আজহার অফিসে যান নি। গতকাল রাতে দুবার খাওয়ায় শরীর বিগড়ে গেছে। ঘনঘন বাথরুমে যেতে হচ্ছে। অ্যাসিডিটিতে বুক জ্বলে যাচ্ছে। দুধ খেলে অ্যাসিডিটির আরাম হয়। যুথী মোড়ের দোকান থেকে এক প্যাকেট মিল্কভিটা নিয়ে এসেছে। তিনি পুরোটা খেয়ে কিছুক্ষণ আগে বমি করেছেন। বমির পর মাথা ঘুরছে। এই উপসৰ্গ দুধ খাওয়ার আগে ছিল না। আজহার যুথীকে বললেন, আমি তো মনে হয় মারা যাচ্ছিরে মা।

যুথী বাইরে যাবে। শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে নির্বিকার গলায় বলল, এত সহজে কেউ মারা যায় না। বাবা।

আজহার বললেন, মানুষ সহজেই মারা যায়। আলেকজান্ডারের মতো মহাবীর ইলিশ মাছ খেয়ে মারা গেছে। কাল রাতে তোর বান্ধবীর বাড়ি থেকে যে খাবার এসেছে, সেখানে ইলিশ মাছের আইটেম ছিল। স্মোকড় হিলসা। আমি ঐ আইটেমটাই বেশি খেয়েছি।

মহাবীর আলেকজান্ডারের ইলিশ মাছ খেয়ে মৃত্যুর গল্প আজহার তাঁর বস ইমতিয়োজ সাহেবের কাছে শুনেছেন। ইমতিয়োজ সাহেব সুন্দর সুন্দর গল্প করেন। তাঁর সব গল্পই আজহার সুযোগমতো ব্যবহার করেন।

যুথী বলল, বেশি খেলেও তুমি মরবে না। বাবা। কারণ তুমি মহাবীর আলেকজান্ডার না। তুমি কাপুরুষদের একজন।

সালমা মাছ কুটছিলেন। মাছ ফেলে উঠে এসে বললেন, এইসব কী ধরনের কথা? বাজারের নটিরাও তো বাপের সঙ্গে এইভাবে কথা বলে না।

যুথী বলল, বাজারের নটিদের বাবারা নটিদের সঙ্গে বাস করে না। কাজেই নটিরা এ ধরনের কথা বলে না।

আজহার বললেন, বাদ দাও। কথা চালাচালি বন্ধ। তুই যাচ্ছিস কোথায়?

চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি।

কিসের চাকরি? কী ইন্টারভিউ? আমি তো কিছুই জানি না।

সবকিছু তোমাকে জানতে হবে?

অবশ্যই। আমি এই সংসারের প্রধান। আমাকে সবকিছু জানতে হবে। তোর মা দুপুরে কী রাধবে তাও আমি জানব।

তোমার সবকিছু জানার দরকার নেই।

আজহার মেয়েকে কঠিন কিছু কথা বলার প্রস্তুতি নিলেন। কথাগুলি বলতে পারলেন না। তাকে অতি দ্রুত বাথরুমে ঢুকতে হলো। যুথী তার মাকে বলল, মা যাই। দোয়া করো যেন চাকরিটা হয়।

সালমা বললেন, কিসের চাকরি?

যুথী বলল, এখনো জানি না কিসের চাকরি। বেতন অনেক। কুড়ি হাজার টাকা। কোম্পানির গাড়ি এসে নিয়ে যাবে, দিয়ে যাবে।

বলিস কী!

যাই মা।

মাকে কদমবুসি করে দোয়া নিবি না?

হলো না-কদম বুসি মাঠে মারা গেল। এটা তো ঠিক না।

যুথী বের হয়ে গেল। বাথরুম থেকে আজহার ডাকছেন, যুথী, পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা কর। জাস্ট ফাইভ মিনিটস।

যুথী চলে যাবার আধঘণ্টার মধ্যে গিফটয়্যাপে মোড়া বিশাল প্যাকেট এসে উপস্থিত। সঙ্গে মুখবন্ধ খাম। খামের ওপর লেখা মিস যুথী।

আজহার খাম হাতে নিয়ে বললেন, একটা ধারালো ব্লেড আনো। চিঠিতে কী লেখা দেখি।

সালমা বললেন, যুথীর চিঠি তুমি পড়লে ও খুব রাগ করবে।

রাগ করলেও চিঠি পড়তে হবে। কোথায় কী চিঠি চালাচালি হচ্ছে জানতে হবে না? তাছাড়া যুথী কিছু জানতে পারবে না। খাম এমনভাবে খুলব যে ডিটেকটিভ। শার্লক হোমস সাহেবও ধরতে পারবেন না। চুলায় পানি দিয়ে কেতলি বসাও।

কেন?

আজহার বললেন, কেতলির মুখ দিয়ে ষ্টিম বের হবে। খামটা স্টিমে ধরলে পাম নরম হবে। তখন ব্লেড় দিয়ে খুলব। চিঠি পড়া শেষ হলে আগের মতো লাগিয়ে রাখা হবে। ক্লিয়ার?

আজহার চিঠি খুলে পড়লেন। চিঠিতে লেখা——

যুথী,

আমার ছেলে শুভ্ৰ বিপদে পড়েছিল। তাকে তুমি সাহায্য করেছি। তার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। সামান্য কিছু ফল পাঠালাম। গ্রহণ করলে খুশি হব।

ইতি
শুভ্রর মা।

আজহার বললেন, শুভ্ৰটা কে?

সালমা বললেন, জানি না কে।

তুমি তার মা। তুমি কিছুই জানো না?

আমাকে না বললে জানব কীভাবে?

তুমি অতি মুর্থ একজন মহিলা। মূর্থিশ্রেষ্ঠ। মেয়ের সঙ্গে মায়ের থাকবে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক। যেন মেয়ে পেটে কথা রাখতে না পারে। রাতে এক বিছানায় মা-মেয়ে শোবে। মেয়ে গুনগুন করে সব কথা বলবে। তুমি সময়মতো আমাকে জানাবে। তা-না, সন্ধ্যা হতেই ঘুম। বুদ্ধির কোনো নাড়াচাড়া আমি তোমার মধ্যে দেখলাম না। অপদার্থ মেয়েছেলে!

গালাগালি করছি কেন?

গালাগালি করছি কারণ গালাগালি তোমার প্রাপ্য। চিঠি পড়ে তো আমার গায়ের রক্ত পানি হবার উপক্রম হয়েছে। শুভ্ৰ মহাবিপদে পড়েছে, এমনই বিপদ যে উদ্ধারের পর তার মা একগাদা ফল পাঠিয়েছে। আর উদ্ধার কে করেছে? তোমার মেয়ে। আমি নিশ্চিত ড্রাগঘটিত কিছু! শুভ্র ড্রাগ চালাচালিতে পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছিল। তোমার মেয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে হাতে-পায়ে ধরে তাকে ছাড়িয়ে এনেছে। তোমার মেয়ে তো কথার রানি। ও কি তার ঘর তালা দিয়ে গেছে?

হুঁ।

এইটাও তো একটা কথা, যখনই বাইরে যাবে ঘর তালা দিয়ে যাবে কেন? এমন কী আছে ঘরে যা কেউ দেখতে পারবে না? আমি তালা খোলার লোক নিয়ে আসছি। তালা খুলে আজ তার ঘর চেক করা হবে।

তোমার শরীরটা খারাপ! শুয়ে থাকে। অন্য কোনোদিন তালা খোলা হবে।

আজহার শার্ট পরতে পরতে বললেন, এইসব জিনিস দেরি করতে নাই। কুইক অ্যাকশানে যেতে হয়। শরীর খারাপের আমি কেঁথা পুড়ি।

 

ইন্টারভিউ বোর্ডে সাধারণত বেশ কয়েকজন থাকেন। এখানে বোর্ডে একজনই আছেন। মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। সুন্ট-টাই পরা না। হালকা সবুজ রঙের টিশার্চ পরা। ভদ্রলোকের চুল কোঁকড়ানো। চেহারা সুন্দর। তাঁর সামনে কোনো ফাইলপত্র নেই। আছে কোনো একটা গল্পের বই। ইন্টারভিউ নেওয়ার চেয়ে গল্পের বই পড়ার ব্যাপারে তার আগ্ৰহ বেশি দেখা যাচ্ছে। কথাবাতাঁর ফাঁকে ফাঁকে তিনি বইও পড়ছেন। তাঁর নাম আহসান। তিনি চিকেন ফেদার কোম্পানির সৰ্বেসৰ্ব্ব। চেয়ারম্যান সাহেবের ঘরটাও খুব সুন্দর। দেয়ালে তিনটা পেইনটিং। প্রতিটাই সুন্দর। একটা পেইনটিং-এ গ্রামের মেয়ে ঘোমটা দিয়ে তাকিয়ে আছে। এটা এত সুন্দর যে যুথীর চোখ বারবার সেখানে চলে যাচ্ছে।

আহসান বললেন, বিএসসি অনার্স পাশ করেছেন। রেজাল্টও বেশ ভালো। প্রথম শ্রেণী। এমএসসি শেষ করলেন না কেন? কারণটা কি আর্থিক?

জি।

অনার্সে সাবজেক্ট কী ছিল?

ম্যাথমেটিকস।

ইন্টারেস্ট্রিং।

ইন্টারেস্টিং কেন?

মেয়েরা সাধারণত অঙ্কের দিকে যায় না। তারা সাইকোলজি, সাহিত্য, এইসব পড়ে। মেয়েদের ছোট করার জন্যে বলছি না। এটাই জেনারেল ট্রেন্ড। ভুল বললে সরি।

যুথী বলল, স্যার ভুল বলেন নি।

ভদ্রলোক বললেন, বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল ছিলেন অঙ্কের ছাত্র। তাঁর নাম জানেন?

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভেরি গুড। তাঁর কোনো বই পড়েছেন?

দুটা বই পড়েছি—পুতুল নাচের ইতিকথা আর জননী। আমার এক বান্ধবী আছে, তার নাম নীপা। সে খুব বই পড়ে। নীপা যেসব বই আমাকে পড়তে দেয়, আমি তা-ই পড়ি।

আপনি যদি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম বলতে পারেন, আমি আপনাকে চাকরি দিয়ে দেব। বলতে পারবেন?

নাম বলতে না পারলে চাকরি পাব না?

যুথী বলল, এই চাকরির সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক কী?

কোনো সম্পর্ক নেই। এই মুহূর্তে আমি উনার একটা বই পড়ছি বলে এরকম সিদ্ধান্ত নিলাম।

যুথী বলল, উনার আসল নাম প্ৰবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

কনগ্রাচুলেশনস।

ভদ্রলোক বোতাম টিপলেন। এবার সুন্ট-টাই পরা একজন ঢুকলেন। আহসান বই থেকে মুখ না তুলে বললেন, জহির, এই মেয়েটির নাম যুথী। সে আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করছে। অফিস এক্সিকিউটিভ। অ্যাপিয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু করার ব্যবস্থা করুন।

জয়েনিং ডেট কবে স্যার?

সামনের মাসের এক তারিখ।

জহির যুথীর দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম আসুন আমার সঙ্গে।

যুথীর সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। এটা কেমন চাকরির ইন্টারভিউ? এত বড় একটা কোম্পানি চলবে খামখেয়ালিভাবে? যুথী কী জানে বা জানে না। এই সম্পর্কে এরা তো কিছুই জানে না। বর্তমান সময়ের কাজের প্রধান যে বিষয় কম্পিউটার জানা তাও সে জানে না। ইংরেজিতে সে খুবই কাঁচা। কারও সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালানো তার জন্যে অসম্ভব ব্যাপার।

জহির বলল, ম্যাডাম! এইটা আপনার রুম। একটু অগোছালো আছে। আজ দিনের মধ্যেই গুছিয়ে দেওয়া হবে। আপনার পার্সেনাল অ্যাসিসটেন্টের নাম গফুর। সে বিরাট ফাঁকিবাজ। তাকে সবসময় ধমকের ওপর রাখবেন।

আমার আগে এখানে কে বসতেন?

শর্মি ম্যাডাম বসতেন। উনি ছিলেন কম্পিউটারের জাদুকর। যে-কোনো প্রবলেম নিমিষে solve করতে পারতেন।

উনার চাকরি কি নেই?

গত মাস থেকে তাকে অফ করা হয়েছে।

কেন?

ম্যাডাম জানি না কেন! চা খান, চা দিতে বলি?

বলুন।

আমি দশ মিনিট পর কাগজপত্র রেডি করে নিয়ে আসব।

যুথী তার ঘরে বসে আছে। ঠান্ডা ঘর। এসি চলছে। বিজবিজ করে এসির শব্দটা এমন অদ্ভুত লাগছে। যুথীর এখন মনে হচ্ছে, এটা কোনো স্বপ্ন। মাঝে মাঝে সে নিখুঁত স্বপ্ন দেখে। একবার স্বপ্নে দেখল, বাসে করে যাচ্ছে। তার পাশেই বুড়োমতো এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের কোলে পাঁচ-ছয় বছরের একটা মানসিক প্রতিবন্ধী ধরনের মেয়ে। সে হা করে আছে। তার মুখ থেকে ক্রমাগত লালা পড়ছে। মেয়েটা ই ই ই করে শব্দ করছে এবং লালা মাখানো হাত দিয়ে যুথীকে ধরার চেষ্টা করছে। অতি বাস্তব ধরনের স্বপ্ন।

নিজের অফিসঘরে সে বসে আছে—এটাও নিশ্চয় সেরকম স্বপ্ন। এক্ষুনি বাবার কাশির শব্দে ঘুম ভাঙবে। প্রতিদিনই যুথীর ঘুম ভাঙে বাবার কাশির শব্দে। ঘুম ভাঙার পর তিনি ঘণ্টাখানিক কেশে শরীরের কলকব্জা ঠিক করেন। বাকি দিন আর কাশেন না।

যুথী টেলিফোন করে তার চাকরি পাওয়ার খবর নীপকে দিল। নীপা বলল, এক কথায় চাকরি দিয়ে দিল? ব্যাটার অন্য কোনো মতলব নাই তো?

অন্য কী মতলব?

হয়তো চাকরির অলিখিত শর্ত, সে যখন দেশের বাইরে যাবে তোকেও সঙ্গে যেতে হবে।

আমাকে সঙ্গে যেতে হবে কেন?

ঘুমপাড়ানো মাসিপিসি হিসেবে যেতে হবে। রাতে বসের ঘুম আসছে না। তুই যাবি, বসের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তাকে ঘুম পাড়াবি।

কী বলছিস এইসব!

ঠাট্টা করছি। আজ সন্ধ্যায় বাসায় চলে আয়, আমরা সেলিব্রেট করব। করিম আংকেলও আসবেন। তার মাথায় নতুন এক আইডিয়া এসেছে। তিনি আইডিয়া শোনাবেন। তুই অবশ্যই আসবি। ঠিক আছে?

হ্যাঁ ঠিক আছে।

গাড়ি পাঠাব?

গাড়ি পাঠাতে হবে না।

যুথী! তুই কি সত্যি চাকরি করবি?

হুঁ।

M.Sc. শেষ করবি না?

না।

সেকেন্ড থাট দিবি?

না।

যুথী টেলিফোন রেখে দিল। গফুর যুথীর জন্যে চা এনে কচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

আপনার নাম গফুর?

জি ম্যাডাম।

যুথী কিছুক্ষণ গফুরের দিকে তাকিয়ে রইল। একে সে যখন-তখন ধমকাতে পারবে, এই চিন্তাটাও আনন্দদায়ক।

 

আজহার মেয়ের ঘরের তালা খুলে পুরো ঘর। তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন। একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে। সেই ডায়েরি তিনি নিয়ে এসেছেন। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে গোপনে এই ডায়েরি পড়তে হবে। এর মধ্যে মেয়ে যদি ডায়েরির খোঁজ করে তিনি বলবেন, তোর ডায়েরির বিষয়ে আমরা জানব কী করে? তুই তো তোর ঘর তালা দিয়েই রাখিস।

যুথী বাসায় ফিরল। বিকেল চারটায়। আজহার বসার ঘরের সোফায় পা তুলে বসা। মনে হচ্ছে মেয়ের ফেরার অপেক্ষায় আছেন। সালমাও স্বামীর পাশে বাসা। আজহার যতক্ষণ বাসায় থাকেন এই মহিলা চেষ্টা করেন। স্বামীর আশেপাশে থাকতে।

যুথী বলল, তোমার শরীরের অবস্থা কী বাবা?

শরীর ভালো; কে যেন তোকে একটা চিঠি দিয়েছে। আর একটা বক্স পাঠিয়েছে। ব্যাপার কী বলা তো? আগে চিঠিটা পড়।

যুথী চিঠি পড়ল।

আজহার বললেন, চিঠিতে কী লেখা?

যুথী বলল, চিঠিতে কী লেখা তুমি জানো বাবা। তুমি চিঠি খুলে পড়েছ। তারপর খামের মুখ বন্ধ করে রেখেছি। কীভাবে বুঝলাম জানতে চাও? চিঠি থেকে ভকভক করে বিড়ির গন্ধ আসছে। যে ভদ্রমহিলা চিঠি লিখেছেন তিনি নিশ্চয়ই বিড়ি খান না।

সালমা বললেন, বাবার সম্পর্কে হুট হাট কথা বলবি না মা। তোর বাবা খাম হাতে নিয়েছিল, সেখান থেকে বিড়ির গন্ধ পাচ্ছিস।

যুথী বলল, মা, আমি চিঠিটা তোমার হাতে দিচ্ছি। তুমি শুকে দেখো। খাম না, শুধু চিঠি।

আজহার দুঃখিত গলায় বললেন, সালমা, তোমার মেয়ের মাথা খারাপ হয়েছে। টোটাল মস্তিষ্কবিকৃতি। ওর কথা ধরে মন খারাপ করার কিছু নাই। ফল কে পাঠিয়েছে তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো। আমি ঠিক করেছি, বাকি জীবন আর সরাসরি তোমার মেয়ের সঙ্গে কোনো কথা বলব না।

যুথী বলল, ফল পাঠিয়েছে তুমি বুঝলে কী করে? তুমি তো চিঠি পড়ে নি।

সালমা বললেন, ভকভক করে ফলের গন্ধ এসেছে, সেখান থেকে তোর বাবা বুঝেছে।

আজহার বললেন, এই মেয়ের সঙ্গে বাক্যালাপ করা মানে সময়ের অপচয়। আমি শোবার ঘরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। সালমা, যদি সম্ভব হয়। আমাকে এককাপ আদা চা দিয়ো।

আজহার উঠে চলে গেলেন। যুথী মার পাশে বসতে বসতে বলল, সবসময় তুমি বাবার লেজ ধরে থাকো কেন মা? নিজের স্বাধীন চিন্তাভাবনা থাকবে না? বাবাকে আড়াল করে রাখার এই অভ্যাসটা খুব খারাপ। বাবাকে যখন চা দিচ্ছ আমাকেও এককাপ দিয়ে। আমার মাথা ধরেছে। আমি কিছুক্ষণ বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব।

সালমা উৎকৰ্ণ হয়ে রইলেন। তাঁর বুক ধ্বক ধ্বক করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি যুথী চেঁচিয়ে বলবে, আমার ঘরের তালা কে খুলেছে?

সেরকম কিছু হলো না। সালমা চা নিয়ে মেয়ের ঘরে ঢুকে ভীত গলায় বললেন, তোর বাবা ডাকছে। একটু শুনে যা লক্ষ্মী মা। যুথী উঠে দাঁড়াল।

যুথীকে ঘিরে ঢুকতে দেখে আজহার হাসিমুখে বললেন, যুথী মা বোস। যেন একটু আগের ঘটনা তার কিছুই মনে নেই। যুথী বসল।

আজহার বললেন, ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলি, সেই বিষয়ে তো কিছুই শুনলাম না। ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে?

খারাপ।

কোয়েশ্চেনের আনসার করতে পারিস নাই?

না।

কোয়েশ্চেন কী করেছে?

জিজ্ঞেস করেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভালো নাম কী?

এটা আবার কী রকম প্রশ্ন! এই হিন্দুটা কে?

একজন লেখক।

হিন্দু লেখক তো একজনই—শরৎ বাবু। উনার একটা বই আছে, নাম চরিত্রহীন। ক্লাস নাইনে জিওগ্রাফি ক্লাসে এই বই পড়ে শেষ করেছিলাম। লাস্ট পাতা পড়তে গিয়ে ধরা খেলাম! চোখের পানি মুছছি, আজজ স্যার বললেন, কী বই পড়ছিস?

আমি বললাম, জিওগ্রাফি বই স্যার।

স্যার বললেন, জিওগ্রাফি বই পড়ে কাঁদছিস কেন? দেখি বই নিয়ে আয়।

বই নিয়ে গেলাম। শুরু হলো শাস্তি। আমাদের সময় শাস্তি ছিল মারাত্মক। পেটে পেন্সিল দিয়ে ডলা। আজকাল শাস্তি উঠে গেছে, শাস্তির সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাও উঠে গেছে।

যুথী বলল, বাবা, তোমার কথা শেষ হয়েছে? আমি উঠি।

আজহার বললেন, ছোট্ট একটা কথা বাকি আছে মা! ইন্টারভিউ নিয়ে মন খারাপ করবে না। Next কোনো ইন্টারভিউ দেওয়ার আগে আমার কাছে পরামর্শ নিবে। ইন্টারভিউ বোর্ডের কিছু আদিবাকায়দা আছে। আমি শিখিয়ে দিব। যেমন, সালাম দিয়ে ঢুকবে। ঢুকেই চেয়ার টেনে বসে পড়বে না। মিষ্টি করে বলবে, স্যার আমি কি বসব? তোমাকে বসতে কলার পর শব্দ করে চেয়ার টানবে না। শব্দ হয় না। এমনভাবে চেয়ার টেনে বসবে। আবারও মিষ্টি করে হেসে বলবে, স্যার ধন্যবাদ। বুঝতে পারছি কী বলছি?

পারছি।

যুথী মা। এখন সর্বশেষ কথা। আমাদের নবী-এ-করিমের একটা হাদিস। তিনি বলেছেন, আল্লাহপাক ছাড়া আমি যদি আর কাউকে সেজদার হুকুম দিতাম তাহলে পিতাকে সেজদার হুকুম দিতাম।

যুথী বলল, যেহেতু নবী পিতাকে সেজদার হুকুম দেন নি, তোমাকে সেজদা করছি না।

যুথী বের হয়ে গেল। আজহার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সালমা স্বামীর পিঠে হাত রেখে বললেন, মন খারাপ করো না।

আজহার বললেন, আমি মন খারাপ করছি না। সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস করছি! আর শোনো, তুমি যখন-তখন আমার গায়ে হাত দিবে না এবং সারাক্ষণ ঘেসাঘেঁসি করবে না। তোমার গা থেকে কড়া রসুনের গন্ধ আসে, এটা জানো? এখন থেকে ভালোমতো সাবান ডলে গরম পানি দিয়ে গোসল করবে।

আচ্ছা।

তার পেট থেকে কথা বের করো। শুভ্ৰ কে? শুভ্র কী বিপদে পড়েছিল? এইসব। তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম! ক্লিয়ার?

কলিংবেল বাজতে শুরু করেছে। সালমা দরজা খোলার জন্যে উঠলেন। আজহার স্ত্রীর পেছনে পেছনে গেলেন। কেন জানি তাঁর মনে হয়েছে বাড়িতে পুলিশ এসেছে। শুভ্রর কোনো ব্যাপারেই এসেছে। বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

দরজা খুলে দেখা গেল টুনু এসেছে। তার সঙ্গে একগাদা জিনিসপত্র। চাল এনেছে দুই বস্তা। মাষকলাইয়ের ডাল দশ কেজি। দুটা লাউ দুটা কুমড়া। পাট শাক, সজিনা। কেরোসিনের একটা টিন দেখা যাচ্ছে। টিনের মুখ খোলা।

আজহার বললেন, টিনের ভেতর কী?

টুলু বলল, জিয়ল মাছ বাবা।

আজহার বললেন, গুড। ভেরি গুড। ঐ পুঁটলার ভেতর কী?

কাঁচামরিচ আর লেবু। বড় চাচা বললেন, এবারের কাঁচামরিচে ঝাল বেশি হয়েছে নিয়ে যা।

টাকা পয়সা কিছু দিয়েছেন?

এগারো হাজার সাতশ টাকা দিয়েছেন।

বলিস কী?

গত বছরের ধান বেচা কিছু টাকা ছিল। সেটা নিয়ে এগারো হাজার সাতশ হয়েছে।

ভাইজানের শরীর কেমন?

শরীর বেশি ভালো না। হাঁটাচলা তেমন করতে পারেন না। সম্পত্তি ভাগাভাগি করে দিতে চান। তোমাকে যেতে বলেছেন।

আজহার আনন্দিত গলায় বললেন, এই হলো আদর্শ বড়ভাই। পিতৃতুল্য। অন্যকেউ হলে সম্পত্তি মেরে দেয়ার তালে থাকত; ঠিক না সালমা?

অবশ্যই ঠিক।

আজহার বললেন, ভাইজানকে কিছুদিন আমার এখানে এনে রাখতে চাই। কিছুদিন সেবা-যত্ন করলাম। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করলাম। সালমা কী বলো?

সালমা বললেন, বলাবলির তো কিছু নাই। তুমি গিয়ে উনাকে নিয়ে আসো।

অফিসে ছুটির দরখাস্ত করব। ছুটি পেলেই উনাকে নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। তুমি একটা গামলা আনো। গামলায় মাছ ঢেলে গুনে দেখি কয়টা। ডিমওয়ালা কয়েকটা শিং মাছ রান্না কোরো। ডিম আলাদা ভুনা করবে।

 

টুনু যুথীর ঘরে ঢুকাল। টুনু বলল, শুয়ে আছিস কেন?

যুথী বলল, মাথার যন্ত্রণা। ভাইয়া, তোকে চাষার মতো দেখাচ্ছে।

টুনু বলল, চাষার মতো দেখানোরই কথা। এতদিন চাষবাসই করেছি। লাউ কুমড়ার বীজ লাগিয়েছি। ডাঁটা বুনেছি। ট্রাক্টর ভাড়া করে দুটা ক্ষেত চাষ দিয়েছি। খুবই ইন্টারেস্টিং। আমি নিজেই ট্রাক্টর চালিয়েছি।

গ্রামে ট্রাক্টর ভাড়া পাওয়া যায়?

পাওয়া যায়। এখনকার গ্রাম আর আগের গ্রাম না। তোর খবর কী?

আমি বিরাট একটা চাকরি পেয়েছি।

সত্যি!

এখনও স্বপ্ন মনে হচ্ছে; তবে সত্যি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার টেবিলে রাখা আছে।

তোর কাজ কী?

কাজ কী জানি না। পোষ্টের নাম অফিস এক্সিকিউটিভ। কুড়ি হাজার টাকা বেতন। ভাইয়া, মাথা টিপে দে।

টুলু আয়োজন করে মাথা টিপতে বসল। যুথীর ঘুম এসে যাচ্ছে, সে কষ্ট করে জেগে আছে! ঘুমিয়ে পড়লে আরামটা পাওয়া যাবে না। টুকু বলল, গ্রাম থেকে একটা খবর শুনে এসেছি। বাবাকে খবরটা দেব কি না বুঝতে পারছি না।

কী খবর?

বড় চাচা না-কি আমাদের সব সম্পত্তি জাল দলিল-টলিল করে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছেন।

খবর দিয়েছে কে?

মেম্বার কুদ্দুস বলেছেন। আরো কয়েকজন বলেছেন। বাবাকে কি বলব?

যুথী বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, না। বাবা তাঁর বড়ভাইকে দেবতার মতো দেখেন। ঘটনা সত্যি হলে বাবা যে শক পাবে, সেই শকেই মারা যাবে।

একদিন তো জানবেনই।

যখন জানবেন তখন জানবেন। এখন ঝামেলা করে লাভ নাই।

 

আজহার মাছ গোনা শেষ করেছেন। আঠারোটা কই মাছ। এদের মধ্যে পাঁচটা বেশ বড়। শিং, মাছ আছে বাইশটা। সবই মাঝারি সাইজের। আজহার বললেন, ভাইজানের শরীরটা খারাপ শোনার পর থেকে মনটা অস্থির হয়ে আছে। কী করি বলে তো?

একটা মুরগি সদগা দিয়ে দাও।

গুড আইডিয়া। মসজিদে একটা মিলাদও দিয়ে দেই।

দাও।

তোমার গুণবতী মেয়েকে ডেকে আনো। দেশ থেকে কী এসেছে একটু দেখুক। দেখার মধ্যেও তো আনন্দ। সে রাতে কী খেতে চায় জিজ্ঞেস করো। সেই মতো রান্না করো।

সালমা বললেন, ও রাতে খাবে না। তার বান্ধবী নীপার বাড়িতে রাতে খাবে।

নিষেধ করো। দুদিন পর পর দাওয়াত খাওয়া আমার অত্যন্ত অপছন্দ। টুনু এতদিন পরে এসেছে, সবাই রাতে একসঙ্গে খাব। ভালো কথা, ফলের বাক্সটা তো খোলা হয় নাই?

না।

খোলো। দেখি কী আছে। তোমার কাজের কোনো সিস্টেম নাই।

ফলের বাক্স খুলে আজহার মুগ্ধ হয়ে গেলেন। দেশী ফল একটাও না। সবই বিদেশী। এর মধ্যে কয়েকটা ফল তিনি চিনতেই পারলেন না। তিনি বললেন, সালমা, আমার মোবাইল টেলিফোনটা আনো, ছবি তুলে রাখি। তুমি এই ফলটা হাতে নিয়ে বসে। আমি ছবি তুলে দেই।

ফলটার নাম কী?

নাম জানি না। এইজন্যেই তো ছবি তুলছি। স্যারকে ছবি দেখাব। উনি নাম বলে দেবেন। অত্যন্ত জ্ঞানী একজন মানুষ! অহঙ্কার একেবারেই নাই। আমার ভাইজানের সঙ্গে উনার চেহারার মিলও আছে। প্রায়ই ভাবি, দাওয়াত করে উনাকে খাওয়াব।

দাওয়াত করলেই পার।

এই সপ্তাহেই করি। কী বলো?

আজহার ফলের চারটা ছবি তুললেন। একটা তুললেন নিজের ছবি। সালমাকে দিয়ে তোলালেন। এই ছবিতে তিনি একটা স্ট্রবেরি নিয়ে মুখের সামনে ধরে আছেন।

 

রেহানা শুভ্রর কিছু কর্মকাণ্ড মোটেই বুঝতে পারছেন না। শুভ্রর ঘরে ঝকঝকে নতুন একটা হারমোনিয়াম। একটা বয়সে যুবকদের গানবাজনার শখ হয়। তারা হারমোনিয়াম কেনে না। গিটার কিংবা কি-বোর্ড পর্যন্ত যায়। অতি দ্রুত গানবাজনার শখের মৃত্যু ঘটে।

তিনি শুভ্ৰকে ডেকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করতে পারেন, তোমার ঘরে হারমোনিয়াম কেন?

জিজ্ঞেস করতে মন সায় দিচ্ছে না। শুভ্ৰ নিজ থেকে কেন বলবে না? কেন তার মধ্যে লুকাছাপা চলে এসেছে? হারমোনিয়াম সে।চাঁদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে, এর অর্থ সে আড়াল করতে চাইছে।

বিকেলে চা খেতে শুভ্র ছাদে যায়। চায়ের কাপটা থাকে ছাদের মাঝামাঝি জায়গায় রাখা শ্বেতপাথরের বেদিতে; শুভ্ৰ ছাদের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় দ্রুত হাঁটাইটি করে। মাঝে মাঝে বেদির কাছে এসে চায়ে চুমুক দেয়। শুভ্ৰ এই হাঁটাহাঁটির নাম দিয়েছে চিন্তাচিন্তি। হাঁটতে হাঁটতে সে নাকি চিন্তা করে।

রেহানা ছেলের খোঁজে ছাদে এলেন। শুভ্ৰ হাঁটাহাঁটি করছে না। বেদিতে বসে। আছে। হাতে চায়ের কাপ। রেহানা বললেন, হাঁটাহঁটির পর্ব শেষ না-কি?

শুভ্ৰ জবাব দিল না। মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসল।

রেহানা বললেন, দেখি তোমার কাপ থেকে এক চুমুক চা খাই।

শুভ্ৰ মার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিল। রেহানার সুচিবায়ুর মতো আছে। কিন্তু ছেলের চায়ের কাপে এক চুমুক দিতে কিংবা তার পেপসির গ্লাসে এক চুমুক দিতে তাঁর ভালো লাগে। এটা তার পুরনো অভ্যাস।

তোমার ঘরে একটা হরমোনিয়াম দেখলাম। কিনেছ?

হুঁ।

হারমোনিয়াম দিয়ে কী করবে?

একজনকে গিফট করব মা।

রেহানা পরের প্রশ্নটা করবেন কী করবেন না বুঝতে পারছেন না। পরের প্রশ্নটা হলো, সেই একজনটা কে? শুভ্ৰ মনে হয় সেই একজনের পরিচয় দিতে চাচ্ছে না। পরিচয় দিতে চাইলে শুরুতেই তার নাম বলত।

রেহানা হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, যাকে হারমেনিয়াম গিফট করবে তাকে কি আমি চিনি?

না। তবে তার নাম শুনেছ।

নাম জানতে পারি?

হারমোনিয়ামটা আমি যুথীর জন্যে কিনেছি মা।

রেহানা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। গলার স্বর স্বাভাবিক রাখতে। শুভ্রর হাস্যকর কাণ্ডকারখানায় গলার স্বর স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। রেহানা বললেন, যুথী মেয়েটা কি তোমাকে হারমোনিয়াম কিনে দিতে বলেছে?

না।

তাহলে তাকৈ হারমোনিয়াম গিফট করছ কেন?

মা। যুথীর গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি। আমি চাই ও গান শিখুক।

তুমি কি তার অভিভাবক?

শুভ্র বলল, না মা, আমি ওর কিছুই না। কিন্তু আমি চাই ও গান শিখুক। আমি খুব সুন্দর একটা চিঠি তাকে লিখেছি। হারমোনিয়াম এবং চিঠিটা তাকে পাঠাব। আমার ধারণা চিঠিটা পড়লেই সে গান শিখবে।

সেই চিঠিটা কি আমি পড়ে দেখতে পারি?

অবশ্যই পার। কেন পারবে না? চিঠিটা আমার বুকসেলফের তিন নম্বর তাকে, বইয়ের ওপর রাখা আছে। ড্রাইভারকে দিয়ে চিঠি এবং হারমোনিয়াম পাঠাবার ব্যবস্থা কোরো তো মা। আমার নিজের যেতে লজা লাগবে।

তুমি কি ছাদে আরও কিছুক্ষণ থাকবে?

সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত থাকব।

তোমাকে কি আরেক কাপ চা পাঠাব?

পাঠাও।

রেহানা ছাদ থেকে নেমে গেলেন। শুভ্রর জন্যে চায়ের ব্যবস্থা করে তিনি চিঠি পড়তে বসলেন।

যুথী
এই হারমোনিয়ামটা আমি আপনার জন্যে কিনেছি। আগেই রেগে যাবেন না। কেন কিনেছি তা শুনুন। আপনার গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি। আমি নিশ্চিত, অনেকেই এই কথা আপনাকে বলেছে। তবে আপনি নিজে বিষয়টা জানেন
প্রকৃতি যখন কাউকে বড় ধরনের গিফট দিয়ে পাঠায় তখন তার উচিত বহুজনকে সেই গিফটের ভাগ দেওয়া। আপনি যদি গান শেখেন এবং গান করেন। তবেই আপনার কিন্নরকণ্ঠের আনন্দ অন্যরা নিতে পারবে।
প্লিজ, আমার ওপর রাগ করবেন না।
শুভ্র।

শুভ্রর ড্রাইভার যখন হারমোনিয়াম এবং চিঠি নিয়ে যুথীদের বাসায় পৌঁছ তখন যুথী নেই। সে নীপার কাছে গেছে।

আজহার টুনুকে ডেকে বললেন, টুনু, ঘটনা কী?

টুনু বলল, বাবা, আমি তো জানি না ঘটনা কী।

ঘরে হারমোনিয়াম চলে এসেছে, ব্যাপার কী? এখন থেকে কি বাড়িতে বাদ্যবাজনা হবে? আমার বাসাটা হবে বাইজি বাড়ি? হারমোনিয়ামের সঙ্গে নাকি চিঠিও এসেছে?

হ্যাঁ।

চিঠি খুলে পড়ে দেখ।

টুনু বলল, যুথীর কাছে লেখা চিঠি আমি কেন পড়ব?

তোকে পড়তে বলছি। এইজন্যে পড়বি। এটা আমার অর্ডার।

টুনু হতাশ গলায় বলল, বাবা, এটা আমি করব না।

আজহার বললেন, তুমি ষাড়ের গোবর ছাড়া কিছু না। প্লেইন এন্ড সিম্পল cowdung. তিনবার ইন্টারমিডিয়েট ফেল করে এখন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াও। ঢাকা শহরে তুমি ঠেলাগাড়ি চালিয়ে জীবন কাটাবে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এখন আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও। স্টুপিড কোথাকার!

টুনু মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল। আজহার খাম খোলার প্রস্তুতি নিলেন। তবে এবার ভুল করলেন না, সাবান দিয়ে বেশ কয়েকবার হাত ধুয়ে নিলেন; যেন চিঠিতে বিড়ির গন্ধ লেগে না থাকে।

 

করিম আংকেল যুথীর চাকরি পাওয়া সেলিব্রেট করার জন্যে শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে খুলতে বললেন, বিশেষ কোনো ঘটনা সেলিব্ৰেট করার জন্য আছড়ে নারিকেল ভাঙার প্রথা ছিল। পশ্চিমা দেশে নারিকেলের পরিবর্তে শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হয়। যুথী, তুমি যদি গ্লাসে একটা চুমুক না দাও। তাহলে সেলিব্রেশন সম্পন্ন হবে না।

শ্যাস্পেনের গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালা হয়েছে। চারজন মানুষ চারটা গ্লাস। নীপা, যুথী, করিম, আংকেল এবং যমুনা।

নীপ বলল, যুথী যখন খেতে চাচ্ছে না। ওকে জোর করার কিছু নেই, ও খালি গ্লাসেই চুমুক দিক।

করিম আংকেল বললেন, তা তো হবে না।

নীপা বলল, আমি নারিকেল আনার ব্যবস্থা করছি। নারিকেল ভাঙা হোক।

যুথী কিছু না বলে একটা শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিল।

করিম আংকল বললেন, খেতে কেমন লাগছে বলো?

যুথী বলল, তেঁতুলের পানির মতো লাগছে।

করিম অ্যাংকেল প্লাস উঁচু করে বললেন, যুথীর চাকরি পাওয়া উপলক্ষে উল্লাস অর্থাৎ Cheers.

যুথী ছাড়া সবাই বলল, চিয়ার্স! যুথী গ্লাসে দ্বিতীয় চুমুক দিল।

নীপা বলল, যুথীকে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে হুট করে চাকরি কেন দিল। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। করিম আংকেল, আপনার কী ধারণা?

করিম আংকেল বললেন, যে চাকরি দিয়েছে সে যে-কোনো কারণেই যুথীর প্রতি প্রবল শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করেছে। বডি কেমিষ্ট্র কাজ করেছে। আর কিছু না।

নীপা বলল, ভদ্র কথা বলুন করিম আংকেল।

এরচেয়ে ভদ্রভাবে বিষয়টা বলা অসম্ভব। যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যে চাকরি হয়েছে তিনিও এরচেয়ে ভদ্রভাবে বলতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো পারতেন। তিনি বলতেন, যুথীকে দেখিয়া উনার শরীর জাগিয়া উঠিল। বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।

যমুনা বলল, শ্যাম্পেন খেতে ভালো লাগছে না। আমি হুইঙ্কি খাব।

করিম আংকেল বললেন, হুইস্কির বোতল যথাসময়ে খোলা হবে। তার আগে আমি যে বিশেষ কথাটি বলতে চাচ্ছি তা বলে ফেলি। আমি একটা ছবি বানাব। ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম। ছবির নাম প্তহামানব! পাইপের ভেতর বাস করে এমন কিছু নরনারীর দিবারাত্রির কাব্য। সবাই বলো, উল্লাস।

সবাই উল্লাস বলল।

 

আজহার দরজা বন্ধ করে যুথীর ডায়েরি নিয়ে বসেছেন। প্রথম পাতায় তারিখ দিয়ে লেখা–

করিম আংকেল আজ আমাকে মদ খাওয়ানোর জন্যে অনেক ঝুলাঝুলি করলেন। যে এই জিনিস খায় না তাকে এত পীড়াপীড়ি কেন! আমাকে বললেন, যুথী, এসো আমরা কারণ ছাড়া কারণ পান করি।

আমি বললাম, কারণ জিনিসটা কী?

করিম আংকেল বললেন, কারণ হলো কারণবারি। তান্ত্রিক সন্নাসীরা মদ বলে না। বলে কারণবারি। এতে মদের দোষ কেটে যায়।

আজহার ডায়েরি বন্ধ করে ঘামতে থাকলেন। এইসব কী? তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। তাঁর মনে হলো এক্ষুনি তিনি মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে যাবেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ