাভাবিক কাজকর্ম করে।

মা বললেন, এই কথা কেন বলছ ভাইজান?

বড় মামা বললেন, মার কর্মকাণ্ড দেখে বাধ্য হয়ে বলছি।

মা কী করেছে?

বড় মামা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যেদিন মারা গেলেন সেদিন সকালে তোর ভাবিকে ডেকে বললেন, “বৌমা, আমার সব গয়না তোমাকে দিয়ে গেলাম। তুমি দিয়ো তোমার ছেলের বৌকে।

তোকে মা এত আদর করত, অথচ তোর কথা একবার মনেও করল না। আশ্চর্য মহিলা!

মা বলল, মাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলবে না ভাইজান। মা যা ভালো মনে করেছে করেছে।

বড় মামা বললেন, কাজটা যে অনুচিত হয়েছে সেটা বলব না? যাই হোক, আমি তোর ভাবিকে বলেছি, কিছু গয়না ফরিদাকে দিয়ো। মায়ের স্মৃতিচিহ্ন। তবে মেয়েমানুষ তো, গয়না হাতছাড়া করবে না।

এই হলো আমার বড় মামা। আমার ধারণা বড় মামা একদিন বলবে, ফরিদা! তোকে বলা হয় নাই, রামপুরার জমিটা বাবা আমাকে লিখে দিয়ে গেছেন। কাজেই তোর সেখানে অংশ নাই। তারপরেও তোকে একটা ফ্ল্যাট আমি দেব।

যদি এরকম কিছু ঘটে, তাহলে আমি বড় মামাকে টাইট দেব। কীভাবে টাইট দেব তা এখনো ঠিক করি নি।

সন্ধ্যাবেলা আহসানের ঘরে গেলাম।

আহসান আহসান বলতে অস্বস্তি লাগছে, আমি আহসান সাহেবে ফিরে যাই। উনার ঘরে কোনো অজুহাত ছাড়া যাওয়া ঠিক না, আমি এক কাপ চা নিয়ে গেলাম।

আহসান সাহেব বললেন, আমি দিনে দুই কাপের বেশি চা খাই না। আজকের দিনের দুকাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে।

আমি বললাম, এটা সাধারণ চা না। এটা তুলসি চা। চা পাতার সঙ্গে তুলসি পাতা জ্বাল দিয়ে বানানো। (কথাটা মিথ্যা, সাধারণ চার মধ্যে আমি ধনিয়া পাতা দিয়েছি। ধনিয়া চা বলা যেতে পারে।)

আহসান সাহেব বললেন, তুলসি চা তো আমি আরও খাই না। তুমি খেয়ে ফেলো।

আমি আচ্ছা বলে চায়ে চুমুক দিলাম। উনি বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো কাজে এসেছ। কাজটা বলো।

আমি বললাম, আপনার মোবাইল থেকে কি একটা টেলিফোন করতে পারব? (আমার কোথাও টেলিফোন করার দরকার নেই। উনার মোবাইল কিছুক্ষণের জন্য প্রয়োজন। আসমা নামের একটা মেয়ে প্রায়ই তাকে টেলিফোন করে। উনিও করেন। আমার ওই মহিলার টেলিফোন নম্বর প্রয়োজন।)

আহসান সাহেব বললেন, মোবাইল ফোন হলো ব্যক্তিগত ফোন। এটা দেওয়া যাবে না। ল্যান্ডফোনে টেলিফোন করো।

আমি বললাম, জি আচ্ছা।

উনি বললেন, আমার কথা শুনে মুখ ভোঁতা করে ফেললে কেন?

আমি বললাম, আপনার কথা শুনে মুখ ভোঁতা করি নি। অন্য কারণে মুখ ভোঁতা হয়েছে।

অন্য কারণটা কী?

উপন্যাসটা লিখতে পারছি না। গল্পটা গোছানো আছে, কিন্তু লেখা আসছে না।

গল্পটা কী?

প্রেমের গল্প। বয়স্ক একজন মানুষ খুবই অল্প বয়সী একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে। বুড়োটা নানান কর্মকাণ্ড করে মেয়েটাকে তার প্রেমের ব্যাপার বোঝাতে চায়, কিন্তু বোঝাতে পারে না।

কী রকম কর্মকাণ্ড?

এটা নিয়ে এখনো চিন্তা করি নি। আচ্ছা যাই।

টেলিফোন না করেই চলে যাচ্ছ?

ও আল্লাহ! ভুলে গেছি।

আমি ল্যান্ডফোন হাতে নিয়ে বসে আছি। কাকে টেলিফোন করব বুঝতে পারছি না। কাছের কারও টেলিফোন নম্বর আমার মনে নেই। আমি কিছুক্ষণ এলোমেলোভাবে নম্বর টিপে কারও সঙ্গে কথা বলছি এমন গলায় বললাম, মৃন্ময়ী! আমি লিপি। দুপুরে তোর ওখানে যাওয়ার কথা ছিল, যেতে পারি নি, সরি। আমার বড় মামা আমাদের বাসায় থাকতে আসছেন। তার জন্য ঘর গুছাচ্ছিলাম। উনি থাকবেন আমার ঘরে। আমি কোথায় থাকব? এখনো ঠিক করি নি। আমাদের একটা স্টোররুমের মতো আছে, সেখানে থাকতে পারি। আচ্ছা রাখি, কাল দেখা হবে।

ফোন রেখে চলে আসছি, আহসান সাহেব বললেন, তোমাদের ফ্ল্যাটের দুইটা ঘর আমার অফিসের জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই, তার একটা খালি করে দিতে বলি, তুমি সেখানে থাকো।

আমি বললাম, না।

তিনি বললেন, না কেন?

আমি একজন লেখিকা, এইজন্য না। ক্রিয়েটিভ মানুষ কারও দয়া নেয় না।

আহসান সাহেব শব্দ করে হাসলেন। আমি বললাম, এইভাবে হাসছেন কেন?

উনি বললেন, তুমি স্টোররুমে থাকবে, এটা আমাকে শোনাবার জন্য মিছিমিছি টেলিফোনে কথা বলেছ। ল্যান্ডফোনে সাতবার বোতাম টিপেছ।

তোমার কথা শুনে যখন ঘরের ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি, তখন আবার লেখিকা সাজছ, এইজন্য হাসছি।

আমি মুখ ভোঁতা করে বের হয়ে এলাম। আজ সোমবার বলেই যথেষ্ট লজ্জা। পেয়েছি। তবে লজ্জার সঙ্গে কিছুটা আনন্দও পেয়েছি। উনি আমাকে যথেষ্ট মন দিয়ে লক্ষ করেছেন, তা না হলে আমি যে সাতবার বোতাম টিপেছি তা ধরতে পারতেন না। আনন্দ পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। হয়তো আরও ঘটবে।

.

আহসান সাহেবের লোকজন একদিনে আমার ঘর ঠিক করে দিল। ঘরে নতুন রঙ করা হলো। এসি লাগানো হলো। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, নতুন একটা বাইশ ইঞ্চি ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি চলে এল। মা অবাক হয়ে বলল, লিপি, ব্যাপার কী রে?

আমি বললাম, জানি না কী ব্যাপার। মনে হয় উনি আমার প্রেমে পড়েছেন। বুড়োরা প্রেমে পড়লে প্রেমিকার মন ভুলাবার জন্যে প্রচুর খরচপাতি করে।

মা আঁতকে উঠে বললেন, ছিঃ ছিঃ কী বলিস তুই! তওবা কর। ফেরেশতার মতো মানুষ। তোকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। তাকে নিয়ে এত নোংরা কথা। উনার কানে গেলে উনি কী ভাববেন?

রাত আটটার দিকে বাবা বাসায় এলেন। মা সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে নালিশ করলেন। বাবা বললেন, লিপি! তুই এই ধরনের কথা বলেছিস? ইয়েস অর নো? (বাবা সবসময় আমার সঙ্গে তুমি তুমি করে কথা বলেন। এখন তুই-এ নেমে এসেছেন।)

আমি বললাম, বলেছি।

বাবা বললেন, কানে ধর।

আমি বললাম, কানে ধরব না।

বাবা বললেন, এত বড় কথা তুই কোন সাহসে বললি?

আমি বললাম, ইচ্ছা হয়েছে বলেছি।

আর কখনো বলবি?

আবার যদি ইচ্ছা হয় বলব।

তোর মতো দুষ্ট মেয়ে তো আমি বাসায় রাখব না। দুষ্ট মেয়ের চেয়ে শূন্য বাড়ি ভালো। তুই এক্ষণ, এই মুহূর্তে আমার বাসা ছেড়ে চলে যাবি।

আমি বললাম, Ok.

বাবা চিৎকার করে বললেন, আবার ইংরেজি বলে? গেট আউট, গেট আউট।

মা বললেন, এত রাতে কোথায় যাবে?

বাবা বললেন, সেটা আমার বিবেচ্য না। যেখানে ইচ্ছা যাবে। দুষ্ট মেয়ে আমি পুষব না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি আদর্শ নিয়ে চলি।

আমি গটগট করে তাদের সামনে থেকে বের হলাম। আহসান সাহেবের ড্রাইভার কিসমতকে বললাম, আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যান, আপনার স্যার। বলেছে।

গাড়ি নিয়ে আমি কোথায় গেলাম শুনলে অবাক হবেন, আমি গেলাম লেখক হুমায়ূন আহমেদের ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে।

দারোয়ান গেটেই আটকাল। আমি বললাম, হুমায়ূন আহমেদ আমার বড় চাচা। শুনেছি উনার শরীর খারাপ, এইজন্যে দেখতে এসেছি।

দারোয়ান বলল, স্যার তো বাসায় নেই। ম্যাডামকে নিয়ে কোথায় যেন গেছেন।

আমি বললাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে চাচা কোথায় গেলেন? লেখক মানুষ, শরীর নিয়ে তাদের কারবার না, মন নিয়ে তাদের কারবার। যাই হোক, আমি অপেক্ষা করব।

দারোয়ান দামি গাড়ি দেখেই মনে হয় ছেড়ে দিল। আমি কিসমত ভাইকে বললাম, আমার বাবা-মা আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। আমি এখন আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। আমি আপনার পায়ে পড়ি, আপনি আমাকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছেন বলবেন না। বলবেন, আমাকে রেলস্টেশনে নামিয়ে দিয়েছেন। আমি চাই তাঁরা দুশ্চিন্তা করুক।

লেখক এবং লেখকপত্নী রাত এগারটার দিকে এলেন। এর মধ্যে আমি বেশ স্বাভাবিকভাবেই আছি। এই বাড়িতে টেলিফোন করলে যে বলত, “স্যার রেস্টে আছেন, তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সে হুমায়ুন আহমেদের পিয়ন, নাম মোস্তফা।

আমি বললাম, মোস্তফা ভাই, ভাত খাব। ঘরে তেমন কোনো খাবার না করলে ডিম ভেজে দিতে বলুন। গরম ভাত, ডিম ভাজা আর শুকনা মরিচ ভাজা। হুমায়ূন স্যারের পছন্দের খাবার। আমি তাঁর লেখায় পড়েছি।

মোস্তফা ভাই ডিম ভাজতে গেল। এই ফাঁকে আমি একটা ঘরে ঢুকে পড়লাম। দেখি, লেখকের পুত্র গম্ভীর হয়ে টিভিতে কার্টুন দেখছে। আমি বললাম, তোমার নাম কী? সে বলল, আমাকে বিরাক্ত করবে না।

আমি বললাম, বিরাক্ত আবার কী?

সে বলল, বিরাক্ত হলো ডিস্টার্ব।

তোমার নামটা জানতে পারি?

নিষাদ।

নামের অর্থ জানো?

আমাকে বিরাক্ত করবে না। আমাকে বিরাক্ত করলে আমি লাগ হব। আমার অনেক লাগ।

ছেলেটা র এর জায়গায় ল বলছে, আবার বিরক্ত বলার সময় র উচ্চারণ করতে পারছে। তার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সে হাত ধরে আমাকে তার ঘরের বাইরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

.

লেখক এবং লেখকপত্নী ফিরলেন রাত এগারটায়।

আমি আয়োজন করে ভাত খাচ্ছি, লেখকপত্নী আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, তুমি কে?

আমি বললাম, আমার নাম মৃন্ময়ী।

লেখকপত্নী বললেন, আমি তো তোমাকে চিনতে পারছি না। তিনি লেখকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি একে চেনো?

লেখক বললেন, না। বলেই তিনি শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন। তাঁর মুখ গম্ভীর। মনে হয় স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।

লেখকপত্নী বললেন, এই বাড়িতে এসেছ কেন? এখানে কী?

আমি বললাম, আমাকে বাবা বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। রাতটা আপনাদের বাসায় থাকব, ভোরবেলা চলে যাব।

লেখকপত্নী বললেন, কোথায় যাবে?

আমি বললাম, এখনো ঠিক করি নি, নাক বরাবর হাঁটা ধরব।

লেখকপত্নী (তাঁর নাম শাওন) শান্ত গলায় বললেন, তুমি খেতে বসেছ, খাও তারপর আমি নিজে তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসব। তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলব।

আমি বললাম, আচ্ছা।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই মহিলা আমাকে শুধু ডিমভাজা আর ডাল দিয়ে খাবার কেন দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে মোস্তফাঁকে ধমক দিলেন। ফ্রিজ থেকে মাং বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে দিতে বললেন।

এক পর্যায়ে লেখক আমার পাশের চেয়ারে খেতে বসলেন। তাকে দেওয়া হলো পাতলা খিচুড়ি। তিনি এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। এত রাতে না খাইয়ে তাঁকে কেন ছেড়ে দিল ভেবে আমার লেখকপুত্রের মতো লাগ হয়ে গেল।

আমি ভেবেছিলাম লেখক সাহেব আমার সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না। পাতলা খিচুড়ি খেয়ে চলে যাবেন। তিনি তা করলেন না। আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, তুমি বলছিলে তোমার নাম মৃন্ময়ী। এটা তোমার আসল নাম না। আসল নাম কী?

আমি বললাম, আসল নাম না তা কীভাবে বুঝলেন?

মৃন্ময়ী শব্দটা যেভাবে উচ্চারণ করেছ সেখান থেকে বুঝেছি।

 আমার নাম লিপি।

এইবার তিনি সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, কেমন আছ লিপি?

আমি বললাম, ভালো আছি।

কতটা ভালো?

অনেকখানি ভালো।

একটা উপদেশ কি তোমাকে দিতে পারি?

অবশ্যই পারেন।

এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা কতটা দুশ্চিন্তা করছেন বুঝতে পারছ?

পারছি।

না, পারছ না। এখন যদি তুমি বাসায় উপস্থিত হও, তোমাকে দেখে তোমার বাবা আনন্দে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। খাওয়া শেষ করে গাড়িতে উঠো, শাওন তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবে।

জি আচ্ছা।

রাত একটায় শাওন ম্যাডাম মোস্তফাঁকে নিয়ে আমাকে পৌঁছে দিলেন। বাবার সঙ্গে তার কোনো কথা হলো না, কারণ বাবা আমাকে দেখেই মাগো কোথায় ছিলি বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আহসান সাহেব আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তাঁর মুখ ভয়ংকর গম্ভীর।

আহসান সাহেব বললেন, তুমি যে কত বড় অন্যায় করেছ তা কি বুঝতে পারছ?

আমি বললাম, আমি কোনো অন্যায় করি নি। বাবা আমাকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন, কাজেই বের হয়ে গেছি।

বাইরে কোথাও না গিয়ে তুমি আমার এখানে চলে আসতে।

আমি বললাম, আপনার এখানে কেন আসব? আপনি আমার কেউ না।

আমি তোমার কেউ না?

না।

আহসান সাহেব বললেন, যার কাছে গিয়েছ সেও তো তোমার কেউ না।

আমি বললাম, উনি একজন লেখক, আমিও একজন লেখিকা, এই পরিচয়ে গিয়েছি। লেখকে লেখকে ধূল পরিমাণ।

বাবার সঙ্গে কী নিয়ে তোমার ঝগড়া হলো সেটা বলো।

আমি শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, আমি মাকে বলেছি আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন। ঠাট্টা করে বলেছি। মা ঠাট্টাটা সত্যি ভেবে নিয়ে বাবার কাছে লাগিয়েছেন।

আমি তোমার প্রেমে পড়েছি–এই কথা বলেছ?

হ্যাঁ।

এমন একটা Absurd কথা তুমি বলতে পারলে?

ঠাট্টা করে বলেছি।

 জীবনটা ঠাট্টা তামাশার ব্যাপার না। এটা মনে রাখবে।

জি আচ্ছা মনে রাখব। এখন কি বাসায় যেতে পারব?

 যাও। রেস্ট নাও। মাথা ঠান্ডা করো।

আমি বাসায় গেলাম। পরদিন থেকে সব আগের মতো হয়ে গেল, শুধু আহসান সাহেবের ড্রাইভার কিসমতের চাকরি চলে গেল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ