খুব ভোরে পুতুলের ঘুম ভাঙল।

আধার ভালো করে কাটে নি। জানালার পাশে পাখি কিচমিচ করছে। বাগানে হাল্কা কুয়াশা। পুতুল নিঃশব্দে একতলায় নামল। বুয়া টেবিল সাজাচ্ছে রান্নাঘরে বাবুচি নিজের মনে কি সব কথা বলছে, আর ঘটাং ঘটাং শব্দ করছে।

রমিলা পুতুলকে দেখে বলল, খালি পাও ক্যান গো? আম্মা রাগ করব!

পুতুল হাসিমুখে বলল, দরজা খুলে দাও।

ক্যান?

বাগানে যাব। কুয়াশা দেখব।

রমিলা দরজা খুলে দিল। দোতলার জানালা থেকে মনে হচ্ছিল বাগানে কুয়াশা, এখানে এসে তা মনে হচ্ছে না। মালি সবে ঘুম থেকে উঠেছে। কয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মাজছে আর কালো রঙের থু থু ফেলছে। পুতুলেরও এ রকম কালো রঙের থু থু ফেলতে ইচ্ছে হল। চাইবে নাকি কয়লার গুড়ো?

মালি বলল, ফুল নিবা সোনাবাবু?

হ্যাঁ, নেব।

ফুল ছিড়া ঠিক না। গাছের জিনিস গাছে থাকন লাগে।

মালিটা কি অদ্ভুত! নিজেই বলছে ফুল নেবে কি না, আবার নিজেই বলছে, ফুল তোলা ঠিক নয়। আর কী অদ্ভুত একটা নামে সে পুতুলকে ডাকে–সোনাবাবু। সোনাবাবু আবার কেমন নাম!

পুতুল বলল,আজ কি সোমবার?

মালি দাঁত বের করে বলল, হ সোনাবাবু, আইজ সোমবার।

আজ গাছ কাটার লোক আসবে, তাই না?

হ। আম্মা আমারে কইলে আমি কাইট্টা দিতাম, এর জইন্যে আবার বাইরের লোক লাগে–কন দেহি সোনাবাবু?

পুতুল চুপ করে রইল। মালি বলল, ও সোনাবাবু।

কি?

শীত লাগে না?

না।

খালি গেঞ্জি গায়ে শীত লাগব। একটা শার্ট পর। আর জুতা।

সে ছোট ছোট পা ফেলে গেটের কাছে চলে এল। গেট তালাবন্ধ, তবে গেটের ভেতরেও একটা ছোট্ট গেট ছিল। সেটা ভোলা। দারোয়ান আশেপাশে নেই। বোধ হয় ঘুমুচ্ছে। সারারাত জেগে থাকে বলে সে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। পুতুল কি মনে করে যেন গেটের বাইরে চলে এল। কেউ তাকে দেখল না। সে ঝাঁঝরি থেকে পানি নিয়ে চোখে মুখে দিচ্ছে।

পুতুল কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। রোদ উঠেছে কী সুন্দর রোদ। দেখে মনে হচ্ছে এই রোদ চুমুক দিয়ে খাওয়া যায়। পুতুল রাস্তা পার হয়ে ও মাথায় গেল। তার পরপরই হঠাৎ কি মনে করে দ্রুত পা ফেলতে লাগল। একবার শুধু পেছন ফিরে তাদের বাড়িটা দেখল। কী সুন্দর, কী প্রকাণ্ড একটা বাড়ি! বাগানবিলাস লতিয়ে উঠেছে দোতলার ছাদ পর্যন্ত। দু’রকমের পাতা ছেড়েছে–হালকা লাল এবং ঘন নীল। দুর থেকে দেখে মনে হচ্ছে আঙুলে লাল এবং নীল রঙ মাখিয়ে কেউ এক জন বাড়িটার গায়ে ছিটিয়ে দিয়েছে।

পুতুল এগুচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন কোথায় যাচ্ছে। আসলে কিছুই জানে না। হাঁটতে ভালো লাগছে, হাঁটছে। কোনো দিন সে একা একা এত দুর আসে নি।

একটা বুড়ো লোক কাঁধে একটা ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছে। পুতুলের মনে হল লোকটা সাপুড়ে, অবিকল এ রকম একটা সাপুড়ে এক বার সাপের খেলা দেখাচ্ছিল। সে গাড়ির ভেতর থেকে দেখতে পেয়ে অনেক অনুরোধ করে গাড়ি থামিয়েছিল। জেসমিন বিরক্ত হয়ে বলেছেন, সাপের খেলা একটা নোংরা ব্যাপার। এর মধ্যে দেখার কী আছে?

অল্প একটু দেখব মা–এক মিনিট।

যা দেখার গাড়ির ভেতর থেকে দেখ।

এখান থেকে তো মা দেখা যাচ্ছে না।

যা দেখা যাচ্ছে তাই দেখ। ওকি, আবার কাঁচ নামাচ্ছ কেন? ধুলো ঢুকবে।

মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখল পুতুল। লোকটা কী অসম্ভব সাহসী! একটা বিরাটি সাপ গলায় পেঁচিয়ে অদ্ভুত স্বরে বলছে–

খা খা খা
বক্কিলারে খা
কিরপিনেরে খা
ননদীরে খা
কিরপিনেরে খা
খা খা খা
বক্কিলারে খা।

এই লোকটাও বোধ হয় সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে গলায় সাপ জড়াবে। ‘বক্কিলারে খা’ গান ধরবে। পুতুল গভীর আগ্রহ নিয়ে দাড়িওয়ালা লোকটির পেছনে পেছনে যাচ্ছে।

লোকটি এক সময় অবাক হয়ে বলল, ও বাবা কি চাও তুমি?

পুতুল লজ্জিত গলায় বলল, কিছু চাই না। আপনার ঝুড়িটার ভেতরে কি সাপ আছে?

লোকটি বিস্মিত হয়ে বলল, পুলা কেমুন কথা কয়! সাপ থাকবে ক্যান?

কি আছে?

পাটালি গুড়।

লোকটি ঝাঁকা নামিয়ে গুড় দেখাল। সুন্দর চাকা চাকা গুড়। মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে।

খাইবা?

জি না। লোকটা একটা গুড়ের টুকরা বাড়িয়ে দিল।

নেও বাপধন, নেও। শরমের কিছু নাই। আদর কইরা দিলাম। কী। অদ্ভুত কথা! ঝুড়ির মইধ্যে সাপ! সাপ দিয়া আমি কি করুম গো বাপধন?

লোকটি খুব হাসতে লাগল। সাপের ব্যাপারটায় সে খুব মজা পেয়েছে। লোকটির হাসি দেখে পুতুলের হাসি লাগছে।

নাম কি তোমার?

পুতুল।

পুতুল আবার কেমুন নাম?

লোকটি আবার হাসতে লাগল। এই লোকের মনে হয় হাসির রোগ আছে–যা দেখে তাতেই তার হাসি আসে।

বাড়ি কোনটে?

এটা আবার কোন ধরনের কথা, বাড়ি কোনটে। পুতুল কিছু বলল না। হাতের মুঠোয় রাখা গুড়ের দলায় ছোট্ট কামড় দিল। সুন্দর গন্ধ। খেতেও কী চমৎকার! আগে জানলে সে রোজ গুড় খেত। ভালো ভালো খাবারগুলো তাদের বাসায় কখনো আনা হয় না। এবার সে মা’কে গুড় কেনার কথা বলবে।

.

পুতুলকে পাওয়া যাচ্ছে না এই খবরটা জেসমিনকে দেওয়া যাচ্ছে না। রমিলা খবর দিতে গিয়ে ধমক খেয়েছে। জেসমিন ঘুম ঘুম চোখে চেঁচিয়েছেন, দরজা নাড়ছে কে? রমিলা ক্ষীণ স্বরে বলল, আম্মা আমি।

বিরক্ত করবে না।

রমিলা নিচে নেমে এল। মালি এবং দারোয়ানকে আবার পাঠাল, বাড়ির আশেপাশে খুঁজে আসবে। সে নিজে গেল ছাদে। যদিও ছাদ এর আগে একবার সে নিজেই দেখে এসেছে।

জেসমিন খবর পেলেন, সকাল নটায়।

সাড়ে ন’টার মধ্যে ঢাকা শহরের সমস্ত আত্মীয়-স্বজনরা জানল, পুতুলকে পাওয়া যাচ্ছে না।

.

পুলিশকে জানান হল বেলা দশটায়।

.

সকাল দশটা।

পুতুলকে সোহরাওয়ারদী উদ্যানে দেখা যাচ্ছে। সে বেশ আয়েশ করে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে এবং কৌতূহলী চোখে ঠিক তার বয়সী একটি ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখছে।

ছেলেটি রোগা ট্যাঙটেঙা। পরনে একটা নীল প্যান্ট। এ ছাড়া গায়ে দ্বিতীয় কোনো বস্তু নেই। গোলগাল মুখ। ছেলেটা একটু পরপর বয়স্ক মানুষের মতো বিরক্তিতে মুখ কোঁচকাচ্ছে। তার এক হাতে একটা কুকুরছানা। কুকুরছানাটা ছাড়া পাবার জন্যে ছটফট করছে। তখনই ছেলেটি মুখ বিকৃত করছে। ছেলেটির নাম অন্তু মিয়া। সেও বেশ কিছু সময় ধরে পুতুলকে লক্ষ্য করছে। এ রকম সুন্দর একটা গেঞ্জি গায়ে তার বয়েসী একটা ছেলে একা একা এখানে কী করছে সে ভেবে পাচ্ছে না। অন্তু মিয়ার ইচ্ছে করছে ছেলেটার সঙ্গে আলাপ জমানোর, কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। সে পিচ করে থুথু ফেলল। এমন ভাবে ফেলল যেন থুথু পুতুলের পায়ের কাছাকাছি পড়ে! অন্তুর নিশানা খুব ভালো। ঠিক পায়ের কাছেই পড়ল। পুতুল অবাক হয়ে বলল, থুথু দিচ্ছ কেন?

ছেলেটি নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল, আমার ইচ্ছা।

আরেকটু হলে আমার পায়ে পড়ত।

না, পড়ত না। নিশানা আছে, এই দেখ।

বলেই অন্তু পরপর তিনবার থুথু ফেলল। প্রতিবারই সেই থুথু পুতুলের পায়ের আশেপাশেই পড়ল, কিন্তু পায়ে লাগল না। ছেলেটির এই ক্ষমতায় পুতুল অভিভূত হয়ে পড়ল। সে বলল, তোমার কি নাম?

অন্তু মিয়া।

এটা তোমার কুকুর?

হুঁ।

কুকুরটার কি নাম?

অখনও ঠিক করি নাই।

আমাদের একটা বিড়াল ছিল, তার নাম ছিল লিলিয়ান। ট্রাকের নিচে পড়ে লিলিয়ান মারা গিয়েছিল।

অন্তু বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটির পাশে এসে বসতে–ঠিক সাহসে কুলোচ্ছেনা। এইসব বড়লোকদের ছেলেপুলে বদের হাডিড হয়। এক্ষণি হয়তো তার বাবাকে ডেকে মার খাওয়াবে। এরা নিজেরা মারামারি করতে পারে না, অন্যকে দিয়ে মার খাওয়ায়। অন্তু বলল, তোর হাতে কি?

গুড। তুমি আমাকে তুই তুই করে বলছ কেন? তুই তুই করে বলা ।

খুব খারাপ।  বললে তুই কি করবি? মারবি আমাকে? আয় না দেখি কত শক্তি। আয় দেখি?

পুতুল অবাক হয়ে বলল, শুধু শুধু আমি মারামারি করব কেন?

তুই বদের হাড্ডি।

আমি কেন বদের হাড়ি হব? এসব তুমি কী বলছ!

তুই শয়তানের ঘোড়া।

তুমি এরকম করে আমাকে বকা দিচ্ছ কেন? আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি?

তুই শিয়ালের গু।

ছিঃ। এসব নোংরা কথা কেন বলছ?

অন্তু মিয়া খুব সাবধানে অনেকখানি দূরত্ব রেখে বেঞ্চিতে বসল। কুকুরটাকে লেজে ধরে খানিকক্ষণ ঝুলিয়ে রাখল। বেচারি কুইকুই করছে। এবং প্রাণপণ চেষ্টা করছে অন্তুকে খামচি দিতে। দিতে পারছে না। অন্তু খুব মজা পাচ্ছে। পৃভুল বলল, ওকে কষ্ট দিচ্ছ কেন?

আমার ইচ্ছা।

পশু পাখিকে কষ্ট দেওয়া ঠিক না।

কষ্ট দিলে কী হয়?

আল্লা পাপ দেন। কুকুরটাকে ছেড়ে দাও।

অন্তু মাথার উপর একটা পাক দিয়ে কুকুরটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। পুতুলের মনে হল কুকুরটা বোধ হয় মরেই গেছে। কিন্তু না, মরে নি। সে আবার পায়ে পায়ে অন্তুর দিকেই এগিয়ে আসছে। অন্তুর পায়ের কাছে এসে কুঁই কুঁই করছে। কুকুরের ভাষা পুতুল বোঝে না, কিন্তু পুতুলের মনে হল কুকুরটা বলছে, আমাকে কোলে নাও। আমাকে কোলে নাও! অন্তু এখন আর কুকুরটার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পুতুল নিচু হয়ে কুকুরটাকে নিজের কোলে তুলে নিল। কুকুরটাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাই তুলে গা-টা এলিয়ে শুয়ে পড়ল, যেন পুতুলের কোলে শুয়ে ঘুমানোই তার অভ্যাস। পুতুল মনে মনে কুকুরটার জন্যে একটা নামও ঠিক করে ফেল–ইয়েলো টাইগার। সে অন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এর জন্যে নাম ঠিক করেছি। নামটা রাখবে?

কী নাম?

ইয়েলো টাইগার।

এইটা আবার কেমন নাম?

ইয়েলো টাইগার মানে–হলুদ বাঘ।

ও বুঝছি-অইলদা বাঘ।

পুতুল হেসে ফেলল। অন্তু মিয়া সেই হাসিতে যোগ দিল না। সে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে আধ-খাওয়া বিড়ি বের করল। আগুন না ধরিয়েই মুখে দিল। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করার ভঙ্গি করতে লাগল। পুতুল অবাক হয়ে দেখছে। অন্তু বলল, বিড়ি খাইবা?

না, সিগারেট খেলে পাপ হয়।

সিগারেট না, বিড়ি।

বিড়ি খেলেও পাপ হয়।

বিনা আগুনে খাইলে কিছু হয় না!

কে বলেছে তোমাকে?

আমি জানি।

তুমি আর কি জান?

মেলা জিনিস জানি। কেমনে রিকশার পাম ছাড়া লাগে হেও জানি।

পুতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অন্তু মিয়া বিড়ির টুকরা পকেটে ঢুকিয়ে খুব দ্রুত মুখ নাড়ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা চিবুচ্ছে।

কি খাচ্ছ তুমি।

পান খাই। খাওয়া-খাওয়া খেলা।

অন্তু মিয়া আঙুলে চুন নিয়ে পানের সঙ্গে চুন মেশানর ভঙ্গি করে পানের পিক ফেলারও সুন্দর অনুকরণ করল। পুতুল এ রকম অদ্ভুত খেলা। আগে আর দেখে নি। বড় মজা তো! অন্তু বলল, রিকশার পাম কেমনে ছাড়ে তুমি জান?

না।

খুব সোজা। একটা পিন লাগে। দিয়াশলাইয়ের কাটি দিয়াও হয়।

রিকশার পাম ছাড়লে কী হয়?

হাওয়া যায় গিয়া। রিকশা চলে না।

পুতুল তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। অন্তু বলল, হরতালের সময় রিকশা বন করন লাগে- জান না?

না তো।

রিকশা সাইকেল সব বন করন লাগে। তখন হাওয়া ছাড়তে হয়।

তাই নাকি?

হ। হরতাল হইল গিয়া গরিবের জইন্যে। হরতাল করলে গরিবের ভালো হয়। দ্যাশ স্বাধীন হয়।

দেশ তো স্বাধীন হয়েছে।

আরো ভালো মতো হয়। গরিবের পেটে খানা-খাইদ্য আয়।

তুমি গরিব?

না। আমি গরিব না।

অন্তু প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দু’টি চকচকে টাকা বের করে দেখায়। যার পকেটে এ রকম চকচকে দু’টি নোট, তাকে গরিব বলার কোনো কারণ নেই। পুতুলের পকেটে তো টাকা নাই। মনে মনে পুতুল ছেলেটাকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। অবশ্যি তারও টাকা আছে। ঈদের দিনে সালাম করে পাওয়া টাকা! কত টাকা যে সেদিন পায়! মা সব টাকা দিয়ে প্রাইজ বণ্ড কিনে রেখে দেন। সে যখন বড় হবে তখন পাবে। পুতুল বলল, আমারো টাকা আছে। অনেক টাকা।

কই দেহি?

এখন নেই।

অন্তু অদ্ভুতভাবে হাসল। পুতুলের মনে হল অন্তু তার কথা মোটেই বিশ্বাস করছে না। তার একটু মন খারাপ হল। ইস, অন্তুকে যদি তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে প্রাইজ বণ্ডগুলো দেখান যেত।

অন্তু বলল, রিকশার পাম ক্যামতে ছাড়তে হয় দেখবা?

এই প্রথম সে তুমি তুমি করে বলছে। পুতুলের বড়ো ভালো লাগল। সে আগ্রহ করে বলল, দেখব। অন্তু বলল, আও আমার সাথে।

পুতুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগুচ্ছে। চমৎকার লাগছে পুতুলের। তারা দু জন বড় রাস্তায় এসে পড়ল। পুতুলকে দাঁড় করিয়ে অন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের সামনে কয়েকটা খালি রিকশা। একটি রিকশার রিকশাওয়ালা পাশেই উবু হয়ে বসে চা খাচ্ছে। পুতুল দেখল অন্তু ভালো মানুষের মতো রিকশাটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যেপথে হাওয়া দেওয়া হয় সেখানে কী যেন করল। শোঁ শোঁ শব্দ হল। রিকশার মালিক লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতেই অন্তু হাওয়া। সে ছুটছে বিদ্যুৎগতিতে। রিকশাওয়ালা কুৎসিত গালি দিচ্ছে। বাকি সবাই দাঁত বের করে হাসছে। পুতুল এমন অদ্ভুত উত্তেজনার দৃশ্য এর আগে দেখে নি, তার গা ঝিমঝিম করছে। রীতিমতো তৃষ্ণা পেয়ে গেছে। সে নিজের জায়গায় ফিরে গেল। অন্তু বসে আছে। অন্তুর মুখভর্তি হাসি। তার পায়ের কাছে ইয়েলো টাইগার কু কু করছে। পুতুল বলল, রিকশার চাকা নষ্ট করেছ তোমার পাপ হবে।

চাকা নষ্ট হয় নাই, শুধু হাওয়া গেছে।

তবু তোমার পাপ হবে।

অন্তুকে পাপের চিন্তায় খুব বিচলিত মনে হল না। সে গম্ভীর গলায় বলল, ফান্টা খাইবা?

খাব।

অন্তু এমন এক ভঙ্গি করল যেন ফান্টার বোতল ধরে আছে। এক হাতে বোতলের মুখ খুলে নিজেই বিজবিজ করতে লাগল। বোতলের গ্যাস

বেরিয়ে গেলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন শব্দ।

নেও খাও।

পুতুল হাত বাড়িয়ে অদৃশ্য বোতলটা নিল। অন্তু বলল, পাইপ আছে, পাইপ দিয়া তারপর খাও। মজা পাইবা।

অদৃশ্য পাইপ দিয়ে অদৃশ্য বোতল থেকে দু জনে ফান্টা খাচ্ছে। পুতুল সত্যি সত্যি খুব মজা পাচ্ছে। অন্তু আবার সত্যিকারের দু’টি ঢেকুর তুলল। বড় মজার ছেলে তো!

অন্তু, তোমার বাসা কোথায়?

বাসা নাই।

বাসা নাই মানে? রাত্রে ঘুমাও কোথায়?

ইস্টিশনে। রেল ইস্টিশন–কমলাপুর।

স্টেশনে ঘুমাও কেন?

ইস্টিশনই ভালো। কেউ কিছু কয় না। সরকারী জায়গা।

স্টেশন সরকারী জায়গা?

হুঁ। এই যে পার্ক–এও সরকারী।

তুমি অনেক কিছু জান, তাই না?

হুঁ জানি।

তোমার আব্বা আম্মাও স্টেশনে থাকেন?

মা মইরা গেছে। বাপ থাকে ময়মনসিং। ইস্টিশনে ভিক্ষা করে।

উনি সত্যি সত্যি ভিক্ষা করেন?

অন্তু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। পুতুল বলল, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছ।

অন্তু হাই তুলে হাল্কা গলায় বলল, মাঝেমইদ্যে আমিও ভিক্ষা করি।

তুমিও কর?

হ!

কিভাবে কর?

কোনো ভদ্দরলোক দেখলে কই-সারাদিনের না খাওয়া-একখান টাকা দিবেন?

মিথ্যা কথা বল কেন?

কোনটা মিথ্যা?

এই যে বললে, সারাদিন না খাওয়া।

মিথ্যা না। মাঝেমইদ্যে সারাদিন না খাওয়া যায়। খাওয়া-খাদ্য হইল ভাগ্যের ব্যাপার। ভাইগ্যে থাকলে হয়, না থাকলে হয় না।

পুতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কী অদ্ভুত কথা বলছে ছেলেটা! খাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার!

ইয়েলো টাইগার আবার ফিরে এসেছে। অন্তুর পায়ের কাছে কুইকুই করছে। অন্তু একটা লাথি বসাল। কুকুরটা ছিটকে পড়ল দূরে। কী অদ্ভুত কাণ্ড। সেখান থেকে আবার এদিকেই আসছে। যে মারছে তার কাছেই আবার আসছে। পুতুল বলল, কুকুরটা বার বার তোমার কাছে আসছে কেন?

অন্তু তার জবাব দিল না। এবার সে ইয়েলো টাইগারকে কোলে তুলে নিল। চিৎ করে শুইয়ে পেটে কাতুকুতু দিতে লাগল। ইয়েলো টাইগার খুব মজা পাচ্ছে। কেমন গা মোচড়াচ্ছে। লেজ নাড়াচ্ছে। আবার একটু যেন হাসার চেষ্টাও করছে। কুকুর আবার মানুষের মতো হাসতেও পারে নাকি!

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ