সালু মামা বললেন, ব্যাপার কী তুই তো বুড়ো হয়ে গেছিস! চুলটুল পাকিয়ে গাল ভেঙ্গে কী অবস্থা। চাপার দাঁত পড়েছে? চাপার দাঁত না পড়লে তো গাল ভাঙ্গার কথা না।

 ফরহাদ উদ্দিন বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলেন। সালু মামা তার থেকে খুব কম করে হলেও পনেরো বছরের বড়। তাকে মোটেও সে-রকম লাগছে না। সুন্দর করে আঁচড়ানো কুচকুচে কালো চুল। পরনে ঘি রঙের ফতুয়া। মুখভর্তি হাসি। এক একবার হাসছেন ধবধবে সাদা দাঁত ঝকঝক করে উঠছে। মানুষের এত সাদা দাঁত সচরাচর চোখে পড়ে না। ফরহাদ উদ্দিন মোটামুটি মুগ্ধ চোখে তার মামার দাঁতের দিকে তাকিয়ে আছেন। সালু মামা বললেন, কলপ দিস না কেন? আমাকে দেখ, ইয়াং ভাব এখনো কিছুটা আছে না? ‘

হুঁ।

দাঁতগুলি নকল, কিন্তু বোঝার কোনো উপায় নেই। মাসে দুবার কলপ দেই। একবার ফ্যাসিয়েল করাই। ভালো একটা পার্লার আমার পরিচিত আছে, এরা খুবই যত্ন করে কাজটা করে। ফ্যাসিয়েল কখনো করিয়েছিস?

জ্বি না।

এটা মুখের একটা ম্যাসেজ। ক্রিম টিম মাখিয়ে কিছুক্ষণ ডলাডলি করে। স্টিম দেয়। এতে মুখের চামড়া ভালো হয়। চামড়ায় যে দাগ পড়ে দাগগুলি উঠে যায়। বয়স কম লাগে। বুড়ো সেজে ঘুরে বেড়ানোর দরকার কী? কোনো দরকার নেই। তোর অফিস ঘরে সিগারেট খাওয়া যায় তো?

যায়।

বাঁচলাম। আজকাল বেশিরভাগ অফিসেই নো স্মোকিং করে দিয়েছে। অফিসে কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার জোগাড় হয়। একটা জিনিস এরা বোঝে না রাস্তায় এক ঘণ্টা গাড়ির ধোয়া খাওয়া দশ প্যাকেট সিগারেট খাওয়ার সমান। ঠিক বলেছি না?

জি।

সালু মামা ফতুয়ার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন—চা দিতে বল। আর দরজা টেনে দে। জরুরি কথাগুলি শেষ করি। এখানে কথা বলতে অসুবিধা আছে না-কি ক্যান্টিনে চলে যাব?

এখানেই বলুন।

সালু মামা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন—ইস্তিয়াকের কাছে সঞ্জুর ঘটনা শুনে আমার কচ্ছপের মতো অবস্থা হয়েছিল। হাত পা সব দেখি শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। বলে কী? আমাদের সঞ্জু। দুধের শিশুর এ-কী কারবার!

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ঘটনা ঠিক না। সঞ্জু হাসনাত নামে কাউকে চিনে।

 চিনে না?

জ্বি না। ওরা ভুল করেছে। নাম গুলিয়ে ফেলেছে।

সালু মামা চিন্তিত গলায় বললেন, পুলিশ এমন জিনিস যে, ওরা যদি শুদ্ধ করে তাহলেও বিপদ, যদি ভুল করে তাহলে আরো বড় বিপদ। আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হলো বিপদ কাটিয়ে বের হতে হবে।

বেয়ারা চা নিয়ে এসেছে। সালু মামা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির শব্দ করলেন। ফরহাদ উদ্দিন মামার দিকে তাকিয়ে আছেন। মানুষটাকে দেখে তাঁর ভরসা লাগছে। এমনভাবে কথা বলছে যেন কিছুই হয় নি।

ফরহাদ!

জ্বি মামা।

তুই কোনোরকম চিন্তা করিস না। চিন্তা ভাবনার ব্যাপারটা তুই আমার হাতে ছেড়ে দে। সঞ্জু কী করেছে এটা কাক পক্ষীও টের পাবে না। আমরা পুরো ঘটনাই গিলে ফেলব।

ও কিছু করে নি মামা।

ফাইন। অতি উত্তম। না করলে তো ভালো। করবেই বা কেন? ও ভদ্রলোকের ছেলে না? যাই হোক পুলিশ যখন সন্দেহ করছে তাদের সন্দেহ দূর করতে হবে। ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের সঙ্গে আমি অলরেডি কথা বলেছি। নম্র ভদ্র বিনয়ী। নাম মকবুল। মকবুল সাহেব বলেছেন—স্যারের আপন ভাগ্নে। স্যারের অতি প্রিয় বোনের একমাত্র ছেলে। বোন মারা গেছেন। ছেলেটাই শুধু আছে। সেটা আমি দেখব।

তবে ঐ লোক গভীর পানির মাছ। মাছ বলা ঠিক না, সে হলো মৎস্য। গভীর পানির মৎস্য—দশ হাজার ফুট নিচের পানির জিনিস।

ও আচ্ছা!

হারামিটা এক ফাঁকে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে—টাকা পয়সা লাগবে। অনেকের মুখ বন্ধ করতে হবে। মামলা অন্যভাবে সাজাতে হবে তার খরচা। আমি এমন ভাব করেছি যে তার কথাবার্তা বুঝতে পারছি না। সঞ্জু এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছে এই দুঃখে আমি অস্থির এরকম একটা ভাব ধরলাম। ভালো করেছি না?

জ্বি।

তুমি যদি হও গভীর জলের মাছ—আমি পাতালের মাছ। আমাদের সঙ্গে ইস্তিয়াক আছে। আসামির আপন মামা। নিজেদের মধ্যে পুলিশের বড় অফিসার থাকায় সুবিধা হয়েছে। না থাকলেও অসুবিধা হতো না। ফাঁক দিয়ে বের করে নিয়ে আসতাম।

সালু মামা আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে গলা নিচু করে বললেন—টাকা খরচ করতে হবে। তোর টাকা পয়সার অবস্থা কী? লাখ দুএক টাকা এই মুহূর্তে লাগবে। এক কাজ কর টাকাটা ইস্তিয়াককে দিতে বল। ওরই তো ভাগ্নে। মাছের তেলে মাছ ভেজে ফেলি। তোর বলতে লজ্জা লাগলে আমি বলতে পারি। বলব?

ফরহাদ উদ্দিন চুপ করে রইলেন। হঠাৎ করে তার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। সালু মামা কী বলছেন মাথায় পুরোপুরি ঢুকছে না।

সালু মামা গলা নামিয়ে বললেন, সঞ্জুর মা তার বাপের সম্পত্তির অংশও তো পাবে। টাকাটা সেখান থেকে দিক। তুই ঝিম মেরে আছিস কেন? কিছু বল।

কী বলব?

টাকা পয়সার ব্যাপারটা কী করা যায় সে সম্পর্কে কিছু বল। ভাতের হাঁড়ির ঢাকনার মতো পড়ে থাকলে তো হবে না। একশানে যেতে হবে। সঞ্জু যে কোলকাতায় গিয়েছিল ফিরেছে?

ফিরেছে।

কবে ফিরেছে?

গতকাল সকালে।

 থাকছে কোথায়? তোর বাড়িতে?

হা।

ওর তো তোর ওখানে থাকা ঠিক না। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার যাবে—নানান যন্ত্রণা করবে। টাকা বের করার জন্যে নানান প্যাঁচ খেলতে থাকবে। সঞ্জুকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিবি। তা ছাড়া ওর সঙ্গে আমার ক্রেজি সিটিং এরও দরকার আছে। প্ল্যান অব একশান ঠিক করতে হবে।

কী প্ল্যান অব একশান?

আমি কয়েকটা প্ল্যান ঠিক করেছি। প্রত্যেকটা প্ল্যানের ভালোও আছে, মন্দও আছে। চিন্তা ভাবনা করে যে-কোনো একটা নিতে হবে। পুলিশ ফাইন্যাল রিপোর্টে তার নাম লেখবে না এটা ধরে নিলাম। ইস্তিয়াক আছে। আমরাও টাকা খাওয়াব। তারপরেও ব্যাক আপ সিস্টেম থাকা দরকার।

ব্যাক আপ সিস্টেম মানে?

 ধর লাস্ট মোমেন্টে কোনো একটা সমস্যা হলো—পুলিশ সঞ্জুর নাম বাদ দিল না। নাম ঢুকিয়ে দিল। তখন যাতে কেটে বের হয়ে যেতে পারি সেই ব্যবস্থা থাকা দরকার। তোর অফিসের চা-তো খুব ভালো। আরেক কাপ খাই—-এখানে না, চল তোদের ক্যান্টিনে বসে খাই। আমি আবার এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসতে পারি না। তোর ক্যান্টিনে নাস্তার ব্যবস্থা কী? আলসার ধরা পড়েছে, ঘন্টায় ঘন্টায় সলিড ফুড পেটে যাওয়া দরকার। আর শোন তুই মুখ এমন ভোঁতা মেরে বসে আছিস কেন? কন্ট্রোল পুলিশের হাতে না, আমার হাতে। নিশ্চিন্ত মনে থাক। টাকা পয়সা নিয়েও চিন্তা করবি না—জোগাড় হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। এদিকে আরেক কাজ করব—কোনো একটা মাদ্রাসার তালেবুল এলেমদের দিয়ে এক লাখ চল্লিশ হাজার বার খতমে ইউনুস পড়ায়ে ফেলব। আল্লাহও খুশি রইল।

ক্যান্টিনে ঢুকে সালু মামা দু’টা সিঙ্গাড়া এবং আলুর চপ খেলেন। চাইনিজ চিকেন কর্ন সুপ পাওয়া যাচ্ছে। এক বাটি পঁচিশ টাকা। স্যুপেরও অর্ডার দিলেন। ভাগ্নের দিকে তাকিয়ে বললেন—তোর যে সত্যি কথা বলার একটা বাতিক উঠেছিল সেটা এখনো আছে?

ফরহাদ উদ্দিন হুঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

 কত বছরের যেন তোর প্ল্যান? কুড়ি না পঁচিশ?

কুড়ি।

শেষ হবে কবে?

ডিসেম্বরে। ডিসেম্বরের তিন তারিখ।

তখন কী হবে? তুই কি পীর দরবেশ কিছু হয়ে যাবি?

না—তখন মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে।

 সালু মামা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই যে এত বোকা জানতাম না। ডিফ এন্ড ডাম অর্থাৎ বোবারা কি মিথ্যা কথা বলতে পারে? তারা সারা জীবনে মিথ্যা বলতে পারে না। কথাই বলতে পারে না, মিথ্যা বলবে কী? তাদের কোন ইচ্ছাটা পূর্ণ হয়? তুই যে শুধু বোকা তা না। মহাবোকা। এই জন্যে তোকে অত্যধিক স্নেহ করি। তোকে কতবার বলেছি কোনো সমস্যায় পড়লে আমার কাছে আসবি। নিজে নিজে সলভ করতে পারবি না। তোর সেই ক্ষমতা নেই। সব গুবলেট করে ফেলবি। আছে কোনো সমস্যা?

না।

সমস্যা ছাড়া মানুষ আছে? বন আছে পাখি নাই, মানুষ আছে সমস্যা নাই এটা কখনো হবে না। ভেবে টেবে দেখ।

একটা ঠিকানা জোগাড় করে দিতে পারবে মামা?

সালু মামা বিস্মিত হয়ে বললেন—কার ঠিকানা?

কনক বলে একটা মেয়ে আমার এখানে থাকে, তার মা’র ঠিকানা। ভদ্রমহিলা কাউকে কিছু না বলে অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে গেছেন। অনেক চেষ্টা করে উনার অস্ট্রেলিয়ার ঠিকানা পাচ্ছি না।

তোর বন্ধু বদরুলের বউ-এর কথা বলছিস?

তোমার মনে আছে?

মনে থাকবে না কেন? তার ঠিকানা বের করা কোনো ব্যাপারই না। অস্ট্রেলিয়ান এম্বেসির মাধ্যমে এগোতে হবে। সরাসরি এম্বেসির কাছে গেলে ওরা পাত্তা দিবে না। রেডক্রসের মিসিং পারসন ব্যুরোর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে। তুই একটা কাগজে ভদ্রমহিলার নাম লিখে দে। নাম, বাবার নাম, স্বামীর নাম—পাত্তা লাগিয়ে দেব। এটা কোনো মামলাই না। সাত ধারার মামলার মতো সহজ মামলা। কোটে উঠার আগেই খালাস।

স্যুপ এসে গেছে। সালু মামা গভীর আগ্রহে স্যুপ খাচ্ছেন। ফরহাদ উদ্দিনের কেমন জানি গা গুলাচ্ছে। বমি ভাব হচ্ছে। মনে হচ্ছে সুপ থেকে কোনো বাজে গন্ধ ফরহাদ উদ্দিনের নাকে আসছে। কাঁচা মুরগির মাংসের গন্ধ। তার কি ঘ্রাণ শক্তি ফিরে আসছে?

তুই এমন নাক কুচকাচ্ছিস কেন?

 শরীর খারাপ লাগছে।

এক বাটি স্যুপ খা। স্যুপটা এরা ভালো বানায়। দশে এদের আট সাড়ে আট দেয়া যায়। মাঝে মাঝে তোর অফিসে এসে স্যুপ খেয়ে যাব। গাদাখানিক সিঙ্গাড়া সমুচা খাওয়ার চেয়ে এক বাটি স্যুপ খাওয়া ভালো।

ফরহাদ উদ্দিন বমি আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। সঞ্জু কোলকাতা থেকে ফেরার পর তার সঙ্গে যখন দেখা হলো তখনো ফরহাদ উদ্দিনের এমন হলো। সঞ্জুর গা থেকে কি কোনো গন্ধ আসছিল? ভেজা কাপড় অনেকদিন ট্রাংকে রেখে দিলে ছাতা পড়ে এক ধরনের গন্ধ বের হয় সে-রকম কিছু? যে গন্ধে বমি বমি ভাব হয়। কিন্তু বমি হয় না। খুবই অস্বস্তির ব্যাপার। সঞ্জুর সামনে তিনি বমি বমি ভাব নিয়ে বসে রইলেন। সঞ্জু বলল, বাবা তোমার জন্যে এক জোড়া স্যান্ডেল এনেছি। রাদুর স্যান্ডেল। সঞ্জু ব্যাগ থেকে স্যান্ডেল বের করে তার সামনে রাখল। তখন তিনি বুঝলেন–এতক্ষণ তিনি যে গন্ধ পাচ্ছেন সেটা কাঁচা চামড়ার গন্ধ। সঞ্জুর সামনে ব্যাপারটা বুঝতে পারেন নি। সালু মামার সামনে বসে মনে হচ্ছে ঘ্রাণশক্তি সত্যি সত্যি ফিরে আসছে। তার জীবনে খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তিনি ঘ্রাণশক্তি ফিরে পাচ্ছেন। কাগজি লেবুর গন্ধ কেমন তিনি ভুলেই গেছেন! প্রথম যেদিন পাবেন সেদিন আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটবে। প্রথম হয়তো কিছুক্ষণ বুঝতেই পারবেন না গন্ধটা কিসের।

ফরহাদ, তুই ঝিম ধরে আছিস কেন?

শরীরটা ভালো লাগছে না মামা।

অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নে। আমার সঙ্গে চল।

কোথায় যাব?

ইন্টারেস্টিং কোনো জায়গায় নিয়ে যাই চল। বাসা-অফিস, অফিস-বাসা করে তো জীবনটাই শেষ করে দিলি। শরীরের আর দোষ কী? শরীর আনন্দ চায়, উত্তেজনা চায়। মদ খেয়েছিস কখনো?

জি না।

কী আশ্চর্য কথা, একটা জীবন পার করে দিলি জিনিসটা চেখে না দেখেই? সারা পৃথিবীর মানুষ এই জিনিস খাচ্ছে মদের ব্যবসা হলো কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা। সেই জিনিস এক ঢোক খাবি না? আমার সঙ্গে চল আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। গান বাজনা শুনবি। ইচ্ছা হলে এক আধটু বিয়ার টিয়ার খাবি। বিয়ার মদের মধ্যে পড়ে না। বিয়ার খেলে দোষ নেই। সঞ্জুর ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করার জন্যেও এটা করা দরকার। মাইন্ড রিলাক্সেসন।

মামা থাক।

আচ্ছা থাক। সঞ্জু যে কোলকাতা থেকে ফিরেছে তার আচার ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন দেখেছিস?

না।

শক্ত ছেলে, ভেরি টাফ। গাইডেন্সের অভাবে পিছলে পড়ে গেছে। টেনে তুললেও লাভ হবে না, আবার পড়ে যাবে।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, মামা, ও হাসনাত নামের কাউকে চিনে না। আমি মিথ্যা কথা বলছি না মামা। তুমি তো জানো আমি মিথ্যা বলি না।

তুই অবশ্যই সত্যি কথা বলছিস। সত্য কথা বলার সাধনা করছিস, সত্যি কথা তো তোকে বলতেই হবে। তোর ছেলে তো আর সে-রকম কোনো সাধনা করছে না। ও মিথ্যা বলছে। মানুষ যে মারে তার কাছে মিথ্যা কিছু না।

ফরহাদ উদ্দিন আতঙ্কিত গলায় বললেন, তুমি কী বলছ মামা? ও মানুষ কীভাবে মা’রবে?

আচ্ছা যা মারে নাই। হাসনাতকে কোলে বসিয়ে গালে চুমু দিয়েছে। এটা ভেবে যদি মনে শান্তি পাস তাহলে তাই ভাব। মনে শান্তি পাওয়া দিয়ে কথা।

মামা এরকম করে কথা বলবে না। সঞ্জু তোমার ছেলে না। তুমি তাকে চিনবে না। আমার ছেলে আমি চিনি।

সালু মামা গম্ভীর গলায় বললেন, মানুষ নিজেকেই চিনে না সে তার ছেলেকে চিনবে কীভাবে? রবী ঠাকুরের বিখ্যাত গান আছে না–চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী ভুল গান। গানটা হওয়া উচিত—চিনি না চিনি না তোমারে ওগো বিদেশিনী। ফরহাদ চল তোর ঘরে আবার যাই। কয়েকটা টেলিফোন করি। দেখি কনকের মা’র ঠিকানা বের করা যায় কি-না। সময় নষ্ট করা ঠিক না। টাইম ইজ মানি।

 সালু মামা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, সঞ্জুর ওজন কি পাঁচ ছয় কেজি বেড়েছে। ওজন বাড়ার কথা।

ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ওজন বাড়বে কেন?

মানুষ খুন করার পর খুনির ওজন বাড়তে থাকে। আট দশ কেজি পর্যন্ত বাড়ে। পরীক্ষিত সত্য। কেন বাড়ে জানি না। ব্যাপারটা রহস্যময়।

.

সঞ্জুর গায়ে জ্বর। কোলকাতা থেকে সে ফিরেছে জ্বর নিয়ে। আজ সারা দিনই সে দরজা বন্ধ করে বিছানায় পড়েছিল। এখন তার গায়ে ঘাম দিচ্ছে। জ্বর ছেড়ে যাবার লক্ষণ। গত দুদিন সে কোনো সিগারেট খেতে পারে নি। তামাকের গন্ধেই শরীর উল্টে যেত। সিগারেট ধরানো দূরের কথা সিগারেটের কথা ভাবলেই মাথা ঘুরত। এখন সে-রকম হচ্ছে না। সঞ্জুর মনে হলো সে একটা সিগারেট ধরাতে পারে। তার জ্বরটা সেরেছে কি-না সে পরীক্ষাও হয়ে যাবে। সিগারেট অর্ধেকের মতো টানতে পারলেও বুঝতে হবে জ্বর কমে যাচ্ছে।

ঘরে কোনো সিগারেট নেই। টেবিলের ড্রয়ারে একটা রিজার্ভ প্যাকেট সব সময় থাকে। সেই প্যাকেটটাও নেই। কোলকাতায় যাবার সময় কি সে এই প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিল? মনে পড়ছে না। সে সিগারেট কেনার জন্য ঘর থেকে বের হলো। লুঙ্গি পরে সে কখনো ঘর থেকে বের হয় না। আজ আর লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতে ইচ্ছা করছে না। বাসার সামনেই দোকান। লুঙ্গি পরে যাওয়া যায়।

সঞ্জু দুপ্যাকেট সিগারেট কিনল। সিগারেটের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট হাতে নিল আর ঠিক তখনই অমায়িক চেহারার পাঞ্জাবি পরা লম্বা রোগী এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বলল–আপনি সঞ্জু না?

সঞ্জু বলল, জ্বি।

ফরহাদ উদ্দিন সাহেবের বড় ছেলে?

সঞ্জু বলল, জ্বি।

ভালো আছেন?

সঞ্জু বলল, আপনাকে চিনতে পারছি না।

আমার নাম মকবুল। মকবুল হোসেন। আমাকে চেনার কথা না। আমি একজন পুলিশ অফিসার। আপনাকে কষ্ট করে একটু আমার সঙ্গে আসতে হবে।

কোথায়?

ডিবি অফিসে। দুএকটা রুটিন প্রশ্ন করব। পাঁচ-দশ মিনিটের ব্যাপার।

এখানে করুন।

একটু কষ্ট করতে হবে যে ভাইয়া। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে, গাড়িতে উঠুন।

মকবুল হোসেন হাত বাড়িয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশের জীপ দেখাল। সঞ্জু শান্ত গলায় বলল, এখনই আমি গাড়িতে উঠতে পারব না। আমি কোথায় যাচ্ছি সেটা বাড়িতে জানিয়ে যেতে হবে। আমার পরনে লুঙ্গি। লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতে হবে।

মকবুল হোসেন হাসি হাসি মুখে বলল—লুঙ্গি তো খুব ভালো পোশাক। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ সারা জীবন লুঙ্গি পরেছেন। লুঙ্গি পরে দেশে বিদেশে ঘুরেছেন।

সঞ্জু কড়া গলায় বলল, আপনি সময় নষ্ট করছেন, আমি এভাবে যাব না।

সঞ্জুর কঠিন কথায় মকবুল হোসেনের মুখের হাসি নষ্ট হলো না। বরং তার মুখ আরো অমায়িক হয়ে গেল। সে এগিয়ে এসে সঞ্জুর কাঁধে হাত রেখে বলল—ভাইয়া গাড়িতে উঠতে হবে। এই মুহূর্তে। আমি হেংকি পেংকি পছন্দ করি না।

.

মোটামুটি অন্ধকার খুপড়ির মতো একটা ঘর। দিনের বেলাতেও সেই ঘরে বাতি জ্বলছে। তাতে অন্ধকার দূর হচ্ছে না কারণ একমাত্র জানালাটাও বন্ধ। ঘরের আসবাব বলতে বড় একটা কাঠের টেবিল। টেবিলের দুপাশে দু’টা হাতাওয়ালা কাঠের চেয়ার। ঘরের দু’টা দেয়াল ভর্তি র‍্যাক। র‍্যাকে ফাইলপত্র। সব ফাইলের ওপর ধুলা জমে আছে। বোঝাই যাচ্ছে দীর্ঘদিন কেউ এইসব ফাইলে হাত দেয় না। মেঝেতে এক জোড়া ছেঁড়া গামবুট। এই ঘরেই কোথাও উঁদুর-টিদুর মরে পচে আছে। বিকট দুর্গন্ধ আসছে। সঞ্জু পাঞ্জাবি দিয়ে নাক ধরে আছে। তার ঠিক সামনেই বসে আছে মকবুল হোসেন। সে নির্বিকার। মনে হচ্ছে পচা ইঁদুরের গন্ধে তার কিছু যাচ্ছে আসছে না। মকবুল হোসেনের সামনে এক কাপ চা। সে বেশ আয়েশ করেই চায়ে চুমুক দিচ্ছে। সঞ্জু বলল, কী জিজ্ঞেস করতে চান তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করুন। আমি এই ঘরে থাকতে পারছি না।

মকবুল হোসেন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সঞ্জুর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল, হাসনাতকে বাসা থেকে টেলিফোন করে কে এনেছে তুমি না—না-কি তোমার অন্য দুই বন্ধুর একজন।

সঞ্জু বলল, হাসনাত নামে আমি কাউকে চিনি না।

মকবুল হোসেন বলল, ভাইয়া আমাকে রাগাবেন না। রেগে গেলে আমি খারাপ লোক হয়ে যাই। ড. জ্যাকেল মিস্টার হাইডের গল্প জানেন না?

খারাপ লোক হন আর যাই হন আমি হাসনাতকে চিনি না।

 চিনেন না?

না।

মকবুল হোসেন চায়ে তৃপ্তির একটা চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোমার লুঙ্গির নিচে দু’টা বিচি আছে না? ঐ বিচি দু’টা যখন টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলব তখন সব চিনবে।

সঞ্জু হতভম্ব গলায় বলল, আপনি এইসব কী বলছেন?

নোংরা কথা বলছি। তুমি মানুষ খুন করতে পারবে আর আমি দু’টা নোংরা কথা বলতে পারব না। তা তো না। গা থেকে পাঞ্জাবিটা খোল—আর লুঙ্গি খোল। লুঙ্গির নিচে আন্ডারওয়্যার আছে? থাকলে সেটাও খোল। নাংগু বাবা হয়ে যাও।

সঞ্জুর বুক ধ্বক করে উঠল। মকবুল হোসেনের গলার স্বর পাল্টে গেছে। কথা বলার ভঙ্গি পাল্টে গেছে। তবে মুখের অমায়িক ভাবটা এখনো আছে। সঞ্জুর এখন মনে হচ্ছে এই লোক করতে পারে না এমন কাজ নেই।

মকবুল হোসেন সিগারেট ধরাল। আরাম করে ধোঁয়া ছেড়ে ডাকল—-ফতে মিয়া। ঐ ফতে।

হাফ প্যান্ট পরা খালি গায়ের একজন বেঁটে লোক ঢুকল। অত্যন্ত বলশালী লোক। কিন্তু গলার স্বর মেয়েলি। সে চিকন গলায় বলল, স্যাররে আরেক কাপ চা দিমু?

মকবুল হোসেন বলল, দে।

 লেম্বু চা না দুধ চা?

দুধ চা। তোর লেম্বু চা মুখে দেওয়া যায় না। চা দেয়ার আগে একটা কাজ কর, চেয়ারে হারামিটা বসে আছে তার কাপড় চোপড় খুলে তারে নেংটা কর। তারপর হাঁটু দিয়ে তার বিচিতে একটা বাড়ি দে। বেশি জোরে দিবি না, মরে যেতে পারে। দুই নম্বরীটা দে।

সঞ্জু তাকিয়ে আছে। বেঁটে লোকটা সত্যি তার দিকে এগিয়ে আসছে। এই তো লুঙ্গিতে হাত দিল। সত্যি সত্যি লুঙ্গি খুলে ফেলছে না-কি? কী হচ্ছে এসব? সঞ্জু কিছু বলতে যাচ্ছিল—কথা গলায় আটকে গেল। হঠাৎ তার কাছে মনে হলো দুই পায়ের ফাঁকে তরল আগুন ঢেলে দিয়েছে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে আবার ফিরে আসছে আগের জায়গায়। আবার সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর পুড়ছে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে।

সীমাহীন ব্যথা ঢেউ-এর মতো উঠা নামা করছে। সঞ্জু আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার দিল। সেই চিৎকারও গলায় আটকে গেল। তবে মিলিয়ে গেল না, মাথার ভেতর চিৎকারটা হতে থাকল। হতেই থাকল। সময় কি থেমে গেছে? কতক্ষণ পার হয়েছে? সে চেয়ারে এসে কখন বসেছে?

সঞ্জু!

উ কীরে হারামজাদা! বল ইয়েস স্যার।

ইয়েস স্যার।

হাসনাতকে কে খবর দিয়ে এনেছে?

আমি।

 ঘটনাটা কী ছিল?

টগর বিদেশে যাবার একটা সুযোগ পেয়েছিল। দুই লাখ পঁচিশ হাজার টাকার দরকার। টাকাটা জোগাড় হচ্ছিল না। প্রথমে সে টাকাটা ধার হিসেবে চেয়েছিল। হাসনাত ভাই রাজিও হয়েছিলেন টাকাটা দিতে। হঠাৎ বললেন, না। টগর গেল রেগে। আমরা ভয় দেখিয়ে উনার কাছ থেকে টাকাটা জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলাম। উনি হঠাৎ এমন চিৎকার শুরু করলেন—দোতলার ভাড়াটে উপরে চলে আসল। তখন হাসনাত ভাই-এর মুখ চেপে ধরা হয়েছে যাতে শব্দ কেউ না শোনে।

এটা ঘটছে টগরের বাসায়?

জ্বি না টগরের চাচার বাসায়। ঐ বাসাটা খালি বাসা দেখা শোনার জন্য টগর সেখানে একা থাকত।

মুখ চেপে ধরার কারণে হাসনাত মারা গেল? মুখ কী দিয়ে চেপে ধরেছিলে, বালিস দিয়ে?

জ্বি।

 তুমিই তো ধরেছ তাই না?

জ্বি।

তারপর ডেডবডি সরালে কীভাবে?

টেলিভিশন যে কার্টুনে থাকে সে রকম একটা বড় কার্টুন বাসায় ছিল। সেই কার্টুনে ভরে বেবিট্যাক্সি করে নিয়ে গেছে।

বেবিট্যাক্সি করে জসিম একা ডেডবডি নিয়ে গেছে?

 জি একা নিয়ে গেছে।

মানুষ খুন করতে কেমন লাগল?

সঞ্জু চুপ করে আছে। মকবুল হোসেন বলল—তোমাকে যে ছোট্ট চিকিৎসাটা এখানে করলাম বিচি চিকিৎসা। এই চিকিসার কথা মনে রাখবে। চিকিৎসাটা করেছি ইস্তিয়াক স্যারের নির্দেশে। তুমি তেরিবেরি করছিলে তো–এই তেরিবেরি বন্ধ করার জন্য। স্যার খবর দিলে যাও না, হাসনাত নামের। কাউকে চেনো না—এইগুলি যেন পুরোপুরি বন্ধ হয়। বুঝতে পারছ?

জ্বি।

তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। তিনজনে মিলে কাজটা করেছ। সেই তিনজনের ভেতর কেউ যদি ধরা পড়ে তাহলে সে বাকি দুজনকে ফাঁসাবে। তিনজনের একজনকে বাদ দেয়া যায় না। বাদ দিলে তিনজনকেই বাদ দিতে হয়। তখন অন্য কাউকে ফাসাতে হয়। বুঝতে পারছ?

জ্বি।

বিচির ব্যথা কমেছে?

জ্বি না।

এই ব্যথা এক মাস থাকবে। চা খাবে?

জ্বি না।

ফতে মকবুল হোসেনের জন্য চা নিয়ে এসেছে। মকবুল হোসেন ফতের হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বলল—-ফতে তোর আগের বাড়িটা দুই নম্বরী দিতে বলেছিলাম–তা তো দিস নাই। তিন নম্বরী বাড়ি দিয়েছিস। এর ব্যথা কমে গেছে। দেখ না কেমন স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

স্যার দুই নম্বুরী একটা দিব?

দে।

সঞ্জু বিড় বিড় করে কী যেন বলল। কিছুই বোঝা গেল না। মকবুল হোসেন সঞ্জুর দিকে ঝুঁকে এসে বলল এখন তোমাকে দুই নম্বরী বাড়ি দেওয়া হবে। কিছুক্ষণ জ্ঞান থাকবে না। বুঝতে পারছ? দুই বিচির জন্যে দু’টা ঠিক আছে না?

জ্বি।

জ্ঞান ফেরার পর পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরে নিও। তোমার মামা আমাদের স্যার ইস্তিয়াক সাহেব এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন। উনাকে খবর দেয়া হয়েছে। ঠিক আছে?

জ্বি।

আমাদের দুজনের মধ্যে সামান্য যে খেলাধুলা হলো এটা কাউকে বলার দরকার নাই।

জ্বি।

তাহলে দুই নম্বর বাড়ির জন্য তৈরি হও। দুই নম্বর বাড়িটা না খেলে ঘটনা বুঝতে পারবে না।

সঞ্জু গোঙাতে গোঙাতে বলল, স্যার একটু আস্তে বাড়ি দিতে বলেন।

.

সঞ্জু পুলিশের জিপে বসে আছে। সঞ্জুর পাশে তার মামা ইস্তিয়াক। দুজনের কেউ কোনো কথা বলছে না। ইস্তিয়াক মাঝে মাঝে মাথা ঘুরিয়ে সঞ্জুকে দেখছে। যতবার সে তাকাচ্ছে ততবারই তার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। সঞ্জু এক দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ডিবি অফিস থেকে বের হয়ে সে বেশ অবাক হয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল বাইরে এসে দেখবে রাত রাস্তার হলুদ বাতি জ্বলছে। অথচ বাইরে ঝকঝকে রোদ। সূর্যটা কোথায় দেখা যাচ্ছে না। সূর্য দেখা গেলে সময়ের আন্দাজ করা যেত। সঞ্জুর হাতে ঘড়ি নেই। তার মামার হাতে ঘড়ি আছে। আড়চোখে একবার তাকালেই সময় জানা যায়। আড় চোখে তাকাতে ইচ্ছা করছে না। গাড়ি কোথায় যাচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ি বনানী পার হয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে। সঞ্জুদের বাসা বা তার মামার বাসা কোনোটাই এদিকে নয়।

সঞ্জু!

জেই।

আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো।

সঞ্জু মামার দিকে তাকাল।

একজন ক্রিমিন্যালকে পাশে বসিয়ে আমি যাচ্ছি এবং ক্রিমিন্যালের সঙ্গে কথা বলছি তার কারণ জানো?

সঞ্জু জবাব দিল না। তার কপালের দুটিা রগ ফুলে উঠল ইস্তিয়াক বলল, কপালের রগ ফুলিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। রগ ঠিক কর।

সঞ্জু মামার হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিয়েছে। একটা দশ। এখন মধ্য দুপুর। ইস্তিয়াক বলল, তোমার মা কেমন ছিলেন সেটা তুমি জানো না কারণ তাকে তুমি দেখার সুযোগ পাও নি। তোমার বাবাকে তুমি দেখেছ। তিনি কেমন মানুষ তুমি কি জানো?

ভালো মানুষ।

ভালো মানুষের ডেফিনেশন কী? একেকজনের কাছে ভালো মানুষের ডেফিনেশন একেক রকম। একজন ক্রিমিনালের কাছে ভালো মানুষের সংজ্ঞা এক রকম, একজন সাধুর কাছে অন্যরকম। আমি তোমার ডেফিনেশনটা শুনতে চাই।

মামা, আমার শরীর ভালো না। আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

অন্যের কথা শুনতে কি ইচ্ছা করছে? নাকি অন্যের কথা শুনতেও ইচ্ছা করছে না।

আপনি কী বলবেন বলুন।

তোমার বাবা একজন ভালো মানুষ। তার ভালো মানুষ কোন পর্যায়ের সেই সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই বলে আমি মনে করি। ধারণা আছে?

না।

তোমার মা’র মৃত্যুর পর তোমার বাবা আবার বিবাহ করেন। তখন আমাদের খুবই দুর্দিন। আমরা দুই ভাই ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। টাকা পয়সার ভয়ঙ্কর টানাটানি। তোমার বাবা আমাদের দুই ভাইয়ের ইউনিভার্সিটির পড়ার খরচ শেষ পর্যন্ত দিয়ে গেছেন। এটা জানতে?

না।

আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবচে ছোটজনের নাম আলতাফ। তোমার বাবা তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতো। ও আম খেতে খুব পছন্দ করত। সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। কোন কিছুই খেতে পারত না। যেদিন মারা যাবে সেদিন তাকে আম কেটে দেয়া হয়েছে। দেখা গেল খুব আগ্রহ নিয়ে আম খাচ্ছে। আমগুলি তোমার বাবা নিয়ে এসেছিলেন। আম খেতে খেতে সে তোমার বাবাকে বলল–দুলাভাই, আমি মরে যাচ্ছি এটা জানি। মরে যাবার পর আম খেতে পারব না এটা ভেবে খারাপ লাগছে। তার মৃত্যুর পর একজন মানুষ আম খাওয়া ছেড়ে দিল, সে হলো আমার বাবা। আমরা কেউ কিন্তু আম খাওয়া ছাড়লাম না। তোমার বাবা যে আম খান না এটা কি তুমি জানো?

জানি

কেন খান না জান?

এখন জানলাম।

আরো শুনবে?

না।

আমি খুবই একটা অন্যায় করেছি। তুমি যে ক্রাইমটা করেছ সেটা তাকে বলে তার মনে কষ্ট দিয়েছি। পৃথিবীর সব মানুষকে আমি কষ্ট দিতে পারি, তাকে কষ্ট দিতে পারিনা। আমি তার মনের কষ্টটা দূর করতে চাই।

কীভাবে?

 আমি তাকে বলব পুলিশ আসলে একটা ভুল করেছে। সঞ্জু এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত না। তুমিও তোমার বাবাকে এই মিথ্যাটী বলবে। এটা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে মানুষটার জীবনের ব্রত সত্যি কথা বলা, তাকে পরামর্শ করে মিথ্যাকথা শুনতে হচ্ছে। চারদিক থেকে সে শুনবে মিথ্যা কথা, কিন্তু তাকে বলতে হবে সত্যি কথা।

গাড়ি উত্তরা ছড়িয়ে চলে গিয়েছিল। ইস্তিয়াক ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলল।

সন্ধ্যাবেলা ফরহাদ উদ্দিন হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিলেন। ফুলওয়ালী মেয়েগুলো বেলি ফুল বিক্রি করছে। ফরহাদ উদ্দিনের কাছে ভাংতি ছিল না। তিনি দশ টাকা দিয়ে পাঁচটা মালা কিনলেন। ফুলগুলো নাকের কাছে ধরতেই হালকা গন্ধ পেলেন। তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। তার কি ঘ্রাণ শক্তি ফিরে আসছে? কুড়ি বছর পূর্ণ হতে বেশি বাকি নেই, এই জন্য কি কিছু কিছু ইচ্ছা পূর্ণ হতে শুরু করেছে? ফরহাদ উদ্দিন আরেকটা দশ টাকার নোট বের করে আরো পাঁচটা মাল কিনলেন। তাঁর শরীর কাঁপছে। আশ্চর্য ঘটনা। ফুলের মালাগুলো দ্বিতীয়বার নাকের কাছে ধরলেন। কোনো গন্ধ পাওয়া গেল না। একটু আগে যে সুঘ্রাণ পেয়েছিলেন এটা কি মনের ভুল? মনের ভুল হবার তো কথা না।

আশেপাশে কোথাও কি কোনো ডাস্টবিন আছে? যার পাশ দিয়ে যাবার সময় লোকজন নাক চেপে যায়? ফুলের তীব্র গন্ধ না পেলেও ডাস্টবিনের তীব্র পুতিগন্ধ নাকে আসার কথা। ফরহাদ উদ্দিন ডাস্টবিন খুঁজতে লাগলেন। ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবেন  নাকে কোনো গন্ধ আসে কিনা পরীক্ষা হয়ে যাবে। এই পরীক্ষা জটিল পরীক্ষা—এসিড টেস্ট। যখন যা খোজা যায় তখন সেটা পাওয়া যায় না। ফরহাদ উদ্দিন হেঁটে যাচ্ছেন কিন্তু চোখে কোনো ডাস্টবিন পড়ছে না। বেছে বেছে কি আজই ঢাকা শহর আবর্জনা মুক্ত হয়ে গেল?

তার বাসার কাছেই ময়লা ফেলার জায়গা একটা আছে। সানসাইন ভিডিওর দোকানটার বামে। লোকজন নাকে রুমাল না দিয়ে ঐ জায়গাটা পারই হতে পারে না। ফরহাদউদ্দিন ঠিক করলেন আজ তিনি সানসাইন ভিডিওর দোকানের আশেপাশে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করবেন। ইস্তিয়াক বলেছিল হাসনাত নামের মানুষটা ছিল সানসাইন ভিডিওর মালিক। দোকানটার দিকে তিনি লক্ষ রাখছেন। কিছুদিন বন্ধ ছিল, এখন খুলেছে। লোকজন ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে ঢুকছে, বের হচ্ছে। মালিকের মৃত্যুতে ব্যবসা বন্ধ হয় নি। ব্যবসা চলছে। এমনকি হতে পারে দোকানের লোকজন তাদের মৃত মালিকের ছবি দোকানে টানিয়ে রেখেছে। তাহলে হাসনাত নামের লোকটা দেখতে কেমন ছিল জানা যেত।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মৃত মালিকের ছবি টানিয়ে রাখার রেয়াজ নেই, এতে ব্যবসা কমে যায়; তারপরেও ফরহাদ উদ্দিন কিছু কিছু জায়গায় এরকম দেখেছেন। শাপলা টেইলারিং হাউসে স্যুট টাই সানগ্লাস পরা একটা ছবি আছে।

ছবির নিচে লেখা

শাপলা টেইলারিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা
মাস্টার টেইলার আজিজ মিয়া
 মৃত্যু ৭ই আগস্ট ১৯৮২

সানসাইন ভিডিওর দোকানটা তালাবদ্ধ। হাসনাত সাহেবের লোকজন ব্যবসা ঠিকমত দেখছে না। ভিডিও ব্যবসার আসল সময় হচ্ছে সন্ধ্যা। এই সময়ে দোকানে তালা দিয়ে চলে গেলে কীভাবে হবে।

ফরহাদ উদ্দিন ডাস্টবিনের দুদিক দিয়ে দুবার গেলেন। কোনো গন্ধ পেলেন না। তারপর একটু হেঁটে সানসাইন ভিডিওর বারান্দায় গিয়ে উঠলেন। অফিস থেকে হেঁটে এই পর্যন্ত এসেছেন। খুবই ক্লান্তি লাগছে। এটা যদি ভিডিওর দোকান না হয়ে চায়ের দোকান হতো তিনি এক কাপ চা খেয়ে যেতেন। বাড়িতে চা খাওয়ার একরকম মজা আবার চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়ার অন্য রকম মজা। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ যে মেঘলা হয়ে ছিল এতক্ষণ খেয়াল হয় নি। শহরবাসীরা আকাশের দিকে তাকায় না। ফরহাদ উদ্দিন বুঝতেও পারেন নি আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখতে মাখতে তিনি বাসার দিকে রওনা হলেন। তিনি এগুচ্ছেন অনাগ্রহের সঙ্গে। বাসায় ফিরতে তাঁর ইচ্ছা করছে না। যদিও খুব ক্লান্ত লাগছে তবু বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শহরে ঘুরতে ইচ্ছা করছে। বদরুলের পাল্লায় পড়ে এক ভাদ্রমাসে এ রকম কাণ্ড করেছিলেন। তারা দুজনই তখন কিশোরগঞ্জে বেড়াতে গিয়েছেন। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া করে পান মুখে দিয়েছেন, হঠাৎ টিপ টিপ করে বৃষ্টি নামল। বদরুল বলল, এই আয় বৃষ্টিতে ভিজি।

ফরহাদ উদ্দিন খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, এখন বৃষ্টিতে ভিজব কেন?

বদরুল বলল, বৃষ্টিতে ভেজার কোনো সময় আছে নাকি? বৃষ্টিতে যখন তখন ভেজা যায়। ভাদ্রমাসের বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকবে না—আয় তো নামি।

বদরুলের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া অতি কঠিন কর্ম। তাঁকে বৃষ্টিতে নামতেই হলো। বদরুল বলল, আয় একটা প্রতিজ্ঞা করি—বৃষ্টি যতক্ষণ থাকবে। ততক্ষণ আমরা গায়ে বৃষ্টি মাখব। পাঁচ মিনিট থাকলে পাঁচ মিনিট। একঘণ্টা থাকলে এক ঘণ্টা। তাঁকে প্রতিজ্ঞাও করতে হলো। সেই বৃষ্টি আর থামেই না। সন্ধ্যার পর থেকে আকাশে মেঘের ওপর মেঘ জমতে শুরু করল। ঝড়ো বাতাস বইতে লাগল। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। যে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন তারা অস্থির হয়ে গেল—মুরুব্বি শ্রেণীর একজন ছাতা হাতে বের হয়ে এসে বললেন—এ-কী পাগলামি করছেন? অসুখে পড়বেন তো।

ততক্ষণে ফরহাদ উদ্দিনের কেমন রোখ চেপে গেছে–শেষ পর্যন্ত কী হয় দেখা যাক। কিশোরগঞ্জের যে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন সেই বাড়ির বড় মেয়ের সঙ্গেই বদরুলের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের আসরে রব উঠেছিল—জামাই পাগল। পাগলের সঙ্গে বিবাহ মুসলিম আইনে সিদ্ধ না। তাতে সমস্যা হয় নি।

ফরহাদ উদ্দিন ঠিক করে রেখেছেন যদি সত্যি সত্যি কোনো একদিন বদরুল ফিরে আসে তাহলে পুরনো দিনের মতো বৃষ্টিতে ভেজার ব্যবস্থা করা হবে। এখন তো আর যৌবনকাল নেই—জ্বর জ্বারি হবে। হলে হবে।

অনেকক্ষণ কলিংবেল টেপার পর রাহেলা এসে দরজা খুলে দিলেন। ফরহাদ উদ্দিন বললেন, বাসায় কেউ নেই?

রাহেলা খুশি খুশি গলায় বললেন, ঐ ছেলে এসে সব মেয়েদের নাটক দেখাতে নিয়ে গেছে। আমাকেও নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। আমাকে এসে বলল, আম্মা আপনিও চলেন। আমি লজ্জায় বাঁচি না।

লজ্জার কী আছে?

বিয়ে হয় নি এখনি মা ডাকছে লজ্জা লাগবে না? এমনভাবে ধরেছিল একবার ভাবলাম চলেই যাই। কোনোদিন মঞ্চ নাটক দেখি নি।

গেলেই পারতে।

তুমি অফিস থেকে এসে দেখবে বাসায় কেউ নেই। আচ্ছা তোমার গা থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে কীসের?

বেলি ফুলের।

ফরহাদ উদ্দিন পকেট থেকে বেলি ফুল বের করলেন। রাহেলার মুখটা সঙ্গে সঙ্গে আহ্লাদী ধরনের হয়ে গেল। গলার স্বরও ভারী হয়ে গেল। তিনি আদুরে গলায় বললেন, সেই কবে তোমাকে বেলি ফুল আনতে বলেছিলাম এতদিন পরে মনে পড়ল। তবে আজকে এনে ভালোই করছে। মেয়েরা কেউ বাসায় নেই। খোঁপায় বেলি ফুলের মালা দিয়ে রাখলে ওরা হাসাহাসি করতে পারবে না। কাঁচা দুধে বেলি ফুল চুবিয়ে রাখলে ফুলের গন্ধ দুধে চলে যায় এটা জানো?

না।

ঐ দুধ দিয়ে পায়েস রাঁধলে পায়েসে বেলি ফুলের গন্ধ হয়। তোমাকে একদিন বেলি-পায়েস খাওয়াব।

আচ্ছা।

আমি ভেবেছিলাম তোমাকে যে বেলি ফুল আনতে বলেছিলাম তুমি ভুলেই গেছ। আমার কোনো কিছু তো তোমার মনে থাকে না। আমি তো আর তোমার প্রথম স্ত্রীর মতো রূপবতীও না। গায়ের রঙ কালো।

ফরহাদ উদ্দিন লক্ষ করলেন রাহেলার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি খুবই অবাক হলেন সামান্য কয়েকটা বেলি ফুল পেয়ে কেউ এত খুশি হতে পারে? তিনি যে রাহেলার কথা মনে করে বেলি ফুল কিনেছেন তাও না। ফরহাদ উদ্দিনের লজ্জা লাগছে। এই সত্যি কথাটা তো গোপন রাখা ঠিক হচ্ছে না। রাহেলার তার সম্পর্কে ভুল ধারণা হচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিন বিব্রত গলায় বললেন, রাহেলা কিছু মনে করো না। বেলি ফুলগুলি তোমার কথা মনে করে কিনি নি। তুমি আমার সম্বন্ধে ভুল ধারণা করছ। ভাবছ আমি সব মনে করে রাখি। এটা ঠিক না।

রাহেলা বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি একটু সঞ্জুর ঘরে যাও তো। ওর মনে হয় শরীর খারাপ। সকালবেলা লুঙ্গি পরে বাসা থেকে বের হয়েছে সারাদিন ফিরে নি। তুমি আসার ঘণ্টা দুএক আগে ফিরেছে। বাতি জ্বালায় নি। চা-নাশতা কিছুই খায় নি। যে রকম দিয়েছিলাম সে রকম পড়ে আছে।

ফরহাদ উদ্দিন দ্রুত ছেলের ঘরের দিকে গেলেন। সঞ্জু সরলরেখার মতো খাটে শুয়ে আছে। তার গায়ে চাদর। সঞ্জু থমথমে গলায় বলল, বাবা বাতি জ্বালিও না।

ফরহাদ উদ্দিন উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে? জ্বর না-কি?

জানি না। কপালে হাত দিও না।

কপালে হাত না দিলে বুঝব কি করে জ্বর কি-না।

বোঝার দরকার নেই।

জ্বর বেশি হলে ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার, মাথায় পানি ঢালা দরকার।

তুমি ব্যস্ত হয়ো না বাবা। ব্যস্ত হবার মতো কিছু হয় নি।

সঞ্জুর ঘরে বাতি নেই, কিন্তু বারান্দার আলো এসে ঘরে পড়েছে। সে আলোতে দেখা যাচ্ছে সঞ্জুর মুখ রক্তশূন্য। ঠোঁট ফ্যাকাশে। চোখের নিচে মনে হয় কালি পড়েছে। ফরহাদ উদ্দিন বললেন–একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসি।

না।

এরকম করছিস কেন রে ব্যাটা? আমি তো তোর খুব কাছের একজন মানুষ দূরের তো কেউ না।

সঞ্জু চাপা গলায় বলল, বাবা আমার খুব মাথা ধরেছে। আমাকে একা একা চুপচাপ শুয়ে থাকতে দাও—মাথার যন্ত্রণাটা কমুক।

মাথায় হাত বুলিয়ে দেই? মাথা ধরা আরাম হবে।

না। বাবা তুমি আমার সামনে বসে থেকো না তো।

 ফরহাদ উদ্দিন উঠলেন না। বসে রইলেন। তাঁর কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হচ্ছে যে তাঁর ছেলে এত বড় হয়েছে। লম্বা করে শুয়েছে–খাটের একেবারে এ মাথা ওমাথা। অথচ সেদিনই তো ছোট্ট ছিল। রাহেলাকে যখন বিয়ে করেন তখন সঞ্জুর বয়স ছ বছর। তিনি আর রাহেলা থাকেন এক ঘরে, সঞ্জু থাকে পাশের ঘরে। মাঝখানের দরজাটা খোলা থাকে। যেন ছেলে রাতে ঘুম ভেঙ্গে ভয় না পায়। প্রায় রাতেই বুকে একটা চাপ ব্যথা নিয়ে ফরহাদ উদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে যেত। বুকে চাপ ব্যথার কারণ হচ্ছে সঞ্জু পাশের ঘর থেকে চলে এসেছে। সে তার অভ্যাস মতো গলা জড়িয়ে বাবার বুকের ওপর নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে।

ফরহাদ উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে রওনা হলেন। তখন তাকে বিস্মিত করে সঞ্জু ডাকল–বাবা, একটা কথা শুনে যাও। ফরহাদ উদ্দিন আবারো এসে চেয়ারে বসলেন। সঞ্জু বলল বাবা তুমি মনে কষ্ট পাচ্ছ কেন? আমার যে কাজটার জন্যে তুমি কষ্ট পাচ্ছ সেই কাজটা আমি করি নি। আজ হোক কাল হোক পুলিশ ভুল স্বীকার করবে। এখন আমার কথা কি তোমার কাছে যথেষ্ট না?

ফরহাদ উদ্দিন গাঢ় স্বরে বললেন, যথেষ্ট।

সঞ্জু বলল, এখন তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘরে গিয়ে ঘুমাও। কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখতে চাচ্ছিলে—জ্বর দেখ।

ফরহাদ উদ্দিন ছেলের কপালে হাত রাখলেন। সঞ্জুর গায়ে জ্বর। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এত জ্বর নিয়ে ছেলেটা শান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। মায়ায় ফরহাদ উদ্দিনের মনটা ভরে গেল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ