বাবু মাটির ঘোড়ার উপর বসে আছে। তার এখন খাবার সময়। ভাত-ডাল মেখে একটা বাটিতে করে আনা হয়েছে। খাওয়ানোর জন্যে তাকে ঘোড়া থেকে নামানো দরকার। সে নামবে না। ঘোড়াতে বসে খেলেও হয়–তাও খাবে না। অনুনয়, গল্প বলা, গান গাওয়া অনেক কিছুই হল–বাবু মুখ খুলবে না।

ফিরুর মা বলল, ফালাইয়া খুন আম্মা। খিদা লাগলে আপছে খাইব।

নায়লা কড়া করে তাকাল। সব কিছুর মধ্যে আগ বাড়িয়ে কথা বলা তার খুব অপছন্দ। নায়লা কঠিন গলায় বলল, তুমি তোমার কাজে যাও তো ফিরুর মা। তোমাকে উপদেশ দিতে হবে না।

উপদেশ না আম্মা, সত্য কথা।

সত্য কথা তোমার বলতে হবে না।

মিখ্যা বললে দোষ, আবার সত্য বললেও দোষ?

একটা কথা না ফিরুর মা। তোমার ভাইয়ের আসার সময় হয়ে গেছে। পানি গরম দিয়েছ?

হ, পানি গরম আছে।

ভাল করে গরম কর।

নায়লা ঘড়ি দেখল–নটা দশ বাজে। আজ ও এত দেরি করছে কেন? বছরের শেষ দিনে সে তো সব সময় সকাল সকাল ফেরে। তার উপর হঠাৎ করে শীত পড়েছে। শীতের কাপড়ও নিয়ে যায়নি। চদির নেয়নি। স্যুয়েটার অবশ্যি আছে। শুধু স্যুয়েটারে কি আর শীত মানে!

ফিরুর মা! ফিরুর মা!

জি।

একটু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখ তো তোমার ভাইকে আসতে দেখা যায় কি-না।

আসলে তো আম্মা এইখানেই আসবো। আগ বাড়াইয়া দেখনের দরকার কি?

আচ্ছা যাও–তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি যাও আমার সামনে থেকে। যাও বলছি।

সব সময় এমন মিরাজ করেন ক্যান আম্মা? ভাইয়ের তো কোনদিন এত মিজাজ দেখলাম না।

যাও বলছি। যাও…

কলিংবেল বাজছে। ফিরুর মা দরজা খুলতে গেল। নায়লা ক্ষিপ্ত গলায় বলল, খবর্দার, তুমি দরজা খুলবে না। খবর্দার বলছি। তুমি রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাক। তুমি আমার সামনেই আসবে না।

জামান এসেছে। বাজার এনেছে। পলিথিনের ব্যাগের ফাঁক দিয়ে লাউয়ের মাথা বের হয়েছে। আজও ইলিশ মাছ কিনেছে কিনা কে জানে। এত রাতে বাজার করে কেউ ফিরে?

এত দেরি হল যে?

জামান কিছু বলল না। বাজারের ব্যাগ নামিয়ে রাখল।

তুমি কি চা খেয়ে গোসল করবে, না গোসল করে সরাসরি ভাত খাবে?

চা খাব না।

তাহলে বাথরুমে ঢুকে যাও, আমি গরম পানি নিয়ে আসছি। আজ তোমার পছন্দের খাবার আছে। সীমের বিচির তরকারি।

ফিরুর মা গরম পানি চুলাতেই দেয়নি। রাগে নায়লার গা জ্বলে যাচ্ছে। সে নিজেই পানি বসাল। ফিরুর মাকে আর রাখা যাবে না। বিদায় করে দিতে হবে। এতদিন যে তাকে সহ্য করা হয়েছে এই যথেষ্ট।

 

মনে হচ্ছে জামানের খেতে ভাল লাগছে না। মুখে যত না দিচ্ছে মাখাচ্ছে তারচেয়েও বেশি। নায়লা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, খেতে ভাল হয়নি?

হয়েছে।

খাচ্ছ না তো।

খিদে হয়নি।

খিদে হয়নি কেন? বিকেলে কিছু খেয়েছিলে?

জামান উত্তর দিল না। ভাত মাখাতে লাগল।

নিশ্চয়ই চা খেয়ে খেয়ে খিদে নষ্ট করেছ। কাচামরিচ নাও। কাচামরিচ খেলে নষ্ট খিদে ফিরে আসে।

জামান কঁচামরিচ নিল। নায়লা বলল, কল দিনটার কথা মনে আছে তো? বাবুর জন্মদিন।

মনে আছে।

বাসায় সামান্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কি করব?

কর।

নায়লা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জন্মদিন না করলেও অবশ্যি হয়। বাবু তো আর জন্মদিন-টন্মদিন বুঝে না। ওর কাছে সব দিনই সমান।

 

তাহলে আর জম্মদিনের দরকার কি? বাদ দাও। টাকা-পয়সার টানাটানি। আমি ভাবছিলাম, জন্মদিন উপলক্ষ্য করে তোমার বন্ধুকে খেতে বলব, সেই সঙ্গে অরুণাকেও আসতে বলব। দুজনের সঙ্গে দুজনের দেখা হল। আমার দায়িত্ব পালন হয়ে গেল।

জামানের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়িয়েছে। একা একা খেতে নায়লার খারাপ লাগে। দুজন একসঙ্গে খেতে বসেছে। একজন খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েছে, অন্যজন পেটুকের মত খেয়েই যাচ্ছে … নায়লাও খিদে রেখে উঠে পড়ল। সে যে খাওয়া শেষ করেনি এটাও জামানের চোখে পড়ল না।

বাবু আজ সারাদিন কিছুই খায়নি। তার ঘোড়ায় চড়া রোগ হয়েছে। সারাদিন ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে। আজ কি করেছে জান? দুপুরে খাওয়াতে নিয়ে গেছি, সে বলল, ঘোড়া দুদু। অর্থাৎ ঘোড়ার পিঠে বসে দুধ খেতে চায়। কি রকম বজ্জাত হয়েছে দেখো না।

ও কোথায়?

ফিরুর মা ঘুম পাড়াচ্ছে। ভাল কথা, শোন তো–তোমার অফিসের লোকজনদের বলে দিও তো–কেউ যদি কোন কাজের মেয়ে পায় তাহলে যেন আমাকে দেয়–আমি ফিরুর মাকে রাখব না। বিদায় করে দেব। আজই বিদায় করে দিতাম। বাবুর জন্মদিন পর্যন্ত রেখে তারপর বিদায় করে দেব। তুমি কিন্তু না বলতে পারবে না। সিগারেট খাচ্ছি না কেন? তুমি তো ভাত খাওয়ার পরপর সিগারেট খাও।

সিগারেট সঙ্গে নেই। কিনতে ভুলে গেছি।

আমি যদি এখন একটা সিগারেট এনে দেই আমাকে কি দেবে? দাঁড়াও, সিগারেট দিচ্ছি। তবে একটা শুধু পাবে। একটাই আমার কাছে আছে।

নায়লার কাছে একটা না, এক প্যাকেট সিগারেট আছে। আলমের প্যাকেট ভুল করে ফেলে দিয়েছিল। নায়লা তুলে রেখে দিয়েছে।

নায়লা বলল, আচ্ছা শোন, জন্মদিন কি করব?

কর, তোমার যদি ইচ্ছা করে।

আমার কোন ইচ্ছ-টিচ্ছা না–তোমার বন্ধু আর অরুণরি কথা ভেবে বলছি। শুধু ওদের দুজনকেই বলবে, আর কাউকে না। আচ্ছা, তোমাকে যে এত রাতে সিগারেট বের করে দিলাম তুমি তো আমাকে থ্যাংকসও দিলে না।

থ্যাংকস।

সব কিছু তোমাকে বলে বলে দিতে হয়। নিজ থেকে তুমি কিছুই কর না। কি যে অদ্ভুত মানুষ! তোমার বন্ধুকে কাল সকালেই কিন্তু দাওয়াত করে আসবে। পারবে না?

পারব।

তাকে জন্মদিনের কথা বলার দরকার নেই। জন্মদিন শুনলেই একগাদা উপহার কিনে হুলস্থূল করবে। তোমার বন্ধুর যা খরুচে স্বভাব। আমার অবশি খরুচে স্বভাবের মানুষই ভাল লাগে। টাকা তো খরচের জন্যে, জমা করে রাখার জন্যে না। তোমার যদি টাকা হয় তাহলে তোমার স্বভাব কেমন হবে? তুমিও কি খরুচে স্বভাবের হবে?

নায়লা গড় গড় করে কথা বলে যাচ্ছে। জামান শুনছে। মন দিয়েই শুনছে, উত্তর দিচ্ছে না। যে ভয়াবহ ঘটনা তার জীবনে ঘটে গেল সেটা নায়লাকে তার বলা দরকার, কিন্তু বলতে পারছে না। ছেলের জন্মদিন নিয়ে খুশিমনে কত পরিকল্পনা করছে সব ভেস্তে যাবে। তাছাড়া নায়লা ছোটখাট দুর্ঘটনাতেই ঘাবড়ে যায়। বড় কিছু ঘটলে কি হবে কে জানে! নায়লাকে যা বলার ধীরে সুস্থে বলতে হবে।

তুমি আমার কথা কিছুই শুনছ না।

শুনছি তো।

না শুনছ না। তুমি অন্য কিছু ভাবছ। কি ভাবছ?

কিছু ভাবছি না।

আচ্ছা শোন, তুমি কি এই মাসে আমাকে বাড়তি কিছু টাকা দিতে পারবে? আমি সংসারের টাকা জমিয়ে জমিয়ে তোমার টাকা ফেরত দেব। পারবে?

কত টাকা?

এক হাজার টাকা।

জামান মনে মনে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এক হাজার টাকা সে দিতে পারবে। তাকে তিন মাসের বেতন দেয়া হবে। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের জমা কিছু টাকাও পাবে। খুব বেশি না —- গত বৎসর বাবুর অসুখের সময় বেশ কিছু টাকা তুলতে হল।

নায়লা আগ্রহের সঙ্গে বলল, কথা বলছ না কেন? দিতে পারবে?

পারব।

কাল সকালে দিতে পারবে?

হ্যাঁ পারব। আমার কাছে এখনই টাকাটা আছে–তুমি নিয়ে নিও।

আসলে টাকাটা আমার কি জন্যে দরকার তেমাকে বলি–নুরু এসেছিল। ওর এক বন্ধু এসেছে দুবাই থেকে। সাতটা ফ্রেঞ্চ শিফন নিয়ে এসেছে। শাড়িগুলির তিন হাজার টাকা করে দাম। সে নুরুকে বলেছে–নুরু যদি শাড়িগুলি বিক্রি করে দিতে পারে তাহলে নুরুকে সে এক হাজার টাকায় একটা শাড়ি বিক্রি করবে। নুরু হালকা গোলাপী একটা শাড়ি নিয়ে এসেছিল। কি যে সুন্দর!

শাড়িটা কি তুমি রেখে দিয়েছ?

না। কোন্ ভরসায় রাখব? শেষে টাকা জোগাড় না হল? কাল সকালে নুরুকে টাকাটা দিয়ে আসব। এত দাম দিয়ে আমার শাড়ি কেনা ঠিক না। কিন্তু এত সুন্দর শাড়ি দেখে লোভ লেগে গেল।

জামানের বলতে ইচ্ছা করছে–নুরুকে টাকা দিলে তুমি শাড়ি পাবে না। জামান বলতে পারল না। নিজের ভাই সম্পর্কে এমন কঠিন কথা নায়লা সহ্য করতে পারবে না।

তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? শুয়ে পড়বে?

এসো তাহলে শুয়ে পড়ি। বাবু রাতে কিছুই খেলো না। ও সারারাত বিরক্ত করবে। বাতিস দুদু বাতিস দুদু করে আমাকে ছিবড়া বানিয়ে ফেলল! দুধ কি করে ছাড়াই বল তো? করলার রস বুকে মাখিয়ে রাখব। তুমি মনে করে করলা নিয়ে এসো তো।

বিছানায় নায়লা স্বামীর কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো। ভারি জড়ানো গলায় ফিসফিস করে বলল, তোমার কি আর কিছু লাগবে?

জামান চমকে উঠে বলল, কি বললে?

কিছু বলিনি। আমাকে একটু আদর কর না। আজ তোমার কি হয়েছে বল দেখি? এমন হাত-পা এলিয়ে পড়ে আছি কেন?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ