মোতাহের সাহেব তাঁর অফিস ঘরে বসে আছেন। পুরানা পল্টনের গলির ভেতর অফিস। অফিসটা যে বেশ বড় সড় বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। ভেতরে অনেক জায়গা। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়। ভেতরে প্রেস আছে। প্রেসের মালিক নতুন যামানা ধরনের নামের কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন। যদিও অফিস ঘরের একটা সাইনবোর্ড আছে— M. Khan and Sons General Merchant, সাইনবোর্ডটা শ্বেতপাথরে লেখা। সেই শ্বেতপাথর অফিসের গেটে বসানো। এম খান হলেন মেরাজ উদ্দিন। মোতাহার উদিনের বাবা। তাঁর দুই ছেলের একজন দেশে আছে— অন্যজন সাবের খান থাকেন নিউজার্সিতে। একুশ বছর বয়সে দেশ ছেড়েছিলেন এখন তাঁর বয়স পাঁচপঞ্চাস। এর মধ্যে দেশে আসেন নি। দেশের কারোর সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগও নেই।

মোতাহার সাহেবের অফিস ঘর অন্য সব অফিস ঘরের মত না। বৈঠকখানা বৈঠকখানা ভাব। চেয়ার টেবিলের সঙ্গে একটা সিঙ্গেল খাটিও এক পাশে পাতা। খাটে মশারির স্ট্যান্ড লাগানো। মোতাহার সাহেব মাঝে মাঝে দুপুরে খাটে শুয়ে থাকেন। তখন মাছি খুব বিরক্ত করে বলে মশারি খাটান। তার খাস বেয়ারা মঞ্জু মশারির বাইরে বসে হাত বাড়িয়েঞ্জার পায়ের আঙুল টেনে দেয়। অফিস ঘরের দুটা বড় জানালা আছে। বাইরের হৈচৈ, বিশেষ করে ট্রাকের হর্ণ মোতাহার সাহেবের অসহ্য লাগে বলে জানালা সব সময় বন্ধ থাকে। শুধু বন্ধ না, জানালায় ভারি পর্দা টেনে দেয়া থাকে। কাজেই অফিস ঘরে সারাক্ষণ বাতি জ্বলে। লোড শেডিং-এর সময় মঞ্জু মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে যায়। হলুদ রঙের মোমবাতি। কোনো এক বিচিত্র কারণে মোতাহার সাহেব সাদা মোমবাতি সহ্য করতে পারেন না।

আজ সকাল থেকেই লোড শেডিং। মোতাহার সাহেব পা তুলে কাঠের চেয়ারে বসে আছেন (গদিওয়ালা চেয়ারে তিনি বসতে পারেন না; তাঁর না-কি সুড়সুড়ি লাগে)। ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। মোতাহার সাহেব নাক কুঁচকে মোমবাতির দিকে তাকিয়ে আছেন; মোমবাতির শিখা ঠিকমত জ্বলছে না। বাঁকা হয়ে জ্বলছে বলে প্রচুর মোম গলে গলে পড়ছে। অন্যসময় হলে শিখাটা ঠিক করে দিতেন। আজ তা করছেন না, কারণ তাঁর শরীর খুবই খারাপ লাগছে। গায়ে জ্বর নেই, কিন্তু থার্মোমিটার ধরতে পারে না এমন জুরে শরীর কাহিল হয়ে আছে। শরীরের ভেতরে শীত লাগছে। শরীরের বাইরে লাগছে না। বাইরে বরং সামান্য গরম লাগছে। তিনি বিশ্ৰী গন্ধ পাচ্ছেন। যে-কোনো বড় ধরনের অসুখের আগে আগে মোতাহার সাহেব এরকম গন্ধ পান। টাইফয়েড় হবার আগে পেয়েছেন, জণ্ডিস হবার আগে পেয়েছেন। সেই দুবারই তাঁর জীবন সংশয় হয়েছিল।

তিনি টেবিলে লাগানো কলিং বেল কয়েকবার টিপলেন। মঞ্জু ঘরে ঢুকাল না। ইলেকট্রিসিটি নেই বলে কলিংবেল কাজ করছে না – এটা তার মাথায় নেই! ডাকা-মাত্ৰ মঞ্জুকে না দেখলে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হন। তিনি রাগী গলায় ডাকলেন, মঞ্জু, মঞ্জু।

মঞ্জু দরজা টেনে প্ৰায় ঝড়ের মত এসে উপস্থিত হল। মঞ্জুকে তিনি কেন ডেকেছেন মনে করতে পারলেন না। তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন, মনেও পড়ল না। তিনি খুবই বিরক্ত হলেন। দুৰ্গন্ধটা আরো কড়া হয়ে নাকে আসছে। কোনো ইদুর কি মরে পড়ে আছে? মঞ্জু করে কী! ভালমত দেখবে না। তিনি মঞ্জুর উপর রাগটা কমানোর চেষ্টা করছেন। কমাতে পারছেন না। রাগটা পুরোপুরি না কমা পর্যন্ত মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে না। মনে রাগ নিয়ে তিনি কারো সঙ্গে কথা বলেন না। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।

মঞ্জু।

জ্বে।

পঁচা গন্ধ পাচ্ছিস?

জ্বে না।

আমিতো পাচ্ছি। তুই পাচ্ছিস না কেন? নাক বন্ধ?

মঞ্জু, জবাব দিল না। মাথা নিচু করে রাখল। মোতাহার সাহেব বললেন, চা দে।

মঞ্জু ঘর ছেড়ে চলে গেল। যাবার সময় খুব সাবধানে দরজা বন্ধ করল। দরজা বন্ধের শব্দ মোতাহের সাহেবের অসহ্য লাগে। দরজায় প্যাডের মত লাগানো হয়েছে। তারপরেও দরজা বন্ধ করলে, খুললে ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দ হয়। সেই শব্দও তাঁর সহ্য হয় না।

পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে মঞ্জু বলল, ম্যানেজার সাহেব কথা বলতে চান। আসতে বলব?

মোতাহার সাহেব মাথা কান্ত করলেন। পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ পড়ে আছে। তিনি চা খাচ্ছেন না। এটা নতুন কিছু না। তিনি প্রায়ই চা চান। তাকে চা দেয়া হয়। পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ সামনে পড়ে থাকে, তিনি ছুঁয়েও দেখেন না।

ম্যানেজার ছালেহ ঘরে ঢুকলেন। চেয়ার টেনে সাবধানে বসলেন। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের উপর। মোটা থলথলে শরীর। বয়স যত বাড়ছে তাঁর শরীর তত বাড়ছে। মোতাহার সাহেব তাঁর এই ম্যানেজারকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। ম্যানেজার শ্রেণীর মানুষ কখনো সৎ হয় না। এই মানুষটা সৎ। ব্যবসা অত্যন্ত ভাল বুঝেন। হাস্যমুখী মানুষ। মুখের কােটাটা এমন যে সব সময় মনে হয়। ভদ্রলোক হাসছেন। মোতাহার সাহেব যেমন কখনোই রাগেন না, ইনি আবার অন্যরকম, চট করে রেগে যান।

মোতাহার সাহেব সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, ছালেহ কেমন আছ?

জ্বি ভাল।

কোনো খবর আছে?

ম্যানেজারের মুখে হাসি দেখা গেল। আসল হাসি। মুখে লেগে থাকা সাৰ্বক্ষণিক হাসি না।

পনেরো লাখ টাকার চেকটা ক্যাশ হয়েছে। আমিতো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।

ক্যাশ হয়েছে?

জ্বি। ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করেছিলেন।

মোতাহারু সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভাল খবর; তুমি অসাধ্য সাধন করেছ।

স্যার আপনার কি শরীর খারাপ?

শরীরটা ভাল লাগছে না।

বাসায় চলে যান।

শরীর যদি ভাল না লাগে, কোনোখানে ভাল লাগবে না।

প্রেসারটা মাপবেন? ডাক্তার সাহেবকে খবর দেই?

মোতাহার সাহেব জবাব দিলেন না। ছালেহ উদ্দিন বললেন, এক কাজ করুন, শুয়ে থাকুন, মঞ্জুকে বলি পা টিপে দিক।

আচ্ছা বল।

ছালেহ উঠতে যাচ্ছিলেন, মোতাহার সাহেব বললেন, তুমি বোস। তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে।

ছালেহ সাথে সাথে বসে পড়লেন। মোতাহার সাহেব জরুরি কথা কিছু বললেন না। আগের মত মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ছালেহ বললেন, ছোট বাবু কি ময়না পাখিটা পছন্দ করেছে?

হুঁ করেছে। খুব পছন্দ করেছে। সে খুবই খুশি।

ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসে। মোমবাতি নিভে গেছে। ফ্যান থেকে খট খট শব্দ আসছে। ফ্যানের এই আওয়াজ মোতাহার সাহেবের খুবই অপছন্দ। এসির আওয়াজ তার চেয়েও বেশি অপছন্দ। প্ৰচণ্ড গরমেও এই ঘরে ফ্যান কিংবা এসি চলে না। যদিও নিজের বাড়িতে এসি চলে। সেই শব্দে তার কোনো সমস্যা হয় না। মঞ্জু হাত পাখা দিয়ে তাঁকে হওয়া করে। ঝালর দেয়া বিরাট একটা তালপাখা এই ঘরে ঝুলানো আছে।

ছালেহ বললেন, স্যার ফ্যান বন্ধ করে দেব?

মোতাহার সাহেব বললেন, না থাক।

জরুরি কথা কী বলবেন বলছিলেন।

মোতাহার সাহেব পা নামিয়ে বসলেন। তিনি বসেছিলেন রিভলভিং চেয়ারে। সেই চেয়ার খুব সাবধানে ম্যানেজারের দিকে ঘুরালেন যেন চেয়ারে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ না হয়। তারপরেও শব্দ হল।

ছালেহ।

জ্বি।

শুভ্ৰকে তোমার কেমন ছেলে মনে হয়?

ছালেহ কিছুক্ষণ তাঁর বড় সাহেবের তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, আপনার প্রশ্নটা বুঝলাম না। শুভ্ৰ কেমন ছেলে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মালিকের ছেলে বলে না… এই জীবনে আমি অনেক ছেলেপুলে দেখেছি, এরকম দেখি নাই।

তোমার কি মনে হয় আমার মৃত্যুর পর শুভ্র আমার ব্যবসা দেখবে?

জ্বি না। স্যার, দেখবে না। তবে…

তবে আবার কী?

মানুষ বদলায়…

মোতাহার সাহেব। আবারো চেয়ারে পা তুলতে তুলতে বললেন, এটা তো ছালেহ তুমি ভুল কথা বললে। কিছুই বদলায় না। একটা বড় পাথর ক্ষয় হয়ে ছোট পাথর হয়। কিন্তু পাথর পাথরই থাকে। মানুষের বেলাতেও এটা সত্যি। মানুষও পাথরের মত। শুভ্ৰ বদলাবে না। এখন যে রকম আছে পঞ্চাশ বছর পরেও তাই থাকবে।

ঠিক বলেছেন। ছোট বাবুর জন্যে কথাটা খুব সত্যি।

শুধু ছোট বাবুর জন্যে সত্যি না। সব বাবুর জন্যেই সত্যি। যে সৎ সে জন্ম থেকেই সৎ, যে অসৎ সে জন্ম থেকেই অসৎ।

ছালেহ কিছু বললেন না। তাঁর চোখের উদ্বেগ আরো বাড়ল। বড় সাহেবের শরীর খারাপটা কোন পর্যায়ের তা তিনি ধরতে চেষ্টা করছেন।

মোতাহার সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার মৃত্যুর পর আমার ব্যবসা কে দেখবে?

ছালেহ চুপ করে রইলেন। মঞ্জু ঘরে ঢুকল। তার হাতে কর্ডলেস টেলিফোনের রিসিভার। মঞ্জু কঁচুমাচু মুখে বলল, আম্মার ফোন। টেলিফোনের শব্দে মোতাহার সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে মাথা ধরে যায় বলে টেলিফোন সেট দোতলায় রাখা। জরুরি। টেলিফোন হলেই মঞ্জু রিসিভার নিয়ে ছুটে আসে। নিতান্ত জরুরি না হলে মোতাহার সাহেব টেলিফোন ধরেন না। টেলিফোনে সূক্ষ্ম এক ধরনের শব্দ হয়— যে শব্দ অন্য কেউ শুনতে পায় না। কিন্তু তিনি শুনতে পান এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে।

মোতাহার সাহেব রিসিভার কানে দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন, হ্যালো জাহানারা। কী ব্যাপার?

জাহানারা উত্তেজিত গলায় বললেন, তুমি কি আজ দুপুরে বাসায় খাবে?

কেন?

ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটেছে, তোমার আসা দরকার। অফিসে যদি তেমন কোনো কাজ না থাকে তুমি চলে এসো।

ঘটনাটা কী?

বাসায় আস তারপর বলি। সব কিছু কি আর টেলিফোনে বলা যায়!

জরুরি কাজ আছে, আসতে পারব না। ঘটনা। কী বল।

টাকা চুরি গেছে।

ও আচ্ছা।

পাঁচশ টাকার তিনটা নোট। খাবার ঘরে যে হলুদ ম্যাট আছে। ম্যাটের নিচে রেখেছিলাম। দুধের বিলের টাকা। দুধের বিল প্লাস টাকা। বিলটা আছে, নোট তিনটা নেই।

ও।

টাকাটা কে নিয়েছে আমি বের করেছি। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। টাকাটা নিয়েছে বিনু। উচ্চ শিক্ষার জন্যে যিনি ঢাকা এসে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন সেই বিনু।

তুমি তাকে কিছু বলেছ?

এখনো কিছু বলি নি।

ভাল করেছ। আমি এসে যা বলার বলব। টাকা চুরি গেছে এটা সে জানে?

হ্যাঁ জানে। ভাল মানুষের মত সে নিজেও খোঁজাখুঁজি করছে। এই খাটের নিচে ঝাঁট দিচ্ছে, এই বালিশ উল্টাচ্ছে। কত বড় হারামজাদি ভাবছে তার অভিনয় কেউ বুঝতে পারছে না।

তুমি কিছু বলো না।

আমি বলব না। কিন্তু এই চুরানী মেয়েকে তুমি আজই বিদায় করবে। দরকার হলে হোটেলে ঘর ঠিক করে দিবে। হোটেলে থাকবে। এই চুরুনীর সঙ্গে আমি এক ছাদের নিচে থাকব না।

আচ্ছা। শুভ্র কোথায়?

ঘরেই আছে। কথা বলবে?

না।

তুমি কি শুভ্ৰকে বিকেলে গাড়ি দিতে পারবে? সে তার কোন বন্ধুর বাসায় যাবে। শুভ্র অবশ্য বলছে গাড়ি নেবে না। কিন্তু গাড়ি ছাড়া ওকে আমি কোথাও যেতে দেব না। আজই পত্রিকায় দেখেছি – রিকশা করে এক হাসবেন্ড-ওয়াইফ। যাচ্ছিল, পেছন থেকে ট্রাক ধাক্কা দিয়েছে, মেয়েটা মারা গেছে। ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় নিউজটা আছে। ছবি দিয়ে ছেপেছে। তোমার অফিসে ইত্তেফাক রাখা হয়?

না।

তাহলে কাউকে দিয়ে ইত্তেফাকটা আনিয়ে নিউজটা পড়।

আচ্ছা পড়ব।

টেলিফোনের পাতলা রিনারিনে শব্দ মোতাহার সাহেবকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। এতক্ষণ তিনি রিসিভার কানের সঙ্গে লাগিয়ে রেখেছিলেন, এখন একটু দূরে সরিয়ে রাখলেন। জাহানারার সঙ্গে কথা বলার প্রধান সমস্যা হল জাহানারা কিছুতেই টেলিফোন ছাড়তে চায় না। কথা বলার মত প্রসঙ্গ তার থাকেই।

হ্যালো হ্যালো।

শুনতে পাচ্ছি।

তোমার অফিস থেকে কাউকে বলবে যেন একজন গ্যাসের চুলার মিস্ত্রি নিয়ে আসে। চুলটার কী হয়েছে গ্যাসের কোনো প্রেসার নেই।

বলব।

তোমার গলার স্বর এরকম কেন? শরীর খারাপ করছে?

না, শরীর ঠিক আছে। জাহানারা এখন রাখি- একটা জরুরি কাজ করছি।

মোতাহার সাহেব টেলিফোন রিসিভার মঞ্জুর হাতে দিতে দিতে বললেন, মঞ্জু আরেক কাপ চাপ দে। কড়া করে দিস। পানসে চা খেতে পারি না।

মঞ্জু আগের কাপটা নিয়ে চলে গেল। ভরা কাপ। মোতাহার সাহেব একটা চুমুকও দেন নি। ছালেহ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, স্যার একজন ডাক্তার নিয়ে আসি প্রেসারটা মাপুক।

মোতাহার সাহেব ডাক্তার লাগবে না। এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর শরীরটা দ্রুত খারাপ করছে। আগে বমি ভাব ছিল না। এখন বমি ভাব হচ্ছে। বিশ্ৰী গন্ধ অনেকক্ষণ ধরে নাকে আসছে বলেই বমি ভাব হচ্ছে।

ছালেহ।

জ্বি স্যার।

বাসায় একজন গ্যাসের চুলার মিস্ত্ৰি পাঠাতে হবে।

জ্বি আচ্ছা!

তুমি একটু ব্যাংকে যাও- কিছু ক্যাশ টাকা নিয়ে আসা। ব্যাংক খোলা আছে না?

জ্বি খোলা আছে।

নতুন নোট আনবে। একশ টাকার নতুন নোট।

জ্বি আচ্ছা।

পঞ্চাশ টাকার নোটও এন। নতুন হয় যেন। পুরনো না। ব্যাংকে যদি নতুন নোট না থাকে তুমি মানি চেঞ্জারদেরকে দিয়ে নতুন নোটের ব্যবস্থা করবে।

জ্বি আচ্ছা।

মোতাহার সাহেব মানিব্যাগ খুলে চেক বের করে দিলেন। চেক আগেই লেখা ছিল। ছালেহ চেকের ওপর চোখ বুলিয়ে বিস্মিত চোখে তাকাল। তিন লাখ টাকার চেক। হঠাৎ করে এত ক্যাশ টাকার দরকার পড়ল কেন? তাও সব নতুন নোট।

মোতাহার সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, গাড়ি নিয়ে যাও। টাকা ক্যাশ করে নিজের কাছে রেখে দিও। আমাকে দেয়ার দরকার নেই। আমি পরে চেয়ে নেব। বুঝতে পারছ?

জ্বি।

কাজ শেষ করে গাড়ি বাসায় পাঠিয়ে দিও। শুভ্ৰ কোথায় যেন যাবে।

জ্বি আচ্ছা। স্যার আপনার কি শরীর বেশি খারাপ?

মোতাহার সাহেব জবাব দিলেন না। মঞ্জু, দ্বিতীয় চায়ের কাপ এনে সামনে রেখেছে। সে বড় সাহেবের দিকে ভীত চোখে তাকাচ্ছে। মোতাহার সাহেব চায়ের কাপের দিকে ফিরেও তাকালেন না। তিনি বারবার নাক কুঞ্চিত করছেন। তিনি দুৰ্গন্ধ এখনো পাচ্ছেন। তবে এখন আগের চেয়ে কিছু কম। সিলিং ফ্যানের খট খটক শব্দটাও এখন আর আগের মত কানো লাগছে না।

তিনি বিছানায় শুতে গেলেন- কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে যদি শরীর ভাল লাগে। মঞ্জু মশারি খাটিয়ে দিল। সে হাত বাড়িয়ে পায়ের আঙ্গুল টানতে শুরু করেছে। মোতাহার সাহেব ঘুমুতে চেষ্টা করছেন। ঘুম আসছে না। এতক্ষণ মাথা ঘুরছিল না। এখন মাথাও ঘুরছে। এটা হচ্ছে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যে। অসুস্থ অবস্থায় ঘুরন্ত কোনো কিছুর দিকে তাকাতে নেই। বাইরের ঘূর্ণিমাথার ভেতর ঢুকে যায়। তিনি মঞ্জুকে ফ্যান বন্ধ করতে বললেন। মঞ্জু লাফ দিয়ে উঠে। ফ্যান বন্ধ করল। তখন তাঁর গরম লাগতে লাগল। মনে হচ্ছে তিনি ভদ্র দুপুরে নৌকার ওপর ছাতা ছাড়া বসে আছেন। রোদের ঝাঁঝাঁটা পড়ছে মাথায়। নদীর পানির গরম ভাব মুখে লাগছে! সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নৌকার দুলুনি। মঞ্জুকে তিনি আবার ফ্যান চালু করতে বললেন। মঞ্জু ফ্যান চালু করল। তিনি অসহিষ্ণু গলায় বললেন, মঞ্জু স্পীড বাড়িয়ে দে। বাতাস লাগছে না।

মঞ্জু ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে সঙ্কুচিত গলায় বলল, বড় সাহেব একজন ডাক্তার ডেকে আনি?

মোতাহার সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দরকার নাই; তুই আমাকে ঠাণ্ড এক গ্লাস পানি এনে দে। বরফ দিয়ে খুব ভাল মত ঠাণ্ড করে আনবি।

মঞ্জু পানি নিয়ে এসে দেখে বড় সাহেব। ঘুমিয়ে পড়েছেন। সে খুব সাবধানে পানির গ্রাস টেবিলে রেখে বের হয়ে গেল। বড় সাহেব ঘুমিয়ে পড়লে তাঁর ঘুম ভাঙ্গানো নিষেধ। শুধু নিষেধ না, কঠিন নিষেধ। তখন জরুরি টেলিফোনও আঁকে দেয়া যায় না। বলা আছে, শুধু যদি ছোট বাবু টেলিফোন করেন। তবেই তাঁর ঘুম ভাঙ্গানো যাবে। তবে ছোট বাবু কখনো টেলিফোন করেন না। মঞ্জুর কি উচিত বড় বড় সাহেবের বাড়িতে টেলিফোন করে তাঁর অসুখের খবরটা দেয়া? উচিত তো বটেই, কিন্তু সমস্যা আছে। অফিসের কারোরই কোনো অবস্থাতেই বড় সাহেবের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি নেই। বৎসর খানেক আগেই এই সামান্য কারণে একজনের চাকরি চলে গিয়েছিল। তার অপরাধ হলো সে টেলিফোনে জানতে চেয়েছিল— বড় সাহেব কখন অফিসে আসবেন।

জাহানার আছরের নামাজে বসার প্রায় সাথে সাথে ঝেঁপে বৃষ্টি এল। তিনি তখন সূরা ফাতেহার মাঝামাঝি। তিনি খুবই অস্থির বোধ করলেন। এই বাড়িটা এমন যে বৃষ্টি এলেই পূর্ব দিকের বারান্দার গ্ৰীল দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে। রান্নাঘর আর শুভ্ৰর ঘরে পানি থৈথৈ করতে থাকে। শুভ্ৰ তাতে খুবই মজা পায়। তিনি অস্থির বোধ করেন।

বাড়িতে দুদিন ধরে কোনো কাজের লোক নেই যে, এরা বুদ্ধি করে জানালা বন্ধ করবে। আর শুভ্র এমন ছেলে যে হা করে বৃষ্টি দেখবে— জানালা বন্ধ করবে: না। তারপর বৃষ্টির পানিতে নিজেই হোঁচটি খেয়ে পড়বে।

নামাজ ছেড়ে উঠে যাওয়া ঠিক হবে না— বড় রকমের গুনাহর কাজ হবে। জাহানারা অতি দ্রুত সূরা শেষ করতে চেষ্টা করলেন। এতে সব কিছু আরো জন্ট পাকিয়ে যেতে লাগল। সূরা ফাতিহা আবার প্রথম থেকে ধরলেন। সূরা শেষ করার আগেই মনে হল— প্রথম রাকাতটা কি পড়া হয়েছে? না, হয় নি। একই সঙ্গে বৃষ্টি কোন দিকে থেকে আসছে তিনি ধরতে চেষ্টা করছেন। উত্তর দিক থেকে এলে তেমন সমস্যা নেই। কারা যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বিনু হাঁটছে। মেয়েটার মতলবটা কী? বৃষ্টি হচ্ছে জানালা বন্ধ করতে হবে এই অজুহাতে সে শুভ্রর ঘরে ঢুকে যাবে নাতো? যে সব গ্রামের মেয়ে শহরে পড়তে আসে তারা তলে তলে হাড় বজ্জাত হয়। মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু আখের গোছাতে তারা ওস্তাদ। তারচেয়েও ওস্তাদ অজুহাত তৈরি করতে। রাত তিনটার সময়ও যদি এই মেয়েকে শুভ্রর ঘরে পাওয়া যায়। সে শুকনো মুখে এমন এক অজুহাত দেবে যে মনে হবে। রাত তিনটায় শুভ্ৰর ঘরে থাকা খুব প্রয়োজন ছিল। তিনি হয়ত তার জন্যে বিনুকে ধন্যবাদও দেবেন। শুভ্ৰর সঙ্গে এই মেয়ের ভালই যোগাযোগ আছে। এটা থাকবেই। এই মেয়ে শুভ্রর মত ছেলেকে যে-কোনো মূল্যে হাতে রাখবে।

জাহানারার নামাজে গণ্ডগোল হয়ে গেলা— তিনি সিজদায় গিয়ে আত্তাহিয়াতু পড়লে শুরু করলেন। ভুল নামাজ চালিয়ে যাবার অর্থ হয় না। তিনি নামাজ বাদ দিয়ে উঠে পড়লেন। মাগরেবের সময় কাজা পড়ে নিলেই হবে। ভুলভাল নামাজ পড়তে সোয়াবের চেয়ে গুণ বেশি হয়। দরকার কী?

বৃষ্টি পূর্ব দিক থেকেই এসেছে। তবে ঘরে পানি ঢুকে নি। এতক্ষণ ঘরে যে হাঁটাহাঁটির শব্দ শুনছিলেন সেটাও কানের ভুল। বিনুর ঘর বন্ধ; শুভ্রর ঘরাও বন্ধ।

তিনি শুভ্রর ঘরের দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। ঘর অন্ধকার। সব কটা জানোলা বন্ধ। শুভ্র ইজিচেয়ারে মূর্তির মত বসে আছে। খুবই অস্বাভাবিক দৃশ্য। বৃষ্টি হবে। আর শুভ্র জানালা খুলে বৃষ্টি দেখবে না, এটা হতেই পারে না।

কী হয়েছে রে, শুভ্ৰ?

শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, কিছু হয় নি তো। কিছু কি হবার কথা?

এরকম বিম ধরে বসে আছিস কেন?

একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস ভাবছিলাম মা। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামতেই মনে হল— ময়না পাখি শুধু কি মানুষের কথা নকল করে না-কি প্রাকৃতিক শব্দও নকল করে! যেমন ধর বৃষ্টির শব্দ। কিংবা ঝড়ের শব্দ। সমুদ্রের ঢেউ-এর শব্দ।

জাহানারা ছেলের খাটের এক কোণায় বসলেন। শুভ্ৰর উদ্ভট উদ্ভট কথা শুনতে তাঁর খুবই ভাল লাগে। উদ্ভট কথাগুলি সে বলে এত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে!

তোর যে বাইরে যাবার কথা যাবি না?

যাব।

কখন যাবি?

বৃষ্টি থামলেই যাব। আজ আমার ইচ্ছা করছে হুড খুলে রিকশা করে যেতে। বৃষ্টি থাকলে ভিজে যাব। কাক ভেজা হয়েতো কারোর বাসায় উপস্থিত হওয়া যায় না। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছে এইভাবে যেতে।

রিকশা করে যাবি কেন? তোর বাবা গাড়ি পাঠাচ্ছে।

গাড়িতে যাব না মা। তোমাকে কী বললাম, আজ আমার রিকশা করে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। মা তুমি কি একটা কাজ করবে।— বিনুকে বলবে একটু আসতে?

জাহানারা অবাক হয়ে বললেন, কেন?

ওকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। কী কথা?

কী কথা?

শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, কথাটা তোমাকে বলা যাবে না মা। যার কথা তাকেই বলতে হবে। তোমাকে বলা গেলে আমি নিশ্চয়ই বিনুকে ডাকতাম না।

এমন কী কথা যে আমাকে বলা যাবে না?

শুভ্ৰ হাসল। মিষ্টি করে হাসল। জাহানারায় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে শুরু করল— বিনুর প্রসঙ্গে ছেলেটা এমন মিষ্টি করে হাসছে কেন? কোনো ঘটনা নেই তো?

জাহানারা গম্ভীর মুখে বললেন, শুভ্ৰ এখন তোকে একটা কথা বলব। না বললেও হত— কিন্তু বলা দরকার। বিনু প্রসঙ্গে একটা কথা।

বল শুনি।

জাহানারা নিচু গলায় বললেন, মেয়েটা ভাল না।

শুভ্ৰ হাসি হাসি মুখে বলল, ভাল না কেন?

ওর অনেক আজেবাজে স্বভাব আছে। আমার কাছে যেটা সবচে খারাপ লাগছে সেটা হচ্ছে – মেয়েটা চোর। বিরাট চোর। গরীবের ঘরে জন্মেছে তো।

শুভ্ৰ যতটা অবাক হবে বলে জাহানারা ভেবেছিলেন সে ততটা অবাক হল না। বরং স্বাভাবিক গলায় বলল, বিনু চোর না-কি? ইন্টারেস্টিং তো! কী চুরি করে?

জাহানারা গুছিয়ে গল্প শুরু করলেন। শুভ্র খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। তবে তার মুখ হাসি হাসি।

জাহানারা চাপা গলায় বললেন, খাবার ঘরের টেবিলে চায়ের কাপে চাপা দিয়ে তিনটা পাঁচশ টাকার নোট রেখেছিলাম দুধের বিল দেব বলে। কিছুক্ষণ পরে এসে দেখি নোট তিনটা নেই। শুধু দুধের বিলটা আছে। কাজের মেয়েটা ছুটিতে। ঘরে মানুষ বলতে- তুই, আমি আর বিনু বাতাসে নোট তিনটা উড়ে জানালা দিয়ে চলে যায় নি। যদি যেত দুধের বিলটাও যেত। দুধের বিল ঠিকই আছে, নোট তিনটা নেই। টাকাটা নিলে হয় আমি নেব, নয়ত তুই নিবি, কিংবা বিনু। তুই নিশ্চয় টাকা নিয়ে যাস নি।

শুভ্ৰ হাসছে। শব্দ করে হাসছে। যেন জাহানারা এই মাত্র মজার কোনো গল্প বলে শেষ করেছেন। জাহানারা রাগী গলায় বললেন, তুই হাসছিস কেন?

তুমি বানিয়ে বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প বলছ— এই জন্য হাসছি। তোমার ফেব্রিকেটেড লাইনগুলি খুবই হাস্যকর হয়।

জাহানারা থমথমে গলায় বললেন, বানিয়ে গল্প বলছি মানে?

শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, মা আজ হচ্ছে মাসের ২৮ তারিখ। আজ তুমি দুধের বিল দেয়ার জন্যে টাকা বের করবে না। এটা ৩১-এ মাস, দুধওয়ালা দুধের বিলই দেয় নি।

জাহানারা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। শুভ্র খুব সহজ গলায় বলল, মা আমি খুব ছোটবেলা থেকে লক্ষ করছি— তুমি বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বল। এবং এক সময় তোমার বানানো কথা তুমি নিজে বিশ্বাস করতে শুরু করা। আমার মনে হয় এটা তোমার এক ধরনের অসুখ।

জাহানারা যন্ত্রের মত বললেন, আমার অসুখ?

হ্যাঁ অসুখ। আমি যখন ক্লাশ গ্ৰীতে পড়ি তখন স্কুলের সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। চশমা ভেঙ্গে গিয়েছিল। চশমার কাচে কপাল কেটে গিয়েছিল। তুমি সবাইকে বলেছ- রিকশায় করে বাসায় ফেরার সময় আমি এ্যাকসিডেন্ট করেছি। পেছন থেকে একটা প্ৰাইভেট কার ধাক্কা দিয়ে আমার রিকশা ফেলে দিয়েছে। কত বছর আগের ব্যাপার অথচ এই ঘটনা সেদিনও তুমি আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের বললে।

কখন বললাম?

আমার হাম হয়েছিল। সবাই দলবেঁধে আমাকে দেখতে এসেছিল, তখন বললে।

যখন বলেছিলাম। তখন তুই আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলি না কেন? তখন কেন বললি না— আমার মা মিথ্যে কথা বলছে। আমার মা মিথ্যাবাদী।

শুভ্র বলল, মা তুমি রাগ করছ?

জাহানারা কোঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলবি আর আমি রাগ করতে পারব না? তুই চুপ করে বসে থাক, নড়বি না। আমি দুধের বিল নিয়ে আসছি। এই নতুন দুধওয়ালা প্রতি মাসেই পঁচিশ-ছাব্বিশের দিকে দুধের বিল দিয়ে দেয়। এখন আমি ডেইরি ফার্ম থেকে দুধ নিচ্ছি। ওরা খুব নিয়মকানুন মেনে চলে।

শুভ্ৰ বলল, একটা মিথ্যা বললে পরপর অনেকগুলি মিথ্যা বলতে হয় মা। তুমি দুধওয়ালা বদলাও নি, আগের দুধওয়ালাই দুধ দিচ্ছে। গতকালও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।

আচ্ছা যা আমি মিথ্যাবাদী। এখন আমাকে কী করতে হবে? তোর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে না, বিনুর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে?

শুভ্র বিব্রত গলায় বলল, মা শোন, তাকাও আমার দিকে।

জাহানারা তাকালেন না। ছেলের ঘর থেকে উঠে চলে এলেন। তাঁর মনে আশা ছিল শুভ্ৰ তাঁর পেছনে পেছনে উঠে আসবে। শুভ্র তা করল না। জাহানারা খুবই অবাক হয়ে দেখলেন বৃষ্টি থামা মাত্র শুভ্ৰ বের হয়ে গেল।

জাহানারা আড়াচোখে লক্ষ্য করলেন, বেড়াতে যাচ্ছে অথচ সে পরেছে ইস্ত্রি ছাড়া একটা শার্ট। চুল আঁচড়েছে, কিন্তু আঁচড়ানো ভাল হয় নি। সিঁথি বাঁকা হয়েছে। রিকশা করে যে সে যাচ্ছে, মানিব্যাগ কি সঙ্গে নিয়েছে? আর সঙ্গে নিলেও মানিব্যাগে কি ভাংতি টাকা আছে? দশ টাকা ভাড়া দেবার জন্যে সে হয়ত পঁচিশ টাকার একটা নোট বের করবে। রিকশাওয়ালাকে টাকা ভাঙ্গিয়ে আনতে বলবে। সে টাকা নিয়ে ভোগে চলে যাবে।

জাহানারা শুভ্রর ঘরে ঢুকলেন। তিনি যা ভেবেছিলেন। তাই। শুভ্ৰ মানিব্যাগ ফেলে গেছে। বিছানার ঠিক মাঝখানে মানিব্যাগ এবং রুমাল পড়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে শেষ মুহূর্তে সে মানিব্যাগ এবং রুমাল নিতে ভুলে গেছে।

জাহানারা বিনুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিনুকে খুব কঠিন কিছু কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কঠিন কথাগুলি গুছিয়ে নিতে পারলে ভাল হত। কিছু গোছানো নেই। অবশ্য কথা গোছানো থাকারও সমস্যা আছে। তিনি লক্ষ করেছেন গোছানো কথা তিনি প্ৰায় কখনোই বলতে পারেন না।

বিনুর ঘরের দরজা ভেজানো। জাহানারা ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। বিনু বিছানায় শুয়েছিল। ধড়মড় করে উঠে বসল। জাহানারা বিকেলের অস্পষ্ট আলোতেও লক্ষ করলেন মেয়েটার চোখ ভেজা। নিশ্চয়ই শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল। জাহানারা গলার স্বর যতদূর সম্ভব কঠিন করে বললেন, আছর ওয়াক্তে শুয়ে ঘুমাচ্ছ কেন? আছর ওয়াক্তে শুয়ে থাকা যে কতবড় অলুক্ষণে এই শিক্ষা কি বাবা-মা দেয় নাই? নামাজও তো কখনো পড়তে দেখি না। তোমাদের বাড়িতে নামাজের চল নাই? তোমার বাবা নামাজ পড়েন?

বিনু নিচু গলায় বলল, জ্বি পড়েন।

আমারতো মনে হয় না তুমি ঠিক বলছি। আমাদের এখানে যখন এলেন আমি খেয়াল করেছি – মাগরেবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। তিনি গল্পই করছেন গল্পই করছেন।

বিনু চুপ করে আছে। তার চোখের পানি এখনো বন্ধ হয় নি। জাহানারা লক্ষ করলেন মেয়েটা অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মোছার চেষ্টা করছে এবং চোখের পানি বন্ধ করার চেষ্টা করছে। চোখে পানি কেন?— এই প্রশ্ন কি করবেন? জাহানারা বুঝতে পারছেন না।

তোমার বাবাতো আজও এলেন না। ব্যাপারটা কী বলতো? মেয়েকে এখানে ফেলে রেখে মেয়ের ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলেছে। না-কি কারো বাড়িতে গিয়ে গল্পে মজে গেছে। এমন গল্পবাজ মানুষ আমি আমার জীবনে দেখি নি। কী মনে হয়— তোমার বাবা কবে আসবে? না-কি কোনোদিন আসবেই না।

বাবা বৃহস্পতিবার আসবেন।

কী করে বললে? গান গুনে?

বাবার চিঠি পেয়েছি।

বাবার চিঠি পেয়েছ বৃহস্পতিবারে আসবে এই খবরটা আমাকে জানাবে না?

চিঠিটা আজ দুপুরে পেয়েছি।

চিঠিতে কী লিখেছেন?

লিখেছেন বৃহস্পতিবারে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। আর বলেছেন আপনাকে সালাম দিতে।

দেখি চিঠিটা।

বিনু অবাক হয়ে তাকাল। জাহানারা বললেন, চিঠিটা দাও দেখি কী লেখা! বাবা নিশ্চয়ই চিঠিতে মেয়েকে এমন কিছু লিখবে না যে সেই চিঠি অন্য কেউ পড়তে পারবে না।

বালিশের নিচ থেকে বিনু চিঠি বের করে দিল। জাহানারা বুঝতে পারছেন চিঠি পড়া উচিত হচ্ছে না। কিন্তু তিনি কৌতূহল আটকাতে পারছেন না। বিনু যে ভর সন্ধ্যায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে তার সঙ্গে বাবার কাছ থেকে আসা চিঠির নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা জানতে ইচ্ছে করছে। মেয়েকে এই বাড়িতে রেখে ইউনিভার্সিটিতে পড়াবে এ ধরনের ইঙ্গিততো চিঠিতে থাকতে পারে। যদি থাকে তাহলে এ বিষয়েও আগে ভাগে ব্যবস্থা নিতে হবে। জাহানারা চিঠি পড়লেন।

আমার অতীব আদরের কন্যা
মোসাম্মত হামিদা বানু (বিনু)
মাগো আমার,
আমার শত সহস্ৰ দোয়া এবং আদর নিও। পর সমাচার এই যে মা— তোমাকে আমি যে যথাসময়ে বাড়িতে নিতে পারি নাই তার জন্যে আমার দুঃখের সীমা নাই। ইনশাল্লাহ আমি আগামী বৃহস্পতিবার দ্বিপ্রহরে চলিয়া আসিব। এবং সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হইব (ইনশাল্লাহ)। মাগো ঢাকায় আসা যাওয়ার ভাড়া জোগাড় করিতে পারি নাই বলিয়া এই সমস্যা হইয়াছে; সব সমস্যার যেমন সমাধান আছে, এই সমস্যারও সমাধান আছে। বুধবার নাগাদ প্রয়োজনীয় টাকার ব্যবস্থা হইবে। এই বিষয়ে তুমি কোনোরকম দুঃশ্চিন্তা করিও না। বাকি আল্লাহপাকের ইচ্ছা।
ভাবি সাহেবকে আমার সালাম দিবে। অতি মহীয়সী মহিলা। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলিয়া আমার অন্তর জুড়াইয়া গিয়াছে। নিজের মাতার মতই তাহাকে দেখিবে এবং তাহার দোয়া নিবে। মাগো, আমরা অতি দরিদ্ৰ— মানুষের দোয়াই আমাদের একমাত্র সম্বল।
এখন একটা সুসংবাদ দেই— তুমি লিচু গাছের যে চারাটি রোপন করিয়াছিলে সেই চারাতে এই বৎসর মুকুল আসিয়াছে। ইনশাল্লাহ তুমি এই বছর তোমার নিজের রোপন করা গাছের লিচু খাইতে পরিবে। ইহা বিরল সৌভাগ্যের বিষয়। যদিও তোমার মা গাছ কাটাইয়া ফেলিবার জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করিতেছে, কারণ আমাদের অঞ্চলে প্ৰবাদ আছে যে বসত বাড়িতে লিচু গাছ বাপন করা হয় সেই বাড়িতে বংশে বাতি দিবার কেহ থাকে না। তবে আমার ধারণা ইহা কথার কথা। গাছের সাথে বংশের কোনো সম্পর্ক নাই! তুমি মোটেও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হইবে না। আমার অতি আদরের কন্যা মোসাম্মত হামিদা বানু যে বৃক্ষ রোপন করিয়াছে আমার জীবন থাকিতে কেহ সেই বৃক্ষের ক্ষতি সাধন করিতে পরিবে না।
দোয়াগো
তোমার পিতা
মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ