পুতুল – হুমায়ূন আহমেদ

উৎসর্গ
নীলু, কল্যাণীয়াসু

কত না দিন রাতি
তুমি ছিলে আমার খেলার সাথী’

.

০১.

পুতুলের ঘর থেকে তাদের বাগানটা দেখা যায়। এত সুন্দর লাগে তার! শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তাদের বাগান অন্যদের বাগানের মতো নয়। তিনটা বিশাল বড়ো বড়ো গাছ, একটা রেনট্রি গাছ। এত বড়ো যে মনে হয় এই গাছের পাতাগুলো আকাশে লেগে গেছে। আর দুটি হচ্ছে কদম ফুলের গাছ। কদম ফুলের গাছ দুটি পাশাপাশি–যেন দুই জমজ বোন, এক জন অন্য জনের গায়ে হেলান দিয়ে আছে। বর্ষাকালে গাছ দুটিতে কী অদ্ভুত ফুল ফোটে। সোনার বলের মতো ফুল।

পুতুলের মা জেসমিন কদম ফুলের গাছ দুটি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। কারণ হচ্ছে শুয়োপোকা। কদম গাছে খুব শুয়োপোকা হয়। আর শুয়োপোকা দেখলেই জেসমিনের বমি পেয়ে যায়। তিনি প্রতি শীতকালে একবার করে বলেন–গাছগুলো কাটিয়ে ফেলা দরকার। শেষ পর্যন্ত কেন জানি কাটা হয় না। দেখতে দেখতে বর্ষা এসে যায়। অদ্ভুত কদম ফুলগুলো ফোটে। কী যে ভাল লাগে পুতুলের!

এখন শীতকাল। ক’দিন আগে ঠিক করা হয়েছে বড়ো বড়ো গাছগুলো সব কেটে ফেলা হবে। জেসমিন বজলু মিয়া বলে একটি লোককে ঠিক করেছেন। লোকটির মুখে বসন্তের দাগ। তার একটা চোখও নষ্ট। ভালো চোখটি দিয়ে সে সবার দিকে বিশ্রীভাবে তাকায়। বজলু মিয়া গতকাল এসে বড়ো বড়ো গাছগুলো সব দেখে গেছে। দড়ি দিয়ে কি সব মাপ– টাপও নিয়েছে। বলে গেছে সোমবারে লোজন নিয়ে আসবে।

পুতুলের এই জন্যেই খুব মন খারাপ। গাছগুলোর দিকে তাকালেই। তার কান্না পেয়ে যায়। বাগানে এলেই সে এখন গাছগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে কি সব কথা বলে। হয়তো-বা সান্ত্বনার কোনো কথা। আজও তাই করছিল। গাছের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে সে লক্ষ করল তার বাবা বাগানে হাঁটছেন। তাঁর হাতে একটা ভাঁজ-করা খবরের কাগজ। তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে খুব রেগে আছেন। খুব রেগে গেলে তিনি এ রকম গম্ভীর হয়ে যান। বাগানে কিংবা ছাদে মাথা নিচু করে হাঁটেন। পুতুলের মনে হল আজ বোধ হয় বাবা-মা’র মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। এই একটা খারাপ ব্যাপার। দু’দিন পর পর তাঁরা ঝগড়া করেন। ঝগড়া করবে ঘোটরা। আড়ি দেবে–ভাব নেবে। বড়োরা এ রকম করবে কেন?

পুতুল ছোট ঘোট পা ফেলে রেনট্রি গাছটার দিকে যাচ্ছে। তার চোখ বাবার দিকে। বাবা কতটা রেগে আছেন সে বুঝতে চেষ্টা করছে। পুতুলের বয়স এগারো। এই বয়সের ছেলেরা চারদিকে কি হচ্ছে না-হচ্ছে খুব বুঝতে চেষ্টা করে।

রহমান সাহেব পুতুলকে রেনট্টি গাছটার দিকে যেতে দেখলেন। কিছু বললেন না। তিনি জানেন, এই গাছের নিচে পুতুল প্রায়ই এসে বসে। এটা সম্ভবত পুতুলের কোনো গোপন জায়গা। সব শিশুদের কিছু গোপন জায়গা থাকে। তাঁর নিজেরও ছিল। পুতুলকে দেখে মাঝে মাঝে তাঁর নিজের শৈশবের কথা মনে হয়। তবে তিনি পুতুলের মতো নিঃসঙ্গ ছিলেন না। অনেক ভাইবোনের মধ্যে বড় হয়েছেন। তাঁদের বাড়িটা ছিল হৈচৈ হুল্লোড়ের বাড়ি। নিজের ভাইবোন ছাড়াও চাচাতো ভাইবোন, ফুপাতো ভাইবোন, পাড়ার ছেলেপেলে। সারাদিন চিৎকার চেঁচামেচি হৈচৈ।

রহমান সাহেব রোদে পিঠ দিয়ে বসলেন। বসতে হল ঘাসে। এমন ভাবে বসেছেন যেন পুতুল কী করছে দেখা যায়। তিনি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন, পুতুল কী করে না-করে খবর রাখতে পারেন না। ছেলেটা খুবই একা। তাকে আরো কিছু সময় দেওয়া দরকার। তা তিনি দিতে পারছেন না। তিনি মৃদু গলায় ডাকলেন, পুতুল।

জ্বী বাবা?

কী করছ তুমি?

কিছু করছি না। কাছে আস।

পুতুল ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসছে। তিনি লক্ষ করলেন, পুতুলের খালি পা। অথচ তাকে অনেক বার বলা হয়েছে খালি পায়ে বাগানে না আসতে। গায়েও পাতলা একটা শার্ট ছাড়া কিছু নেই। শীতের সকালবেলা পাতলা একটা জামা পরে কেউ থাকে? রহমান সাহেব খুব বিরক্ত হলেন। বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। ছেলেটা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। এ রকম হাসিমুখের একটি ছেলেকে ধমক দিতে মায়া লাগে।

তুমি প্রায়ই ঐ রেনট্রি গাছটার নিচে বসে থাক। কী কর ওখানে?

কিছু করি না। বসে থাকি।

কিছু নিশ্চয়ই কর। শুধু শুধু কি কেউ বসে থাকে?

পুতুল লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। তার হাসি বলে দিচ্ছে সে শুধু শুধু বসে থাকে না। রহমান সাহেব বললেন, বসে বসে ভাব, তাই না?

হ্যাঁ  ভাবি।

কী নিয়ে ভাব?

পুতুল উত্তর না দিয়ে আবার লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। রহমান সাহেবের ইচ্ছে করল ছেলেটাকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। মাথা ভর্তি রেশমের মতো চুল। দেখলেই হাত বোলাতে ইচ্ছে করে।

আজ তোমার শরীর কেমন?

ভালো।

কী রকম ভালো সেটা বল–খুব ভালো, না অল্প ভালো–নাকি মন্দের ভালো।

খুব ভালো।

আচ্ছা ঠিক আছে। যাও–যা করছিলে কর।

পুতুল গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছে তার কিছু বলার আছে। কিছু বলতে চাচ্ছে অথচ বলতে পারছে না। রহমান সাহেবের খানিকটা মন খারাপ হল। এত বাচ্চা একটি ছেলে, সে কেন মনের কথাগুলো সহজভাবে বাবা-মা’কে বলতে পারবে না। তিনি নরম গলায় বললেন, পুতুল তুমি কি কিছু বলতে চাও?

পুতুল মাথা নাড়ল। সে বলতে চায়। রহমান সাহেব বললেন, কী বলতে চাও বাবা?

গাছগুলো কেন কাটবে?

গাছ কাটা তোমার পছন্দ নয়?

না।

ছোটরা অনেক কাজ করে, যেগুলো বড়োরা পছন্দ করে না। আবার ঠিক তেমনি বড়োরা অনেক কাজ করে যা ঘোটরা পছন্দ করে না। গাছগুলোতে শুয়োপোকা হয়, তোমার মা এই পোকাটা সহ্য করতে পারেন না।

পুতুল চুপ করে রইল। রহমান সাহেব বললেন, তাছাড়া আরেকটা কারণও আছে। গাছগুলোর জন্যে ঘরে আলো-হাওয়া তেমন ঢুকতে পারে না। এখন দেখবে প্রচুর রোদ আসবে। এখন যাও, যা করছিলে কর।

পুতুল তার আগের জায়গায় ফিরে গেল। বাবা তাকে ধমক দিয়ে কিছু বলেন নি, এজন্যে তার খুব ভালো লাগছে। অবশ্যি কেউ তাকে ধমক দিয়ে কিছু বলে না। তার শরীর ভালো নয়, এই জন্যে। এ বাড়িতে যে আসে সেই বলে, তোমার শরীর কেমন পুতুল? বলেই খুব করুণ করে তাকায়। পুতুলের বিশ্রী লাগে। করুণ করে কেন তাকাবে? সে কি কাউকে বলেছে। করুণ করে তাকাতে?

পুতুল দেখল চায়ের কাপ হাতে মা বাগানে আসছেন। মা’র মুখ গম্ভীর। হয়তো বাবার সঙ্গে ঝগড়া করবেন। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করার সময় বা ঝগড়ার ঠিক আগে মা’র মুখ এমন গম্ভীর থাকে। গম্ভীর থাকলেও মা’কে খুব সুন্দর লাগে পুতুলের। মা হচ্ছেন পরীর মতো সুন্দর। এখন তিনি পরেছেন একটা নীল শাড়ি। সকালবেলার রোদে নীল শাড়িতে কী সুন্দর লাগছে তাঁকে! মনে হচ্ছে সত্যি একটা নীল পরী। পুতুলদের বাগানে বেড়াতে এসেছে। কিছুক্ষণ বেড়াবে, নাচবে, গান গাইবে, তারপর আকাশে উড়ে চলে যাবে।

জেসমিনের আজ খুব মেজাজ খারাপ। কাজের মেয়েটা একটা কুকাণ্ড করেছে। বেলজিয়াম থেকে আনা কুকি জার’টা ভেঙে ফেলেছে। তাঁর খুব সখের জিনিস। টাকা খরচ করলেই এসব জিনিস পাওয়া যায় না।

বাগানে এসে তাঁর মেজাজ আরো খারাপ হল। তিনি দেখলেন পুতুল মাটিতে কী সব আঁকাআঁকি করছে। পায়ে জুতো স্যান্ডেল কিছু নেই। গায়ে পাতলা একটা শার্ট। কে জানে হয়তো শার্টের নিচে গেঞ্জিও নেই।

পুতুল।

জ্বি মা?

মাটি ছানছ কেন? মাটি দিয়ে এটা কী ধরনের খেলা?

পুতুল চুপ করে রইল। তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কেউ কড়া কোনো কথা বললে তার কান্না পেয়ে যায়।

পা খালি কেন? এগারো বছর বয়স হয়েছে, এখনো সব শিখিয়ে দিতে হবে? সকালে নাশতা খেয়েছ?

হ্যাঁ।

কী খেয়েছ?

পরিজ, ডিম, কলা, একটা রুটি-মাখন।

দুধ খাও নি?

না।

কেন খাও নি জানতে পারি?

পরিজ দুধ দিয়ে খেয়েছি তাই …

পরিজ তো দুধ দিয়েই খায়। পরিজ কি কেউ পানি দিয়ে খায়? তোমাকে কি বলা হয় নি সমস্ত দিনে দু’গ্লাস দুধ খেতে হবে? সকালে এক গ্লাস, রাতে ঘুমুতে যাবার সময় এক গ্লাস।

পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিন বিরক্ত মুখে বললেন, যাও, সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধোও। দুধ খাও আর একটা সোয়েটার গায়ে দাও। আমি যা যা অপছন্দ করি তুমি বেছে বেছে সেই সব কর। খুব অন্যায়।

পুতুল চলে যেতেই জেসমিন রহমান সাহেবের দিকে তাকালেন। খুব বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি মাটিতে বসে আছে কেন?

এমনি বসলাম।

তোমাকে দেখে তোমার ছেলে এইসব শিখছে। কাউকে বললেই তো বাগানে একটা চেয়ার এনে দিত। এমন তো না যে ঘরে লোকজনের অভাব।

রহমান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। জেসমিন তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এই তো পাজামায় দাগ লাগিয়ে ফেলেছ।

একটু-আধটু দাগ লাগলে কিছু হয় না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে মেজাজ খারাপ না করাই ভালো। আমার সঙ্গে ঝগড়া যদি করতেই হয়, বড়ো কোনো ব্যাপার নিয়ে কর।

তার মানে?

রহমান সাহেব হেসে ফেললেন। বারান্দায় ইয়াসিন এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি হাতের ইশারায় ইয়াসিনকে দুটি চেয়ার দিয়ে যেতে বললেন। ইয়াসিন সঙ্গে সঙ্গে দুটি বেতের চেয়ার দিয়ে গেল। রহমান সাহেব শান্ত গলায় বললেন, বস জেসমিন একটা জরুরী ব্যাপার নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করি।

কী জরুরী ব্যাপার?

আগে বস, তারপর বলছি।

বসতে-টসতে পারব না। যা বলার বল।

তোমার কি মনে হয় না পুতুল খুব একা একা থাকে?

একা একা থাকবে কেন? বাড়িতে প্রচুর লোকজন আছে। তা আছে, তবু আমার মনে হয় ও একটু একা। আমি তাকে সময় দিতে পারি না। তুমি ব্যস্ত থাক তোমার কাজকর্ম নিয়ে।

তুমি কি চাও আমি সব ছেড়েছুঁড়ে ছেলে কোলে নিয়ে সারাদিন বাসায় থাকি?

না-না, তা চাইব কেন? আমাদের সবারই তো নিজের কাজ আছে। তবুও অসুস্থ ছেলে, ঠিকমতো যদি …

তুমি কি বলতে চাও আমি ঠিকমতো ওর যত্ন নিই না?

পুতুল দুধ খেতে খেতে শুনল মা-বাবা দু জনই খুব উঁচু গলায় কথা বলছেন। সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আজ ছুটির দিন। ছুটির দিনের এমন চমৎকার সকালে কেউ এ-রকম করে কথা বলে?

দুধ খেতে তার বিশ্রী লাগছে। প্রায় বমি চলে আসছে। উপায় নেই, খেতে হবে। খাওয়া জিনিসটা যদি পৃথিবী থেকে উঠে যেত কি চমৎকার হত। এ রকম একটা দেশ যদি থাকত, যেখানে কাউকে কিছু খেতে হয় না–বিশেষ করে দুধ।

রমিলা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। পুতুল করুণ গলায় বলল, খেতে পারছি বুয়া। রমিলা বলল, না খাইলে আম্মা রাগ হইব। কষ্ট কইরা খাইয়া ফেল গো সোনাচান।

বমি চলে আসছে। বেসিনে ফেলে দিই?

আম্মা জানতি পারলে সর্বনাশ।

মা জানবে না।

বলতে বলতে পুতুল দুধের গ্লাস বেসিনে উল্টো করে দিল। ঠিক তখন জেসমিন ঢুকলেন। ব্যাপারটা তিনি লক্ষ করলেন। পুতুলের বুক ধুকধুক করছে। হাত-পা ঘামছে। কে জানে হয়তো মা বুঝে ফেলেছেন।

পুতুল।

জি মা?

আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে সন্ধ্যা হবে।

আচ্ছা।

তোমার একা একা লাগবে না তো?

উঁহু।

উঁহু আবার কেমন শব্দ? বল–না।

না।

লক্ষ্মী হয়ে থাকবে সারাদিন।

আচ্ছা।

খেলবে, গল্পের বই পড়বে। বিকেলে তোমার ছোটমামা এসে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে।

আচ্ছা।

গল্পের বই আছে তো তোমার? মানে নতুন গল্পের বই-পড়া হয় নি এমন।

আছে, লাল কমল নীল কমল।

খুব ভালো। বসে বসে লাল কমল নীল কমল পড়। আজ আরো কিছু নতুন বই কিনে দেব। খিদে পেলে বুয়াকে বলবে, সে স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে দেবে।

আচ্ছা।

মা লাল রঙের গাড়িটা নিয়ে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বেরুলেন বাবা। মা তার গাড়ি নিজেই চালান। বাবা কখনো নিজে চালান না। বাবার সাদা ডাটসান ড্রাইভার চাচা চালায়। যাবার আগে বাবা সব সময় তাকে আদর করেন। অদ্ভুত আদর। দু আঙুলে পুতুলের নাক চেপে বলেন–

কুটু কুটু পুটু পুটু ইট পুট
পুতুল সোনা খুটখুট।
ঔ ঔ হৈ চৈ
পুতুল সোনা কৈ কৈ?

তিনি এমন শক্ত করে নাক চেপে ধরেন যে পুতুলের রীতিমতো ব্যথা করে, তবু বাবার আদর এত ভালো লাগে! তার ইচ্ছে করে বাবা সারাক্ষণ তার নাক চেপে ধরে, এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলুক। মা’র আদরও তার খুব ভালো লাগে। মা আদর করেন ঘুমুতে যাবার আগে। কিছুক্ষণ মাথায়

বিলি কেটে বলেন, এত সুন্দর চুল কেন তোমার বল তো? শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে। এই বলে তিনি তার কপালে চুমু খেয়ে গল্প বলা শুরু করেন। কী যে সুন্দর সে সব গল্প। শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। মা অবশ্যি একটার বেশি গল্প কখনো বলেন না। গল্প শেষ হওয়া মাত্র নীল বাতি জ্বালিয়ে মশারি ঠিকঠাক করে বলেন, গুড নাইট পুতুল সোনা।

গুড নাইট মা মনি।

সুইট ড্রিমস।

সুইট ড্রিমস মা মনি।

আজ বাবা চলে যাবার সময় পুতুলকে আদর করেন নি। হয়তো মনে ছিল না। সব সময় কি আর আমাদের সব কিছু মনে থাকে? পুতুল লাল কমল নীল কমল বই নিয়ে রেনট্রি গাছের নিচে গিয়ে বসল। ঠিক তখন দেখল, বাবার গাড়ি ফিরে আসছে। এত তাড়াতাড়ি বাবা চলে এলেন! এক মিনিটও তো হয় নি বাবা গিয়েছেন।

রহমান সাহেব ফিরে এসেছেন ছেলেকে আদর করবার জন্যে। তাঁর গাড়ি যখন বড়ো রাস্তায় পড়েছে, তখনি মনে হয়েছে একটা ছোট্ট ভুল করা হল। বাচ্চারা এইসব জিনিস খুব মনে রাখে। ছোটবেলায় তাঁকে ঠিক একই ভাবে আদর করতেন মতি চাচা। দু আঙুলে নাক চেপে গ্রাম্য একটা ছড়া বলতেন–

নিমের পাতা তিতা রে
জামের পাতা নীল।
গাঙের পারে বইয়া বইয়া
গাঙের পানি গিল।

বলতেন অতি দ্রুত। কথাগুলো পরিষ্কার বোঝা যেত না, কিন্তু শুনতে এত সুন্দর লাগতো। যতবার মতি চাচা তাদের বাড়িতে আসতেন, তত বারই এই ঘটনা ঘটত। শুধু একবার ঘটল না। মতি চাচা ভুলে গিয়েছিলেন। হয়তো। তার কী যে কষ্ট হয়েছিল। মনে আছে কষ্টের তীব্রতায় খাটের নিচে বসে তিনি খানিকক্ষণ কেঁদেও ছিলেন। শিশুরা খুব অভিমানী হয়। পুতুলও আজ হয়তো মন খারাপ করে আছে। কে জানে হয়তো-বা কাঁদছে।

তাছাড়া গাছ কাটার ব্যাপারে তার মনে একটা খটকা লেগেছে। হয়তো এটা নিয়ে সে বেশ কষ্ট পাচ্ছে। ভালোমতো আলোচনা করে এই কষ্টটাও দূর করা উচিত। দরকার হলে গাছ কাটা পিছিয়ে দিতে হবে। অবশ্যি জেসমিন তাতে রাজি হবে না।

.

তিনি লক্ষ্য করছেন পুতুল রেনট্রি গাছের নিচে বই হাতে বসে আছে। চোখ বড়ো বড়ো করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

পুতুল।

জ্বি বাবা।

কাছে আস।

পুতুল সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল। ঠিক তখনই টেলিফোন বাজল। রহমান। সাহেব টেলিফোন ধরতে ভেতরে চলে গেলেন। টেলিফোন এসেছে জয়দেবপুর থেকে। তার মোল্ডিং কারখানায় কী সব ঝামেলা হচ্ছে। শ্রমিকরা ওভারটাইম চেয়ে হাঙ্গামা বাধিয়েছে, এক্ষণি যাওয়া দরকার। তিনি মুখ অন্ধকার করে বেরিয়ে গেলেন। যার জন্যে এসেছিলেন, তা-ই করা হল না। পুতুলকে আদর করতে আবার ভুলে গেলেন।

রোদ বেশ কড়া। পুতুলের গরম লাগছে। শার্ট খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করলেও খোলা যাবে না। খালি গায়ে থাকা খুব অভদ্রতা। মা জানলে খুব রাগ করবেন। পুতুল বই খুলে পড়তে শুরু করল–

অনেক কাল অনেক কাল আগে বনের ধারে বাস করতেন এক রাজা। সেই রাজার দুই পুত্র–নীল কমল, লাল কমল। এই দু জন রাজার দু চোখের মণি। এরা চোখের আড়াল হলে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। যখন সিংহাসনে বসেন, তার দু পুত্রকে দু পাশে বসান। যখন খেতে বসেন তখনো দু ভাই দু’ পাশে। রানী সোনার থালা থেকে মাছের মুড়ো তুলে দেন রাজার পাতে। রাজা সেই মুড়ো দু’ ভাগ করে তুলে দেন দুই ছেলের থালায়। এইসব দেখে রানী ছটফট করেন হিংসায়। কারণ তিনি আসল মা– নন। তিনি লাল কমল আর নীল কমলের সত্য। এই দু জন তাঁর চোখের বালি, গলার কাঁটা। দিন-রাত ফন্দি করেন কী করে এই দু’ জনকে দূর কোনো দেশে নির্বাসন দেওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে একদিন তাঁর মাথায় বুদ্ধি এল। খাটে শুয়ে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগলেন। রাজা ছুটে এসে। বললেন–

কী হয়েছে রানী?

রানী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমি আর বাঁচব না গো, আমার হাড় মুড়মুড়ি ব্যারাম হয়েছে।

সে আবার কী!

এই ব্যারামে শুধু হাড় মুড়মুড় করে–ওগো, আমি আর বাঁচব না গো।

এর কি কোনো অষুধ নেই?

অষুধ থাকবে না কেন? এক শ’ বার আছে। সতেরো নদী যে দেশে এক জায়গায় মিলেছে সেই দেশের রাজবাড়ির বাগানে আছে এক ডালিম গাছ। সেই ডালিম গাছে বছরে একটি মাত্র ডালিম হয়। ভয়ঙ্কর এক কালকেউটে সেই ডালিম পাহারা দেয়। ঐ ডালিম খেলেই আমার অসুখ সারবে।

তাহলে আর চিন্তা কি? ঐ ডালিম আনতে আজই আমি প্রধান সেনাপতিকে পাঠাচ্ছি।

তাতে কোনো লাভ হবে না মহারাজ। একমাত্র রাজার কুমাররাই ঐ ডালিম আনতে পারে। আর কেউ পারে না।

লাল কমল আর নীল কমলকে পাঠিয়ে দিই।

আহা, ওরা যে দুধের শিশু। তাছাড়া আমি ওদের সৎমা। সৎমার জন্যে কেউ কি আর এত কষ্ট করে?

শুনে লাল কমল আর নীল কমল বলল, আমরা করব। আমরা মা’র জন্যে ডালিম নিয়ে আসব।

রওয়ানা হল দুই রাজকুমার। কত পথ, কত গ্রাম, কত নগর, কত অরণ্য পার করে তারা চলছে তো চলছেই। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। যেতে যেতে যেতে যেতে তারা পৌঁছল মনা রাক্ষুসীর দেশে।

পুতুল মুগ্ধ হয়ে পড়েছে। রাজপুত্রদের দুঃখে তার চোখ ভিজে উঠছে। কী যে কষ্ট হচ্ছে। এমন রাগ লাগছে সস্তার ওপর। এত পাজি কেন সত্যটা? ভাগ্যিস তার সম্মা নেই।

সন্ধ্যাবেলা ছোটমামা এলেন। ছোটমামাকে পুতুলের ভালো লাগে। ছোটমামা খুব মজার মানুষ। সারাক্ষণই গল্পগুজব করেন। আজ করছেন না। কেমন যেন বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছেন।

কি রে পুতুল, কি করছিস?

কিছু করছি না মামা।

পিতা এবং মাতার দু’ জনেরই কোনো খোঁজ নেই! ব্যাপারটা কেমন হল বল তো?

পুতুল তাকিয়ে আছে। পুতুলের মামা নাজমুল তার বিরক্তি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আজ সন্ধ্যায় তার এক জায়গায় যাবার কথা। ছোটখাট উৎসবের ব্যাপার আছে। সেখানে যাওয়া যাছে না। পুতুলকে তার খুবই পছন্দ। কিন্তু আজকের দিনটিতে এ বাড়িতে থাকতে না পারলেই ভালো হত?

পুতুল।

জ্বি মামা?

একটা মুশকিল হয়ে গেল রে আমার যে এক জায়গায় যেতে হয়। চলে যাও।

তুই একলা একলা থাকবি?

মা সন্ধ্যাবেলায় এসে পড়বে।

আরে না। তার আসতে আসতে রাত ন’টা। লায়নেস ক্লাবে কি যেন মিটিং।

তুমি চলে যাও।

নাজমুল চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথার চুল টানতে লাগল। মামার চিন্তিত মুখ দেখে পুতুলের মায়া লাগছে আহা, বেচারা তাকে ফেলে যেতে পারছে না, আবার থাকতেও পারছে না।

পুতুল।

জ্বি মামা?

আমার সঙ্গে যাবি? চল তোকে নিয়েই না-হয় যাই। যাবি?

যাব।

পুতুলের চোখ আনন্দে দপ করে জ্বলে উঠল। মুখ হাসি হাসি। নাজমুলের আরো বেশি খারাপ লাগছে। এই অসুস্থ নিঃসঙ্গ ছেলেটাকে সঙ্গে নেওয়া ঠিক হবে না। আপা খুব রাগ করবে। পুতুলকে ঘর থেকে বের করতেই তার আপত্তি। পুতুলের হার্টের ভাল্বে কি জানি সমস্যা আছে সে কোনো রকম উত্তেজনা সহ্য করতে পারে না। এক তলা থেকে দোতলায় সিঁড়ি ভেঙে ওঠা পর্যন্ত নিষেধ। বুয়া কোলে করে তুলে দেয়। ফাইভ পর্যন্ত স্কুলে পড়াশোনা করেছে। এখন তাও বন্ধ। দু জন মাস্টার এসে তাকে ঘরে পড়ান। আগামী বছরের জানুয়ারিতে পুতুলের হার্টের ভাল্ব ঠিক করা হবে। আমেরিকার সিয়াটলের সেইন্ট লিউক হাসপাতালে। এখন তারই প্রস্তুতি চলছে।

মামা আমি কোন শার্টটা পরব?

নাজমুল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তোর যাওয়াটা ঠিক হবে না রে, তুই থাক। আমিও যাচ্ছি না। আয়, গল্পগুজব করি।

তোমার তো কাজ আছে, তুমি চলে যাও। আমার অসুবিধা হবে না।

সত্যি বলছিস?

হুঁ। গল্পের বই পড়ব–লাল কমল নীল কমল।

স্যার আসবে না আজ?

আজ তো ছুটির দিন।

ও আচ্ছা। মনেই ছিল না। আমি চলে যাব তাহলে?

যাও মামা।

মন খারাপ করবি না তো?

একটু করব। বেশি না। নাজমুল চলে গেল। পুতুল কিছুক্ষণ তার লেগো সেট নিয়ে খেলল। পিস্তল বানাল, এরোপ্লেন বানাল। খানিকক্ষণ টিভি দেখল। ছুটির দিনে টিভি দেখতে কোনো বাধা নেই। খুব বাজে কি একটা প্রোগ্রাম হচ্ছে টিভিতে। মোটা এক জন মানুষ চোখ বন্ধ করে একঘেয়ে স্বরে বলে যাচ্ছে–

দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নৈরাজ্য চলছে। সুকুমার কলার কিছু নীতিমালা আছে। কোনো কিছুই নিয়ম বহির্ভূত নয়। ভাঙতে হবে বলেই নিয়ম ভাঙা একটা ফ্যাসান। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ফ্যাশান আমদানির যৌক্তিকতা আমাদের ভাবতে হবে। …

পুতুল টিভি বন্ধ করে গল্পের বই নিয়ে বসল। লাল কমল নীল কমলের গল্প ভোরবেলা যতটা ভালো লেগেছিলো, এখন ততটা লাগছে না। কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে।

রাত ন’টা বাজতেই বুয়া তাকে ভাত খেতে ডাকল। সে নিঃশব্দে ভাত খেল। হাত-মুখ ধুয়ে ঠিক সাড়ে নটায় ঘুমুতে গেল। রমিলা বলল, আমি বারিন্দায় বইস্যা আছি। ভয়ের কিছু নাই।

আমি ভয় পাচ্ছি না তো, তুমি চলে যাও।

বাত্তি জ্বালান থাউক।

না বাতি নিভিয়ে দাও।

পুতুলের ঘুম আসছে না। কান পেতে আছে, কখন গেটে শব্দ হবে। সে বুঝতে পারবে বাবা-মা এসে পড়েছেন। সিঁড়িতে তাঁদের পায়ের শব্দ শোনা যাবে। মা ঘরে ঢুকে মশারি তুলে দেখবেন, পুতুল ঠিকমতো ঘুমুচ্ছে কি

অপেক্ষা করতে করতে পুতুল একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। তার বাবা-মা এলেন তারো অনেক পরে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ