মাতাল হাওয়া (২০১০)

উৎসর্গ

কোনো মৃত মানুষ মহান আন্দোলন চালিয়ে নিতে পারেন না। একজন পেরেছিলেন। আমানুল্লাহ মোহম্মদ আসাদুজ্জামান। তাঁর রক্তমাখা শার্ট ছিল ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের চালিকাশক্তি।

 

প্রাককথন

আমি মূলত একজন গল্পকার। গল্প বানাতে ভালোবাসি, গল্প করতে ভালোবাসি। দুর্বোধ্য কারণে ইতিহাস আমার পছন্দের বিষয় না। আমি বর্তমানের মানুষ। আমার কাছে অতীত হচ্ছে অতীত। লেখকদের সমস্যা হলো, তারা কাল উপেক্ষা করে লিখতে পারেন না। তারা যদি বিশেষ কোনো সময় ধরতে চান, তখন ইতিহাসের কাছে হাত পাততে হয়।

ঊনসত্তর আমার অতি পছন্দের একটি বছর। আমার লেখালেখি জীবনের শুরু ঊনসত্তরে। একটি মহান গণআন্দোলনকে কাছ থেকে দেখা হয় এই ঊনসত্তরেই। মানুষ চন্দ্র জয় করে ঊনসত্তরে। মাতাল সেই সময়কে ধরতে চেষ্টা করেছি মাতাল হাওয়ায়। তথ্যের ভুলভ্রান্তি থাকার কথা না, তারপরেও যদি কিছু থাকে জানালে পরের সংস্করণে ঠিক করে দেব।

উপন্যাসটি লেখার সময় অনেকেই বইপত্র দিয়ে, ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছেন। দু’একজনের নাম বলতেই হয়। বন্ধু মনিরুজ্জামান, শহীদ আসাদের ছোটভাই। সাংবাদিক এবং কবি সালেহ চৌধুরী।

প্রুফ দেখা, গল্পের অসঙ্গতি বের করার ক্লান্তিকর কাজ করেছে শাওন। তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। পুত্র নিষাদ আমার আট পৃষ্ঠা লেখা এমনভাবে নষ্ট করেছে যে আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাকে তিরস্কার।

হুমায়ূন আহমেদ
১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০
নুহাশ পল্লী, গাজীপুর

 

০১.

হাজেরা বিবি সকাল থেকেই থেমে থেমে ডাকছেন, হাবু কইরে! ও বু! হাবু!

হাবু তাঁর বড় ছেলে। বয়স ৫৭। ময়মনসিংহ জজ কোর্টের কঠিন ক্রিমিনাল লইয়ার। জনশ্রুতি আছে তিনি একবার এক গ্লাস খাঁটি গরুর দুধকে সেভেন আপ প্রমাণ করে আসামি খালাস করে নিয়ে এসেছিলেন। দুধের সঙ্গে আসামির কী সম্পর্ক- সেই বিষয়টা অস্পষ্ট।

হাজেরা বিবি যে ডাকসাইটে অ্যাডভোকেটকে হাবু ডাকছেন তাঁর ভালো নাম হাবীব। হাবীব থেকে আদরের হাবু। এই আদরটা সঙ্গত কারণেই হাবীবের পছন্দ না। তিনি শান্ত গলায় অনেকবার মাকে বলেছেন, মা, আমার বয়সের একজনকে হাবু হাবু বলে ডাকা ঠিক না। একতলায় আমার চেম্বার। মক্কেলরা বসে থাকে। তারা শুনলে কী ভাববে?

হাজেরা বিবি বললেন, মা ছেলেকে ডাকে। এর মধ্যে ভাবাভাবির কী আছে? তোর মক্কেলদের মা তাদের ডাকে না? না-কি তাদের কারোর মা নাই?

মা, আমার নাম হাবীব। তুমি আমাকে হাবীব ডাকো। হাবু ডাকো কেন? হাবু শুনলেই মনে হয় হাবা।

হাজেরা বিবি বললেন, তুই তো হাবাই। লতিফার বিয়ের দিন কী করেছিলি মনে আছে? হি হি হি। এই তো মনে হয় সেইদিনের ঘটনা। তুই নেংটা হয়ে দৌড়াচ্ছিস, তোর পিছনে একটা লাল রঙের রামছাগল। রামছাগলের মতলবটা ছিল খারাপ। হি হি হি।

হাজেরা বিবির বয়স একাশি। দিনের পুরো সময়টা তিনি কুঁজো হয়ে পালঙ্কে ঠেস দিয়ে বসে থাকেন। রাতে তার একেবারেই ঘুম হয় না। সারা রাত জেগে থাকেন। ক্রমাগত কথা বলেন। বেশির ভাগ কথাই আজরাইলের সঙ্গে। তিনি আজরাইলের শরীরের খোঁজখবর নেন। আদবের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন, আপনার শরীর ভালো? খুব পরিশ্রম যাইতাছে? আইজ কয়জনের জান কবজ করছেন? তার মাথা খানিকটা এলোমেলো অবস্থায় আছে। তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প প্রায়ই বলেন, যেসব গল্পের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। তার বেশির ভাগ গল্পেই লতিফ নামের একটা মেয়ের উল্লেখ থাকে। বাস্তবে লতিফা নামের কারোর সঙ্গে তার পরিচয় নেই। আদর করে মাঝে মাঝে লতিফাকে তিনি লতু বলেও ডাকেন।

হাবীবের চেম্বার মফস্বল শহরের তুলনায় যথেষ্ট বড়। সেগুন কাঠের মস্ত টেবিলের তিনদিকে মক্কেলদের বসার ব্যবস্থা। মেঝের একপাশে ফরাস পাতা। মাঝে মাঝে রাত বেশি হলে মক্কেলরা থেকে যান। তখন বালিশের ব্যবস্থা হয়। মক্কেলরা ফরাসে ঘুমান। চেম্বারে দুটা সিলিং ফ্যান আছে। কারেন্টের খুব সমস্যা হয় বলে টানা পাখার ব্যবস্থা আছে। রশীদ নামের একজন পাংখাপুলার পাংখার দড়ি ধরে বসে থাকে। ফ্যান বন্ধ হওয়া মাত্র সে দড়ি টানা শুরু করে।

চেম্বারে তার দূরসম্পর্কের ভাই মোনায়েম খান সাহেবের বড় একটা ছবি আছে। ছবিতে তিনি এবং মোনায়েম খান পাশাপাশি দাঁড়ানো। দু’জনার গলাতেই ফুলের মালা। মোনায়েম খান তখন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর। হাবীবের আরেকটা বড় ছবি আছে আয়ুব খানের সঙ্গে। ইউনিফর্ম পরা জেনারেল আয়ুব তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। আয়ুব খান চশমা পরা, তার মুখ হাসি হাসি। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ছবি কিন্তু মোটামুটি অর্থহীন, কারণ হাবীবের মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার মুখের খানিকটা অংশ দেখা গেলেও হতো, লোকে বুঝত যার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করা হচ্ছে তিনি দুদে অ্যাডভোকেট হাবীব খান। এই ছবির দিকে যারই চোখ যায় তিনি মনে মনে বলেন, শুয়োরের বাচ্চা ফটোগ্রাফার! নেংটা করে পাছায় বেত মারা উচিত।

আজ শুক্রবার হাবীব চেম্বারে মকেল নিয়ে বসেছেন। শুক্রবার তিনি চেম্বারে বসেন না। আজ বসতে হয়েছে কারণ মক্কেল শাসালো। খুনের মামলায় ফেঁসেছে। ৩০৫ ধারা। মকেল ভাটি অঞ্চলের বেকুব সিন্ধি গাইয়ের মতো দিনে তিনবার দুয়ানো যাবে। হাবীব মক্কেলের সঙ্গে কথা বলে আরাম পাচ্ছেন না। কারণ কিছুক্ষণ পরপর তার মা’র তীক্ষ্ণ গলায় ডাক শোনা যাচ্ছে হবু হবুরে! ও হাবু! হাবীব খানের মুহুরি প্রণব বাবু বললেন, স্যার, আপনারে আম্মা ডাকেন। আগে শুনে আসেন। আম্মাকে ঠান্ডা করে আসেন। হাবীব বিরক্ত মুখে উঠে গেলেন। মনে মনে ঠিক করলেন চেম্বারটা এখান থেকে সরিয়ে এমন কোনো ঘরে নিতে হবে যেখান থেকে মা’র গলা শোনা যাবে না। এত বইপত্র নিয়ে চেম্বার সরানো এক দিগদারি। সহজ হতো মা’র ঘর সরিয়ে দেওয়া। সেটা সম্ভব না। হাজেরা বিবি ঘর ছাড়বেন না। কারণ দক্ষিণমুখী ঘর। সামনেই নিমগাছ। সারাক্ষণ নিমগাছের হাওয়া গায়ে লাগে। বৃদ্ধ বয়সে নিমের হাওয়ার মতো ওষুধ আর নাই।

হাবীব মার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে মুখ হাসি হাসি করে বললেন, ডাকেন কেন?

হাজেরা বিবি বললেন, তুই আছিস কেমন?

ভালো আছি। আর কিছু বলবেন? মক্কেল বসে আছে।

হাজেরা বিবি বললেন, আঁটা মেরে মক্কেল বিদায় কর। তোর সাথে আমার জরুরি কথা।

বলেন, শুনি আপনার জরুরি কথা।

বাড়িতে কী ঘটেছে?

হাবীব বললেন, কিছুই ঘটে নাই।

হাজেরা বললেন, শুনলাম সন্ধ্যাকালে বাড়িতে এক ঘটনা ঘটবে।

কী ঘটনা ঘটবে?

বাড়িতে কাজী সাহেব আসতেছে। বিবাহ পড়াবে?

হাবীব মার খাটের পাশে বসতে বসতে বললেন, সবই তো জানেন। আপনাকে বলেছে কে? যে আপনের কানে কথাটা তুলেছে তার নামটা বলবেন? কে বলেছে?

নাম বললে তুই কী করবি? ফৌজদারি মামলা করবি? তোর বউ লাইলী বলেছে। এখন যা মামলা কর। বৌরে জেলে ঢুকা। এই বাড়ির ভাত তার রুচে না। জেলের ভাত খাইয়া মোটাতাজা হইয়া ফিরুক।

হাবীব বললেন, লাইলী আপনাকে কতটুকু বলেছে সেটা শুনি।

হাজেরা বিবি বললেন, কী বলেছে মনে নাই। সন্ধ্যাকালে কাজী আসবে, বিবাহ পড়াবে—এইটা মনে আছে। ঘটনা কি সত্য?

হ্যাঁ সত্য। আর কিছু জানতে চান?

জানতে চাই। ইয়াদ আসতেছে না। আচ্ছা তুই যা। মক্কেলের সাথে দরবার কর।

হাবীব সরাসরি তার চেম্বারে গেলেন না। তিনি গেলেন রান্নাঘরে। লাইলীকে কঠিন কিছু কথা বলা দরকার। বারবার বলে দিয়েছিলেন, বিয়ের এই ঘটনা কেউ যেন না জানে।

রান্নাঘরে লাইলী মাছ কাটা তদারক করছেন। প্রকাণ্ড এক কাতল মাছ তিনজনে ধরেও সুবিধা করা যাচ্ছে না। হাবীব খানের মক্কেলের ভাটি অঞ্চলে জলমহাল আছে। সেখানকার মাছ। বিশাল টাটকা মাছ দেখাতেও আনন্দ। লাইলী মাথায় শাড়ির আঁচল তুলতে তুলতে বললেন, এক টুকরা মাছ কি ভেজে দিব? খাবেন?

দাও। আরেকটা কথা, ফরিদের বিবাহ বিষয়ে মা’কে তুমি কিছু বলেছ?

বলেছি।

উনাকে বলতে নিষেধ করেছিলাম না? কেন বললা?

আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন বলেই বলেছি। শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করবেন, আর আমি মিথ্যা বলব?

হাবীব বললেন, উনার কাছে এখন সত্য-মিথ্যা সবই সমান।

লাইলী বললেন, উনার কাছে সমান কিন্তু আমার কাছে সমান না। আমার কাছে মিথ্যা, মিথ্যাই।

হাবীব রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলেন। স্ত্রীর সঙ্গে বাহাসে যাবার এটা উপযুক্ত সময় না। রান্নাঘরে মাছ কাটাকাটি হচ্ছে। সবাই কান পেতে আছে। কামলাশ্রেণীর মানুষের প্রধান কাজই হলো, ঝাকি জালের মতো কান ফেলা। হাবীব চেম্বারের দিকে রওনা হলেন।

চেম্বারে মুহুরি প্রণব বাবু ছাড়া মক্কেলরা কেউ নাই। তারা জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছে। খুনের মামলায় যে পড়ে সে এবং তার আত্মীয়স্বজনরা কখনো জুম্মার নামাজ মিস দেয় না।

প্রণব মুখে পান দিতে দিতে বললেন, ভালো পার্টি। এরকম পার্টি বৎসরে একটা পেলেও চলে। জলমহাল আছে তিনটা। বিলাত থেকে ব্যারিস্টার আনতে কত খরচ লাগবে জানতে চাইল।

তুমি কী বললা?

আমি বললাম, বিলাতের খবর রাখি না। দেশের খবর রাখি। তখন সে বলল, পূর্বপাকিস্তানের সবচেয়ে বড় উকিল কে?

আমি বললাম, আপনি তো খোঁজখবর নিয়া তার কাছেই আসছেন। আবার ‘জিগান’ কোন কারণে? মনে সন্দেহ থাকলে কোর্ট কাচারিতে ঘুরেন। ঘুরে খবর নেন। তারপরে আসেন। আমরা তো আপনারে দাওয়াতের কার্ড ছাপায়া আনি নাই। তখন চুপ করে গেল।

হাবীব বললেন, প্রণব, তোমার একটাই দোষ। কথা বেশি বলে। যে কথা বেশি বলে তার গুরুত্ব থাকে না। কথা হলো দুধের মতো। অধিক কথায় দুধ পাতলা হয়ে যায়।

প্রণব বললেন, কথা কম বলার চেষ্টা নিতেছি। পারতেছি না। শুনেছি তালের রস খেলে কথা বলা কমে। এই ভাদ্র মাসে তাল পাকলে একটা চেষ্টা নিব।

হাবীব বললেন, কাজী আসবে কখন?

প্রণব বললেন, রাত দশটার পর আসতে বলেছি। চুপিচুপি কর্ম সমাধা হবে। বিয়ে অধিক রাতে হওয়াই ভালো। আপনাদের তো সুবিধা আছে, লগ্নের কারবার নাই! যখন ইচ্ছা তখন কবুল কবুল কবুল।

হাবীব বললেন, ফরিদকে চোখে চোখে রাখতে বলেছিলাম, রেখেছ? পালিয়ে যায়।

তার ঘরের দরজার সামনে সামছুকে বসায়ে রেখেছি। পালায় যাবার পথ নাই! আর পালাবে বলে মনে হয় না। ঝিম ধরে বসে আছে। হারামজাদা।

গালাগালি করবে না।

প্রণব বললেন, কেন করব না স্যার? সে হারামজাদা না তো কে হারামজাদা। আরে তুই একটা মেয়ের পেট বাধায়েছিস, এখন তুই বিয়ে করবি না? তুই বিয়ে না করলে তার বাপরে দিয়ে বিয়ে করাব।

কথা কম বলো প্রণব।

চেষ্টা করতেছি স্যার। রোজ ভোরে সূর্যপ্রণাম করে ভগবানকে বলি, ভগবান! দয়া করো। জবান কমাও।

হাবীব বললেন, আমাকে এক পিস ভাজা মাছ দিতে বলেছিলাম। কোনো খোঁজ নাই। তোমার বৌদিকে বললা মাছ লাগবে না।

হাবীবের কথা শেষ হবার আগেই বড় কাসার প্লেটে এক টুকরা মাছ চলে এল। বিশাল টুকরা। তাকিয়ে দেখতেও আনন্দ। মাছের সঙ্গে চামচ আছে। হাবীব হাত দিয়ে মাছ ভেঙে মুখে দিলেন। খাদ্যদ্রব্য হাত দিয়ে স্পর্শ করাতেও আনন্দ আছে। সাহেবরা কাটাচামচ দিয়ে খায়। খাদ্য হাত দিয়ে ছোয়ার আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত।

মাছে লবণের পরিমাণ ঠিক আছে। এটা আনন্দের ব্যাপার। চায়ে চিনি এবং মাছে লবণ একই। সামান্য বেশকম হলে মুখে দেওয়া যায় না।

হাবীব বললেন, খুনটা করেছে কে?

নাম জহির। একুশ-বাইশ বছর বয়স। ঘরে লাইসেন্স করা বন্দুক ছিল। সেটা দিয়ে নিজের আপন মামাকে গুলি করেছে। পুলিশ এখনো চার্জশিট দেয় নাই। অনেক টাকা খাওয়ানো হয়েছে। তবে চার্জশিট দু’এক দিনের মধ্যে দিবে।

খুনের কারণ কি মেয়েমানুষ?

সব শুনি নাই।

হাবীব বললেন, জগতের বড় যত crime তার সবের পেছনে একটা মেয়েমানুষ থাকবে। শুরুতে সেটা মাথায় রাখলে সুবিধা হয়। ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে গেল হেলেন নামের নাকর্বোচা এক মেয়ের জন্যে।

প্রণব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আফসোস!

হাবীব বললেন, তিন ধরনের নারীর বিষয়ে সাবধান থাকতে শাস্ত্রে বলে। সবু নিতম্বের নারী, বোচানাকের নারী আর পিঙ্গলকেশী নারী। এই তিনের মধ্যে

ভয়ঙ্কর হলো পিঙ্গলকেশী।

প্রণব বললেন, আপনার সঙ্গে থাকা শিক্ষাসফরের মতো। এক জীবনে কত কিছু যে শিখলাম।

হাবীব বললেন, আজ জুম্মা পড়তে যাব না। জোহরের নামাজ ঘরে পড়ে নিব। শরীর ভালো ঠেকতেছে না। ঘরে বিশ্রাম নিব।

মক্কেলদের সঙ্গে বসবেন না।

সন্ধ্যার পর বসব। মাগরেবের ওয়াক্তের পরে। তোমার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছ? পাক বসাবে না?

প্রণব নিরামিশাষী। স্বপাকে আহার করেন। আজ নানান ঝামেলায় রান্না হয় নাই। প্রণব বললেন, আজ ঠিক করেছি উপাস দিব। মাসে দুই দিন উপাস দিলে শরীরের কলকব্জা ঠিক থাকে। ফকির মিসকিনদের যে রোগবালাই কম হয়, তার কারণ একটাই—তারা প্রায়ই উপাস দেয়।

হাবীব উঠে পড়লেন। প্রণবের সামনে বসে থাকলে সে বকবক করতেই থাকবে। হাবীবের সঙ্গে পাংখাপুলার রশিদও উঠে পড়ল। স্যারের গায়ে সাবান ডলে গোসল দেওয়ার দায়িত্ব তার। রশিদের স্বভাব প্রণবের উল্টা। সে নিজ থেকে কখনো কথা বলে না। সে সবার সব কথা শোনে। আট বছর আগে সে খুনের এক মামলায় ফেঁসেছিল। তার সঙ্গী দু’জনের ফাঁসি হয়েছে, সে বেকসুর খালাস পেয়েছে। হাবীব তাকে পাংখপুলারের কাজ দিয়েছেন।

চেম্বার থেকে বের হয়ে হাবীব ডানদিকে তাকালেন। তার ডানদিকে শেষ প্রান্তে ফরিদের ঘর। টিনের চালের হাফবিল্ডিং। সামনে প্রকাণ্ড অশোকগাছ। লাল ফুলে গাছ ভর্তি। ফরিদ মাথা উঁচু করে ফুলের দিকে তাকিয়ে কাঠের চেয়ারে বসে আছে। হাবীবকে সে দেখেনি। দেখলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াত। তিনি ডাকলেন, ফরিদ।

ফরিদ থতমত খেয়ে গেল। উঠে দাঁড়াতেও ভুলে গেল। হাবীব এগিয়ে গেলেন তার দিকে।

ফরিদ, আছ কেমন?

জি। ভালো।

আজ তোমার বিবাহ। বিবাহের দিন লুঙ্গি পরে খালিগায়ে বসে আছ, এটা কেমন কথা?

ফরিদ কিছু বলল না। সে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাবীব বললেন, তোমাকে যে আমি বিশেষ স্নেহ করি এটা জানো?

ফরিদ বিড়বিড় করে বলল, জানি।

হাবীব বলল, বিশেষ স্নেহ করি বলেই এত বড় অন্যায়ের পরেও তোমাকে কোনো শাস্তি দেই নাই। অন্যায়টা যার সঙ্গে করেছ, তার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দিচ্ছি। এখনো বলো তোমার কোনো আপত্তি কি আছে?

না।

এই মেয়েকে তুমি আগে ব্যবহার করেছ বেশ্যার মতো, এখন সে তোমার স্ত্রী হবে। সেটা খেয়াল রাখবে।

জি, রাখব।

প্রণবকে বলে দিব যেন নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি কিনে দেয়। মাথার চুল কাট। বিবাহের দিন চুল কাটা উত্তম সুন্নত।

হাবীব দোতলায় উঠে গেলেন। সিড়ির শেষ মাথায় হঠাৎ তার পা পিছলাল। রশিদ পেছন থেকে দ্রুত ধরে ফেলায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল না। হাবীব সিঁড়ির শেষ ধাপের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই দুর্ঘটনা আজ প্রথম ঘটেনি। আগেও দু’বার ঘটেছে এবং একই জায়গায় ঘটেছে। এর মধ্যে কি কোনো ইশারা আছে?

রশিদ বলল, স্যার দুঃখু পাইছেন?

না। আজ তোমার পাংখা টানাটানি করতে হবে না। ফরিদের বিবাহের ব্যাপারটা দেখো।

জে আচ্ছা।

আরেকটা কাজ করো। মাওলানা সাহেবরে খবর দাও। তিনি যেন দেয়া পড়ে সিঁড়িটাতে ফুঁ দেন। এই সিঁড়িতে দোষ আছে।

জে আচ্ছা।

ফরিদের সঙ্গে যার বিবাহ হবে তার নামটা যেন কী? হঠাৎ করে নাম বিস্মরণ হয়েছি।

তার নাম সফুরা।

আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তুমি যাও।

রশিদ সঙ্গে সঙ্গে গেল না। হাবীবকে শোবার ঘরে ঢুকিয়ে ফ্যান ছাড়ল। ইলেকট্রিসিটি আছে। সিলিং ফ্যান বিকট শব্দ করে ঘুরছে।

রশিদ বলল, পানি খাবেন স্যার। এক গ্লাস পানি দিব?

না।

সিনান কখন করবেন?

পানি গরম দাও, খবর দিব। ভালো কথা, চুল কাটার পর ফরিদকে ভালোমত সাবান ডলে গাল দিবা।

জি আচ্ছা।

জীবনে তিনবারের গমন অতি গুরুত্বপূর্ণ। জন্মের পর, বিবাহের দিল এবং মৃত্যুর পর। এই তিন গোসলেই বড়ইপাতা লাগে, এইটা জানো?

জে না।

তবে আজকাল জনের পরের গোসল আর বিবাহের গোসল—এই দুই শামলে বইপাতা ব্যবহার হয়না। কেন হয়না কে জানে!

ফরিদ ভাইরে কি বইয়ের পাতা দিয়া গোসল দিব?

দাও।

হাবীব বিছানায় শুয়ে পড়লেন। শরীর ছেড়ে দিয়েছে। জ্বর আসার আগে আগে শরীর ছেড়ে দেয়। মক্কেলদের সঙ্গে আজ সন্ধ্যায় বসতে পারবেন–এইরকম মনে হচ্ছে না। বমি বমি ভাবও হচ্ছে। এত বড় মাছের টুকরাটা খাওয়া ঠিক হয় নাই।

 

উপন্যামের এই পর্যায়ে ফরিদের এ বাড়িতে আগমন এবং স্থায়ী হওয়ার ঘটনা বলা যেতে পারে। মাতাল হাওয়ায় ফরিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপুরু। মাঝে। মাঝে গুরুত্বহীন মানুষকে অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। অভাজন হয় যান বিশেষ জন।

শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যাবেলা। হাবীব মসজিদে মাগরীবের নামাজ শেষ করে। ফিরছেন। রশিদ ছাতা হাতে তাঁর পেছনে পেছনে আসছে। ছাতার প্রয়োজন ছিল না। বৃষ্টি পড়ছে না। তবে আকাশের অবস্থা ভালো না। মেঘ ডাকাডাকি করছে। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। ছাতা মেলে প্রস্তুত থাকা ভালো।

হাবীব বাড়ির গেটের সামনে থমকে দাঁড়ালেন।গেটে হাত রেখে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। যুবক তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেট ছেড়ে সরে দাঁড়ান। অস্পষ্ট শব্দে বিড়বিড় করল। মনে হয় সালাম দিল। হাবীব বললেন, কে? নাম কী?

ফরিদ।

কিছু চাও?

জে না।

কিছু চাও না, তাহলে আমার বাড়ির গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই বাড়ির কারও সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?

জে না।

এই বাড়ির কাউকে চেনো?

না।

ঠিকমতো বলো, চুরি-ডাকাতির ধান্দা আছে?

ফরিদ বলল, স্যার, আমি আরাম করে একবেলা ভাত খেতে চাই।

দুপুরের খাওয়া হয় নাই?

না।

সকালে কী খেয়েছ?

মুড়ি।

ভাত খাও না কত দিন?

তিন দিন।

করো কী?

ফার্মেসিতে চাকরি করতাম। চাকরি চলে গেছে।

চাকরি কী জন্যে গেছে? চুরি করেছিলা?

জি।

কত টাকা চুরি করেছিলা?

দুইশ টাকা আর কিছু ওষুধ।

টাকা এবং ওষুধ কাকে পাঠায়েছিলা?

স্যার, আমার মাকে। উনার টিবি হয়েছিল।

উনি কি বেঁচে আছেন?

জি-না। উনার ইন্তেকাল হয়েছে।

বাবা কি জীবিত?

জি-না।

আসো আমার সঙ্গে। চেম্বারে গিয়ে বসো। খানা হতে দেরি হবে। অপেক্ষা করে। কী খেতে চাও?

কষানো মুরগির সালুন আর চিকন চালের ভাত।

আর কিছু না?

জি-না।

চেম্বারের সামনের বেঞ্চিতে ফরিদ জবুথবু হয়ে বসে রইল। বৃষ্টি নেমে গেছে। সে বৃষ্টি দেখছে। রাতে সে আরাম করে খেতে পারবে—এই আনন্দেই তার চোখে পানি এসে গেছে। চোখের পানি আটকানোর কোনো চেষ্টা সে করছে মা। আশেপাশে কেউ নেই যে তাকে দেখবে।

ফরিদের বয়স পঁচিশ। অসম্ভব রোগা একজন মানুষ। মাথার চুল কোঁকড়ানো। চোখ বড় বড়। সে মেট্রিকে তিনটা লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছিল। কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। সংসার চালানোর জন্যে ফার্মেসিতে চাকরি নিতে হয়েছিল।

হাবীব ফরিদের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। ঘরে মুরগি ছিল না। তিনি কষানো মুরগি রাধতে বললেন। কালিজিরা চালের ভাত করতে বললেন। রশিদকে বলে দিলেন, ফরিদকে থাকার জন্যে যেন একটা ঘর দেওয়া হয়। যতদিন ইচ্ছা সে থাকবে। খাওয়াদাওয়া করবে।

রশিদ বিস্মিত হয়ে তাকাল। হাবীব বললেন, বড় বড় বাড়ির শোভা হচ্ছে কিছু উটকা মানুষ। আশ্রিত মানুষ। এরা বাড়ির সঙ্গে যুক্ত না। কোনো কাজেকর্মে না। থাকবে, খাবে এবং লজ্জিত হয়ে জীবনযাপন করবে। এদের লজ্জাটাই বাড়ির শোভা। বুঝেছি?

জি।

তুমি বোঝে নাই। বোঝার প্রয়োজনও নাই! যা করতে বলেছি করো। এই ধরনের মানুষ কিছুদিন থাকে, তারপর একদিন কাউকে কিছু না বলে চলে যায়। ত্রিশ দিনের মাথায় চলে যায়। এই ছেলেও তাই করবে।

ফরিদ তা করেনি। সে তিন বছর ধরে আছে। সে নিজ থেকেই বাগানের গাছপালা দেখে। নানান জায়গা থেকে গাছ এনে লাগায়। আশেপাশে যখন কেউ থাকে না, তখন নিচুগলায় গাছের সঙ্গে কথা বলে। তেঁতুলগাছের সঙ্গে তার এক দিনের কথাবার্তার নমুনা

আছ কেমন? ছোট হয়া আছ, বিষয় কী? আদরযত্নের কি কমতি হইতেছে? গোবর সার, পচা খইল সবই তো পাইছরে বাপধন। আরও কিছু লাগবে? লাগলে বলে। সর্বনাশ, পাতায় পোকা ধরছে! দাঁড়াও নিমের ডাল দিয়া ঝাড়া দিব। নিমের ডালের ঝাড় হইল কোরামিন ইনজেকশন। তবে তোমার পোকায় ধরা ডাল ফেলে দিব। একটু কষ্ট হবে। উপায় কী?

 

বিশাল কাতল মাছ রান্না হয়েছে, হাবীব খেলেন না। তার জ্বর এসেছে। জ্বর গায়ে নিয়েই গোসল করেছেন। এতে সামান্য আরাম পাচ্ছেন। ঘুম এসেছে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছেন। অসুস্থ অবস্থায় স্বপ্নগুলিও অসুস্থ হয়। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, হাতির পিঠে করে নদী পার হচ্ছেন। নদীতে প্রবল স্রোত। হাতি ঠিকমতো সাঁতরাতে পারছে না। মাহুত মুখে হট হট করছে। হাতি সামলানোর চেষ্টা করছে। পারছে না।

রাত দশটায় তার ঘুম ভাঙানো হলো। ছোট্ট সমস্যা না-কি হয়েছে। কাজী সাহেব এসেছেন। সব প্রস্তুত। শুধু সফুরা এখন বলছে সে কবুল বলবে না। বিবাহ করবে না। খবর নিয়ে এসেছেন প্রণব বাবু। তাকে চিন্তিত এবং ভীত মনে হচ্ছে।

হাবীব বললেন, বিবাহ করবে না। পেটে বাচ্চা নিয়ে ঘুরবে। বড় বাড়ির ইজ্জত নষ্ট করবে।

প্রণব চুপ করে রইলেন।

হাবীব বললেন, নৌকা ঠিক করো। মেয়েটাকে নৌকায় তুলে দাও। নৌকা তাকে ভাটি অঞ্চলে ছেড়ে দিয়ে আসবে। সেখানে সে যা ইচ্ছা করুক। এই জাতীয় মেয়ের স্থান হয় বেশ্যাপল্লীতে। শেষ পর্যন্ত সে সেইখানেই যাবে।

প্রণব বললেন, ফরিদকেও নাওয়ে তুলে দেই, মেয়ের সাথে বিদায় হয়ে যাক।

হাবীব বললেন, না। সে তো বিবাহ করতে রাজি হয়েছে। যে মেয়ে তার সঙ্গে রাত কাটিয়েছে, সে ভালো মেয়ে না। অন্যের সঙ্গেও সে এই কাজ করতে পারে। তারপরেও ফরিদ বিবাহে মত দিয়েছে, এরে ছোট করে দেখা ঠিক না। তার দোষ এতে কিছু কাটা গেছে। মেয়েটাকে বিদায় করে আমাকে খবর দাও যেন শান্তিমতো ঘুমাতে পারি।

প্রণব চলে গেলেন এবং আধঘণ্টার মধ্যে জানালেন, সমস্যার সমাধান হয়েছে। সফুরার সঙ্গে এক শ’ এক টাকা কাবিনে ফরিদের বিবাহ হয়েছে।

হাবীব বললেন, ভালো।

প্রণব বললেন, আপনার জ্বর কি বেশি? একজন ডাক্তার ডেকে আনি?

হাবীব বললেন, না। মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করতে বলো। আর জামে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে স্বপ্নের তফসির নিয়ে আসে। স্বপ্নে আমি হাতির উপর উঠেছি। হাতি নদী পার হচ্ছে। নদীতে প্রবল স্রোত।

 

রাত প্রায় বারোটা। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। শহর অন্ধকার। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাস দিচ্ছে। এখনো বর্ষণ শুরু হয়নি। ফরিদের নবপরিণীতা স্ত্রী চৌকিতে বসে কাঁদছে। তার মুখ জানালার দিকে ফেরানো বলে ফরিদ মুখ দেখতে পাচ্ছে না। চৌকির ওপর মশারি খাটানো। বাতাসে নৌকার পালের মতো মশারি উড়ছে। ফরিদ মশারি ঠিক করতে ব্যস্ত। ঘরে হারিকেন জ্বলছে। তবে হারিকেন দপদপ করছে। যে-কোনো সময় হারিকেন নিভবে। ফরিদ কলল, রাত অনেক হয়েছে। শুয়ে পড়ো।

সফুরা বলল, আপনে আমার সাথে কথা কবেন না। আমার গায়ে হাত দিবেন না। শইলে যদি হাত দেন দাও দিয়া কোপ দিব। হাত ফালায়া দিব।

ফরিদ বলল, আমি কী দোষ করলাম।

দোষ করেন নাই?

ফরিদ বলল, না। তুমি জানো, আল্লাহপাক জানেন, তোমার সঙ্গে আমার কিছু হয় নাই। কারোর সঙ্গেই কিছু হয় নাই। আমি সেরকম মানুষ না। তুমি মহাবিপদে পড়েছিলা বলে সাহায্য করেছি। একবার আমিও মহাবিপদে পড়েছিলাম। স্যার সাহায্য করেছেন। একজনের বিপদে অন্যজন সাহায্য করবে এইটাই নিয়ম।

সফুরা বলল, যে দোষ করেন নাই সেই দোষ নিজের ঘাড়ে কী জন্যে নিয়েছেন?

একটা কারণ আছে। কোনো একদিন তোমারে বলব। কান্দন বন্ধ করো।

সফুরা বলল, আমি সারা রাত কানব। অপনের অসুবিধা আছে।

আমি ঘুমাইতে পারব না। এইটাই অসুবিধা।

আইজ রাইতে আপনি ঘুমাইতে পারবেন?

কেন পারব না।

আপনে মানুষ না। আপনে গাছ। গাছের সাথে যে কথা বলে, সে গাছই হয়।

আমি গাছের সাথে কথা বলি তুমি জানো?

সবেই জানে।

ফরিদ বলল, এই তো তোমার কান্দা বন্ধ হইছে। তুমি অত্যধিক সুন্দর মেয়ে, এইটা আগে নজর করি নাই।

সফুরা বলল, আগে নজর করলে কী করতেন? ইশারা দিতেন? বিছানার ইশারা?

ছিঃ, এমন চিন্তা করবা না। সব মানুষ একরকম না। কিছু মানুষ আছে। ফেরেশতারও উপরে।

সফুরা বলল, মানুষ তে ফেরেশতার উপরেই। ফেরেশতার যে সর্দার সে মানুষরে সালাম করছিল।

বাহ্, সুন্দর বলেছ। সব মানুষই ফেরেশতার উপরে। তোমার কথা শুনে মনে বল পেয়েছি।

সফুরা বলল, আমি একটা নটি মাগি। আমার কথা শুনে মনে বল পেয়েছেন?

নিজের বিষয়ে এইভাবে বলবা না।

দমকা বাতাসে হারিকেন নিভে গেল। তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। স্বামী-স্ত্রী অন্ধকারে পাশাপাশি বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। এক পর্যায়ে সফুরা বলল, আপনে শুইয়া পড়েন। আপনে বইসা আছেন কোন দুঃখে? ঠান্ডা বাতাস ছাড়ছে, আরামে ঘুম দেন! মাথা টিপ্যা দিতে বললে মাথা টিপা দিব।

ফরিদ বলল, গল্প শুনব। একটা গল্প বলব?

বলতে চাইলে বলেন। আমারে গাছ ভাবছেন? ভাবছেন গাছের মতো আমিও আপনের গফ শুইন্যা মজা পাব? আমি গাছ না।

ফরিদ বলল, এক কাঠুরের গল্প। সে কাঠ কাটতে বনে গিয়েছে। হঠাৎ তার কুড়ালটা পড়ে গেল পানিতে। মনের দুঃখে সে কাঁদছে। তখন পানি থেকে জলপরী উঠে এসে বলল, কুড়ালের জন্যে কাঁদছ? এই সোনার কুড়ালটা কি তোমার?

সফুরা বলল, এই গল্প আমি জানি। কাঠুরে বলল, না। তখন জলপরী একটা রুপার কুড়লি তুলে বলল, এইটা তোমার? কাঠুরে বলল, না। আমার কুড়াল লোহার। তখন তার ভালোমানুষি দেখে জলপরী খুশি হয়ে তিনটা কুড়ালই দিয়ে দিল।

ফরিদ বলল, আমি যে গল্পটা বলব সেটা এখানেই শেষ না। আরেকটু আছে। বলি?

বলেন।

সেই কাঠুরে অনেকদিন পর তার স্ত্রীকে নিয়ে বনে বেড়াতে গেছে। হঠাৎ স্ত্রী পানিতে পড়ে ডুবে গেল। কাঠুরে কান্না শুরু করেছে। জলপরী অতি রূপবতী রাজকন্যার মতো এক মেয়েকে পানি থেকে তুলে বলল, এই কি তোমার স্ত্রী?

কাঠুরে বলল, জি এই আমার স্ত্রী।

জলপরী বলল, কালো করে দেখে তারপর বলো।

কাঠুরে বলল, সরি দেখতে হবে না। এই আমার স্ত্রী।

জলপরী বলল, আগের বার তোমার সততা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখন তুমি এটা কী করলে? রূপবতী মেয়ে দেখে স্ত্রীকে ভুলে গেলে?

তখন কাঠুরে বলল, আমি বাধ্য হয়ে বলেছি এইটাই আমার স্ত্রী। যদি না বলতাম, আপনি এরচেয়ে একটু কম সুন্দর আরেকটা মেয়ে তুলতেন। আমি যদি বলতাম এই মেয়ে না। আপনি সবশেষে আমার স্ত্রীকে তুলতেন এবং আগের বারের মতো তিনজনকেই আমাকে দিয়ে দিতেন। আমি নিতান্তই গরিব মানুষ। তিন বউকে পালব কীভাবে? এই কারণে প্রথমবারই বলেছি এটা আমার স্ত্রী।

সফুরা বলল, ও আল্লা। সুন্দর তো।

ফরিদ বলল, গল্পটা তোমার পছন্দ হয়েছে?

সফুরা বলল, হয়েছে।

ফরিদ বলল, এই গল্পটা তোমাকে কেন বললাম জানো? গল্পটা বললাম যেন তুমি বুঝতে পারো আমি কত গরিব। ওই কাঠুরের তিনজন স্ত্রী পালার ক্ষমতা নাই। আমার অবস্থা তারচেয়ে অনেক খারাপ। আমার একজন স্ত্রী পালার ক্ষমতাও নাই।

ফরিদের কথা শেষ হতেই দোতলা থেকে হাজেরা বিবির তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল, হাবু, হাবু! ও হাবু! হাবুরে!

 

ফরিদের বিয়ের তারিখ ১৭ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সন। এই তারিখটা গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ থেকে এই দিন শেখ মুজিবুর রহমান বেকসুর খালাস পান। হাসিমুখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি বের হলেন। ফুলের মালা নিয়ে অনেকেই তার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাদের সময় দিতে হবে। মিছিল করে ফেরার পথে বক্তৃতা দিতে হতে পারে। দীর্ঘ কারাবাসে তার শরীর এবং মন—দুইই ক্লান্ত। দ্রুত ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করছে। ঘরে ফিরে গরম পানি দিয়ে গোসল। গোসল শেষে অনেক দিন পর স্ত্রীর হাতের রান্না খাবার। কয়েকদিন থেকেই কেন জানি পুঁটি মাছের কড়কড়া ভাজি আর ছোট টেংরা মাছের টক খেতে ইচ্ছা করছে। আজ কি সম্ভব হবে? মনে হয় না।

জেলগেটের বাইরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আবার গ্রেফতার করা হলো। এবার দেশরক্ষা আইনে না। এবার গ্রেফতার হলেন, আর্মি নেভি এবং এয়ারফোর্স অ্যাক্টে। তাঁকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হলো কুর্মিটোলা সেনানিবাসে।

 

হাবীব সারা দিনে একবারই খবর শোনেন। রাতের শেষ ইংরেজি খবর। তিনি রাতের খবরে জানলেন দু’জন সিএসপি অফিসারসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ববাংলা বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারা ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনারের সঙ্গে গোপন মিটিং চালাচ্ছিল। দেশ ধ্বংস ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।

হাবীব বিড়বিড় করে বললেন, এইবার আর রক্ষা নাই। ঝুলে পড়তে হবে। তিনি শোবার আয়োজন করলেন। স্ত্রীর জন্যে অপেক্ষা। স্ত্রী প্রথম বিছানায় যাবে, তারপর স্বামী—এটাই নিয়ম। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না। ব্যতিক্রম হলে স্বামীর আয়ু কমে।

লাইলী পানের বাটা নিয়ে ঢুকলেন। হাবীব পানের বাটা থেকে এক টুকরা লং নিয়ে মুখে দিলেন। লাইলী বললেন, একজন নির্দোষ মানুষরে আপনারা দোষী করলেন?

কে নির্দোষ? কার কথা বলো?

ফরিদের কথা বলি।

সে নির্দোষ কীভাবে জানো?

লাইলী হাই তুলতে তুলতে বললেন, জানি।

হাবীব বললেন, বেশি জানবা না এবং বেশি বুঝবা না। যারা বেশি জানে এবং বেশি বোঝে তারাই বিপদে পড়ে। যেমন শেখ মুজিবুর রহমান। সে বেশি বুঝে ফেলেছিল। এখন তাকিয়ে আছে ফাঁসির দড়ির দিকে। আমাকে অজুর পানি দাও।

লাইলী বললেন, এশার নামাজ তো পড়েছেন। আবার অজুর পানি কেন?

তাহাজ্জুত পড়ব। মন অস্থির হয়েছে।

মন অস্থির কেন?

এত কথা তোমারে বলতে পারব না। অজুর পানি দিতে বলেছি—পানি দাও। আরেকটা কথা, এই বৎসর এখনো খেজুরের রস খাওয়া হয় নাই। কাল সকালে খেজুরের রস খাব।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ