টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ মেঘে ঢাকা। মেঘের রঙ ক্রমেই কালো হচ্ছে। মনে হচ্ছে সারা দিনই বৃষ্টি হবে। পর্দা ঢাকা রিকশা, তবু সোমা অনেকখানি ভিজে গেছে। খুব বিরক্ত লাগছে। ভেজা শাড়ি গায়ে লেপ্টে থাকবে আর সে নামবে রিকশা থেকে।

রাস্তা ভালো নাখানাখন্দ। একেক বার এমন ঝাঁকুনি খাচ্ছে মনে হচ্ছে সোমা উলটে পড়ে যাবে। সে কড়া গলায় বলল, আস্তে চালান না ভাই। মেয়েরা আস্তে চালাতে বললে রিকশাওয়ালারা সাধারণত খুব দ্রুত চালাতে শুরু করে। এখানেও তাই হল রিকশা চলল ঝড়ের গতিতে। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে সবকিছু নিয়ে রিকশা উলটে পড়বে। দ্বিতীয় বার রিকশাওয়ালাকে আস্তে চালানোর অনুরোধ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। হোক একটা অ্যাকসিডেন্ট। সোমার ভাগ্যে অ্যাকসিডেন্ট যোগ আছে। ওর পঁচিশ বছরের জীবনে তিন বার সে রিকশা নিয়ে উলটে পড়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার কোনো বারই তার নিজের কিছু হয় নি। গায়ে সামান্য আচড়ও লাগে নি। অথচ রিকশাওয়ালা প্রতি বারই জখম হয়েছে। এক বার তো এক জন একেবারে মর মর। হাসপাতালে ছিল অনেক দিন। সোমা দুবার দেখতে গিয়েছে। রিকশাওয়ালার স্ত্রী খাটের কাছে বসে থাকত। সোমাকে দেখলেই বাঘিনীর মতো তাকাত, যেন সমস্ত দোষ সোমার।

আফা কোন বাড়ি?

পরের গলিটা দিয়ে ঢেকেন। সাবধানে যাবেন রাস্তা ভাঙা।

ভাঙা রাস্তায় সাবধানে গাড়ি চালাইলে অ্যাকসিডেন্ট বেশি হয় আফা।

বেশ তা হলে অসাবধান হয়েই চালান।

ঝিকাতলার এই বাড়ির অর্ধেক সোমাদের। সোমার দাদা গ্রামের সমস্ত জমিজমা বিক্রি করে ঢাকা শহরে দুতলা বাড়ি করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর দুই ছেলে বাড়ি পেয়ে গেল। দুজনেই মোটামুটিভাবে অপদার্থ। সোমার বাবা সাইফুদ্দিন সাহেব এল এম এফ ডাক্তার। দীর্ঘ দিনেও তাঁর কোনো পসার হল না। সারা দিন ডিসপেনসারিতে বসে থাকেন, একটা রুগী আসে না। এক ডিসপেনসারির মালিক তো এক দিন বলেই বসল, আপনি ভাই অপয়া মানুষ। অন্য কোথাও গিয়ে বসেন। ডাক্তারের কাছে রুগী না এলে ওষুধপত্র বিক্রি হয় না। বুঝলেন না?

সোমার বড় চাচা ছদরুদ্দিন সাহেবও একই পদের মানুষ। তাঁর কাজ হচ্ছে টীকা ফাটকা ব্যবসা করা এবং বড় বড় কথা বলা। গা জ্বলে যাবার মতো কথা। তাঁর কথা যেই শোনে তারই গা জ্বলে যায়—তিনি বিমলানন্দ উপভোগ করেন।

বাড়ির একতলা পেল সোমারা, দোতলা পেলেন ছদরুদ্দিন সাহেব। ছদরুদ্দিন সাহেবের ধারণা তিনি ক্যাপিটালের অভাবে বড়কিছু করতে পারছেন না। একটা বড় রকমের ক্যাপিটাল পেলেই ভেলকি দেখিয়ে দেবেন। ভেলকি দেখাবার আশাতে তিনি তাঁর নিজের অংশ বিক্রি করে দিলেন। ছোট ভাইকে বললেন, এক মাসের মামলা, এক মাসের মধ্যে দুতলা কিনে নেব। টাকা কিছু বেশি দিতে হবে। উপায় কি। এই এক মাস তোর সঙ্গে থাকব। তবে মাগনা থাকব মনে করি না। পুরো রেন্ট পাবি। হা-হা-হা। নিজের ভাই বলে যে বাড়তি সুযোগ নেব, আমি এই রকম মানুষই না।

এক মাসের জন্যে এসেছিলেন এখন দশ বছর হয়েছে। এক তলার অর্ধেকটা ছদরুদ্দিন সাহেবের দখলে। এখনো তিনি টুটকা ফাটকা ব্যবসা করেন। এবংসারাক্ষণই আক্ষেপ করেন যে, ক্যাপিটালের অভাবে কিছু করতে পারছেন না। বছর দুই ধরে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর মুখ দেখাদেখি বন্ধ—শুধু ছোট ভাই নয়, ছোট ভাইয়ের পরিবারের কারোর সঙ্গেই তিনি কথা বলেন না। কয়েক দিন আগে প্রথম নাতনির জন্ম হল—এ বাড়ির কাউকে বলা হয় নি।

সোমা রিকশা থেকে নেমেই তার বড় চাচার মুখোমুখি হয়ে গেল। ছদরুদ্দিন সাহেব ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ির সামনের কড়ই গাছটার নিচে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সামনে দড়ি হাতে একটা শুকনো ধরনের লোক। লোকটার সঙ্গে নিচু গলায় কি সব কথাবার্তা হচ্ছে। সোমা স্যুটকেস হাতে এগিয়ে গেল। বড় চাচার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, কেমন আছেন চাচা?

ভালো আছি। তুই কোত্থেকে?

সোমা তার জবাব না দিয়ে চাচার পা ছুঁয়ে সালাম করল। ছদরুদ্দিন প্রসন্ন গলায় বললেন, বাড়িতে আসলেই সালাম করতে হবে না-কি? যা যা ভেতরে যা।

আপনি এই বৃষ্টির মধ্যে কি করছেন?

গাছ কাটাচ্ছি। আট হাজার টাকায় এই গাছ বেচলাম।

গাছের দাম এত?

মানুষের চেয়ে গাছের দাম বেশিরে মা। এমনও গাছ আছে যার দাম লাখ টাকা। লাখ টাকা দামের মানুষ কটা আছে বল দেখিঃ হাতে গোনা যায়। যা ভেতরে যা।

সোমা দরজায় কড়া নাড়ল। ভেতর থেকে ঊর্মি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কে? যেন ধমক দিচ্ছে। সতের আঠার বছরের কোনো মেয়ে এরকম ধমকের গলায় কথা বলে না-কি? সোমা নরম গলায় বলল, ঊর্মি, দরজা খোল। আমি।

ঊর্মি দরজা খুলল, খুশি-খুশি গলায় বলল, আপা তুমি চলে এসেছ। বাবা আর বিজু ভাইয়া এই কিছুক্ষণ আগে তোমাকে আনতে গেল। বিজু ভাইয়া তোমার জন্যে একটা জিপ জোগাড় করেছে।

আমি বুঝি জিপ ছাড়া চলাফেরা করি না?

জিনিসপত্র থাকবে সঙ্গে এই জন্যে।

জিনিসপত্র থাকবে কেন? জিনিসপত্র আমি পাব কোথায়? জিপ যাবে জানলে অবশ্যি ফুলের টব দুটো নিয়ে আসতাম। মা কই রে?

রান্নাঘরে নাশতা বানাচ্ছে। এখনো কারো নাশতা হয় নি। তুমি এলে একসঙ্গে হবে।

একটা শুকনো গামছা দে তো গোসল করব। ঘরে গায়ে-মাখা সাবান আছে?

জানি না। থাকলে বাথরুমে আছে। তবে খুব সম্ভব নেই। এ-বাড়ির নিয়ম হল যখন যে জিনিস চাইবে সে জিনিস থাকবে না।

সোমার মা এককালে খুব রূপবতী ছিলেন। তাঁর কিছুটা এখনো অবশিষ্ট আছে। এককালে শান্ত এবং মৃদুভাষী ছিলেন, এখন তার কিছুই নেই। অল্পতেই রেগে যান। রেগে গেলে অনর্গল কথা বলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে কাজের ছেলেটি মার খায়। সহজ মার না, হিংস্র ধরনের মার। এক কালের শান্ত, মৃদুভাষী এবং রূপবতী এক জন। মহিলা যে এতটা হিংস্র হতে পারেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

হিংস্রতার পর্ব কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়েছে। খুন্তির হাতল দিয়ে মনের সুখে কাজের ছেলেটিকে পিটিয়ে এখন তিনি খানিকটা ক্লান্ত। কাজের ছেলেটির বয়স নয়-দশ। নাম মুরাদ। তার ব্যথা-বোধ তেমন তীব্র নয় বলে মনে হচ্ছে। খুন্তির হাতার দাগ তার সারা গায়ে কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। কানের পাশ দিয়ে রক্ত পড়ছে। সে মোটামুটি নির্বিকার ভঙ্গিতেই রুটি বেলছে। মাঝে-মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছে। জাহানারা খুন্তি উঠিয়ে বলছেন, খবরদার-শব্দ করলে মেরে ফেলব।

ঊর্মি রান্নাঘরে ঢুকে হাসিমুখে বলল, বড় আপা একা-একা চলে এসেছে।

জাহানারা বিরস গলায় বললেন, কান্নাকাটি করছে না-কি?

না।

এখানে আসতে বল। গোসল করছে।

এসেই গোসল, বালতির পানি সব শেষ না করে তা রেরুবে না। বলে দে, পানি যেন সাবধানে খরচ করে।

থাক মা কিছু বলার দরকার নেই। মুরাদকে মেরেছ নাকি?

জাহানারা কিছু বললেন না।

ইস কি অবস্থা করেছ। কান দিয়ে রক্ত পড়ছে তো মা।

জাহানারা তিক্ত গলায় বললেন, যা তুই কোলে নিয়ে আদর কর।

ঊর্মি আর কিছু বলল না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাথরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। নরম গলায় ডাকল, আপা।

কি রে?

সাবান পেয়েছ?

হুঁ।

পানি কিন্তু সাবধানে খরচ করতে হবে। পানির খুব টানাটানি।

আগে বললি না কেন? শেষ করে ফেলেছি তো।

শেষ করলে করেছ।

সোমা মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে বের হয়ে এল। রাতের অঘুমের ক্লান্তি মুছে গেছে। তার সারা মুখে একটা স্নিগ্ধ ভাব।

ঊর্মি হাসিমুখে বলল, তুমি আর একটু ফর্সা হলে খুব সুন্দর লাগত।

এখন অসুন্দর লাগে?

না, এখনো সুন্দর।

বিজুরা এখনো ফেরে নি?

না–যত দেরিতে ফেরে ততই ভালো। কেন?

ফিরলেই প্রচণ্ড হৈচৈ শুরু হবে। বড় চাচা কাউকে কিছু না বলে চার হাজার টাকায় গাছ বিক্রি করে দিয়েছেন।

চার হাজার? আমাকে তো বললেন, আট হাজার।

একেক জনের কাছে একেক কথা বলছেন। কোনটা সত্যি কে জানে। গাছ কাটার লোকও চলে এসেছে। বিজু ভাইয়া বলেছে গাছে হাত দিলে খুনখুনি হয়ে যাবে।

বিশ্রী ব্যাপার দেখি।

কি যে বিশ্রী–কল্পনা করতে পারবে না। রোজ ঝগড়া। জঘন্য সব গালাগালি। বড় চাচা ঐ দিন বলে গেল গুণ্ডা দিয়ে বিজু ভাইয়ার চোখ উপড়ে নেবে।

সে কি?

চল আপা, রান্নাঘরে চল। রান্নাঘরে গেলেও তোমার খারাপ লাগবে। মা যা মারা মেরেছেন। খবরদার, আবার ঐ নিয়ে কথা বলতে যেও না। কিছু বললেই মা…….

ঊর্মি কথা শেষ করল না। কারণ জাহানারা এক কাপ চা হাতে ঘরে ঢুকেছেন। সোমা নিচু হয়ে সালাম করল। জাহানারা বললেন, সালাম কেন আবার? নে চা নে। নাশতা খেয়ে এসেছিস?

না।

বিজুরা আসুক। একসঙ্গে নাশতা দেব। তোর জিনিসপত্র কোথায়?

ঐ স্যুটকেস। জিনিসপত্র আর কিছু নেই।

আনতে দেয় নি?

নিজেই আনি নি।

ব্যবহারী জিনিসগুলো তো আনতে পারতি। আবার তো টাকা খরচ করে কিনতে হবে। হাতের বালাগুলো কোথায়?

রেখে এসেছি।

রেখে এলি কেন?

আমার আনতে ইচ্ছা করল না।

জিপের শব্দ শোনা গেল। ঊর্মি চলে গেল দরজা খুলে দেবার জন্যে। জাহানারা মেয়েকে হাত বাড়িয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করলেন। এই মেয়েটি তাঁর বড় আদরের। জাহানারার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে।

সোমা মৃদু স্বরে বলল, চা গায়ে পড়ে গেছে মা। হাত আলগা কর। জাহানারা হাত আলগা করলেন না। সোমা ভেবে রেখেছিল, এ-বাড়িতে এসে সে কিছুতেই কাঁদবে না। কঠিন পাথর হয়ে থাকবে। এই প্ৰতিজ্ঞা সে রাখতে পারল না। মাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল। বিজু ভেতরে একনজর উকি দিয়ে আবার বাইরে চলে গেল।

সাইফুদ্দিন সাহেব ভেতরে ঢুকলেন। কি বলবেন, এটা ঠিকঠাক করতে করতে তাঁর অনেক সময় গেল। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর কিছু মনে আসে না। বিশেষ বিশেষ ঘটনায় তিনি কি বলবেন তা আগে থেকেই ঠিকঠাক করা থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা বদলে যায়। ঠিক করে রাখা কথাগুলো বলা হয়ে ওঠে না। আজকের দিনের জন্যে যেসব কথা ঠিক করে রেখেছেন সেগুলো হচ্ছে, সবকিছু যে ভালোয়-ভালোয় শেষ হয়েছে এটা অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। আরো খারাপ হতে পারত। সেটা হয় নি। এখন পুরানো কথা সব ভুলে গিয়ে একটা ফ্রেশ স্টার্ট নিতে হবে। লাইফের রিয়েলিটি স্বীকার করতে পারা হচ্ছে বিরাট গুণ।

ঠিক করে রাখা কথা একটাও বলা গেল না। হাউমাউ করে যে-মেয়ে কাঁদছে তাকে কিছুই বলা যায় না। সাইফুদ্দিন সাহেব ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বিব্রত গলায় বললেন, নাশতার কি হয়েছে দেখ তো মা।

এ-বাড়ির ভিতরের বারান্দায় লম্বা একটা ছয় চেয়ারের টেবিল আছে। কোন চেয়ারে কে বসবে তা নির্দিষ্ট করা। সাইফুদ্দিন সাহেব এবং বিজুবসে মুখোমুখি দুজন দুই প্রান্তে। বাকি চারটি চেয়ারের একটিতে ঊর্মি, অন্যটিতে জাহানারা। তারা বসে কোনোকুনিভাবে।

আজ দীর্ঘদিন পর নিয়ম ভঙ্গ হল। সোমা ভুল করে তার বাবার চেয়ারে বসে পড়েছে। সাইফুদ্দিন সাহেব অস্বস্তি বোধ করছেন। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। নিজের চেয়ারে না বসলে তিনি ভালোমতো খেতে পারেন না। হাত রাখার জায়গাটা অপরিচিত লাগে। নির্দিষ্ট যে-কাঠের উপর ডান পা রাখেন সেই কাঠ না থাকায় পাটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। তিনি আজ বসেছেন ঊর্মির চেয়ারে। কাজেই সব এলোমলো হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পর বাবা এবং ছেলে বসল পাশাপাশি। দুজনের চেহারার মিল খুবই বেশি। বিজু বুড়ো হলে কেমন দেখতে হবে তা সাইফুদ্দিন সাহেবের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সোমা লক্ষ করল দুজনেই রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসছে। যেন তাদের মধ্যে গোপন কোনো রহস্যের ব্যাপার আছে। বাইরে কড়ই গাছ কাটা হচ্ছে। করাত চালানোর শব্দ আসছে। পিতাপুত্র কাউকে গাছকাটা নিয়ে চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না। ঊর্মি বলল, ভাইয়া গাছ তো কাটা শুরু করেছে।

বিজু হাসিমুখে বলল, কাটুক।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে সাইফুদ্দিন সাহেবও বললেন, কাটুক।

জাহানারা থমথমে গলায় বললেন, দিনে-দুপুরে ডাকাতি করবে কিছু বলবে না?

বিজু চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল, না।

সাইফুদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, আমরা কিছুই বলব না। কথা শেষ করেই তিনি বিজুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন। বিজু হাসল না। গম্ভীর গলায় বলল, গাছ কাটার পর খেলা জমবে। অপেক্ষা কর–আগে গাছটা কাটা থোক।

ঊর্মি বলল, মারামারি করবে?

বিজু বলল, না। কিছুই করব না। বসে বসে শুধু মজা দেখব। গাছ কাটা শেষ হবার পরপরই একটা মজার ব্যাপার হবে। মজার ব্যাপারটা কী বলে দেব বাবা?

বলে দে।

বিজু মজার ব্যাপার ব্যাখ্যা করল সোমার দিকে তাকিয়ে। ব্যাপারটা কি হয়েছে। আপা শোন, বিগ ম্যাঙ্গো করল কি…….

বিগ ব্যাঙ্গো কে?

বিগ ম্যাঙ্গো হচ্ছে আমাদের সম্মানিত বড় চাচা মুখটা ফজলি আমের মত তো তাই তার নাম বিগ ম্যাঙ্গো। যাই হোক, বিগ ম্যাঙ্গো কি করল শোন—অত্যন্ত গোপনে গাছ বিক্রির ব্যাপারটা এক লোকের সঙ্গে ফাইন্যাল করে ফেলল। চার হাজার টাকা। আসল দাম খুব কম হলেও আট হাজার। যাই হোক, আমি ঐ লোকের সাথে দেখা করলাম। তাকে একটা খুব খারাপ কথা বললাম, সেটা তোমাদের না শুনলেও চলবে। সঙ্গে তিন জন মস্তান নিয়ে গেলাম। গাছওয়ালার নাম কুদ্দুস। ভয়ে সে তখন প্যান্ট ভিজিয়ে দেয় স্টেইজে আছে। আমি বললাম, কুদ্দস মিয়া, গাছ কিনতে যাচ্ছ খুবই ভালো কথা। তবে গাছ আমার। টাকা তুমি আমাকে দেবে এবং এখন দেবে, তারপর গাছ কেটে নিয়ে যাবে। যার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে তাকে বলবে গাছের টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। আমি তোমাকে পাকা রসিদ দেব। তবে ঐ পার্টি যেন গাছ। কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু জানতে না পারে। ব্যাস, কাজ খতম। রসিদ দিয়ে টাকা নিয়ে এসেছি। বিগ ম্যাঙ্গোর অবস্থা কি হয় এটা দেখার জন্যে সারা দিন ঘরে বসে থাকব। হা-হা-হা। বিজু দুলে-দুলে হাসতে লাগল।

বিজুকে এখন কেমন যেন অচেনা লাগছে। তার চেহারায় যে মায়া মায়া ভাবটা ছিল তা নেই। চোখ পিটপিট করে ধূর্ত মানুষের মতো তাকাচ্ছে। বিজুর ভালো নাম বিজয়। যোলই ডিসেম্বর জন্ম বলেই এই নাম।

আদরে আদরে বিজয় হয়ে গেছে বিজু। এই বিজু ছটা লেটার নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করে চারদিকে বিস্ময়ের সৃষ্টি করল। সেই বিস্ময় দীর্ঘস্থায়ী হল না। ইন্টারমিডিয়েটে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে গেল। ইউনিভারসিটিতে অনেক চেষ্টা করেও ভর্তি হওয়া গেল না। ভর্তি হল জগন্নাথ কলেজে। সায়েন্স ছেড়ে দিয়ে নিল ইতিহাসে অনার্স। বর্তমানে সে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। কলেজ সংসদের সে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সম্পাদক। কোথায় যেন গানও শেখে। দু-একটা ফাংশনে গণসংগীত গেয়েছে। সাইফুদ্দিন সাহেব পুত্রের এইসব প্রতিভাতেও মোটামুটি মুগ্ধ। ইদানীং তাঁর মনে হচ্ছে পড়াশোনার দিকটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। পড়াশোনার সঙ্গে-সঙ্গে অন্য সাইডও থাকতে হবে। অন্য সাইড যদি ভালো হয় তা হলে পড়াশোনায় একটু ডাউন হলেও ক্ষতি নেই। থার্ড ডিভিশন পাওয়া একজন ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় চাকরি পেয়ে যায়। আর ফার্স্ট ডিভিশনওয়ালারা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে।

টেবিল এখন ফাঁকা। ঊর্মি চলে গেছে কলেজে। বিজু কলেজে যায় নি। অন্য কি-একটা কাজে গেছে, আধ ঘন্টার মধ্যে না-কি এসে পড়বে। জাহানারা আবার রান্নাঘরে ঢুকেছেন। শুধু সোমা তার বাবার সঙ্গে বসে আছে। সাইফুদ্দিন সাহেব বুঝতে পারছেন না সোমা সম্পর্কে ভেবে রাখা কথাগুলো এখন বলবেন, কি বলবেন না। বললে এখনই বলা উচিত।

সোমা।

জ্বি।

ও কি কোনো ঝামেলা করেছিল না-কি?

না।

বুঝতে পেরেছে ঝামেলা করে লাভ হবে না। নয় তো এত সহজে ছাড়ত না।

হতে পারে।

বিজু অবশ্যি সবরকম প্ৰিকশন নিয়ে রেখেছিল।

বিজু খুব কাজের ছেলে হয়েছে।

খুবই অ্যাকটিভ। অনেক লোকজনের সঙ্গে চেনা-জানা। অনেক কবি-সাহিত্যিকেও চেনে। ঐ দিন বাসায় দাওয়াত করে ঔপন্যাসিক শওকত আলীকে নিয়ে এসেছিল। বিশিষ্ট ভদ্রলোক।

পড়াশুনা কেমন করছে?

করছে। পড়াশুনাও করছে। দুটো সাইডই ঠিক আছে। এখন তুই যখন আছিস নিজেই দেখবি।

তুমি আজ বেরুবে না?

না। বের হবার দরকার ছিল অবশ্যি। থাক, ব্যাপারটা দেখেই যাই।

কোন ব্যাপার?

গাছ কাটার পর কি হয় ঐটা আর কি।

সোমা শীতল গলায় বলল, এরকম একটা ছেলেমানুষির মধ্যে তুমি আছ কেন। বাবা? তুমি তো আর ছেলেমানুষ নও।

সাইফুদ্দিন কি বলবেন ভেবে পেলেন না। ঠিক সময়ে ঠিক কথাটা তাঁর কিছুতেই মনে আসে না। তিনি মিনমিনে গলায় বললেন, তোর মাকে এক কাপ চা দিতে বল তো। সোমা চায়ের কথা বলার জন্যে উঠে গেল। জাহানারা বললেন, তুই শুয়ে থাক। রেস্ট নে।

রেস্ট নেবার কি আছে মা? আমি তো আর হাসপাতাল থেকে ফিরছি না। রোগশোেকও হয় নি।

চা খাবি আরেক কাপ?

খাব। কাজের ছেলেটা কোথায় মা?

বাজারে গেছে।

ঐটুকু ছেলে আবার বাজার করে না-কি?

বাজার করে, চুরি করে, সবই করে।

মা।

কি?

এই রকম করে আর মারধোর করো না।

জাহানারা চা ঢালতে ঢালতে বললেন, আর মারব না।

সোমা বাবাকে চা দিয়ে আবার রান্না ঘরে ফিরে এল। জাহানারা চুপচাপ বসে আছেন। যদিও এই মুহূর্তে রান্নাঘরে তাঁর কোনো কাজ নেই। সোমা বলল, সবকিছু কেন জানি অন্যরকম লাগছে।

যতই দিন যাবে ততই দেখবি আরো অন্যরকম লাগবে।

তুমি এখন রান্নাঘরে বসে আছ কেন?

যাব কোথায়? রান্নাঘর ছাড়া আমার যাবার জায়গা আছে?

 

ছদরুদ্দিন সাহেব গাছ কাটার তদারক করছেন। বৃষ্টি থেমে গেছে। তবু তাঁর মাথায় ছাতি ধরা আছে। সাত ফুটের এক একটা টুকরো করা হচ্ছে। তিনি নিজেই গজফিতা দিয়ে মেপে দেখলেন। বিকেলে মিস্ত্রিদের চা এবং মুড়ি খাওয়ালেন।

সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে কুদুস তাঁকে বলল যে, গাছের টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। রেভিন স্ট্যাম্পে দেওয়া পাকা রসিদও কুদুস তাঁকে দেখাল। শুকনো গলায় বলল, বিশ্বাস না হলে বিজু ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন। উনি ঘরেই আছেন।

ছদরুদ্দিন সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, বিশ্বাস না হবার কিছু নেই। বিশ্বাস হচ্ছে। ঠিক আছে তুমি যাও।

অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার দরুদ্দিন সাহেব এই নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ