যেদিন তাড়া থাকে সেদিনই একের পর এক সমস্যা দেখা দেয়। আজ জামানের সকাল সকাল অফিসে যাবার কথা। বছর শেষের এই দিনটি জামানদের অফিসের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। এইদিন অফিসে কাজকর্ম তেমন কিছু হয় না। কয়েকটা মিটিং হয়। মিটিংএর বিষয়বস্তু হল–বিগত বছরে কোম্পানী কি করেছে তার পর্যালোচনা। সামনের বছরে কোম্পানী কি করবে তার আভাস। পদোন্নতির ব্যাপারগুলিও এই দিনই জানা যায়। দুপুরে কোম্পানীর খরচে লাঞ্চ দেয়া হয়। ফুল রোস্ট, রেজালা, দৈ, মিষ্টি, কোল্ড ড্রিংকস …।

ঠিকমত অফিসে পৌঁছার জন্যে জামান আজ অন্যদিনের চেয়ে আগেই রওনা হয়েছিল। বাসে করে যাচ্ছে–শাহবাগের মোড়ে বাসের ভেতর প্রচণ্ড হৈ চৈ। বাস নাকি বেবীটেক্সির উপর উঠে গেছে। চারদিক থেকে ধর ধর শব্দ। নিমেষের মধ্যে বাসের ড্রাইভার দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে পড়ল। সে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ছুটছে, তার পেছনে ছুটছে রাজ্যের মানুষ। কণ্ডাক্টার পালাতে পারেনি। বাসের যাত্রীরা তাকে ধরে ফেলেছে। শুরু হয়েছে প্রচণ্ড মার। এই লোকটার দোষ কি? একসিডেন্টের সময় যে যাত্রীদের ভাড়া আদায় করছিল। বেবীটেক্সির উপর বাস তুলে দেয়াতে তার কোন ভূমিকা ছিল না। লোকটাকে কি মেরেই ফেলবে? গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে–এই শব্দের ফাঁকে ফাঁকে কণ্ডাক্টার বলছে–ঘরে আমার ছোট ছোট দুইটা মাইয়া। আপনাদের আল্লাহর দোহাই লাগে–আঁ আঁ আঁ!

জামান বাস থেকে নামল। পুলিশ ছাড়া এই লোককে বাঁচানো অসম্ভব। শাহবাগের মোড়ে একসিডেন্ট পুলিশ নিশ্চয়ই চলে এসেছে। ওয়ারলেস সেট হাতে একজন পুলিশ সার্জেন্টকে মোটর সাইকেলে বসে থাকতে দেখা গেল। জামান এগিয়ে গিয়ে কণ্ডাক্টারের কথাটা বলল। পুলিশ সার্জেন্ট অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, আমরা দেখছি, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

লোকটাকে মেরে ফেলছে!

মানুষ এবং বিড়াল এই দুই প্রাণী সহজে মরে না। আপনি আপনার কাজে যান। ভিড় বাড়াবেন না।

ভিড় যা হয়েছে, দর্শনীয়। মুহূর্তের মধ্যে এতগুলি লোক জড় হল কি করে সে এক রহস্য। ভিড় ঠেলে বের হতে জামানের আধ ঘন্টার মত লাগল।

খালি রিকশা অনেক আছে। কিন্তু কেউ মতিঝিল যাবে না। এখানকার মজা শেষ না করে কেউ নড়বে না। বেবীটেক্সি আছে–এতগুলি টাকা খরচ করে বেবীটেক্সি নেবার কোন অর্থই হয় না। হেঁটে যাওয়াও অসম্ভব। স্যাণ্ডেলের স্ট্র্যাপ ছিড়ে গেছে। পা। ছেড়ে ছেড়ে কতদূর আর যাওয়া যায়!

নটার ভেতর অফিসে পৌছার কথা। জামান অফিসে পৌছল দশটা কুড়িতে! ম্যানেজমেন্টের মিটিং শুরু হয়ে গেছে। হঘরে চেয়ার পাতা হয়েছে। ডেকোরেটরের কাছ থেকে ভাড়া করে আনা চেয়ার। চেয়ারে যারা বসে আছে তাদের সবার মুখ শুকনো। এমড়ি সদরুদ্দিন সাহেবের বক্তব্য মনে হয় কারো তেমন পছন্দ হচ্ছে না।

জামান খুব সাবধানে পেছনের দিকের একটা চেয়ারে বসল। এমডি সাহেব ইংরেজিতে লিখিত বক্তৃতা পাঠ করছেন। বক্তৃতার বিষয় হল –

কোম্পানীকে নিজের পায়ে শক্ত করে দাঁড় করাতে হবে। কোম্পানী এবং বৃক্ষ এক রকমের। ছোট্ট চারা থেকে হয় মহীরুহ। তেমনি ছোট্র কোম্পানী থেকে হয় বিরটি মাল্টিনেশনাল কোম্পানী। বৃক্ষ নড়বড়ে হয় তখন, যখন তার শাখা-প্রশাখা বেড়ে যায়। এই কোম্পানীও শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে নড়বড়ে অবস্থায় চলে এসেছে। কাজের লোকের চেয়ে অকাজের লোক বেশি। হেড অফিসেই টাইপিস্টের সংখ্যা তের জন। অথচ ওয়ার্ড প্রসেসর ইউনিটও আছে। তের অন টাইপিস্টের বলতে গেলে কোন কাজ নেই। এরা অফিসে আসে, গল্প-গুজব করে বাসায় ফিরে যায়–নিয়মমত তারা একটা কাজই করে, সেটা হল বেতন নেয়া …

জামানের পাশে রকিব সাহেব বসেছিলেন। সিনিয়র হেড এ্যাসিসটে। কোম্পানীর জন্মলগ্ন থেকে এর সঙ্গে আছেন। রকিব সাহেব ফিস ফিস করে বললেন, জামান ভাই, অনেক ছাঁটাই হয়েছে।

ছাঁটাইয়ের কথা কি বুড় সাহেব বলেছেন?

সরাসরি এখনো কিছু বলে নাই তবে শোনা যাচ্ছে। এই বছর কোম্পানী অনেক লস দিয়েছে…।

কারা ঘঁটাই হয়েছে কিছু শুনেছেন?

না। শোনা যাচ্ছে মোট আঠার জন।

বলেন কি?

এমডি সাহেব কোম্পানীর উন্নতির জন্যে যে সব কর্মচারী সৎ এবং আন্তরিক চেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের ধন্যবাদ দিয়ে বক্তৃতা দিলেন এবং সবাইকে তাঁর সঙ্গে এক কাপ চা খাবার আমন্ত্রণ জানালেন–

দুপুরে লাঞ্চের ঠিক আগে আগে ছাঁটাইকৃত কর্মচারীরা তাদের নাম জানল। মোট এগার জন উঁটাই হয়েছে। জামানের নাম দশ নম্বরে।

কোম্পানী আইনের ধারা উল্লেখ করে তারা জামানের কাছে যে চিঠি দিয়েছে তার ভাষা বড়ই কঠিন –

আপনাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হল।

চিঠি পকেটে নিয়ে জামান চুপচাপ বসে আছে। দুঃখবোধের চেয়েও যে ব্যাপারটা তাকে আলোড়িত করছে তা হল লজ্জাবোধ। সবাই আসছে, সান্ত্বনার কথা বলছে, চিঠি পড়তে চাচ্ছে।

কিছুক্ষণের ভেতর লাঞ্চের ডাক পড়বে। সেখানেও যেতে হবে। লাঞ্চ না খেয়ে চুপচাপ বসে থাকা মানে রাগ করে ভাত না খাবার মত। জামান কার উপর রাগ করবে?

অনেকেই এসে তাকে বলছে, আপনি এমডির সঙ্গে সরাসরি দেখা করুন। আপনার মত মানুষের চাকরি চলে যাবে, এটা একটা কথা না-কি? আপনি যান, আমরা সবাই আপনাকে সাপোর্ট দেব। মগের মুল্লুক? এক কথায় চাকরি নট? কোর্টকাচারি করে সব ছেড়াবেড়া করে ফেলব না?

জামান জানে, এও কথার কথা। দেশে চাকরি বাকরির অবস্থা খুব খারাপ। চরম দূঃসময়। এই সময়ে নিজের চাকরি নিয়ে সমস্যা হতে পারে এ ধরনের কিছু কেউ করবে না।

অন্য সবার মতই জামান বর্ষশেষ লাঞ্চে গেল। বুফে লাঞ্চের ব্যবস্থা। বড় টেবিলে খাবার সাজানো। সবাই নিজের পছন্দমত খাবার উঠিয়ে নিচ্ছে। আস্ত একটা মুরগীর রোস্ট একজনের পক্ষে খাওয়া মুশকিল, তারপরেও দেখা যাচ্ছে–কেউ কেউ দুষ্টা ব্রেস্ট নিয়েছে।

এমডি সদরুদ্দিন সাহেব প্লেটে সামান্য কিছু পোলাও নিয়েছেন। চামচে সেই পোলাওয়ের খানিকটা মুখে দিচ্ছেন এবং হেঁটে হেঁটে সবার সঙ্গে গল্প করছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে এক সময় জামানের কাছে চলে এলেন, হাসিমুখে বললেন, কেমন আছেন জামান সাহেব?

জ্বি স্যার, ভাল।

অনেকেই দেখি দুটা করে রোস্ট নিয়েছে, আপনি একটা, ব্যাপার কি? নিন আরেকটা নিন।

জি না স্যার।

কাজ করুন। ভালমত কাজ করুন। আপনি কোম্পানীকে দেখবেন। কোম্পানী আপনাকে দেখবে।

জামান ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল–এমডি সাহেব জানেনও না যে সে এখন আর কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত না। এমডিদের এত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না।

সদরুদ্দিন জামানের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে বললেন, সবাই আমার একটা ঘোষণা শুনুন। আমি একটা প্রাইজ ডিক্লেয়ার করছি। মেক্সিমাম নাম্বার অব ব্রেস্ট যে কনজিউম করবে তার জন্যে সুন্দর একটি পুরস্কার।

সবার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। একজন উজ্জ্বল চোখ করে জিজ্ঞেস করল, প্রাইজটা কি স্যার?

প্রাইজ কি এখন বলব না–তবে ভাল প্রাইজ। ইউ উইল লাইক ইট। আচ্ছা, বলেই দেই–টিকিট। কক্সবাজারের বিমানের টিকিট। একটি না, দুটি টিকেট। স্পাউস সঙ্গে নেয়া যাবে।

সদরুদ্দিন সাহেব হাসছেন। অন্যরাও হাসছে। ক্যাশিয়ার আবদুল করিম সাহেবকে ব্রেস্টের থালার দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ