পিপলী বেগম – হুমায়ূন আহমেদ

তারা তিন বোন –তিলু, বিলু, নীলু। সবচে বড় হল তিলু, সে ভিকারুননেসা স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। খুব শান্ত মেয়ে।

তারপর বিলু, সেও ভিকারুননেসা স্কুলে পড়ে। ক্লাস থ্রী। সে মোটেও শান্ত না। দারুণ হৈ চৈ করে। কদিন আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে। ভাঙ্গা হাত প্লাস্টার করে এখন তার গলায় ঝোলানো। বিলু খুব খুশি। হাতের প্লাস্টারে ছবি আঁকতে পারছে।

সবচে ছোট নীলু। এবার তার স্কুলে ভর্তি হবার কথা ছিল। অনেক কটা স্কুলে টেস্ট দিয়েও এলাউ হয় নি। নীলু খুব কেঁদেছিল। নীলুর বাবা মতিন সাহেব বলেছেন –মা পচা স্কুলগুলিতে তোমাকে পড়তে হবে না। আমিই তোমাকে পড়াব। নীলু অবাক হয়ে বলেছে, তুমি কি করে পড়াবে? তুমি তো মাস্টার না। তুমি ডাক্তার।

ডাক্তাররাও পড়াতে পারে মা।

না পারে না।

নীলুর কথাই ঠিক হয়েছে। মতিন সাহেব পড়াতে পারছেন না। সময় পাচ্ছেন না। তিনি সেই সকালে যান, ফিরতে রাত এগারোটা বাজে। তিলু বিলু ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ঘুম চোখে জেগে থাকে নীলু। মতিন সাহেব ঘরে ঢুকতেই সে বলে, বাবা আমাকে পড়াবে না?

অবশ্যই পড়াব মা।

বই নিয়ে আসব?

 আজতো অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল থেকে আমরা শুরু করব।

আচ্ছা।

কালও শুরু করা যায় না, আরো দেরি হয়। তিলু বিলুর মা শাহানা একদিন বললেন, তুমি কয়েকদিন হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় থাকোতো। বাচ্চারা তোমার চেহারা ভুলে যাচ্ছে। একদিন দেখা যাবে রাস্তার কাউকে দেখে চেঁচিয়ে উঠবে –বাবা! বাবা!

মতিন সাহেব সত্যি সত্যি ছুটি নিয়েছেন। দুদিনের ছুটি। বাচ্চাদের সঙ্গে তিনি গত দুদিন ধরে আছেন। ওদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলেছেন। মনোপালি খেলেছেন, নাম-দেশ-ফুল-ফল খেলেছেন। এখন সন্ধ্যা। মেয়েরা বাবাকে ঘিরে বসেছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। ঘরে মোম জ্বালানো হয়েছে। গল্প শোনার রাত। মেয়েরা গল্প শুনতে চায়। মতিন সাহেব পড়েছেন বিপদে। কোন গল্পই তাঁর মনে আসছে না। পাঁচ মিনিট ধরে তিনি মাথা চুলকাচ্ছেন। মাথা চুলকালে ছেলেবেলায় শোনা কোন গল্প মনে পড়তে পারে –এই তাঁর ক্ষীণ আশা। মাথা চুলকানোয় কোন লাভ হচ্ছে না। তিলু বলল, কি হল বাবা, শুরু কর। তুমি না বলেছিলে আমাদের সব কথা শুনবে।

কি শুরু করব?

কি আবার, গল্প।

 কিসের গল্প শুনতে চাও? ভূতের?

বিলু বলল, ভূতের গল্প আমি মরলেও শুনব না। একটা বাঘের গল্প বল, বাবা।

মতিন সাহেব ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যদি ছাদের দিকে তাকালে কিছু মনে পড়ে!

কি হল বাবা?

মনে করার চেষ্টা করছি।

মনে আসছে না?

উঁহু।

একবার শুরু করে দাও। শুরু করলেই দেখবে মনে পড়বে।

কিভাবে শুরু করব?

বল –এক দেশে ছিল এক বাঘ।

মতিন সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। বৃষ্টি আরো চেপে আসছে। কে জানে ঝড় শুরু হবে কি-না। তিনি অসহায় গলায় বললেন, তোর মা ফেরার পর গল্প শুরু করলে কেমন হয়? সেও শুনতে পেত।

নীলু বলল, মা আজ রাতে ফিরবে না, বাবা। মা ছোটমামার বাসা থেকে টেলিফোন করেছে। সে মামার বাসায় আটকা পড়েছে। বাড়ির সামনে এক-কোমর পানি। মা কাল ভোরে আসবে। মা বলেছে তুমি যেন আমাদের দেখেশুনে রাখ।

বলিস কি? এ তো আরেক যন্ত্রণা হল।

কোন যন্ত্রণা হয়নি, বাবা। তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। তুমি গল্প বললেই হবে। তিন জনের জন্যে তিনটা গল্প। শুরু কর —

রাতের খাবারের কি ব্যবস্থা হবে।

মা রান্না করে রেখে গেছে। খিদে লাগলে আমরা খেয়ে নেব।

কি রান্না?

খিচুড়ি আর ডিমের তরকারী।

হাসের ডিম না মুরগীর ডিম?

 বাবা তুমি ইচ্ছা করে –অন্য কথা বলছ। গল্প শুরু কর।

রাতের খাওয়ার পর শুরু করলে কেমন হয়?

খুব খারাপ হয়। শুরু কর বাবা।

মতিন সাহেব বললেন –এক দেশে ছিল এক পিপড়া …

তিলু চেঁচিয়ে বলল, বাবা তুমি কি বললে? কি ছিল?

পিপড়া।

পিপড়া? তুমি পিপড়ার গল্প বলবে?

 হু।

 পিপড়ার কি কোন গল্প হয়, বাবা?

বাঘের গল্প যদি হয়, হাতির গল্প যদি হয় তাহলে পিপড়ারও গল্প হয়।

বিলু বলল, এত ছোট একটা জিনিস চোখেই দেখা যায় না।

মতিন সাহেব বললেন, ভূতও তো চোখে দেখা যায় না। পিপড়া ছোট হলেও দেখা যায়।

তিলু বিলু বলল, আমরা পিপড়ার গল্প শুনব না। শুধু নীলু বলল, সে শুনবে। নীলু বলল, বাবা, তুমি আবার বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলবে না তো?

অসম্ভব। বানিয়ে বলব না।

 সত্যি গল্প?

গল্প সব সময় সত্যি হয়। গল্প কখনো মিথ্যা হয় না।

তিলু বিলু বলল, সব গল্পই কি সত্যি?

অবশ্যই সত্যি।

একটা গল্পে যখন বাঘ কথা বলে সেটাও কি সত্যি?

সেটাও সত্যি। এমনি পৃথিবী আর গল্পের পৃথিবী –দুটি আলাদা পৃথিবী। দুটি পৃথিবীই সত্যি। আমাদের পৃথিবীতে বাঘ কথা বলে না, কিন্তু গল্পের পৃথিবীতে বলে। বুঝতে পারলে?

তিলু বিলু মাথা নাড়ল না, তবে নীলু মাথা নাড়ল অর্থাৎ সে বুঝেছে। বিলু বলল, বাবা দেখ নীলু কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ছে। মতিন সাহেব বললেন, আমার ধারণা নীলু ঠিকই বুঝেছে ছোট বলেই যে সে কিছু বুঝবে না তা তো না। বরং ছোটরাই অনেক বেশি বোঝে।

মতিন সাহেব গল্প শুরু করলেন।

.

এক দেশে ছিল এক পিপড়া। মেয়ে পিপড়া। তার নাম পিপলী বেগম। বয়স খুব বেশি না, মানুষের হিসেবে তার বয়স তের বছর। দেখতে সে খুব সুন্দর। সবচে সুন্দর তার চোখ। ঝকঝকে নীল। চোখ দেখলেই বোঝা যায় পিপলী বেগমের খুব বুদ্ধি। স্কুলের পরীক্ষায় সে সব সময় ফার্স্ট হয়। শুধু সেবার পরীক্ষায় খুব খারাপ করল। অঙ্কে পেল মাত্র ১৯। ভূগোলে তেইশ। তাদের আপা পিপলীকে অফিসঘুরে ডেকে নিয়ে গেলেন।

নীলু বলল, বাবা, ওদের স্কুল আছে?

অবশ্যই আছে। স্কুল থাকবে না কেন? স্কুল আছে, কলেজ আছে। সেখানে সবাইকে পড়াশোনা করতে হয়।

ওদের স্কুলগুলি কেমন বাবা?

ওদের স্কুলগুলি বেশির ভাগই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মত। খোলা ময়দানে ক্লাস হয়। কখনো গাছের নিচে। কখনো গাছে। তবে ঝড়-বাদলার দিনে স্কুলঘরে।

ওদের স্কুলঘর আছে?

আছে। দুতলা-তিনতলা স্কুলঘর। পিপড়ারা যে খুব সুন্দর বাড়ি বানাতে পারে তা তুমি জান না?

না।

ওরা মাটির নিচে বাড়ি বানায়। সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বাড়িতে পানি আছে –ইলেকট্রিসিটি আছে।

তিলু রাগী গলায় বলল, বাবা, তুমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা শুরু করেছ। ওরা ইলেকট্রিসিটি কোথায় পাবে?

 মতিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, ওদের ইলেকট্রিসিটি মানুষের ইলেকট্রিসিটির মত না। এক ধরনের পচা কাঠ আছে, অন্ধকারে জ্বলে। ওরা করে কি –ঐসব কাঠের ছোট ছোট টুকরা নিজেদের বাড়ির হলরুমে রাখে। ওদের মিটিং-টিটিং তো সব হলঘরে হয় –এই জন্যেই শুধু হলঘরে আলোর ব্যবস্থা।

বিলু বলল, বাবার কথা আমার মোটেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে বাবা বানিয়ে বানিয়ে বলছে। তিলু বলল, আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে।

নীলু বলল, বাহ্, বাবার সব কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে। বাবা তুমি বল। পিপড়াদের কি মজা তাই না বাবা।

মজা তো বটেই। আমরা মানুষ ছাড়া অন্য সবাইকে খুব ছোট করে দেখি। ছোট করে দেখা ঠিক নয়। বুঝলে মা? প্রাণীদেরও বুদ্ধি আছে। অনেক বুদ্ধি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষদের বুদ্ধির চেয়েও বেশি। বাবুই পাখি কি করে জান?

না। কি করে?

ওরা ওদের বাড়িতে জোনাকি পোকা ধরে রাখে। প্রথমে খানিকটা গোবর নিয়ে যায়, সেই গোবরে জোনাকি পোকা পুঁতে দেয়। এতে ঘর আলো হয়।

বাবুই পাখিদেরও কি স্কুল আছে?

সবারই স্কুল আছে। সবাইকে শিখতে হয়। তবে পিপড়াদের স্কুল হল খুব ভাল স্কুল। এরা অনেক কিছু শেখায়।

বিলু বলল, কি কি শেখায়?

অঙ্ক তো শিখতেই হয়। হিসেব-নিকেশ না শিখলে চলবে কেন? তারপর শিখতে হয় মাটিবিদ্যা। ওরা মাটিতে থাকে, মাটি দিয়ে ঘর বানায় –মাটিবিদ্যা শিখলে চলবে কেন? ওদের ভূগোল খুব বেশি বেশি পড়তে হয়। কোন জায়গাটা কি রকম তা না জানলে ওদের চলে না। আবহাওয়া জানতে হয় –কখন বৃষ্টি হবে, কখন ঝড় হবে …

তিলু বলল, বাবা, ওদের কি সায়েন্স, আর্টস আছে?

আছে। তবে আর্টস পড়ে খুব কম পিপড়া। যারা অসম্ভব জ্ঞানী তারাই শুধু আর্টস পড়ে। ওদের কাজ হচ্ছে চিন্তা করা।

কি চিন্তা করে?

নানান বিষয় নিয়ে চিন্তা করে। পিপড়া কেন পৃথিবীতে তৈরি করা হল, এদের কি প্রয়োজন ছিল। এইসব ….।

নীলু বলল, পিপড়া হওয়া তো বাবা খুব মজা।

মজা তো বটেই। তারপর শোন কি হল, স্কুলের বড় আপা পিপলী বেগমকে ডেকে নিয়ে গেলেন। বড় আপা বললেন, পিপলী, তোমার রেজাল্ট এত খারাপ হল কেন? অঙ্কে উনিশ, ভূগোলে তেইশ। ব্যাপারটা কি বল তো?

পিপলী বলল, পড়তে আমার ভাল লাগে না, আপা।

বড় আপা অবাক হয়ে বললেন, কি বললে?

পড়তে ভাল লাগে না।

বড় আপা অবাক হয়ে পিপলীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল যার পড়তে ভাল লাগে না। পিপড়ারা মানুষের মত। তাদের সবারই পড়তে খুব ভাল লাগে। এমন একজনকেও পাওয়া যায় না, যার পড়তে ভাল লাগে না। শুধু পিপলী বেগমকে পাওয়া গেল।

বিলু বাবার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলল, বাবা আমারো পড়তে ভাল লাগে না। মতিন সাহেব বললেন, তোমার কথাতো এখন হচ্ছে না। এখন পিপলী বেগমের কথা হচ্ছে। তোমার কথা পরে শুনব। যা বলছিলাম –পিপলীর পড়তে ভাল লাগে না শুনে বড় আপা বললেন, এত অদ্ভুত কথা তো আমি জন্মেও শুনিনি। তোমার কি সত্যি সত্যি পড়তে ভাল লাগে না? নাকি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?

আমার সত্যি সত্যি পড়তে ভাল লাগে না। পড়ার কথা মনে হলেই রাগ লাগে। স্কুলে আসতেও ইচ্ছা করে না। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ইচ্ছা হয়।

অদ্ভুত ইচ্ছা হয়? কি রকম অদ্ভুত ইচ্ছা?

বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে। অনেক, অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছা করে।

বড় আপা চেঁচিয়ে বললেন, কি দেখতে ইচ্ছা করে?

সবচে বেশি দেখতে ইচ্ছা করে মানুষদের।

মানুষদের দেখতে ইচ্ছা করে! তুমি তো ভয়ংকর কথা বললে! মানুষরা ভয়াবহ জীব। এদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়। অনেক দূরে। মানুষ কি করে জান? পিপড়া দেখলে পায়ে পিষে মেরে ফেলে। বিশেষ করে মানুষদের হোট ছোট বাচ্চারা পিপড়া মা’রতে খুব ভালবাসে।

তবু আমার মানুষ দেখতে ইচ্ছা করে। ওদের কত বুদ্ধি!

মানুষদের বুদ্ধি আছে। এই অদ্ভুত কথা তোমাকে কে বলল, পিপলী? এই পৃথিবীতে সবচে বোকা হল মানুষরা। আমরা যেমন খাবার ভাগাভাগি করে খাই, ওরা তা করে না। কোন কোন মানুষের বাড়িতে প্রচুর খাবার। আবার কারো কারো বাড়িতে কোন খাবার নেই। কারো কারো থাকার জন্যে বাড়ি আছে, কারো কারো নেই –তারা থাকে পথে, গাছের নিচে। পিঁপড়াদের বেলায় এই জিনিস কখনো হবে না। কখনো না।

তবু আমার মানুষ দেখতে ইচ্ছা করে। ওদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে।

ওদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে?

হু। ওদেরকে বলতে ইচ্ছা করে এই যে মানুষ, তোমাদের এত বুদ্ধি কিন্তু তোমরা এমন কেন?

কি সর্বনাশের কথা! কি সর্বনাশের কথা! তোমার শরীর ভাল আছে তো পিপলী বেগম? অনেক সময় শরীর খারাপ হলে উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসে। তোমার কি রাতে ভাল ঘুম হয়?

মাঝে মাঝে ঘুম হয় না। মন খারাপ লাগে।

যা ভেবেছি তাই। তোমার শরীর খারাপ। শরীর খারাপ হলেই মন খারাপ হয়। কারণ মন বলে আলাদা কিছু নেই। আমার ধারনা তোমার শরীর খুবই খারাপ।

আমার শরীর ভালই আছে আপা।

তুমি বললে তো হবে না। ডাক্তার এসে দেখে বলুক। আমরা ধারণা তোমার জটিল কোন রোগ হয়েছে। খুব জটিল। এসো মা, তুমি এই টেবিলে শুয়ে থাক। আমি স্কুলের ডাক্তারকে খবর দিচ্ছি। ডাক্তার সাহেব এসে দেখুক।

বিলু বলল, বাবা, পিপড়াদের ডাক্তার আছে?

মতিন সাহেব বললেন, পিপড়াদের তুমি এত তুচ্ছ ভাবছ কেন মা? ওদের ডাক্তার আছে –ওদের হাসপাতাল পর্যন্ত আছে। ওদের যে বসতবাড়ি, সেই বসতবাড়ির একটা তলা হল ওদের হাসপাতাল। হাসপাতালে রুগ্ন, অসুস্থ পিপড়ারা থাকে। অসুখ-বিসুখ ওদের বেশি হয় না, কিন্তু একসিডেন্ট খুব বেশি। বেশির ভাগ রোগী আসে হাত ভাঙা, পা ভাঙা। অর্থাৎ পঙ্গু হাসপাতাল।

তারপর কি হল শোন। পিপলী বেগমের বড় আপা খুব ব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। পিপলীকে শুইয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। বড় আপার চিন্তার সীমা রইল না। স্কুলের দুজন ডাক্তার এসে নানাভাবে দেখলেন। জিভ দেখলেন, কান দেখলেন, গলা দেখলেন। ব্লাড প্রেসার মাপলেন। একটা ছোট্ট কাঠের হাতুরী দিয়ে টুক করে পিপলীর হাঁটুতে বাড়ি দিয়ে রিফ্লেক্স এ্যাকশান দেখলেন।

বড় আপা ভীত গলায় বললেন, কি দেখলেন ডাক্তার সাহেব? আমার খুব চিন্তা লাগছে। এতদিন ধরে স্কুলে পড়াচ্ছি, এমন তো কখনো শুনিনি! পিপলীর শরীর কি খুব বেশি খারাপ?

ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, শরীরে তেমন কিছু পাচ্ছি না। বুকে কফ জমে আছে। ঠাণ্ডা লেগেছে বোধহয়। অবশ্যি ব্লাড প্রেসার নরমালের চেয়ে সামান্য নিচে। ভালমত খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিন। দিনকয় বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিক।

বেড রেস্টে থাকুক।

নীলু বলল, বাবা পিপড়ারা কি ইংরেজীও জানে?

দু একটা শব্দ জানে।

ওরা কোন ভাষায় কথা বলে বাবা? বাংলা ভাষা?

না ওদের ভাষা হচ্ছে পিপ-ভাষা। তোমরা কথা কিন্তু বেশি বলছ মা। এত কথা বললে গল্প বলব কখন।

আর কথা বলব না বাবা তুমি গল্প শুরু কর।

বড় আপা ঠিক করলেন পিপলীকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। সাতদিনের ছুটি। পড়াশোনার ক্ষতি হবে। কি আর করা! বাড়তি ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া রাণীমাকে খবরটা দিতে হবে। এতবড় ঘটনা রাণী মাকে না জানালে হবে না।

নীলু বলল, ওদের রাজা-রাণী আছে?

রাজা নেই, রাণী আছে। রাণীর ভয়ংকর ক্ষমতা। পিপড়াদের কারোর অতি সামান্য কিছু হলেও রাণীকে জানাতে হয়। কি কথা ছিল মা? বেশি প্রশ্ন করবে না। তুমি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছ। যাই হোক, তারপর কি হল শোন –বড় আপা বললেন, পিপলী, তোমার ব্যাপারটা তো রাণী-মাকে জানাতে হয়। আমি নিজেই গিয়ে জানাব। উনি কি করবেন তা তো জানি না। হয়ত তোমাকে ডেকে পাঠাবেন। তোমার কি কখনো রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা হয়েছে?

না।

তাহলে রাণী-মা’র সঙ্গে কথা বলার নিয়ম-কানুন খুব ভাল করে শিখে রাখ। কথা বলবে খুব আদবের সঙ্গে। খুব জোরেও বলবে না, আবার ফিসফিস করেও বলবে না। মনে থাকবে?

থাকবে।

রাণী-মা’র বাড়ির চারপাশে লাল দাগ দেয়া। বৃত্তের মত। কখনো ভুলেও সেই লাল দাগের ভেতরে যাবে না। লাল দাগের ভেতরে যাওয়া মানেই মহাসর্বনাশ।

কি সর্বনাশ?

সারা জীবনের জন্যে নির্বাসনদণ্ড। পিপীলিকা সমাজে মৃত্যুদণ্ড নেই। মৃত্যুদণ্ড থাকলে, মৃত্যুদণ্ডই হত। খুব মনে রাখবে –লাল দাগ।

পিপলী বলল, রাণী-মা দেখতে কেমন?

জানি না কেমন। আমরা কেউ কখনো দেখিনি। কেউ দেখা করতে গেলে উনি প্রাসাদের জানালার সামনে এসে বসেন। সেই জানালায় পর্দা দেয়া। কেউ তাকে দেখতে পায় না। তাছাড়া জানালার দিকে তাকানোও এক ধরনের অসভ্যতা। তাকালেও নির্বাসনদণ্ড হতে পারে। অনেকের হয়েছে।

এত কঠিন নিয়ম-কানুন কেন?

 কি আশ্চর্য! রাণী-মা’র নিয়ম-কানুন কঠিন হবে না? উনি কি আর তোমার আমার মত সাধারণ? ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি —রাণী-মা যদি কথায় কথায় কোন হাসির কথা বলেন, তাহলে হাসবে কিন্তু খুব শব্দ করে হাসবে না।

শব্দ করে হাসলে কি হয়?

অসভ্যতা হয়। উনার সামনে অসভ্যতা করা যায় না।

উনি কি হাসির কথা বলেন?

বলবেন না কেন? বলেন। একবার কি হল শোন –আমি রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। উনি এমন এক হাসির গল্প বললেন যে আমার মরে যাবার মত অবস্থা। এত হাসি আসছে, হাসতেও পারছি না –হাসলে যদি বেয়াদবী হয়। রাণী-মা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, আচ্ছা এখন যাও। অন্য একদিন এসো। আমি ছুটি পেয়ে দৌড়ে রাস্তায় এসে হো হো করে হাসলাম।

পিপলী বলল, রাণী-মা কি আমাকেও হাসির গল্প বলবেন?

তা তো জানি না পিপলী। তোমার সঙ্গে উনি কি গল্প করবেন তা উনিই জানেন। তবে একটা কথা মনে রেখ –রাণীমা কোন প্রশ্ন করলে সত্যি জবাব দেবে। ভুলেও মিথ্যা বলবে না, কিংবা চুপ করে থাকবে না।

জি আচ্ছা।

আর রাণী-মা’র সঙ্গে কথা বলার আগে দুহাতে মাথা চেপে ধরে বলবে –হে পিপড়া সম্প্রদায়ের মহান রাণী। আপনার মঙ্গল হোক। কল্যাণ হোক। মনে থাকবে?

থাকবে।

আচ্ছা, এখন বাসায় চলে যাও। বাসায় গিয়ে তৈরি হয়ে থেকো। কে জানে তিনি হয়ত আজই তোমাকে ডাকবেন। তোমার ভয় করছে না তো আবার?

একটু একটু করছে।

তা ভয় তো করবেই। আমার এত বয়স হল –এখনো রাণী-মা’র কাছে যাওয়ার কথা উঠলে শরীর কাঁপতে থাকে। এই দেখ, আমার শুড় দু’টা কাঁপছে। দেখতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

রাণী-মা’র সামনে গঁড় কাঁপানো আবার এক ধরনের অসভ্যতা। তবে তিনি কিছু মনে করেন না –এটাই ভরসা।

বড় আপা রাণী-মা’র বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পিপলী রওনা হল তার। বাড়ির দিকে।

.

পিপলীরা এক রুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। সে, তার মা আর তার দাদীমা। দাদীমা’র অনেক বয়স হয়েছে। তিনি এখন চোখেও দেখেন না, কানেও খুব কম শুনেন। তবে কথা বলতে পারেন। দিনরাত বক বক করেন। কেউ তার কথা শুনছে কি শুনছে না তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। কথা বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন। পিপলী রাতে দাদীমা’র সঙ্গে শোয়। মাঝে মাঝে দাদীমা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেন, একটা মজার ইতিহাস মনে হয়েছে রে পিপলী, শোন।

আমার শুনতে ইচ্ছা করছে না দাদীমা।

কি বললি?

আমার শুনতে ইচ্ছা করছে না।

কি বলছিস একটু চেঁচিয়ে বল না।

চেঁচিয়েই তো বলছি। তুমি কানে শুনতে না পেলে কি করব? আমার ঘুম পাচ্ছে। গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে না।

বড়ই মজার ইতিহাস। একটু শোন লক্ষ্মী মেয়ে। তোর মত বয়সে আমি একবার হারিয়ে গিয়েছিলাম, বুঝলি? কি হল শোন। কদিন খুব বৃষ্টি হল। বৃষ্টিতে আমাদের ঘরবাড়ি সব পানিতে ডুবে গেল। রাণী-মা বললেন, এই বাড়িঘর ছেড়ে নতুন জায়গায় যেতে হবে। নতুন আবাস বানাতে হবে। বলে রাণী-মা খুব কাঁদতে লাগলেন।

কোন রাণীমা? আমাদের এখনকার রাণী-মা?

 উঁহু, উনার আগের জন।

রাণী হুকুম দিলেন –আমরা সব খাবার-দাবার নিয়ে তৈরি হলাম। রাণী মা’র কাছে বিদায় নিতে গেলাম। রাণী-মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। আহা রে! কি কান্না! সেই কান্নার শব্দে পাষাণ গলে যায়। আমরাও খুব কাঁদলাম।

পিপলী অবাক হয়ে বলল, রাণীমা কাঁদছিলেন কেন?

রাণী-মা কাঁদছিলেন, কারণ, আমরা সবাই নতুন জায়গায় যাব –কিন্তু রাণী-মা যেতে পারবেন না।

উনি যেতে পারবেন না কেন?

রাণীদের বাড়ি ছেড়ে যাবার নিয়ম নেই। তাঁকে সেখানেই থাকতে হবে। বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেলে তাঁকেও পানিতে ডুবে মরতে হবে। কাজেই আমরা রাণী-মাকে ফেলে রেখে কাঁদতে কাঁদতে রওনা হলাম। আহা, কি কষ্ট! যাবার পথে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। সে এক বিচিত্র ইতিহাস। শুনবি?

বিচিত্র ইতিহাস শুনব না। তুমি ঐ রাণী-মা’র কথা বল।

আহারে বড় ভাল রাণী ছিল। আমরা উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবার সময়, তিনি আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন।

তোমাকেও চুমুদিলেন।

হ্যা দিলেন। ভাল কথা আরেকটা মজার গল্প মনে হয়েছে। শুধু যে মজার তাই না, বিচিত্র ইতিহাস বলি?

না। ঘুম পাচ্ছে।

ছড়া শুনবি?

না।

বৃষ্টির ছড়া একটা শোন না। মজা লাগবে।

আমার এখন বৃষ্টির ছড়া শুনতে ইচ্ছা করছে না, দাদীমা। ঘুমুতে ইচ্ছা করছে।

ছড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়। ছড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তে অনেক বেশি মজা। বৃষ্টি যখন অসি আসি করে তখন এই ছড়া সুর করে পড়তে হয়। এই ছড়া পড়লে বৃষ্টি আসে না —

যা বৃষ্টি যা,
যেখান থেকে এসেছিলি
সেইখানেতে যা।
 সেইখানে তোর মা আছে
 মায়ের কাছে আদর আছে।
যা বৃষ্টি যা।
মায়ের কোলে বসে বসে
মায়ের আদর খা।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ