সাত তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেবেন রেসকোর্সের মাঠে। ভোররাত থেকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। দোকানপাট বন্ধ। অফিস-আদালত কিছু নেই। সবার দারুণ উল্কণ্ঠা, কী বলবেন এই মানুষটি? সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব মন দিয়ে আজ শুনতে হবে তিনি কী বলেন। আজ তাকে পথ দেখাতে হবে। শোনাতে হবে অভয়ের বাণী।

হাজার হাজার মানুষ জমতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে রেসকোর্সের ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হলো। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী সবাই অপেক্ষা করছে। বাবার কাঁধে চেপে এসেছে শিশুরা। অবাক হয়ে তারা দেখছে এই বিশাল মানুষের সমুদ্রকে।

বহুদূরে অপেক্ষা করছে সারি সারি মিলিটারি ভ্যান। চোখে সানগ্লাস পরা তরুণ অফিসারদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। সম্মিলিত শক্তি ভয়াবহ শক্তি। ওরা কি বুঝতে পারছে সে-কথা? ঘনঘন কথা বলছে ওয়ারলেসে। মাথার ওপর দিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে উড়ে যাচ্ছে হেলিকপ্টার। বিমান বাহিনীর পদস্থ অফিসাররা হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে নিচে তাকাচ্ছে। ওদের কপালেও ঘাম। নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত। অপেক্ষা করছে তারাও।

সাজ্জাদ এসেছে খুব ভোরে। সে ঠিক বক্তৃতা শুনতে আসেনি। বক্তৃতা-টতা তার বিশেষ ভালো লাগে না। সাজ্জাদ এসেছে তার দুলাভাইয়ের খোঁজে। তার মনে ক্ষীণ আশা, কোনো অলৌকিক উপায়ে তাকে হঠাৎ হয়তো পাওয়া যাবে। দেখা যাবে, মাঠের প্রান্তে পা ছড়িয়ে চীনাবাদাম খাচ্ছে। সাজ্জাদকে দেখামাত্র ডাকবে, অ্যাই যে, অ্যাই এই সাজ্জাদ। সাজ্জাদ বলবে, আরে দুলাভাই, আপনি এখানে!

এলাম, দেখি শেখ সাহেব কী বলেন।

এদিকে আপনার জন্যে আমরা অস্থির। আপা বাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

তাই নাকি?

আবার বলছেন তাই নাকি। এসব কী কাণ্ড দুলাভাই! চলেন বাসায় যাই।

যাব যাব। বসো আগে বক্তৃতাটা শুনি। বাদাম খাবে?

না।

আরে খাও না। অ্যাই, অ্যাই বাদামওয়ালা।

বাস্তবে অবশ্যি সেরকম কিছুই হলো না। কত অসংখ্য মানুষ এসেছে। কিন্তু কারও সঙ্গে কারও চেহারার কোনো মিল নাই। সাজ্জাদের হঠাৎ মনে হলো, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার তো। সব পণ্ড দেখতে একরকম। দুটি শিয়ালের মধ্যে প্রভেদ কিছু নেই। মানুষরা কত আলাদা। কেন, এরকম কেন?

সাজ্জাদ চমকে পেছন ফিরল। খয়েরি রঙের একটা চাদর গায়ে দিয়ে হেড স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। সাজ্জাদের মনে হলো, সভাতে আসার জন্যে হেড স্যার প্রথমেই একটা প্রচও ধমক দেবেন। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। স্যার অস্বাভাবিক নরম গলায় বললেন, সাজ্জাদ, একটা খবর শুনলাম তোমার দুলাভাইয়ের সম্পর্কে, এটা কি সত্যি? ওনাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না?

সত্যি, স্যার।

বলো কী? আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়েছ তো?

জি স্যার।

আত্মীয়স্বজন কে কে আছেন?

সাজ্জাদ চুপ করে রইল। তার তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। এক মামা আছেন কুড়িগ্রামে, পোস্টমাস্টার। নিকটআত্মীয় বলতে তিনি। তার সঙ্গে বহুদিন যাবত যোগাযোগ নেই। হেড স্যার বললেন, তোমাদের চলছে কীভাবে? সঞ্চয় তো মনে হয় তেমন কিছু তোমার দুলাভাইয়ের ছিল না। নাকি ছিল? সাজ্জাদ জবাব দিল না। হেড স্যার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, কাল তুমি অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করবে। বাসা চেনো তো?

চিনি স্যার।

সকালবেলা আসবে।

জি আচ্ছা।

এখানে দাঁড়িয়ে তো কিছু শুনতে পাবে না। আরেকটু সামনে যাওয়া দরকার। চলো সামনে যাই।

আপনি যান স্যার। আমি বাসায় চলে যাব।

সে-কী! ভাষণ শুনবে না?

জি-না স্যার।

আচ্ছা ঠিক আছে, যাও। কাল সকালবেলা মনে করে আসবে। মনে থাকবে তো?

থাকবে স্যার।

সাজ্জাদ বাসায় গেল না। নীলুদের বাসার দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিল। তার একটু লজ্জা করতে লাগল। এক সপ্তাহ পর আসছে এখানে। দাদুমণি খুব করে বলে দিয়েছিলেন একটা খবর দেওয়ার জন্যে।

দরজা খুলল নীলু। সে থমথমে গলায় বলল, খুব বকা খাবে দাদুমণির কাছে। দাদুমণি খুব রেগেছেন তোমার ওপর। আমাকে বলেছেন এলেও যেন ঢুকতে না দেই।

দাদুমণি অবশ্যি তেমন রাগ করলেন না। কিংবা রাগটা জমা করে রাখলেন, পরে করবেন। তিনি বললেন, তুমি আমি না-আসা পর্যন্ত থাকবে এখানে। আমি শেখ সাহেবের ভাষণ শুনতে যাচ্ছি। নীলু বলল, সে তো দাদুমণি রেডিওতে শুনলেই হয়।

না, এসব জিনিস সভাতে উপস্থিত থেকে শুনতে হয়। রেডিওতে শুধু কথাগুলি শোনা যাবে। কিন্তু বক্তৃতা শুনে মানুষের চোখেমুখে কী পরিবর্তন হচ্ছে সেটা দেখা যাবে না। আমার কাছে বক্তৃতার চেয়ে এইসব জিনিসই দেখতে ভালো লাগে।

দাদুমণি চলে যাওয়া মাত্র নীলু বলল, তোমাদের কথা আমার রোজ মনে হয়েছে। আশ্চর্য, একবারও তোমরা এলে না।

এলাম তো।

এক সপ্তাহ পর এলে। দাদুমণি যতটুকু রাগ করেছে আমি তারচেয়েও বেশি রাগ করেছি। আমি কোনো কথাই বলব না।

আমার একটা বড় বিপদ হয়েছে। আমার দুলাভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না।

খুঁজে পাচ্ছ না মানে?

কার্ফুর রাতে আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন, তারপর আর ফিরে আসেননি।

সাজাদের চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করল। নীল তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। একসময় দেখা গেল সেও কাঁদতে শুরু করেছে। তার পোষা ময়না ক্রমাগত ডাকতে লাগল, কুটুম এসেছে, বসতে দাও।

ঠিক তখনই রেসকোর্সে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা শুরু করলেন। তার মুখ দিয়ে কথা বলে উঠল বাংলাদেশ।

…আমি যদি তোমাদের কাছে না থাকি, তোমাদের উপর আমার আদেশ রইল ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। রক্ত যখন দিতে শিখেছি আরও দেব। বাংলাকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ