নাদিয়ার হাতে পুরনো দিনের বাহারি গ্লাস। গ্লাসভর্তি চা। গ্লাস গরম হয়ে আছে। হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছে না। নাদিয়া গ্লাসটা ধরেছে তার রুমাল দিয়ে। রুমালে সেন্টের গন্ধ। যতবার সে চায়ে চুমুক দিচ্ছে, ততবারই চায়ের গন্ধের সঙ্গে সেন্টের গন্ধ মিলে অন্যরকম সৌরভ তৈরি হচ্ছে। গন্ধটা ভালো লাগছে না, আবার খারাপও লাগছে না। নাদিয়া যাচ্ছে তার গাছের কাছে। গাছের নাম কদম।

নাদিয়ার ছোটমামা তাকে তার পঞ্চম জন্মদিনে এই গাছটা দিয়ে বলেছিলেন, নিজের হাতে এই গাছ লাগাবি। এখন তোর বয়স পাঁচ। যখন বয়স ষােল হবে, তখন এই গাছ মহীরুহের মতো বড় হয়ে যাবে। প্রতি বর্ষায় ফুল ফুটাবে। তখন তুই গাছের চারদিক বাধিয়ে দিবি। তুই আর তোর স্বামী গাছের বাধানেী পাড়ে বসে গল্প করবি। আমি দূর থেকে দেখব। নাদিয়ার মামা সেই বছরই যক্ষায় মারা যান। দূর থেকে কোনো দৃশ্যই তার দেখা হয়নি।

গাছ প্রসঙ্গে ছোটমামার কথা ফলেছে। কদমগাছ বিশাল হয়েছে। বর্ষার শুরুতে ফুলে ফুলে নিজেকে সে ঢেকে ফেলে। যেন শত শত সোনালি টেনিস বল নিয়ে কদমগাছ দাঁড়িয়ে থেকে বলে, এসো আমার সঙ্গে বর্ষার খেলা খেলবে। নাদিয়া তার স্কলারশিপের টাকায় গাছের চারপাশ বাঁধিয়ে দিয়েছে এবং ছেলেমানুষের মতো বলেছে, এই গাছের বাঁধানো পাড়ে আমি ছাড়া কেউ বসবে না। নাদিয়ার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। এই গাছের বাঁধানো পাড়ে কেউ বসে না।

বাগানে ঢুকে নাদিয়া চমকে উঠল। তার গাছের বাঁধানো পাড়ে অচেনা একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটার হাতে বই। সে বই পড়ছে। সন্ধ্যা হয় হয় সময়। আকাশ মেঘলা থাকায় আলো নেই বললেই হয়। এত অল্প আলোতে বই পড়া কষ্টের। মানুষটা চোখের কাছে বই ধরে এই কাজটা করছে। নাদিয়া প্রায় নিঃশব্দে লোকটার কাছাকাছি চলে এল। শান্ত গলায় বলল, আপনি কে?

মানুষটা হঠাৎ কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল। তার হাত থেকে বই পড়ে গেল। সে চট করে উঠে দাঁড়াল। তখন তার কোল থেকে পড়ল একটা চামড়ায় বাঁধানো খাতা এবং কলম।

আমি এই বাড়িতে থাকি।

নাদিয়া বলল, এই বাড়িতে অনেকেই থাকে। আপনি এই বাড়িতে থাকেন এটা কোনো পরিচয় হতে পারে না।

আমার নাম হাসান রাজা চৌধুরী।

আপনি কি বাবার নতুন কোনো কর্মচারী।

না।

কিছু মনে করবেন না। যতবারই আমি ছুটিতে বাড়িতে আসি, ততবারই বাবার নতুন কোনো কর্মচারী দেখি। এইজন্যেই বলেছি। আপনি কতদিন ধরে এখানে আছেন?

সতেরো দিন।

সতেরো দিনে কেউ আপনাকে বলেনি যে কদমগাছের নিচে বসা নিষেধ।

বলে নাই। নিষেধ কেন?

নাদিয়া বল, আমি নিষেধ করেছি এইজন্যে নিষেধ। এই গাছটা আমার। এখানে আমি একা বসি।

হাসান বলল, আর বসব না।

নাদিয়া বলল, বিকেলে বই পড়ার জন্যে এই বাগানে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। আপনি পুকুরঘাটে বসতে পারেন।

হাসান বলল, আমি বেশির ভাগ সময় সেখানেই বসি।

নাদিয়া বলল, চা খাবেন? আপনাকে চা দিতে বলব? আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি তো, এইজন্যে চায়ের কথা বলে কাটান দেওয়ার চেষ্টা করছি।

হাসান বলল, আমি চা খাব না।

নাদিয়া বলল, আমাকে কি আপনি চিনেছেন?

আপনি এই বাড়ির মেয়ে। আপনার নাম নাদিয়া।

নাদিয়া বলল, আমার তিনটা নাম। একটা নাম তোজল্লী, আমার দাদি রেখেছেন। বাবা-মা নাম দিয়েছেন নাদিয়া। ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা আমাকে ডাকে দিয়া। তারা না বাদ দিয়েছে। আপনার সঙ্গে অনেক কথা বলে ফেলেছি, এখন চলে যান। আমি একা একা বসে চা খাব। ভালো কথা, আপনি গত সতেরো দিন ধরে কোথায় অর্থাৎ কোন ঘরে থাকেন?

হাসান আঙুল উঁচিয়ে দেখাল।

নাদিয়া বলল, অতিথঘরে থাকেন? ভূত দেখেছেন? অতিথঘরে ভূত থাকে। বেদানা নামের একটা মেয়ে ওই ঘরে শাড়িতে ফাঁস লাগিয়ে সুইসাইড করেছিল। নিশিরাতে হঠাৎ হঠাৎ তাকে দেখা যায়। অনেকেই দেখেছে। আপনি দেখেননি?

না।

ঘুমিয়ে রাত পার করলে কীভাবে দেখবেন? সারা রাত জেগে থাকবেন, তাহলে দেখতে পাবেন। আচ্ছা এখন যান। কী আশ্চর্য! বইখাতা সব ফেলে চলে যাচ্ছেন। নিয়ে যান।

নাদিয়া চায়ের কাপে চুমুক দিল। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিতে খারাপ লাগছে না। অন্ধকার নামছে। দিঘির পানি শুধু চকচক করছে। আর সবই অন্ধকার। মাগরেবের আযান হচ্ছে। নাদিয়া শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিল। শুকনা পাতায় সড়সড় শব্দ হচ্ছে। সাপ যাচ্ছে মনে হয়। নাদিয়া পা উঠিয়ে বসল। সে হঠাৎ বিষণ্ণ বোধ করল। ছোটমামার নামটা সে মনে করতে পারছে না। তার এত প্রিয় একজন মানুষ, অথচ নাম মনে পড়ছে না। চোখের আড়ালে যে থাকে মানুষ তাকে দ্রুত ভুলে যায়। ব্রেইন নতুন স্মৃতি রাখার জন্য পুরনো স্মৃতি ধুয়ে ফেলে। হাসান নামে যে মানুষটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার স্মৃতি রাখার জন্যে ব্রেইন কিছু জায়গা করেছে। যে অংশে ছোটমামার স্মৃতি ছিল সেই অংশেই জায়গা করেছে কি না কে জানে।

 

মাগরেবের নামাজ শেষ করে হাবিব জায়নামাজের একটা কোনা ভাঙলেন। ভাজ করে রাখলেন। এখন এটা আর জায়নামাজ না। সাধারণ বসার আসন। এখন এখানে বসে সংসারি আলাপ-আলোচনা করা যায়। খাওয়াদাওয়া করা যায়।

লাইলী পানের বাটা হাতে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হাবিব ইশারায় স্ত্রীকে ডাকলেন।

লাইলী বললেন, পান খাবেন? পান বানায়া দিব? হাবিব বললেন, পান খাব না। তুমি একটু বসো।

তিনি জায়নামাজ থেকে সামান্য সরলেন। ভদ্রতা করা। যেন বলা, আমার সঙ্গে জায়নামাজে বসো। যদিও সেরকম জায়গা নেই। লাইলী বসলেন তার সামনে। হাবীব বললেন, তোমার মেয়ে কোথায়?

লাইলী বললেন, বাগানে।

হাবীব বললেন, এই বাড়ির কিছু নিয়মকানুন আছে। সন্ধ্যাবেলা মেয়েছেলে বাগানে যাবে না।

লাইলী বললেন, নাদিয়া বাগানে ঘুরতে পছন্দ করে।

হাবীব বললেন, সব পছন্দের গুরুত্ব দিতে হয় না। আজ যদি তোমার মেয়ে বলে—এক হিন্দু শিক্ষককে আমার পছন্দ হয়েছে। তাকে বিবাহ করতে চাই। তুমি কি সেই মালাউনের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিবে?

লাইলী বললেন, নাদিয়া কি এমন কোনো কথা বলেছে?

হাবিব বললেন, বলে নাই। যদি বলে তুমি কী করবে? রাজি হবে?

না।

হাবীব বললেন, এখন কি বুঝতে পেরেছ সব পছন্দের গুরুত্ব দিতে হয় না?

বুঝতে পারছি।

কাউকে পাঠাও, মেয়েকে নিয়া আসুক।

লাইলী বললেন, আমি নিজেই যাব। নিয়া আসব। লাইলী উঠে দাঁড়াতে গেলেন। হাবীব বললেন, বসে, কথা শেষ হয় নাই।

লাইলী বসলেন! হাবীব বললেন, আমি তোমার মেয়ের বিবাহ দিতে চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

লাইলী বললেন, আপনার হাতে কি পাত্র আছে?

আছে। পাত্র এই বাড়িতেই ঘুরঘুর করতেছে।

বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে লাইলী বললেন, একজন খুনির সঙ্গে আপনি মেয়ের বিবাহ দিবেন?

হাবীব বললেন, হ্যাঁ দিব। খুন একটা দুর্ঘটনা। মানুষের জীবনে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা বড় করে দেখতে হয় না। আত্মরক্ষার জন্যে কিংবা সম্মান রক্ষার জন্যে খুন করা জায়েজ আছে।

লাইলী কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন। হাবীব বললেন, ওই ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পেছনে তিনটা কারণ আছে। প্রথম কারণ, জমিদার বংশ। ছেলে বাপের একমাত্র ওয়ারিশ। বিশাল বিষয়সম্পত্তি।

লাইলী বলেন, আপনার ধনসম্পদের কমতি নাই। ধনসম্পদের জন্য আপনার ‘লালচ’ থাকা ঠিক না।

হাবীব বললেন, আমার কথার মাঝখানে কথা বলবা না। স্বামীর কথা শেষ হওয়ার আগেই কথা শুরু করলে আদবের বরখেলাপ হয়। যাই হোক, ওই ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিবাহের দ্বিতীয় কারণ, ছেলেকে আমি মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করব। সে বাকি জীবন এই কারণে তোমার মেয়ের কেনা গোলাম হয়ে থাকবে।

লাইলী বললেন, একজন স্ত্রী স্বামী হিসাবে বন্ধু চায়। কেনা গোলাম চায় না।

হাবীব বললেন, আবারও আদবের বরখেলাপ করলা। যাই হোক, তৃতীয় কারণ শোনো। এই ছেলের চরিত্র ভালো। আমি পরীক্ষা নিয়েছি। পরীক্ষায় সে পাশ করেছে।

কী পরীক্ষা নিয়েছেন?

হাবীব বললেন, মলিনা নামে তোমার যে দাসী আছে, গভীর রাতে তাকে ছেলের কাছে নগ্ন অবস্থায় পাঠায়েছিলাম। ছেলে তাকে ধমক দিয়ে বিদায় করেছে। এবং ঘটনা কারও কাছে প্রকাশ করে নাই।

লাইলী হতভম্ব গলায় বললেন, আপনার মতো মানুষ একজন দাসীর সঙ্গে পরামর্শ করে এমন নোংরা কাজ করে?

হাবীব বললেন, মলিনার সঙ্গে পরামর্শ আমি করি নাই। প্রণব করেছে।

লাইলী বললেন, কথা একই। প্রণব বাবু আপনার হয়েই কথা বলেছে। কত বড় অন্যায় কাজ আপনি করেছেন তা বুঝতে পেরেছেন?

হাবীব বললেন, তুমি বুঝতে পেরেছ এই যথেষ্ট। আমার বুঝার প্রয়োজন। নাই। একসঙ্গে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আমার কথা শেষ। এখন যাও বাগান থেকে মেয়েকে নিয়ে আসো। আরেক কথা, আমার কাছে কৈফিয়ত তলব করবা না। তুমি আদালত না।

লাইলী উঠে দাঁড়ালেন। হাবীব এশার নামাজের প্রস্তুতি নিলেন। মাগরেবের নামাজ শেষ করে এশা পর্যন্ত জায়নামাজে বসে থাকা এবং এশার নামাজ আদায় করা একটা উত্তম সুন্নত।

 

বাগানে ঢোকার মুখে প্রণবের সঙ্গে লাইলীর দেখা হলো। প্রণব রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খিচুড়ি বসাবেন। কাঁচামরিচ খিচুড়ি। এক মুঠ চাল, এক মুঠ ডাল, দশটা কাঁচামরিচ, এক চামচ ঘি দিয়ে অল্প আঁচে রান্না হবে। আঁচের বেকম হলেই খিচুড়ির ঝাল ঠিক থাকবে না।

লাইলী ডাকলেন, প্রণব বাবু, একটু শুনে যান।

প্রণব ছুটে গেলেন। মাথা নিচু করে জোড়হাতে নমস্কার বললেন। লাইলী বললেন, আমার বাপের বাড়ির যে দাসী এ বাড়িতে থাকে, মলিনা নাম, তাকে আগামীকাল ভোরবেলায় টাকাপয়সা দিয়ে বিদায় করে দেবেন।

প্রণব বললেন, অবশ্যই। সকাল আটটার পর তাকে আর এ বাড়িতে দেখবেন না।

রান্না বসিয়েছেন? কী রাঁধছেন?

মরিচ-খিচুড়ি। হরিদ্বারের এক সাধুবাবার কাছ থেকে এই রান্না শিখেছি। ঠিকমতো বাঁধতে পারলে অমৃত। মন্ত্র পাঠ করতে করতে রাঁধতে হয়।

কী মন্ত্র?

প্রণব হাতজোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পাঠ করলেন

গন্ধপুষ্পে ও গনপতয়ে নমঃ
গন্ধপুষ্পে ওঁ নারায়ণায় নমঃ
গন্ধপুষ্পে ও শিবাদি পঞ্চ দেবতাভ্য নমঃ

মন্ত্রপাঠ শেষ করে প্রণব লজ্জিত গলায় বললেন, এই খিচুড়ি অন্য কাউকে খাওয়ানো গুরুর নিষেধ, নয়তো আপনাকে একদিন বেঁধে খাওয়াতাম।

লাইলী বললেন, আপনি একজন সাধুপ্রকৃতির মানুষ। সাধুপ্রকৃতির মানুষ হয়ে বড় বড় অন্যায়গুলি কীভাবে করেন?

প্রণব শান্ত গলায় বললেন, ন্যায়-অন্যায় সবই ভগবান করান। ভগবানের অনুমতি ছাড়া কেউ ন্যায়ও করতে পারে না, অন্যায়ও করতে পারে না।

লাইলী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বাগানের দিকে রওনা হলেন। কদমগাছের নিচে নাদিয়া বসে আছে। তার পরনের শাড়ি সাদা দূর থেকে সাদা রঙ চোখে পড়ছে। কুমারী মেয়েদের সাদা শাড়ি নিষিদ্ধ, কিন্তু নাদিয়ার প্রিয় রঙ সাদা।

নাদিয়া বলল, আমাকে নিতে তুমি আসবে আমি জানতাম। আমি তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি।

লাইলী মেয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, মশার কামড় খাচ্ছিস?

নাদিয়া বলল, মশা কানের কাছে গুনগুন করছে কিন্তু কামড়াচ্ছে না। মা দেখো, জোনাকির ঝাঁক। অনেকদিন পর জোনাকি দেখলাম। প্রকৃতিতে কত অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস আছে, তাই না মা? একেকটা ঝাঁকে কতগুলি করে জোনাকি থাকে গোনার চেষ্টা করছি, পারছি না।

লাইলী বললেন, ঘরে চল। এতক্ষণ ধরে বাগানে বসে আছিস, তোর বাবা রাগ করছে।

নাদিয়া বলল, করুক একটু রাগ। মা শোনো, আজ সন্ধ্যাবেলা এক যুবকের সঙ্গে আমার দেখা। গ্রিক দেবতাদের মতো তার রূপ।

গ্রিক দেবতা তুই দেখেছিস?

ছবিতে দেখেছি।

লাইলী বলল, দেবতার সঙ্গে কী কথা হলো?

নাদিয়া বলল, আমি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। আমার নিজের আলাদা করা জায়গায় বসেছিল। দেখে হঠাৎ রাগ উঠে গেল।

লাইলী বললেন, আমিও তো বসেছি। আমাকে দেখে রাগ লাগছে না?

লাগছে। তবে বেশি লাগছে না। একা একা এখানে আমি ছাড়া কেউ বসতে পারবে না। আমার সঙ্গে পারবে।

লাইলী বললেন, তোর বাবা তোর বিয়ে দিতে চাচ্ছে।

নাদিয়া হালকা গলায় বলল, দিতে চাইলে দিবে। গাভর্তি গয়না পরে বিয়ে করব।

তোর নিজের পছন্দের কেউ আছে?

না। আর যদি কেউ থাকেও তার সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে দিবে না। আমার বিয়ে করতে হবে বাবার পছন্দের কাউকে।

লাইলী বললেন, চল ঘরে যাই।

নাদিয়া বলল, আরেকটু বসি। চাঁদ দেখে যাই। এখনই চাঁদ উঠবে।

লাইলী বললেন, ঘন জঙ্গলে বসে আছিস, চাঁদ দেখবি কীভাবে?

নাদিয়া বলল, দিঘির পানিতে চাঁদের ছায়া পড়বে। সেটা দেখব। আচ্ছা মা, দাদি যেসব গল্প করে তার সবই কি মিথ্যা?

লাইলী বললেন, বেশির ভাগই মিথ্যা। উনার মাথা পুরোপুরি গেছে। এখন যা মনে আসে বলেন।

নাদিয়া বলল, আমার নিজের কী ধারণা জানো মা? দাদির মাথা ঠিক আছে। তিনি ভাব করেন ঠিক নেই। এতে তার কিছু সুবিধা হয়। তিনি মিথ্যা কথার মাঝখানে কঠিন কঠিন সত্য কথা বলতে পারেন।

লাইলী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হতে পারে।

নাদিয়া বলল, এই বাড়িতে তুমি ছাড়া সবচেয়ে ভালো মানুষ কে বলে তোমার ধারণী?

লাইলী বললেন, জানি না। প্রণব বাবু হতে পারেন।

নাদিয়া বলল, প্রণব কাকা না মা। উনার আচার-আচরণে ভালোমানুষ ভঙ্গি আছে। এই পর্যন্তই। বাবা যদি প্রণব কাকাকে ডেকে বলে, অমুককে খুন করো। প্রণব কাকা নিজে খুনটা করবে না, অন্যকে দিয়ে ঠিকই করাবে।

লাইলী বললেন, হতে পারে।

নাদিয়া বলল, আমার ধারণা এই বাড়ির সবচেয়ে ভালোমানুষ পাংখাপুলার রশিদ।

লাইলী বললেন, ভালোমানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছিস কেন?

কোনো কারণ নেই, এম্নি। আচ্ছা মা, এই বাড়ির সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটা কে?

লাইলী বললেন, তুই নিজে।

নাদিয়া বলল, হয়েছে। মা, আমি তোমার কাছে আমার বুদ্ধির একটা নমুনা দিচ্ছি। হাসান রাজা চৌধুরী নামের যে ছেলেটার সঙ্গে আমার সন্ধ্যায় দেখা হয়েছে, বাবা তার সঙ্গেই আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছে। ঠিক বলেছি?

লাইলী কিছু বললেন না। চাঁদ উঠেছে। তিনি দিঘির জলে চাঁদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছেন।

মা, ছোটমামার নাম ভুলে গিয়েছিলাম। খুব খারাপ লাগছিল। এখন মনে পড়েছে। একই সঙ্গে অন্য একটা রহস্য ভেদ করেছি।

কী রহস্য?

সবুজ শাড়ি রহস্য। তুমি তোমার অতি পছন্দের সবুজ শাড়ি পরো না তার কারণ ছোটমামা।

ওই প্রসঙ্গ থাক।

আচ্ছা থাক। আচ্ছা মা ছোটমামার একটা ত্রুটির কথা বলে। ত্রুটিশূন্য একজন মানুষের কথা ভাবতে খারাপ লাগে।

ওর কোনো ত্রুটি ছিল না।

মা ছিল। উনি জানতেন তাঁর কোনো ত্রুটি নেই। এ কারণে তাঁর অহঙ্কার ছিল। অহঙ্কার বড় ধরনের ত্রুটি। ঠিক না মা?

হ্যাঁ ঠিক। মা তোমার কি মনে হয়—আমি অহঙ্কারী।

লাইলী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই অহঙ্কারী না। তুই তোর ছোটমামার মতো ত্রুটিশূন্য মানুষ।

মা। থ্যাংক য়ু।

 

হাজেরা বিবির সামনে মলিনা দাঁড়িয়ে আছে। কেঁদে সে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। চোখের কাজল গালে লেপ্টে গেছে। হাজেরা বিবি তার কান্নাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তিনি নিজমনে পান ছেঁচে যাচ্ছেন।

তোরে বিদায় দিয়া দিচ্ছে?

জে।

বিদায় দিল কে?

প্রণব স্যার।

হেন্দুটা তো বড় ত্যাক্ত করে। এইজন্যেই হেন্দুজাত খারাপ।

মলিনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কাইল সকাল আটটার আগে বাড়ি ছাইড়া যাইতে বলছেন। কী অপরাধ করলাম কিছুই জানি না। এককথায় বিদায়।

চইলা যাইতে বললে চইলা যাবি। ঘরে দৈ খাকলে দৈ খায়া যাবি। দধি যাত্রা শুভ।

দাদি, কী কন আপনি! আমি চইলা যাব?

হাজেরা বিবি বিরক্ত হয়ে বললেন, তোরে বিদায় দিছে, তুই যাবি না তো কী করবি? ঘরে বইসা ডিম পাড়বি?

মলিনা বলল, বড় সাব ঘটনা এখনো শুনে নাই। বড় সাব শুনলে ব্যবস্থা নিতেন।

কী ব্যবস্থা নিতেন?

আমারে বিদায় করতেন না।

হাজেরা বিবি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমার ছেলে তোর বিদায় করত না কোন কারণে? তুই কি তার সাথে হাঙ্গা বসছস? দুপুর রাইতে ঠোটে রঙ মাখছস। তুই কি নটি বেটি? বদমাগি! দূর হ সামনে থাইকা।

হাজেরা বিবি পান ছেঁচায় মন দিলেন।

 

খিচুড়ি মুখে দিয়ে প্রণবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। প্রচণ্ড ঝাল। মন্ত্রপাঠে ভুল হয়নি। শুদ্ধ শরীরে বেঁধেছেন। রান্নার সময় হাঁড়িতে কি কোনো মুসলমানের ছায়া পড়েছে? গুরু বলে দিয়েছিলেন, নির্জন স্থানে রান্না করতে হবে। যেন হাঁড়িতে কোনো বিধর্মীর এবং কুকুরের ছায়া না পড়ে। অন্য জীবজন্তুর ছায়া পড়লে অসুবিধা নাই।

কষ্ট করে এই খিচুড়ি খাওয়ার অর্থ হয় না। প্রণব উঠে পড়লেন। রাতে এক গ্লাস দুধ খাবেন।

অতিথঘরের বারান্দায় হাসান রাজা বসে আছে। মূর্তির ভঙ্গিতে বসা। কোনো নড়াচড়া নেই। এই যুবক ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে পারে। প্রণবের হরিদ্বারের গুরুত্বও এই ক্ষমতা ছিল। তিনি চোখের পলকও ফেলতেন না। এই যুবক নিশ্চয়ই পলক ফেলে। তারপরেও পরীক্ষা করা দরকার।

হাসান প্রণবের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। প্রণব সামান্য বিরক্ত হলেন। একজন বয়স্ক মানুষকে সম্মান দেখাতে হয়। তাকে ‘আদাব’ বললে দোষ হতো না।

প্রণব বললেন, ভালো আছেন?

হুঁ।

রাতের খাওয়া হয়েছে?

না।

খাওয়া আসে নাই?

এসেছে, পরে খাব।

প্রণব বললেন, পরে কেন খাবেন? গরম গরম খেয়ে নেন।

হাসান বলল, ঠান্ডা খাবার খেতে আমার অসুবিধা হয় না।

প্রণব বললেন, আমি আবার ঠান্ডা খেতে পারি না।

হাসান বলল, একেক মানুষ একেক রকম।

প্রণব বসলেন হাসানের পাশের চেয়ারে। মুখোমুখি বসতে পারলে ভালো হতো। চোখের পলক ফেলার ব্যাপারটা ধরা যেত। বারান্দা অন্ধকার হয়ে আছে, এটাও একটা সমস্যা।

প্রণব বললেন, নাদিয়া মা’র সঙ্গে আলাপ করছেন দেখলাম। কী নিয়ে আলাপ।

হাসান বলল, তেমন কিছু না।

প্রণব বললেন, নাদিয়া অতি গুণের মেয়ে। মাথায় সামান্য ছিট আছে। গুণের সব মানুষই কিছুটা ছিটগ্রস্ত হয়।

হাসান কিছুই বলল না। চুপ করে রইল। প্রণব আশা করেছিলেন হাসান জানতে চাইবে কী ধরনের ছিট। কেউ কিছু জানতে চাইলে সে বিষয়ে বলা যায়। নিজ থেকে বলা এক সমস্যা। প্রণব বললেন, কী ধরনের ছিটগ্রস্ত সেটা বলি। নাদিয়া মা আমাকে বলল, প্রণব কাকা! জোনাকির আঁকে কয়টা করে জোনাকি থাকে আমাকে শুনে বলবেন। উড়ন্ত জোনাকি গুনা কি সম্ভব?

হাসান এখনো নিশ্চুপ। প্রণব বললেন, মলিনা বলে যে একটা মেয়ে আছে, অল্পবয়স্ক, সুন্দরমতো গোল মুখ। তার চাকরি নট হয়েছে। আগামীকাল ভোর আটটার আগে তাকে চলে যেতে হবে। মনে হয় কোনো বড় ধরনের ভুলত্রুটি করেছে। আপনার সঙ্গে কি কিছু করেছে?

হাসান বলল, না।

নীলমণি লতাটার পাশে জোনাকির একটা ঝাঁক দেখা যাচ্ছে। হাসান ঝাঁকের জোনাকি মনে মনে গুনছে। সতেরোটা জোনাকি হিসাবে পাওয়া গেল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ