সন্ধ্যার আগে আগে নায়লার অসম্ভব মাথা ধরল।

মাথা তো ধরবেই–একের পর এক সমস্যা হচ্ছে। নুরু টাকা নিয়ে গেছে কিন্তু, শাড়ি দিয়ে যায়নি। অথচ এই শাড়ি পরার জন্যে সে রেডিমেড় ব্লাউজ কিনে এনেছে। ইস্ত্রি করিয়ে রেখেছে।

চোখে কাজল দেবে, কাজলদানি খুঁজে পাচ্ছে না। ফিরুর মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে বলল, আমি তো আম্মা চউক্ষে কাজল দেই না। আমি কই ক্যামনে?

চোখে কাজল দাও না বলে কাজলদান কোথায় তুমি জানবে না?

জ্বে না। যার জিনিস হে খুঁজ রাখব।

রাগে নায়লার শরীর কাঁপছে। সে রাগ সামলাতে পারছে না। তিনতলার বাসা থেকে চারটা দামী গ্লাস এনেছিল, একটা ভেঙে গেল। সে নিজেই ভাঙল। রান্নাঘর থেকে ফিরুর মা বলল, আল্লা বাচাইছে, আফনের হাতে ভাঙছে, আমার হাতে ভাঙলে আইজ গজব হইত।

চুপ কর ফিরুর মা।

চুপ কইরাই তো আছি গো আম্মা ফিরু মরণের পর থাইক্যা…

আর একটা কথা বললে তোমাকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেব—

দেন ফেলাইয়া। ফিরু মরণের পর থাইক্যা বাইচা খাকতে ইচ্ছা করে না।

এই পর্যায়ে নায়লার মাথা ধরল। রান্নাবান্নাও তখনো শেষ হয়নি। মাংস সিদ্ধ হচ্ছে। যত জ্বাল হচ্ছে মাংস মনে হয় ততই শক্ত হচ্ছে।

বাবু বিকেল থেকেই ঘ্যান ঘ্যান করছে–বাতিস দুদু। বাতিস দুদু। নায়লা ঠিক করেছে তাকে আর বুকের দুধ দেয়া হবে না। কাদুক যত ইচ্ছা। কেঁদে কেঁদে গলা ভেঙে ফেলুক।

জামান বাবুকে নিয়ে তখন থেকেই ছাদে ইটছে। গল্প বলে শান্ত করার চেষ্টা করছে। যতক্ষণ গল্প বলে ততক্ষণ বাবু শান্ত হয়ে শুনে। গল্প শেষ হলেই মাম্মাট বাতিস দুদু। মাম্মাট বাতিস দুদু। জামান গল্পের পর গল্প বলে যাচ্ছে। গল্পগুলি বাবু বুঝতে পারে কিনা কে জানে। যে ভাবে শুনে তাতে মনে হয় বুঝতে পারছে। অথচ বুঝতে পারার কোন কারণ নেই। জামান নতুন গল্প শুরু করল—

বাবু, কি হয়েছে শোন। আমার না চাকরি চলে গেছে। আর আমাকে অফিসে যেতে হবে না। মজা হয়েছে না? এখন শুধু তোমার সঙ্গে খেলব। তবে মাসের শেষে কোন টাকা আসবে না–এইটাই সমস্যা।…

এই জরুরী গল্প জামান এখনো নায়লাকে বলতে পারেনি অথচ বলা দরকার। সে ঠিক করেছে আজ রাতেই বলবে। বাবু যত শান্ত হয়ে শুনেছে নায়লা কি শুনবে? কেঁদেকেটে অস্থির হবে। নায়লা একবার কাঁদতে শুরু করলে থামতে পারে না।

বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতিস দুদু পাওয়া যাবে না, এই ব্যাপারে হতাশ হয়েই বোধহয় ঘুমুচ্ছে। বড় মায়া লাগছে জামানের। ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সারাজীবন সে ছেলে কোলে নিয়ে ছাদে হাঁটতে পারবে।

নায়লা ছাদে এসে বলল, বাবু কি ঘুমুচ্ছে?

হুঁ।

ঘুমুচ্ছে, শুইয়ে দিচ্ছ না কেন? ছাদে নিয়ে হাঁটাহাটি করে ঠাণ্ডা লাগাবে নাকি? শুইয়ে দাও। আর শোন–কাচা বাজার থেকে শসা এনে দাও। শসা আনতে ভুলে গেছি।

আচ্ছা।

আমার শাড়িটা নিয়ে নুরুর আসার কথা, ও তো এলো না। তুমি কি মার বাসা হয়ে আসবে?

আচ্ছা যাব।

রান্নাই এখনো শেষ করতে পারিনি। কখন কি করব কিছু বুঝতে পারছি না। প্রচণ্ড মাথাও ধরেছে। এত অস্থির লাগছে।

সামান্য ব্যাপারে এত অস্থির হয়ো না।

নায়লা তীক্ষ্ম গলায় বলল–তোমার কাছে এই ঝামেলাগুলি সামান্য মনে হচ্ছে? আশ্চর্য–!

নুরুর কাছে শাড়ির খোঁজে যাওয়া অর্থহীন। তবু জামান শ্বশুরবাড়িতে গেল। নুরুকে পাওয়া গেল না। শাড়ির ব্যাপারে বাসায় কেউ কিছু জানে না। জামানের শাশুড়ি সঁতের ব্যথায় কাতর হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। গাল ফুলে একাকার। জামাইয়ের সঙ্গে কোন কথা বলার তার অবস্থা নেই। জামানের শ্বশুর মোর্তজা সাহেব এম্নিতেই কথা বেশি বলেন। রিটায়ারমেন্টের পর থেকে কথা বলাই তার একমাত্র কাজ হয়ে দাড়িয়েছে। কেউ বাড়িতে এলে তার আনন্দের সীমা থাকে না। কথা বলার মানুষ পাওয়া গেল। জামানকে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন। কারণ জামান মন দিয়ে কথা শুনে, কথার মাঝখানে বিরক্ত করে না।

মোর্তজা সাহেব বললেন, জামান বাবা, কেমন আছ?

জি ভাল।

বাবু কেমন আছে?

ভাল।

বাবু নামটা বদলে দাও। বাবু বিবি এগুলো নাম হল-–? নাম হতে হয় সুন্দর, ভদ্র, শোভন। নামের মধ্যে অনেক কিছু প্রতিফলিত হয়। বাবা-মার রুচি, পরিবারের সামগ্রিক শিক্ষার মান। বোস না, দাঁড়িয়ে আছ কেন?

আজ চলে যাই। বাসায় কয়েকজনকে দাওয়াত করেছি।

দাওয়াত করেছ, এসে খেয়ে যাবে। পাঁচ মিনিট আগে খেতে, এখন খাবে পাছ মিনিট পরে। আজকের খবরের কাগজ পড়েছ?

জি না।

পড়বে। কাগজটা মন দিয়ে পড়বে। যা লিখে সবই মিথ্যা, তবু মিখ্যার ফাক দিয়ে কিছু কিছু সত্য বের হয়ে আসে! সত্য হচ্ছে আলোর মত। গোল আলু ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় কিন্তু সত্যের আলো রাখা যায় না। ফাঁক-ফোক দিয়ে কিছু বেরিয়ে আসবেই। বোস–চা খাও।

সালাদের জন্যে শসা কিনে বাসায় যেতে হবে।

একদিন সালাদ না খেলে কিছু হবে না। মানুষ তো আর ঘোড়া না যে প্রতিদিন কাচা ঘাস, লতাপাতা খেতে হবে। বোস তো।

জামান বসল। মোর্তজা সাহেজ বললেন, কাজের লোক বিদেয় হয়ে গেছে। তোমার শাশুড়ির এই অবস্থা। ব্যথা যতটুকু না চিৎকার শুনলে মনে হবে কি না কি হয়ে গেল। আরে বাবা, বয়স হয়েছে, এখন দাঁতের ব্যারাম হবে, বুক ধড়ফড় করবে, এসিডিটি হবে–দিস ইজ লাইফ। কি বল জামনি?

জ্বি।

বোস, চা খাও। আমি নিজেই বানাব। উপায় কি?

আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

হোক না একটু দেরি। কি হয় সামান্য দেরিতে? আমাকে তো আর বেশিদিন পাবে না। হঠাৎ একদিন শুনবে —শেষ। গেম ইজ ওভার। তখন নিজেই আফসোস করবে– আহা! বেচারা বুড়ো মানুষ! বসতে বলেছিল, বসলাম না। আমার অবস্থা এখন খুব খারাপ। কেউ এখন আর আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁসে না। নুরুকে ডাকলে ও কি করে জান? ধর আমি ডাকলাম, নুরু! নুরু! সে মিষ্টি করে বলবে, আসছি বাবা। বলেই অন্য দরজা দিয়ে রাস্তায় চলে যাবে। দিস ইজ মাই লাইফ। বুড়ো বয়সে স্বামী-স্ত্রী বসে কুটকুট করে গল্প করে এমন একটা কথা শোনা যায়। আমার কপালে তাও নেই। ধর কোন একটা জরুরী কথা তোমার শাশুড়িকে বলতে চাচ্ছি। আমি মুখ খোলার আগেই তোমার শাশুড়ি বলবেন–চুপ কর। কথা শুরুর আগেই চুপ কর। আরে জীবনটাই তো চুপ করে করে কাটিয়ে দিলাম। ঠিক বলছি না?

জ্বি।

মরার পর যদি কোন কারণে আমার বেহেশতে স্থান হয় আমি কি চাইব জান?

কি চাইবেন?

আমি চাইব তোমার শাশুড়ি আমার সামনে বসে থাকবে, আর আমি ক্রমাগত কথা বলে যাব। সে শুধু শুনবে। কখনো বলতে পারবে না, চুপ কর। আমার কথা ভাল লাগুক আর না লাগুক তাকে শুনতে হবে। She must listen.

জামান ছাড়া পেল রাত আটটায়। শসা কিনে বাসায় পৌছতে পৌছতে আটটা পনেরো। তার অস্বস্তির সীমা রইল না। নায়লা রাগ করবে। রাগ করাটা স্বাভাবিক। সবার সামনে হৈ-চৈ শুরু না করলেই হয়।

 

অতিথি দুজনই এসেছে। বসার ঘরে আলম গল্প করছে অরুণার সঙ্গে। আলম সত্যি সত্যি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। অরুণ পরেছে বাটিকের কাজ করা রাজশাহী সিল্ক। অরুণা এম্নিতেই সুন্দর। আজ তাকে আরো সুন্দর লাগছে। নায়লা রান্নাঘরে। পোলাও বসিয়েছিল–পোলাও নষ্ট হয়ে গেছে। পুড়ে একাকার। আবার নতুন করে পোলাও চড়িয়ে সে হাঁড়ির কাছে পঁড়িয়ে। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। সে কাপড় বদলায়নি। কাজলদানি খুঁজে পাওয়ায় শুধু চোখে কাজল দিয়েছে। সেই কাজলও ভাল হয়নি, লেপ্টে গেছে।

জামান রান্নাঘরে শসা রাখতে রাখতে বলল, খুব দেরি করে ফেললাম!

নায়লা জবাব দিল না। শুধু কঠিন চোখে তাকাল। জামান বলল, রান্না হয়নি?

রান্না নিয়ে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। শাড়ি এনেছ?

নুরু বাসায় ছিল না।

গ্রীন ফার্মেসীতে খোঁজ করেছিলে?

না।

ও বাসায় কতক্ষণ থাকে? ও তো দিনরাত গ্রীন ফার্মেসীতে পড়ে থাকে। সেখানে গিয়ে একটু খোঁজ নেবার কথা মনে পড়ল না? সামান্য বুদ্ধিটাও তোমার হয় না? বুদ্ধি জমা রেখে রেখে হবেটা কি?

সামান্য ব্যাপারে এত রেগে যাচ্ছ কেন?

আমার সবই তো সামান্য। রান্নাঘরে গাছের মত দাঁড়িয়ে থাকবে না। যাও, ওদের সঙ্গে বোস। না থাক, এদের সঙ্গে বোসতে হবে না। বাবুর কাছে যাও।

জামান চলে যেতেই ফিরুর মা বলল, স্বামী হইল গিয়ে আম্মা বেহেশতের চাবি। বেহেশতের দরজার মধ্যে বাইশ হাত লম্বা এক তালা ঝুলছে। স্বামী হইল হই তালার চাবি। কোন মেয়েছেলে বেহেশতে ঢুকনের আগে হেই চাবি দিয়ে দরজা খুলন লাগে। এই জন্যে স্বামীর সঙ্গে খারাপ কথা বলা কিতাবে নিষেধ।

ফিরুর মা, তোমার মুখটা দয়া করে তালাবন্ধ করে রাখ একটা কথা না।

 

জ্বাল কমাইয়া দেন আম্মা–পোলাও মরম হইব।

পোলাও নরম হবে না শক্ত হবে সেটা আমি দেখব। তোমার বক্তৃতা দিতে হবে না।

নায়লা রাগ করেই আগুনের আঁচ আরো বাড়িয়ে দিল। তার কান্না পাচ্ছে। আজ সবকিছু এমন খারাপভাবে এগুচ্ছে কেন?

অরুণার উপর তার ভয়ংকর রাগ লাগছে। যদিও রাগ লাগার তেমন কোন কারণ নেই। মেয়েটাকে আজ প্রচণ্ডরকম বেহায়া মনে হচ্ছে। ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে কী করে রেখেছে। অন্য সময় তো এত লাল লিপস্টিক দিতে দেখা যায় না। আলমের প্রতিটি কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে। এই মেয়ের পেটে এত হাসি লুকানো ছিল? রান্নাঘর থেকে বসার ঘরের কথাবার্তা সবই শোনা যায়। নায়লা খুব মন দিয়ে শুনছে। এমন কিছু হাসির কথা তো আলম বলছে না। তাহলে এত হাসি কেন? কিশোরী মেয়েরা খিল খিল করে হাসলে মানায়। তুই এক ধামড়ি, তুই এমন করে হাসছিস কেন? সুন্দর ছেলে দেখে হুস নেই?

নায়লা রান্নাঘরে আটকে আছে। তার কি উচিত ছিল না একবার এসে খোঁজ নেয়া? ভদ্রতা করেও তো বলতে পারতো–তোর কি সাহায্য লাগবে বল। ভদ্রতাটতা এখন এই মেয়ে গুলে খেয়ে বসে আছে। কেউ বোধহয় তাকে বলে দিয়েছে। খিলখিল করে হাসলে ছেলেরা খুশি হয়। সে হেসেই যাচ্ছে। নায়লার ইচ্ছে করছে বলে আসে–আস্তে করে হাসো। বাবু উঠে যাবে।

 

সবাই খেতে বসল রাত নটায়। অরুণা বলল–এত রাত হয়েছে বুঝতেই পারিনি। বাসায় ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যাবে। কি সর্বনাশের কথা! আলম বলল, কেন সর্বনাশের কথা না। আনন্দের কথা। আমরা এই আসর ভাঙব রাত বারোটায়। আপনার ভয় নেই। আপনাকে আমি পৌঁছে দেব।

বারোটার সময় বাসায় পৌঁছে দিলে আমাকে স্ট্রেট বাসা থেকে বের করে দেবে। আমি হব পথবাসি।

নায়লার গা জ্বলে গেল–কি কাব্য! আমি হব পথবাসি! আলম বলল, আমরা থাকতে আপনি পথবাসি হবেন না। আচ্ছা অরুণা, শুনুন, আপনি কি গান জানেন?

উহুঁ।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি গান জানেন।

স্কুলের ফাংশানে গাইতাম–না জানার মতই।

নায়লার মুখ তেতো হয়ে গেল। স্কুলের ফাংশানে গাইতাম! তুই স্কুলের ফাংশানে গান গেয়ে সবাইকে উদাস করে দিয়েছিস! লতামুঙ্গেশকর এসেছে।

নায়লা ভেবে পাচ্ছে না আরুনার উপর তার এত রাগ হচ্ছে কেন! অরুণার উপর রাগ করে এমন খারাপ খারাপ কথাই বা কেন মনে আসছে? আলম বুলল, খাওয়ার পর

আপনার গান শুনব।

সর্বনাশ! আমার গান শুনলে এই এ্যাপার্টমেন্টের লোকজন আমাকে রাস্তায় বের করে দেবে।

নায়লা মনে মনে বলল, তোকে রাস্তায় বের করবে না, তোকে কানে ধরে স্টেডিয়ামে চক্কর দেয়াবে। তামুঙ্গেশগিরি বের করে দেবে।

আলম বলল, আপনার কোন অজুহাত শুনতে চাচ্ছি না। খাওয়ার পর শুরু হবে সংগীত। স্পেনিশরা কি করে জানেন? যে কোন পার্টির পর নাচতে শুরু করে, নাচ চলে একেবারে মধ্যরাত পর্যন্ত।

নায়লা মনে মনে বলল, তুই বসে আছিস কেন? তুই বল আমি স্কুলের ফাংশানে নেচেছি। আপনি চাইলে এখানেও নাচব।

বাবু উঠে গেছে। উঠেই কান্না। জামান খাওয়া বন্ধ রেখে ছেলেকে ধরল। ছেলে ব্যাকুল হয়ে বলল, বাবা, আমি বাতিস দুদু খাব না? এত দীর্ঘ একটা বাক্য ছেলে এই প্রথম বলল। জামানের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে ছেলেকে নিয়ে ছাদে হাঁটতে গেল।

আলম বলল, বাচ্চা-কাচ্চা খুব ভাল জিনিস, কিন্তু এদের জন্যে যে খাওয়া রেখে উঠে যেতে হয়, গল্পের আসর ফেলে কোলে নিয়ে ঘুরতে হয়, এটা খারাপ। বাচ্চাকাচ্চা কেমন হওয়া উচিত জানেন অরুণা? বাচ্চাকাচ্চা হওয়া উচিত চাবি সিস্টেমে। চাবি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন–আবার যখন আদর করতে ইচ্ছা করল চাবি দিয়ে জাগিয়ে খানিকক্ষণ আদর করলেন।

অরুণা খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে সে বিষম খেল! নায়লা ভাবল–এই মেয়েটা নিতান্ত বেহায়ার মত হাসছি। বোঝাই যাচ্ছে বিয়ের জন্যে অস্থির হয়ে আছে। লজ্জা-শরম বিসর্জন দিয়েছে।

 

খাওয়া-দাওয়া শেষে অরুণা সত্যি সত্যি গান গাইতে বসল। নায়লা মেয়েটার নির্লজ্জতায় হতভম্ভ হয়ে গেল।

আপনারা কিন্তু আমার গান শুনে মুখ টিপে হাসতে পারবেন না। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলতেও পারবেন না–ভাল হয়েছে।

নায়লা মনে মনে বলল–ঢং করিস না বারি কোথাকার! গান গাইতে বসেছিস, গেয়ে ফেল। গানের শেষে তুই একটা খ্যামটা নাচও দেখাবি। আলম তোর খ্যামটা নাচও পছন্দ করবে।

অরুণা বলল, আমি কি একটা রবীন্দ্র সংগীত করব?

আলম বলল–আপনার যা ইচ্ছা করুন। শুধু দয়া করে খেয়াল ধরবেন না।

অরুণা আবারও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। নায়লার ইচ্ছা করছে বলে–তুই যে ভাবে হাসছিস তোর দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।

অরুণা গান শুরু করেছে–

আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে
কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে।

অরুণার গলা মিষ্টি। গাইছেও খুব সুন্দর করে। নায়লা বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে। অরুণা এতো সুন্দর গাইতে পারে নায়লার জানা ছিল না।

গান শেষ করে অরুণা হালকা গলায় বলল, বাবার খুব শখ ছিল আমি গান শিখি। মাস্টার টাস্টার রেখে হুলস্থূল করেছিলেন। বাবা মারা গেলেন, গনিও মারা গেল। দশ বছর পর প্রথম একটা পুরো গান গাইলাম।

আলম বলল, অসাধারণ আপনার গলা। নায়লা, অসাধারণ না?

নায়লা বলল, হ্যাঁ।

আলম বলল, আমরা কি আরেকটা শুনতে পাব?

অরুণা বলল, হ্যাঁ পাবেন। এবং এইটাই শেষ। আর কোন গানই আমি পুরো জানি। অরুণা আবার শুরু করল —

মধুর, তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হল শেষ
ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ-আবেশ।

নায়লা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল–তার কত শখ ছিল গান শেখার। স্কুলের আপা বলেছিলেন–নায়লা, তুই মন দিয়ে গান শেখ, তুই নাম করবি–তোর গলা ভাল। সেই ভাল গলা দিয়ে তার লাভটা কি হল? বাবাকে সে গানের স্যার রাখার কথা বলতেই তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন—স্যার রেখে গান শিখতে হয় না-কি? রেডিও শুনে শুনে শিখবি। যে শিখতে পারে সে রেডিও শুনে শুনে শিখতে পারে। যে পারে না তাকে মাস্টার গুলে খাওয়ালেও পারে না।

আলম বলল, নায়লা, তুমি গান জান না? নায়লা কঠিন গলায় বলল, না।

গুন গুন করে গাওয়ার মত খানিকটা নিশ্চয়ই জান। ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াও না? না-কি ঘুম পাড়াবার দায়িত্ব বাচ্চার বাবার?

নায়লা বলল, আমি রান্না আর ঘর ঝাট দেয়া ছাড়া আর কিছু জানি না। ঘর কি করে কাঁট দেয়া হয় দেখতে চাইলে ব্র আঁট দিয়ে দেখাতে পারি।

আচ্ছা বেশ, আমরা তাই দেখব। নিয়ে আস ঝাড়ু?

অরুণা আবার হেসে উঠল খিলখিল করে। নায়লার এমন রাগ লাগছে।

বাবু খুব কাঁদছে। ফেঁপাতে ফেঁপাতে ডাকছে, মাম্মাট মাম্মাট।

 

আলম বলল, নায়লা, তুমি বাবুর কাছে যাও তো। সে তোমার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। আমরা এখন বিদেয় হব। তোমার বান্ধবীকে নিয়ে চিন্তা করবে না। আমি তাকে ঠিকমত নামিয়ে দেব। আরেকটা কথা, তোমার বান্ধবীর সামনেই বলছি–তোমার বান্ধবীকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। শ্রামার প্রসঙ্গে তোমার বান্ধবীর মনোভাবটা কি জানতে পারলে ভাল হত। তিনি কি বলবেন?

অরুণা মেঝের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

নায়লা মনে মনে বলল, বাদরি, তুই এত ঢং কোথেকে শিখেছিস? চিৎকার করে বলে ফেল–আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। এক্ষুণি চাই। এক্ষুণি চাই। সিনেমার নায়িকার মত তুই ঢং করছিস কেন রে ঢঙ্গি? এর মধ্যে ঢং করার কি আছে? কি কুৎসিত কথা সে অরুণাকে নিয়ে ভাবছে! অথচ অরুণা এত ভাল একটা মেয়ে। নায়লার কি হয়েছে? কেন সে এত খারাপ হয়ে গেছে?

 

নায়লা শোবার ঘরে বাবুকে দুধ খাওয়াচ্ছে। সারাদিন বাবু আজ মাকে কাছে পায়নি। সে দুহাতে শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমরা চলে গেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, যাবার আগে নায়লার কাছ থেকে বিদায় পর্যন্ত নেয়নি।

জামান ওদের আগিয়ে দিতে গেছে। নায়লা ফিরুর মাকে বলল বাতি নিভিয়ে মশারি খাঁটিয়ে দিতে। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে আসছে। সে বাবুকে নিয়ে শুয়ে থাকবে।

খাবার টেবিল নোংরা হয়ে আছে। টেবিল পরিষ্কার করতে হবে। তাকেই করতে হবে। ফিরুর মাকে দিয়ে হবে না। সে কাচের জিনিস ভাঙবে। ইচ্ছা করেই ভাঙবে।

ফিরুর মা বলল–আইট্যা বাসুন কি ধুমু আম্মা?

না। তুমি খেয়ে নাও।

ভাইজানরে কি পেলািও গরম কইরা দিমু? ভাইজানের খাওয়া হয় নাই। খাওনের মাঝখানে উইঠা গেল।

ভাইজানের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তুমি তোমার চিন্তা কর।

 

জামান ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আসতে গিয়েছে এগারোটা দশে। এখন বাজে সাড়ে বারোটা। এর মধ্যে ফিরুর মা দুবার নিচে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে। কেউ নেই। মানুষটা গেল কোথায়?

নায়লার ভয় ভয় লাগছে। ঢাকা বিচিত্র শহর। কত কি হতে পারে। তার ইচ্ছা করছে নিজেই একবার খোঁজ নিয়ে আসে। যদিও তা সে করল না। ঘর পরিষ্কার করল। খালা-বাসন ধুয়ে শুকনো ন্যাকড়া দিয়ে মুছল। সন্ধ্যাবেলাতেই সে একবার গোসল করেছে। আবার পানি গরম করে গোসল করল। গোসলের পারে মাথায় ভার ভার ভাবটা দূর হয়েছে। ভাল লাগছে। ফিরুর মা চা বানিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড ক্লান্তির পর গরম চ-টা খেতে ভাল লাগছে।

ভাত খাওয়া হয়েছে ফিরুর মা?

জ্বে না।

খাওনি কেন?

ভাইজান ফিরতাছে না। ডরে আম্মা শইল কাঁপতাছে।

শরীর কাঁপাকাপির কিছু না। তোমার ভাইজান কচি খোকা না। যাও খেতে বোস।

নিচে দারোয়ানরে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইজানরে দেখছেন? হে আমার সাথে মশকারা করে। আমারে কয় কি–আমি রাইতকানা, রাইতে চউক্ষে দেখি না।

চুপ কর তো! কথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছি।

অল্পে অস্থির হওয়া তো আম্মা ভাল না।

তোমাকে আমি আর রাখব না ফিরুর মা। তুমি দেশে চলে যাবে।

আইচ্ছা।

জামান ফিরেছে। এত দেরি করে যে ফিরেছে তার জন্যে কোন দ্বিধা কোন সংকোচ নেই। আশ্চর্য মানুষ তো! নায়লা দেখছে মানুষটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে হাত-পা ধুচ্ছে। প্যান্ট বদলে লুঙ্গি পরে বলল, চল শুয়ে পড়ি।

নায়লা বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

অলিম ধরে নিয়ে গেল। অরুণাকে নামিয়ে ওর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঘুরলাম।

রাত দুপুরে ঘুরলে?

আলমকে তো তুমি জান না। ও কিছু বললে না করা মুশকিল। ও আচ্ছা, তোমার ছবিগুলি সে দিয়ে দিয়েছে।

আমার কি ছবি?

ওর সঙ্গে সাভার গিয়েছিলে–ছবি তুলেছ, সেইসব ছবি। সুন্দর ছবি এসেছে। টেবিলের উপর রেখেছি। দেখো।

নায়লা শক্ত হয়ে গেল। জামান কি ব্যাপারটায় কিছু মনে করেছে? ছবি দেখে অন্য কিছু ভেবে বসেনি তো?

নায়লা!

হুঁ।

খুব ঠাণ্ডা লেছে। শোবার আগে চা খাওয়াবে?

নায়লা নিঃশব্দে চা বানাতে উঠে গেল। চা বানিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে, জামন ছবি দেখছে। খুব মনযোগের সঙ্গেই দেখছে।

নায়লা বলল, প্রথম যেদিন উনার কাছে গেলাম উনি বললেন, সাভার থেকে কি যেন কিনবেন। জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন। তুমি রাগ করনি তো?

না। রাগ করব কেন? ও যাদের পছন্দ করে তাদের খুক আপন করে দেখে। তোমাকে খুব পছুন্দ করে।

আমাকে পছন্দ করে না। তোমাকে করে! আমি হচ্ছি ফাউ। দেখি ছবিগুলি।

ছবি সুন্দর এসেছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে আলমের পাশে নায়লা দাড়িয়ে। নায়ল আলমের দিকে তাকিয়ে হাসছে, আর আলম বা হাতে নায়লাকে জড়িয়ে ধরে আছে। নায়লার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল। কখন এই ছবি তোলা হল? আলম কখন তাকে জড়িয়ে ধরেছিল? মনে নেই তো। কি সুন্দর হয়েছে ছবিটা! কি সুন্দর। নায়লা চোখ ফেরাতে পারছে না।

নায়লা।

হুঁ।

আলম তোমাকে কাল হোটেলে যেতে বলেছে।

নায়লা তীক্ষ্ম গলায় বলল, আমাকে তার হোটেলে যেতে বলবে কেন? এটা কেমন কথা–শুনতেও তো খারাপ লাগছে!

তার বিয়ের তারিখ-টারিখ ঠিক করবে। বিয়ের জিনিসপত্র কিনবে। ও সামনের সপ্তাহেই বিয়ে করতে চায়।

সামনের সপ্তাহেই করুক বা আগামীকালই করুক, তিনি তো আমাকে বলতে পারেন না। হোটেলে যেতে ব্যাচেলার একজন মানুষ, একা থাকেন …

তুমি হঠাৎ রেগে গেলে কেন? ওর মনে কিছু নেই বলেই ও এতো সহজে বলতে পারল। এটা তুমি কেন বুঝতে পারছ না? তাছাড়া এমন তো না যে তুমি তার হোটেলে যাওনি!

আমি গোপনে গিয়ে উপস্থিত হইনি। কাছে গিয়েছি।

সেও তোমাকে গোপনে যেতে বলছে না। জরুরী কাজেই ডেকেছে।

নায়লা কঠিন গলায় বলল, আমাকে তোমার বন্ধু হোটেলে ডেকে পাঠাচ্ছেন–আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি–দরজা বন্ধ করে জরুরী আলোচনা করছি–এটা তুমি সহজভাবে নেবে?

হ্যাঁ নেব। আলমকে আমি চিনি।

একজন স্বামীই কখনো তার স্ত্রীকে চিনতে পারে না আর তুমি ছেলেবেলার বন্ধুকে চিনে ফেলবে। তুমি কতটুকু জান কে?

অনেকখানিই জানি।

না, তুমি অনেকখানি জান না। তুমি জান না যে ঐ লোক আমাকে প্রেম নিবেদন করেছে।

জামান সহজভাবে বলল, তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছে?

সরাসরি বলেনি, ইশারায় বলেছে।

তুমি যাকে ইশারা ভাবছ তা হয়ত ইশারা নয়।

তোমার ধারণা আমি এতই কম বুদ্ধির একটা মেয়ে যে কেউ আমার প্রেমে পড়তে পারে না?

তুমি শুধু শুধু রাগছ। আলম তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছে। ঠাট্টাটাই সত্য ভেবে তুমি কষ্ট পাচ্ছ।

ঠাট্টা হলে তো ভালই। চল ঘুমুতে যাই।

 

দুজন দুপাশে আর বাবু মাঝখানে শুয়ে আছে। একটা জানালা মনে হচ্ছে খোলা। বাতাস আসছে। নায়লার উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা করছে না। সে জেগে আছে। তবে পড়ে আছে মরার মত। তাকে দেখলে যে কেউ ভাববে সে ঘুমুচ্ছে।

বাবু ঘুমের মধ্যেই বলল, মাম্মাটের কাছে যাব। আমি মাম্মাটের কাছে যাব।

জামান ছেলের গায়ে হাত রেখে তাকে আদর করছে। বেচারা আজ মার আদর তেমন পায়নি। ঘুমের মধ্যেও সেই না পাওয়ার অস্থিরতা চলে আসছে। জামান বলল, নায়লা, ঘুমিয়ে পড়েছ?

না।

আমার অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছে, তোমাকে বলা দরকার।

ঝামেলার কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না। অন্য কিছু বলার থাকলে বল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জামান বলল, তুমি খুব অস্থিরতার মধ্যে আছি। তোমার কি হয়েছে?

আমার কিছু হয়নি। জানালাটা বন্ধ করে দেবে? ঠাণ্ডা বাতাস আসছে।

জামান উঠে জানালা বন্ধ করল। নায়লা বলল, ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়াও জামান পানি এনে দিল। নায়লা পানি খেল না। এক চুমুক দিয়েই গ্লাস ফিরিয়ে দিল। তার আসলেই কেমন জানি অস্থির লাগছে। জানালা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘরটাও যেন অনেকখানি গরম হয়ে পড়েছে। নায়লা গা থেকে লেপ সরিয়ে দিল। এখন তার ইচ্ছা করছে–দরজা খুলে ছাদে গিয়ে বসে থাকতে।

জামান বলল, তোমার কি খারাপ লাগছে?

হ্যাঁ।

কেন বল তো?

বুঝতে পারছি না। বাতিটা জ্বালাও।

জামান বাতি জ্বালাল। নায়লা বলল, তোমার বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা আমার উচিত হয়নি। খুব ভুল হয়েছে। আসলে ব্যাপারটা কি হয়েছে তোমাকে বলি…

আমাকে কিছু বলার নেই। তুমি ওর সঙ্গে ছবি তুলে তাতে কি হয়েছে?

অনেক কিছুই হয়েছে। না শুনলে তুমি বুঝবে না। উনি সাভার যাবেন, আমাকেও নিয়ে যাবেন। আমি যেতে চাইনি, উনি এমন জোর করলেন যে আমি না বলতে পারলাম না…

তুমি কেন কেউ পারবে না।

আমি তো আগে কখনো স্মৃতিসৌধে যাইনি–এত ভাল লাগল! ছবি তুলতে ইচ্ছা করল। উনাকে বলতেই উনি ক্যামেরা নিয়ে এলেন। এক সময় তার গাড়ির ড্রাইভারকে বললেন আমাদের দুজনের ছবি তুলে দিতে। বলেই তিনি আমার পাশে পঁড়ালেন। কখন যে তিনি তাঁর হাত আমার কাধে রেখেছেন বুঝতেই পারিনি। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে খারাপ লেগেছিল বলে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারিনি …

তোমার খারাপ লাগার কিছু নেই।

তুমি নিজে ভাল মানুষ বলে পৃথিবীটা তোমার মত করে দেখ। পৃথিবীর সব পুরুষই তুমি তোমার মত মনে কর। পৃথিবীর পুরুষগুলি তোমার যত না। পুরুষ মানুষদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। তোমার বন্ধু সম্পর্কেও খারাপ। ঐ দিন আমার সঙ্গে ছবি তোলার পর থেকে তার ভাবভঙ্গি পাল্টে গেল…

কি যে তুমি বল!

আমি ঠিকই বলি। আমি ভুল বলি না। যেহেতু ঐ দিন ছবি তোলার সময় আমি আপত্তি করিনি কাজেই সে প্রশ্রয় পেয়ে গেল। প্রশ্রয় পেল বলেই এই ধরনের অস্বাভাবিক কথা সে বলতে পারল।

জামান মৃদু স্বরে বলল, আলম হল পাগল টাইপের। ও কি মনে করে কি বলেছে কে জানে। ওর কথায় অস্থির হয়ো না।

আমি অস্থির হয়ে আছি তোমাকে কে বলল? অস্থির হবার মত কি ঘটেছে? কিছুই ঘষ্টেনি। ফালতু ধরনের একটা ছেলে যদি আমাকে কিছু বলে বসে তাতে কি যায় আসে। আমি তো ফালতু মেয়ে না।

চট করে কাউকে ফালতু বলা ঠিক না।

যে ফালতু তাকে ফালতুই বলতে হয়। তোমার প্রাণের বন্ধুর স্বভাবটা কেমন তুমি জানতে চাও?

ওর স্বভাব কেমন আমি জানি নায়লা।

না, তুমি জান না। একজন পুরুষ অন্য একজন পুরুষের আসল স্বভাব কখনো ধরতে পারে না। একজন মেয়েই শুধু পারে। আমি বলি তোমার বন্ধুর স্বভাব কেমন। তার হল মেয়ে-ঘেঁসা স্বভাব। মেয়ে দেখামাত্রই তার মনে ছোক ছোক ভাব হয়। সে এমন একটা ভাল করে যেন প্রেমে পড়ে গেছে। মেয়েরা তার এই ভঙ্গিতে প্রতারিত হয়, ধরা দেয়।

তুমি কি প্রতারিত হয়েছ?

নায়লা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আমি প্রতারিত হব কেন?

এম্নি বললাম।

না, তুমি এম্নি কলনি। তোমার মনে অন্য কিছু আছে। তুমি কি ভাব আমাকে?

জামান হকচকিয়ে গেল। নায়লা হঠাৎ এমন উত্তেজিত হয়ে গেল কেন?

তোমার কি ধারণা তোমার বন্ধুর প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি?

এইসব কথা কেন আসছে?

কারণ আছে বলেই আসিছে। কারণ না থাকলে আসত না। তোমাকে আমি চিনি–তুমি ভালমানুষের মত ভঙ্গি করে থাক। ভঙ্গি পর্যন্তই। তোমার ভেতরটা অন্য পুরুষদের মতই অন্ধকার। তুমি কি ভেবেছ, তোমার মত ভালমানুষ পুরুষ আগে দেখিনি? দেখেছি। এরকম একজনের সঙ্গে আমার বিয়েও ঠিক হয়েছিল। তখন ধারণা হয়েছিল এই মানুষটার মত মানুষ পৃথিবীতে আর জন্মায়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এই মানুষ আমাকে নিয়ে কি করল জানতে চাও? জানতে চাইলে বলতে পারি। শুনলে তুমি কলার খোসার মত আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলবে।

নায়লা হাউ মাউ করে কাঁদছে। কান্নার শব্দে বাবু উঠে পড়েছে। সেও কাঁদতে শুরু করেছে। জামান তাকিয়ে আছে হতভম্ব হয়ে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ