দাদীমাকে নিয়ে পিপলীর খুব সমস্যা হয়েছে। সারারাত জেগে পিপলীকে কবিতা শুনাবে, গল্প শুনাবে, ছড়া শুনাবে। সবচে সমস্যা হয় যখন গান শুরু করেন। দাদীমা’র গলা খারাপ। গানের সুরেরও কোন আগামাথা নেই। এই গানের সুর অন্য গানে, এক গানের কথা অন্য গানে। এমন বিরক্তিকর ব্যাপার। রাত জেগে জেগে হাত পা নেড়ে গান। দাদীমা’র ঘুম হয় না –সে পিপলীকেও ঘুমুতে দেয় না। তারা যদি একটা দুরুমের ফ্ল্যাট পেত খুব ভাল হত। দাদীমাকে একটা রুম দিয়ে দেয়া যেত। দুরুমের একটা ফ্ল্যাট তাদের পাওয়ার কথা কিন্তু তারা পাচ্ছে না। কারণ বাড়ি বানানোর মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির মাটি আনতে হচ্ছে অনেক দূর থেকে। সেখানে যাওয়া যেমন কষ্ট, পথও তেমনি বিপদজনক। কাছেই অবশ্যি ভাল মাটি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু রাণী-মা সেই মাটি পছন্দ করলেন না।

রাণী মা বললেন, আমি জানি এই মাটি ভাল। এই মাটির ঘর মজবুত হবে তাও জানি –কিন্তু এই মাটির গন্ধ আমার পছন্দ হচ্ছে না। তোমাদের মাটি আনতে হবে দূর থেকে। জানি, তোমাদের কষ্ট হবে। মাটি আনতে গিয়ে অনেকেই মারা পড়বে। তবে সেই মৃত্যু হবে সুখের মৃত্যু। কারণ যারা মারা যাবে তারা মারা যাবে অন্যের সুখের জন্য। এই মৃত্যু বড়ই আনন্দের মৃত্যু। তোমাদের কাজ করতে হবে দিনরাত। বিপদকে তুচ্ছ করতে হবে।

পিপড়ারা তাই করে যাচ্ছে। তাদের সব কাজ ভাগ ভাগ করা। যারা মাটি আনে –তাদের কাজই হল মাটি আনা। তারা অন্য কাজ করবে না। তারা হল মাটি-বাহক। সারা বৎসর তারা শুধু মাটিই আনে। অবশ্যি খুব জরুরী পরিস্থিতিতে তারা পিপড়ার ডিম নিয়ে এক জায়গা থেকে একজায়গায় যায়।

বিলু বলল, বাবা আমি পিপড়াদের মুখে ডিম নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে দেখেছি।

তিলু বলল, আমিও দেখেছি।

শুধু নীলু দেখেনি। এই জন্যে নীলুর একটু মন খারাপ হল। মতিন সাহেব বললেন, আমাকে গল্প শেষ করতে দাও –কি বলছিলাম যেন?

নীলু বলল, তুমি বলছিলে একদল পিপড়া আছে এদের কাজ হল মাটি আনা। তাদের নাম –মাটি বাহক।

মতিন সাহেব বললেন, সেই মাটি চালুনি দিয়ে চেলে তাতে পানি মিশিয়ে, গাছের আঠা মিশিয়ে মাটি তৈরির কাজ করবে অন্যরা। তাদের নাম মাটি মিশ্রক। সেই তৈরি মাটি দিয়ে বাড়ি বানানোর কাজ আবার অন্যদের হাতে। তাদের বলে নির্মাতা পিপীলিকা।

আরেক দল আছে। যাদের কাজ খাদ্য অনুসন্ধান করা। এরা জায়গায় জায়গায় যাবে, খাদ্য খুঁজে বের করবে, খবর দেবে রাণী-মাকে। খাদ্যের নমুনাও খানিকটা ভেঙে নিয়ে আসবে। রাণীমা সেই খাদ্য চেখে দেখবেন। যদি দেখেন ভাল, তখন অন্য আরেক দলকে হুকুম দেবেন খাদ্য নিয়ে আসতে।

রাণী-মাকে পাহারা দেওয়া এবং পিপড়াদের নিরাপত্তার জন্য আছে বিশাল সৈন্যবাহিনী। তাদের দাঁতে আছে বিষ। এরা হিংস্র প্রকৃতির। যুদ্ধ করা ছাড়া তারা অন্য কোন কাজ জানে না। খাদ্য নিয়ে আসার সময় দলে দলে সৈন্য পাঠানো হয়। সৈন্যরা সারি বেঁধে যায়। রাস্তা ঠিক করে দেয়। অন্য কোন পোকা-মাকড় যাতে এই খাদ্য নিয়ে যেতে না পারে সেই দিকে তারা লক্ষ্য রাখবে। মাঝে মাঝে বড় ধরনের যুদ্ধও তাদের করতে হয়। এই যুদ্ধ হয় অন্য গোত্রের পিপড়াদের সঙ্গে। কিছুদিন আগেই এরকম একটা যুদ্ধে পিপলীদের দলের শত শত সৈন্য মারা পড়ল। এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনেকদিন হয়নি। ঘটনা কি হয়েছিল বলি —

পিপলীদের দল একটা বড় শুঁটকি মাছ পেয়েছিল। শুঁটকি মাছ হল পিপড়াদের জন্যে খুবই আদর্শ খাবার। পুষ্টিকর। উপাদেয়। অনেকদিন ঘরে রাখা যায়। নষ্ট হয় না। পিপলীদের সৈন্যবাহিনী পাহারা দিয়ে সেই খাবার নিয়ে যাচ্ছিল। কোন রকম সমস্যা হচ্ছিল না। হঠাৎ কালো পিপড়া গোত্রের একটা পিপড়াকে দেখা গেল এগিয়ে আসছে। সে ইশারায় বলল, কথা আছে। তার মুখ গম্ভীর।

পিপলীদের দলের একজন কর্নেল এগিয়ে গেল।

 কি কথা?

কালো পিপড়া গম্ভীর গলায় বলল, আপনার পরিচয় দিন। আগে পরিচয়, তারপর কথা।

আমি রাণী-মা’র সৈন্যবাহিনীর একজন কর্নেল। আপনার কি পরিচয়?

আমি কালো গোত্রের একজন অনুসন্ধানী পিপড়া। এই যে খাবার তোমরা নিয়ে যাচ্ছ এই খাবার আমি প্রথম খুঁজে বের করি। তোমরা এটা নিয়ে যেতে পার না।

তোমার কথা সত্য না। তুমি যদি খাবার খুঁজে পেতে তাহলে খাবারের উপর তোমাদের পতাকা পুঁতে দিতে। সেই পতাকা দেখে আমরা বুঝতাম তোমরা খুঁজে পেয়েছ। খাবারের উপর তোমাদের পতাকা ছিল না।

আমাদের পতাকা পোতার নিয়ম নেই।

নিয়ম সবার জন্যই। সমস্ত পিপড় সম্প্রদায় এই নিয়ম মেনে চলে।

আমরা আগে মানতাম, এখন মানি না।

তুমি মিথ্যা কথা বলছ।

কাল পিপড়া হুংকার দিয়ে বলল, আমাকে মিথ্যাবাদী বলছ? তোমার সাহস তো কম না!

মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাবাদী বলতে সাহস লাগে না।

কি বললে! আমি মিথ্যাবাদী?

 হ্যাঁ।

তুমি কি যুদ্ধ করতে চাও?

আমি চাই না। আমাদের রাণী-মা অকারণে যুদ্ধ চান না। আমরা আমাদের খাবার নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের রাজ্যে ফিরে যেতে চাই।

শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যেতে চাও –খুব ভাল কথা। শান্তি সবাই চায়। আমরাও চাই। তবে সেই শান্তি পেতে হলে খাবার রেখে যেতে হবে।

তা সম্ভব না।

তাহলে যুদ্ধ হবে।

কালো পিপড়া কথা শেষ করেই একটু দূরে সরে গিয়ে ইশারা দিল। আর তখনি শত শত কালো পিপড়া বের হয়ে এল। তারা এতক্ষণ আড়ালে ঘাপটি মেরে বসেছিল। কালো পিপড়ারা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেল। ভয়ংকর যুদ্ধ। কালো পিপড়ারা খুবই ভাল যোদ্ধা। এদের গায়ের জোর প্রচণ্ড। তাছাড়া তাদের সঁড়াশীর মত একটা অস্ত্র আছে। লাল পিপড়াদের তা নেই। তবে লাল পিপড়ারা অনেক সংঘবদ্ধ। এদের বুদ্ধিও বেশি। তারপরও লাল পিপড়ারা যুদ্ধে হেরে গেল। এদের শত শত সৈন্য মারা গেল। যারা বেঁচে গেল, কালো পিপড়ারা তাদের বন্দি করে নিয়ে গেল। বন্দি লাল পিপড়াদের এখন কাজ হচ্ছে কালো পিপড়াদের কাজকর্ম করে দেয়া। ওদের বাড়িঘর বানানো।

পিপলী বেগমের বাবা ঐ কালো পিপড়াদের হাতেই বন্দি। তিনি কেমন আছেন, কোথায় আছেন পিপলী বেগম কিছুই জানে না। মাঝে মাঝে বাবার জন্য সে কাঁদে। সবাই যখন খেলতে যায় সে যায় না চুপ করে বসে থাকে।

আজও বাড়ি ফিরে পিপলী বেগম চুপচাপ বসে রইল। পিপলীর মা বললেন, তোর কি হয়েছে রে?

পিপলী বলল, কিছু হয় নি।

কিছু হয়নি তো মুখ এমন অন্ধকার করে বসে আছিস কেন? স্কুলে আপার বকা খেয়েছিস?

না।

তাহলে এরকম চুপচাপ বসে থেকে রেশন কার্ড নিয়ে যা। খাবার নিয়ে আয়।

আমাদের খাবার যা আছে তাতে চলে যাবে মা। আর লাগবে না।

চিনি নেই তো। কয়েক দানা চিনি থাকা ভাল। বর্ষাকাল এসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক-আধটু চিনি খেতে ভাল লাগে।

বেশি চিনি খাওয়া ভাল না, মা। ডায়াবেটিস হবে।

কে বলেছে তোকে?

স্কুলের আপা বলেছেন।

তোর দাদীমা’র চিনি খুব পছন্দ। এই বয়সে তাঁর অন্য কোন খাবার মুখে রুচে না। যা না রেশন কার্ডটা নিয়ে। লক্ষ্মী মা আমার। ময়না মা আমার।

যাচ্ছি, যাচ্ছি।

যাচ্ছিস যখন তখন তুই কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারবি?

কি কথা।

এবছর আমাদের নতুন ফ্ল্যাট দেবে কি না।

 মনে থাকলে জিজ্ঞেস করব।

তোর দাদীমা’র কথা বলিস। বেচারীর এখন একার একটা ঘর দরকার।

আচ্ছা বলব।

তোর মুখটা এমন কালো লাগছে কিছু হয়নি তো মা?

না।

পিপলী রেশন কার্ড নিয়ে গেল। পিপড়া সমাজের নিয়ম হল –সব খাদ্য স্টোর রুমে জমা হবে। তারপর হিসেব হবে কি পরিমাণ খাদ্য আছে। হিসেব মত সব খাবার সমানভাবে ভাগ করা হবে। কেউ বেশি পাবে না। কেউ কমও পাবে না।

মাঝে মাঝে কিছু খাবার পাওয়া যায় যার পরিমাণ খুবই অল্প –যেমন এক টুকরা চকলেট। খুব দামী খাবার পরিমাণ অল্প হলে রাণী মাকেই উপহার দেবার নিয়ম। তবে এদের রাণী মা কোন খাবার উপহার হিসেবে নেন না। যত ভাল খাবারই হোক প্রজাদের দিয়ে দেন। এ জাতীয় খাবারের বেলায় নিয়ম অন্য। কাকে বাড়িতে নিতে দেয়া হবে না –এখানে এসে খেতে হবে। খাবার সময় বলতে হবে –রাণীমা’র মঙ্গল হোক।

ষ্টোর ইনচার্জ পিপলীকে দেখে বললেন, কি খবর মা? মুখ মলিন কেন? শরীর ভাল।

জি চাচা শরীর ভাল।

খাবার নিয়েছিস?

হু।

পিপলীর ভাগে পড়ল চারদানা চিনি। এক টুকরা নোনতা বিসকিট। শাদা শাদা এক ধরনের গুড়া। স্টোর-ইন-চার্জকে পিপলী বলল, চাচা, ওটা কি? খেতে ভয়ংকর তিতা।

স্টোর-ইন-চার্জ রাগী গলায় বললেন, তুই কি এটা খেয়ে দেখেছিস?

হু।

তোকে নিয়ে তো বড্ড যন্ত্রণা হল। কতবার বলেছি জিজ্ঞেস না করে কিছু মুখে দিবি না।

জিনিসটা কি চাচা? বিষ না-কি?

না, বিষ না। এক ধরনের সাবান। গুড়া সাবান। গায়ে মেখে গোসল করার জন্যে আনা। তোর বুদ্ধিশুদ্ধি এখনো হলো না। কিছু দেখলেই ফট করে মুখে দিয়ে দেয়া। যা, জিনিসপত্র নিয়ে বিদেয় হয়ে যা। একা সব নিতে পারবি, না লোক দেব?

না, লোক লাগবে না। আমি নিজেই নিতে পারব। একবারে না পারলে দুবারে এসে নেব।

বাহু, এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা। নিজের কাজ নিজে করার আনন্দই আলাদা। তোর দাদীমা কেমন আছে রে পিপলী?

ভাল। আচ্ছা চাচা, আমরা কি এ বছর নতুন ফ্ল্যাট পাব না?

উঁহু। রাণী-মা’র হুকুমে বাড়ি বানানো এখন বন্ধ। এই মাটিও রাণী-মা’র পছন্দ হচ্ছে না। আরো দূর থেকে মাটি আনতে বলেছেন। তবে বাড়ি তৈরি হলে প্রথম ফ্ল্যাটটা তোদের দেয়া হবে। তোর দাদীমাকে এই নিয়ে কিছু ভাবতে নিষেধ করবি।

আচ্ছা। যাই চাচা?

কাল মনে করে আসিস। ভালখাবার পাওয়া গেছে শুঁটকি মাছ। অনেক দূর থেকে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসার কথা। কাল ভোরেই সব ভাগাভাগি করে দেব।

পিপলী বলল, শুঁটকি মাছ নিয়ে আগের বারের মত কালো পিপড়াদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে না তো।

না। বার বার কি যুদ্ধ হয়। কিছুই হবে না দেখিস।

আমাদের সৈন্য যায় নি চাচা। গিয়েছে।

আগের বারের চেয়ে অনেক বেশি গিয়েছে?

না। আগের বার যত জন গিয়েছিল, এবার ততজনই গেছে।

আরো বেশি পাঠানো উচিত ছিল না চাচা?

পাঠালে ভাল হত। তবে এসব ব্যাপারতো মা রাণীমাই ভাল বুঝেন। উনিই সব ঠিক করেন। আমাদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার দায়িত্ব তো রাণী মা’র। ঠিক না-মা?

হ্যাঁ ঠিক চাচা।

পিপলী বাড়ি ফিরে দেখে সব কেমন থমথম করছে। পিপলীর দাদীমা বিছানায় শুয়ে বিড় বিড় করে বলছেন, কি সর্বনাশ হয়ে গেল রে। কি সর্বনাশ হয়ে গেল রে। আশে পাশের ফ্ল্যাট বাড়ি থেকেও কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছে। পিপলীর মা একবার ছুটে রাস্তায় যাচ্ছেন, আরেকবার ঢুকছেন ঘরে। পিপলী বলল, কি হয়েছে মা?

যুদ্ধ লেগে গেছে রে। ভয়ংকর যুদ্ধ লেগে গেছে। এই মাত্র খবর এসেছে।

কালো পিপড়াদের সঙ্গে যুদ্ধ?

হ্যাঁ। ভয়ংকর যুদ্ধ।

 বল কি মা? আমাদের এখান থেকে সৈন্য যাচ্ছে না?

 না। রাণী মা হুকুম দিয়েছেন শ্রমিক পিপড়াদের যুদ্ধে যাবার জন্যে।

ওরা তো যুদ্ধ জানে না।

রাণী হুকুম দিয়েছেন। কিছু তো করার নেই।

এ রকম হুকুম উনি কেন দিলেন মা? উনি সৈন্য পাঠালেই পারেন। আমাদের কি সৈন্যের অভাব আছে?

রাণী মা যখন শ্রমিক পাঠাতে বলেছেন তখন ভেবে চিন্তেই বলেছেন। উনি অনেক কিছু জানেন যা আমরা জানি না। রাণী-মা’র মঙ্গল হোক। বলেই পিপলী বেগমের মা ছুটে বের হয়ে গেল।

পিপলীও গেল মা’র পেছনে পেছনে। কি করুণ দৃশ্য শ্রমিক পিপড়ারা বাড়ি থেকে বের হচ্ছে, তাদের ছেলেমেয়েরা কাঁদছে। শ্রমিক পিপড়া মাথা নিচু করে নামছে রাস্তায়। শুকনো মুখে এগুচ্ছে সামনের দিকে। প্রধান রাস্তার শুরুতে উঁচু মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে শহরের মেয়র রাণী-মা’র হুকুম পড়ে শুনাচ্ছেন —

শ্রমিক পিপীলিকার জন্যে
রাণী মা’র জরুরী বার্তা।

 কালো পিপড়াদের সঙ্গে আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি। নির্দেশ দিচ্ছি সকল শ্রমিক পিপীলিকাদের তারা যেন এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। অপ্রাপ্তবয়স্ক, রুগ্ন ও অসুস্থ পিপীলিকারাই শুধু এই নির্দেশের বাইরে থাকবে।

শ্রমিক পিপীলিকার জন্যে
রাণী-মা’র জরুরী বার্তা

কালো পিপড়াদের সঙ্গে আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি …

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পিপলী নির্দেশ শুনল। তার এত মন খারাপ লাগছে। শ্রমিক পিপড়ারা যুদ্ধের কিছুই জানে না। এরা যাবে আর মারা পড়বে। রাণী-মা কেন এদের পাঠাচ্ছেন?

পিপলী এগিয়ে গেল মেয়রের দিকে। চিকণ গলায় ডাকল, মেয়র চাচা, মেয়র চাচা।

মেয়র তাকালেন পিপলীর দিকে। তাকিয়েই চমকে উঠলেন –আরে পিপলী। তুমি আমার আশে পাশে থাক। তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে। তোমার মা’র সঙ্গে দেখা হল কিছুক্ষণ আগে তাঁকে বলেছি। তোমাকে বলা হয় নি। তোমার মা তোমাকে খুঁজছেন।

কি ব্যাপার চাচা?

বলছি। একটু সামাল দিয়ে নি। এক সঙ্গে সব ঝামেলা মাথায় এসে পড়ে। শ্রমিক পিপড়াদের বার্তা আগে শেষ করি। বলতে বলতে গলাও গেছে ভেঙ্গে।

আপনাকে এই বার্তা আর কষ্ট করে বলতে হবে না চাচা। সবাই এর মধ্যে শুনে ফেলেছে।

তা ঠিক সবাই শুনেছে।

আচ্ছা চাচা রাণী-মা সৈন্য না পাঠিয়ে এদের পাঠাচ্ছেন কেন?

আমি তো ঠিক জানি না মা। রাণী-মা কে আমিতো আর প্রশ্ন করতে পারি না। তবে আমার মনে হয় তিনি প্রথম শ্রমিক পিপড়া পাঠাচ্ছেন যাতে ওরা মনে করে আমাদের কোন সৈন্য নেই। সৈন্য শেষ হয়ে গেছে। এই ভেবে যখন তারা অসতর্ক হয়ে পড়বে তখন হয়ত আমাদের আসল সৈন্যরা যাবে।

কিন্তু তার আগেইতো আমাদের এরা সবাই মারা যাবে।

মেয়র দুঃখিত গলায় বললেন, তা ঠিক মা। তা ঠিক।

পিপলী বলল, আমার সঙ্গে আপনার কি জরুরী কথা চাচা?

খুবই জরুরী কথা মা। খুবই জরুরী কথা। রাণী-মা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার কাছে পাস পাঠিয়ে দিয়েছেন। পাস নিয়ে বাসায় চলে যাও।

পিপলী হকচকিয়ে গেল। নরম গলায় বলল, কখন যেতে হবে চাচা?

সব পাসের উপর লেখা আছে। আগামী কাল। মা এখন আমার সমানে থেকে যাও —বড়ই ব্যস্ত —

শ্রমিক পিপীলিকার জন্যে
 রাণী মা’র জরুরী বার্তা .

পিপলী বাড়ি ফিরে দেখে তার মা খুবই উত্তেজিত। তিনি ছোটাছুটি করছেন। উত্তেজনার জন্যে ঠিকমত কথাও বলতে পারছেন না।

কথা জড়িয়ে যাচ্ছে –

ও পিপলী, তোকে রাণী-মা ডেকে পাঠালেন কেন?

 জানি না মা।

কি আশ্চর্য কথা! এই দেখ, আমার হাত-পা কাঁপছে। রাণী-মা ডেকে পাঠিয়েছেন –সহজ কথা তো না। তের ভয় লাগছে না পিপলী?

একটু লাগছে?

লাগারই কথা। তবে ভয়ের কিছু নেই। রাণী-মা খুব দয়ালু। রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা হলে কি বলতে হবে জানিস তো? প্রথমেই বলতে হবে –হে পিপড়া সম্প্রদায়ের মহান রাণী! আপনার মঙ্গল হোক, কল্যাণ হোক! আর কথা বলার সময় রাণী-মা’র চোখে চোখে কখনো তাকাবি না। কথা বলার সময় রাণী-মা’র চোখের দিকে তাকানো খুব অসভ্যতা। রাণী-মা’র সঙ্গে খুব জোরেও কথা বলা যাবে না, আবার ফিসফিস করেও কথা বলা যাবে না। দুটোই অসভ্যতা।

আমি জানি মা।

আজ রাতে তোকে উপোষ থাকতে হবে।

কেন?

রাণী-মা’র কাছে ভরা পেটে যেতে নেই। রাণী-মা’র কাছে ভরা পেটে যাওয়াও অসভ্যতা।

রাতে উত্তেজনায় পিপলী বেগম, পিপলী বেগমের মা এবং দাদীমা কেউই ঘুমুতে পারল না। তিনজন একসঙ্গে বসে গল্প করে করেই রাত কাটিয়ে দিল। এত বড় একটা যুদ্ধ হচ্ছে তা যেন কারোর মনেও নেই। পিপলীর দাদীমা বললেন, আমার কাছ থেকে একটা ছড়া ভালমত শিখে যা পিপলী। ছড়া শিখে গেলে রাণী-মাকে শুনাতে পারবি। রাণী-মা খুশি হবেন।

রাগও হতে পারেন। তোমার ছড়াগুলি যা পচা পচা।

এই ছড়াটা সুন্দর। আর তুই যদি গানের মত করে বলিস তাহলে শুনতে ভাল লাগবে। ইচ্ছা করলে নেচে নেচেও শুনাতে পারিস। তবে নেচে নেচে শুনানো অসভ্যতা কিনা তাও জানি না। ছড়াটা বল।

রাণী-মা, রাণী-মা
গালে তার লালিমা …

পিপলী দাদীমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাণী-মা’র গালে লালিমা কি-না তা তো কেউ জানে না। কেউ তো রাণী-মাকে দেখেনি …

আচ্ছা, তাই তো। তাহলে তুই কি একটা মশার ছড়া শুনাবি?

মশার ছড়া? মশার ছড়া শুনে উনি কি করবেন?

 হয়ত উনার ভাল লাগবে —

মশা মশা মশা
চুপচাপ বসা
কাছে গেলে
উড়ে যায়
দূরে যায়
দিন রাত
গান গায়।
ফুল খায়
ফল খায়
মানুষের রক্ত খায়।
মশা মশা মশা
চুপ চাপ বসা।

 পিপলী, ছড়াটা কেমন লাগল রে?

ভাল লাগেনি। আর ছড়া-টড়া বলার দরকার নেই। এসো দাদীমা, আমরা চুপচাপ বসে রাত পার করে দিই। আমার ভাল লাগছে না।

ভাল লাগছে না কেন?

আমার শুধু মনে হচ্ছে রাণী-মা হয়তো আমার উপর বিরক্ত হবেন। আমাকে শাস্তি দেবেন।

ওমা, এ কেমন কথা! তোর উপর বিরক্ত হবেন কেন?

 তা জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে বিরক্ত হবেন।

অলুক্ষণে কথা বলিস না তো।

.

খুব ভোরে পিপলী বেগমের মা পিপলীকে সাবান মাখিয়ে গোসল করিয়ে আনলেন। পিপলীর চোখ এম্নিতেই সুন্দর, তারপরেও চোখের দুপাশে কাজল লাগিয়ে দিলেন। পিপলীকে সুন্দর দেখাতে লাগল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবা থাকলে আজ কত খুশি হত! আনন্দে হয়ত চিৎকার করে কাঁদত –তার মেয়ে যাচ্ছে রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা করতে –সহজ কথাতো না। কত বড় কথা! কত আনন্দের কথা! আহা, মানুষটা আজ কোথায় না জানি আছে।

দাদীমা বললেন, ভয় লাগছে না-কি রে পিপলী?

পিপলী বলল, না। তার কিন্তু ভয় লাগছে। বেশ ভয় লাগছে।

.

সূর্য আকাশে অনেকখানি উঠেছে। পিপলী বেগম রওনা হয়েছে রাণী-মা’র কাছে। পিপলীর মা ঘরে বসে কাঁদছেন।

রাণী-মা’র বাড়ি পিপড়াদের মূল বসতবাড়িগুলি থেকে দূরে। শুধু দূরে নয় অনেকখানি দূরে। পিপড়াদের বসতবাড়ি মাটির নিচে, খুব নিচে নয় –অল্প নিচে। সূর্যের আলো যেন সেখানে যেতে পারে তার ব্যবস্থা আছে। রাণী-মা’র বাড়ি তারচেয়েও অনেক নিচে। সুরঙ্গ পথে যেতে হয়। সুরঙে কিছুক্ষণ পর পর পাহারা। বাজখাই গলায় পাহারাদাররা চেঁচিয়ে উঠে, কে? কে যায়?

পিপলী ভয়ে ভয়ে বলে –আমি। আমি পিপলী বেগম।

যাওয়া হচ্ছে কোথায়?

 রাণী-মা’র বাড়ি। উনি ডেকে পাঠিয়েছেন?

পাশ আছে?

আছে।

আছে বলে হাবার মত দাঁড়িয়ে থেকো না। দেখাও।

পিপলী পাশ দেখায়। আরো খানিকক্ষণ যায়। আবার একজন চেঁচিয়ে ওঠে —-কে? কে যায়?

এমন করে যেতে যেতে সে একটা সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছল। জায়গাটা তত অন্ধকার না। আবছা করে হলেও সব দেখা যাচ্ছে। উঁচু দেয়াল-ঘেরা জায়গা। এই দেয়ালের নাম প্রথম দেয়াল। এরকম আরো দু’টা দেয়াল পেরুবার পর রাণী-মা’র বাড়ি।

প্রথম দেয়ালে একটিমাত্র গেট। বন্ধ গেটের বাইরে বেশ কজন উঁচু পদস্থ কর্মচারী। এরা সবাই গম্ভীর। এদের মেজাজও মনে হয় ভাল না। একটু দূরে রক্ষীবাহিনীর একজন বড় অফিসারকে ঘিরে কয়েকজন অফিসার। প্রথম গেটটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গেটে পাশ পরীক্ষা করা হয়। সেই পরীক্ষা খুব জটিল পরীক্ষা। পরীক্ষার পর এই পাশ রেখে নতুন পাশ দেয়া হয়।

পিপলী বেগমের পাশ দু-তিনজন মিলে পরীক্ষা করল। পাশ ঠিকই আছে। রক্ষীবাহিনীর অফিসার বললেন –পিপলী বেগম, তোমার সঙ্গে কি কিছু আছে? কোন বিপদজনক অস্ত্র বা এই জাতীয় কিছু?

জি না। এই দেখুন আমার হাত খালি।

 তোমার চোখ এমন দেখাচ্ছে কেন? চোখে কি দিয়েছ?

আমার মা দিয়ে দিয়েছেন –কাজল।

এইত সমস্যা হল। চোখে কাজল পরে রাণী-মা’র কাছে যাওয়া যায় কি-না তাও তো জানি না। নিয়ম-কানুনের বইটা দেখো তো।

নিয়ম-কানুনের বই অনেকক্ষণ ধরে ঘাঁটা হল। কিছুই পাওয়া গেল না। অফিসার বললেন –এ তো দেখি ভাল যন্ত্রণা হল!

পিপলী বেগম বলল, আমি না হয় কাজল মুছে ফেলি।

না, তার প্রয়োজন দেখছি না। কষ্ট করে তোমার মা চোখে কাজল দিয়ে দিয়েছে। দেখাচ্ছেও সুন্দর। আচ্ছা চল, তোমাকে দ্বিতীয় দেয়ালে নিয়ে যাই। ওরা বোধহয় জানে।

দ্বিতীয় দেয়ালের একটামাত্র গেট। সেই গেট পাহারা দিচ্ছে সৈন্যবাহিনী। শুধু গেট না –সমস্ত দেয়াল জুড়েই সৈন্যবাহিনীর সারি। দেখলেই ভয়ে গা কাঁপে। কি তাদের চেহারা! কি তাদের স্বাস্থ্য!

দ্বিতীয় দেয়ালের গেটে পিপলীকে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল। তারাও চোখের কাজল সম্পর্কে কিছু পেল না। সেনাবাহিনীর অফিসার বললেন, সবচে ভাল হয় কাজল তুলে ফেললে। পিপলী তাতে রাজি। বসে থাকতে তার আর ভাল লাগছে না। তা ছাড়া তার অসম্ভব খিদে পেয়েছে। খুব পিপাসাও পেয়েছে সে চোখের কাজল মুছে ফেলল।

সেনাবাহিনীর অফিসার নিজেই তাকে সঙ্গে নিয়ে তৃতীয় দেয়ালের গেটে পৌঁছে দিলেন। তৃতীয় এবং শেষ দেয়াল পাহারা দিচ্ছে রাণী-মা’র নিজস্ব সৈন্যবাহিনী। এই বাহিনীর সব সৈন্যই মেয়ে। পিপলীর মনে হল এরা পুরুষ সৈন্যদের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ এদের প্রত্যেকের দুটি করে সাঁড়াশী আছে। ধারালো সাঁড়াশী ঝক ঝক করছে। মেয়ে সৈন্যবাহিনীর প্রধান পিপলী বেগমকে নিজের অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়ে যন্ত্রের মত গলায় বলল —

শোন পিপলী বেগম –এখন থেকে তোমার সঙ্গে কেউ যাবে না। তুমি একা হেঁটে হেঁটে রাণী-মা’র প্রাসাদের দিকে যাবে। দূর থেকেই প্রাসাদ দেখা যায়। তোমার চিনতে কোন অসুবিধা হবার কথা না। প্রাসাদের সামনে দাঁড়ালেই তুমি রাণী-মাকে দেখতে পাবে। রাণী-মা দিনের প্রথম অংশে বারান্দায় সিংহাসনে বসে থাকেন। প্রাসাদের চারদিকে লাল দাগ দেয়া আছে। লাল দাগের ভেতরে যাবে না। ভেতরে যাবার নিয়ম নেই। লাল দাগের ভেতরে পা দেয়ার অপরাধের একটাই শাস্তি –নির্বাসন। মনে থাকবে?

হু

হু আবার কি? আদব-কায়দা তো মনে হচ্ছে কিছুই শেখোনি। বল –জ্বি মহামান্যা। মনে থাকবে।

জী মহামান্যা, মনে থাকবে।

রাণী মা’র সঙ্গে দেখা হবার পর তুমি যা বলবে তা হচ্ছে –হে পিপীলিকা সমাজের মহান রাণী! আপনার মঙ্গল হোক, কল্যাণ হোক। মনে থাকবে?

জি মহামান্যা, মনে থাকবে।

এখন এসো, প্রতিজ্ঞা কর।

পিপলী বিস্মিত হয়ে বলল, কি প্রতিজ্ঞা?

রাণী-মা’র কাছে যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করতে হয়।

কিভাবে প্রতিজ্ঞা করব?

 হাঁটু গেড়ে বস।

পিপলী হাঁটু গেড়ে বসল।

 বল —

শপথ চন্দ্র ও সূর্যের নামে, শপথ পৃথিবীর নামে, শপথ আমার
পিতা ও মাতার নামে, –শপথ বৃর্ষার প্রথম বৃষ্টির নামে,
শপথ খাদ্যের নামে মহান রাণী-মা’র কোন অনিষ্ট করিব না
কিংবা কাউকে অনিষ্ট করিতে দিব না।

পিপলী বলল। তখন তাকে গেটের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। সে হতভম্ব হয়ে দেখল রাণী-মা’র প্রাসাদ। এ তো প্রাসাদ নয়, এ যেন এক স্থলপদ্ম ফুটে আছে। কি প্রকাণ্ড! কি কারুকার্যময়! প্রাসাদের গায়ে কত না ফুল, লতা পাতা আঁকা। কি অপূর্ব সব নকশা! কত অসংখ্য গম্বুজ —কত যে খিলান। প্রাসাদের নিচটা টকটকে লাল —যতই উপরের দিকে যাওয়া হচ্ছে লাল রঙ ততই কমছে। প্রাসাদের উপরের দিকটা ধবধবে শাদা। লাল থেকে প্রাসাদ হয়েছে শাদা। কোথায় লাল রঙের শুরু, কোথায় শাদা রঙের আরম্ভ বোঝার কোন উপায় নেই। ভেসে আসছে সুমধুর বাঁশি। পাতার বাঁশি। প্রসাদের ভেতর বসে অনেকেই একসঙ্গে বাঁশি বাজাচ্ছে।

পিপলী প্রাসাদের দিকে হাঁটতে শুরু করল। একসময় এসে পৌঁছল। রাণী মাকে দেখা যাচ্ছে –বারান্দায় সিংহাসনে বসে আছেন। কি সুন্দর লাগছে রাণী মাকে। কি সুন্দর! তবে যে তাকে বলা হল –রাণী মা কাউকে দেখা দেন না। তিনি থাকেন পর্দার আড়ালে। এইত সে দেখতে পাচ্ছে। যদিও রাণী-মা’র দিকে তাকানোর নিয়ম নেই। তাকালে অসভ্যতা হয়। অসভ্যতার শাস্তি নির্বাসন। তবু পিপলী চোখ নামাতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে সে সারাজীবন রাণী-মা’র দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবে।

কি সুন্দর! কি সুন্দর! আর তাঁর সিংহাসনটাই কত সুন্দর! সিংহাসনের নিচটাও লাল উপরের দিকটা শাদা। অবিকল প্রাসাদের মত।

রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা হবার পর তাঁকে যেসব কথা বলতে হয় তার কিছুই এখন পিপলী বেগমের মনে নেই। সব ভুলে গেছে। সে কয়েকবার বলল, হে মহান! হে মহান! হে মহান! … বাকি কথাগুলি আর মনে পড়ল না। রাণী-মা হাসলেন। চাপা হাসি। তারপর নরম গলায় বললেন —

কেমন আছ পিপলী বেগম?

পিপলী বেগমের গলায় কথা আটাকে যাচ্ছে। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ভা ভা ভা ভাল আছি রাণী মা। সে আবার কথাগুলি বলার চেষ্টা করল, হে মহান হে মহান করল কিন্তু লাভ হল না। কিছুই মনে পড়ছে না।

রাণী-মা বললেন, তুমি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত?

পিপলী মাথা নাড়ল। সে ক্ষুধার্ত। অসম্ভব ক্ষুধার্ত। রাণীমা নিজ থেকে বলার আগে তা সে নিজেই বুঝতে পারে নি। রাণী-মা বললেন –পিপলীকে খেতে দাও।

দুটি পিপড়া থালায় করে খাবার আনছে। কিন্তু তারা এমন অদ্ভুতভাবে হাঁটছে কেন? এলোমেলোভাবে পা ফেলছে। শুধুমাত্র অন্ধরাই এমনভাবে হাঁটে। আচ্ছা, এরা কি অন্ধ?

দুটি পিপড়া যন্ত্রের মত এক সঙ্গে বলল, তোমার জন্যে খাবার এনেছি। খেয়ে নাও।

পিপলী কৌতূহল সামলাতে না পেরে বলল, আচ্ছা, আপনারা কি অন্ধ?

তোমার এত কথার দরকার কি? খাবার এনেছি, খাও।

আপনাদের ধন্যবাদ।

আমাদের ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই। রাণী-মাকে ধন্যবাদ দাও।

রাণী-মাকে ধন্যবাদ।

থালাভর্তি তরল সোনার মত খাবার।

ঝিকমিক করছে। কি তার গন্ধ! চারদিক মোহিত হয়ে যাচ্ছে। পিপলী একটু মুখে দিল –এত মিষ্টি! এত স্বাদ! ইশ, সে যদি তার মাকে আর দাদীমাকে একটু খাওয়াতে পারত! খানিকটা খাবার কি সে তাদের জন্যে নিয়ে যাবে? নিয়ে গেলে কি অসভ্যতা হবে? রাণীমা রাগ করবেন?

যারা খাবার এনেছে তাদের একজন ফিসফিস করে বলল, গবগব করে খেও না। রাণী-মা’র সামনে গব গব করে খাওয়া অসভ্যতা। পিপলী বলল, এই খাবারটার নাম কি?

নাম দিয়ে তুমি কি করবে? এই খাবার কি আর খেতে পারবে? আর পারবে না। এ হচ্ছে রাণী-মা’র খাবার। নিশি ফুলের মধু। নাম শুনেছ কখনো?

না।

দেখ, তোমার কত ভাগ্য, যে খাবারের নামও কখনো শুননি সেই খাবার খেতে পাচ্ছ। চেটেপুটে খাও। ফেলে রেখো না।

পিপলী চেটেপুটে খেল। তার ইচ্ছা করছে যে থালায় করে খাবার এনেছে সেই থালাটাও খেয়ে ফেলতে। এতই মজার খাবার!

রাণী-মা বললেন, পিপলী বেগম।

জি রাণী মা!

আমি শুনেছি তোমার পড়াশোনা করতে ভাল লাগে না। এটা কি সত্যি পিপলী?

সত্যি নয়, রাণী-মা।

তাহলে তুমি মিথ্যা কথা বলেছ তোমার বড় আপার কাছে?

জি রাণী-মা।

তুমি অপরাধ করেছ পিপলী বেগম। শাস্তি পাবার মত অপরাধ।

জি রাণী-মা।

কিন্তু তুমি অঙ্কে উনিশ পেয়েছ। ভূগোলে মাত্র তেইশ। তুমি কি অঙ্ক এবং ভূগোল ঠিকমত পড়নি?

ঠিকমতই পড়েছি।

তাহলে পরীক্ষা খারাপ হল কেন?

 ইচ্ছা করে পরীক্ষা খারাপ দিয়েছি। জানা অঙ্ক ভুল করেছি।

কেন?

কারণ আমি জানি পরীক্ষা খারাপ করলে আপনি ডেকে পাঠাবেন। এর আগে একজন পরীক্ষা খারাপ করেছিল –আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

কি কথা বলতে চাও?

আমি কি আপনার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি রাণী-মা?

পার।

পিপলী রাণী-মা’র দিকে তাকাল। রাণী-মাও এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে না তিনি খুব রাগ করছেন। বরং মনে হচ্ছে। তিনি মজা পাচ্ছেন।

পিপলী বেগম!

জি রাণী-মা।

বল, কি বলতে চাও।

 পিপলী কি বলবে গুছিয়ে নিল। যদিও রাণী-মাকে এখন আর ভয় ভয় করছে না, তবু তার কাছে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর হালকা লাগছে। একটু যেন ফুর্তি-ফুর্তি ভাবও হচ্ছে। এরকম হচ্ছে কেন? খাবারটার জন্যে হচ্ছে?

রাণী-মা বললেন, চুপ করে আছ কেন? শুরু কর। আমি তোমার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি।

রাণী-মা, আপনার সঙ্গে দেখা হলে যে কথাটা বলতে হয় সেই কথাটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়েছে –হে পিপীলিকা সম্প্রদায়ের মহান রাণী, আপনার মঙ্গল হোক! কল্যাণ হোক!

রাণী-মা বললেন, তোমারও মঙ্গল হোক। কল্যাণ হোক।

রাণী-মা এখন আমি বলি –কি জন্যে এসেছি।

 বল।

বলার আগে আমার খুব নাচতে ইচ্ছা করছে। রাণী-মা, আমি কি একটু নাচতে পারি? বেশি নাচব না। অল্প একটু নাচব।

বেশ তো নাচ। আমি অনেকদিন নাচ দেখি না।

পিপলী বেগম ঘুরে ঘুরে খানিকক্ষণ নাচল –গুন গুন করে নাচের সঙ্গে গানও গাইল —

নাচে পিপলী নাচে রে
ধিন ধিনাধিন নাচে রে
 ঘুরে ফিরে নাচে রে
শুড় ঘুরিয়ে নাচে রে।
পা কাঁপিয়ে নাচে রে
নাচে পিপলী নাচে রে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ