হাবীব চেম্বারে বসেছেন। তার সামনে মক্কেলরা বসা। সামনের সারিতে বসেছে। তিনজন, তাদের পেছনে বোরকাপরা এক মহিলা। এমন কঠিন বোরকা যে মুখও দেখা যাচ্ছে না। এই গরমেও বোরকাপরা মহিলার গায়ে কাজ করা হলুদ রঙের চাদর। হাবীবের সঙ্গে প্রণব বসে আছেন। প্রণবের মুখভর্তি পান। রশিদ পাংখা টেনে যাচ্ছে। হাবীব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মক্কেলদের চোখের দিকে তাকালেন। কথাবার্তা শুরুর আগে তাদের ভাবভঙ্গি দেখা প্রয়োজন।

সবচেয়ে বয়স্কজনের গায়ের রঙ পাকা ডালিমের মতো। চুল-দাড়ি সবই ধবধবে সাদা। তাঁর দৃষ্টি ভরসাহারা। চোখের নিচে কালি। তিনি লম্বা আচকান পরেছেন। তাঁর হাতে তসবি। তিনি তসবির গুটি টেনে যাচ্ছেন। তার দু’পাশে যে দু’জন বসা তারা টাউটশ্রেণীর তা বোঝা যাচ্ছে। মামলা-মোকদ্দমা জাতীয় বিপদে টাউট জুটে যায়। একজনের থুতনিতে অল্প দাড়ি। মাথায় বেতের টুপি। চোখে সুরমা। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। অনাজন যুবা বয়সের। শার্ট-প্যান্ট পরা। তার গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে। হাবীব বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আসামির কে হন?

বৃদ্ধ বললেন, পিতা।

নাম?

রহমত রাজা চৌধুরী।

হজ্জ করেছেন?

জি জনাব। দুইবার হজ্জ করেছি।

আপনার সঙ্গে এই দুইজন কে?

একজন আমার গ্রামসম্পর্কের ভাতিজা, নাম সুলায়মান। হজ্জ করেছে। মামলা-মোকদ্দমা ভালো বোঝে। আরেকজন আমার দূরসম্পর্কের ভাই। নাম ইয়াকুব।

আপনার ভাই ইয়াকুব, তিনিও কি মামলা-মোকদ্দমা ভালো বোঝেন?

জি জনাব। জলমহাল নিয়ে একটা হাঙ্গামায় পড়েছিলাম, সে নানান সাহায্য করেছে। তার ‘উনসুনি’ বুদ্ধি ভালো।

হাবীব বললেন, এই দু’জনকে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বলেন। যারা মামলা-মোকদ্দমা ভালো বোঝে তাদের সামনে আমার কথাবার্তা বলতে অসুবিধা হয়। কারণ আমি নিজে মামলা-মোকদ্দমা কম বুঝি।

বদ্ধ তার দুই সঙ্গীকে নিচুগলায় কিছু বললেন। দুজনেই কঠিন মুখ করে নাসূচক মাথা নাড়ল। একজন (ইয়াকুব) হাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল, জনাব, আমাদের থাকার প্রয়োজন আছে। মামলার অনেক খুঁটিনাটি আমরা জানি। হাজি সাহেব সুফি মানুষ, তিনি বলতে গেলে কিছুই জানেন না।

হাবীব বললেন, আপনি অনেক কিছু জানেন?

জি, অবশ্যই।

খুনটা কে করেছে। আপনি?

আমি কেন খুন করব? এইসব কী বলেন?

হাবীব বললেন, আপনি খুন না করলে সব খুঁটিনাটি জানবেন কীভাবে?

হাজি সাহেব বললেন, এই তোমরা যাও। বাইরে অপেক্ষা করো।

নিতান্ত অনিচ্ছায় দু’জন উঠে গেল। হাবীব বললেন, হাজি সাহেব, আপনার পেছনের মহিলা কে?

আমার ভাগ্নি। জনাব, সে থাকুক। সে শুধু শুনে যাবে, কোনো কিছুই বলবে না।

হাবীব বললেন, উনি থাকলে আমার সমস্যা নাই। আমি টাউট অপছন্দ করি। যাই হোক, আমি প্রশ্ন করলে তা উত্তর দিবেন। উকিল এবং ডাক্তার এদের কাছে মিথ্যা বললে পরে বিরাট সমস্যা হয়।

হাজি সাহেব বললেন, জনাব, আমি এম্নিতেই সত্য কথা বলি। অভাবি মানুষ মিথ্যা বেশি বলে। আমি অভাবি না।

খুব ভালো। খুন আপনার ছেলে করেছে?

জি।

কে খুন হয়েছে?

ছেলের আপন মামা। আমার বড় শ্যালক। তার নাম আশরাফ। আশরাফ আলি খান। খী বংশ।

খুনটা কী কারণে হয়েছে?

এই বিষয়ে আমি জানি না। ছেলে কিছু বলে নাই। সে বলবে না।

ঘটনা কীভাবে ঘটেছে বলুন।

আমার বড় শ্যালক আশরাফ আলি খান ব্যবসা করে। মোহনগঞ্জে এবং ধর্মপাশায় তার বিরাট পাটের ব্যবসা। একটা লঞ্চও আছে। বর্ষাকালে ভাটি অঞ্চলে লঞ্চ চলাচল করে। আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই মোহনগঞ্জে মামার সঙ্গে থাকে।

কেন?

ভাটি অঞ্চলে কোনো স্কুল নাই। মামার সঙ্গে থেকে ছেলে মোহনগঞ্জ পাইলট স্কুলে পড়েছে। আমার ছেলে লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভালো। মাশাল্লাহ। সে চারটা লেটার নিয়ে মেট্রিক পাশ করেছে। সিলেট এম সি কলেজ থেকে স্টার মার্ক পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে।

খুনটা কীভাবে হয়েছে সেটা বলুন। ছেলের বিদ্যাবুদ্ধি বিষয়ে পরে জানব।

আমার বড় শ্যালক ফজরের নামাজের অজু করে নামাজে বসেছে, তখন আমার ছেলে দু’নলা বন্দুক দিয়ে দু’টা গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।

ঘটনা কেউ দেখেছে?

বারান্দায় নামাজ পড়ছিল, ইমাম সাহেব ছিলেন। উনি দেখেছেন। তারপর সবাই ছুটে এসেছে। সবাই ছুটে এসেছে।

পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে?

এখনো দেয় নাই। তদন্ত চলছে।

আপনার ছেলে কি পুলিশ কাস্টডিতে?

হাজি সাহেব বললেন, জি-না। পুলিশ তাকে খুঁজছে। কিন্তু সে পলাতক। তাকে শিলচর পাঠিয়ে দিয়েছি সেখানে আমার এক আত্মীয় আছে।

হাবীব বললেন, একটু আগে বললেন, আপনি মিথ্যা বলেন না। এখন তো মিথ্যা বললেন। ছেলে আপনার সঙ্গেই আছে। বোরকাপরাটা আপনার ছেলে।

ছেলের নাম কী?

হাসান রাজা চৌধুরী।

হাবীব কঠিন গলায় বললেন, হাসান রাজা চৌধুরী, বোরকা খেলো।

হাজি সাহেব বললেন, একগ্লাস পানি খাব।

প্রণব পানি আনার জন্যে উঠে গেলেন। হাবীব বিরক্তমুখে সিগারেট ধরালেন। হাসান রাজা চৌধুরী বোরকা খুলল। হাবীব অনেকক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি তার দীর্ঘ জীবনে এমন রূপবান পুরুষ দেখেননি। কোরান শরিফে অতি রূপবান হিসেবে ইউসুফ নবীর কথা বলা আছে। সেই নবী কি সামনে বসে থাকা ছেলেটির চেয়েও সুন্দর ছিলেন?

হাবীব বললেন, মক্কেলের সঙ্গে আমি মামলা ছাড়া অন্য বিষয়ে আলাপ করি না। আজ অন্য একটা প্রসঙ্গে কথা বলব। হাজি সাহেব, আমি আপনার ছেলের মতো রূপবান পুরুষ দেখি নাই। প্রণব, তুমি কি দেখেছ?

প্রণব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, একবার দেখেছিলাম। শম্ভুগঞ্জ বাজারে কাপড়ের আড়তে সে বসা ছিল। জিজ্ঞেস করে জানলাম তার নাম মনীন্দ্র। তাকে দেখার জন্যে ভিড় জমে গিয়েছিল। ছয় ফুটের মতো লম্বা। ইংরেজ সাহেবদের মতো গাত্রবর্ণ। আমি যখন বললাম, আপনার নাম এবং পরিচয় কি জানতে পারি? তখন…

হাবীব বললেন, প্রণব, বাকিটা পরে শুনব। এখন একটু বাইরে যাও। রশিদ, তুমিও যাও। আমি এই দু’জনের সঙ্গে প্রাইভেট কিছু কথা বলব।

প্রণব অপ্রসন্ন মুখে উঠে গেলেন। মামলা-মোকদ্দমার প্রাইভেট কথায় তিনি থাকবেন না কেন তা বুঝতে পারছেন না।

হাবীব বললেন, হাজি সাহেব, আপনার মামলা আমি নিব। ছেলের পলাতক থাকাটা ঠিক না। পলাতক থাকার অর্থ অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া। খুনের মামলায় পলাতক আসামির বেশির ভাগ সময় মৃত্যুদণ্ড হয়।

হাজি সাহেব বললেন, ছেলেকে কি পুলিশের হাতে তুলে দিব?

এখনো না। যখন বলব তখন। আরও মাসখানিক সে পলাতক থাকতে পারে। আমি মামলা গুছিয়ে আনার পর সে পুলিশের কাছে ধরা দিবে। তবে আপনি যে ছেলেকে বোরকা পরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাখছেন তা ঠিক না। আপনার দুই সঙ্গীও বিষয়টা জানে। এটাও ঠিক না। ছেলে এমন জায়গায় থাকবে যে আপনি ‘াড়া আর কেউ জানবে না।

হাজি সাহেব বললেন, আমার এমন কোনো জায়গা নাই। শিলচরে আমার খালাত ভাই থাকে। ছেলে সেখানে যেতে রাজি না।

আপনি কোথায় থাকেন?

আমি হোটেলে উঠেছি। হোটেলের নাম ‘আল হেলাল।

আপনার ছেলেও আপনার সঙ্গে থাকে?

জি।

আপনার দুই সঙ্গীকে না জানিয়ে ছেলেকে আমার এখানে দিয়ে যাবেন। সে মামার এখানে লুকিয়ে থাকবে। আপনি একা পারবেন না। আমার পাংখাপুলার রশিদকে পাঠাব। সে অতি বিচক্ষণ। আমার এখানে ছেলেকে রাখতে আপনার আপত্তি আছে?

হাজি সাহেব বললেন, জি-না জনাব। ছেলের মত আছে কি না একটু জেনে নেই।

হাবীব কঠিন গলায় বললেন, আপনার ছেলের মতামত বলে এখন কিছু নাই। যেদিন মামলার রায় হয়ে যাবে, হাইকোর্ট থেকে আপিলের ফলাফল হাতে আসবে, তখন তার মতামত শুরু হবে।

হাজি সাহেব বললেন, আমি খবর নিয়েছি অনেক খুনের আসামিকে আপনি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। আমার ছেলেকে কি ছাড়িয়ে আনতে পারবেন?

হাবীব বললেন, ছেলে যদি বলে আমি খুন করেছি তাহলে ছাড়িয়ে আনতে পারব না। তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।

এই প্রথম হাসান রাজা চৌধুরী মুখ খুলল। সে শান্ত গলায় বলল, আমি মিথ্যা কথা বলব না।

হাবীব বললেন, তাহলে তো বাবা আমার কাছে খামাখা এসেছ। সত্যি কথা বলে ফাঁসিতে ঝুলে পড়ো। তোমাকে আমি একটা কথা বলি, তুমি কঁসিতে ঝুলিলে আমার কিছু যায় আসে না। আবার তুমি খালাস পেয়ে নৌকাবাইচ খেললেও কিছু যায় আসে না। বুঝেছ?

হাসান বলল, জি।

হাবীব বললেন, আমার অনুমানশক্তি ভালো। তুমি খুনটা কেন করেছ সেটা আমি অনুমান করতে পারি। বলব আমার অনুমান?

হাসান বলল, না।

হাবীব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, চিন্তাভাবনা করে ঠিক করুন কী করবেন?

হাজি সাহেব বললেন, আপনি কি চলে যাচ্ছেন।

হাবীব বললেন, জি। গভর্নর মোনায়েম খানকে আজ বার কাউন্সিল থেকে একটা সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আমি বার কাউন্সিলের প্রধান।

 

সময় ১৯৬৮, এশিয়ার লৌহমানব বলে স্বীকৃত আয়ুব খান হাসি হাসি মুখে পাকিস্তানের সব ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছেন। পূর্ব এবং পশ্চিম, দুই পাকিস্তানেই তার উন্নয়নের দশ বছর পালিত হচ্ছে। বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনা।

পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংহতি আরও প্রবল করার বাসনায় তিনি এক সভায় ঘোষণা করলেন, বাংলা-উর্দু মিলিয়ে এক নতুন ভাষা পাকিস্তানে তৈরি করা হবে। ভবিষ্যতের পাকিস্তানিরা এই ভাষাতেই কথা বলবে।

সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ঘোষণা করল বাংলা বর্ণমালা লিখন রীতির সংস্কার করা প্রয়োজন।(১)

পূর্বপাকিস্তানে মোনায়েম খান নামের একজনের রাজত্বকাল। তার উত্থানের গল্পটি এরকম—তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ বারের অতি সাধারণ একজন ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার। আয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি নামের অদ্ভুত পদ্ধতিতে এমএলএ হন। নির্বাচিত এমএলএ-রা যাবেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে সংসদ বসবে। এয়ারপোর্টে ছাত্ররা তাদের ঘিরে ধরল। তাদের দাবিদাওয়া যেন সংসদে পেশ করা হয়। সবাই চুপ করে থাকলেন, শুধু মোনায়েম খান বললেন, এইসব দাবিদাওয়া কোনো কাজের কথা না। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হাতে। লাগল। এক পর্যায়ে কিছু ছাত্র তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধাক্কা খেয়ে মোনায়েম খানের টুপি উড়ে গেল। এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করা হলো। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকে ছবিটি ছাপা হলো।

আয়ুব খান বুঝে গেলেন মোনায়েম খানকে তার প্রয়োজন। তিনি শুরুতে তাঁকে করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিছুদিন পরেই গভর্নর।

মোনায়েম খানকে নিয়ে মজার মজার সব গল্প। যেমন, তিনি রাতে ঘুমানোর সময় বুকের ওপর একটা বই নিয়ে ঘুমান। বইটির নাম Friends Not Masters, বইটির লেখক আয়ুব খান।

তিনি না-কি টিভি এবং বেতারের দুই প্রধানকে গভর্নর হাউসে চা খেতে ডেকে নিয়ে বলেছেন, আমার সম্পর্কে কিছু অপপ্রচার আছে। আমি নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীত বিরোধী। অবশ্যই না। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে আমি চাই এখন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত আপনারা মুসলমান গীতিকারদের দিয়ে লেখাবেন। বেতার এবং টিভিতে মুসলমানদের লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ।

আনন্দমোহন কলেজের প্রিন্সিপাল নিযুক্তি নিয়েও গল্প আছে। মোনায়েম খান ঠিক করলেন তিনিই প্রিন্সিপাল নির্বাচন করবেন। ঠিক মানুষকে নিতে হবে। নয়তো সমস্যা। দু’জন ক্যান্ডিডেটের একজনকে বললেন, সকালে কী দিয়ে নাশতা করেছেন।

তিনি বললেন, পরোটা ডিমভাজি।

এই ক্যান্ডিডেট সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে গেলেন। কারণ ডিম হিন্দুয়ানি শব্দ। যে ডিম বলবে সে ইসলামি তমুদ্দনের একজন হবে না।

অন্য ক্যান্ডিডেট বললেন, রুটি আর আন্ডাভাজি দিয়ে নাশতা করেছি।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হলেন। কারণ ‘আভা’ মুসলমানি শব্দ। তবে তাকেও মোনায়েম খান বললেন, আল্ডা না বলে আপনি যদি বইদা বলতেন তাহলে আমি আরও খুশি হতাম। বইদা হলো ডিমের খাস আরবি। অনেকেই বইদা বলে। আপনার বলতে অসুবিধা কী? এখন থেকে বইদা বলবেন।

মোনায়েম খান তার রাজত্বকালে অতি গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করলেন তা হলো, এনএসএফ নামের ছাত্র সংগঠনকে পুরোপুরি গুণ্ডাবাহিনীতে রূপান্তর করা। তিনি এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন। এনএসএফকে গুণ্ডামির অলিখিত লাইসেন্স দেওয়া হলো। বিষয়টা পুলিশ বাহিনীকেও জানানো হলো।

এই সরকারি দলের একজনের নাম পাচপাত্তুর। সে টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে থাকে। হাতে সাইকেলের চেইন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাতাল হাওয়া’ গ্রন্থে পাচপাত্তুরের ভূমিকা আছে বলেই তার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হচ্ছে। শুরুতে পাচপাণ্ডুর নামকরণের ইতিহাসটা বলা যাক। তার আসল নাম সাইদুর। তার বাবা বিএম কলেজের শিক্ষক। সে ছিল M.Sc. Part -র ছাত্র। তার ঘরের দরজায় নিজের নাম লেখা। নামের শেষে লেখা Pass Part Two.

‘পাস পার্ট টু’ থেকে হয়েছে পাচপাস্তুর। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে তার পূর্ণ ক্ষমতা যে ঘটনাটি দিয়ে দেখাল তা হলো, এক রাতে রেলওয়ে কলোনি থেকে অল্পবয়েসী দু’জন প্রসটিটিউট নিয়ে এল। শহীদুল্লাহ হলের মাঠে তাদেরকে দিয়ে নগ্ননৃত্যের ব্যবস্থা করল। সে নিজেও চেইন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ নাচল। শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র-শিক্ষকরা হতভম্ব হয়ে এই দৃশ্য দেখল।(২)

এনএসএফ নামক সংগঠনটির প্রেসিডেন্টের নাম জমির আলি। সেক্রেটারি মাহবুবুল হক দোলন। এই দু’জন খুব সম্ভব এসএম হলে থাকত। তবে এনএসএফ-এর মূল ঘাঁটি ছিল সদ্যনির্মিত মহসিন হল। এরা সহকারী হাউস টিউটরের জন্যে বানানো চমৎকার একটি উইং দখল করে ছিল। সাধারণ ছাত্রদের টাকায় কেনা খাবারদাবারের একটি অংশ চলে যেত তাদের কাছে। তাদের জন্যে আলাদা রান্না হতো।

মহসিন হলের পাশেই রেললাইন। রেললাইনের দু’পাশে বস্তি। বস্তির কিছু মেয়ে ছিল যৌনকর্মী। তাদেরকে প্রায়ই মহসিন হলে এনএসএফ-এর নেতাদের কাছে আসতে দেখা যেত। হলের প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটররা পুরো বিষয় জানতেন। কেউ কিছুই বলতেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাব হয়তো ছিল না, সাহসের অভাব ছিল।

মহসিন হলের ৫৬৪ নম্বর রুমে রসায়ন বিভাগের অতি নিরীহ একজন ছাত্র বাস করত। SSC এবং HSC-তে তার রেজাল্ট ভালো ছিল বলে তাকে একটি সিঙ্গেল সিটের রুম দেওয়া হয়েছিল। এই বেচারা এনএসএফের নেতাদের ভয়ে সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকত। একদিন কোনো কারণ ছাড়াই এনএসএফের নেতারা তার ঘরে ঢুকে রুম তছনছ করে দিল। তোষক জ্বালিয়ে দিল এবং বেচারার নিজের টাকায় কেনা Organic Chemistry’র Morrison and Boyed-এর লেখা বিশাল বইটাও ছিড়ে কুটিকুটি করে ফেলল। বই কুটিকুটি করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণে বইটা সে অনেক দাম দিয়ে স্কলারশিপের টাকায় কিনেছে। তার একটাই বই। কেমিস্ট্রির অন্য বইগুলি সে লাইব্রেরি থেকে এনে পড়ত। নতুন করে আরেকটা তোষক কেনার টাকা তার ছিল না। খাটে পত্রিকার কাগজ বিছিয়ে ঘুমানো ছাড়া তার কোনো পথ রইল না।

গোবেচারা এই ছাত্রের নাম হুমায়ুন আহমেদ। তার ঘর তছনছ করার ঘটনার তদন্ত করতে এলেন হাউস টিউটর প্রফেসর এমরান (পদার্থবিদ্যার শিক্ষক)। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। ছাত্রদের প্রতি মমতার তার কোনো কমতি ছিল না।

স্যার আমাকে বললেন, কারা এই কাজ করেছে তাদের নাম বলো। কাগজে লিখে দাও। তদন্তে সত্যি প্রমাণিত হলে কঠিন শাস্তি হবে। হল থেকে বের করে দেওয়া হবে।

আমি নাম কাগজে লিখে স্যারের কাছে দিলাম।

তিনি নামের তালিকা পড়ে ঝিম ধরে গেলেন এবং বললেন, পলিটিকস ছেড়ে দাও। পলিটিকস করো বলেই এই ঘটনা ঘটেছে।

আমি বললাম, স্যার আমি পলিটিকস করি না।

এমরান স্যার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, আবার মিথ্যা কথা বলে বেয়াদপ ছেলে! সিট ক্যানসেল করে দেব। তুমি পলিটিকস করো না—তারা খামাখা তোমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমাকে তুমি কী ভাবে? আমি দুদু খাই?

স্যার নাম লেখা কাগজ আমার হাতে ফেরত দিয়ে চলে গেলেন।

সন্ত্রাসের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আগেও মাথা নিচু করে থাকতেন। এখনো থাকেন।

‘৬৮ এবং ‘৬৯-এর মাতাল হাওয়া আমার গায়ের ওপর দিয়ে গিয়েছে। কিছু অভিজ্ঞতা উপন্যাসের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে দেব। উপন্যাসের কাঠামো নির্মাণে এই বিষয়টা চলে না, তবে মাতাল হাওয়া কখনোই নিয়ম মানে না।

————–
(১) কর্তা খুশি রাখার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাকশাল করেন, তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক বাকশালে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নেন।

(২) আমি নিজে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র। থাকি মহসিন হলে। পাচপাত্তুরকে স্বচক্ষে দেখার জন্যে একদিন শহীদুল্লাহ হলে গিয়েছিলাম। পাচপাত্তুর বন্ধুদের নিয়ে নিজের ঘরে বসে গল্প করছিল। বন্ধুদের একজনের নাম খোকা। সেও দেখতে রাজপুত্রের মতো। খোকা ছিল দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। সে সঙ্গে জ্যান্ত সাপ নিয়ে ঘুরত। সাপ ব্যবহার করত সবাইকে ভয় দোনোর জন্যে। পকেটে থাকত পিস্তল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ