মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে রাহেলা গম্ভীর হয়ে পড়লেন। বেশ জ্বর গায়ে। জ্বরের আঁচে গাল লাল হয়ে আছে। অথচ সকালে বেশ ভালো ছিল। অনজু ও বিলুর সঙ্গে হইচই করে খেলেছে।

কেমন লাগছে মা?

ভালো লাগছে।

মাথাব্যথা করে।

নাহ।

শরীর খারাপ লাগছে না?

না তো।

রাহেলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তুমি একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই আমরা নর্থ। ডাকোটায় চলে যাব।

আমি যেতে চাই না মা।

যেতে চাও না কেন? আমেরিকা তোমার ভালো লাগে না।

লাগে।

প্রিসিলা জবাব দিল না। ঘরের দরজায় অনজু আর বিলু উঁকি দিচ্ছিল। তাদের হাতে লুডু বোর্ড। রাহেলা বললেন, প্রিসিলার জ্বর। প্রিসিলা খেলবে না। তোমরা এখন ওকে বিরক্ত করবে না।

প্রিসিলা বলল, মা, আমি ওদের সঙ্গে খেলতে চাই।

না। তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকবে।

শুয়ে থাকতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে না।

ইচ্ছে না হলেও থাকবে। আমি ডাক্তারকে টেলিফোন করছি।

রাহেলা নিচে নেমে গেলেন। নিচে গিয়ে দেখলেন, কবীর পাংশুমুখে বসে আছে একটা চেয়ারে। তার ঠোঁট কাটা, সেখানে রক্ত জমে আছে। আমিন সাহেব বসে আছেন তার সামনে। রাহেলা বললেন, কী হয়েছে?

মিছিলে গিয়েছিলাম চাচি। হঠাৎ পুলিশ তাড়া করল। দৌড়াতে গিয়ে উল্টে পড়ে গেছি।

ঠোঁট তো দেখি অনেকখানি কেটেছে।

না, বেশি না।

আমিন সাহেব বললেন, খুব মিছিল হচ্ছে, না?

খুব হচ্ছে।

ওদের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা, ঠিক না?

আমিন সাহেব হেসে উঠলেন। রাহেলা গম্ভীর হয়ে বললেন, হাসির কোনো ব্যাপার হয়নি। তুমি হাসছ কেন?

হাসির ব্যাপার না, তবে আনন্দের ব্যাপার।

আনন্দের ব্যাপারটা কোথায়?

আমিন চাচা গম্ভীর হয়ে বললেন, একটা সিংহ তার ক্ষমতা বুঝতে পারছে, ব্যাপারটা আনন্দের নয়? রাহেলা জবাব দিলেন না। ডাক্তারকে টেলিফোন করতে গেলেন। টেলিফোনে রিং হচ্ছে না। অনেকবার চেষ্টা করা হলো। রাহেলা মুখ কালো করে বললেন, পৃথিবীর কোনো দেশে এত খারাপ টেলিফোন সার্ভিস আছে বলে আমার জানা নেই।

.

খোকনের সমস্তটা দিন খুব খারাপ কেটেছে। ভয়াল-ছয়ের একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বল্টু ও টুন দুজনেই দেশের বাড়িতে চলে গেছে। অবস্থা ভালো না হলে এরা ফিরে আসবে না। সাজ্জাদকেও তার বাসায় পাওয়া গেল না। সে কোথায় গেছে কী তাও জানা গেল না। সাজ্জাদের বোন কোনো কথারই জবাব দিতে পারেন না। শুধু কাঁদেন। অনেক ঝামেলা করে মুনিরকে পাওয়া গেল। মুনিরের কাছে স্যার এসেছেন, ইংরেজি পড়াচ্ছেন। মুনির এক ফাঁকে বলে গেল, একটু দাড়া, স্যার এক্ষুনি চলে যাবেন। খোকন অপেক্ষা করতে লাগল। স্যার যেতে অনেক দেরি করলেন। বসে থাকতে থাকতে খোকনের প্রায় যখন ঘুম ধরে গেল তখন স্যার গেলেন। খোকন বলল, দুপুরে পড়িস তুই?

হুঁ। বাবা স্যার রেখে দিয়েছেন। স্কুল তো এখন বন্ধ, কাজেই ঘরে বসে যতটুকু পারা যায়। তোদের ভয়াল-ছয়ের কী অবস্থা?

ভালেই।

ভালো আর কোথায়! সব তো চলেই গেছে। তুই আর সাজ্জাদ এই দুজন ছাড়া তো এখন আর কেউ নেই।

আ আবার আসবে, তখন হবে।

এসব জিনিস একবার ভেঙে গেলে আর হয় না।

তোকে বলেছে।

খোকনের বসে থাকতে আলো লাগছিল না। সে একসময় বলল, ঘুরতে যাবি।

কোথায়?

ওই রাস্তায়, আর কোথায়?

না ভাই। বাবা রাগ করবেন। তাছাড়া বিকেলে আমার কাছে আরেকজন স্যার আসবেন। অঙ্ক স্যার।

কটা স্যার তোর?

বেশি না এই দুজনই। বৃত্তি পরীক্ষা আসছে তো, তাই।

খোকন একা একা অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াল। ফার্মগেট থেকে হেঁটে হেঁটে চলে গেল শাহবাগ অ্যাভিনিউ পর্যন্ত। শাহবাগের মোড়ে কিসের যেন জটলা। লোকজন বলাবলি করছে জী মিছিল আসছে পুরনো ঢাকা থেকে, একটা কাণ্ড হবে। একজন স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক বললেন, থোকা তুমি বাড়ি যাও। খোকন বাড়ি গেল না। পাক মটরস পর্যন্ত গিয়ে চলে গেল কলাবাগানের দিকে। সেখানেও প্রচুর গণ্ডগোল, একটা পুলিশের ট্রাক পড়ছে। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। খোকনের দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও ভিড় গলে ভেতরে ঢুকতে পারল না। একটা দমকলের গাড়ি এসে থেমে আছে। কেউ সেটাকে যেতে দিচ্ছে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আশপাশে কোথাও পুলিশ বা মিলিটারির কোনো চিহ্ন নেই। খোকন কলাবাগানে কাটাল বিকেল পর্যন্ত। বাড়ি ফিরতে তাই সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। বড়চাচা আজ নির্ঘাৎ ধরবেন। আজ বাড়িতে ভূমিকম্প হবে।

বড়চাচা অবশ্যি তাকে ধরলেন না। ধরলেন কবীর ভাইকে। রাতের খাবার শেষ হয়ে যাওয়ার পরপরই বিচারসভা বসল। আসামি মাত্র একজন। কবীর ভাই। বিচার বসল বড়চাচার লাইব্রেরিঘরে। সবাই সেখানে উপস্থিত। কবীর ভাই মাথা নিচু করে সোফার একটা কোনায় বসে আছেন। বড়চাচা থেমে থেমে বললেন, তুমি একবার সকালবেলা একটা মিছিলের সঙ্গে জুটে গিয়ে ঠোঁট কেটে এলে। তারপরও বিকেলবেলা আবার গেলে! অথচ আমি অনেকবার বলেছি এসব মিটিং-মিছিল থেকে দূরে থাকবে। এই প্রসঙ্গে তোমার কী বলার আছে?

কবীর ভাই চুপ করে রইলেন।

তোমার কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো। তোমার কি ধারণা যা করছ দেশের জন্যে করছ?

জি।

ভুল ধারণা। হাঙ্গামা হুজ্জত করে দেশের কিছু হবে না। এতে দেশের অমঙ্গলই হবে, মঙ্গল হবে না। বুঝতে পারছ?

কবীর ভাই কিছু বললেন না। খোকনের আব্বা হঠাৎ কথা বলে উঠলেন। শান্তস্বরে বললেন, আপনার কথাটা ঠিক না। আন্দোলন করে অনেক কিছু আদায় করা যায়। ভাষা আন্দোলনের কথা মনে করে দেখুন। সেদিন আমরা আন্দোলন না করলে আজ রাস্তাঘাটে উর্দুতে কথা বলতাম।

আন্দোলনের অনেক রকম পথ আছে। গান্ধিজী অহিংস পথে দেশকে স্বাধীন করেছেন।

আমিন চাচা বললেন, তার জন্যে গান্ধিজীর মতো নেতা দরকার। সেরকম যখন নেই তখন আমাদের পথে নামা ছাড়া উপায় কী?

এইসব বাচ্চা ছেলেপুলে পথে নামবে?

নামবে না কেন? নামবে। অল্পবয়স থেকেই তাদের শিখতে হবে।

বড়চাচা দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, ভুট্টো সাহেব এসেছেন। আলোচনায় বসেছেন। এখন সব মিটমাট হবে। মিছিল ফিছিলের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এতে ওদেরকে শুধু খেপিয়েই তোলা হবে। কবীর আমার হুকুম অমান্য করেছে। কাজেই এর শাস্তিস্বরূপ সে আগামী এক সপ্তাহ ঘর থেকে বেরোতে পারবে না। কবীর, আমি কী বলেছি তুমি বুঝতে পারছ?

পারছি।

আর শোনো, যদি আমার কথার অবাধ্য হয়ে আবার বের হয়ে যাও তাহলে এ বাড়িতে এসে আর ঢুকতে পারবে না।

বড়চাচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে অসম্ভব গম্ভীর হয়ে পড়লেন।

রাত দশটায় ভয়েস অব আমেরিকা থেকে বলা হলো–শেখ মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যে কথাবার্তা এগোচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তারা একটা আপসে পৌঁছবার চেষ্টা করছেন। শহরের পরিস্থিতি আগের মতোই। চারদিকে থমথমে ভাব যা ঝড়ের ইঙ্গিত দেয়।

রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে খোকনের মা খোকনকে ডেকে পাঠালেন। কাদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই আজও গিয়েছিলি? খোকন চুপ করে রইল। তিনি খুব কাঁদতে লাগলেন। খোকন বলল, কাঁদছ কেন?

কাঁদব না! তুই যেখানে সেখানে যাবি। আমি খোঁজও নিতে পারি না তুই কোথায় যাস কী করিস। আর কোথাও যাবি না।

আচ্ছা।

আমার গা ছুঁয়ে বল কোথাও যাবি না।

খোকন মাথা নিচু করে বসে রইল।

আয় না বাবা, আয়।

খোকন এগিয়ে যেতেই মা তার হাত ধরে ফেললেন। খোকনের কেন জানি খুব লজ্জা করতে লাগল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ