লোকটার নাম কামাল।

কামালউদ্দিন। বয়স সাঁইত্রিশ। তবে কানের কাছের সব চুল পেকে যাওয়ায় বয়স খানিকটা বেশিই দেখায়। ঠিক রোগা তাকে বলা যাবে না, তবে কেন জানি রোগা দেখায়। মুখটা গোলগাল। ভালোমানুষি ভাব অনেক কষ্ট করে আনে। নিজের ঘরে যা তাকে করতে হয় না। আজ অবশ্যি কামালের চেহারায় ভালোমানুষি ভাবটা নেই। সকালে দাড়ি কামানো হয় নি। খোঁচা-খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি বের হয়ে পড়েছে। চোখটাও যন্ত্ৰণা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর পানি পড়ছে। রুমালটাও সঙ্গে আনা হয় নি। তাকে শার্টের হাতায় চোখ মুছতে হচ্ছে। খুবই বিরক্তির ব্যাপার।

কামালউদ্দিন যে কাজে নারায়ণগঞ্জে গিয়েছিল কাজটা পাওয়া গেছে। তবে ঝামেলা আছে। তাদড় পার্টি। পানিতে না নেমে মাছ ধরতে চায়। কামাল বড়ই বিরক্ত হচ্ছে। তবে এই বিরক্তি সে প্রকাশ করছে না। তার সামনে বসে আছে সুলতান সাহেব। চেহারা ভালোমানুষের মতো। কথাবার্তার ভঙ্গিও বড় মধুর। কথা শুনলে মনে হয় শান্তিনিকেতন থেকে কথা শিখে এসেছে। অথচ বাড়ি হচ্ছে কুমিল্লায়। বিরাট ফক্কড় লোক।

কামাল বলল, কথাবার্তা যা বলার দরকার তা তো বলেই ফেললাম এখন তা হলে উঠি ভাইসাব? অনুমতি যদি দেন।

আরে বুসন না। আরেকটু বসুন। লাচ্ছি খান। লাচ্ছি আনতে গেছে।

লাচ্ছি খেলে তো আমার হবে না—আমার তো আরো কাজকর্ম আছে।

এখানেও কাজকর্মই তো করছেন—তাই না।

করছি আর কোথায়। কথাবার্তা বলছি। এত কথা আমার ভালো লাগে না। দরে বনলে কাজ করবেন, না বলে না।

সুলতান সাহেব বললেন, সামান্য কাজ এত টাকা চাচ্ছেন।

কামাল শান্ত গলায় বলল, কাজটা সামান্য না। এটা আমিও জানি, আপনিও জানেন। দলিল তৈরি করে দিব। সেই দলিল হবে আসল দলিলের বাবা। কোর্টে গেলে আমার দলিল টিকবে। আসলটা টিকবে না। এই জন্যে টাকা খরচ করবেন না? পঞ্চাশ লাখ টাকার সম্পত্তি পাবেন আর এক লাখ টাকা খরচ করবেন না?

সুলতান সাহেব বললেন, আপনাকে ত্রিশ দিতে পারি তবে জিনিস দেখার পরে, তার আগে না। দেখেন আপনি রাজি আছেন কি-না।

কামাল গম্ভীর হয়ে রইল। লাচ্ছি চলে এসেছে। সে বিনা বাক্য ব্যয়ে একটানে লাচ্ছি শেষ করে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলল, উঠি তা হলে ভাইসাব-স্লামালিকুম।

উঠি মানে? হ্যাঁ-না কিছু বলেন।

আমি ভাইসাব এককথার মানুষ। এক লাখ চেয়েছি এক লাখ দেবেন। পুরানো স্ট্যাম্প জোগাড় করে নিব, কলম দিয়ে লেখলেই দলিল হয় না। রেকর্ড রুমের রেকর্ড ঠিক করা লাগে। খাজনার রসিদ লাগে। মিউটেশনের কাগজপত্র লাগে। আমার কাজকর্ম আপনে জানেন না, তাই মাছের দর শুরু করেছেন। নকল দলিল এক হাজার টাকা দিলে করা যায়, কিন্তু ঐ জিনিস কোর্টে গেলে জজ সাহেব ঐ দলিলে নাকের সর্দি ঝাড়বে, বুঝলেন?

কামাল উঠে পড়ল। এটা হচ্ছে তাদড় পার্টি। এখানে লাভ হবে না। খালি খেলাবে। গোসল করতে চায় অথচ চুল ভিজাতে চায় না। হারামজাদা।

সুলতান নড়েচড়ে বসলেন। মুধর স্বরে ডাকলেন, কামাল সাহেব।

কি-বলেন।

সামনের সপ্তাহে কি আরেক বার আসতে পারেন?

কেন?

না মানে, আরো ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভেবে দেখতাম।

গরম যা পড়েছে তার মধ্যে তো মাথা আর ঠাণ্ডা যাবে না। যত চিন্তা করবেন মাথা তত গরম হবে।

সুলতান সাহেব বললেন, প্লিজ আপনি সামনের সপ্তাহে এক বার আসুন। আমার বড় শ্যালকও থাকবে। সে হচ্ছে এক জন ল ইয়ার। আইনের ব্যাপারগুলো ভালো বুঝবে। আপনি আসুন। আমি আসা-যাওয়ার খরচ দিয়ে দিচ্ছি।

সুলতান সাহেব মানিব্যাগ খুলে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করলেন। কামাল মনে মনে বলল, শুয়োরের বাচ্চা, আসা-যাওয়ার খরচ পঞ্চাশ টাকা? মুখে বলল, এই পঞ্চাশ টাকা আপনি রেখেই দেন ভাইসাব। পঞ্চাশ-এক শ আমি নেই না। ডেইলি পঞ্চাশ টাকা আমি ভিক্ষাই দিই। পাপ কাজ করি তো, দান-খয়রাত করতে হয়। উঠলাম ভাই, স্লামালিকুম।

দাঁড়ান, দাঁড়ান—একটু দাঁড়ান। এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন?

সুলতান সাহেব ভেতরে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পাঁচ শ টাকার একটা নোট নিয়ে এসে অমায়িক গলায় বললেন, এই নিন আপনার খরচ। সামনের সপ্তাহে আসুন, দেখি একটা এগ্রিমেন্টে যাওয়া যায় কি-না। এইসব কথা কি লাখ কথার কমে হয়?

হবার হলে এক কথাতেই হয় না হলে লাখ কথাতেও হয় না। আমি আসব সামনের সপ্তাহে। সন্ধ্যা নাগাদ আসব। বুধবার সন্ধ্যা।

আচ্ছা।

কামাল ঘর থেকে মোটামুটি খুশি হয়েই বের হল। তাদড় পার্টির কাছ থেকে পাঁচ শ টাকা বের করা গেছে এই যথেষ্ট। এই পার্টির ত্রিসীমানায় সে আর আসবে না। আসার দরকার নেই। এই পার্টির কাছ থেকে আর কিছু পাওয়া যাবে না। ঢাকার বাসে উঠে সে পাঁচ শ টাকার নোটটা চোখের সামনে মেলল। ছেড়া নোট। স্কচ টেপ দিয়ে মেরামত করা। মনে মনে বলল, হারামজাদা। দুনিয়া সুদ্ধ লোক ঠকাতে চাস। ব্যাটা ফকিরের পোলা।

ফকিরের পোলা হচ্ছে কামালের একটা প্রিয় গালি। তবে এই গালি সে সবসময় মনে মনে দেয়। মনে মনে গালি দিতে পারার সুযোগ থাকায় সে আনন্দ বোধ করে। তার ধারণা মনে মনে গালাগালি দেবার সুযোগ না থাকলে বিরাট সমস্যা হত। গাল দিলেই রাগ বাষ্প হয়ে যায়। কামাল আবার বলল, হারামজাদা ফকিরের পোলা।

কামালের কাজকর্ম খুব পরিষ্কার। সে কখনো বেশি ঝামেলায় যায় না। নকল দলিলের কথাবার্তা পাকা করে। বেশ কিছু দলিলেন নমুনা দেখায় তারপর সটকে পড়ে। দিন পনের পর যখন পার্টি মোটামুটি নিশ্চিত যে, সে সটকে পড়েছে তখন হঠাৎ উদয়। হয়। মুখ-চোখ কালো করে বলে, বিরাট সমস্যা ভাই সাব। পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন ছিলাম হাজতে। জামিনে ছাড়া পেয়েছি। পার্টি এইকথা ঠিক বিশ্বাস করে না। সে বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপর একটা কালো দাগ দেখিয়ে বলে, এই দেখেন ভাই অবস্থা। মারের নমুনা দেখেন।

হাতের এই দাগটা কামালের জন্মদাগ। তবে মারের কারণে কালো হয়ে যাওয়া দাগ হিসেবে একে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়। কামাল গম্ভীর গলায় বলে, কার কি কাজ করছি এটা জানার জন্যে পুলিশ হেভি চাপ দিল। আপনাদের কথা অবশ্য কিছু বলি নাই।

পার্টি এই কথায় একটু সচকিত হয়। নড়েচড়ে বস। তখন কামাল বলে, আপনাদের জানাশোনার মধ্যে পুলিশের বড় কেউ আছে? বিরাট বিপদে পড়েছি ভাইসাব।

এই পর্যায়ে কামালের চোখে পানি এসে যায়, চোখে পানি আনার ক্ষমতা কামালের অসাধারণ। অতি অল্পসময়ে সে তা পারে। তার জন্যে যা করতে হয় তা হচ্ছে চোখের পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। এতেই কাজ হয়। চোখে পানি আসে। তার চোখে একটা সমস্যা আছে। ছোটবেলায় চোট পেয়েছিল। এর জন্যে হয়তো চোখে পানি আসে খুব তাড়াতাড়ি।

মানুষ সবকিছুকেই অবিশ্বাস করে। চোখের পানিকে করে না। ভাগ্যিস করে না। যদি করত তা হলে কামালের মতো মানুষদের খুব অসুবিধা হত।

 

দলিল তৈরি কামালের মূল ব্যবসা নয়। তার মূল ব্যবসা জমি বেচা-কেনা। একদল লোক বিদেশে চাকরি করতে যাওয়ায় এই ব্যবসা খুব রমরমা হয়েছে। কিছু মানুষের হাতে কাঁচা টাকা-পয়সা এসেছে যাদের হাতে কোনো কালেই কোনো পয়সাকড়ি ছিল না। হঠাৎ পাওয়া ধন তারা কি করবে বুঝতে পারে না তখন জমির টোপ ফেলতে হয়। এগুতে হয় খুব সাবধানে। এইসব ধনীরা সাধারণত খুব সন্দেহপরায়ণ হয়। কোনকিছুই তারা বিশ্বাস করে না। সবকিছুতেই অবিশ্বাস। পাকা দলিল দেখেও বলে—দলিলটা তো নকল। তাদের ঘায়েল করতে হয় তাদের নিজেদের অস্ত্রে। যেমন গত মাসে কামাল একটা কেইস করল পার্টির বাসা নূরজাহান রোডে। ছোট ভাই কাজ করছে বিদেশে। টাকাপয়সা ভালোই পাঠাচ্ছে। খোঁজ-খবর আগে থেকে ভালোমলতা নিয়ে কামাল উপস্থিত হলহাতে ব্রিফকেস। চোখে চশমা।

বড় ভাই দরজা খুলে খুবই সন্দেহজনকভাবে তাকাতে লাগল। কামাল বলল, ভাই, আমার নাম কামাল। শুনলাম জমি কিনতে চান, সেই জন্যে আসলাম।

বড় ভাই মুখ লম্বা করে দিয়ে বলল, কার কাছে শুনলেন?

সেটা দিয়ে তো ভাই আপনার দরকার নাই। কিনবেন কি কিনবেন না সেটা দিয়ে। হচ্ছে কথা। যদি বলেন না, তা হলে বিরক্ত করব না। চলে যাব। যদি বলেন হ্যাঁ, তা হলে বসব। কথা হবে।

সন্দেহপ্রবণ লোকেরা সোজাসুজি কথায় সাধারণত একটু ঘাবড়ে যায়। কারণ এরা সারা জীবনেও সোজাসুজি কথা বলে না।

বড় ভাই বললেন, জমি কোথায়?

সারা ঢাকা শহর জুড়ে আমার জমি নাই। এক জায়গাতেই আছে। তিন বিঘা জমি আছে। জায়গাটা হচ্ছে সাভার। জায়গার নাম নয়নপুর।

এত দূর জমি কিনব না।

ঠিক আছে। না কিনলে কি আর করা, নেন ভাই একটা সিগারেট নেন। কামাল সস্তা ধরনের একটা সিগারেট বের করল। সন্দেহপ্রবণ লোকদের দামি সিগারেট দেওয়া যায় না। দামি সিগারেট দিলেই ভাবে কোন একটা মতলবে এসেছে।

বড় ভাই সিগারেট নেন। নেবেন জানা কথা। বিনা পয়সার কোনো জিনিস এরা ছাড়ে না। কামাল নিজের মনেই বলে সবাই জমি কিনতে চায় ঢাকা শহরে। দূরে কেউ যাবে না। ঢাকা শহরে কি জমি আছে যে কিনবে? বিনা ঝামেলায় একটা প্লট কেউ বার করুক ঢাকা শহরে। যদি বার করতে পারে আমি কান কেটে ফেলে দিব। জমি কিনার পর মিউটেশান করতে গেলে দেখা যায় আরেক পার্টির কাছে জমি বিক্রি করা। এর পর বের হয় থার্ড পার্টি। এই থার্ড পার্টি জমি দখল করে বসে থাকে। মামলা ঠুকে দেয়। রাইট অব পজেশান। এইসব দেওয়ানি মামলার অবস্থা জানেন? দেওয়ানি মামলা হল আপনার কচ্ছপের কামড়। এক বার ধরলে আর ছাড়ে না। পনের বছর, বিশ বছর, পঁচিশ বছর মামলা চলতে থাকে।

আচ্ছা ভাই যাই। অনেক বিরক্ত করলাম।

বসেন একটু। রোদের মধ্যে এসেছেন। এক কাপ চা খান।

কামাল সঙ্গে-সঙ্গে বলে, তা খাওয়া যায়। চা পেলে বড় ভালো হয়। চা আসে। কামাল বলে, একটা ভালো সিগারেট খাবেন ভাই সাব? নিজের জন্যে কিছু ভালো সিগারেট আলাদা রাখি। কোনো শালাকে দেই না। নিন একটা খান।

বড় ভাই সিগারেট ধরান। এর মধ্যে লোটার প্রতি তাঁর সন্দেহ খানিকটা কমে এসেছে। তিনি মনে করতে শুরু করেছেন—লোকটা ভালো, এককথার মানুষ। কামাল বলে, একসময় ধানমণ্ডির জমি কেউ কিনতে চাইত না। চোখ আসমানে তুলে বলত, সর্বনাশ! এত দুরে জমি কিনে কি করব? জংলা জায়গা! আর আজ সেই জংলা জায়গার অবস্থা দেখেন।

ঠিক বলেছেন।

সাভারেও লোকজন এখন জমি কিনতে চায় না। বলে জংলা জমি। আমি হাসি। আর মনে-মনে বলি-ব্যাটা দশটা বছর যাক তার পর তোর মুখখান এক বার এসে দেখে যাব।

বড় ভাই বলেন, সাভারের জমি কি আপনার?

পাগল হয়েছেন? আমি জমি পাব কোথায়? আমি একজন পথের ফকির। জমি আমার বড় মামার। আমাকে বলেছে বিক্রি করে দিতে। আমার হয়েছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। ঐ জমি বিক্রি হবে না। বেহুদা পরিশ্রম।

বিক্রি হবে না কেন?

তিন বিঘা জমি পুরোটা এক জনের কাছে বেচতে চায়। কার দরকার পড়েছে। একসঙ্গে এতটা জমি কেনার? ভাই উঠি দেরি হয়ে গেছে। চা-টা ভালো বানিয়েছেন।

আরে বসেন না। আরেক কাপ চা খান। অসুবিধা কি? খান আরেক কাপ চা।

কামাল বসে। আরাম করেই বসে। পার্টি টোপ গিলে ফেলেছে। এখন শুধু সুতা ছাড়তে হবে। সুতা ছাড়তে তার বড় ভালো লাগে। সুতা ছেড়ে মাছ সবসময় ঘরে তোলা যায় না। সুতা ছিঁড়ে যায়। তবে এই মাছ সে তুলেছিল। অবিশ্বাসী লোক যখন কাউকে বিশ্বাস করে তখন পুরোপুরিই করে। এই লোক করেছিল। ইচ্ছা করলে লোকটাকে সে পথের ফকির করতে পারত। তা সে করে নি। মায়া লাগল। বায়নার পঁচিশ হাজার টাকা নিয়েই ছেড়ে দিল। মনে মনে বলল, ব্যাটা ফকিরের পোলা, তোক মাফ করে দিলাম।

 

বাসায় ফিরতে ফিরতে তিনটা বেজে গেল। দরজা খুলল মিলু। কামাল সার্ট খুলতে-খুলতে অভ্যাসমতো ডাকল, সোমা, ও সোমা। ঢাকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ল সোমা নেই। মিনু দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। তাঁর চোখে কৌতূহলের সঙ্গে খানিকটা ভয়ও মিশে আছে। মানুষটিকে সে বেশ ভয় করে। লোকটাকে তার পাগলা পাগলা মনে হয়। জ্বর কমেছে না-কি রে মিনু?

হ।

রান্নাবান্না করেছিস কিছু?

হ।

আরে যন্ত্রণা, সবকথা এক অক্ষরে বলছিস কেন? চড় খাবিবুঝলি। ঠাশ করে একটা চড় দিব। কী বেঁধেছিস?

ভাত।

ভাত ছাড়া আর কী?

আর কিছু না।

ফকিরের মাইয়া বলে কী? শুধু ভাত খাব কীভাবে?

আর কিছু রানতে জানি না।

এর ওপরে কোনো কথা চলে না। রাঁধতে না জানলে সে করবে কী? কামাল বলল, শুকনো মরিচ ভেঙ্গে ফেল। পেঁয়াজ আর শুকনো মরিচের ভর্তা বানিয়ে খাওয়া যাবে। মরিচের ভর্তা ঠিকমতো বানাতে পারলে কোপ্তা-কালিয়ার মতো টেস্ট হয়। ঘরে সরিষার তেল আছে তো? সরিষার তেল দিয়ে হেভি ডলা দিতে হবে।

বিড়ালটা পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছে। আহ্লাদ করছে। কামাল নিচু হয়ে বিড়ালটাকে খানিকক্ষণ আদর করল। আদর খেয়ে সে একেবারে চলে যাচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি। আদর সবাই বোঝে। শুধু মানুষ ববাঝে না। মানুষ হচ্ছে বিচিত্র চিড়িয়া। সে আদর সোহাগ বোঝ না। রাগটা বোঝে। ঘৃণা বোঝে। শালার মানুষ।

মিনু।

জ্বি।

বেড়ালটারে দুধ দিয়েছিলি?

না। না কি রে হারামজাদী—এমন চড় দেব……

দুধ কেমনে বানাইতে হয় জানি না।

কামাল রাগ সামলে নিল। যে দুধ বানাতেই জানে না তাকে দুধ না বানানোর জন্যে চড় দেওয়া যায় না। সোমা এই মেয়েটাকে দেখি কিছুই শেখায় নি। অকৰ্মার ধাড়ি করে রেখেছে।

ও মিনু।

জ্বি।

খাওয়াদাওয়ার পর দুধ বানানো শিখিয়ে দিব-বুঝলি। খুব সোজা। বিড়ালটাকে রোজ দুধ দিবি। পেটে বাচ্চা আছে। এই সময় ভালোমল খাওয়ার দরকার। আর খবরদার লাথিফাথি দিবি না। বাচ্চার ক্ষতি হবে। যা ভাত বাড়। শুকনো মরিচ ভাজ। পুড়িয়ে আবার কালো করে ফেলিস না। কালো যদি হয় এক থাবড়া খাবি।

সাবান গামছা নিয়ে কামাল বাথরুমে ঢুকে পড়ল। বাথরুমে ঢুকেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি সুন্দর সাজানো বাথরুম। ঝক ঝক করছে। এককণা ময়লা কোথাও নেই। অপরিষ্কার বাথরুম ছিল সোমার দু চোখের বিষ। সোমার মতে বাথরুম এমন হবে যেন ঢুকলেই মনের মধ্যে একটা পবিত্র ভাব হয়। এই মেয়ের কথাবার্তার কোন মা-বাপ নেই। পরিষ্কার বাতিক। এত পরিষ্কার দিয়ে হয় কি? দুনিয়াটাই অপরিষ্কার। এর মধ্যে পরিষ্কার পরিষ্কার করে চেঁচালে কি হবে? কিছুই হবে না। আজ এই বাথরুম ঝক ঝক করছে। সাত দিন পরে করবে না। তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। কোনকিছুই আটকে থাকে না। কামাল গায়ে পানি ঢালতে লাগল। ঠাণ্ডা পানি গায়ে ঢালতে বড় আরাম লাগছে। ঘুম এসে যাচ্ছে। সে গুন গুন করে একটা সুর ভাঁজল। তার বেশ ভালো লাগছে।

কামাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুল। ঘুম ভাঙার পর ডাকল, সোমা, ও সোমা। এক দিনে দ্বিতীয় বার ভুল। মেজাজ খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। মেজাজ কিছুটা খারাপই হল। যে গেছে সে গেছে—এখন ডাকাডাকি করে হবেটা কী? কিছুই হবে না। মানিয়ে নিতে হয়। সব অবস্থায় সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাই হচ্ছে বড় কথা।

মিনু।

জ্বি।

চা বানা দেখি।

চা রানতে জানি না।

অতি উত্তম। হারামজাদী, তুই জানিস কি? ফ্লাস্ক নিয়ে যা মোড়ের দোকান। থেকে চা নিয়ে আয়। বিড়ালকে দুধ দিয়েছিলি?

হ।

গুড। দু বেলা দুধ দিবি সকালে এক বার, রাতে এক বার। যা চা নিয়ে আয়।

কামাল বিছানা ছেড়ে নামল। হাতমুখ ধুয়ে সিগারেট ধরাল। তার মনে হল সোমার অভাব সে যতটা বোধ করবে ভেবেছিল তার চেয়ে অল্প একটু বেশি বোধ করছে। এর কারণ সে ঠিক ধরতে পারছে না। তার হিসাবে ভুল খুব একটা হয় না। এখানে ভুল হল কেন?

মিন ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছে। হোটেলের চা বিম্বাদ হলেও এর আলাদা একটা স্বাদ আছে। এই স্বাদে আবার অভ্যস্ত হয়ে যেতে হবে। সেটা মন্দ কি। স্বাধীন জীবনের আলাদা আনন্দ আছে। চা খেতে খেতে কামালের মনে হল—শুধু স্বাধীন জীবন না, সবধরনের জীবনেরই আলাদা আনন্দ আছে। যে তের মাস সে জেল খাটল সেই তের মাস সময়টাও তার খুব একটা খারাপ কাটে নি। জেলে তার সঙ্গীরা মানুষ হিসেবে খারাপ ছিল না। যথেষ্ট বুদ্ধিমান। শুধু বুদ্ধিমান নারসিকও ছিল। এদের এক জন বিনয় পোদ্দার। বার বছরের কয়েদ হয়েছিল। কি অসম্ভব রসিক মানুষ। তার আশেপাশে থাকাই একটা আনন্দের ব্যাপার। এক বার জেলখানায় ইম্প্রভ ডায়েট হল ঈদ উপলক্ষে। পোলাও, গোস্ত আর একটা করে চপ। চপ মুখে দিয়েই সবাই থুথু করে ফেলে দিল। বাসি চপ। গরমে টক হয়ে গেছে। বিনয় পোদ্দার বলল, বাসি চপের গল্প শুনবে নাকি হে তোমরা। সবাই হৈ হৈ করে উঠল, বলেন, বলেন।

এক বার এক হোটেলে গেছি। চপের অর্ডার দিয়েছি। চপ আসল। মুখে দিয়ে দেখি, সর্বনাশবাসি মানে, পচে যাওয়া মাল। মেজাজ গেল গরম হয়ে। বেয়ারাকে বললাম, ডাক তোমার ম্যানেজারকে। এই পচা চপ খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। বেয়ারা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, আপনি নিজেই যে জিনিস খেতে রাজি না ম্যানেজারবাবু সেটা কি করে খাবেন বলুন।

আহ কি গল্প। আর কি গল্প বলার ভঙ্গি। কামাল বিমর্ষ বোধ করছে। সন্ধ্যা সময়টা আসলেই খারাপ। মন ভার ভার হয়ে থাকে। সন্ধ্যায় এই জন্যে ঘরে থাকতে নেই।

মিনু!

জ্বি।

আমি এখন বেরুব বুঝলি। ফিরতে রাত হবে। একা একা ভয় লাগবে?

হুঁ।

তা হলে কী করা যায় বলত?

আফা আসবে না?

না। ঐ সম্পর্ক শেষ। এখন তুই কী করবি চিন্তা করে দেখ। তোর খালার কাছে যাবি? তোর খালা থাকে না কলতাবাজার। যাবি সেখানে?

না।

যাবি না কেন?

খালা খাওন দেয় না।

এ তো দেখি আরেক যন্ত্রণা। তোকে কোলে নিয়ে আমি ঘুরব না-কি?

মিনু হেসে ফেলল। সঙ্গে-সঙ্গে হাসি লুকাবার জন্যে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এই লোকের সামনে হাসতে বড় ভয় লাগে।

কামাল মিনু-সমস্যার কয়েকটা সমাধান বের করল—ঘরে তালা দিয়ে মিনুকে ঘরের বাইরে বসিয়ে রেখে চলে যাওয়া। দুই, মিনুকে চায়ের দোকানে রেখে যাওয়া। ফেরার পথে উঠিয়ে নেওয়া। মিনুর হাতে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে তাকে তার কলতাবাজারে খালার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া। কোনো সমাধানই তার মনে ধরল না। মুখ অন্ধকার করে একের পর এক সিগারেট টেনে যেতে লাগল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ