শুভ্র
ভূমিকা

শুদ্ধতম মানুষ কেমন হবে?

অনেক প্রশ্নের মতো এই প্রশ্নটা আমার মনে প্রায়ই আসে। আমি আমার চারপাশের মানুষজন খুব মন দিয়ে দেখি। এক ধরনের গোপন অনুসন্ধান চলতে থাকে- যদি কোনো শুদ্ধ মানুষের দেখা পেয়ে যাই। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েতো আমি শুদ্ধতম মানুষ খুঁজে বের করতে পারব না। আমাকে খুঁজতে হবে। আমার পরিচিতজনদের মধ্যে।

দীর্ঘ দিনের অনুসন্ধানে কোনো লাভ হয় নি। শুদ্ধ মানুষ আমাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে কল্পনায়। শুভ্র সে রকম একজন। বেচারার চোখ খুব খারাপ। চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললে সে প্রায় অন্ধ। তার ক্লাসের বন্ধুরা তাকে ডাকে কানাবাবা! শুদ্ধ মানুষের চোখ খারাপ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তাকে চোখ খারাপ দেখানোর পেছনের প্রধান যুক্তি সম্ভবত আমি, আমার নিজের চোখও ভয়ঙ্কর খারাপ (পাঠকরা দয়া করে ভাববেন না যে আমি নিজেকে খুব সূক্ষ্মভাবে শুদ্ধতম মানুষ বলার চেষ্টা করছি। কোনো শুদ্ধ মানুষের একশ গজের ভেতর যাবার যোগ্যতা আমার নেই)। যাই হোক, শুভ্ৰ চরিত্রটি তৈরি হলো। বেশ কিছু উপন্যাস লিখলাম শুভ্রকে নিয়ে, যেমন রূপালী রাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ। তারপর হঠাৎ করেই শুভ্ৰকে নিয়ে লেখা বন্ধ করে দিলাম। আমার কাছে মনে হলো আমি ভুল করছি, শুদ্ধতম মানুষ বলে কিছু নেই। শুভ্র চরিত্রটি নতুন করে লিখতে হবে।

বর্তমান উপন্যাসটি শুভ্ৰ নামে পাক্ষিক অন্যদিন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। খুবই অনিয়মিতভাবে লিখেছি। এক সংখ্যায় লিখলাম, পরের দু সংখ্যায় লিখলাম না- এ রকম। শেষের দিকে এসে কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই লেখা বন্ধ করে দিলাম। অন্যদিন-এর পাঠক-পাঠিকা এবং বিশেষ করে পত্রিকা সম্পাদকের কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। মানুষ মাত্রই ক্ষমা করতে পছন্দ করে। তারা আমাকে ক্ষমা করবেন বা ইতিমধ্যেই ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

হুমায়ূন আহমেদ ধানমণ্ডি, ঢাকা

০১.

শুভ্রর একটা বিশ্ৰী সমস্যা হয়েছে।

রোজ ঠিক রাত তিনটায় অবধারিতভাবে তার ঘুম ভেঙে যায়। কাঁটায় কাটায় তিনটায়। পাঁচ মিনিট আগেও না, পরেও না। মনে হচ্ছে কোনো অদ্ভুত উপায়ে তাঁর শরীরের ভেতর একটা এলার্ম ক্লক ঢুকে গেছে। এলার্ম ক্লিকটা রাত তিনটা বাজার মিনিট তিনেক আগে বেজে ওঠে। রাত তিনটায় শুভ্ৰ ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর এলার্ম ক্লিক থামে।

গভীর রাতে অনেকেরই ঘুম ভাঙে। তাদের ঘুম ভাঙার সঙ্গে শুভ্রর ঘুম ভাঙার কোনো মিল নেই। তারা পানি খেয়ে, বাথরুম করে আবার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। শুভ্ৰ পারে না। তার ঘুম আসতে আসতে ছটা। তিনটা থেকে ছটা এই তিন ঘণ্টা সময় কাটানো খুব কষ্টের। আগে পড়াশোনা ছিল, হাত-মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসলে সময় কেটে যেত। এখন পরীক্ষা শেষ। থিসিসের উপর ভাইভাও হয়ে গেছে। তিন ঘণ্টা জেগে থেকে সে করবে। কী? তিন ঘণ্টা তো কম সময় না। দশ হাজার অ্যািটশ সেকেন্ড। এই সময়ে আলো ১,৮৬,০০০ × ১০,৮০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করবে। পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ৪৫ ডিগ্রি ঘুরে যাবে। পৃথিবীতে অনেক কীটপতঙ্গ আছে যাদের আয়ু তিনঘণ্টারও কম। তিন ঘণ্টা তুচ্ছ করার ব্যাপার না। শুভ্ৰ তুচ্ছ করতে পারছে না। করতে পারলে ভাল হত।

শুভ্ৰ সময় কাটানোর মোটামুটি একটা রুটিন করে ফেলেছে। পনেরো মিনিট-— বাথরুম, দাঁত ব্ৰাশ করা, হাত-মুখ ধোয়া, পানি খাওয়া। পনেরো মিনিট— গান এবং চা পান। চা-টা সে নিজেই বানায়। ইলেকট্রিক হিটারে পানি গরম করে, বড় একটা মাগে দুটো টি ব্যাগ দিয়ে মগ ভর্তি চা বানিয়ে গান শুনতে বসে। হিন্দি গান। গভীর রাতে হিন্দি গান ছাড়া অন্য কোনো গান কেন জানি শুনতে।ভাল লাগে না। খুব লো ভল্যুমে সিডি প্লেয়ারে গান বাজে। গানের ভল্যুম একটু বাড়লেই শুভ্রর বাবা মোতাহার সাহেবের পাতলা ঘুম ভেঙে যাবে। তিনি মহাব্যস্ত হয়ে শুভ্ৰর ঘরে উপস্থিত হবেন এবং আতংকিত গলায় বলবেন, কী হয়েছে। বাবা? ঘুম আসছে না? বলিস কী? ঘুম আসবে না কেন?

যেন শুভ্রর ঘুম না হওয়াটা ভয়ংকর একটা ঘটনা। পৃথিবীর আহ্নিক গতি বন্ধ হয়ে যাবার মত বড় ঘটনা। গান পর্ব শেষ হবার পরের এক ঘণ্টা পড়াশোনা। ইন্টারেস্টিং কোনো বই; যেমন–Life in Space, Magic of Number, Birth of God। এখন সে পড়ছে ব্রেইলী পদ্ধতির উপর একটা বই। অন্ধরা হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কীভাবে পড়ে খুব সুন্দর করে উদাহরণ দিয়ে বইটাতে ব্যাখ্যা করা। এই বইটা শুভ্র খুব আনন্দের সঙ্গে পড়ছে এবং ব্ৰেইলী পদ্ধতিতে পড়া প্রায় শিখে ফেলেছে। একটা উঁচু ফোঁট মানে A, দুটো ফোঁটা একটি উপরে একটি নিচে B, দুটো ফোঁটা পাশাপাশি C, কোণাকুণি দুটো ফোঁট মানে E। সমস্যা হল A এর জন্য যে চিহ্ন, ফুলস্টপের জন্যে একই চিহ্ন। ব্ৰেইলী পদ্ধতি শুভ্র খুব আগ্রহ করে শিখছে কারণ তার চোখ ভয়ংকর খারাপ। চশমা ছাড়া সে কিছুই দেখে না। চশমা। চোখে শুভ্রকে প্রথম যে দেখে সেও একটা ধাক্কার মত খায়। শুভ্রর চোখের দিকে যেই তাকাবে তার কাছে মনে হবে কাচের সমুদ্রে দুটো চোখ ভাসছে। শুধু যে ভাসছে তা না, ঢেউ এর মত খানিকটা উঠা-নমাও করছে। শুভ্রর ধারণা— কোনো এক ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে সে কিছুই দেখবে না। ব্ৰেইলী পদ্ধতির পড়া এখন কাজে না লাগিলেও তখন কাজে লাগবে।

পড়াশোনার পর্ব শেষ করার পরের অংশ হল বারান্দা। বারান্দায় সে এক ঘণ্টা থাকবে। এই এক ঘণ্টায় সকাল হতে শুরু করবে। সকাল দেখাটা মন্দ না। অন্ধকার থেকে আলোয় আসার পর্বটা এত সুন্দরভাবে হয় যে শুভ্ৰ প্ৰতিবারই মুগ্ধ হয়। সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, একটা সকালের সঙ্গে আরেকটা সকালের কোনোই মিল নেই। প্রতিটি সকালেই আলাদা।

সকাল হওয়া দেখে শুভ্ৰ আবারো বাথরুমে যায়। হাত, মুখ ধোয়। আবারো দাঁত ব্ৰাশ করে। তারপর পাতলা চাঁদর গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ঘুম আসতে তখন আর দেরি হয় না।

 

আজ শুভ্রর ঘুম ভাঙল তিনটার অনেক আগে। সে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতভম্ব। রাত বাজছে বারোটা দশ। সে ঘুমুতে গেছে। দশটা চল্লিশে। অর্থাৎ সে মাত্র দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। এর মধ্যেই ঘুম ভেঙে গেল। কারণটা কী? শরীরের ভেতরের এলার্ম ক্লাকে কি কোনো গণ্ডগোল হয়েছে? যিনি এলার্ম ক্লাকে চাবি দেন সেই তিনি চাবি দিতে ভুলে গেছেন? শুভ্ৰ বিছানা থেকে নামল আর তখনি শুনল খুব স্পষ্ট গলায় কে যেন ক্রমাগত বলছে

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

গলার স্বরটা অনেকটাই তার বাবার মতো; একটু শুধু চিকন। শব্দটা আসছে। তার ঘরের বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে। বাবা কি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন? তার পুত্ৰ ভাত খেয়েছে কি-না জানতে চাচ্ছেন? তা কী করে হয়! শুভ্ৰ বিস্মিত গলায় বলল, কে?

দরজার ওপাশের শব্দ সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। ভৌতিক কিছু? না-কি হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারণে শুভ্ৰীয় মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে, হেলুসিনেশন হচ্ছে। শব্দের হেলুসিনেশন। শরীরে হঠাৎ করে অক্সিজেনের অভাব হলে হেলুসিনেশন হয়। দরজা জানালা বন্ধ করে শোয়ায় কি অক্সিজেনের ঘাটতি হল? তা হবার কথা না। শুভ্র বাথরুমে ঢুকল। চোখে-মুখে পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে আবারো সেই ব্যাকুল জিজ্ঞাসা—

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

শুভ্ৰ মা বলে আতংকিত শব্দ করল। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় ধাক্কা দিয়ে শুভ্ৰর মা জাহানারা বললেন, ও খোকন আমি এখানে, ভয় পেয়েছিস? দরজা খোল। শুভ্র হড়বড় করে বলল, মা, কে যেন কথা বলছে। জাহানারা বললেন, দরজাটা খোল খোকন। আমি ভয় ভাঙ্গিয়ে দিচ্ছি।

শুভ্র দরজা খুলছে না। বিড়বিড় করছে। অস্পষ্টভাবে সে মাকে ডাকছে। তার পা কাঁপছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। জাহানারা ব্যাকুল গলায় বললেন, ও খোকন ভয়ের কিছু নেই। এটা একটা ময়না পাখি। তোর বাবা এনেছে। দরজা খোল বোকা।

দরজা খুলে শুভ্ৰ বের হয়ে মাকে দেখল। খাচা হাতে তিনিই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলে প্ৰচণ্ড ভয় পেয়েছে এই জন্যে তিনি খুবই বিব্রত। জাহানারা বললেন, এত ভয় পেয়েছিস কেনরে বোকা? ইশ মুখ টুখ শুকিয়ে কী হয়েছে! এই দেখি ময়না। কথা বলা ময়না। ময়না কথা বলছিল।

শুভ্ৰ ময়নার দিকে তাকালো। ময়না যন্ত্রের মত বলল–

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

জাহানারা ছেলের হাত ধরলেন। এবং কপালের উত্তাপ পরীক্ষা করলেন। ভয়ে ছেলের জ্বর এসে যায়নিতো? জ্বর দেখার কাজটা তিনি সব সময় করেন। জ্বর থাকলেও করেন, না থাকলেও করেন। অনেক দিনের অভ্যাস থেকে এরকম হয়েছে। ছোটবেলায় শুভ্রর হঠাৎ করে জ্বর আসত। ছেলে দিব্যি নিজের মনে হাসছে খেলছে- কপালে হাত দিলেই দেখা যেত আকাশ-পাতাল জ্বর।

জাহানারা কোমল গলায় বললেন, খুব ভয় পেয়েছিলি?

শুভ্ৰ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। বাড়াবাড়ি রকমের ভয় পাওয়ায় তার একটু লজার মত লাগছে।

জাহানারা বললেন, তুই কি ভেবেছিলি ভূত?

কিছু ভাবি নি। তবে ভয় পেয়েছি।

তোর বাবা তিন মাস আগে ময়নাটা কিনেছে। অফিসে রেখে কথা শিখিয়েছে। আমাকে বলেছে ঠিক যেন বারোটা এক মিনিটে পাখিটা নিয়ে তোর দরজার সামনে দাঁড়াই। আমি তাই করলাম। তুই এত ভয় পাবি বুঝতে পারি নি।

শুভ্র ময়নার খাঁচার সামনে বসে পড়েছে। পাখিটা অবিকল তার বাবার গলায় কথা বলছে। কী বিস্ময়কর ঘটনা! জীবন্ত ভয়েস রেকর্ডার।

খোকন।

উঁ।

ময়না পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ হয় নি। খাঁচায় বন্দি পাখি দেখতে খারাপ লাগে, তবে খুব অদ্ভুত লাগছে- মা, ময়না পাখি কি যা শুনে তাই বলতে পারে?

হ্যাঁ পারে। তুই মজার মজার কথা শিখাবি– ও সুন্দর করে বলবে।

আমি শুধু Talking bird-এর কথা শুনেছি, এই প্রথম ওদেরকে কথা বলতে শুনলাম। ব্যাপারটা যে এত ইন্টারেস্টিং হবে জানতাম না। বাবার গলাটাতো খুব সুন্দর নকল করেছে।

তুই খুশি হয়েছিস শুভ্ৰ?

শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, খুশি হব কেন?

তোর একটা শখের জিনিস তোর বাবা তোকে প্রেজেন্ট করল। এই জন্যে।

হ্যাঁ খুশি হয়েছি।

জাহানারা ছেলের দিকে তাকিয়ে রহস্যপূর্ণ গলায় বললেন, খোকন বলত ঠিক বারোটা এক মিনিটে তোর ঘরের দরজার সামনে কেন দাঁড়িয়েছিলাম? দেখি তুই বলতে পারিস কি-না।

শুভ্র কারণটা জানে। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনে মা রাত কারোটায়। এই ধরনের ছেলেমানুষী করেন। বাবারও তাতে সায় থাকে। শুভ্ৰ মার দিকে তাকাল। জাহানারায় চোখ চকচক করছে। শুভ্ৰ জানে মা জন্মদিনের খবরটা দিয়ে তাকে চমকে দিতে চাচ্ছেন। মাকে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। জাহানারা আবার বললেন, কীরে জিনিস, কেন রাত বারোটা এক মিনিট তোর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম?

জানি না।

আরে বোকারাম আজ তোর জন্মদিন। আচ্ছা তুই সব সময় নিজের জন্মদিন ভুলে যাস কেন? গতবারও ভুলে গেলি। তোর সব কিছু মনে থাকে। আর জন্মদিন মনে থাকে না? অন্যদিন রাত এগারোটার সময় ঘুমুতে যাস আজ ঘুমুতে গেলি সাড়ে দশটায়।

জাহানারা ছেলের পাশে বসলেন। তাঁর একটু মন খারাপ, কারণ শুভ্ৰ তার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না— শুভ্রর যাবতীয় কৌতূহল ময়নাটার দিকে। শুভ্র বলল, ময়নাটা আর কোনো কথা জানে না?

আমি তো একটা কথাই বারবার শুনছি।

কী অদ্ভুত ব্যাপার তাই না? একটা পাখি অবিকল মানুষের গলায় কথা বলছে।

শুভ্ৰর কথার মাঝখানে পাখি বলল—

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

শুভ্ৰ বিক্ষিত গলায় বলল, শুভ্রর মত যুক্তাক্ষর কত স্পষ্ট করে বলছে দেখছ মা? কোনোরকম সমস্যা হচ্ছে না। একজন আমেরিকান বা বিলেতী সাহেব দু তিন বছর চেষ্টা চরিত্র করার পরও শুভ্র বলতে পারবে না। বলবে সুবরু।

 

জাহানারা বললেন, তোর পাখি সাহেবদের চেয়েও সুন্দর করে শুভ্র বলছে ঠিকই, কিন্তু খাইছ শুনতে বিশ্ৰী লাগছে না? তোর বাবা ইচ্ছা করলেই খাইছ না শিখিয়ে খেয়েছো শেখাতে পারত। তোর বাবার গ্রাম্যতা দূর হল না। ময়না যখন কথা বলে তখন মনে হয়। কাজের বুয়া কথা বলছে। সুন্দর কিছু শিখাবে— তা না।

শুভ্র বলল, ভাত খাইছাঁ শুনতে আমার কাছে খারাপ লাগছে না। মিথ্যা করে হলেও মনে হচ্ছে পাখিটা আমার ব্যাপারে কনসার্ন। আমি ভাত খেয়েছি। কিনা তা জানতে চায়।

তোর বাবাকে থ্যাংকস দিবি না?

বাবা কি জেগে আছেন?

হ্যাঁ জেগে আছে। তোকে হ্যাপী বাৰ্থ ডে বলার জন্যে জেগে আছে। তার শরীরটা অবশ্যি খারাপ। জ্বর এসেছে। ঘুমিয়ে পড়লে ভাল করত।

বাবাকে ঘুমিয়ে পড়তে বল মা। আমি সকালে থ্যাংকস দেব।

তোর জন্যে জেগে বসে আছে- তুই সকালে থ্যাংকস দিবি এটা কেমন কথা? অসুস্থ একজন মানুষ। অপেক্ষা করে আছে। আর আমি নিজেও তো তোর জন্যে কাওনের চালের পায়েস বানিয়েছি। আয় সবাই মিলে পায়েস খাব। তুই আমাদের পা ছুঁয়ে কদম্বুসি করে দোয়া নিবি না?

তুমি যাও। আমি আসছি। তবে পায়েস খাব না। আর কদমবুসিও করতে পারব না। লজ্জা লাগে।

শুভ্ৰ গভীর আগ্রহের সঙ্গে পাখির দিকে তাকিয়ে আছে। পাখিটার কী সুন্দর, চকচকে কালো গা। যেন গা থেকে কালো আলো বের হচ্ছে। শুভ্র নিজের মনেই হাসল— ফালো আলো আবার কী? আলো কখনো কালো হয় না। পাখিটাকে মজার কিছু শেখাতে হবে। অদ্ভুত কিছু। যেন পাখির কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। এক লাইন গান শেখালে কেমন হয়?

বধূ কোন আলো লাগল চোখে।

যে পাখি শুভ্ৰ ভাত খাইছ বলতে পারে সে নিশ্চয় বিধু কোন আলো লাগল চোখেও বলতে পারবে। কিংবা আরেকটা জিনিস শেখানো যায়— খিলখিল হাসি। পাখিটা একটু পর পর খিলখিল করে হেসে উঠবে। শুভ্রর পরিচিত মানুষদের মধ্যে সবচে সুন্দর করে হাসে মীরা। একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে মীরার হাসি রেকর্ড করে নিয়ে এলে হয়। রেকর্ড করা হাসি বার বার পাখিকে শুনানো হবে। মীরাকে আগে বলা যাবে না কেন তার হাঁসি রেকর্ড করা হচ্ছে। একদিন তার হাঁসি তাকে ফেরত দিয়ে চমকে দেয়া যাবে।

 

শুভ্ৰর বাবা মোতাহার সাহেবের শরীর কদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। তাঁর ডায়াবেটিস আছে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এসিডিটি। মানুষের শরীরে কোনো রোগ একা বাস করতে পারে না। কিছুদিনের মধ্যেই সে তার সঙ্গি জুটিয়ে ফেলে। যার ডায়াবেটিস আছে তাকে ধরে এজমায়।

মোতাহার সাহেব নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেন। সকালে নিয়ম করে এক ঘণ্টা হাঁটেন। দুপুরে চায়ের কাপে এক কাপ ভাতের বেশি। কখনো খান না। তারপরেও রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে বলছে। ইনজেকশনের ব্যাপারে মোতাহার সাহেবের সীমাহীন ভীতি আছে। রোজ ইনজেকশন নিতে হবে- এই ভয়েই তিনি কাতর হয়ে আছেন।

আজ তাঁর জ্বর এসেছে। তেমন কিছু না, নাইনটি নাইন পয়েন্ট ফাইভ। পঞ্চাশ বছর বয়সে এই জুরাই মানুষকে কাহিল করে দেয়। সন্ধ্যার দিকে মনে হচ্ছিল তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুক ভার, নিঃশ্বাসে কষ্ট। সেই যন্ত্রণা এখন নেই। শুধু মাথা ভার ভার হয়ে আছে এবং চোখ জ্বালা করছে।

তিনি খাটে চাঁদর গায়ে শুয়ে আছেন। ঘর ঠাণ্ডা, এসি চলছে। খাটের পাশে টেবিল ল্যাম্প জুলছে। আলো চোখে লাগে বলে টেবিল ল্যাম্পের ওপর একটা টাওয়েল দেয়া আছে। টাওয়েলের রঙ সবুজ বলেই ঘৱে কেমন সবুজ সবুজ আলো। তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন, জাহানারা ঘরে ঢোকার পরেও চোখ না মেলেই বললেন, শুভ্ৰ খুশি হয়েছে?

জাহানারা বললেন, খুশি মানে। বাচ্চাদের মত খুশি। খাচার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। এখনই তোমাকে থ্যাংকস দিতে আসবে।

থ্যাংকসের কী আছে? জন্মদিনের সামান্য উপহার।

জাহানারা অবাক হয়ে বললেন, সামান্য উপহার? তুমি কলমাকান্দা থেকে পাখি আনিয়েছ। অফিসে তিন মাস রেখে কথা শিখিয়েছ। এটা সামান্য হল? বাংলাদেশের কটা বাবা এরকম করে?

শুভ্ৰর বয়স কত হল?

তেইশ। আচ্ছা শোন, আমি শুভ্রর বিয়ে দিতে চাই।

মাত্র তেইশ বছর বয়স, এখনই কীসের বিয়ে?

তুমি নিজে কিন্তু তেইশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলে?

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই। আমি শুভ্ৰকে এখনই বিয়ে দেব। ওর জন্যে শক্ত টাইপের একটা মেয়ে দরকার। শুভ্র হচ্ছে লতানো গাছ, ওরা দরকার শক্ত খুঁটি। তা ঠিক। জাহানারা একটু পান দাও তো, পান খাই।

পান পরে খাও। শুভ্ৰ আসুক, আমরা আগে এক সঙ্গে পায়েস খাব। তোমার জন্যে আলাদা করে স্যাকারিন দিয়ে পায়েস বানিয়েছি।

স্যাকারিন মিষ্টিটা আমার শরীরে সহ্য হয় না। খেলেই বমি বমি ভাব হয়।

তুমি যখন আগে থেকে জািন যে স্যাকারিন দেয়া হয়েছে তখনই বমি বমি ভাব হয়। না জানলে হয় না। যে দুদিন তোমাকে না জানিয়ে চিনির চা বলে স্যাকারিনের চা খাইয়েছি। তুমি কিছু বুঝতে পার নি।

মোতাহার সাহেব শোয়া থেকে উঠে বসলেন। এতক্ষণ চোখ বন্ধ করেই কথা বলছিলেন, এখন চোখ মেললেন। ঘরে আলো নেই ধললেই হয়। সবুজ তোয়ালে সব আলো চুষে নিয়েছে, তারপরও চোখ জ্বালা করছে। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কই শুভ্ৰতো আসছে না?

পাখি নিয়ে এখনো বোধহয় খেলছে! ছেলেটা কী যে মজা পেয়েছে। একেবারে বাচ্চাদের স্বভাব। ডেকে নিয়ে আসি?

না থাক ডাকতে হবে না। আসুক নিজের মত করে। তুমি কি সত্যি শুভ্রর বিয়ে দিতে চাও?

জাহানারা আগ্রহের সঙ্গে বললেন, অবশ্যই চাই। এ বাড়িতে একটা বউ আমার জন্যেও দরকার। তুমি থাক তোমার ব্যবসা নিয়ে, শুভ্র থাকে তার পড়াশোনা নিয়ে, আমার কে আছে বল? আমি থাকব কী নিয়ে? শুভ্রর বৌ থাকলে আমি যখন-তখন তার সঙ্গে গল্প করতে পারব। তাকে নিয়ে টুকটাক শপিং-এ যেতে পারব।

তা ঠিক।

আমি বউমাকে হাতে ধরে রান্নাও শেখাব। তারপর দুজনে মিলে রান্না করব। একটা আইটেম সে করল, একটা আইটেম করলাম। আমি। তোমরা খেয়ে বলবে কোনটা কে বেঁধেছে। কোনটা ফার্স্ট, কোনটা সেকেন্ড।

শুভ্ৰ কি বিয়ে করতে রাজি হবে?

কেন রাজি হবে না! তুমি বললেই রাজি হবে। আজই বল। আজ একটা শুভ দিন। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি ছেলের বিয়ে দিয়ে দেব।

মোতাহার সাহেব প্রশ্ৰয়ের হাসি হাসলেন। জাহানারা বললেন, তুমি হাসবে না। আমি কিন্তু সিরিয়াস। ঘোমটাপরা লাজুক একটা মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাবতেই কেমন লাগে।

আজকালকার মেয়েরা কি আর ঘোমটা দিয়ে ঘুরবে? লজ্জার ঘোমটা না, ফ্যাশানের ঘোমটা।

আমার ছেলের বউ ঘুরবে।

দরজায় টোকা পড়ছে। খোলা দরজা, শুভ্ৰ ইচ্ছা করলেই ঢুকতে পারে, তা সে করবে না। দরজায় টোকা দেবে। বাবার ঘরে ঢোকার আগে কোনো ছেলে কি টোকা দেয়?

শুভ্রর গলা শোনা গেল, বাবা আসব? মোতাহার সাহেব বললেন, আয়।

শুভ্র ঘরে ঢুকেই বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল।

মোতাহার সাহেব মুগ্ধ হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী সুন্দর গায়ের রঙ! মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। পাতলা ঠোঁট লালচে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে খুব হালকা করে লিপষ্টিক দেয়া। মোতাহার সাহেব এবং জাহানারা দুজনেরই গায়ের রং ময়লা। তাদের বংশে কারোর কোঁকড়ানো চুল নেই। ছেলে এত সব সুন্দর সুন্দর জিনিস কোথেকে পেল? জাহানারা প্রায়ই বলেন, ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হত কত ভাল হত। আমি কত সুন্দর একটা মেয়ে পেতাম। তেমন সুন্দরী মেয়েতো আজকাল দেখাই যায় না। শুভ্ৰ যদি মেয়ে হত আমি তার নাম রাখতাম জুই। বিছানায় যখন শুয়ে থাকে তখন মনে হয় কেউ এক খলুই জুই ফুল ঢেলে রেখেছে। ছেলে হবার জন্য কঠিন একটা নাম রাখতে হল। উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে যায়। শুভ্র! নামটা উচ্চারণ করার পর শেষ হয় না। মুখের ভেতর র র র করে কিছুক্ষণ বাজে।

মোতাহার সাহেব বলেছিলেন, ছেলের নাম টগর রাখলে কেমন হয়? টগার সাদা ফুল। নামের বানানও কঠিন না। যুক্তাক্ষর নেই।

জাহানারা ফুলের নামে ছেলের নাম রাখতে রাজি হলেন না। ফুলের নামে ছেলের নাম রাখলে সেই ছেলে মেয়েলি স্বভাবের হয়। সামান্য কিছুতেই খুনখুন করে কাঁদে। কথা বলার সময় মাথা কত করে রাখে। নাইন টেনে পড়ার সময় পাছা দুলিয়ে হাঁটা রপ্ত করে। ছিঃ।

শুভ্রর মধ্যে একটু বোধহয় মেয়েলি স্বভাব আছে। অতি সামান্য কারণে তার চোখ ছলছল করে। মাঝে মাঝে টপ করে চোখ থেকে পানি পড়েও যায়। যদিও শুভ্ৰ তার মাকে বলেছে- চোখ খারাপের জন্যে তার চোখে পানি জমে থাকে। জাহানারা ছেলের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না। কত মানুষেরইতো চোখ খারাপ থাকে। তাদের সবার চোখ দিয়েই টপ টপ করে পানি পড়ে না-কি?

শুভ্র বাবার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বসতে না বলা পর্যন্ত বসবে না। মোতাহার সাহেব বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন, চেয়ার টেনে বোস।

শুভ্ৰ চেয়ার টানল না। চেয়ার যেখানে রাখা ছিল সেখানে বসতে বসতে বলল, বাবা তোমার কি শরীর খারাপ?

মোতাহার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ শরীরটা খারাপ। বেশ খারাপ। আজ অবশ্যি জ্বর এসেছে। জ্বর না এলেও বলতাম শরীর খারাপ।

শুভ্ৰ কিছু বলল না। মোতাহার সাহেব একটু মন খারাপ করলেন। কেউ যদি তার শরীর খারাপ বলে তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাস করতে হয়- কী হয়েছে? অথচ শুভ্ৰ কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। চুপ করে চেয়ারে বসে আছে। জাহানারা বললেন, শুভ জন্মদিন শুভ্ৰ। তোর তেইশ বছর বয়স হয়ে গেছে কল্পনাই করা যায় না।

শুভ্ৰ মার দিকে তাকিয়ে হাসল। জাহানারা বললেন, একটু আগে তোর বাবার সঙ্গে কী নিয়ে কথা হচ্ছিল জানিস— তোর বিয়ে নিয়ে। আমরা দুজন মিলে ঠিক করেছি। তোর বিয়ে দিয়ে দেব। বাড়িতে বালিকা বধূ নিয়ে আসব। বউমাকে বলা থাকবে সে যেন সব সময় পায়ে নুপুর পরে থাকে। যেখানে যাবে ঝমঝম করে নুপূর বাজবে।

শুভ্র আবারো হাসল। এই হাসির মানে কী? যেহেতু শুভ্রর চোখ মোটা চশমার আড়ালে ঢাকা থাকে তার হাসির মানে বোঝা যায় না।

জাহানারা বললেন, তোর পছন্দের কেউ আছে? থাকলে বল।

শুভ্র বাবার দিকে ফিরে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, ময়না। কী খায় বাবা?

বিয়ের প্রসঙ্গে সে একবারও গেল না। হ্যাঁ না— কিছু না। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে এল। মোতাহার সাহেব বললেন, ফলমূল খায়। কলা, আপেল, ধানও খায়। তবে কম। মাঝে মধ্যে শুকনো মরিচের বিচি খায়।

পাখিটা আমার পছন্দ হয়েছে।

মোতাহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, পছন্দ কদিন থাকে এটা হচ্ছে কথা। পশু-পাখি পোষা যন্ত্রণার মত।

জাহানারা বললেন, তোর বাবার উপহার তোর খুব পছন্দ সেটা বুঝতে পারছি। আমার উপহারটা পছন্দ হয় কি-না দেখতো।

মোতাহার সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, তুমি কী দিচ্ছ?

আগে বলব কেন? ও গিফট র্যাপ খুলে নিজেই দেখুক।

জাহানারা গিফটের ছোট্ট প্যাকেটটা ছেলের দিকে দিলেন। শুভ্ৰ প্যাকেট খুলছে। জাহানারা ধরার চেষ্টা করছেন— ছেলেটা প্যাকেট খোলার কাজটা কি আনন্দের সঙ্গে করছে? না-কি অনগ্রহের সঙ্গে করছে? মনে হয় না খুব আগ্রহের সঙ্গে খুলছে। হাত দিয়ে প্যাকেট খুলছে, তাকিয়ে আছে অন্য দিকে। আগ্রহ নিয়ে খুললে প্যাকেটের দিকেই তাকিয়ে থাকত।

তিনি ছেলের জন্য একটা দামি সিগারেট লাইটার কিনেছেন। পাথরের লাইটার। ঘন্টায় পনেরো কিলোমিটার বেগে বাতাস বইলেও এই লাইটার জ্বালানো যাবে। তিনি জানেন শুভ্ৰ সিগারেট খায় না। তাতে কী— কখনো সখনো খাবে। ছেলেকে লাইটার উপহার দেবার পেছনে আরেকটা কারণ আছে। তিনি বলতে চাচ্ছেন- শুভ্ৰ তুমি বড় হয়েছ। লাইটার পেয়ে ছেলে কী করে কে জানে। শুভ্র যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন তাকে শেভিং রেজার কিনে দিয়েছিলেন। শেভিং রেজার, শেভিং ক্রম, ব্ৰাশ। শুভ্ৰ কাঁদো কাদো গলায় বলেছিল- মা, শেভিং-এর জিনিসপত্র কিনে দিলে কেন? তিনি বললেন, ওমা গাল ভর্তি ফিনফিনে দাড়ি। নাকের নিচে গোঁফ- তুই শোভ করবি না? দাড়ি গোঁফ রেখে সন্ন্যাসী হবি? এই কথায় শুভ্রর চোখে পানি এসে গেল এবং সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি কোনোদিন দাড়ি গোঁফ ফেলব না। আশ্চর্য কাণ্ড সত্যি সত্যি সে তাই করল। কলেজের পুরো দুবছর মুখভর্তি ফিনফিনে দাড়ি। কী বিশ্ৰী অবস্থা! সবাই হাসাহসি করে। এর মধ্যে তাদের এক টিচার শুভ্ৰকে ডেকে বললেন— যারা জীবনে কখনোই দাড়ি গোঁফ ফেলে না তারা বেহেশতে লাইলী-মজনুর বিয়ে খেতে পারে বলে শুনেছি। তুমি ঐ বিয়ের দাওয়াত খাবার ব্যবস্থা করছ?

কে জানে আজ সে সিগারেট লাইটার নিয়ে কী করে। মনে হয় না কিছু করবে। সে তো আর ছেলেমানুষ শুভ্ৰ না; বড় হয়েছে।

শুভ্র লাইটার হাতে নিল; মার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, মা আমি সিগারেট খাই না।

জাহানারা আনন্দিত গলায় বললেন, সেটা তোকে বলতে হবে না, আমি জানি। শখে পড়ে যদি বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে কখনো খাস। আর না খেলেও থাকল একটা লাইটার। মাঝে মধ্যে আগুন জ্বালাবার দরকার পড়ে না? ধর ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। মোম খুঁজে পেয়েছিস কিন্তু দেয়াশলাই পাচ্ছিস না।

তোমাকে এত ব্যাখ্যা করতে হবে না। মা। তোমার উপহার। আমার পছন্দ হয়েছে।

পাথরটা সুন্দর না?

হ্যাঁ পাথরটা সুন্দর। এই পাথরটার নাম ম্যালাকাইট। ম্যালাকাইট খুব সুন্দর পাথর।

মোতাহার সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, কী নাম বললি?

ম্যালাকাইট।

তুই পাথর চিনিস না-কি?

সব পাথর চিনি না। দুএকটা চিনি। তুমি আঙ্গুলে যে আংটি পরে আছে তার পাথরটা হল Agate, বাংলায় বলে আকিক।

রাসুলাল্লাহ আকিক পাথর পরতেন। এক পামিস্টকে হাত দেখিয়েছিলাম। সে বলেছিল চুনি পাথর পরতে, তাহলে স্বাস্থটা ভাল থাকবে। চুনি পাথর দেখলে চিনতে পারবি?

পারব। লাল পাথর। তবে পাথরে স্বাস্থ্য ভাল হয় না। সব পাথরই আসলে এলুমিনিয়াম অক্সাইড। কোনো এলুমিনিয়াম অক্সাইডে সামান্য লোহা থাকে, কোনোটায় কপার। চুনি পাথরও যা নীলাও তা। সব পাথর আসলে এক।

মোতাহার সাহেব বললেন, সব মানুষইতো এক রকম। নাক-মুখ-চোখ নিয়ে মানুষ। তার পরেও একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো মিল আছে? তোর মত আরেকজন শুভ্ৰ কি আছে?

বাবা আমিতো পাথর না। আমি মানুষ।

জাহানারা বললেন, এত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে ভাল লাগছে না, চল পায়েস খেতে যাই।

মোতাহার সাহেব বললেন, এখানে আনতে পারবে না?

জাহানারা বললেন, এখানে আনতে পারব না। খাবার ঘরে চল। শোবার ঘরে খাওয়া দাওয়া আমার একটুও পছন্দ না। খাবার পড়ে থাকে, পিঁপড়া ওঠে।

মোতাহার সাহেবের উঠতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু জাহানারা গোপনে তাঁকে চোখ ইশারা করলেন। খাবার ঘরে জন্মদিন উপলক্ষে অন্য কিছু আছে। মনে হয় মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। কেকও থাকতে পারে। গত বছর ছিল।

জাহানারা খাবার ঘরে ঢুকে অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। বিনুকে যেভাবে সব গুছিয়ে রাখতে বলেছিলেন সে সেভাবে কিছুই করে নি। কেকের চারপাশের তিনটা মোমবাতি বাঁকা হয়ে আছে। টপটপ করে কেকের ওপর মোম গলে গলে পড়ছে। পায়েস খাবার জন্যে লাল বাটি বের করতে বলেছিলেন, সে বের করেছে নীল বাটি। তারা তিনজন মানুষ, তিনটা বাটি বের করার কথা। সে বের করেছে। চারটা। তার মানে কী? মেয়েটা কি মনে করেছে সে নিজেও সবার সঙ্গে পায়েস খাবে! এত সাহস কেন হবে? জাহানারা বিনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে তুমি এখন ঘুমুতে যাও। যাবার আগে পায়েসের বাটি বদলে দিয়ে যাও। লাল বাটি দিতে বলেছিলাম না? কী বলি মন দিয়ে আগে শুনবে না? মানুষ তিনজন আর তুমি চারটা বাটি কেন বের করলে?

বিনু মোতাহার সাহেবের দূর সম্পর্কের ভাগ্নি। সে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা এসেছে ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা দিতে। ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেছে। সে এখনও ফিরে যাচ্ছে না। কারণ তার বাবা তাকে নিতে আসে নি। জাহানারা অত্যন্ত খুশি যে বিনুর ভর্তি পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া মানে প্রথম দেড় দুই বছর হলে সিট পাবে না। মেয়েটাকে এ বাড়িতে রাখতে হবে। নানান যন্ত্রণা। জাহানারা যন্ত্রণা পছন্দ করেন না। তাঁর ছিমছাম সংসার। এখানে যন্ত্রণার স্থান নেই।

জাহানারা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মন বেশ খারাপ হয়েছে, কারণ শুভ্ৰকে দেখে মনে হচ্ছে না জন্মদিনের কেক, মোমবাতি এইসব দেখে সে খুশি হয়েছে। তার বোধহয় ঘুম পাচ্ছে। সে দুবার হাই তুলল। মার দিকে তাকিয়ে বলল, কেকটা খেতে ইচ্ছা করছে না মা।

জাহানারা গন্ত্রীর গলায় বললেন, খেতে ইচ্ছা না হলে খাবি না। এটা তো ওষুধ না যে জবরদস্তি করে খাওয়াতে হবে।

তুমি রাগ করছ না-কি?

তুই কেক খাবি না। এতে আমার রাগ করার কী আছে?

ঠিক আছে মা, তুমি আমাকে ছোট্ট দেখে একটা পিস দাও।

ইচ্ছে করছে না, শুধু শুধু খাবি কেন?

তোমাকে খুশি করবার জন্যে খাব। মাকে খুশি করার জন্যে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর দামোদর নদী সাঁতরে পার হয়েছিলেন। আমি না হয় এক পিসি কেকই খেলাম।

মোতাহার সাহেব বললেন, মাকে খুশি করার জন্যে বিদ্যাসাগর এই কাজ করেন নি। তার মাকে দেখতে যেতে ইচ্ছা করছিল। খেয়া নৌকা ছিল না। তাই নদী সাঁতরে পার হয়েছেন।

শুভ্র বলল, এই খবর জেনে তাঁর মা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন।

যে-কোনো মা-ই খুশি হবে।

শুভ্ৰ হাসি হাসি মুখে বলল, তাহলে বাবা আমার স্টেটমেন্টেতো ভুল নেই।

অসহ্য লাগছে।

শুভ্ৰ কেক খাচ্ছে। জাহানারার মনে হল কেকটা শুভ্র খুব আগ্রহ করেই খাচ্ছে। এই পিস শেষ করার পর সে হয়তো আরেকটা পিস খেতে চাইবে। জাহানারা বললেন, খেতে কেমন লাগছেরে শুভ্ৰ?

ভাল।

আরেক পিস খাবি?

খাব। আচ্ছা মা, বিনু মেয়েটাকে কখনো হাসতে শুনেছো?

জাহানারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। স্বামীর দিকেও একবার তাকালেন; শুভ্ৰ বিনুর প্রসঙ্গে কথা বলবে কেন? বিনু কে? ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছে। পরীক্ষা দেয়া হয়েছে, এখন চলে যাবে। তার সম্পর্কে কথা কেন?

শুভ্র বলল, মা তুমি বিনুর হাসি কি শুনেছ?

জানতে চাচ্ছিস কেন?

আমার একটা দরকার আছে। এখন তোমাকে বলা যাবে না। তোমাদের জন্যে একটা সারুপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। বিনুর হাসি কি তুমি শুনেছ?

জাহানারা বললেন, না শুনি নি। সবোক্স হাসি শুনে বেড়ানোর সময় আমার নেই। বিনুর সাথে কি তোর প্রায়ই কথা হয়?

মাঝে মাঝে কথা হয়, তবে ওকে কখনও খিলখিল করে হাসতে শুনি নি।

জাহানারার ভুরু কুঞ্চিত হল। মোতাহার সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন। শুভ্র বলল, তোমরা এত অবাক হচ্ছ। কেন মা? বিনুর সঙ্গে কথা বলা কি নিষিদ্ধ? জাহানারা কিছু বললেন না। শুভ্র খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমি এখনো বিয়ের কথা ভাবছি না। ভাবলে…।

জাহানারার কঠিন গলায় বললেন, ভাবলে কী?

শুভ্র বলল, না কিছু না।

শুভ্রর মুখ হাসি হাসি। তার চোখে রহস্যময় আলো। এই সবের মানে কী?

 

অসুস্থ মানুষের সঙ্গে ঘুমুতে গেলে জাহানারার নিজেকে অসুস্থ লাগে। অসুখটাকে জীবন্ত মনে হয়। মনে হয় জীবস্তু অসুখ হাত বাড়িয়ে তাঁকে ছয়ে দিচ্ছে। কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগে। ঘেন্না লাগলেও উপায় নেই অসুস্থ স্বামীকে এক বিছানায় রেখে তিনি অন্য বিছানায় শোবেন তা হয় না। সমাজে বাস করলে সমাজের নিয়ম কানুন মেনে বাস করতে হয়।

জাহানারা শুয়ে আছেন, তার ঘুম আসছে না। নিজেকে কেমন অশুচি অশুচি লাগছে। তিনি ঠিকমত নিঃশ্বাসও নিতে পারছেন না। খারাপ একটা গন্ধ পাচ্ছেন। সব রোগের গন্ধ আছে। কেউ সেই গন্ধ পায় না। কিন্তু তিনি পান। মোতাহার সাহেবের গা থেকে অসুখের গন্ধটা খুব কড়া করে তাঁর নাকে আসছে। নিশ্চয়ই অসুখ বেড়েছে। জাহানারা নিচু গলায় বললেন, এই ঘুমিয়ে পড়েছ?

মোতাহার সাহেব জবাব দিলেন না। জাহানারা খুব সাবধানে উঠে বসলেন। অসুস্থ মানুষের পাশে জেগে শুয়ে থাকার চেয়ে বারান্দায় হাঁটাহাটি করা ভাল। হাঁটাহাটির জন্য এ বাড়ির বারান্দাটা ভাল। বিরাট বারান্দা। শুধু পূর্ব-পশ্চিম খোলা। সেই দুই দিকে গ্ৰীল নেই। দক্ষিণ দিকে দুটা বড় ঘর। একটাতে থাকছে শুভ্ৰ। অন্যটায় আপাতত বিনু থাকছে। বিনু যে ঘরে আছে। এই ঘরটা শুভ্রর ঘরের চেয়েও সুন্দর। ফালতু টাইপ একটা মেয়েকে এত বড় ঘরে থাকতে দেয়া উচিত না। কিন্তু জাহানারা থাকতে দিয়েছেন। কারণ এই ঘরটা ভাল না। জাহানারার শ্বশুর মেরাজ উদ্দিন এই ঘরে থাকতেন। শেষ বয়সে তিনি পুরোপুরি পাগল হয়ে যান। মারা যান দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে। ঘরটা সেই কারণেই দোষী। বিনুদের মত মেয়েদের জন্য দোষী ঘরই ভাল। উত্তর দিকে রান্নাঘর ছাড়াই পাঁচটা কামরা। একটাতে তিনি থাকেন। অন্য সব ঘর খালি। এর মধ্যে একটা বসার ঘর। যদিও বসার ঘরে কাউকেই বসানো হয় না।

একতলায় সুন্দর একটা বসার ঘর আছে! কেউ এলে সেই বসার ঘরে বসানো হয়। তাদেরকে দোতলায় আনা হয় না। বাইরের কেউ দোতলায় উঠুক এটা জাহানারার খুবই অপছন্দ। যত কাছের আত্মীয়ই হোক তাদের বসতে হবে একতলার বসার ঘরে। জাহানারাকে খবর দিলে তিনি দোতলা থেকে নিচে নামবেন। গ্রামের আত্মীয়-স্বজন কেউ যদি এক দুরাত থেকে যায়। তাদের জন্যে একতলাতেই ব্যবস্থা আছে। মোতাহার সাহেবের অফিসের কিছু লোকজন একতলায় থাকে। তাদের জন্যেও দোতলা নিষিদ্ধ।

জাহানারা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। বারান্দায় আলো আছে। শুভ্ৰর ঘরেও আলো জুলছে। শুভ্ৰ জেগে আছে। তারপরেও জাহানারার গা সামান্য ছমছম করছে। এই বারান্দায় তিনি কিছু কিছু ভৌতিক ব্যাপার নিজে দেখেছেন। প্রায় ছফুট লম্বা রোগা একটা মেয়েকে দেখেছেন বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটে যেতে। শেষবার দেখেছেন গত বৎসর নভেম্বর মাসে। মেয়েটা হাঁটছে, মাথা নিচু করে হাঁটছে, মাঝপথে থমকে দাঁড়িয়ে জাহানারার দিকে তাকাল। তারপর আবার আগের মত হাঁটতে শুরু করল। যেন জাহানারার উপস্থিতিতে তার কিছুই যায় আসে না। মেয়েটা মিলিয়ে গেল গ্ৰীলের কাছে গিয়ে।

পুরনো ধরনের বাড়িতে বাস্তু সাপের মত বাস্তু ভূতও থাকে। এরা মাঝে মাঝে দেখা দেয়। কিন্তু কারো কোনো ক্ষতি করে না। জাহানারীদের এই দোতলা বাড়ি খুব কম করে হলেও দুশ বছরের পুরনো বাড়ি। মোতাহার সাহেবের দাদা আফসর উদ্দিন জজকোটের পেশকার দয়াল দাসের কাছ থেকে বাড়িটা সেই আমলে আঠারো হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। দয়াল দাস বাড়ি বিক্রির দলিলে সই করার দিন বললেন— বাড়িতে একটা প্ৰেত আনাগোনা করে তবে ভয়ের কিছু নেই। আমরা প্রতি অমাবশ্যায় প্রেতিটাকে ভোগ দিতাম। বড় শোল মাছ ভাজা। আপনারা মুসলমান, আপনারাতো প্রেতকে ভোগ দিবেন না। তবে দয়া করে দূর্ঘ্যবহার করবেন না। বাড়ি বন্ধক দিয়ে তাকে দূর করারার চেষ্টাও করবেন না। সে অনেকদিন এই বাড়িতে আছে। তাকে দূর করার দরকার নাই। সে থাকবে তার মত, আপনারা থাকবেন আপনাদের মত।

জাহানারার ধারণা তালগাছের মত রোগা লম্বা মেয়েটাই প্ৰেত। তিনি এই প্ৰেতটাকে যেমন দেখেছেন, আরো অনেকেই দেখেছে। সবচে বেশি দেখেছেন তার শ্বশুরু মেরাজ উদ্দিন। গভীর রাতে তার ঘর থেকে চাপা গলার শব্দ শোনা যেত। মেরাজউদ্দিন বলতেন— এই দূর হ। দুর হ মাগি। দূর হ। শ্বশুরের গলা শুনে জাহানারার ভয় ভয় লাগত। কাকে তিনি দূর হতে ঋলছেন— ঘরে তো কোনো মেয়ে নেই। থাকার মধ্যে আছে জুলহাস। মেরাজ উদিনের খাস খেদমতগার। জাহানারার খুব ইচ্ছা করত রাতে একবার গিয়ে শ্বশুরের ঘরে উঁকি দিতে। দেখার জন্যে কাকে তিনি দূর হতে বলছেন। মোতাহার সাহেবের কারণে সেটি সম্ভব হয় নি। বিয়ের রাতেই মোতাহার সাহেব স্ত্রীকে বলেছেন— সন্ধ্যার পর কখনো বাবার ঘরে উঁকি দিবে না। বারান্দাতেও যাবে না। জাহানারা বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, কেন?

সন্ধ্যার পরে বাবা সামান্য নেশা টেশা করেন। মাথা ঠিক থাকে না। তোমাকে হঠাৎ চিনতে না পেরে কী বলতে কী বলে ফেলবেন দরকার কী? খবৰ্দার যাবে।

আচ্ছা, আমি যাব না।

দিনের বেলা বাবার কাছে যাবে। তাঁর সেবা যত্ন করবে। সন্ধ্যার পর কখনো না।

জাহানারার বিয়ের এক মাসের মাথায় তার শ্বশুরু দেয়ালে মাথা ফাটিয়ে মারা যান। তিনি যদি আরো কয়েক মাস বেঁচে থাকতেন তাহলে জাহানারা অবশ্যই কোনো এক রাতে উঁকি দিয়ে শ্বশুরের কাণ্ডকারখানা দেখে আসতেন। তাঁর কৌতূহল খুব বেশি।

বারান্দায় বিনুর ঘরের সামনে তারের ওপর সাদা রঙের কী যেন দুলছে। জাহানারার বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগল—ব্রার মত দেখতে। বিনু তার ব্ৰা ঝুলিয়ে রাখে নি তো? জিনিসটা এমন জায়গায় ঝুলছে যেখান থেকে জানালা খুললেই শুভ্র দেখেতে পাবে। এই পাঁজি মেয়েটা এমন জঘন্য একটা কাণ্ড করতে পারল? ব্ৰা ঝুলিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা— ছিঃ ছিঃ। জাহানারা এগিয়ে গেলেন। এখন রাত বাজছে তিনটা। যত রাতই হোক জিনিসটা যদি ব্ৰা হয় তিনি বিনুকে ডেকে তুলবেন এবং এমন কিছু কথা বলবেন যা মেয়েটার সারাজীবন মনে থাকবে। ব্যাপারটা শুধু কথা দিয়েই শেষ হবে না, সকালবেলা বিনুকে চলে যেতে হবে। তার বাবা তাকে নিতে অ্যাসে নি তাতে কী— তিনি ম্যানেজার সাহেবকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। জাহানারা কাছে গিয়ে দেখলেন তাক্সের উপর সাদা তোয়ালে ঝুলছে। তবে তিনি যে ভেবেছিলেন— শুভ্রর জানালা খুললে এই জায়গাটা দেখা যায়। কারণ তিনি শুভ্ৰকে দেখতে পাচ্ছেন। সে খাটে বসে আছে। বই পড়ছে। তার কোলে মোটা একটা বই। আচ্ছা বিনু কি এখানে দাঁড়িয়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে। মন ভুলানোর চেষ্টা করে? ব্যাপারটা খেয়াল রাখতে হবে। কিংবা শুভ্ৰকে বলতে হবে এই দিকের জানালাটা যেন বন্ধ রাখে।

জাহানারা শুভ্রর জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। শুভ্র বই থেকে মুখ না তুলে বলল, মা এত রাতে বারান্দায় হাঁটা হাঁটি করছ, কেন? শেষে তোমার সঙ্গে মহিলা ভূতটার দেখা হয়ে যাবে। তুমি ভয়টয় পাবে। ঘুমুতে যাও।

তুই ঘুমুচ্ছিস না কেন?

শুভ্র বই থেকে মুখ তুলে হাসিমুখে বলল, মা শোন, জেগে যখন আছ একটা কাজ করতে পারবে- চা খাওয়াতে পারবে? চা খেতে ইচ্ছা করছে। আমি নিজেই বানোতাম, এখন বই ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না।

কী বই পড়ছিস?

অন্ধাদের লেখাপড়া শেখার বই। যখন অন্ধ হয়ে যাব তখন এই বই-এর বিদ্যা খুব কাজে লাগবে।

শুভ্ৰ হো হো করে হাসছে। যেন অন্ধ হয়ে যাওয়াটা খুব মজার ব্যাপার। ময়না পাখিটা ঘুমুচ্ছিল, সে হাসির শব্দে জেগে উঠে ডানা ঝাপটাচ্ছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ