ফেরার গল্প ভাটি অঞ্চল নিয়ে।

আমার নানার বাড়ির দেশ, যেখানে শৈশবের বর্ণাঢ্য দিনগুলি কাটিয়েছি। গল্পের মূল চরিত্রের কেউ আর বেঁচে নেই। তাদের কথা আজ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে করছি।

গল্পে বেশ কিছু আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছি। কৌতূহলী পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে অপ্রচলিত আঞ্চলিক শদের একটি নির্ঘন্ট বইয়ের শেষে জুড়ে দিয়েছি। ভাটি অঞ্চলের খুঁটিনাটি প্রসঙ্গে সাহায্য করেছেন আমার মা এবং আমার হোটমামা মাহবুবুন্নবী শেখ। তথ্যগত ভুল কিছু থাকলে তার দায়দায়িত্ব তাঁদের।

ফেরা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ঈদ সংখ্যা উত্তরাধিকারে (১৯৮৩)।

 

০১.

মতি মিয়া দ্রুত পায়ে হাঁটছিল।

আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে, যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সঙ্গে ছাতাফাতা কিছুই নেই, বৃষ্টি নামলে ভিজে ন্যান্যাতা হতে হবে।

মতি মিয়া হনহন করে ডিসট্রিক্ট বোর্ডর সড়ক ছেড়ে সোহাগীর পথ ধরল। আর তখনি বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। মতি মিয়ার বিরক্তির সীমা রইল না। সকাল-সকাল বাড়ি ফেরা দরকার। শরিফার পা ফুলে ঢোল হয়েছে। কাল সারা রাত কোঁ-কোঁ করে কাউকে ঘুমাতে দেয় নি। সন্ধ্যার পর আমিন ডাক্তারের এসে দেখে যাবার কথা। এসে হয়তো বসে আছে। মতি মিয়া গম্ভীর একটা ঝাঁকড়া জামগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল।

দেখতে দেখতে বৃষ্টির বেগ বাড়ল। ঢালা বর্ষণ, জামগাছের ঘন পাতাতেও আর বৃষ্টি আটকাচ্ছে না, দমকা বাতাসের শো-শোঁ আওয়াজ। দিনের যা গতিক, ঝড়-তুফান শুরু হওয়া বিচিত্র নয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার কোন অর্থ হয় না। মতি মিয়া উদ্বিগ্ন মুখে রাস্তায় নেমে পড়ল। পা চালিয়ে হাঁটা যায় না। বাতাস উল্টো দিকে উড়িয়ে নিতে চায়। নতুন পানি পেয়ে পথ হয়েছে দারুণ পিছল। ক্ষণে ক্ষণে পা হড়কাচ্ছে। সরকারবাড়ির কাছাকাছি আসতেই খুব কাছে কোথায় যেন প্ৰচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। আর আশ্চর্য, বৃষ্টি থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মতি মিয়া অবাক হয়ে শুনল সরকার বাড়িতে গান হচ্ছে। কানা নিবারণের গলা বাতাসের শো-শোঁ শব্দের মধ্যেও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে,

আগে চলে দাসী বান্দি পিছে ছকিনা,
তাহার মুখটি না দেখিলে প্ৰাণে বাঁচতাম না
ও মনা ও মনা …..

সরকারবাড়ির বাংলাঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। মতি মিয়া ধাক্কা দিতেই নাজিম সরকার মহা বিরক্ত হয়ে দরজা খুললেন। হ্যাঁ, কানা নিবারণই গাইছে। সেই গাট্টাগোট্টা চেহারা, পান-খাওয়া হলুদ রঙের বড়ো বড়ো কুৎসিত দাঁত। কানা নিবারণ গান থামিয়ে হাসিমুখে বলল, মতি ভাই না? পেন্নাম হই। অনেক দিন পরে দেখলাম।

মতি মিয়া বড়োই অবাক হল। কানা নিবারণের মতো লোক তার নাম মনে রেখেছে। জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে। কানা নিবারণ গম্ভীর হয়ে বলল, মতি ভাইরে একটা গামছা-টামছা দেন।

কেউ গা করল না। নাজিম সরকার রাগী গলায় বললেন, ভিজা কাপড়ে ভিতরে আসলা যে মতি? দেখ ঘরের অবস্থা কী করছ। তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি আর হইল না, ছিঃ ছিঃ।

কানা নিবারণ বলল, ঘরে না আইসা উপায় কি? বাইরে ঝড়-তুফান।

নাজিম বড়োই গম্ভীর হয়ে পড়লেন। থেমে থেমে বললেন, তুমি গান বন্ধ। করলা কেন নিবারণ?

কানা নিবারণ সঙ্গে সঙ্গে গান শুরু করল–

দুধের বরণ সাদা সাদা কালা দিঘির জল
তাহার মনের গুপ্ত কথা আমারে তুই বল।

মনটা উদাস হয়ে গেল মতি মিয়ার। শরিফা বা আমিন ডাক্তার কারোর কথাই মনে রইল না। কন্যার মনের গুপ্ত কথাটির জন্যে তারো মন কাঁদতে লাগল। আহা, এত সুন্দর গান কানা নিবারণ কী করে গায়? কী গলা।

গান থামল অনেক রাতে। ততক্ষণে মেঘ কেটে আকাশে পরিষ্কার চাঁদ উঠেছে। গাছের ভেজা পাতায় চকচক করছে জোঙ্গা। মতি মিয়া উঠোনে নেমে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না এমন অদ্ভুত লাগে। বিড়ি টানতে টানতে নিবারণ বাইরে আসতেই মতি মিয়া বলল, কেমন চাঁদনি রাইত, দেখছেন নি নিবারণ ভাই?

চাঁদনি রাইত নিবারণকে তেমন অভিভূত করতে পারল না, বিড়িতে টান দিয়ে সে প্রচুর কাশতে লাগল। কাশির বেগ কমে আসতেই গম্ভীর হয়ে বলল, বাড়িত যান মতি তাই, রাইত মেলা হইছে।

আর গাওনা হত না?

নাহ, আইজ শেষ। ওখন বেশি গাই না। বুকের মধ্যে দরদ হয়।

ডাক্তার দেখান নিবারণ ভাই।

নিবারণ বিরক্ত মুখে এক দল থুথু ফেলে, চোখ কুঁচকে বলল, বাড়িত যান। আমার ডাক্তার লাগে না।

রাস্তায় নেমেই মতি মিয়া লক্ষ করল–আবার মেঘ করেছে। দক্ষিণ দিকে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চৌধুরীবাড়ির কাছাকাছি আসতেই দুই পহরের শেয়াল ডাকল। এতটা রাত হয়েছে নাকি? চারদিক নিশুতি। চাঁদ মেঘের আড়ালে পড়ায় ঘুঘটে অন্ধকার, গা ছমছম করে।

কেডা, মতি নাকি?

মতি মিয়া চমকে দেখে, হোট চৌধুরী। উঠোনে জলচৌকি পেতে খালিগায়ে বসে আছেন। এঁর মাথা পুরোপুরি খারাপ। গত বৎসর কৈবর্তপাড়ার একটা ছেলেকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন।

কে, একটা কথা কয় না যে? মতি নাকি?

জ্বি।

এত রাইতে কই যাও?

বাড়িত যাই।

তোমার বড় পুলাড়া তোমারে খুজতেছে। তোমার বৌয়ের অবস্থা বেশি বালা না। নীলগঞ্জে নেওন লাগব।

জি আচ্ছা।

জ্বি জ্বি কর কেন মতি মিয়া? তাড়াতাড়ি বাড়িত যাও।

মতি মিয়া তবু দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট চৌধুরীর অভ্যাস হচ্ছে ভালোমানুষের মতো কথা বলে হঠাৎ তাড়া করা। সে কারণেই চট করে সামনে থেকে চলে যেতে ভরসা হয় না।

ছোট চৌধুরী গর্জন করে ওঠেন, কথা কানে ঢুকে না? থাপ্পড় দিব, ছোটলোক কোথাকার। যা, বাড়িত যা।

মতি মিয়া বাড়ি ফিরে দেখে আমিন ডাক্তার বসে আছে। শরিফার জ্ঞান নেই। আজরফ চুলা ধরিয়ে কি যেন জ্বাল দিচ্ছে।

আমিন ডাক্তার বলল, অবস্থা বড় সঙ্গিন। রাইত কাটে কিনা সন্দেহ।

মতি মিয়া কিছু বলল না। যেন সে আমিন ডাক্তারকে দেখতেই পায় নি। আজরফের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় ধমক দেয়, অত রাইতে কী জ্বাল দেস?

চা। আমিন চাচা চায়ের পাতা আছে।

আমিন ডাক্তার মৃদু স্বরে বলল, সারা রাইত জাগন লাগব, চা ছাড়া জুইত হইত না। বুঝছনি মতি, নীলগঞ্জ নেওন লাগব।

আমিন ডাক্তার লোকটি ভীতু প্রকৃতির। রুগীর অবস্থা একটুখানি খারাপ দেখলেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলগঞ্জ নেবার জন্যে, বারবার বলে, রাইত কাটা সম্ভব না। রাইতের মধ্যেই ভালো-মন্দ হইতে পারে।

কিন্তু আজ রুগীর অবস্থা সত্যি খারাপ। আমিন ডাক্তার চিন্তিত মুখে ক্ৰমাগত হঁকা টানে। মতি মিয়া বিরক্ত হয়ে বলে, মেয়েমানুষের মত বেআকেল জিনিস খোদার আলমে নাই, বুঝলা ডাক্তার?

ডাক্তার ইকা টানা বন্ধ করে গম্ভীর হয়ে বলে, নীলগঞ্জ নেওনের ব্যবস্থা কর মতি।

কইলেই তো ব্যবস্থা হয় না। যোগাড়-যন্ত্র লাগে। সকাল হউক। টেকাপয়সার যোগাড় দেখি।

আইজ রাইতেই নেওন লাগব মতি।

মতি মিয়া কথা না বলে খেতে বসে। আজরফ ভাত বেড়ে দেয়। তাত শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে গেছে। কাঁচা মরিচে ঝালের বংশ নেই। মতি মিয়া আধপেটে খেয়েই হাত ধোয়। হোট ছেলে নুরুদ্দিন আমিন ডাক্তারের গা ঘেঁষে বসেছিল। সে দীর্ঘ সময় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস করে বলে ফেলে, আমারে নীলগঞ্জ নেওন আগব বাজান।

বহু কষ্টে রাগ সামলায় মতি মিয়া। আমিন ডাক্তার বলে, চা খাও। আজরফ, রে বাপরে চা দে।

আমারে দিস না।

আরে খাও। বালা চা। মোহনগঞ্জের খরিদ।

নীলগঞ্জ যাওয়ার যোগাড়-যন্ত্র করতে অনেক সময় লাগে। বাঁশের যে-খুঁটিতে পয়সা জমান হত, সেটি কাটা হয়। সব মিলিয়ে সাত টাকার মতো পাওয়া যায় সেখানে। এতটা মতি মিয়া আশা করে নি। আজরফ চলে যায় নৌকার ব্যবস্থা করতে। ঠিক হয় আজরফ নুরুদ্দিন দুজনেই সঙ্গে যাবে। আমিন ডাক্তারও যাচ্ছে। নীলগঞ্জ হাসপাতালের কম্পাউণ্ডার সাহেবের সঙ্গে তার নাকি ভালো জানাশোনা। আপনি আপনি করে কথা বলে।

খালি বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্যে আনা হয়েছে রহিমাকে। রহিমার মেয়েটি কাঁদছে গলা ফাটিয়ে। শরিফার জ্ঞান ফিরেছে। সে বিড়বিড় করে কী যেন বলে, ঠিক বোঝা যায় না। মতি মিয়া কড়া ধমক লাগায়, চুপ। একদম চুপ। বেআক্কল মেয়েমানুষ।

শরিফা চুপ করে যায়। আমিন ডাক্তার এক ফাঁকে বলে, আমারে যে সাথে। নিছ সেই বাবদ দুই টেকা ভিজিট কথা স্মরণ রাখবা মতি।

মতি মিয়া দারুণ বিরক্ত হয়।

তোমারে সাথে নেওনের কথা তোকই নাই। নিজের ইচ্ছায় তুমি যাইতাছ।

আমিন ডাক্তার চুপ করে যায়।

নৌকায় উঠবার মুখে ৰূপৰূপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। দুইয়ের নিচে খড় বিছিয়ে শরিফার বিছানা। শরিফার গায়ের সঙ্গে সেঁটে লেগে থাকে নুরুদ্দিন। ডাক্তার বসেছে নৌকার সামনের মাথায়। এর মধ্যেই সে ভিজে চুপসে গেছে। তার সঙ্গে ছাতা আছে। কিন্তু রুগী নিয়ে কোথায়ও যাওয়ার সময় ছাতা মেলতে হয় না। খুব অলক্ষণ। নৌকাতে দুটি মুরগি এবং একটি পাকা কাঁঠাল নেওয়া হয়েছে। নীলগঞ্জ বাজারে ভালো দাম পাওয়া যাবে।

মুরগি দুটি অনবরত ডানা ঝাপ্টায়। ডাক্তার গম্ভীর হয়ে হঁক ধরায়। বৃষ্টির ছাট থেকে ককে আড়াল করে রাখতে তাকে অনেক কায়দা-কানুন করতে হয়। পাকা কাঁঠালের গন্ধের সঙ্গে তামাকের গন্ধ মিশে অদ্ভূত একটা মিশ্ৰ গন্ধ তৈরী হয়। তুমুল বৰ্ষণের মধ্যে নৌকা ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আজরফ টপাটপ বৈঠা মারে। মতি মিয়ার বড়ো মায়া লাগে।

শীত লাগে আজরফ?

নাহ্‌।

মাথাডা গামছা দিয়া বাঁধ। মাথা শুকনা থাকলে সব ঠিকঠাক–বুঝছস?

বুঝছি।

বৈশাখ মাসের বিষ্টির মজাটা কি জানস নি আজরফ?

না।

মজাটা হইল, অসুখ-বিসুখ হয় না। সব আল্লাহর কেরামতি।

আজরফ কথা বলে না। ছৈয়ের ভেতর থেকে শরিফা বিড়বিড় করে কী যেন বলে। অসহ্য বোধ হয় মতি মিয়ার।

কি কও?

পুলাড়া ভিজতাছে।

দুত্তেরি মেয়েমানুষ। বিষ্টির সময় ভিজত না?

অসুখ করব।

চুপ থাক মাগী, খালি প্যানপ্যাননি।

আমিন ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলে, মেয়ে জাতের সাথে এই সব গালিগালাজ করা ঠিক না মতি।

তুমি ফরফর কইর না, চুপ থাক।

আমিন ডাক্তার চুপ করে যায়। ছপছপ বৈঠা পড়ে। মৈয়ের ভেতর থেকে মুরগি দুটির ডানা ঝাপটানর আওয়াজ আসে। দূরের সোপোতার হাওরের দিক থেকে হত হত শব্দ হয়। গা ছমছম করে আজরফের। নৌকা এখন বড়ড়া গাঙে পড়বে। জায়গাটা খারাপ। গাঙের মুখটাতেই তিনটি প্রকাণ্ড শ্যাওড়া গাছ। রাতে নাম নেওয়া যায় না, এমন সব বিদেহী জিনিসদের খুব আনাগোনা।

 

নৌকা নীলগঞ্জে পৌঁছল দুপুরের পর। মতি মিয়ার নড়বার শক্তি নেই। একনাগাড়ে নৌকা বেয়ে সমস্ত শরীর কালিয়ে গেছে। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ার চিন্তা ছাড়া তার মাথায় এখন আর কিছু টুকছে না। আমিন ডাক্তার একাই গেল হাসপাতালে খোঁজ নিতে। ঘন্টাখানিক পর ফিরে এল মুখ কালো করে। হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব গেছেন ছুটিতে। কখন আসবেন কেউ জানেনা। কম্পাউণ্ডার সাহেবের মেয়ের বিয়ে। তিনি গেছেন বাঁশখালি। বিষ্যত্বর নাগাদ আসবার কথা। মতি মিয়ার কোনো ভাবান্তর হল না। সে গম্ভীর মুখে বলল, চেষ্টার তো কোন ত্রুটি করি নাই, কী কও ডাক্তার? কপালের লিখন না যায় খণ্ডন করণের তো কিছু নাই।

আমিন ডাক্তার চুপ করে থাকল। মতি মিয়া বলল, খাওয়া-খাইদ্য শেষ কইরা চল বাড়িত যাই।

মতি ভাই, চল মিশনারি হাসপাতালে লইয়া যাই। বেশি দূর না, একটা মুটে হাওর পরে সোনাদিয়া হাওর।

আমিন ডাক্তারের কথা শেষ হবার আগেই মতি মিয়া ঝাঁঝিয়ে ওঠে, এই সব খিরিস্তানির মধ্যে আমি নাই। এই সব কথা মুখে আইন্য না, বুঝলা?

আমিন ডাক্তার চুপ করে যায়। শরিফারও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। জারুল গাছের ছায়ায় নৌকা বেঁধে ভরপেট চিড়া খেয়ে মতি মিয়া ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘুম ভাঙে সন্ধ্যার পর। নৌকা তখন সোনাদিয়ার হাওরে পড়েছে। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পাল খাটান হয়েছে। আমিন ডাক্তার হাল ধরে বসে আছে। ভাবখানা এরকম, যেন কিছুই জানে না।

মতি ভাই, বাতাসের এই ধরনের জোর থাকলে এক পহরেই মিশনারি হাসপাতালে পৌঁছান যাইবে।

মতি মিয়া চুপ করে থাকে।

তামুক খাইবা নাকি, কি ও মতি ভাই?

নাহ্‌।

মিশনারি হাসপাতালে এক বার নিয়া ফেলতে পারলে বুঝলা আর চিন্তা নাই। হেইখানে নিখল সাব ডাক্তার খুব এলেমদার লোক।

মতি মিয়া চুপ করে থাকে। আড়চোখে দেখে, আজরফ কাল রাতের পরিশ্রমে কাহিত হয়ে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে। শরিফার মুখের কাছে ভনভন করে মাছি উড়ছে একটা। মরে গেছে নাকি? মরলেই কি আর বেঁচে থাকলেই কি? হাওরের দিগন্তবিস্তৃত কালো পানির দিকে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে যায় তার। জগৎসংসার তুচ্ছ বোধ হয়। সে চাপা স্বরে গুনগুন করে–,

লোকে আমায় মন্দ বলে রে
মন্দ বলে মন্দ বলে মন্দ বলে রে
আমি কোথায় যাব কি করিব
দুঃখের কথা কাহারে করে।
মন্দ বলে মন্দ বলে মন্দ বলে রে।

আমিন ডাক্তার মৃদু স্বরে বলে, তুমি কিন্তু বড়ো ছাতক, মতি ভাই।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ