হাসাহাসির শব্দে ফরহাদ উদ্দিনের ঘুম ভাঙল।

তিনি অনুভব করলেন সারা বাড়িতে আজ তুমুল উত্তেজনা। মেয়েরা ছোটাছুটি করছে। একজন দরজায় ধাক্কা খেয়েছে, ব্যথা পেয়েও হাসছে। তুমুল আনন্দের মুহূর্তে শারীরিক ব্যথা-বেদনাও আনন্দময় মনে হয়।

বিরাট আনন্দের কিছু ঘটেছে। কী ঘটেছে তিনি অনুমান করার চেষ্টা করলেন। অনুমান করা গেল না। বালিশের নিচে রাখা হাতঘড়িতে সময় দেখলেন—এগারোটা দশ। তাঁর আঁতকে উঠার কথা। অফিস শুরু হয় নটায়। কোনো কারণ ছাড়াই অফিস কামাই হলো। কিন্তু তিনি আঁতকে উঠলেন না, যে ভাবে শুয়ে ছিলেন সেই ভাবেই শুয়ে রইলেন।

মেয়েরা হাসছে। ছোটাছুটি করছে। শুনতে ভালো লাগছে। তবে শরীর ক্লান্ত। কাল সারা রাত জেগে ছিলেন। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি এখনো কাটছে না। তবে একটা ভালো কাজ হয়েছে—সকালের আলোয় মনে হচ্ছে গত রাতটা জেগে কাটানোর কোনো কারণ ছিল না। ভুল বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা। ইস্তিয়াক সঞ্জুকে চিনে না। তিনি চেনেন।

ফরহাদ উদ্দিন বিছানা থেকে নেমে দরজা খুললেন। রাহেলা বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন। তিনি চায়ের কাপ হাতে উঠে এলেন। রাহেলার মুখ হাসি হাসি। আনন্দময় যে ঘটনায় বাড়ির সবাই উল্লসিত সে ঘটনায় রাহেলারও ভূমিকা আছে। ঘটনাটা কী হতে পারে?

তোমার ঘুম শেষ পর্যন্ত ভাঙল? কতবার যে দরজা ধাক্কানো হয়েছে। ঘটনা কী বলো তো? অফিসও তো মিস করেছ! সেতু বলল তুমি সারা রাত ঘুমাও নি। সে রাত চারটার সময় ঘুম ভেঙে পানি খেতে খাবার ঘরে এসে দেখে তুমি বারান্দায় বসে আছ।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, শরীরটা একটু খারাপ।

শরীর খারাপ সে তো তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমার মনে হয় ডায়াবেটিস আরো বেড়েছে। ব্লাড সুগারটা আরেকবার দেখাও। এক কাজ কর, আজ যখন অফিসে যাও নি–আজই যাও।

দেখি।

মিতু বাবাকে দেখতে পেয়ে দূর থেকে নাকি গলায় বলল, বাবা চা খাবে? চা বানিয়ে আঁনব?

ফরহাদ উদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, এই মেয়ে নাকি গলায় কথা বলছে। কেন?

রাহেলা মুখের হাসি চাপতে চাপতে বললেন, সেতুর যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে নাকি নাকে কথা বলে। এই জন্যে সবাই নাকে কথা বলা প্র্যাকটিস করছে।

নাকে কথা বলে?

আরে না, নাকে কথা বলবে কী জন্যে? তোমার মেয়েরা হয়েছে জগতের ফাজিল। সবকিছু নিয়ে ফাজলামি করে।

সেতুর ছেলে পছন্দ হয়েছে?

মুখে বলছে ছেলে পছন্দ হয় নি। নাকে কথা বলে কাজেই ভূত-টাইপ ছেলে। আমার ধারণা খুবই পছন্দ। দশটার সময় ছেলের টেলিফোন এসেছে। সেতু এখনো কথা বলছে।

বিয়ে কবে?

বিয়ে কবে সেটা তো তুমি ঠিক করবে। তুমি মেয়ের বাবা। সবকিছু আমি ঠিক করব নাকি?

.

নীতু বারান্দায় ছুটে এসে মাকে বলল, মা সেঁতু আঁপা এতক্ষণ আঁপনি আঁপনি করে কথা বলছিল। এখন উঁমি তুমি করে বঁলছে। এসো, শুনে যাও। কী যে হাস্যকর লাগছে।

রাহেলা বললেন, তোরা শোন, আমি কী শুনব?

আঁড়াল থেকে শুনবে। খুব মজা পাবে।

নীতু এসে মায়ের হাত ধরে টানছে। রাহেলা এমনভাবে এগুচ্ছেন যেন নিতান্তই অনিচ্ছায় যাচ্ছেন। অথচ তাঁর চোখে মুখে আগ্রহ ফেটে বের হচ্ছে।

ফরহাদ উদ্দিন শাস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তার কাছে মনে হলো সংসার অতি সুখের জায়গা। যে-কোনো মূল্যে এই সংসার টিকিয়ে রাখতে হয়। রাহেলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফিরে আসছেন। ফরহাদ উদ্দিনের হঠাৎ ইচ্ছা করল মেয়েদের মতো নাকি সুরে কথা বলে রাহেলাকে চমকে দেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি যদি বলেন–কী হয়েছে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাঁসছ কেন? তাহলে কেমন হয়? না, ভালো হয় না। মেয়ে-জামাইকে নিয়ে রসিকতা করা যায় না।

রাহেলা বললেন, কী হয়েছে, এমন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? হাত মুখ ধুয়ে এসো নাশতা খাই। আমি তোমার জন্যে এখনো নাশতা খাই নি।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, কনক কোথায়?

কনক কলেজে গেছে। ওর পরীক্ষার রুটিন দিবে।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আজ যখন অফিস মাটিই হলো তখন এক কাজ করা যায়। চল আমরা সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় যাই।

কখন যাবে?

এখন চল।

সেতু বলছিল তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে—এখন তো মনে হচ্ছে আসলেই তাই। দুপুরের এই রোদে কেউ চিড়িয়াখানায় যায়। আর তোমার মেয়েদের কি এখন চিড়িয়াখানায় যাবার বয়স আছে? বরং এক কাজ কর—চল রাতে সবাইকে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যাই।

চল যাই।

ছেলেটাকেও খেতে বলি। তুমি তো তাকে দেখ নি। দেখবে, কথা কথা বলবে।

আচ্ছা বলো।

রাহেলা অনিন্দিত ভঙ্গিতে এই খবর বড় মেয়েকে দিতে গেলেন আর তখনই ফরহাদ উদ্দিনের মনে পড়ল আজ তার দুলিদের বাসায় যাবার কথা। ইস্তিয়াক কী যেন বলবে। দুলি তাকে বাইম মাছ খাবার দাওয়াত দিয়েছে। ভালো ঝামেলা হয়ে গেল।

ফরহাদ উদ্দিন ঠিক করলেন—সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ও বাড়িতে যাবেন। আধ ঘণ্টাখানিক থেকে চলে আসবেন। দুলিকে বলবেন মাছের তরকারিটা ফ্রিজে রেখে দিতে। পরে কোনো একদিন এসে খেয়ে যাবেন। দুলিকে বিষয়টা বুঝিয়ে বললে সে বুঝবে। দুলি অবুঝ মেয়ে না।

.

সঞ্জুর ঘরের দরজা খোলা। চায়ের কাপ নিয়ে ফরহাদ উদ্দিন ছেলের ঘরের দিকে এগোলেন। তাঁর কাছে মনে হলো হঠাৎ করে অফিস বাদ দিয়ে ভালোই হয়েছে কাজের দিনের সংসারের স্বাদটা পাওয়া যাচ্ছে। ছুটির দিনের সংসার এক রকম আবার কাজের দিনের সংসার আরেক রকম।

কী করছিস সঞ্জু? বলতে বলতে ফরহাদ উদ্দিন ছেলের ঘরে ঢুকে পড়লেন। সঞ্জু সিগারেট টানছিল। জানালা দিয়ে সিগারেট ফেলে দিয়ে বাবার দিকে তাকাল। কিছু বলল না। তার হাতে কালো রঙের বড় একটা হ্যান্ডব্যাগ। সে হ্যান্ডব্যাগে কাপড় রাখছে। ফরহাদ উদ্দিনের সামান্য মন খারাপ হলো। ছেলেটা আরাম করে সিগারেট খাচ্ছিল—বাবাকে দেখে ফেলে দিতে হলো।

যাচ্ছিস নাকি কোথাও?

হুঁ।

কোথায় যাচ্ছিস?

কোলকাতা যাব।

তোর তো ভাইবা বাকি আছে।

ভাইবার এখনো ডেট হয় নি।

হঠাৎ কোলকাতা যাচ্ছিস কেন?

সঞ্জু জবাব দিল না। ছেলেকে নিয়ে এই সমস্যা—একবার প্রশ্ন করলে জবাব পাওয়া যায় না। একই প্রশ্ন দুবার তিনবার করতে হয়।

তোর মামা বলছিল তোক নিয়ে তার বাসায় যেতে। তোর সঙ্গে কী নাকি জরুরি কথা।

সঞ্জু বিরক্ত মুখে বলল, তোমাকে তো একবার বলেছি যাব না।

আচ্ছা ঠিক আছে, যেতে না চাইলে যাবি না। কোলকাতা কখন যাচ্ছিস?

রাত নটায় বাস ছাড়ে।

টাকা পয়সা লাগবে?

না।

বিদেশে যাচ্ছিস, হাতে কিছু টাকা পয়সা তো থাকা দরকার।

সঞ্জু জবাব দিল না। তার ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে। সে বাবার সামনের চেয়ারে বসল। টেবিলে পিরিচ দিয়ে ঢাকা চায়ের কাপ। সে চায়ে চুমুক দিল। পুরো ব্যাপারটা ফরহাদ উদ্দিন খুব আগ্রহ করে দেখলেন। পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ আগে চোখে পড়ে নি। বাপ ছেলে দুজনে এক সঙ্গে চা খাচ্ছে। এই ব্যাপারটা তার ভালো লাগছে। ফরহাদ উদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন–তোর বেড়াতে ভালো লাগে?

সঞ্জু জবাব দিল না। বাবার দিকে তাকালও না। মাথা নিচু করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। ফরহাদ উদ্দিন আনন্দিত গলায় বললেন—বেড়ানোর শখ ছিল আমার বন্ধু বদরুলের। সারাক্ষণ নানান প্ল্যান প্রোগ্রাম–অমুক জায়গায় যাবে তমুক জায়গায় যাবে। একবার তো তার পাল্লায় পড়ে বিনা পাসপোর্টে আগরতলা চলে যাচ্ছিলাম। ত্রিপুরার মহারাজার বাড়ি দেখবে। সে এক ইতিহাস,..

ফরহাদ উদ্দিন দীর্ঘ ইতিহাস বলতে পারলেন না। সঞ্জু তার আগেই উঠে দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল, আমি এখন বের হবো।

তোর কোলকাতা রওনা হবার আগে আমার সঙ্গে দেখা হবে না? আমাকে আবার সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ইস্তিয়াকের ওখানে যেতে হবে। দুলি আমার জন্য বাইম মাছ রান্না করবে। দুলিদের ওখানে খাওয়া যাবে না। রাতে বাসার সবাই বাইরে খেতে যাচ্ছে। তুই থাকলে ভালো হতো। পারিবারিক অনুষ্ঠানে সবার উপস্থিত থাকা দরকার।

চায়ের কাপ হাতে ফরহাদ উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। সঞ্জু মনে হয় বিরক্ত হচ্ছে। তিনি ঘরে বসে আছেন বলে সে বের হতে পারছে না। সে বাইরে গেলে ঘর তালা দিয়ে যায়।

সঞ্জু বলল, বাবা কোলকাতা থেকে তোমার জন্য কী আনব?

ফরহাদ উদ্দিনের মনটা আনন্দে ভরে গেল। ছেলে এখনো বাইরে যায় নি। কিন্তু চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে কার জন্য কী আনবে। এরই নাম মায়া। মানুষ যেখানেই থাকুক তার মন পড়ে থাকে সংসারে। ফরহাদ উদ্দিন গাঢ় স্বরে বললেন, কিছু আনতে হবে না রে ব্যাটা। তুই ভালোমতো থাকিস। রোদে বেশি ঘোরাঘুরি করবি না। কোলকাতা শহরের রোদ খুবই কড়া—এক ঘণ্টায় চামড়া কালো করে ফেলে। আমাদের অফিসের হাবীবুর রহমান সাহেবের কাছে। শুনেছি।

সারাটা দিন ফরহাদ উদ্দিনের খুব আনন্দে কাটল। তাড়াহুড়া করে পত্রিকা পড়তে হলো না। আরাম করে বিছানায় আধশোয়া হয়ে পত্রিকা পড়লেন। আজকাল সব পত্রিকার সঙ্গেই একটা করে ম্যাগাজিন থাকে। ম্যাগাজিন পড়েও আনন্দ পেলেন। একটু পর পর কনক এসে জিজ্ঞেস করছে, চাচাজি চা খাবেন? তিনি চা খান না, তারপরেও দুপুর বারোটার মধ্যে তিন কাপ চা খেয়ে ফেললেন।

কনক মেয়েটা অন্যদের মতো না। সে চায়ের কাপ রেখেই চলে যায় না। যতক্ষণ চা খাওয়া না হয় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তখন তার সঙ্গে গল্পগুজব করা যায়। কনকের এই স্বভাবটা আগে লক্ষ করলে তিনি ঘন ঘন চা দিতে বলতেন।

ফরহাদ উদ্দিন চা খেতে খেতে অনেক গল্প করলেন। সব গল্পই সামান্য উদ্দেশ্যমূলক। আকারে ইঙ্গিতে সঞ্জুর প্রশংসা। এই মেয়েটার মন সঞ্জুর প্রতি কৌতূহলী করার সূক্ষ্ম চেষ্টা।

বুঝলে মা, সঞ্জুর সঙ্গে তোমার স্বভাবের বেশকিছু মিল আছে। মিলগুলো তুমি লক্ষ করেছ?

না।

একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের মিল-অমিল লক্ষ করতে হয়। এতে অনেক কিছু শেখা যায়। সঞ্জুর সঙ্গে তোমার মিলগুলো হলো—সঞ্জু কথা কম বলে। তুমিও কথা কম বলো। সঞ্জু শান্ত, তুমিও শান্ত। সঞ্জুর সঙ্গে তোমার বাবারও বেশকিছু মিল আছে। সঞ্জু বেড়াতে পছন্দ করে, তোমার বাবাও বেড়াতে পছন্দ করত। আজ এখানে কাল ওখানে। তোমার বাবার পাল্লায় পড়ে একবার যে পাসপোর্ট ছাড়া প্রায় আগরতলা চলে গিয়েছিলাম সেই গল্প বলেছি?

না।

গল্প না, যাকে বলে ইতিহাস। প্রথম গেলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বদরুল করল কী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানা থেকে আমার আর তার নামে দু’টা পারমিট বের করল। সেখানে লেখা আমাদের দুজনের দু’টা গাই গরু সীমান্ত অতিক্রম করে চলে গেছে। গরু দু’টা খুঁজে আনার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে থাকার পারমিট। স্থানীয় ভাষায় এর নাম গরু পাসপোর্ট। আমার তো সাহস কম। আমি বদরুলকে বললাম—গরু পাসপোর্ট নিয়ে আমি যাব না। বদরুল রাগ করে আমাকে ফেলে একাই চলে গেল। তার চলে আসার কথা সন্ধ্যার মধ্যে, ফিরল আট দিন পরে। সে ত্রিপুরা মহারাজার বাড়ি, নীর মহল, আরো কী সব হাবিজাবি দেখে এসেছে। এদিকে টেনশানে আমার প্রথমে হয়েছে ডায়রিয়া, তারপর হয়ে গেল রক্ত আমাশা। সঞ্জুরও এরকম অভ্যাস আছে। কাউকে কিছু না বলে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে চলে গেল। একবার ছয়দিন তার কোনো খোঁজ নেই। দরজা তালাবন্ধ করে চলে গেছে, কাউকে কিছু বলেও যায় নি। সেবারও টেনশানে আমার ডায়রিয়া হয়ে গেল। ডায়রিয়া থেকে রক্ত আমাশা। এই আমার এক সমস্যা।

দুপুরে খাবার পর ফরহাদ উদ্দিন খুবই আরাম করে ঘুমুলেন। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায় সন্ধ্যায়। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে তাদের খাবার কথা রাত নটায়। হাতে সময় আছে। তিনি ইস্তিয়াকের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। এখন বাজে ছটা। যেতে আসতে এক ঘণ্টা। তিনি থাকবেন আধঘণ্টা। সাড়ে সাতটার মধ্যে ফিরে আসবেন।

ঘর থেকে বেরুবার মুখে রাহেলার সঙ্গে দেখা। রাহেলা অবাক হয়ে বললেন, এখন বের হচ্ছে কোথায়? রাতের দাওয়াতের কথা মনে আছে?

ফরহাদ উদ্দিন হাসিমুখে বললেন, মনে আছে। সাড়ে সাতটার মধ্যে ফিরব।

রাস্তায় যদি বেলি ফুলের মালা পাও আমার জন্য নিয়ে এসো। বেলি ফুল পাওয়া যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমি চোখে দেখলাম না।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তুমি আগেও বলেছিলে—মনে ছিল না। আজ অবশ্যই নিয়ে আসব।

.

ইস্তিয়াক বিস্মিত হয়ে বলল, আপনাকে বলেছিলাম সঞ্জুকে নিয়ে আসতে, ও কোথায়?

ও গেছে কোলকাতায়। বিকেল পাঁচটায় ফ্লাইট। চারটায় ছিল রিপোর্টিং। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম ওকে এয়ারপোর্টে তুলে দিয়ে আসব। যত কাছেই হোক বিদেশ যাত্রা।

আসবে কবে?

আসবে কবে তাতো জানি না। তবে বেশিদিন থাকবে না—তার ভাইবা বাকি আছে। পড়াশোনার ব্যাপারে এই ছেলে আবার খুবই সিরিয়াস।

ইস্তিয়াকের ভুরু কুঁচকে আছে। মানুষটাকে সামান্য বিরক্ত মনে হচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিন ইস্তিয়াকের বিরক্তির কারণ ধরতে পারছেন না। সঞ্জুকে আনা হয় নি—বিরক্তি কি এই কারণেই? আজ আসে নি, অন্য আরেক দিন আসবে।

ইস্তিয়াক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, দুলাভাই আপনাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন? মনে হচ্ছে আপনি খুবই আনন্দিত।

আমি বেশির ভাগ সময় আনন্দেই থাকি। অফিসেও এখন ঝামেলা কম। ও আচ্ছা, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি—আমার দুনম্বর মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলের সবই ভালো। একটু বোধহয় নাকে কথা বলে। এটা কোন সমস্যা না। মেয়ের ছেলেকে পছন্দ—এটাই বড় কথা।

ভালো তো।

আমার অবশ্যি ইচ্ছা ছিল প্রথমে সঞ্জুর বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনব, তারপর মেয়ে বিয়ে দেব। সেটা আর হলো না। সঞ্জু চাকরি বাকরি ঠিক না করলে তার বিয়ে দেয়া ঠিক না। তুমি কী বলো?

ইস্তিয়াক জবাব না দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাল। ফরহাদ উদ্দিন তাকিয়ে থাকলেন। তিনি তার সামনে বসে থাকা গম্ভীর চেহারার এই মানুষটাকে ছোটবেলায় দেখেছেন। লাজুক ধরনের ছেলে ছিল। একবার তাকে এসে বলল, দুলাভাই দড়ি কাটার একটা ম্যাজিক দেখবেন? দড়ি কেটে জোড়া লাগিয়ে দেব।

তিনি হ্যা বলার আগেই সে দড়ি কেটে জোড়া লাগিয়ে ফেলল। তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এরকম আশ্চর্য ম্যাজিক তিনি জীবনে কমই দেখেছেন। সেই ছেলে আজ গম্ভীর মুখে সামনে বসে আছে। একটার পর একটা সিগারেট টানছে। পুলিশের বড় অফিসার ভাবটা চেহারাতে চলে এসেছে। কারণ ফরহাদ উদ্দিনের তাকিয়ে থাকতে কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। অথচ ভয় লাগার কিছু নেই। ইস্তিয়াক তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। অনেকদিন যোগাযোগ নেই, তাতে কী হয়েছে! আত্মীয় মানে আত্মীয়। ইস্তিয়াকের পরনে পুলিশের পোশাকও নেই যে ভয় লাগবে। লুঙ্গির উপর একটা গেঞ্জি পরেছে। পুলিশের অফিসার লুঙ্গি পরে বসে আছে ভাবতে জানি কেমন লাগছে।

ইস্তিয়াক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, সঞ্জু যে বিরাট এক ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে এটা বলার জন্যেই তাকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। সঞ্জুর এক বন্ধু, তার নাম টগর। সে পুলিশের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছে। সেখানে সঞ্জুর নাম আছে।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, হাসনাত সাহেবকে নিয়ে কোনো ঝামেলা? সঞ্জু হাসনাত সাহেবের সঙ্গে কী গণ্ডগোল করেছে আমি জানি না। তবে আমার ধারণা তুমি একটা ভুল করছ। হাসনাতকে সে চিনে না। টগর নামের যে ছেলেটা সঞ্জুর কথা বলেছে সে অন্য কোনো সঞ্জুর কথা বলেছে। ঢাকা শহরে অনেক সঞ্জু আছে। আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন আমার সঙ্গে আরো দুইজন ফরহাদ পড়ত। এক ক্লাসে তিন ফরহাদ। ভেবে দেখ কী অবস্থা! আমাদের তিনজনকে আলাদা করার জন্যে ছাত্ররা আমাদের কী ডাকত জানো? একজনকে ডাকত বে ফরহাদ! বে ফরহাদ মানে বেকুব ফরহাদ। আরেকজনের নাম ছিল বু ফরহাদ। বু ফরহাদ মানে বুদ্ধিমান ফরহাদ। আর থার্ডজনের গু ফরহাদ। ওর মুখ থেকে খুব দুর্গন্ধ আসত বলে ওর নাম হয়ে গেল গু ফরহাদ। মুখে গু ফরহাদ বলতে খারাপ লাগে বলে আমরা বলতাম G ফরহাদ। G হলো গু।

ফরহাদ উদ্দিন শরীর দুলিয়ে হাসছেন। ইস্তিয়াকের মুখে হাসি নেই। ফরহাদ উদ্দিন খুবই অবাক হয়ে দেখলেন–ইস্তিয়াকেরও কপালের মাঝখানের দু’টা রগ ফুলে উঠেছে।

কপালের রগ ফুলানোর এই ব্যাপারটা সঞ্জু নিশ্চয়ই তার মামাদের কাছ থেকে পেয়েছে। ছেলেমেয়েরা মামাদের দিকগুলি বেশি পায়।

দুলাভাই, আপনি মন দিয়ে আমার কথা শুনুন।

মন দিয়েই তো শুনছি।

যতটুকু মন দিয়ে শুনছেন তার চেয়েও একটু বেশি মন দিন। হাসনাত নামের এক ভিডিও ব্যবসায়ী খুন হয়েছে। যে তিনজন মিলে তাকে খুন করেছে সেই তিনজনের একজন সঞ্জু।

ফরহাদ উদ্দিন তাকিয়ে আছেন। তিনি ইস্তিয়াকের কথা শুনতে পাচ্ছেন। আবার একই সঙ্গে আরো একজনের কথা শুনতে পাচ্ছেন, তবে বুঝতে পারছেন না কারণ সে বিড়বিড় করছে। ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো তার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাথা পুরোপুরি খারাপ হবার আগে মাথার ভেতর নানান রকম শব্দ হয়।

ইস্তিয়াক ঝুঁকে এসে বলল—ভালো করে মনে করে দেখুন এপ্রিল মাসের নয় তারিখ থেকে তের তারিখ পর্যন্ত সে বাড়িতে ছিল না। মোট পাঁচ দিন। মনে পড়েছে?

ফরহাদ উদ্দিন হা-সূচক মাথা নাড়লেন।

ফরহাদ উদ্দিন বিড়বিড় করে বললেন, আমি তোমার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। সঞ্জু তো হাসনাত নামের কাউকে চিনেই না। হাসনাতের নাম শুনে সে আকাশ থেকে পড়েছে।

ইস্তিয়াক বিরক্ত গলায় বলল, দুলাভাই আপনি বোকা নাকি বোকার ভান করছেন এটা বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা আপনি ভান করছেন। ভানে কাজ দেবে না। বাস্তব চিন্তা করতে হবে। সঞ্জু লুকিয়ে কোলকাতায় বসে আছে। কত দিন সে ওখানে থাকবে—এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, এক বছর! তাকে তো দেশে আসতে হবে। দেশে এলেই এরেস্ট হবে। আর যদি তার অনুপস্থিতিতে মামলা চলে তাহলে ডেথ পেনাল্টি তো হবেই। ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।

ফরহাদ উদ্দিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ইস্তিয়াকের কোনো কথাই এখন তাঁর মাথায় ঢুকছে না। এখন মনে হচ্ছে ইস্তিয়াক ফিসফিস করে কথা বলছে। বেশির ভাগ কথাই শব্দহীন। ঠোঁট নড়ছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। তাঁর নিজের মাথাও এখন সামান্য দুলছে। এটা হচ্ছে সিগারেটের গন্ধে। সিগারেটের ধোয়া তার সহ্য হয় না। অথচ একটা লোক তার সামনে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে।

আপনি ভেঙে পড়বেন না। আমি আছি, আমার যা করার আমি করব। ব্যাপারটা জানাজানি হতে দেয়া যাবে না। এরেস্ট হয়ে কোর্ট কাছারি হয়ে ছাড়া পাওয়া এক কথা আর একেবারেই জানাজানি হওয়া আরেক কথা। বুঝতে পারছেন কী বলছি?

পারছি।

কাজেই শুরুতেই টাকা দরকার। ভালো এমাউন্টের টাকা দরকার।

ও আচ্ছা।

পুলিশের যে অফিসার এই কেইসটা ইনভেস্টিগেট করছে তাকে আমি সঞ্জুর কথা বলেছি। উনার নাম মকবুল হোসেন। ডিবির পুলিশ ইন্সপেক্টর। কেইসটা চলে গেছে ডিবিতে মকবুলকে বলা হয়েছে। ফাইনাল রিপোর্টে যেন সঞ্জুর নাম না যায়।

ফাইনাল রিপোর্টটা কী?

ফাইনাল রিপোর্ট হলো পুলিশ তদন্ত করে একটা চার্জশিট দেয়। মকবুল কাজটা করবে। তবে তাকে আলাদা করে টাকা দিতে হবে। কোনো উপায় নেই। ছয় সাত লাখ টাকা খরচ হবে। ঘটনাটা কী ঘটেছিল শুনতে চান?

কী ঘটনা?

 হাসনাতের খুন হবার ঘটনা। এরা তিনজনে মিলে কাজটা কীভাবে করল।

ফরহাদ উদ্দিন কিছু বললেন না। এখন তার পেটে মোচড় দিচ্ছে। নিঃশ্বাসেও সামান্য কষ্ট হচ্ছে। মাথায় পানি ঢালতে পারলে ভালো হতো।

দুলাভাই, মন দিয়ে শুনুন কী ঘটনা। হাসনাতের ভালো নাম মোহাম্মদ আবুল হাসনাত। আপনাদের বাড়ির কাছেই তার ক্যাবল কানেকশনের অফিস আছে—নাম হোম ভিডিও। তার একটা ভিডিওর দোকানও আছে, সেটার নাম সানসাইন ভিডিও। এটাও আপনাদের বাড়ির কাছে। অফিসে যেতে আসতে নিশ্চয়ই দেখেছেন। সঞ্জু প্রায়ই ভাড়া করে ভিডিওর দোকান থেকে ক্যাসেট আনত। সেই সূত্রে ভিডিওর দোকানের মালিকের সঙ্গে তার ভালো পরিচয়। হাসনাতকে সে ডাকত হাসনাত ভাই। মাঝে মাঝে সে আর তার দুই বন্ধু মিলে হাসনাতের বাসায় আড্ডা দিত। মদ টদ খেত।

কী খেত?

মদ ফেনসিডিল এইসব খেত। ঘটনার দিন সকালবেলা সঞ্জু টেলিফোন করে হাসনাতকে দোকান থেকে বের করে নিয়ে এলো…

ফরহাদ উদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আরেকদিন শুনব। তাছাড়া আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। যে ছেলেটার সঙ্গে সেতুর বিয়ে হচ্ছে তাকে নিয়ে আমরা বাইরে কোথাও খেতে যাব।

ইস্তিয়াক বলল, আমার তো মনে হয় আপনার এখনই শোনা উচিত। রিয়েলিটি ফেস করতে হবে। হবে না?

হুঁ।

আপনার যে একজন মামা ছিলেন, ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ সালু মামা। উনাকে অফিসে ডেকে এনেছিলাম, তিনি পুরো ঘটনা জানেন।

ও।

তার সঙ্গে সব কথা হয়েছে। আমাদের প্ল্যান অব একশান কী হবে সেটাও আলাপ হয়েছে। প্রথম কথা, ছেলেকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে হবে। দ্বিতীয় কথা, জানাজানি করা যাবে না। আপনার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?

হুঁ।

তাহলে থাক। আমাকে আবার একটু বেরুতে হবে। আপনি খাওয়া-দাওয়া করে যাবেন না? দুলি আপনার জন্যে বাইম মাছ আনিয়েছে। দুলি হাসনাতের পুরো ব্যাপারটা জানে। আপনি ওর কাছ থেকেও জেনে নিতে পারেন।

ফরহাদ উদ্দিন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। অদ্ভুত ঘটনা ইস্তিয়াক কী বলছে এখন তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। বিদেশী কোনো ভাষায় কথা বললে যেমন ক্যাচ কাঁচ শব্দ মাঝে শোনা যায় সেরকম শোনা যাচ্ছে।

ইস্তিয়াক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো তার বুকের ওপর থেকে বড় একটা চাপ নেমে গেছে। এতক্ষণ কেউ একটা পাথর বসিয়ে রেখেছিল। ইস্তিয়াক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন পাথরটা সরাল। ফরহাদ উদ্দিন পা উঠিয়ে চেয়ারে বসে রইলেন। দুলি যখন এসে বলল, দুলাভাই খেতে আসুন—তিনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। আজ রাত আটটায় তার যে সবাইকে নিয়ে খেতে যাবার কথা তা আর মনে রইল না। হঠাৎ তাঁর মনে হলো, প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। ক্ষিধেয় পেটের ভেতর মোচড় দিচ্ছে।

দুলি অনেক কিছু রান্না করেছে। কাঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকি মাছ, বাইম মাছের ঝোল, চেপা ভর্তা, কুমড়া ফুলের বড়া। খেতে বসে ফরহাদ উদ্দিনের মন ভালো হয়ে গেল। কুমড়া ফুলের বড়া সেই কবে ছেলেবেলায় খেয়েছিলেন আর খাওয়া হয়নি। দুলি বলল, আজ সব স্পেসাল আইটেম রান্না হয়েছে। চিংড়ি মাছের একটা প্রিপারেশন আছে গরম ভেজে দিতে হয়। সব রেডি করে রেখেছি। আপনি খেতে বসলেই ভেজে নিয়ে আস।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তুমি তো অনেক ঝামেলা করেছ।

দুলি বলল, যে খেতে ভালোবাসে তাকে খাওয়াতে ভালোলাগে। এবাড়িতে কেউ খেতে পছন্দ করে না। ইস্তিয়াকের কাছে খাওয়াটা অত্যাচারের মতো। ডাল ভাত সে যেমন অনাগ্রহের সঙ্গে খাবে পোলাও কোরমাও সেরকম অনাগ্রহের সঙ্গে খাবে। দুলাভাই আপনি খাওয়া শুরু করুন।

একা একা খাব?

বাসায় আর কেউ নেই যে আপনার সঙ্গে বসবে। আমি বসতে পারি। আমি ভেজে দেবে কে? আপনি সঞ্জুর ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আরাম করে খান।

ওর ব্যাপারে ভাবছি না।

সঞ্জুর মামা সব ব্যবস্থা করবে। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। মকবুল সাহেবকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে৷

মকবুল সাহেব কে?

ইনভেস্টিগেটিং অফিসার। পুলিশ ইন্সপেক্টর।

ও আচ্ছা।

সেদিন বাসায় এসেছিলেন। আমিও কথা বলেছি৷

ভালো করেছ

এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে ভালো একটা মেয়ে দেখে সঞ্জুর বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। সংসারের জোয়াল কাধে পড়লে অন্য কোনো দিকে তাকাতে পারবে না। ওর নিজের কোনো পছন্দের মেয়ে যদি না থাকে আমাকে বলবেন। আমার হাতে ভালো ভাল কিছু মেয়ে আছে।

আচ্ছা।

খাওয়া শুরু করুন। প্রথম খান কুমড়া বড়া।

ফরহাদ উদ্দিন হেতে শুরু করলেন। যখন খেতে বসেছিলেন তখন মনে হয়েছিল ক্ষিধে নেই–এখন মনে হচ্ছে প্রচুর ক্ষুধা।

ভালো রান্না বিরাট গুণ।

দুলি খুবই গুণী মেয়ে।

দুলাভাই, বড়া খেতে ভালো হয়েছে?

 খুব ভালো হয়েছে।

বড়া ভাজায় দশে আমাকে কত নম্বর দেবেন?

 দশে নয়।

এখন চেপা ভর্তা খান। চেপা ভর্তা যে ঠাণ্ডা ভাত দিয়ে খেতে হয় এটা জানেন?

না।

চেপা ভর্তায় খুব ঝাল দেয়া হয় বলে গরম ভাত দিয়ে খাওয়া যায় না। ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাত দিয়ে খেতে হয়। ঠাণ্ডা ভাত আমি আলাদা করে রেখেছি।

তুমি দেখি দারুণ একটা মেয়ে।

বাইম মাছের তরকারিটা এত ভালো হয়েছে যে খেয়ে ফেলতে পর্যন্ত মায়া লাগছে। দুলি বলল, আমি অনেকবার শুনেছি পারুল আপা আপনার কথা উঠলেই না-কি বলতেন, আপনার মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে জন্মায় না। আপনি এমন কী করতেন যে পারুল আপা এই ধরনের কথা বলত?

ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত গলায় বললেন, আমি এমন কিছু করি নি।

শুধু শুধু তো একজনের সম্পর্কে এমন কথা বলা হয় না। নিশ্চয়ই কিছু করেছেন।

কিছু করলেও আমি জানি না। আমি বোকা মানুষ। বোকা মানুষ কোনো কাজ ভেবে চিন্তে করে না।

আপনি কি নিজেকে বোকা ভাবেন?

ভাবাভাবির কিছু নাই। আমি বোকা।… আপনার বাইম মাছ রান্না অসাধারণ হয়েছে।

 দুলি বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে হঠাৎ আপনি করে বলছেন কেন?

ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত গলায় বললেন, ভুল হয়ে গেছে। আমার মাথাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সব কেমন আউলা ঝাউলা লাগে। কোনটা আমার বড় মেয়ে আর কোনটা মেজো ধরতে পারি না। ছোটজনকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। বড় দুজনকে নিয়ে খুবই ঝামেলা হয়। আপনাকে বলতে ভুলে গেছি আমার মেজো মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওর নাম মিতু না সেতু এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ওদের নাম রাখার একটা ফর্মুলা বের করেছিলাম—MSN ফর্মুলা। এটাতেও ঝামেলা লেগে গেছে। MSN না-কি SMN নিয়ে গণ্ডগোল। আমার কথাবার্তা আপনি মনে হয় কিছু বুঝতে পারছেন না।

না।

বোঝার কথাও না। আজ খাওয়াটা অতিরিক্ত হয়ে গেছে। হাঁসফাস লাগছে। আপনাদের ঘরে পান আছে? পান থাকলে একটা পান খাব। না থাকলে অসুবিধা নেই, দোকান থেকে কিনে নেব।

ফরহাদ উদ্দিন খাওয়া বন্ধ করে হড়বড় করা কথা বলেই যাচ্ছেন। দুলি চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে।

খাওয়া বেশি হয়েছে তো এই জন্যে আজ অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে হবে। শরীরের ক্যালোরি হেঁটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এখান থেকে সরাসরি হেঁটে বাসায় যাব। এতেও কাজ হবে না। আরো হাঁটা দরকার।

দুলি বলল, আপনি হাত ধুয়ে ফেলুন। প্লেটের উপরই ধুয়ে ফেলুন। বেসিনে যাবার দরকার নেই। হাত ধুয়ে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন—আমি পান আনিয়ে দিচ্ছি। পানে কি আপনি জর্দা খান?

 না জর্দা খাই না। তবে আজ একটু খেয়ে দেখি। এক কাজ কর–পান যখন আনাচ্ছ সেই সঙ্গে একটা সিগারেটও আনাও। খেয়ে দেখি একটা সিগারেট। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রতি মাসে হলে ফিস্ট হতো। ফিস্টের দিন আমি আর বদরুল একটা সিগারেট কিনতাম। ভাগাভাগি করে খেতাম। আমি তিন চারটা টান দিয়ে তাকে দিতাম, সেও কয়েকটা টান দিয়ে আমাকে দিত। ঐ সিগারেট টানাটানি থেকেই বদরুলের সিগারেটের নেশা ধরে গেল। আমার ধরল না।

আপনার জন্যে তো ভালোই।

বদরুলের মেয়েটা এখন আমার কাছে আছে। কনক নাম। অতি ভালো মেয়ে। দেখি একবার আপনার এখানে নিয়ে আসব।

বেশ তো নিয়ে আসবেন।

আমার মনে একটা গোপন ইচ্ছা আছে। সঞ্জুর সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দেয়া। হবে কি-না জানি না। বিয়ের ব্যাপারটা আল্লাহপাক ঠিক করে রাখেন। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই।

দুলি বলল, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? কেমন করে যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।

ফরহাদ উদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। বেশি খেয়ে ফেলেছি এই জন্যে বোধহয়। বমি আসছে। আপনাদের বাথরুমটা কোন দিকে?

তিনি বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারলেন না। তার আগেই ঘর ভাসিয়ে বমি করলেন। ফরহাদ উদ্দিনের দৃশ্যমান পৃথিবী দুলছে। ঘরটা ঘুরছে, দুলি ঘুরছে, খাবার টেবিল ঘুরছে। তিনি ঘূর্ণায়মান ঘরের দিকে একবার করে তাকাচ্ছেন আর বমি করছেন। তিনি কোথায় শুয়ে আছেন? নিজের বাড়িতে? না-কি এটা হাসপাতাল? নিজের বাড়ির এক ধরনের গন্ধ থাকে। গায়ের ঘামের গন্ধের মতো আপন আপন গন্ধ। সেই গন্ধটা এখন পাচ্ছেন না। তাছাড়া চোখে আলো লাগছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডে বাতি কখনো বন্ধ করা হয় না। সারারাত চোখে আলো লাগে। গলব্লাডার অপারেশনের সময় তিনি আটদিন হাসপাতালে ছিলেন। সেই স্মৃতি মনে আছে। ফরহাদ উদ্দিন পিটপিট করে চোখ মেলে আবারও বন্ধ করে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন কপালে হাত রাখল। ফরহাদ উদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এটা হাসপাতাল না। হাসপাতালে চোখ মেলা মাত্র কেউ কপালে হাত রাখে না।

রাহেলা বললেন, এখন কেমন লাগছে?

ফরহাদ উদ্দিন নিচু গলায় বললেন, ভালো।

তোমাকে ওরা রাত এগারোটার সময় দিয়ে গেছে। এখন বাজে সাড়ে তিনটা। এতক্ষণ তুমি ঘুমাচ্ছিলে।

ও আচ্ছা।

আমি যে কী ভয় পেয়েছি একমাত্র আল্লাহপাক জানেন।

ঘরের আলোটা একটু নেভাও না। চোখে লাগছে।

 রাহেলা বললেন, ঘরে বাতি জ্বলছে না তো। বারান্দায় বাতি।

ও আচ্ছা। আর মানুষজন কোথায়?

সবাই জেগে আছে। আমি এ ঘরে আসতে নিষেধ করেছি। ডাক্তার বলে দিয়েছে কেউ যেন তোমাকে ডিসটার্ব না করে।

ও আচ্ছা।

এখন কি শরীরটা ভালো লাগছে?

হুঁ।

কিছু খাবে?

খুব ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাব।

রাহেলা পানি আনার জন্যে উঠে গেলেন। দরজায় মিতু, সেতু, নীতু আর কনক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কেউ ঘরে ঢুকছে না। সেতু বলল, ভালো আছ বাবা?

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ভালো আছিরে মা।

তুমি সবাইকে ভয় দেখাতে এত পছন্দ কর কেন বলো তো বাবা? ভয়ে আমার সর্দি লেগে গেছে।

ফরহাদ উদ্দিন আনন্দে হেসে ফেললেন। এই মেয়েটা এত সুন্দর করে কথা বলে না হেসে পারা যায় না। ভয়ে আবার কারো সর্দি লাগে না-কি?

রাহেলা পানির গ্লাস নিয়ে ঢুকলেন। মেয়েরা দরজা থেকে সরে গেল। রাহেলা বললেন, চায়ের চামচ দিয়ে পানি মুখে দিয়ে দেব?

ফরহাদ উদ্দিন উঠে বসতে বসতে বললেন, আরে না। আমি ভালো আছি। এখন শরীরটা ঝরঝরে লাগছে।

তিনি তৃপ্তি করে গ্লাসের পুরো পানি শেষ করলেন। রাহেলা বললেন, তুমি আজ যে আমাদের কী বিপদে ফেলেছ! আমরা সবাই সেজে গুঁজে বসে আছি। তোমার দেখা নেই। তুমি কোথায় গিয়েছ তাও জানি না। রাত নটা বেজে গেল। ঐ ছেলে রেস্টুরেন্টে একা বসে আছে। একটু পর পর সেখান থেকে টেলিফোন করছে। শেষে তোমাকে ছাড়াই চলে গেলাম।

খুব ভালো করেছ।

সেখানে গিয়ে আমি পড়লাম লজ্জায়। ঐ ছেলে কিছুতেই বিল দিতে দিবে। সে যে শুধু খাবারের বিল দিল তা না প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা গিফট। আমার জন্যে শাড়ি, তোমার জন্যে পাঞ্জাবি। প্রত্যেক মেয়ের জন্যে একটা করে শাড়ি। কোনোটাই এলেবেলে না। দামি জিনিস। ছেলের খরচের হাত বেশ ভালো।

ফরহাদ উদ্দিন হাসলেন। রাহেলা বললেন, ছেলের এই দিকটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। খরুচে ছেলে, কাউটা না।

কাউটা জিনিসটা কী?

 কাউটা হলো কৃপণ। মেয়েরা সবাই খুবই আনন্দ করেছে। আর সেতু কী করেছে এটা শোন~ সে বলল, আপনি সবার জন্যে গিফট এনেছেন, আমার ভাইয়ার গিফট কোথায়? ওর জন্যে গিফট আনেন নি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি, এক কাজ করুন—ক্যাশ টাকা দিয়ে দিন, আমরা পছন্দ মতো কিনে নেব। আর আমাদের কাজের মেয়ে আছে, সে বাদ পড়বে কেন। বুঝে দেখ তোমার মেয়ের অবস্থা।

ফরহাদ উদ্দিন হাসছেন। রাহেলা বললেন, হাসবে না। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তোমাকে দেখে সে-রকম মনে হচ্ছে না। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুবই খুশি। খুবই আনন্দিত।

আনন্দিতই ছিলাম, বাসায় এসে দেখি তুমি বিছানায় আধমরা হয়ে পড়ে আছ। কাজের মেয়েটা বলল—একজন মহিলা এসে গাড়ি করে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। মহিলা বলে গেছেন তোমার শরীর সামান্য খারাপ। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তার তোমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। এবং বলেছেন যেন তোমাকে জাগানো না হয়।

ভদ্রমহিলা কে? তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

ফরহাদ উদ্দিন জবাব দিলেন না।

রাহেলা বললেন তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে? কিছু খাবে? তোমার জন্যে খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে এসেছি।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আমি কিছু খাব না।

রাহেলা বললেন, তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।

তিনি শুয়ে পড়লেন। তাঁর একটু শীত শীত লাগছে। ফ্যানের স্পিড একটু কমিয়ে দিলে ভালো হতো। কিন্তু এই কথাটা রাহেলাকে বলতে ইচ্ছা করছে না। রাহেলা কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর খুবই ভালো লাগছে।

রাহেলা বললেন, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে যাই তোমার ঐ মামা, সালু মামা—কয়েকবার টেলিফোন করেছেন। তোমাকে তার নাকি বিশেষ দরকার। কী দরকার বলো তো?

জানি না।

রাহেলা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আমার কাছে অনেক কিছু গোপন কর। এটা আমার ভালো লাগে না। কারো কাছে কোনো কিছু গোপন করার অর্থ তাকে অবিশ্বাস করা। দীর্ঘ দিন তোমার সঙ্গে জীবন যাপন করেও তোমার বিশ্বাস অর্জন করতে পারি নি এটা খুবই দুঃখের কথা।

রাহেলা বললেন, আজ সন্ধ্যায় তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

ফরহাদ উদ্দিন জবাব দিলেন না। এরকম ভাব করলেন যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইচ্ছা করে নিঃশ্বাসের শব্দ ভারী করলেন। রাহেলার প্রশ্নের জবাব দিলে তাকে সত্যি কথা বলতে হবে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মিথ্যা বলা যাবে না। রাহেলাকে এই মুহূর্তে কোনো সত্যি কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ?

ফরহাদ উদ্দিন ঘুমের অভিনয়টা আরো ভালো করার চেষ্টা করলেন। গাঢ় ঘুমের সময় মানুষ নিঃশ্বাস দ্রুত ফেলে না ধীরে ধীরে ফেলে এটা মনে পড়ছে না। মনে পড়লে ভালো হতো।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ