হাবীব বৈঠকথানার ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। রশিদ বড় তালপাতার পাখায় তাকে হাওয়া করছে। আজ ছুটির দিন। কোর্ট বন্ধ। হাবীব আয়োজন করে খবরের কাগজ পড়তে বসেছেন। ছুটির দিনে তিনি মন দিয়ে কাগজ পড়েন। কোনো খবর বাদ যায় না। কিছু কিছু খবর নিয়ে প্রণবের সঙ্গে আলাপ করেন।

প্রণব বড় একটা জুলচৌকিতে আসন করে বসেছেন। তার সামনে পানের বাটা। নানান পদের মসলা ছোট ছোট কৌটায় ভরা। তিনি কৌটার মুখ খুলে মসলার গন্ধ শুকে শুকে দেখছেন।

হাবীব বললেন, মাওলানা ভাসানী সম্পর্কে তোমার ধারণা কী প্রণব?

প্রণব বললেন, সাধুপুরুষ।

হাবীব বিরক্ত গলায় বললেন, সাধুপুরুষ রাজনীতি করে না।

প্রণব বললেন, তাও ঠিক।

হাবীব বললেন, মানুষটার কাজকর্ম চিন্তাভাবনা কিছুই বুঝি না। আয়ুব খানের পক্ষের লোক ছিল—এখন উল্টাগীত শুরু করেছে। গদি ছাড়তে বলতেছে। তার হিসাব কিছুই বুঝতেছি না।

প্রণব বললেন, সাধুপ্রকৃতির মানুষের হিসাব বুঝতে সাধুমানুষ লাগে। সবাই পারে না। বগুড়ার মোহম্মদ আলির কথা চিন্তা করেন। সবাই তার হিসাব জানে। কারণ সে চোরপ্রকৃতির।

হাবীব তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, চোরকৃতির বললা কী জন্যে?

প্রণব পান মুখে দিতে দিতে বললেন, পূর্বপাকিস্তানের এমএলএ যারা তারা সবাই শপথ করে গেল সংসদে তারা পূর্বপাকিস্তানের দাবিদাওয়া তুলবে। বগুড়ার মোহম্মদ আলি নিজেও শপথ নিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছেই আয়ুব খানের সঙ্গে আঁতাত করে বসলেন। এই দিকে আমি মোনায়েম খান সাহেবকে ধন্যবাদ দিব। উনি আগে কোনো শপথ করেন নাই। স্যার, পান খাবেন?

হাবীব বললেন, দাও খাই। জর্দা ছাড়া। জর্দা সহ্য হয় না। মাথা ঘুরে।

প্রণব বললেন, সামান্য দেই? জর্দা ছাড়া পান আর বোতাম ছাড়া শার্ট একই। বোয়াম ছাড়া শার্টে নিজেকে নেংটা লাগে। জর্দা ছাড়া পানও নেংটা পান।

দেশের গতিক কী বুঝতেছ?

কিছু বুঝতেছি না।

পশ্চিম পাকিস্তানে তো ভালো হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। ভুট্টো সাহেবকে ঢুকায়েছে জেলে। এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানও জেলে। এটা একটা কাজের কাজ হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান ঝামেলা সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কিছু পারে না। দেশ কিছুদিন ঝামেলা ছাড়া চলবে।

প্ৰণব বললেন, অবশ্যই।

হাবীব বললেন, একজন ঝামেলাওয়ালা, আরেকজন সুনশনওয়ালা। কথায় কথায় অনশন। কার কথা বললাম বুঝেছ?

না।

হাবীব রশিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ফরিদকে ডাক দিয়া আনো। জটিল কিছু কথা তার সঙ্গে আছে। কথার সময় তুমি থাকবা না। বাতাসের প্রয়োজন নাই। আজ আবহাওয়া শীতল।

হাবীব জর্দা দেওয়া পান চিবুচ্ছেন। সামান্য মাথা ঘুরছে, তবে খারাপ লাগছে। ফরিদ এসে বেতের মোড়ায় বসেছে, তাকে চিন্তিত এবং ভীত মনে হচ্ছে। প্রণব তার জায়গাতেই আছেন। হাবীব ফরিদের দিকে না তাকিয়ে বললেন, কেমন আছ ফরিদ?

ফরিদ মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, ভালো আছি।

সংসার কেমন চলতেছে?

ভালো।

ফরিদ, তোমার বুদ্ধি কেমন?

ফরিদ চমকে তাকাল। কী বলবে বুঝতে পারল না। হঠাৎ বুদ্ধির প্রসঙ্গ কেন চলে এসেছে কে জানে। তার পানির পিপাসা পেয়ে গেল। পানি খাবার জন্যে উঠে যাওয়া সম্ভব না।

হাবীব বললেন, তোমার বুদ্ধির একটা পরীক্ষা নিব বলে তোমাকে ডেকেছি। আজকের ইত্তেফাকে একটা খবর ছাপা হয়েছে—গরুর হাতে গরুচোরের মৃত্যু। খবরটা শব্দ কইরা পড়ো আমি শুনি! খবরটা তৃতীয় পাতায়।

ফরিদ খবরের কাগজ হাতে নিল। তার হাত সামান্য কাঁপছে। সে সব পাতাই খুঁজে পাচ্ছে, তৃতীয় পাতাটা খুঁজে পাচ্ছে না। প্রণব বের করে দিলেন। ফরিদ পড়তে শুরু করল।

গরুর হাতে গরুচোরের মৃত্যু।
(নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত)
ধর্মপাশা অঞ্চলের কুখ্যাত গরুচোর আবুল কাশেমের মৃত্যু হইয়াছে গরুর হাতে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, আবুল কাশেম জনৈক গৃহস্থের বাড়ি হইতে একটি বলশালী ষাড় চুরি করিয়া হাওরের জনশূন্য প্রান্তর দিয়া দ্রুত পালাইতেছিল। এর মধ্যে তার ধূমপানের নেশা জাগ্রত হয়। সে ষাড়ের দড়িটি নিজের কোমরে বাঁধিয়া একটি বিড়ি ধরায়। দেয়াশলাইয়ের আগুন দেখিয়া গরু চমকাইয়া ছুটিতে শুরু করে। এবং গৃহস্থের বাটিতে উপস্থিত হয়। দেখা যায় দড়ির একপ্রান্তে গরুচোরের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। কুখ্যাত গরুচোরের মৃত্যুতে অত্র অঞ্চলে

স্বস্তির সুবাতাস বহিতেছে। ফরিদ খবর পড়া শেষ করে চিন্তিত চোখে হাবীবের দিকে তাকাল। হাবীব বললেন, খবরটায় একটা বড় ভুল আছে। ভুলটা কী?

ফরিদ বলল, বলতে পারব না স্যার।

হাবীব প্রণবের দিকে তাকালেন। প্রণব মাথা চুলকে বললেন, আমিও পারব না।

হাবীব বললেন, দেয়াশলাইয়ের আগুন দেখে ভয় পেয়ে গরু দৌড়াতে শুরু করল। এই খবরটা নিজস্ব সংবাদদাতাকে কে দিল? চোর দিতে পারবে না, সে মৃত। তাহলে খবরটা দিতে পারে গরু নিজে। তার পক্ষে কি খবরটা দেওয়া সম্ভব?

এখন ভুল বুঝতে পেরেছ?

ফরিদ হা-সূচক মাথা নাড়ল। হাবীব বললেন, ফরিদ, তোমাকে এই ভুলের কথা বলার পেছনে একটা কারণ আছে। যাতে তুমি আমার বিচার বিবেচনায় আস্থা রাখতে পারো। যাতে বুঝতে পারে যে, আমার সিদ্ধান্তে ভুল থাকে না। আমি তোমার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি কিছুদিন জেল খাটবা। রাজি আছ?

ফরিদ বলল, আপনি যা বলবেন তা-ই করব।

হাবীব বলেন, অনোর অপরাধে জেল খাট। ভাতে তোমার লাভ ছাড়া ক্ষতি কিছু হবে না। ব্রহ্মপুত্র নদীর দক্ষিণ দিকে কুড়ি বিঘা ধানি জমি পাইবা। তার সঙ্গে নগদ পাঁচ হাজার টাকা। রাজি আছ?

ফরিদ বলল, আপনি যা করতে বলবেন আমি করব। টাকা বা জমি লাগবে। আপনি একটা কাজ করতে বলতেছেন এ-ই যথেষ্ট।

হাবীব বললেন, টাকা-জমি অবশ্যই লাগবে। তুমি বিবাহ করেছ। তোমার সংসার হয়েছে। জেল থেকে বের হয়ে তুমি রাজার হালে জীবন কাটাবে। আশ্রিত জীবন কাটাতে হবে না।

ফরিদ বলল, কতদিন জেলে থাকতে হবে স্যরি?

হাবীব বললেন, খুব বেশি হলে পাঁচ বছর। এখন তুমি বলো, একজন মানুষের জীবনে পাঁচ বছর কি খুব বেশি সময়?

জি-না স্যার।

ঘটনাটা মন দিয়ে শোনো, তুমি একজনের অ্যাসিসটেন্ট। তোমার যে মুনিব তার শিকারের শখ। তিনি ভোরবেলা শিকারে যাবেন। তোমাকে দুনলা বন্দুক পরিষ্কার করতে বললেন। তখন দুর্ঘটনা ঘটল। বন্দুক থেকে গুলি বের হয়ে গেল। একজন মারা গেল।

ফরিদ বলল, যিনি মারা গেলেন তার নাম কী স্যার?

হাবীব বললেন, তার নাম দিয়ে তোমার প্রয়োজন নাই। জীবিত মানুষের নামের প্রয়োজন, মৃত মানুষের নামের প্রয়োজন নাই। আদালতে দুর্ঘটনার মামলা হবে। সাজা পাঁচ বৎসরের বেশি হওয়ার কোনো কারণ নাই।

ফরিদ বলল, সাজা বেশি হলেও কোনো ক্ষতি নাই স্যার।

হাবীব বললেন, প্রণব আজ বিকালে তোমাকে জমি দেখাবে। জমি তোমার স্ত্রীর নামে আগামীকাল রেজিস্ট্রি হবে। জেল থেকে বের হয়ে এসে তুমি ঘর তুলে থাকবে।

হাবীব প্রণবকে ইশারা করলেন। প্রণব উঠে গেলেন। ড্রয়ার থেকে টাকার বান্ডিল বের করলেন। পাঁচ টাকার নোটে পাঁচ হাজার টাকা। হাবীব বললেন, টাকা ভালোমতো গুণে দেখা।

ফরিদ বলল, গুণতে হবে না স্যার।

হাবীব বললেন, অবশই গুণতে হবে।

ফরিদ টাকা গুণছে। হাবীব প্রণবের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আরেকটা পান দাও। দোতলা থেকে হাজেরা বিবি চেঁচাচ্ছেন, ও হাবু! হাবুরে! হাবু কই গেলি? হাবীব বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকালেন।

 

হাজেরা বিবির কাছে নাদিয়া উপস্থিত হয়েছে। নাদিয়া বলল, দাদি, কী হয়েছে?

হাজেরা বিবি বললেন, আমার খাটের নিচে আজরাইল বইসা আছে।

নাদিয়া বলল, উনাকে কী করতে বলব? চলে যেতে বলব? না-কি খাটের উপর এসে বসতে বলব?

হাজেরা বিবি কঠিন গলায় কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। হেসে ফেললেন। নাদিয়া বলল, হাসছ কেন দাদি?

হাজেরা বিবি বললেন, তোর বদামি দেইখা হাসলাম। তুই বিরাট দুষ্ট হইছস।

নাদিয়া বলল, তুমিও অনেক দুষ্ট দাদি। সারাক্ষণ সবাইকে ভয় দেখানোর চেষ্টা। আজরাইল আজরাইল। দিনেদুপুরে আজরাইলের কথা বললে কি কেউ ভয় পাবে? নিশিরাতে বলে দেখতে পারো।

আমারে বুদ্ধি দিবি না। আমার বুদ্ধির প্রয়োজন নাই।

হাজেরা বিবি নাতনিকে হাতের ইশারায় পাশে বসতে বললেন। নাদিয়া বসল। হাজেরা বিবি বললেন, গোপন কথা শুনতে মন চায়? এমন এক গোপন কথা জানি, শুনলে শইলের সব লোম খাড়ায়া যাবে।

নাদিয়া বল, গোপন কথা শুনতে চাই না।

শুনতে চাস না কেন? আসল মজা গোপন কথার মধ্যে।

নাদিয়া বলল, দাদি, একেকজনের আসল মজা একেকরকম। মা’র আসল মজা রান্নাবান্নাতে, বাবার মজা প্যাঁচ খেলানোয়।

হাজেরা বিবি বললেন, এমন কেউ কি আছে যার কোনো মজা নাই?

থাকতে পারে। আমি জানি না।

নাদিয়া উঠে দাঁড়াল। হাজেরা বিবি বললেন, যাস কই? ঠান্ডা হইয়া বস। গফ করি।

নাদিয়া বলল, আমি বারান্দার কাঠের চেয়ারে ঠান্ডা হয়ে বসব। বারান্দায় বসে আমি অনেক মজা পাই।

কী মজা পাস?

বারান্দায় বসে সবাইকে দেখি। কেউ আমাকে দেখে না। এর অন্যরকম মজা।

হাজেরা বিবি বললেন, আমারে সাথে নিয়া চল। আমি তোর সাথে মজা দেখব।

নাদিয়া দাদিকে হাত ধরে খাট থেকে নামাল। নাদিয়ার কাধে ভর দিয়ে তিনি দোতলার বারান্দায় চলে এলেন। টানা বারান্দার একপ্রান্তে তিনটা ভারী হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার। বারান্দা ঘেঁসে কাঠালগাছ। প্রাচীন এই গাছ বারান্দায় অশ্রু তৈরি করেছে। বারান্দায় কেউ বসেছে কি না, চট করে বোঝা যায় না।

হাজেরা বিবি বসতে বসতে বললেন, কী মজা দেখাবি দেখা।

নাদিয়া বল্ল, ওই দেখো রশিদ ভাই। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

হাজেরা বিবি বললেন, এটা দেখার মধ্যে মজা কী?

একটা মানুষ গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে, এটা দেখার মধ্যে মজা আছে না? মানুষ তো গাছ না। সে কতক্ষণ এইভাবে থাকে কী করে এইটাই আমরা দেখব।

তুই পাগলি আছস।

আমরা সবাই পাগল। একেকজন একেকরকম পাগল। তুমি হচ্ছ সেয়ানী পাগল।

হাজেরা বিবি এখন রশিদের ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহী হয়েছেন। তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, ঘটনা তো সত্য। এই হারামজাদা ঝিম ধইরা আছে কী জন্যে?

হে চায় কী? ডাক দিয়া জিগা।

ডেকে জিজ্ঞেস করলে তো দেখার মজাটা থাকবে না। দাদি, এখন পুকুরঘাটের দিকে তাকাও। দেখো একজন বই পড়ছে। তার নাম হাসান রাজা।

হাজেরা বিবি বললেন, এই হারামজাদা এখনো আছে?

নাদিয়া বলল, সবাইকে হারামজাদা বলছ কেন?

হাজেরা বিবি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, যে হারামজাদা তারে হারামজাদা বলব না। মহারাজা বলব? নিজের বাপরে গুলি কইরা মারছে। বাপ নামাজে বসছে, তখন দু’নলা বন্দুক দিয়া গুলি দিচ্ছে। ঠাস ঠাস।

নাদিয়া বলল, এইসব কী বলছ দাদি?

হাজেরা বিবি বললেন, বাতাসে ভাইস্যা যা কানে আসে তা-ই বলি। আগ বাড়ায়া কেউ আমারে কিছু বলে না। রশিদ হারামজাদাটা গেল কই?

নাদিয়া বলল, আমরা যখন দিঘির ঘাটের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন সে চলে গেছে।

গেছে কোনদিকে?

সেটা তো আমি জানি না দাদি।

হাজেরা বিবি বললেন, জানা দরকার।

কেন জানা দরকার?

এতক্ষণ খাম্বার মতো খাড়ায়া ছিল, ফুড়ুৎ কইরা চইলা গেল। কই গেল জানা দরকার না?

নাদিয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, হাসান রাজা নামের এই যুবক নিজের বাবাকে গুলি করে মেরেছে এটা কি সত্য?

তোর বাপরে জিজ্ঞাস কইরা জান, সত্য না মিথ্যা। তোর বাপু অবশ্য মিছা কথার বাদশা। সমানে মিছা বলবে। তার চউক্ষের দিকে তাকায়া থাকবি মিছা বলার সময় তোর বাপের চউখ পিটপিট করে। আচ্ছা রশিদ হারামজাদা তো আর বাইর হইতেছে না। চিন্তার বিষয় হইল।

নাদিয়া বলল, ঘরে চলো দাদি।

হাজেরা বিবি বললেন, ঘরে যাব না। এইখানে বইসা থাকব।

আমি চলে যাই।

যা ইচ্ছা কর।

নাদিয়া দোতলা থেকে একতলায় নামল। রান্নাঘরের দরজা ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। লাইলী বলল, ধুয়ার মধ্যে থাকিস না মা। গায়ের রঙ ময়লা হয়ে যাবে।

নাদিয়া বলল, তুমি তো জীবনের বেশির ভাগ সময় রান্নাঘরে কাটিয়ে দিয়েছ, তোমার গায়ের রঙ কাচাহলুদের মতো।

লাইলী বললেন, বিয়ের আগে কুমারী মেয়েদের গায়ে ধুয়া লাগলে গায়ের রঙ ময়লা হয়। বিয়ে হয়ে যাবার পর আর রঙ বদলায় না।

নাদিয়া হাসছে। লাইলী বললেন, হাসছিস কেন?

নাদিয়া বলল, তোমার উদ্ভট কথা শুনে হাসছি। তুমি এমন একজনকে কথাগুলি বলছ যে ফিজিক্সের ছাত্রী। এবং ফেলটুসমার্কা ছাত্রী না। খুব ভালো ছাত্রী।

লাইলী বললেন, রান্নাঘর থেকে যা তো মা।

নাদিয়া বের হলো। রওনা হলো দিঘির ঘাটের দিকে। সে ঠিক করেছে প্রথম দিনের মতো নিঃশব্দে যাবে। তাকে দেখে মানুষটা যখন চমকে উঠবে তখন সে ঠান্ডা গলায় বলবে, আচ্ছা আপনি কি আপনার বাবাকে গুলি করে মেরেছেন?

নাদিয়া দিঘির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘাটের সিঁড়িতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে মানুষটা বই পড়ছে। তার চোখে পানি। বানানো দুঃখের গল্পে যে অশ্রুবর্ষণ করে সে প্রিয়জনদের দুঃখে কখনো অশ্রুবর্ষণ করবে না।—কথাটা যেন কার? কিছুতেই মনে পড়ছে না। মানুষটা কী বই পড়ছে জানতে ইচ্ছা করছে। ম্যাথমেটেশিয়ান আবেল (Abel) অংকের জটিল কোনো বই পড়লে মুগ্ধ হয়ে অবর্ষণ করতেন।

কেমন আছেন?

মানুষটা ঠিক ওইদিনের মতো চমকে উঠল। তার হাত থেকে বই পড়ে গেল। বইয়ের নাম তিথিডোর। লেখক বুদ্ধদেব বসু। এই বই নাদিয়ার পড়া নেই। বইটা পড়তে হবে।

নাদিয়া বলল, আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।

হাসান বলল, বসুন।

নাদিয়া বসতে বসতে বলল, দিঘির এই ঘাটটা মনে হয় আপনার খুব পছন্দ?

হাসান বলল, জি।

আপনাদের নিজের বাড়িতে কি এরকম ঘাট আছে?

হাসান বলল, দিঘির ঘাট নেই, তবে হাওরের সঙ্গের ঘাট আছে। আমাদের বাড়ির পেছনে ঘাট। বর্ষার সময় এই ঘাটটা আমার কাছে তাজমহলের চেয়েও সুন্দর মনে হয়।

আপনি কি তাজমহল দেখেছেন?

দেখেছি। আমাদের বাড়িটাও খুব সুন্দর। বাড়ির নামটাও সুন্দর। কইতরবাড়ি।

কী বাড়ি?

কইতরবাড়ি। কইতর হলো কবুতর। বাড়িটার নানান খুপড়িতে শত শত কবুতর বাস করে। আপনি যদি দোতলার বারান্দায় কাকতাড়ুয়ার মতো দুই হাত মেলে দাঁড়ান দুই হাতে কবুতর এসে বসবে। বকম বকম করে ডাকতে থাকবে। কী যে সুন্দর দৃশ্য।

নাদিয়া অবাক হয়ে গল্প শুনছে। অবাক হবার প্রধান কারণ হাসান নামের মানুষটার নিজের বাড়ি সম্পর্কে মুগ্ধতা।

হাসান বলল, আমি আপনাকে অনুরোধ করব এক রাত আমাদের বাড়িতে থেকে আসতে। একবার যদি যান বাকিজীবন এই বাড়ির কথা আপনার মনে থাকবে। স্বপ্নেও আপনি এই বাড়ি দেখবেন।

নাদিয়া বলল, আমি যাব। আচ্ছা আপনার বাবা কি বেঁচে আছেন?

হাসান বলল, হ্যাঁ। উনি এখন ময়মনসিংহেই আছেন। আমি বাবাকে বলব যেন আপনাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমি সঙ্গে যেতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু আমি সঙ্গে যেতে পারব না।

পারবেন না কেন?

আমি বিরাট এক ঝামেলায় পড়েছি। ঝামেলা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।

কথা বলতে না চাইলে কথা বলতে হবে না। আচ্ছা শুনুন, তিথিভোর’ বইটা আপনার পড়া শেষ হওয়ার পর আমাকে দেবেন। আমি পড়ে দেখব চোখের পানি ফেলার মতো কী আছে। এখন পর্যন্ত কেনো গল্পের বই পড়ে আমার চোখে পানি আসেনি।

হাসান বলল, বইটা আপনি নিয়ে যান। আপনি পড়ে শেষ করার পর আমি পড়ব। প্লিজ।

নাদিয়া হাত বাড়িয়ে বই নিল। হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন আপনি ঘাট ছেড়ে চলে যান। আপনি যেখানে বসে যে ভঙ্গিতে বইটা পড়ছিলেন আমি সেইভাবেই পড়ব। আপনি সর্বশেষ কোন পাতাটা পড়ছিলেন বের করে দিন। আমি পাতাটা ভাজ করে রাখব। দেখব এই পাতাটা পড়ার সময় চোখে পানি আসে কি না।

হাসান পাতা বের করতে করতে বলল, আপনি প্রণব বাবুকে জোনাকির ঝাঁকে জোনাকির সংখ্যা গুনতে বলেছিলেন। আমি তিনটা ঝাক গুনেছি। একটাতে জোনাকির সংখ্যা সতেরো, একটাতে নয়, আরেকটাতে পাঁচ।

নাদিয়া বলল, সব বেজোড় সংখ্যা? আশ্চর্য তো!

হাসান বলল, সাতরা পাখি বলে একধরনের পাখি আছে, এদের দলে সব সময় সাতটা পাখি থাকে। তার কমও না, তার বেশিও না।

নাদিয়া বলল, তাই না-কি?

হ্যাঁ তাই।

এটা আমি জানতাম না। আপনার কাছে কি তাশ আছে? খেলার তাশ।

হাসান আশ্চর্য হয়ে বলল, না তো।

নাদিয়া বলল, দুই প্যাকেট তাশ জোগাড় করে রাখবেন। আমি তাশের ম্যাজিক দেখাব? এখন চলে যান।

 

সন্ধ্যা সাতটা।

ফরিদ পাবলিক লাইব্রেরিতে। ক্ষিতিশ বাবুর সামনের চেয়ারে বসে আছে। সে ক্ষিতিশ বাবুর জন্যে গরম সিঙ্গাড়া এবং আলুর চপ নিয়ে এসেছে। ক্ষিতিশ বাবু অবাক হয়ে তাকালেন। ফরিদ বলল, আমার নিজের রোজগারের টাকায় কিনা। আপনি খান।

রোজগার শুরু করেছ?

জি।

উত্তম। অতি উত্তম।

ফরিদ নিচুগলায় বলল, আপনার জন্যে একটা ধুতি কিনে এনেছি। যদি নেন খুবই খুশি হব।

ক্ষিতিশ বাবু সিঙ্গাড়া মুখে দিতে দিতে বললেন, তোমাকে একটা প্রশ্ন করব। প্রশ্নের জবাব দিতে পারলে নিব। জবাব দিতে না পারলে ধুতি নিয়া বাড়িত যাবা। প্রশ্নটা হলো—বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাবের নাম কী?

ফরিদ বলল, সিরাজউদ্দৌলা।

ক্ষিতিশ বাবু বললেন, হয় নাই। শেষ স্বাধীন নবাবের নাম মীর কাশেম।

মীর কাশেম?

হ্যাঁ মীর কাশেম। ক্লাইভের গর্ধব মীর জাফরের পর মীর কাশেম সিংহাসনে বসেন। তিনি ইংরেজবিদ্বেষী স্বাধীনচেতা নবাব ছিলেন। পড়াশোনা করার এই এক লাভ। আমজনতা যেটা জানবে তার চেয়ে বেশি জানা।

ফরিদ বলল, জেলখানায় কি লাইব্রেরি আছে?

ক্ষিতিশ বাবু চোখ সরু করে বললেন, জেলখানার লাইব্রেরির খোঁজ নিচ্ছে কেন? জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে?

জি।

কী অপরাধে জেলে যাবে?

খুনের অপরাধে।

ক্ষিতিশ বাবু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে বললেন, কাকে খুন করেছ?

ফরিদ বলল, যাকে খুন করেছি তার নাম জানি না।

কীভাবে খুন করেছ? গলা টিপে?

গুলি করেছি।

কী কারণে গুলি করেছ?

বন্দুক পরিষ্কারের সময় হঠাৎ গুলি বের হয়েছে।

কোথায় খুন করেছ?

বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে ফরিদ বলল, কোথায় খুন করেছি আমি জানি না।

 

ফরিদ যে শুধু ক্ষিতিশ বাবুর জন্যে ধুতি কিনেছে তা নয়, সে তার স্ত্রীর জন্যে লালপাড় টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি কিনেছে। প্রণবের জন্যে ঘিয়া রঙের চাদর কিনেছে।

প্রণব চাঁদর হাতে নিয়ে বললেন, তোমার খরচের হাত খারাপ না। আজ টাকা পেয়েছ, আজই বাজারসদাই শুরু করেছ। কথায় আছে—

হাতে আসছে টাকা
এক দিনে ফাঁকা
দুই দিনে ধার
তিন দিনে গঙ্গা পাড়।

যাই হোক, চাদরটা ভালো কিনেছ। একটা চাদরের প্রয়োজনও ছিল! ভগবান তোমার মঙ্গল করুক। ভগবান আমার কথায় কিছু করবে না। নিজের ইচ্ছায় যদি করে।

 

ফরিদের স্ত্রী সফুরা শাড়ি কোলে নিয়ে বসে আছে। ফরিদ বলল, রঙ পছন্দ না হলে বদলায়ে দিবে।

সফুরা বলল, রঙ পছন্দ হয়েছে।

রঙ পছন্দ হলে মুখ বেজার কেন?

বুঝতেছি না কেন।

ফরিদ টাকার বান্ডেল এগিয়ে দিতে দিতে বলল, এখানে দুইশ কম পাঁচ হাজার টাকা আছে। তোমার কাছে রাখো। ইচ্ছামতো খরচ কোরো।

টাকা কই পেয়েছেন? চুরি করেছেন?

না। রোজগার করেছি।

কী কাজ করে রোজগার করলেন?

একটা মানুষ খুন করে টাকাটা পেয়েছি। ঘটনা আরেকদিন বলব। আজ না। এখন যাও, নয়া শাড়ি পইরা আসো। তোমারে দেখি।

আপনি মানুষ ভালো।

সব মানুষই ভালো। অতি মন্দ মানুষের মধ্যেও থাকে অতি ভালো। মন্দ এবং ভালো মিলে সমান সমান হয়। আমার কথা না। বই পড়ে শিখেছি।

কথা ঠিক না। বই পইড়া ভুল কথা শিখেছেন। একজন মন্দ মানুষের সবটাই মন্দ। একজন ভালো মানুষের সবটা ভালো। আমার দিকে তাকায়ে দেখেন। আমার সবটাই মন্দ। চেহারা শুধু সুন্দর।

যাও শাড়িটা পরে আসো। নয়ন ভইরা দেখি। বেশিদিন তোমারে দেখব না।

সফুরা উঠে গেল। অসময়ে স্নান করল। সময় নিয়ে সাজতে বসল। ফরিদ নামের অতি ভালো মানুষটার সামনে আজ সে পরী সেজে দাঁড়াবে। গুনগুন করে একটা গীতও করবে–

মন পবনের নাওয়ের মাঝি
কই তোমারে কথা
তোমারে না। আমি
দুঃখ বারতা…

গীত শুনে মানুষটা চমকাবে। কারণ সফুরা যে গীত জানে মানুষটা জানে না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ