সঞ্জুর বিয়ের কার্ড ফরহাদ উদ্দিনের খুবই পছন্দ হয়েছে। রুপালি বর্ডার দেওয়া কার্ড। লেখাগুলি সবুজ। চিঠির ভাষাটাও সুন্দর। সালু মামা সুন্দর করে সব সাজিয়েছেন।

পরম করুণাময়ের নামে শুরু
 সুধী,
আসোলামু আলায়কুম। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি আমার একমাত্র পুত্র আশরাফ উদ্দিন সঞ্জুর শুভ বিবাহের তারিখ …


কার্ডের উল্টো পিঠে বরের পরিচয় কনের পরিচয়। বরযাত্রার সময়। এবং সবশেষে লেখা–
উপহার আনিবেন না। আপনার দোয়াই কাম্য।

সব কিছুই ঠিক আছে শুধু বিয়ের তারিখটা যেন কেমন। এই একটা জায়গায় খটকা। আর কোথাও কোনো খটকা নেই। তারিখের খটকাটা না থাকলে ফরহাদ উদ্দিন তার অফিসের কলিগদের সবাইকে একটা করে কার্ড দিতেন।

যে রিকশাওয়ালা তাকে চা বিসকিট খাইয়েছিল তাকে যে করেই হোক খুঁজে বের করে তাকেও একটা কার্ড দিতেন। আর একটা কার্ড পাঠাতেন অস্ট্রেলিয়ায়। বদরুল পাশাকেও একটা কার্ড পাঠাতেন। কার্ডের ওপরে লিখতেন বদরুল পাশা। ঠিকানার জায়গায় লিখতেন—ঠিকানা অজানা। তারপর সেই কার্ড পোস্টাফিসের বাক্সে ফেলে দিয়ে আসতেন। কার্ড বদরুলের কাছে পৌঁছত না। তাতে কী? মনের একটা শান্তি। মনের শান্তি খুবই জরুরি জিনিস।

সালু মামা বারবার বলে দিয়েছেন কার্ডগুলি লুকিয়ে রাখতে যেন কারো চোখে না পড়ে। ফরহাদউদ্দিন তাই করেছেন। সব কার্ড অফিসের ড্রয়ারে তালাবন্ধ আছে। একটা কার্ড শুধু আলাদা করে রেখেছেন। এই কার্ডটা পৌঁছাতে হবে। তিনি ঠিক করেছেন সঞ্জুকে সঙ্গে নিয়েই এই কার্ড পৌঁছাবেন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্ড বরকে সঙ্গে নিয়ে বিলি করতে হয়।

ফরহাদ উদ্দিন ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছেন। উদ্দেশ্যটা বলেন নি। ঘর থেকে বের হয়ে বলবেন।

বাবা ডেকেছ?

ফরহাদ উদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সঞ্জু হালকা হলুদ রঙের একটা শার্ট পরেছে। সার্টটায় তাকে এত মানিয়েছে। শার্টের হলুদ রঙের আভা পড়েছে চুলে। চুলগুলি মনে হচ্ছে সোনালি। ফরহাদ উদ্দিন গলা নামিয়ে বললেন, তোর বিয়ের কার্ড দেখেছিস? তারিখটা শুধু ইয়ে হয়ে গেল। আর সবই ভালো ছিল। হাতে নিয়ে দেখ।

সঞ্জু বিরক্ত মুখে বলল, কার্ড দেখার জন্য ডেকেছ? দেখার দরকার নেই।

নিজের বিয়ের কার্ড নিজে দেখবি না এটা কেমন কথা? তোর শ্বশুরের নামের বানানে ভুল ছিল। বদরুল পাশার জায়গায় লিখেছে বদরুল পাসা। আমি কলম দিয়ে ঠিক করে দিয়েছি।

সঞ্জু নিঃশ্বাস ফেলল। ফরহাদ উদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, চল যাই।

সঞ্জু বলল, কোথায় যাব?

জরুরি একটা কাজে যাব। খুবই জরুরি। যাব আর আসব। দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।

কোথায় যাবে বলো?

 এত কথা বলাবলির দরকার কী? বাবার সঙ্গে যাবি সমস্যা তো কিছু নেই।

দুপুরে আমার খুব জরুরি কাজ আছে বাবা।

আরে বোকা তোকে কী বললাম, দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।

ফরহাদ উদ্দিন ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। প্রথম গলিটা পার হয়ে দ্বিতীয় গলির মোড়ে থমকে দাঁড়ালেন। সঞ্জু বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, হাসনাত সাহেবের বাসায়।

কার বাসায়?

হাসনাত সাহেবের বাসায়। সানসাইন ভিডিওর মালিকের বাসায়।

কেন?

উনি তো আর বেঁচে নেই। উনার স্ত্রীর হাতে তোর বিয়ের একটা কার্ড দেব। হাসনাত সাহেব মারা না গেলে তো আর বিয়েটা হতো না। উনি মারা গেছেন বলেই তো সব জট পাকিয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে। ফাঁকতালে তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। একটা কার্ড তাদের প্রাপ্য।

সঞ্জু তীক্ষ্ণ চোখে বাবার দিকে তাকাল। ফরহাদ উদ্দিন বললেন, এটা একটা স্বাভাবিক ভদ্রতা। সৌজন্যবোধ। চল যাই।

ফরহাদ উদ্দিন ছেলের হাত ধরলেন। সঞ্জু বলল, বাবা তোমার মাথা যে এলোমেলো হয়ে গেছে এটা তুমি জানো?

ফরহাদ উদ্দিন বিস্মিত গলায় বললেন, মাথা এলোমেলো হবে কেন? স্মৃতি শক্তির সামান্য সমস্যা হচ্ছে। এটা ছাড়া মাথার বরং উন্নতি হয়েছে। এখন মাঝে মাঝে ঘ্রাণ পাচ্ছি। তুই সেন্ট মেখেছিস। তোর গা থেকে সেন্টের গন্ধ পাচ্ছি। এখন তুই খুব ঘামছিস এখন সেন্টের গন্ধ ছাপিয়ে ঘামের গন্ধ পাচ্ছি। তুই এত ঘামছিস কেন? ভয় পাচ্ছিস না-কি?

ভয় পাব কেন?

তুই তো খুবই ভয় পাচ্ছিস। ভয়ে তোর গলার স্বর পর্যন্ত বদলে গেছে।

 সঞ্জু বলল, বাবা হাত ছাড়।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তোর হাত আমি ছাড়ব না। হাসনাত সাহেবের স্ত্রীর কাছে আমি তোক নিয়ে যাব। তুই খুবই ভদ্রভাবে তাঁর হাতে কার্ডটা দিবি। এটা ছাড়া তোর গতিও নেই।

সঞ্জু বলল, গতি নেই মানে কী?

গতি নেই তার কারণ এখন আমার ইচ্ছামতো সব হবে।

কী বলছ হাবিজাবি!

ফরহাদ উদ্দিন অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললেন–তোকে বুঝিয়ে বলছি মন দিয়ে শোন। সত্যি কথা বলার যে সাধনাটা শুরু করেছিলাম সেটা কাজে লেগে গেছে। যা ইচ্ছা করছি তাই দেখি এখন হচ্ছে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো–প্রচণ্ড গরম পড়েছে, নাশতা হিসেবে পান্তা ভাত খেলে মন্দ হতো না। তারপর কী হয়েছে শোন—নাশতার টেবিলে গিয়ে বসেছি। রাহেলা বলল, গত রাতে মেয়েরা কেউ ভাত খায় নি। ভাতে পানি দিয়ে রেখেছি। ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে পান্তা খাবে? মজা করে পান্তা খেলাম।

সঞ্জু বলল, বাবা হাতটা একটু ছাড়। আমার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ফরহাদ উদ্দিন মনে হলো ছেলের কথা শুনতে পেলেন না। তিনি আগের কথার খেই ধরে নিজের মনে বলে যেতে লাগলেন—বুঝলি সঞ্জু, খুবই অবাক লাগছে। যেটা ইচ্ছা করছি তাই হচ্ছে। এই যে দেখ আমি ইচ্ছা করলাম তোকে নিয়ে হাসনাত সাহেবের স্ত্রীর কাছে যাব তাই কিন্তু যাচ্ছি। হাজার চেষ্টা করেও তুই এটা বন্ধ করতে পারবি না।

সঞ্জু বলল, বাবা তুমি হঠাৎ এটা কী শুরু করলে। চিনি না জানি না তাকে বিয়ের কার্ড দিতে যাব কেন?

হাসনাত সাহেবের স্ত্রীকে না চিনলেও হাসনাত সাহেবকে তো চিনিস।

আমি তোমাকে বলেছি হাসনাত নামের কাউকে আমি চিনি না। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?

আগে বিশ্বাস করেছিলাম এখন করছি না। সত্য কথা বলার সাধনার আরেকটা উপকারিতা হলো—কেউ তখন আমার সঙ্গে মিথ্যা বললে আমি ধরে ফেলতে পারি। তোর কোনো উপায় নেই সঞ্জু। তোকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে।

সঞ্জু বাবার চোখের দিকে তাকাল। ফরহাদ উদ্দিনের মুখ শান্ত। উত্তেজনাহীন সহজ স্বাভাবিক মুখ। তিনি প্রায় অস্পষ্ট শব্দে বিড়বিড় করেও কী যেন বললেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে অভয়দানের মতো করে হাসলেন। সঞ্জু বলল, বাবা একটা রিকশা ভকি। আমাকে থানায় নিয়ে চল। আমি সব স্বীকার করব। আর হাতটা ছাড় বাবা—ব্যথা পাচ্ছি।

ফরহাদ উদ্দিন ছেলের হাত ছেড়ে দিলেন।

.

আকাশে ঝলমলে রোদ।

রোদ গায়ে লাগছে না, কারণ প্রচুর বাতাস। বাতাসে সঙ্গুর চুল উড়ছে। রোদ পড়ায় চুলগুলি এখন আরো সোনালি লাগছে। ফরহাদ উদ্দিন যতটা সম্ভব এক পাশে সরে বসেছেন। গরমের সময় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলে সঞ্জুর ভালো লাগে না।

সঞ্জু বলল, বাবা ঠিকমতো বস তো। এরকম হেলে বসে আছ কেন?

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, গায়ের সঙ্গে গা লাগলে তোর তো আবার গরম লাগে।

সঞ্জু বলল, তুমি আরাম করে বোস। আমার গরম লাগছে না।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, এ জার্নি বাই রিকশা কেমন লাগছেরে ব্যাটা?

 সঞ্জু জবাব দিল না। হাসল। ফরহাদ উদ্দিনের খুব ইচ্ছা করছে ছেলের হাত ধরতে। সাহসে কুলুচ্ছে না। গায়ে হাত দিলে সঞ্জু খুব রাগ করে। ফরহাদ উদ্দিনকে অবাক করে দিয়ে সঞ্জু বাবার হাত ধরল।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, একটা ধাঁধা তোকে জিজ্ঞেস করছি। দেখি জবাব দিতে পারিস কিনা–

আকাশে জন্মে কন্যা
পাতালে মরে
হাত দিয়া ধরতে গেলে
ছটর ফটর করে।

সঞ্জু বলল উত্তর জানিনা বাবা।

তোর মা রোজ ধাঁধা জিজ্ঞেস করত। আমি কোনোটার উত্তর দিতে পারি নি। সে নিজেও উত্তর দিত না। উত্তর জিজ্ঞেস করলে হাসত। আমি করতাম রাগ।

সঞ্জু বলল, বাবা আমার ধারণা মা উত্তর জানত না। নিজে বানিয়ে বানিয়ে ধাঁধা বলত–যার কোনো উত্তর নেই।

হতেপারে। আমি এইভাবে চিন্তা করিনি।

সঞ্জু বলল, কাঁদছ কেন বাবা? কাঁদবে না।

 ফরহাদ উদ্দিন চোখের পানি মুছে ফেলতে চাচ্ছেন। কিন্তু পারছেন না। তার ডান হাত সঞ্জু ধরে আছে। চোখের পানি মুছতে হলে বাঁ হাত দিয়ে মুছতে হয়। বাঁ হাত দিয়ে চোখের পানি মুছা খুবই অমঙ্গলজনক। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রিকশা করে যাচ্ছেন এমন মঙ্গলময় মুহূর্তে অমঙ্গল হয় এমন কাজ করা সম্ভব না।

সঞ্জু বলল, বাবা তোমার সত্য সাধনা কবে যেন শেষ হবে।

ফরহাদ উদ্দিন আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বেশি বাকি নেই। ডিসেম্বরের তিন তারিখ।

.

খুবই কাকতালীয় ভাবে সঞ্জুর ফাসি হয় ডিসেম্বরের তিন তারিখ।

ফরহার উদ্দিন অপেক্ষা করতে থাকেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সামনে। ছেলের ডেডবডি তাকে দিয়ে দেয়া হবে ভোর ছটায়। তিনি ডেডবডি নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের একটা গাড়িকে খবর দেয়া আছে। সেই গাড়ি এখনো আসেনি। গাড়ি না এলে ডেডবডি নেয়া সমস্যা হবে।

সেদিন গাঢ় কুয়াশা পড়েছিল। এমন কুয়াশায় চারদিকের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সূর্য অনেক আগেই উঠে গেছে কিন্তু সূর্যের কোনো আলো শহরে এসে ঢুকছে না, বরং কুয়াশা গাঢ় হচ্ছে। খুব কাছের মানুষকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো দূরে কাকে যেন দেখা যাচ্ছে। হাঁটার ভঙ্গিটা বদরুল পাশার মতো। লম্বা একজন মানুষ হাত দুলিয়ে দুলিয়ে বদরুলের মতোই হাঁটছে। আজ তাঁর ইচ্ছা পূরণের দিন। বদরুলের সঙ্গে আবার যেন দেখা হয় এই ইচ্ছাটা কি পূর্ণ হতে যাচ্ছে?

ফরহাদ উদ্দিন দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। যে আসছে সে আসুক। মানুষটা যদি বদরুল হয় ভালোই হয়। ডেডবডি বাড়িতে নিয়ে যাবার মতো ঝামেলার কাজে সে সাহায্য করতে পারে। আর বদরুল না হলেও কোনো ক্ষতি নেই।

ছ’টা বেজে গেছে। জেলখানার মূল ফটক খোলার শব্দ হচ্ছে। মনে হয় এরা এখন সঞ্জুকে নিয়ে আসছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ